‘ঈমান’ (إ يمَان) শব্দটি বাবে أفعال এর ক্রিয়ামূল أمن ধাতু হতে উদ্ভূত। أمن অর্থ শান্তি বা নিরাপত্তা। আরবী ভাষায় ‘ঈমান’ শব্দটি বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । ক্ষেত্র বিশেষে তা বিশ্বাস করা, স্বীকার করা, ভরসা করা এবং নিরাপত্তা প্রদান করা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অপর বর্ননা মতে, ঈমানের আভিধানিক অর্থ ‘অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা’ ।
ইমানের শর’ঈ অর্থঃ
ইমানের শর’ঈ অর্থ আলিমগণ বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। কোনোকোনো আলিম এর মতে হযরত মুহম্মদ (সা) আল্লাহ্র নিকট হতে যে কিতাব প্রাপ্ত হয়েছেন তাতে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করাই ঈমান। আলিমগণের এক শ্রেণীর মতে, অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে তা মুখে উচ্চারণ করাও ঈমানের অঙ্গীভূত । মতান্তরে অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকারোক্তি এবং আমলে সালিহ্ অর্থাৎ সৎকর্ম এ তিনের সমন্বিত নাম ঈমান।
আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, রছূল, জান্নাত,জাহান্নাম তাকদীরের ভাল মন্দ ও কিয়ামত এগুলি মুখে স্বীকার, ক্বলব অর্থাৎ অন্তর বা মন দিয়ে বিশ্বাস করার নাম হলো ঈমান। আর বিশ্বাসকারীকে বলা হয় মোমেন। হাদীছে জিবরীলে ঈমানের বিষয় অর্থাৎ আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, রছূল আখেরাত এবং তকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস করাকে ঈমান বলা হয়েছে।
আল্লাহ তাআ’লা কোরআন মাজীদে এরশাদ করেছেন-
(২৮৫) রছূল ঈমান এনেছে তার প্রতি তাঁর রবের নিকট থেকে নাযিল হয়েছে এবং মুমিনগনও। প্রত্যেকে বিশ্বাস করে আল্লাহর উপর, তাঁর ফিরিশতাগণের উপর, তাঁর নাযিলকৃত কিতাব সমূহের উপর, তাঁর রছূলগণের উপর, আর আমরা তাঁর রছূলগণের মধ্যে পার্থক্য করিনা।
— ছূরা বাকারাহ
(১৭৭) পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ ফিরানো শুধু নেক কাজ নয় বরং নেক কাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর, কিয়ামত দিনের উপর, ফিরিশতাগণের উপর, কিতাব সমূহের উপর, সকল নবী রছূলগণের উপর। আর আল্লাহর মুহব্বতে তার মাল সম্পদ ব্যয় করবে তাঁর আত্মীয় স্বজন, এতিম, মিছকীন, মুছাফির, ভিক্ষুক ও কৃতদাসদের (মুক্ত করার) জন্যে। আর যারা নামাজ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে আর কারো সঙ্গে কোন ওয়াদা-অঙ্গীকার করলে তা পূরণ করে, বিপদ আপদ ও যুদ্ধের ময়দানে তারা ধৈর্য্যধারণ করে, তারাই হলো সত্যবাদী আর তারাই হলো মুত্তাকী পরহেজগার।
— ছূরা বাকারাহ
(১৩৬) আর যে অবিশ্বাস করবে আল্লাহকে, তাঁর ফিরিশতাগণকে, তাঁর কিতাব সকলকে, তাঁর রছূলগণকে এবং আখিরাতকে, নিশ্চয় সে সঠিক পথ হতে বহু দূরে সরে গেছে।
— ছূরা নেছা
আল্লামা ইদ্রিস কান্দলবী (রঃ) এর মতে,
হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর প্রতি আস্থাশীল হয়ে আল্লাহ্র পক্ষ হতে তাঁর আনীত আদর্শকে মনেপ্রাণে মেনে নেওয়া এবং তৎপ্রতি মৌখিক স্বীকারোক্তি প্রদান করাকে শরীয়াতের পরিভাষায় ঈমান বলা হয় ।
ইমাম গাযালী (র) বলেন,
নবী করীম (সা) কর্তৃক আনীত সকল বিষয়সহ তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাকে ঈমান বলে।
ঈমানের সংজ্ঞায় ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আশ্-শাইবানী (রঃ) বলেন,
নবী করিম (সঃ) কর্তৃক আনীত সকল বিষয়সহ তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, সাথে সাথে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সমস্ত কিছু থেকে নিজের সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করা ।
কাযী সানাউল্লাহ্ পানিপথী (রঃ) বলেন
নবী করিম (সঃ) আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন সবকিছুই মেনে নেওয়া, অনুরাগ ও ভক্তির সাথে বিশ্বাস করা এবং মৌখিকভাবে তা স্বীকার করা । তবে বিশেষ অবস্থায় মৌখিক স্বীকার অপরিহার্য নয় ।
আল্লামা মাহ্মুদ আলুসী আল বাগদাদী (রহঃ) তৎপ্রণীত বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘রুহুল মা’আনীতে উল্লেখ করেছেন যে
নবী করিম (সঃ) কর্তৃক আনীত বিষয় যা জানা গিয়েছে তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, যা বিস্তারিতভাবে এবং যা সংক্ষিপ্তভাবে জানা গিয়েছে তাঁর প্রতি বিস্তারিতভাবে ও সংক্ষিপ্তভাবে বিশ্বাস স্থাপন করাকে শরীয়াতের পরিভাষায় ঈমান বলা হয় ।
উপরে ঈমানের যে বিভিন্ন সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়েছে এগুলোর লক্ষ্য একই । এ সকল সংজ্ঞা সমন্বিত করা হলে তাঁর মর্ম দাঁড়ায় নিম্নরূপঃ
নবী করিম (সঃ) কর্তৃক আনীত সকল বিষয় যা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত, বিস্তারিত হোক বা সংক্ষিপ্ত, নবী করিম (সঃ) এর প্রতি আস্থাশীল হয়ে মনেপ্রাণে এগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সাথে সাথে আল্লাহ্ ছাড়া সমস্ত কিছু থেকে নিজের সম্পর্কহীনতার কথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করাকে শরীয়াতের পরিভাষায় ঈমান বলা হয় ।
উল্লেখ্য যে, ঈমানের প্রাথমিক স্তর হল অন্তরের বিশ্বাস এবং মৌখিক স্বীকৃতি এবং ঈমানের উচ্চতর স্তর হল হৃদয়ের প্রশান্তি তথা শরী’আতের দাবিসমূহ স্বভাবসুলভ দাবিতে পরিণত হওয়া অর্থাৎ স্বভাবসুলভ কাজসমূহ মানুষ যেভাবে স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে করে থাকে আর তা সম্পাদন না হওয়া পর্যন্ত অস্বস্তিবোধ করে অনুরূপ শরী’আতের আমলসমূহ যথাযথভাবে আদায় না করা পর্যন্ত যদি উদ্বেগ ও অস্বস্তিবোধ হয় তবে এ স্তরে উপনীত হওয়া বোঝা যাবে । নিম্নোক্ত হাদিসে এ কথাই বলা হয়েছে । রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
তোমাদের কেউ মু’মিনে কামিল হতে পারবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাঁর ইচ্ছা আমার আনীত আদর্শের অনুগত হয়।