কবিতা
খোঁপা খুলে দাও : শামশাম তাজিল
আরাধনা : মেহেদী হাসান
আকাশে বাতাসে এখন : আনোয়ার কামাল
স্বপ্ন-বিলাস : নাঈমুল আলম মিশু
কপোতাক্ষ শুকিয়ে যায়, মফস্বল মরে যায় : সোহাগ আলী
তুমি ছাড়া মৃত্যুর পথে হাঁটা : সোহেল রানা
যাত্রী : তন্ময় বিশ্বাস
বৃক্ষের জবানবন্দি : মোঃ আব্দুল কাইয়্যূম বিপুল
গল্প
চল ঈশ্বরকে দেখে আসি
আব্দুর রহমান
ফাহাদ ফাহমি
রঙহীন রঙিন স্বপ্ন
শাব্দিক যাতনা
হারুন পাশা
আংটি
মুহম্মদ মাহমুদুর রহমান
ভুলুমিঞা
সামিন রহমান
শ্যাম কনিকা দিঘী
হেমন্ত ইকবাল ধ্রুব
অণুগল্প
সন্ধ্যার কাছাকাছি : সীমান্ত সওদাগর
পাথরের মতো মানুষ : গণেশ গাওয়াল
ত্রয়ী : সুব্রত দত্ত
কুকস এন্ড বুলস স্টোরি : তন্ময় ম্যাথিয়াস গমেজ
স্মৃতিকথা
পুণ্যসঙ্গ : কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত : আবু দায়েন
যে খাবার কেউ যাচে না : বিপ্লব কুমার হালদার
ভোরের শিশির : স্মৃতিকথা
অস্ট্রেলিয়ায় এখনো 'গো ব্যাক টু হয়ার ইউ কাম ফ্রম' বিতর্ক? : আশরাফুল আলম
একজন প্রিয় স্যার : আসাদ
ভোরের শিশিরে কবিতা
খোঁপা খুলে দাও
শামশাম তাজিল
অলক অরণ্যে খুঁজি অলৌকিক সোনা
নিঃশব্দ নির্ঝরে নিবিড় ডুবিয়ে পা হোক মিথ্যের জালবোনা
সাংসারিক আগুনে পুঁড়ে গেল হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো
জ্বেলেছি অগ্নি-আমিও পুড়েছি ঘর অন্য কারো
ভালোবেসে মাটি হবো; পোড়ামাটি ছাই
বিবিক্ত মনে--দ্বিধান্বিত পদসঞ্চালনে তবু প্রেম আছে
--তোমাকেই চাই
অনুধ্যান স্বপ্নে ফলে না শ্রমের সম্মান
কাঁকন মাটি হলে ফলাতাম সোনামুখী ধান
ধানের শীষে নাচে পুরনো বোধ-স্বপ্ন, বঙ্কিম তাকায় নারী
তিনবেলা আহার্য-জল গ্রহণ করি; তবু আটাশের অনাহারী
তোমাকে পেলে শরীরে খুঁজে নেবো মাটি-সোনা-জল
তোমার দৃষ্টি রাজহাস, পায়ে চলা পথে জ্বলুক
শিশির টলমল।
আরাধনা
মেহেদী হাসান
চুম্বনে চুম্বনে রক্ত-লাল বেল রং শরীর, আর নয়--
এবার হালকা-নীল মেঘের মত জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়।
মৃদু জলে ভরা সমুদ্র চোখ দুটো বিছিয়ে রেখো,
সেখানেই ঘুমোবো দুজন জড়াজড়ি করে।
কাশফুলের মত তোমার নরম চুলে
আঙ্গুল চালাতে চালাতে-জিজ্ঞেস করবো:
তুমি আমার ঈশ্বর হবে?
ছি ছি ছি--
না না না না--
তুমিই আমার শরীরী ঈশ্বর,
তোমাকে গড়েছি আমার একান্ত ঈশ্বর।
মানুষ কি পারে তৈরি করা ঈশ্বর ছাড়া বাঁচতে?
কাঁচা আলোর নদী ছেড়ে, কে ডুবে মরে
সাত স্তর অন্ধকারের ওপারে!
বিছানা ছেড়ে কেন যাবো এতো দূরে-সেই সপ্তম আসমানে!
তোমার অভ্যন্তরে তো কয়েক মুহূর্তের উষ্ণ প্রাসাদ,
আর তাহার মাঝে জমাট শীতলতা করি অনুভব।
তুমি নিথর থাকবে শুয়ে:
তোমার প্রতি অঙ্গে শিহরণ হয়ে ফুটবে আমার আরাধনা;
তোমার নাভীমূল থেকে আপনি গজিয়ে উঠবে পূজোর রঙ্গিন ফুল।
শীৎকারে-চিৎকারে তোমার নরম ছোট হাত
মাথায় বুলিয়ে-ছড়িয়ে দেবে মুঠো মুঠো চূর্ণ আশীর্বাদ।
ভক্তিতে উঠলে উপচে নগ্ন দেহ পেয়ালা,
কিছুটা ঝাঁকুনি ছিলকে ফেলে আবার নিথর হয়ো।
অবয়বহীন কি ভালোবাসা যায়--
কীভাবে বাসা যায় ভালো!
ভয়ই বা কি-- তবে আর সমীহই বা কেন?
পূর্ণিমার রাতের আঁধারে পাশের জানালাটি যাবে খুলে,
জ্যোৎস্নার সাথে গলে মিশে পড়বো ছড়িয়ে,
তোমার শরীরের সমস্ত আনাচে কানাচে-
আলোর ধর্ম অমান্য করে এগিয়ে যাবো বাহারি গলি পথধরে।
চাঁদটাও ক্লান্ত এতক্ষণে,
আমিই শুধু অবিরাম স্পষ্ট আরাধনায়।
আকাশে বাতাসে এখন
আনোয়ার কামাল
প্রতিদিন বাসের চাকা পিষে ফেলছে মানুষ
কালো পিচঢালা পথ উষ্ণ রক্তে লাল টকটকে হয়ে যাচ্ছে
খাদ্যে বিষ! ফরমালিনে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে
বাতাসে কালো ধোঁয়া, সিসের প্রলেপ লেপ্টে আছে
দেহতে বসতি গেড়েছে ক্ষয় রোগ।
ঢাকার ফল মাছ না এখন হোটেলের ভাতে
মাছের বদলে বরফে ফরমালিন ফুটপাতে
আমরা তা দেদারসে শরবত বানিয়ে আর
দামি রেস্তোরায় ফালুদা বানিয়ে খাচ্ছি।
আকাশে এখন ঈগল নখর মেলে
ভেসে বেড়াচ্ছে, কখন যেন থাবা দেয়
হৃদয়ের টুকরো নাড়ি ছেড়া সোনার ধনকে
গ্রাস করে। সুন্দরের বিশাল বনরাজি নিভৃতে কাঁদে
সমুদ্রের গর্জন আরো বেড়ে যায়
প্রতিবাদী হয়ে ওঠে মৎসকুল।
কি সুন্দর অন্ধকার আমাদের সুনীল স্বপ্নকে
আলো থেকে কালো অমানিশায় ছেয়ে দেয়
জীবনের অনেক চাওয়া পাওয়া রুদ্ধ হয়ে যায়।
তবে কী আমরা অমানুষ হয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন?
তারপরেও কিছু মানুষ প্রতিবাদ করে গর্জে ওঠে
চেতনায় শাণিত হয় আরো কিছু মানুষ
মানুষে মানুষ একাকার হয়, কণ্ঠ কণ্ঠে মিলে যায়
সুন্দরী, ধুন্দল, কেওড়া, গড়ান, গোলপাতা
ঝাঁ ঝাঁ করে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে।
স্বপ্ন-বিলাস
নাঈমুল আলম মিশু
হৃদয় থেকে উপচে পড়া
কিছু স্বপ্নরা--
আজ ঠিকানা খুঁজে বেড়ায়।
হয়তো তোমাদের ব্যস্ততায়;
হয়তো নীরবতার গভীরে;
নয়তো চায়ে চুমুক দেয়া ঠোঁটের কোণে।
কিছু মৃত স্বপ্ন জেগে ওঠে
সুখের প্লাবন আনবে বলে।
তবু তারা ফিরে যায়
তোমাদের মহাশ্মশানে;
যেখানে তোমরা বেঁচে আছ
জীবন্ত লাশ হয়ে।
কিছু স্বপ্নরা নীড় খুঁজে ফিরে
হারিয়ে যাওয়া পাহাড়ী সুরে;
গেরুয়া মাটিতে মিশে থাকা--
কিছু জীবাশ্মের মাঝে।
এক চিলতে রোদ হয়ে
কিছু স্বপ্ন সাজিয়ে রাখে--
গোধূলীর আকাশটাকে।
কিছু স্বপ্ন বেঁচে থাকে হৃদয়ে
তোমাদের ব্যস্ততায়
নাগরিক কোলাহল হয়ে।
কপোতাক্ষ শুকিয়ে যায়, মফস্বল মরে যায়
সোহাগ আলী
কপোতাক্ষ মিশে যায় মাটিতে প্রতিবেশি কোনো এক রাষ্ট্রের স্বার্থপরতায়-
অথবা জ্ঞাতি কোনো এক নদী ভাগীরথীর স্বার্থে, যে বয়ে ভারত মহাসাগরে ।
আমরা, শত চেষ্টায় সেখানে আজ জোয়ার-ভাটা
পাওয়া যায় হঠাৎ জলোচ্ছ্বাস যখন বন্যা নামে অকালে ।
কপোতাক্ষ, অনেক বয়স হল
তাই শুকিয়ে যায়, বুকে ধরে আছে অজস্র সবুজ শেওলা
আর নীল ফুলগুলো যারা দিয়ে যায় অবিরত বাতাসে দোলা ।
আর আমার এই মফস্বল আধা শহর,
হতে পারেনি শহর, ফিরে যেতে পারেনি কোথাও ফেলে আসা গ্রামে ।
তাই পড়ে রয় দ্বিধাহীনতায় ।
আজ এই পাড়া ভরে আছে নিঃশব্দতায় ।
অনেক বয়স হল, জীবিকার উৎসগুলো আস্তে আস্তে শুকিয়ে আসে ।
পাড়াগুলো তাই নীরবতায় ছেয়ে আছে, শব্দগুলো ছড়িয়ে গেছে,
দেশে-বিদেশে, আনাচে-কানাচে কিন্তু পাড়া হতে অনেক দূরে ।
নিজেকে এখন কপোতাক্ষ মনে হয়, মনে হয় এই পাড়ার প্রতীকরূপী একজন,
পারেনি নিজেকে নিজ স্থানে মিলাতে, পারেনি পর স্থানে টিকিয়ে রাখতে ।
আমাকে টেনে আনে ভবিষ্যত নিরাপত্তার স্বপ্ন,
এই চির কোলাহলের শহরে, বাড়িয়ে আরও কিছু শব্দ যতটুকু কমে যায় মফস্বলে ।
জানি না কপোতাক্ষ বেঁচে কিবা হত, হয়তো কিছুই না অথবা অনেক কিছু
ফেলে আসা ছন্দময় সময় তো ফিরে পেতাম ।
যেখানে জেলেদের আনাগোনা
জোয়ারের জল, জল টলমল, সৃষ্টি সুখের অসংখ্য গান ।
তুমি ছাড়া মৃত্যুর পথে হাটা'
সোহেল রানা
তোমাকে বলি আমাকে থামাও
ঘুমের ঘরে আমি হাটি
করুণ ভয়ের দীর্ঘশ্বাসে ছুটি
আমি জাগি, বাস্তবে আমি
মৃদু কিছুটা ঘামি।
তুমি আমাকে ফেরাও প্রেয়সী
শরৎ সন্ধ্যায় বিধ্বস্ত মনে
তুমি দেখ দুয়ারে দাঁড়িয়ে
মৃত্যুর পথে আমি হাঁটি
তুমি নেই সঙ্গী।
প্রেমের কঠিন বজ্রপাতে
ধারালো ছুরির আঘাতে
শূন্যতার বেদনার্ত মেঘাচ্ছন্ন
আকাশ শিউরে উঠে
ভালবাসাহীন আমার কান্নায়।
মৃত্যুর অপেক্ষায় অলস আধার
ঢেকে দেয় মুক্তির আলো।
নীল বেদনার উল্লাস জাগে
দগ্ধ বালির দ্বীপে,
সেখানে আমি আঁকি
চলে যাওয়া প্রেমের ছবি
ফেলি দুঃখের করুণ চিহ্ন
লিখি প্রেমহীন আমার গল্প
হাঁটি,
তুমি ছাড়া মৃত্যুর পথে!
যাত্রী
তন্ময় বিশ্বাস
কত রাত খুঁজেছি তোমায় তারাদরে পথে
দূর তারাদের প্রান্ত সীমায় ভেসে যায়,
প্রিয়তমা মনোরমা স্মৃতি
চাঁদ, তারা, ফুলে স্মৃতি রোমন্থন,
মনে নেই।
ফুল বনে কে বসে নেই?
পাহাড়ি ঝর্ণা পাথর তো কথা বলে কত
সে কথা শোনার মন নেই,
কোথা গলে বসন্ত সেই ...?
চেনা অচেনার ভীড়ে
খুঁজে বেড়ায়।
তুমি রাত্রী, সাজাবো তোমায়;
সে জানে না এসেছিলো খুঁজতে আমায়
রাত্রী তুমি,
চাঁদ লীলাময়, আমি পেতেছি ফাঁদ
পেতেছি দু ঠোঁট
মেশার নেশায়, ভেঙে গেলে ঘুম
ভেঙে গেলে বাধ চুমুতে চুমুক
কে আগলায়?
সে এসেছিল খুঁজতে আমায়
কাল সারা রাত আকাশরে মাঝে,
চাঁদ জানে সব কি হয়ে গলেো
বিচ্ছেদের হোমানলে বিশুদ্ধ,
হোমানলের পরশমণিতে পরিশুদ্ধ।
বৃক্ষের জবানবন্দি
মোঃ আব্দুল কাইয়্যূম বিপুল
ভূবন নামাঙ্কিত চিত্রে-স্থির এক ‘ব’বৃক্ষ-
বাংলা নামে বহু সাহিত্য কর্ম-নিষ্কর্মের জাগরণ,
বৃক্ষরূপে কালের আদালতে দিচ্ছে সাক্ষ্য
ধরেছি কলম, লিখব গোড়াপত্তন
ঘাটব ইতিহাস, খুলব মুখোশ-প্রকাশ্য-
লিখব না নিজ, করব বৃক্ষের উচ্চারণ।
বেড়েছে বৃক্ষ নীরবে; হয়ে সাক্ষী গোপাল
বিয়াল্লিশে দিল পা, অবগত সবাই তা-
জানল না কেউ, মুক্তির মাঝে সৃষ্টি হল নব কঙ্কাল
বলতে নাই দ্বিধা, বৃক্ষের চূড়ায় বসেছে, শাখামৃগের মিতা।
বহু ত্যাগের মাঝে কা-র প্রত্যাবর্তন-
স্নেহ-মমতাবিহীন বেড়ে চলা একাকী
তবুও সুখ-মুক্ত প্রসারণ; হ্যাঁ
আজ অবধি শুধু তারই গড়ন।
বহু স্বপ্নের প্রতিফলন শাখা-প্রশাখায় তার
বেড়েছে বয়স, বেড়েছে পাতার-আকার
প্রতিটি পাতা যেন, এক-একটি রূপকথা-
আফসোস, বোঝে না যে কেউ তার মর্মব্যথা।
জোটে না তার শিশুকালের স্বর্ণালী সে ভোর
পায় না সে যৌবনের গানে নৃত্যের কোলাহল-
ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন সে, হয় না আনন্দে বিভোর-
বৃদ্ধ সে, ব্যথায় কাতর, অন্তিমের ঢাক-ঢোল।
প্রকৃতির দোলে বৃক্ষটা খেলে;
কিন্তু এ প্রকৃতি আজ বিষণ্ণ;
কৃত্রিমতার আভাষ যে কা-েই মেলে;
সত্য পরিচার্যক না পেলে ধ্বংস আসন্ন।
পরিচার্যকরূপী বন্ধু এসেছে, গিয়েছেও বটে;
প্রথমে ভেঙেছে শাখা-প্রশাখা; অতঃপর-
মুছে ফেলেছে পাতার ইতিহাস, মিষ্ট বুলির ডাঁটে-
সাজিয়েছে রঙের মেলা; বৃক্ষের কাণ্ডের উপর
হরেক রকমের বেলুন; ঘাড়ে বন্দুক- নরাধমদের হাটে।
হাঁক দেয়; দশটি গুলি- দুই টাকা, দুই টাকা
উদ্দেশ্য কারও যেন হয় ঝুলি ফাঁকা।
সুযোগ হয় কিছু নতুন সুখ দেখার-
উৎসুক জনতার ভিড়; কার হাত কত ঠিক।
ছয়টি বেলুনে, চারটে বিঁধে বৃক্ষে-
পালাক্রমে চলে তা, নাই কোন রক্ষে-
বন্ধুর নাই কোনো চিন্তার ভাঁজ; ভাবলেশহীন ব্যবসা-
পরিবারতন্ত্রের অল্প পুঁজি, অধিক লাভ-
বৃক্ষ পঁচুক, পঁচে যাক।
ধিক্কার তোরে, যে কা- তোর অন্নদাতা-
তারেই দিলি পাশবিক যাঁতা।
ও-দিকে বৃক্ষ থেকে রস বেরোয়,
ঘৃণার সংকেত; বুঝেও না বোঝার ভাণ-
শুধু বন্ধু নয়, মূর্খ জনতাও চোখ ফিরিয়ে রয়-
যার ছায়া ব্যতিত বাঁচবে না কেউ-
নাই তারই প্রতি টান; বিশিষ্ট অম্লান।
বৃক্ষ আজ খেলনা; খেলা শেষে
নিজ নিজ জ্বালাময় বিষে বন্ধুগণ
হারিয়ে গেছে চিরতরে অবশেষে।
মনে করে নিকো খেলনাটার অবদান
নেকড়ের মত ভেঙেছে অংশবিশেষ
তার দগ্ধময় দাগ; আজও আছে মিশে।
নতুন বন্ধুর আগমন; বৃক্ষের প্রসন্ন মন
আশায় বুকটা বাঁধে; নিরাশা কিছুক্ষণ
সেও খেলবে তাকে নিয়ে আমরণ
শুধু খান খান হওয়ার অপেক্ষণ।
প্রশ্ন ছুঁড়ে বৃক্ষ- কেন এই অবমাননা
খেলা আনন্দের তা কি জান না
খেলনা ভাঙলে অংশিত কিছু
মমতার বাহুডোরে সারিও নিও পিছু।
এমন বন্ধু কি আছে?
অদূর ভবিষ্যতে পাব কি তার দেখা-
আসবে কি এমন সুহৃদ-
জুড়াবে কি? প্রাণভরে বৃক্ষের ছায়া-
পড়বে কি? পাতায় খোঁচিত সে বেদনাবিধুর ইতিহাস।
প্রশ্ন রেখে যায় বৃক্ষ-
বুদ্ধিজীবীদের মাথা থাকে নত,
জানা আছে উত্তর; মিছেমিছি ভাবান্তর-
সৎসাহস নেই বলবার;
বৃক্ষ আর কিছু বলে না; শুধু হাসে
নির্মম সে হাসি ঘৃণার আবেশে।
হেসে যাবে বৃক্ষ এভাবে আজীবন
ব্যথা উপচে পড়ে; যন্ত্রণার দরুণ-
হবে না যে বৃক্ষের সহজ মরণ।
ভোরের শিশিরে গল্প
চল ঈশ্বরকে দেখে আসি
আব্দুর রহমান
একটা রোঁয়া উঠা ভগ্ন নেড়ি কুকুর বেশ খানিক ক্ষণ ঘুর ঘুর করছে। দক্ষিণ দিকটাতে কিছু পঁচা ভাত ও কয়েক টুকরো হাড় পড়ে আছে। এর মধ্যে পলিথিনের কানি ধরে সেটাকে বেশ খানেক ছড়িয়ে দিয়েছে। এখন সেগুলোকেই একত্র করতে ঘুর ঘুর করছে। ওপাশে দুজন একের পর এক, টেনে চলছে আবর্জনা। একজন শিশু, নিজের চেয়ে তার বস্তার দৈর্ঘ্য একটু বেশি তাই অগত্যা রেকসিনের বস্তাটাকে ঝুলিয়ে নয়, এক প্রকার হেঁচড়ে টেনে চলছে ছেলেটা। হার্ডবোর্ড, কাগজ, পাস্টিকের ভাঙা-চোরা অংশ, পলিথিন, দুই-এক টুকরো লোহা, যা পাচ্ছে সব একের পর এক ঝোলার মধ্যে ভরছে। খালি গা, পরনে হাফ প্যান্ট, কিন্তু তার ঠিক নিচের দিকটাতে ছিঁড়ে গেছে। দু-পা দু-দিকে দিয়ে দেওয়ার মত অবস্থা আর নেই; একাকার হয়ে গেছে। যখন হেট হয়ে ময়লা ঘাটছে তখন পেছন থেকে মনে হচ্ছে, পেছনের দিকটাতে পরা আর না পরা সমান হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তার নাক থেকে দু-এক ফোঁটা বাজারের ঘিয়ের মত হলুদ বর্ণের পোটা গড়িয়ে পড়ছে। কখনো তা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে জিবটা সর্বোচ্চ বের করে টেনে নিচ্ছে, আবার কখনো বিপুল শক্তি ব্যয় করে নাক টেনে চলছে জন্ম জন্মের সঞ্চিত অমূল্য নাসিকা রস। আর দু-হাতে প্রাণপণে সরাচ্ছে ডাস্টবিনের জঞ্জাল। সি আর দত্ত রোডে; কাঁটাবন মসজিদ ও হাতির পুল বাজারের মাঝখানে এই ডাস্টবিন।
আর একজনও ঠিক তাই, ওর বয়স সতেরো থেকে চল্লিশের মধ্যে যে যেমন ধরে নিতে পারে। এক মাথা সরু চুল তার একগাল সরু দাঁড়ির সাথে মিলেই তার বয়সের এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কিছুটা অপ্রকৃতস্থ মনে হচ্ছে। পরনে তার পুরানো ছেঁড়া জিন্সের প্যান্ট; এক পাশে একটু বেশি গোটানো। গায়ে একটা ময়লা তেল-চিটচিটে ফুল-শার্ট, বুকের উপরের প্রথম তিনটা বোতাম খোলা। কোন দিকে নজর নেই তার; সেও আপন মনে সরাচ্ছে জঞ্জাল। এরই মধ্যে বস্তাটা বেশ ভরে উঠেছে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে, পাশের ছেলেটার দিকে বার দুই তাকিয়ে, মুখ-খিঁচিয়ে, বিচ্ছিরি রকমের গালি-গালাজ ছুড়ে দিলো লোকটা। কিন্তু ছোট এই ছেলেটার সুদ মুখের কাছে পরাজিত হয়ে বিবাদ ছাড়াই সরে পড়লো সে। রাস্তার ফুটপাতে গিয়ে বসেছে সে। কি যেন কি ভেবে সে একটু অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়লো। কোত্থেকে এক পুরানো ইনজেকশন বের করলো, সাথে সাথেই প্যান্টের পকেটগুলো হাতড়াতে শুরু করলো সে। যেন জীবনের অতি মূল্যবান কি একটা হারিয়ে গেছে তার! হঠাৎ চোখে-মুখে হাসি ফুটলো; হাতে একটা মৃত-সঞ্জীবনী বিশল্যাকরণীর ছোট কৌটা উঠে এসেছে। বেশি দিনের পুরানো নয়। তবু সামান্যই আছে তাতে। ইনজেকশন দিয়ে সেই সামান্য সঞ্জীবনীটুকু নেওয়ার চেষ্টা করছে সে। আস্তে আস্তে এখন হাত কাঁপা শুরু করেছে তার। সমস্ত শরীরের মাংস-পেশীগুলো টান দিয়ে বার দুই খিঁচিয়ে উঠলো শরীর। গায়ের রগগুলো শক্ত হয়ে এলো কিছুক্ষণের জন্য। ততক্ষণে ইনজেকশনে ভরা হয়ে গেছে শেষ সঞ্জীবনীটুকু। এর পর একজন অভিজ্ঞ গ্রামের পশু ডাক্তারের মত ঘ্যাচাং করে ফুঁড়ে দিলো হতের উপরে। যেন এক অজানা স্বস্তি এসে ভরেছে শরীরে। এখন সে রাণীক্ষেতে আক্রান্ত মুরগির মত ঝিমোতে শুরু করেছে। হয়ত এক সময় ঘুমিয়ে পড়বে সে দুরন্ত মরফিনের তেজে।
তখনো ডাস্টবিনের ময়লা কুড়িয়ে চলেছে ছেলেটি। হঠাৎ উল্লাসে চিল্লাত শুরু করলো সে; একটা ভাঙা মোবাইলের অংশ পেয়েছে। হয়ত এই অমূল্য সম্পদের জন্যই এতক্ষণ ছাই উড়িয়েছে সে। উল্লসিত মন নিয়ে বস্তাটা টানতে টানতে চলে গেল পশ্চিম দিকে। এখন ডাস্টবিনটা নীরব একাকী। নেড়ি কুকুরটাও তাকে ছেড়ে গেছে। হয়ত ক্ষুধার পরিতৃপ্তি হয়েছে তার।
হাতির পুল বাজার, ভূতের গলি, এলিফ্যান্ট রোড, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের এই বিশাল এলাকার ময়লা সব এখানেই ফেলা হয়। এ ডাস্টবিনের অপর পাশে সুরম্য সব প্রাসাদ, বড় বড় মার্কেট। মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় থেকে শুরু করে বিলাসবহুল জিনিস সব যেমন দোকানদাররা দিতে প্রস্তুত, এ অঞ্চলের সমস্ত বর্জ্য, ময়লা, আবর্জনাও এ তেমনই বুকে নিতে প্রস্তুত। মানুষের ঘরের জঞ্জাল প্রতিনিয়ত বে বহন করে চলেছে সে। কত হাতের স্পর্শ তার কাছে সঞ্চিত। কত গলিত-বস্তুর সঞ্চায়ক সে। নোংরা বলে মানুষের সর্বোচ্চ ঘৃণার বস্তু সে। কিন্তু এ কথা সত্য যে, সে যত নোংরা হবে এ প্রাণের শহর তত পরিষ্কার থাকবে।
এই ডাস্টবিনের পাশে একটু নিরিবিলি স্থান পেয়ে; কয়েকটা পরিবার তারই পাশে শান্তিতে ফুটপাতে বাস করতে শুরু করেছে। এদেরও মধ্যে আছে রিক্সাওয়ালা, শ্রমিক আর আছে একজন ভিুক। তার ডান পায়ে বিশাল গোদরোগ। ফুলে যেন কলা গাছ হয়ে আছে। সেটাকেই পুঁজি করে সে আজ ছয় বছর ধরে ভিক্ষা করে চলছে। এ বস্তিতে তারই ইনকাম সবচেয়ে বেশি। এই পুঁজির জের ধরেই সে দিনে প্রায় ২০০ থেকে ৬০০ এর কাছাকাছি টাকা ইনকাম করে। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই তার বয়স তবুও কিছুদিন আগে একটা নতুন বিয়ে করেছে সে। বেশ ভালই সুখে আছে এরা কজনা ।
ইতোমধ্যে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে, লোকালয় থেকে বেশ কিছু ভ্যান এর মধ্যে এখানে এনে ঢেলে রেখে গেছে। এখন বেশ কিছু লোক জুটেছে এখানে, একই খাবারের আশায়, যেমন একাধিক কুকুর এসে জুটে একটা কেউ কেউ, ঘেউ ঘেউ শুরু করে দেয় তেমনই কেইমেই শুরু করে দিয়েছে এরা। এভাবেই চার-পাঁচজন লোক ক্রমাগত ময়লা খুঁজে চলছে। এদের মধ্যে দুজন শিশু, একটা মহিলা ও সকালের সেই দাঁড়িওয়ালাও রয়েছে। ডাস্টবিনটা যেন বুকের সঞ্চিত-পদার্থগুলো এদের জন্য একের পর এক মেলে ধরছে।
ফাহাদ ফাহমি
রঙহীন রঙিন স্বপ্ন
অনবরত কেশেই যাচ্ছে ইসহাক আলী। বুঝলেন তো ভাই মানুষ জাতি বড় স্বার্থপর জাতি। কতো হাতজোড় কইরা কইলাম, দেননা ভাই দুইডা হাজার টেকা। গঞ্জে একটা ব্যবসা করমু, এক মাসের মধ্যে আপনের টেকা ফিরত দিমু। যেমনে পারি দিমু, দরকার হইলে নিজের রক্ত বেইচ্যা দিমু। গায়ের মেম্বাররে কইলাম, চেয়ারম্যানরে কইলাম, মোড়লরে কইলাম, টেকাওলা বাবুরে কইলাম। কেও দিল না, কেও না। ইসহাক আলীর সাথে আমার দেখা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে । জীর্ণ শীর্ণ মানুষ। রোদে পোড়া ক্লান্ত চেহারা, সেই ক্লান্ত চেহারায় বিষাদ যেন ঘিরে ধরেছে অক্টোপাসের মতো। বয়স চল্লিশের কোঠায় হবে। গায়ে ছেঁড়া ফতোয়া, লুঙ্গিতে যে কয়টা তালি দেওয়া আছে তা দেখা সম্ভব হল না আলো আধারির উদ্দম খেলার কারণে। চুলগুলো হয়তো বা কাটা হয়নি বছরখানেক হবে, চিরুনির আদরও হয়তো পরেনি দীর্ঘ দিন ধরে । চোখের কোনে ময়লা জমে আছে বিচ্ছিরি ভাবে। গা থেকে আসছে বিকট একটা গন্ধ। একটা পা না থাকার কারণে বাঁশের একটা লাঠিকে ভর করে দাড়িয়ে ছিল ইসহাক আলী। কিন্তু মায়াবী একটা হাসি তার সমস্ত বাহ্যিক খারাপ ভঙ্গিকে আড়াল করে ফেলেছে। ভাই পেরেম কইরা বিয়া করছিলাম ময়নার মায়রে। নদীর ঘাটে পানি নিবার আইত, নাইবার আইত। পরে সম্বন্ধ কইরা বিয়া কইরা ফেলাইলাম। নদীর পাড়ে আছিল আমাগো গেরাম, যাত্রাপুর নাম। তিন শতক জমির উপর একটা দোচালা ঘর, পাশে একটা ছনের রান্ধন ঘর। নদী থাইক্যা ফুরফুর কইরা বাতাস আইত। যাত্রাপুর হাটে আমার একটা চায়ের দোকান আছিল। দোকান থেক্ক্যা ফিরা দুয়ারে বইয়া সুখ দুঃখের কথা কইতাম ময়নার মার লগে। দিন আইনা দিন খাইতাম। কিন্তু আমরা অনেক সুহি আছিলাম। এক্সিডেন্টে একটা পা হারাইলাম। একটা কাজে শাহাবাগ এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে আসছি। কোন একটা কাজে ও আটকে গেছে। আরও ঘণ্টা দেড় দেরি হবে ওর আসতে। সময় কাটানোর জন্য প্রবেশ করলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। একটা বেনসন ধরিয়ে ধীর গতিতে হেঁটে চলছি। অন্ধকার এসে ঘিরে ধরেছে আরও আধঘণ্টা আগে । ল্যাম্প পোস্টের কৃত্রিম আলো ভালো লাগছিলনা। তাই আঁধারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। চাঁদটা পূর্ব আকাশে । অর্ধচন্দ্র। ভাই লাগবো নাকি-হঠাৎ করে দুটু ইটের উপর বসে থাকা একটা লোক বলে উঠলো। আমি উৎসুক হয়ে বললাম কি? লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ''ভাই দেড়শ টেকা। ভালা সুন্দর মাইয়্যা, ফিগারও ভালা। আফনের জন্য আরও বিশ টেকা কমাইতে পারমু। যদি লাগে কন, খালি আছে।'' আমি যাবনা শোনে ইসহাক আলীর মন খারাপ হয়েছে। মুখটা মলিন হয়ে উঠেছে। জানি না কেন যেন একটু কথা বলতে ইচ্ছে করলো ইসহাক আলীর সাথে। আমি আমার হাতের সিগারেটটা এগিয়ে দিলাম তাঁর দিকে। সাদরে গ্রহণ করলো ইসহাক আলী। “ভাই মনডা আমারও কান্দে, বড় কান্দে।কিন্তু এইযে পেটটা বানাইছে আল্লায়, এই পেট বড় হারামজাদা ভাই। ছিনাল পদ্মায় ভাইঙ্গা নিলো সব, ঘর বাড়ি, দোকান, সুখ ,ভালোবাসা সব। কেও আমারে টেকাডা দিলো না। ঢাকায় আইলাম, কাম কইরা খামু। পাই নাই। পুরা তিন ডা দিন না খাইয়া ছিলাম। থাকার জায়গা নাই। রাস্তায় রাস্তায় কুত্তার মতো ঘুরছি। ডাস্টবিন থেকা পচা খাবার খুইটা খুইটা খাইছি। আফনেরা তো প্রতিদিন কতো খাবার ফেইল্যা দেন। ঐ গুলান আমাগো দিলেও তো খাইবার পারি। কেও দেই নাই ভাই কেও না। এই সহোরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকার জায়গা কইরা দিলো আনিছের মায়। বড় ভালা মানুষ। রাস্তায় টানানু ব্যানার ছিইরা আইন্যা ডেরা তুইল্যা দিলো। ইটের উপর বসে পড়েছে ইসহাক আলী। চোখের নিচে জমে থাকা পানি হালকা আলোতে চিকচিক করছে । না জানি কতো কষ্ট ঘনীভূত হয়ে আছে ঐ লোনা পানিতে। হয়তোবা চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার, পারছে না। কতো দিন এইভাবে থাকন যায়। আল্লায় তো পাডা কাইরা নিলো । শরীরডাও ভালো যায়তাছেনা। কোন কাম করতে পারি না। একদিন আনিছের মায় এই কামে নামনের বুদ্ধি দিলো। কথাডা শুইনা মনে অইল বুড়িরে মাইরা ফ্যালাই। একদিকে ক্ষুধার জ্বালা অন্য দিকে, ময়না আমার না খাইয়্যা কাঠের মতন হইয়্যা যায়তাছে। এইযে এইহানে ডেরা তুলছি এর জন্য প্রতি মাসে মজিদ গুণ্ডারে পাঁচশ টেকা দিতে হয়। না দিলে থাকার জায়গা দিবো না। ভাই অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়। বউরে নামাইলাম এই কাজে। কিচ্ছু করার ছিল না ভাই সব পেটের দায়। আল্লায় কেনে আমারে মাইরা ফেলাইলো না। এই কাম কইরাও ভাই ভালভাবে চলবার পারি না। প্রতিদিন যে ইনকাম হয় তার মধ্যে থ্যাইকা একটা ভাগ পুলিশরে দিতে অয়, এক ভাগ মজিদ গুণ্ডারে দিতে অয়। সব দিয়্যা আমাগো দুই বেলার ভাত খাওনের টেকা থাকে কোন মতন। কেন জানি আজ আর কোন কিছুতেই কষ্ট লাগে না। ইসহাকের ধরা গলার কথা গুলো আমার কাছে যেন গল্প মনে হচ্ছিল । তার জন্য খুব একটা দুঃখ অনুভব করতে পারছিনা আমি। আমি কি আমার মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছি? আমাকে কি পশুত্ব কিনে নিয়েছে? তবে কি আজ আর আমি মানুষ না, পশু। আমার কি কিছুই করার নাই। যান্ত্রিক সভ্যতার ভালো মুখোশ ধারী মানুষ বা রোবট আমি। ভাই পদ্মার বুকে চর জাগতাছে । মাঝে একবার গেরামে গেছিলাম। মেম্বার সাহেব কইলো আমাগো জমি ফেরত দিবো, পাঁচ হাজার টেকা লাগবো। সব মিথ্যা, আমার জমি আমারে ফেরত দিবার লাইগা আবার টেকা লাগবো ক্যান। ওরা খাইব, আমার গরিব মানুষ দিতে অইব। আমাগো তো চুইস্যা খাইতেই ওরা মজা পায় । দুই এক টেকা কইর্যা জমাইতাছি। চইল্যা যামু। একটা ছোট ঘর তুলমু। পাশের গ্রামের বাজারে একটা চায়ের দোকান দিমু। আর এই কাম করতে হইব না ময়নার মারে। আমার ফোন বেজে উঠেছে। আমার বন্ধুর ফোন। চলে এসেছে ও। আর এখানে থাকার কারণ নেই। আমাকে যেতে হবে, অনেক কাজ পড়ে আছে । ইসহাক নিচু হয়ে হয়তো চোখের পানি ফেলছে। ফেলুক না কিছুক্ষণ। কষ্ট হালকা হবে। ওকে বিরক্ত করা উচিৎ হবে না। তাই কিছু না বলেই উঠে দাঁড়ালাম আমি। আসার সময় একবার পিছে ফিরে তাকালাম আমি। ইসহাক আলী সে ভাবেই বসে আছে। হয়তো স্বপ্ন দেখছে ও। রঙিন স্বপ্ন। পদ্মার বুকে জায়গা ফিরে পেয়েছে , ঘর বেঁধেছে সেখানে। বাতাসে কাশফুল দুলছে। পড়ন্ত বিকেলে আকাশের নিচে দুয়ারে খেজুর পাতার পাটিতে বসে আছে সে, দোকান থেকে ফিরে দখিনা বাতাসে ক্লান্ত দেহকে আরাম দিচ্ছে। ময়নার মা ময়নাকে রাজপুরীর গল্প শোনাচ্ছে তার পাশে বসে। আর কোন কষ্ট নাই , আর কোন আঁধার রাতে তাকে বসে থাকতে হবে না সহোরাওয়ার্দী উদ্যানে মানুষ রূপী পশুদের অপেক্ষায়। কোন হিংস্র থাবা পরবে না আর তার বুকে.........।
২৩/১১/২০১৩
শাব্দিক যাতনা
হারুন পাশা
এই কথা কম ক! বন্ধু উন্মেষ, ফোন দিছে।
হ্যালো
হ্যাঁ মামা ক্যামন আছো?
আর বলো না মামা, আমার ভালোত্ব চাঙ্গে উঠেছে।
ক্যান, ছ্যাঁকাট্যাকা খাইছো নাকি?
না মামা ত্যামন কিছু না, ড্যানিয়েল জোন্সের বই পড়তাছি।
এতো ভালো কথা, কিন্তু...
ভালো কথাই তো, কি রসময় ভাষা, পড়তে গেলে বারবার ঘুম পায়, আর অভিধানকে বানাইছি কোলবালিশ।
ভালো তো , বেশি ঘুমাবা শাহরুখ খানের ফিগার পাবা।
হ মামা, টিটকারি না মাইরা তোমার কথা বলো?
আমিও ওর একটা সম্পূরক বই পড়তাছি ।
ক্যামন লাগছে?
ভাষা রসময় নয়, একটু ঝাঁঝালো আর এলোমেলো।
এই মিঠু ‘প্রতিভাত’ শব্দের অর্থটা দেখতো। মামা বলো-
মামা আমিও তো জানি না, এই বেটা কী আসমান থাইক্কা শব্দটা আনছে নাকি?
মামা একটু লাইনে থাকো।
২.
মিঠু মিনিংটা পাইলি?
রিফি পানির বোতলডা দে-তো, একটু গলাডা বিজায়া লই, আর কলাডা দে খায়া আঙ্গুলের বল বৃদ্ধি করি।
পাইলি?
এক ঘন্টা ধইরা দ্যাখতাছি-খুঁজতাছি, কলা খাওয়া,পানি খাওয়ার মানে বোঝ না।
তারন, কী করছ?
বিসিএস এর লাইগ্যা পড়তাছি।
মামা বিসিএস ফ্যানের লগে ঝুলতাছে, খালি গলা বাড়ায়া দিবা আর...
ওই এ্যাতো কথা কছ ক্যান?
কমু না। আমরা মরি মিনিং খোঁজা লইয়া, আর তুমি মিয়া...
আচ্ছা, আয় আমরা কয়জনে মিইল্যা খুঁজি।
তুই একটু দেখতে থাক আমি বাথরুম থাইক্কা আয়ি।
এই রিফি ওরে পানি দিছস ক্যান? তুই তো জানছ পড়বো বালডা, পানি খাইবো আর ...
কিরে পাইলি?
খুঁজতাছি।
এই দীপরে একটা ফোন দ্যাম নাকি? যদি...
দীপ কী অবস্থা?
ভালো, তোমার কী খবর?
ভাবতাছি, জোন্সকে নিয়া একটা গল্প লিখব- লেখা যায়?
হোয়াই নট! আর শোন, নায়িকার প্রয়োজন হলে আমায় স্মরণে রেখো।
হায় আল্লাহ, বুইড়া ব্যাটার নায়িকা হবে পিয়ংকা চোপরা।
আরে বাবা বয়স কোন ব্যাপার না।
আচ্ছা, গল্পের নাম কী দেওয়া যায়।
নাম,একটু সময় নিয়ে- নাম দিতে পারো- ‘জোন্স তোমার ভাষা বোঝার আশা দিলাম জলাঞ্জলি’।
নামটা তো বেশ! কিন্তু ‘জোন্সীয় প্রহসন’ দিলে ক্যামন হয়।
প্রহসন না ট্র্যাজেডি?
প্রহসনে দেখানো হয় একটা সঙ্কটের বিদ্রুপ, আর এখানে ‘কাঠিন্য+কিছুটা উদ্ভট শব্দ+যন্ত্রণাকাতর স্টুডেন্টস’; প্রহসন হোক আর ট্র্যাজেডি হোক সেটা হবে নি, কিন্তু কীভাবে শুরু করা যায়- তা বলবে?
গল্প লিখবা তুমি, খ্যাতিও তোমার আর সবি বলে দিব আমি? নায়িকা হতে চাওয়াও দেখি পেইন।
রাগ করছো ক্যান?
শোন ওই সব ফালতু চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়া ভালো কইরা পড় নইলে জোন্সের সাথে তোমার ‘ব্রেকআপ’ ঘটবে।
কাজের কথায় আসো। ‘প্রতিভাত’ শব্দের মিনিং জানো?
না, পেলে জানাচ্ছি।
ওকে, বিদায়।
৩.
-কি মিঠু পাইলি?
পাইবো কী, একটা পাতা উল্টায় আর ঐখানে যায়।
দাঁড়া মাইকেলকে (মাইকেল জ্যাকসনের গান বেশি শুনে বলে তার নাম মাইকেল) একটা ফোন দেই, জ্যাকসনের গান শুনতে শুনতে যদি এ্যামন শব্দের সন্ধান পায়া থাকে।
মাইকেল কী অবস্থা, ক্যামন আচছ?
ভিঘি ভিঘি রাতওমে...
কি মামা, তুমি শোন পরানের বন্ধু মাইকেলের গান আর মুখে আদনান সামি, ব্যাপার কী?
মামা আমি তো খেয়ালি প্রকৃতির, তাই! কোন কথা থাকলে বলতে পারো।
না মামা তোমার লগে আপাতত কোন কথা নাই, তুমি মনোযোগ দিয়া জ্যাকসনকে শোন আর মুখে গাও ভিগি ভিগি... ক্যামন।
এই মিঠু পাইলি?
না রে খালি ওইহানো যান লাগে বারবার, তোর বন্ধু বান্ধবীরা পাইলো মিনিংটা?
ওরা তো আরো বেশি ভোদাই, তবুও আরেকটারে জ্বালাইÑ
হেই ফিরনা কী অবস্থা?
বয়ফ্রেন্ডের লগে কথা কওয়া বাদ দিয়া তর লগে কথা কইতাছি, কামের কথা না কইয়া জিগাছ কী অবস্থা?
তর কান না পঁইচা গেছিলো।
জোড়াতালি দিয়া চালাইতাছি।
তুই বাংলায় পড়ছ না ।
হ! তয় কি অইছে?
তাইলে বয়ফ্রেন্ড বলস ক্যান, বলবি ‘নাগর’।
‘নাগর’ আবার কী জিনিস?
বোকা মাইয়া নাগর হইলো ‘অবৈধ প্রণয়ী’।
আমি তো ভাবছি ‘ডাকঘর’ নাটকের ঐ নাগরা জুতা পরা লোকটার কথা কইতাছস, যে সকলে ঘুমায়ে থাকলে ঝরনার পানিতে পা ভিজিয়ে আস্তে আস্তে দূরে চলে যায়, ঘাড়ের লাঠিতে পুটুলি বাইন্ধা।
তরে যে কারণে ফোন দিছি, তা হল-প্রতিভাতের মিনিং জানস।
এ্যামন শব্দ তো আমার চৌদ্দ পুরুষও হুনে নাই।
তাই!
হ, লেখক ব্যাটা এ্যামন দাঁত ভাঙ্গা শব্দ পাইছে কই? এই লেখকটা বুঝি চান্দিয়া, নইলে..
চান্দিয়া না ন্যাড়া, গতকাল দ্যাখলাম শাহবাগ মোড় দিয়া যাইবার সময় একটা পক্ষি দিছে আইগ্যা, আর রোদে তা ডিম ভাজার মত দেখালে, এক টোকাই দৌঁড়ায়ে আইসা ঝাপ মাইরা তা লইয়া মুখে পুইড়া ফালায়।
তাই নাকি!
তাই, মিনিংটা পেলে জানাস।
৪.
মিঠু পাইলি?
না রে, কী বালের শব্দ ব্যবহার করছে Ñ খুঁজতে গিয়া মাথাটাই গ্যাছে।
এই বাংলা একাডেমীর পরিচালককে এ্যাকটা ফোন লাগাতো ব্যাটা কী অভিধান বাইর করছে শব্দ, তার মিনিং পাওয়া যায় না।
হ মামা ফোন লাগাও ব্যাটারে একটা ফাঁপর দেই, ক্যাম্পাসে তো র্যাগ-ফাঁপর বন্ধ অনেক দিন থাইক্যা এর রিহার্সেল করতে পাইতাছি না, ফোন লাগাও...
আরে বুধ মামা কই থাইক্যা আইলা?
আইল্যাম মামা তোমাগোর দ্যাখবার।
ভালো করছো বিপদের সময় আইছো, এই না বন্ধুত্ব।
মামা সামনে তো পরীক্ষাÑ নোটপাতি আছে কিছু?
আমরা মিনিং খোঁজার জ্বালায় মরি, আর তুমি আইছো নোটের লাইগ্যা, মানে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ দিতে।
শোন মামা, আমার ফোনে কিছু নতুন কালেকশন আছেÑ দ্যাখো সব জ্বালা যাইবগা।
হ তোমার এইত্যা দেহি আর বাথরুমে গিয়া..., তুমি যাওতো!
আচ্ছা যাইতাছি নোটপাতি হাতে পাইলে কিছু দিয়ো।
৫.
এই রাইকে একটা ফোন দিলে বোধহয় মিনিংটা পাওয়া যেতে পারে, কারণ ছেলেটা তো একটু লেখালেখি করে হয়তো যন্ত্রণার লাঘব হতে পারে।
বন্ধু, ক্যামন আচছ?
‘ফাকিং গুড’ ।
অর্থ কী?
মানে ‘ফাটাফাটি’ তথা ‘বেশ ভালো’, তোর কথা বল।
আর বলিস না, একটা শব্দের মিনিং খুঁইজা পাইতাছি না।
শব্দটা কী?
‘প্রতিভাত’।
এই তুই কি জোন্সীয় বই পড়তাছস।
ক্যামনে বুঝলি?
আরে ঐসব শব্দ কী আর অন্য লেখকরা ব্যবহার করতে পারে, আমিও পড়েছি।
তাইলে তো অর্থটা পাবো বোধ হচ্ছে।
আরে পড়তে গিয়া তো এই শব্দটা অনেকবার পাইছি, কিন্তু মিনিং লইয়া তো মাথা ঘামাই নাই।
তাইলে বললি যে পড়ছস।
হ পড়ছি তো ক্যামনে জানছÑ ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের আশালতার মতো, সে ‘যতই জ্ঞানলাভের চেষ্টা করে, অক্ষরগুলো ততই তাহার দৃষ্টিপথের উপর দিয়া কালো পিপীলিকার মতো সার বাঁধিয়া চলিয়া যায়।’ আমার দশাও তাই, একটু লাইনে থাক বাঁশিটায় একটা টান দেই, যদি মাথায় চইলা আয়ে মিনিংটা।
(এদিকে পাকু এবং সাজি বাঁশি অথাৎ নেশা করার এক ধরনের উপাদান বানিয়ে বসে ছিলো)
এই পাকু বাঁশিটায় একটু আগুন ধরাতো।
খাড়াও বন্ধু ম্যাচটা বাইর করি।
তাড়াতাড়ি কর।
বালা কইরা মুখে ল আগুন লাগাইতাছি, হোন ধুয়া খায়ালাইস না।
আমারে এত বাচ্চা ভাবছ ক্যান, ছেলেটা ছোট বইল্যা ।
না তুই তো বিজ্ঞ জোন্স...
হইছে কম কইরা লেকচার পিটা।
পাকু তুই ‘প্রতিভাত’ শব্দের অর্থ জানছ।
জানি মানে এইডা তো ‘প্রতি’ উপসর্গ যোগে ঘটিত, যা কিনা বদ্ধরূপমূল।
ঠিক কইচছ, কিন্তু বদ্ধরূপমূল তো আলাদা কোন অর্থ দিতে পারে না, কিন্তু এই শব্দের একটা অলাদা অর্থ আছেÑ আমার সেই অর্থটা দরকার।
ও তাই তো, মামা দাও তো আরেকটা টান দেই।
সাজি তুমি কিছু জানো? (এক ব্যাচ সিনিয়র ও একটু শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে বলে সবাই একটু...)
রাই রিজলাটা একটু বানাও তো!
সিউর!
আসলে রাই, আমি ঐসব জোন্স- ফোন্সের বই এই জটিলতার কারণে পড়ি না; সাংবাদিকতা, পত্রিকা বের করাসহ দশ-বারোটা চিন্তায় আমার মাথা ভর্তি থাকে। ঐসব শব্দ লইয়া ভাববার সময় কই? তুমি যখন বলছ দেখি মাথায় আসে কিনা। এই পাকু রিজলাটা দাও!
রিজলা খাইবা আগেই?
ক্যান?
না বলছিলাম একটা চেইন আছে না, আগে সবজি (গাঁজা) খায়া পরে... বুঝই তো কত জটিল শব্দ, মাথা ভালোভাবে ঠিক না করলে মিনিংটা তো পাওয়া মুশকিল অইব।
একটু মজা করে ঠিকি বইলছো যে, পাকু বুদ্ধদেব বসু কী আমাদের মতো টাল ছিলো,সারাদিন খালি খাইতো আর খাইতো।
ক্যামনে কই ঐ সময় তো আমার বাপ-মায়েরও জন্ম অয় নাই, আমার জানার তো প্রশ্নই উঠতে পারে না।
বই টই পইড়া কিছু জানো নাই।
না, তোমার আবার বুদ্ধদেব হবার সাধ জাগলো নাকি?
আরে কোথায় বুদ্ধদেব আর কোথায় আমি, যাকে বলেÑ ‘কোথায় শেকসাদি আর কোথায় ছাগলের নেদী’।
পাকু, সাজি তোমাগোরে কইছি মিনিং খুঁজবার আর তোমরা চাও অইবার বুদ্বদেব। একটা সাধারণ মিনিং উদ্ধার যাদের দ্বারা অসম্ভব আর তারা নাকি অইবো... ।
সরি দোস, রাই দে কয়েকটা টান দেই।
পাকুর সাথে রাইও টানের পর টান দিয়েই যাচ্ছে, সুযোগ আসছে না বলে সাজি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে বুভুক্ষের ন্যায়।
৬.
হ্যালো কে, পাকু?
হ দোস ক।
তোদের একটা মিনিং দেখতে কইছিলাম, দেখচ্ছ না।
রাই কই?
অয় ত লোড অইয়া কবিতা লিখতে বইছে।
শক্তির মতো।
ঠিক ধরচ্ছ, শক্তিকে কয়েক বোতল মাল দিলে একটার পর একটা কবিতা যেমন প্যার প্যার প্যার কইরা বাইর করত, ওর দশাও তাই।
সাজির কি খবর?
ওয় তো দশ-বারোটা চিন্তা লইয়া বিরবির করতাছে।
তুই কি করলি মিনিংটা বাইর করতে পারলি না।
দোছ খাড়া এক প্যাক খায়া লই; আর পাইলে জানামু নে, বাই।
৭.
মোবাইলটা দে তো, দেহি কোন শুভাকাঙ্খী ফোন দিছে কি-না।
হেই দীপ মিনিংটা পাইছো।
আরে না, শোন আমারে গল্পের নায়িকা বানাইতাছো তো?
মরজ্বালা, ভালো থেকো, বাই।
আবার কিডা ফোন দিলোÑ
ফিরনা, কোন খবর থাকলে বল।
কি বলবো, তুই কইছিলি না আমার নাগর এক ব্যাচ সিনিয়র পাইলে পাইতেও পারে মিনিংটা।
হ ঠিকই তো কইছিলাম।
ঠিক না ছাই, এমন শব্দের কথা শুইনা ফিট অইয়া গ্যাছে, ও তো সারাদিন টাঙ্কি মাইরা বেরায়, তোর মতো তো বইয়ের পোকা না।
ঠিক আছে, তুই ওর জ্ঞান ফিরানোর ব্যবস্থা কর , আর ভালো থাকিস, ক্যামন।
মিঠু অভিধানডা দে তো।
ধর।
(বিরক্তির সাথে অনেকক্ষণ পাতা উল্টানোর পর) এই দ্যাখ ব্যাটা লিখছে কি, প্রতিভাত=‘প্রকাশ’, এ্যাতো সোজা শব্দ বাদ দা ব্যাটারা ... উন্মেষ শুনছো?
আংটি
মুহম্মদ মাহমুদুর রহমান
আর বেশিক্ষন শুয়ে থাকতে পারল না সাদেক আলি। বিছানা ছেড়ে উঠে ষাট পাওয়ারের বাতিটা অন করল সুইচ হাতড়ে।
একটা জর্দার কৌটায় জিনিসটা। সাদেক আলি কৌটার মুখ খুলল। আঙ্গুলে ঢুকিয়ে জিনিষটা বের করে আনল। একটা আংটি। সোনার আংটি। সাদেক আলি চোখের সামনে এনে আংটি টা ধরে। বয়স হয়েছে তার। তিন কুড়ি। চোখে ভাল দেখতে পায় না। খিদে এখন আছে আগের মতোই। চোখের খুব কাছে এনে সাদেক আলি বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানাভাবে দেখতে থাকে আংটি টা। দাম কত হবে এর ? এই আংটি বিক্রি করলে কয় দিন যাবে সাদেক আলির ?
আজ বিকেলে আংটি টা চুরি করেছে সাদেক আলি। ট্রেনের এক যাত্রির কাছ থেকে। বিমান বন্দর স্টেশনে যখন ট্রেন টা থামল তখন সাদেক আলির নজরে পড়ল যাত্রীটাকে। ট্র্বেনের প্রথম শ্রেণীতে বসে আছে। জানালা দিয়ে বাইরে একটা হাত বের করে রেখেছে। সেই হাতেই ছিল আংটি।
সাদেক আলি দেখল ট্রেন টা ছেড়ে দিয়েছে। কিছু টা গতিও নিয়েছে, কিন্তু প্লাটফরম থেকে এখনও বের হয় নি। এখনি সুযোগ।
সাদেক আলি প্লাটফরমের শেষ মাথায় দাড়িয়ে আছে। এখনি গ-নম্বর বগিটা এগিয়ে আসবে তার দিকে।
গ বগিটা এগিয়ে আসছে। এখনও আংটি পড়া যাত্রীটা আংটি সমেত হাত বের করে রেখেছে জানালার বাইরে। সাদেক আলি দেখতে পাচ্ছে যাত্রিটার চোখ বন্ধ। বাইরে বের করা একটা হাত দিয়ে ট্রেনের দেয়ালে আলতো ভাবে টোকা দিচ্ছে আর কি একটা গানের সুর ভাজছে।
সাদেক আলি হেঁচকা টান দিয়ে আংটিটা খুলে ফেলল যাত্রীটার আঙ্গুল থেকে। কাকপক্ষীও টের পেল না। কেবল সেই যাত্রীর গানের তাল গেল কেটে। কিন্তু ট্রেন এখন আর প্লাটফরমে নেই। সাদেক আলি রেল লাইনের পাশে তার বস্তিতে তার রুমে, তথা বাড়িতে ফিরে এল। এক রুমের বাড়ি।
আংটি টা হাতে নিয়ে নানাভাবে দেখতে লাগল সাদেক আলি। কখন আলোর কাছে নিয়ে দেখে, কখন চোখের সামনে নিয়ে দেখে।
বাচ্চুর সাথে কথা হয়েছে সাদেক আলির। বাচ্চু সোনার ব্যবসায়ী। এ পর্যন্ত সাদেক আলি বাচ্চুর কাছেই চুরি করা সোনাদানা বিক্রি করে এসেছে। চুরির মাল বলে সঠিক দামটা পায় না সাদেক আলি। অনেক কম দামে বাচ্চুর কাছে এইশব জিনিষ বরাবর বিক্রি করে আসছে সে। আগামিকাল সকালেই এই আংটিটা বাচ্চুর কাছে বিক্রি করে আসবে সাদেক আলি। তাতে করে কিছুদিন চলবে তার।
আংটি কোন হাতে পরে মানুষ ? ডানহাতে নাকি বামহাতে ? বোধহয় বামহাতে। কোন আঙ্গুলে ? যে লোক টার আংটি চুরি করেছিল সাদেক আলি সে কোন আঙ্গুলে পরেছিলো আংটি টা ? মনে নেই। সাদেক আলির মনে নেই।
সাদেক আলি প্রথমে ভাবল একটার পর একটা আঙ্গুলে আংটি পরা যাক। যে আঙ্গুলে সবচেয়ে বেশি মানাবে সেই আঙ্গুলেই থাকবে আংটি।
প্রথম বিবেচনায় বুড়ো আঙ্গুল ও কনিষ্ঠাকে বাদ দিতে হল। বুড়ো আঙ্গুলে আংটি ঢুকছে না, কনিষ্ঠায় আংটি থাকছে না। অনামিকায় বেশ দেখাচ্ছে আংটিটা। সাদেক আলি বারবার হাত উঠিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দেখতে লাগল আংটিটা। ভাগ্যিস তার বউ-বাচ্চা নেই। নইলে এই গভীর রাতে ষাট বছরের এই বুড়ো শিশুটির খেয়ালি আচরণে নির্ঘাত তারা আপত্তি জানাত।
মধ্যমাতেও চমৎকার মানিয়েছে আংটিটা। সাদেক আলির উচ্ছ্বাস যখন কিছু অর্থহীন শব্দের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল, তখনই তার মনে পড়ল যে ট্রেনের যাত্রী আংটি পড়েছিল তর্জনীতে। মনে হওয়ার সাথে সাথেই সাদেক আলি আবিষ্কার করল যে আংটির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হল তর্জনী।
বিপত্তিটা দেখা দিল তখনই। আংটি কিছুতেই মধ্যমা থেকে আর বের করা যাচ্ছে না। আঙ্গুলের গিটে এসে বারবার আটকে যাচ্ছে। কেমন করে পরাবার সময় পরানো গেল কে জানে। পরানো গেলে এখন আর বের করা যাচ্ছে না কেন ?
তেল খুঁজতে থাকে সাদেক আলি। নারকেল তেল তার বাসায় নেই। মাথায় চুল খুব কম। তাই নারকেল তেল ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। আর সাদেক আলি চুল চেহারা পোশাক সম্বন্ধে সচেতন-ও নয়। চুরি করতে চেহারা লাগে না।
কেরসিন তেল বাসায় নেই। তাছাড়া কেরসিন তেল বোধহয় স্বর্ণের উপর প্রয়োগ করা ঠিক নয়।সরিষার তেল পাওয়া গেল। মুহূর্তেই চোখদুটো চকচক করতে থাকে সাদেক আলির। ডান হাতের আঙ্গুল গুলো দিয়ে যতটুকু সম্ভব সরিষার তেল নিয়ে ডলতে থাকে বাম হাতের তর্জনীতে। এই তো, আরেকটু। পিচ্ছিল হয়ে এখুনি খুলে আসবে আংটিটা।
এতক্ষণ হয়ে গেল এখনও খুলছে না কেন আংটিটা ? সমস্যাটা কোথায় ? আর কিছুক্ষণ পরেই তো মোরগ ডাকবে। ভোর হবে। তুর্ণা-নিশীথা এসে বিমান বন্দর স্টেশনে থামবে। সেখানেও তো ওকে যেতে হবে দাও মারার জন্য। কিছুখন ঘুমিয়ে না নিলে মাথা তো কাজ করবে না। আংটি আপাতত তর্জনীতেই থাকুক। একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। ঘুম থেকে উঠে ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করা যাবে আংটির ব্যপারে।
না, ঘুমানো চলবে না। ঘুমের মধ্যে বেখেয়ালে আংটি তে যদি চাপ পড়ে ? আংটি যদি ভেঙ্গে যায় ? না, ঘুমানো চলবে না।
ভোরের আজান শোনা যাচ্ছে। হাতে আর বেশি সময় নেই। যে করেই হোক আংটি টা বের করতে হবে বাম হাতের তর্জনী থেকে।
সাদেক আলি সারা ঘরে পায়চারি করতে থাকে অস্থিরভাবে। ঘরের নানা জিনিষপত্র হাতাতে থাকে। কী খুঁজছে সে কে জানে।
হঠাৎ একশো পাওয়ারের বাল্বের মতো সাদেক আলির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তোশকের তলা থেকে পুরনো একটা ছুরি বের করে আনে। মাঝে মধ্যে চুরি করতে গেলে আত্মরক্ষায় এই ছুরি কাজে লাগে। আশ্চর্য ! এই সহজ সমাধানটার কথা এতক্ষণ তার মাথায় আসে নি ! এবার আংটির বাপের-ও সাধ্য নেই সাদেক আলির তর্জনী কামড়ে তাকে উপহাস করতে থাকবে।
- সাদেক ভাই যে ! তা কেমন শরীর ?
- ভাল। বাচ্চু, কাল তোমাকে যে আংটিটা দেব বলেছিলাম, এনেছি। এই দেখ।
- এতো অনেক দামি জিনিস। আপনাকে আমি আরো একশো বাড়িয়ে দেব।
- তা তোমার যদি ইচ্ছে হয় দেবে না কেন, অবশ্যই দেবে।
- এই নিন আপনার আংটির দাম। আংটিটা রেখে তাড়াতাড়ি বাসায় যান। সকাল হয়ে গেছে। লোকজন রাস্তায় বেড়িয়েছে। এ সময় চোরাই মাল নিয়ে আর আলোচনা নয়।
- যাই।
- সাদেক ভাই, আপনি, মানে আপনার-
- কী ?
- আপনার আঙ্গুলে এতো বড় ব্যান্ডেজ কেন?
ভুলুমিঞা
সামিন রহমান
তিতাসের তীর।
আকাশ কেমন যেন কালো কালো, মেঘাছন্ন।
একটি পোড়া শীতল পাটির উপর ভুলুমিঞা হাঁটু গেড়ে নিঃসঙ্গ বসে আছে। স্থির দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে দূরে, নদীর দিকে। ডান হাতের মুঠোয় ভরা তিনজোড়া করবী ফল, ডান হাতটি হালকা হালকা কাঁপছে। পেছনে আট-দশ হাত দূরে কতগুলো আধপোড়া ঘর হতাশ মুর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ জোরে বাতাস বইতে শুরু করলো। ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠল নদী। এই নদীকে নিয়ে নানান স্মৃতি রয়েছে ভুলুমিঞার। আজ হঠাৎ করেই একের পর এক মনে পড়ে যাচ্ছে তার।
এক বিকেলের কথা।
চারপাশ কেমন যেন লাল হয়ে এসেছে। একটুপরেই সমাপ্ত হবে দিনের খেলা। ভুলুমিঞা তখন নদীতে নৌকা বাইছে। নৌকায় গোটাকয়েক যাত্রী।লাল ভুলমিঞার সন্তান।সে ভুলুমিঞার কাছেই বসেছিল; আর একমনে নিজের বাবাকে দ্বার বাইতে দেখছিলো।
যাত্রীদের মধ্যে গ্রামের মাস্টার সাহেব ছিলেন। মাস্টার সাহেবের পাশে ডান হাত তুলে বসেছিলো তোতামিঞা। সে খুবই উত্তেজিত, মাস্টার সাহেবকে সে প্রশ্ন করতে ইচ্ছুক।এটা তোতামিঞার অন্যতম অসহনীয় স্বভাব।মাস্টার সাহেবকে দেখলেই তার ভেতর কি যেন হয়ে যায়। আপনা আপনি ডান হাতটা উপরে উঠে যায় আর মুখটা অনবরত বিরক্তিকর সব প্রশ্ন করতে চায়। মাস্টার সাহেব যথেষ্ট ধৈর্য ধরে সেসব প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রায় সময়ই, সেই ধৈর্য উনার পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হয় না।
মাস্টার সাহেব প্রশ্ন করলেন-
“কি বলতে চাও?”
“মাস্টারসাহেব, একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিলো।”
“সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ?”
“জ্বি মাস্টার সাহেব”
“তাহলে বলো।”
“আচ্ছা মাস্টার সাহেব, পানি খাইলে পিপাসা নিবারণ হয়, কিন্তু থুতু খাইলে হয় না কেন?”
“পানি আর থুতু কি এক জিনিস?”
“একই তো মনে হয়।”
“তোমার মনে হইলে তো হবে না।”
“কেন হবে না মাস্টার সাহেব?”
“হবে না বলছি এজন্যে হবে না।”
“মানেটা ঠিক বুঝলাম না মাস্টারসাহেব। একটু খুলে বলেন।”
“কি খুলে বলবো?কাপড় খুলে বলবো? বলদ। না বুঝলে চুপ থাকবি।”
“কেন চুপ থাকব মাস্টার সাহেব?আমি মুখ্য সুখ্য মানুষ। আপনি বিরাট জ্ঞানী হইছেন।বইপত্র সব খাইয়া ভূড়ি বানাইয়া বসে আছেন। আপনের কাছ থেকে কিছু জানতে হইলে তো শব্দ করতে হবে। চুপ থাকা যাবে না।”
মাস্টার সাহেব আরেকবার তোতামিঞার দিকে রূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে তারপর ঝিম ধরে বসে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর অধৈর্য হয়ে ভুলুমিঞারে ডাকলেন।
“ভুলুমিঞা”
“জ্বি মাস্টার সাহেব।”
“ভালো আছনি?”
“ভালো আছি মাস্টারসাহেব।আপনে কেমুন আছেন?”
“ভালো নাইরে ভাই। ছাগলের পাল্লায় পড়েছি।খালি ম্যা ম্যা করতেই আছে।তুমি ভাই একটা গান ধরো, অনেকদিন তোমার গান শুনিনা।”
যাত্রীদের অনেকেই সায় দিল।
“হ ভুলুমিঞা গান ধরো। তোমার গান বড়ই মিঠা।”
ভুলুমিঞা ঈষৎ হাসে। তারপর দ্বার বাইতে বাইতেই গান ধরে।
আমি খুঁজিতে যাই,খুঁজে না পাই
মনের মাঝে চাইরে
দেখি সবই ঢাকা,সবই ফাঁকা
তারে দেখি নাইরে।
আমি হারায় খুঁজি, খুঁজিই হারাই
তারেই বুঝি ভাইরে
দেখি সবই আছে, তবু পাছে
তারে দেখি নাইরে।
গান চলতে থাকে বেশ। কিন্ত বাকি সবকিছু কেমন স্থির হয়ে থাকে। প্রকতি হঠাৎ করেই অনুভব করে,গভীর কোন ঘোরের মধ্যে সে লুপ্ত। এবং এরকম ঘোরেই তাকে লুপ্ত থাকতে হবে। এটা যেন নিয়ম। আর এর মধ্যে সময় কিন্ত চামে অনেকটুকু সময় পেয়ে যায় সুন্দর কিছু দেখে নিতে, সুন্দর কিছু লিখে নিতে,সুন্দর কিছু বুঝে নিতে। সময় কিন্ত জানে এই অসম্ভব সুন্দর পৃথিবীতেও কখনো কখনো সুন্দর কিছু খুব দুর্লভ, খুব সুপ্ত।
পরিশেষে গান শেষ হলো।
ততক্ষণে নিভে গেছে আকাশের আলো।
পাড়ে এসে ভিড়েছে নৌকা।
যাত্রীরা একে একে সবাই নেমে গেছে।
বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন ভুলুমিঞা। তীরে দাঁড়িয়ে লাল বাবাকে দেখছে। হঠাৎ সে বাবাকে ডাকলো,
“বাপজান”
ভুলুমিঞা লালের কাছে এগিয়ে এলো। গামছা দিয়ে মুখ হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হইছেরে বাপ, ক্ষুধা লাগছে?”
“বাপজান আপনার কাছে একটা আবদার করুম।”
“কি আবদার?”
“আপনে রাগ করবেন নাতো?”
“না। তুই বল।”
“বাপজান আপনের গান আমার খুব ভালো লাগে। আপনে আমারে গান শিখায়বেন?”
নিজের ছ’ বছরের পুত্রের মুখে এ আবদার না জানি কেন, ভুলুমিঞার অন্তরে এক গভীর প্রশান্তির ভাব এনে দিলো। ভুলুমিঞা লালকে বুকে জড়িয়ে নিলো। নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেললো।
এর বেশ কয়েক বছর পর এই নদীরই একপাশে একাত্তরের এক বর্ষনমুখর দিনে ভুলুমিঞা তার যুদ্ধে যাওয়া ছেলের বেয়োনেট খোঁচানো রক্তাক্ত নগ্ন মৃতদেহ খুঁজে পায়। ভুলুমিঞার মনে হচ্ছিলো মৃতদেহটি জীবন্ত, কি যেন খুব কাঁদতে কাঁদতে বলছে। ভুলুমিঞা শোকে জড়ছিল। তাই সে কিছু বোঝে নি। বোঝবার চেষ্টাও করেনি।
এরপর আরও একটি স্মৃতি।
কি সুন্দর! কি সুন্দর!
ভুলুমিঞার দিনটি খুব মনে পড়ে। নদীর ওপাড়ে তার বিয়ে হচ্ছে। বউ দশ বছর বয়সী কুমারী কন্যা। নাম রাধা। বিয়ে শেষে ভুলুমিঞা রাধাকে নিয়ে এপাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
সুন্দরী নববধুকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাভ্রমণ যদিও মন্দ হবার কথা নয় তবু ভুলুমিঞার সময় কাটছিলো বেশ ভয়ে ভয়ে। নৌকায় উঠবার আগেই রাধা খুব ভালোমত শাসিয়ে দিয়েছে,” সাবধান, গায়ে হাত দেবেন না কিন্তু, সঙ্গে চাক্কু আনছি।"
ভুলুমিঞা ভগবানের নাম নিতে নিতে বৈঠা বাইছে। রাধা নৌকার ছইয়ের ভেতর ঘোমটা টেনে বউ সেজে বসে আছে। ভুলুমিঞা বার কয়েক দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করেছে। লাভ হয়নি। রাধা সাড়া দেয়নি। ঘোমটা পড়া সদ্য নববধূকে ভুলুমিঞা দূর থেকেই দেখতে লাগলো। যদিও ঘোমটার উপর রাধার মুখোবয়ব বেশ অস্পষ্ট তবু সেই মুখোবয়বই ভুলুমিঞার মনে গভীর শূন্যতার জন্ম দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। তবে সে সব ঠিক টিকছে না। লাশ হবার দুশ্চিন্তায় কর্পুরের মত হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
ভুলুমিঞা তখনো নৌকা বাইছে। বাড়ি পৌছাতে এখনো ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। ভুলুমিঞা আকাশের পানে চাইলো। সেখানে কালো মেঘ এসে জমা হচ্ছে। চারপাশের চঞ্চল হাওয়া নদীকে প্রভাবিত করতে পারলেও, মেঘগুলোকে নড়াতে পারলো না। ভুলুমিঞা নৌকা বাইবার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো।
হঠাৎ চারিদিক ছাপিয়ে নামতে লাগলো বৃষ্টি। ভুলুমিঞা ঝাপসা চোখে চারপাশে তাকালো। লক্ষ্য করলো নৌকার ছই হতে রাধা বেরিয়ে এসেছে। তার মাথায় ঘোমটা নেই। সে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টিতে ভিজছে এবং হাসছে। ভুলুমিঞা অভিভূত হলো।
হঠাৎ ভুলুমিঞা লক্ষ করলো নিজের অজান্তেই তার হাত থেকে বৈঠাটা পড়ে গেছে। ভুলুমিঞা সচকিত হলো। এক মুহূর্ত দেরী না করে নদীতে ঝাঁপ দিলো।
মিনিট চারেক পর ভুলুমিঞা নৌকায় উঠে এলো। দেখতে পেলো রাধা কাঁদছে। ভুলুমিঞা জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলো? কাঁদো কেন?”
রাধা ভুলুমিঞাকে দেখে হঠাৎ কান্না থামালো। কিছুক্ষণ বড় বড় চোখে চেয়ে থেকে বললো,
“ঠিক আছে, আর কাঁদবো না। তয় আপনার মত বুকা মানুষ আমি আমার জিন্দেগিতে দেখি নাই।”
এই বলে রাধা আগের মতন নৌকার ছইয়ে ঢুকে বসে রইলো। ভুলুমিঞা শুকনো মুখে দ্বার বাইতে লাগলো আর মনে মনে গভীর আনন্দে আনন্দিত হলো।
এর অনেকদিন পর একাত্তরের এক দিনে পাকিস্তানী হানাদার কর্তৃক অপহৃত, ধর্ষিত এবং জবাইকৃত অবস্থায় ভুলুমিঞা তার সঙ্গিনীকে এবং লাল তার মাকে এই নদীরই একপাশে খুঁজে পায়। মূলত সেদিন তারা কিছু বলতে পারেনি, কিছু বুঝতে পারেনি। কি এক অদ্ভুত ঘোর যেন তাদের জাপ্টে ধরেছিলো। আর...
আর কিছু নয়।
এরপর, এখন পর্যন্ত অনেক সময় চলে গেছে। ভুলুমিঞা কখনো এমনটা অনুভব করেনি,যে অনুভবটা এখন তাকে ভীষণ অসহায় করে তুলছে। ভুলুমিঞা ভাবে,সকল স্বপ্ন হঠাৎ কেন এভাবে নিরর্থক হয়ে যাবে,কার দোষে?
ভুলুমিঞা ভাবে। হঠাৎ ভুলুমিঞা একটি ডাক শুনতে পায়।
“ভুলুমিঞা নাকি?”
ভুলুমিঞা চমকে উঠে দাঁড়ায়।
“সালাম,মাওলানা সাহেব।”
“বস ভাই, আমিও তোমার পাশে বসি।”
মাওলানা সাহেব ভুলুমিঞার পাশে বসে পড়লেন।এতে অবশ্য আধপোড়া শীতল পাটিটার কোন কষ্ট হল না।যদিও ওর প্রাণহীন প্রানে অজস্র স্মৃতি,অজস্র অনুভব।
“ভাই, তোমাদের ঘর বাড়িতো সব শেষ।এখন কি করবা?”
“কিছু চিন্তা করি নাই মাওলানা সাহেব।”
“ভাই মন খারাপ কইরা থাকবা না বুঝলা। কঠিন সময় যেমন থাকবে সহজ সময়ও কিন্তু থাকবে। এই দুই নিয়াইত মানবজীবন।তয় ভাই এটাই কিন্তু মানবজীবনের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। অনেকে এইটাই মাইনা নিতে পারে না।যারা পারে তাগোর জীবনে কিন্তু দুঃখ বইলা কিছু নাই,বুঝলা।”
ভুলুমিঞা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে,
“আচ্ছা মাওলানা সাব ঐ সাদা টুপি পড়া দাড়িওলা পোলাপানগুলা আমাগো ঘর পোড়াইল কেন?আমাগোর দোষটা কি কনতো?”
“তোমাগোর তো কোন দোষ নাই ভাই। ওরা অবুঝ পোলাপাইন।আল্লা ওগোরে বুঝ দেন নাই।ওগোরে বুঝ দিছে মানুষ,শয়তান মানুষ। ওরা যুয়ান পোলাপাইন,রক্ত গরম,মাথাও গরম। যা করতে বলছে তা না বুঝেই করে ফেলছে।আল্লা পাক সবই দেখতাছেন।তিনি নিশ্চয় ওগোরে হেদায়েত করবেন।”
ভুলুমিঞা চুপ করে থাকে।মাওলানা সাহেব বেশ সময় নিয়ে বলেন,
“ভুলুমিঞা,আমি সারাটা জীবন মানছি সব ধর্মের মানুষকে পাশাপাশি একে অপরের ভাই হয়ে মিলেমিশে থাকা উচিত।কিন্ত সারাটা জীবন এমনটা দেখছি খুব কম।তবুও ভাই যা হওয়া দরকার,যা হওয়া উচিত,তা তো সব সময় হয় না।তাও বেঁচে থাকতে হবে।যতদিন না পর্যন্ত উনি উপরে ডাইকা নেন,ততদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার মধ্যেই সব।আমি তাই ভাই বাঁচবার চেষ্টা করি।ভরসা হারাই না।যা হবার তা তো হবেই।”
ভুলুমিঞা চুপ করে থাকে।
“ভুলুমিঞা, তোমার তো ভিটা বাড়ি সব শেষ।আর তোমার তো কেউ নাইও।তাই বলি কি তুমি আপাতত আমার সাথে আইসা থাকো।পরে কোন গতি হইলে চইলা গেলা।”
ভুলুমিঞা চুপ করে থাকে।
“কিও ভাই কথা বলো।চুপ কইরা আছ কেন?”
ভুলুমিঞা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল।
“আরে মিঞা পোলাপানের মত কাঁদার কি হইল,কান্না থামাও।”
মাওলানা সাহেব ভুলুমিঞাকে জড়িয়ে ধরেন। এক সময় ভুলুমিঞা কান্না থামায়।
“আমি নামায পড়ে আসতেছি। তুমি জিনিসপত্র কি নিবা নিয়া নেও।ঠিক আছে?”
ভুলুমিঞা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। মাওলানা সাহেব চলে যান।
ভুলুমিঞা উঠে দাঁড়ায়। নদীর বুকে আরো একটি বার তাকায় সে।কি যেন খোঁজবার চেষ্টা করে।সম্ভবত নিজের জীবন। আসলে নদীর এ ব্যাপারটি ভুলুমিঞা জেনেছিল অনেক আগেই।নিজের সামান্য এ জীবনে সে দেখেছেও অনেকবার। নদী আসলে তার সেই জন্মকাল থেকে প্রতিটি দিন, প্রতিটি সময়, প্রতিটি ক্ষণ,সমস্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি মুহুর্মুহু নিজের অঙ্গে ধারণ করে আসছে। তাই নদীর দিকে তাকালে সহজেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। ভুলুমিঞা খুঁজে পায় অনেকটুকুই, নিজেকে, নিজের জীবনকে। ভুলুমিঞা অনুভব করে এক বড় শান্তির মত ভালোলাগা ধীরে ধীরে ডানা মেলে উঠছে তার অন্তরের ভেতর। সে নতুন করে বুঝতে পারে, এতগুলো বছর চলে গেছে, এখনো তো এ জীবন ভেঙ্গে পড়েনি।
ভুলুমিঞা আর বিলম্ব করল না।
করবী ফলগুলো সজোরে ছুঁড়ে মারল নদীর বুকে।
হঠাৎ প্রতিটি বিন্দু বিন্দু জল নিজেদের প্রাণের স্পন্দন নতুন করে অনুভব করল।
শ্যাম কনিকা দিঘী
হেমন্ত ইকবাল ধ্রুব
এই দিঘীটির আরো একটি সুন্দর নাম আছে, যা অনেকেরই অজানা। ১৯৭১ সালে বাংলা স্বাধীন হওয়ার পর , মুক্তি বাহিনীর একজন সদস্য শ্রী বলেশ্বর পাল দিয়েছিলেন।
শ্রী বলেশ্বর পাল ছিলেন একজন সধারন হিন্দু পরিবারের খেটে খাওয়া বিন মজুর। এক মেয়ে আর স্ত্রী কে নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার। বাংলার স্বাধীনতা ঘোষনার প্রয় দুই মাস পূর্বে পাকিস্থানীরা তাদের গ্রাম আক্রমন করে। তখন বেশির ভাগ হিন্দু পরিবার তাদের সব কিছু নিয়ে ভারত চলে যায়। কিন্তু বলেশ্বর পাল যায় নি। বলেশ্বর পাল না যাওয়ার পিছনে অন্যতম কারন ছিল, সে দিন পাকিস্থানী বাহিনীর আক্রমনে তার বাবা শ্রী আনন্দ পালের নির্মম মৃত্যু হয়। তার বাবার বহমান তাজা রক্ত সেদিন তার বিবেকের সামনে বাধাঁ হয়ে দাড়িয় ,তার অপ্রতিরুদ্ধ কন্ঠ অব্যক্ত ভাষায় বলে উঠে। "এই বাংলা শুধু মোসলমানদের নয়, এই বাংলা সকল জাতির ,সকল ধর্মের।"
সে দিন থেকে বলেশ্বর দূঢ় প্রতিঙ্গা বদ্ধ , এই বাংলাকে সে স্বাধীন করবে এবং এখানেই সে বেঁছে থাকবে।
দিনটি ছিল ২৫ শে শ্রাবণ! ঘন মেঘ আকাশের চারধারে ঘুর ঘুর করছে, কিন্তু বৃষ্টির বিন্দু মাত্র চিহ্ন নেই। বেলা প্রয় পশ্চিম আকাশে চলে গেল, বলেশ্বর এখনো বাড়ি ফেরেনি। বলেশ্বরের স্ত্রী "শ্যামলী" আর এক মাত্র কন্যা "কনক" ঘরে এক।
একটু বাদে আকাশটা প্রকান্ড ভাবে ডেকে উঠলো, মনে হয় এখনী আকাশ ফেটে বৃষ্টির রসদ গুলু সবুজ শ্যামল প্রান্তরে চাদরের মতো বিচিয়ে পড়বে।
পৃথিবীটা আজ কেমন যেন ভয়ংকর হয়ে উঠছে।
বৃষ্টির শব্দের মতো বাহিরে কিসের শব্দ হচ্ছে, তা দেখার জন্য শ্যামলী কপাট খুলতেই দেখে, কাঁঠাল গাছের নিছে হলুদ রঙের খাকি পোশাক পরা তিনজন মানুষ দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে কি যেন বলছে। গোধূলীর আবছা আলোয় শ্যামলী তাদের চেহারা দেখার চেষ্টা করছে। তাদেরকে আগে কোথাও দেখেছে বলে শ্যামলীর মনে হয় না। তাদের গাল ভর্তী দাড়ি, এক জন বসে বড়ি খাচ্ছে আর বাকিরা দাড়িয়ে পান চিবাচ্ছে, তাদের এক জনের থুতনি বেয়ে পানের রস পড়ছে, সে আবার মাঝে মাঝে তার হলুদ দাত গুলু বের করে করে হাসছে। আজকের এই চেনা পরিবেশটাও শ্যামলীর কাছে বড় বেশি অচেনা লাগছে।
ঘন মেঘ গোধূলীর রক্তিম সূর্যটাকে ঢেকে দিয়েছে। পৃথিবীতে আজ সন্ধ্যা নামার আগেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চার পাশটা কেমন যেন ভয়ানক হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে বিজলী চমকাচ্ছে। মেঘের গর্জন আর বিজলীর অদ্ভুত আলো মিলে পৃথিবী এক ভয়ংকর রুপ ধারন করছে। বাহিরে দাড়ানো তিন জন অচেনা মানুষকে শ্যামলীর কাছে আরো অদ্ভুত লাগছে। সে কি করবে বুজতে পারছে না,বৃষ্টি আসার আগেই তাদের ভিতরে ডেকে আনবে না দরজা বন্ধ করে ভিতরে চলে যাবে। শ্যামলীর ভাবনাগুলো শেষ না হতে ভিতর থেকে নয়-দশ বচরের একটি মেয়ে বলে উঠলো,
মা !
খুব ক্ষুদা পেয়েছে, কিছু খেতে দাও।
ম!
বাবু যে এখনো আসছে না?
বাহিরে মেঘের গর্জন শুনছো? মনে হয় একবার শুরু হলে আর থামবে না।
মা !
বাবু কখন আসবে?
বৃষ্টিতে ভিজলে বাবুর অসুখ করবে । আর বাবুর অসুখ করলে তুমি কাদঁতে শুরু করবে।
মনে পড়ে মা?
কয়েক দিন আগে বাবুর একবার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা হয়েছিল। বাবু সারাদিন বিচানায় শুয়েছিল, আর তুমি বাবুর মাথায় ঔষধ মেখে দিলে। আর কি কান্নাটাই না কাদঁলে। যানো মা , তুমি যখন কাদোঁ তখন আমারো খুব কান্না পায়।
মেয়েকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা শ্যামলীর জানা নেই। তবুও বললো , তোর বাবুতো এতো দেরি করে আরতো কোন দিন ঘরে ফিরেনি। হয়তো একটু পরেই দেখবী তোর জন্য মস্ত বড় পুতুল নিয়ে তোর বাবু ঘরে ফিরে এসেছে।
অমনিতে বাহির থেকে কেউ একজন বললো,
ঘরে কেউ আছে?
কনক দৌড়ে এসে দরজা খুললো, ভাবছে তার বাবু এসেছে। দরজা খুলতেই কিছু না বলে অচেনা তিন জন লোক ঘরে প্রবেশ করলো। কনক তার ভিতু দৃষ্টি দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, এই প্রথম সে এক পোষাকে তিন জন মানুষ দেখলো। সে বললো ,
আপনারা কি বাবুর কাছে এসেছেন? বাবু ঘরে নাই।
আপনারা এই খানে বসুন , বাবু একটু পরেই চলে আসবে।
এই বলে কনক ভিতরে চলে এলো, সে তার মা কে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে জড়ানো কন্ঠে বললো।
মা !
দেখ, বড় বড় দাড়ি গোফ ওয়ালা তিন জন লোক বাবুর কাছে এসেছে, আমি তাদের কে সামনের ঘরে বসতে বলেছি। মা ওদের দেখে আমার না খুব ভয় করছে।
ধিরে ধিরে আকাশ ফেটে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো । বৃষ্টির ফোটা গুলু তাল পাতার চাওনী ভেদ করে কনকের স্নেহময়ী মুখে এসে পড়ছে। মেঘ বিকট গর্জন দিলে সে তার মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
অপরিচিত ভয়ংকর লোক গুলু সামনের ঘর থেকে ভিতরে চলে এলো। তারা কিছু না বলে কনক কে তার মায়ের কোল থেকে চিনিয়ে নেয়। ভয়ে কনকের মুখ নিল হয়ে গেলো। শ্যমলী চিৎকার করে বলে উঠলো,
আপনারা কে? কি চান? আমার মেয়ে কে ছেড়ে দিন।
শ্যামলীর এই তিব্র আর্তনাদ মনে হয় আজ এই ঘর থেকে বের হচ্ছে না।
বৃষ্টির ফোটাগুলো ধীরে ধীরে আরো বড় হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দগুলো শ্যামলীর আহাজারী কে রুদ্ধ করে দেয়।
আরেকটা পিচাস পিচন থেকে এসে শ্যমলীকে মাটিতে শুইয়ে দেয়। শ্যমলী তার সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজকে বাঁচিয়ে খোলা দরজায় দৌড়ে পালালো। যে লোকটি কনককে পিছন থেকে ধরে রেখেছিল, কনক তার হাতে শক্ত করে কামড় বসিয়ে মায়ের পিছে পিছে চুটছে। এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে মা আর মেয়ের পিছু নিলো অপরিচিত সেই ভয়ংকর লোকগুলো ।
চারদিক অন্ধকার। অন্য দিকে ঝুম বৃষ্টি। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন । দাড়িয়ে যায় তারা। হঠাৎ বিজলি চমকাতে দৌড়ে ছুটে গহীনে। মা তার মেয়ে কে নিয়ে নিজদের আড়াল করার জন্য আশ্রয় নিলো নির্জন ঝোপের নিছে। ঝুম বৃষ্টি আর মেঘের বিকট গর্জন ,মাঝে মাঝে বিজলীর অদ্ভুত আলো, পৃথিবীকে এক নব ভয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
হঠাৎ সেই নিঝুম ঝোপের নিচ থেকে বিকট চিৎকার। একটি মায়ের আহাজারি আর একটি শিশুর করুন আর্তনাদ। বৃষ্টির মায়াবী শব্দের সাথে মা ও মেয়ের আর্তনাদ মিলে মিশে একাকার ।
শ্রাবণের আরেকটি দিন শুরু। নব ঊষার প্রথম আলো, রাস্তার উপর বিছিয়ে থাকা ঘাস গুলুর উপর পড়তেই মনে হয়, বৃষ্টির কণাগুলো ঘাসকে খুব আপন মনে করে জড়িয়ে আছে। বিচিত্র এই সোনালী রোধ ঘন ঘাসের উপর জমে থাকা বৃষ্টির কনা গুলুকে আরো বিচিএ ময় করে তুলেছে। প্রভাতের এই মায়া ভরা ঘাসের উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছে বলেশ্বর। বলেশ্বরের দু'পা কে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধেরেছে জমে থাকা বৃষ্টির কনাগুলো ।
বলেশ্বর তার উঠানে দু'পা দিয়ে একটি গভীর নিরবতা অনুভব করলো। যা তাকে বহু কাল তাড়া করে বেড়িয়েছে। বলেশ্বর তার স্নেহময়ী কন্ঠে বলে উঠলো।
মা কনক !
ও মা কনক !
কোথায় গেলিরে তুই? দেক তোর জন্য বাবু কি নিয়ে এসেছি। এই বলে সে ঘরে দু'পা দিলো, দিয়ে সে আরো গভীর শূন্যতা অনুভব করলো। ঘরের চর্তুকোন আজ ভরপুর শূন্যতায়। কোথাও কারো বিন্দু মাত্র সাড়া শব্দ নেই। দূরে কোথাও পান্জাবীরা কারো বাড়ি আক্রমন করেছে। সেখানের মানুষের ঘোর আর্তনাদ আর গুলির শব্দ শোনা যায়।
বলেশ্বর ভাবলো তার স্ত্রী দক্ষিণ পাড়ার শ্রীমতী কাছে গিয়েছে। শ্রীমতী তার বাল্য সখী। এক সঙ্গে তারা বহু দিন ছিল। তাই মাঝে মাঝে শ্যামলী তার কাছে যায়। এছাড়া শ্যামলীর যাওয়ার মতো কোন স্থান নাই ।
বলেশ্বর তাদের জন্য দুপুর পযন্ত অপেক্ষা করলো। দুপুর গড়িয়ে প্রয় বিকেল ,তাদের ফেরার নাম গন্দ মাত্র নাই। বলেশ্বরের মন আর মানছেনা। সে চললো শ্রীমতীর বাড়ির দিকে।
বেলা প্রায় পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে, সে হাটছে রাস্তার এক পাশ ধরে। রাস্তার দু'ধার জনো শূন্য। রাস্তার পাশের দিঘীটির এক কোনে কিছু জড়ো হয়ে কা..... কা.....করছে । কয়েকটি কুকুর ঘেউ ......ঘেউ.....করে সে দিকে এগেয়ে যাচ্ছে। কাক আর কুকুরের শব্দ গুলু এতোই ভয়ানক যে, বলেশ্বর জনো শূন্য রাস্তায় ভয়ে ভয়ে হাটছে।
আরেকটু সামনে এগুতেই তার শরিরের লোম গুলু দাড়িয়ে গেল। সে দেখতে পেল দিঘীর পূর্ব কোনে একটি উলঙ্গ মানুষের পাশে কিছু কুকুর ঘুরা ফেরা করছে। আর তার উপরে এক ঝাক কাক অভিরাম কা...কা... করছে।
বলেশ্বর খানিকক্ষণ এদিক ও দিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে, সে একাই উলঙ্গ মানুষটাকে দিঘীর পাড়ে টেনে তুললো । বলেশ্বর সেই মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজকে আর সামলে রাখতে পারলো না। আজ তার নিরবতার সকল প্রাচির ভেঙ্গে সেখানে অশ্রুর স্রোত বইছে। সৃষ্টির অসীম সৌন্দর্য তার নয়ন সম্মুখে স্তব্ধতার কালো শোকে ছেয়ে গেছে। আপন জন হারানোর বেদনা আপনাকে কত খানী কাতর করে তুলতে পারে তা আজ স্পষ্ট ভেসে উঠেছে বলেশ্বরের মুখে। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো সে ।
ঘন নির্জনে একা একটি মানুষের শব দেহের পাশে বসে কাঁদছে বলেশ্বর। তার পাশে কিছু কাক আর কুকুর ছাড়া কোন প্রানী বলতে নেই।
বলেশ্বরের রক্ত শিতল হয়ে আসছে, কন্ঠ শান্ত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার নড়ার বিন্দু মাত্র শক্তি নেই। বলেশ্বর দেখছে দূরে জঙ্গলের পাশে, দিঘীর কিনারে আরো একটি উলঙ্গঁ বাচ্চাকে কুকুরে ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। কিছু কাক তার উপরে উড়ছে আর অবিরাম কা.....কা.....করছে।
ধিরে ধিরে কিছু মানুষ জড়ো হলো এই নির্জন জঙ্গলে । এই অবেলায় তারা আসার কারন ছিলো পাকিস্থানীরা তাদের তাড়া করছে। মানুষ গুলু দেখতে পেল বলেশ্বর একটি নারীর শব দেহের পাশে অবচেতন অবস্থায় গাছের শিকড়ের সাথে মিশে আছে । মানুষ গুলু তাকে তুলতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। সন্ধ্যা ঘনাতে পাকিস্থানীরা জঙ্গলে এসে খুব গোলা গুলি করতে লাগে। এদিকে সবাই জঙ্গলে ছেড়ে পালিয়ে যায়। একা বলেশ্বর থেকে যায়।
অবশ্য সেদিন তার পায়ে একটি গুলিও লাগে।
সেই থেকে এই দিঘীটির নাম '"শ্যাম কনিকা দিঘী"'।
ভোরের শিশিরে অণুগল্প
সন্ধ্যার কাছাকাছি : সীমান্ত সওদাগর
পাথরের মতো মানুষ : গণেশ গাওয়াল
ত্রয়ী : সুব্রত দত্ত
সন্ধ্যার কাছাকাছি
সীমান্ত সওদাগর
উঠোন বৃষ্টিতে ল্যাটোর-প্যাটোর। হাঁসের পাল কাদার খোঁচে মুখ ঢুকিয়ে অযথা হাসাহাসি করছে। বাড়ির বড় বউ ‘আয় আয় চইচই, আয় আয়....’ বলে হাঁসগুলোকে কুড়ো দিতে ডাকছে। মানুষের মতো স্বভাব নিয়ে একঝাঁক হাঁস নতুন বউটার দিকে এক নজর তাকিয়ে সমবয়সী অন্যান্য হাঁসের সাথে ফিসফিস করে কী যেনো বলছে আর খিলখিল করে
হাসছে। বউটা হাঁসের পালের দিকে তাকিয়ে আছে। কী যেনো ভাবছে। সে... ভাবনার শেষ নেই.... অযাচিত ভাবনা... ভাবনাগুলোও যেনো কাদায় ল্যাপটা-ল্যাপটি করছে.... আহারে ! হঁসেরাও এভাবে খেলে ! প্রেমিকার পাখনার ভেতর মুখ ঢুকিয়ে শরীর চুলকে দেয় ! এমন করে
খুনসুটিতে মেতে থাকে সারা উঠোন জুড়ে ! ধুর ছাই! এমন উন্মুক্ত সঙ্গমে
ওদের লজ্জা করে না ? বেহা হাঁস, হাঁসিনীও বেহা, লজ্জা নেই-শরম নেই, আমি হলে.....। এমন দৃশ্য আমার কাছে সত্যি অবাক হওয়ার মতো। আমি শহরের ইট-পাথরের দেয়ালের ভেতর শরীরের পরিধি বাড়িয়েছি। জীবনের গতি থাকে শুনেছিলাম, আজ দেখছি। কতো ভালবাসার গল্প শুনেছি, আজ বর্তমান। আহ ! আমার প্রেমিক যদি আমার পালকের
ভেতর মুখ গুজে দিয়ে শরীর চুলকে দিতো ! এমন খুনসুটিতে মেতে
থাকতো সারাবেলা ! এমন উন্মুক্ত সঙ্গম......
পাথরের মতো মানুষ
গণেশ গাওয়াল
ছেলেটার বয়স ৩ বছর। আজ সকালে পাশের পুকুরে ডুবে গেছে। বাবা দরজায় মাথা ঠুকিয়ে কাঁদছে, ৯ বছরের বোনটা চিৎকার করছে, দাদি লাঠিাটা হাতে নিয়ে নির্বাক। এইতো আজ ভোরে মায়ের কাছ থেকে ঘুম ভেঙে উঠে দাদির শোবার ঘরে গিয়ে দাদির কোলে একবার ঝাঁপ দিয়েছে। দাদার মুখে আদার দিয়ে বারান্দায় খেলছিল। সবাই তাকে খেলতে দেখেছে বারান্দায়। কখন যে সে গেলো ঐ কালের পুকুরে কে জানে !
হয়তো ভূতে নিয়ে গেছে, নইলে সবার চোখ ফাকি দিয়ে কীভাবে মনি গেলো পুকুরে ! পাড়ার লোক এসেছে- নানা জনের নানা কথা। হারুনের বউ ময়নার মাকে বললো-‘দেখলি বু, মনি’র মা কেন্তে না, ও মাগি পাষাণ মাগি। ময়নার মা বললো, হু...
ত্রয়ী
সুব্রত দত্ত
বেশ চলছে জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্নাস পড়ছি। ঝামেলাহীন জীবন। একটি প্রেম ও একটি টিউশনি। মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকা। সপ্তাহ শেষে একটি দিন ডেটিং।
বাসস্ট্যান্ডের পাশে বয়ে যাওয়া মৃত নদী। অল্প পানি। ফ্যাক্টরির বর্জ্য পদার্থে ভর্তি দূষিত কালো পানি। তার উপর তীর ঘেঁষে বস্তি। বসতি থেকে বস্তি। বাঁশের ঘর। ভাঙাচোরা। একটি ঘর। সাত জন মানুষ। পাঁচ জনই শিশু।
রাস্তার দু'ধারে বিল্ডিং। উঁচু উঁচু সারিবদ্ধ বিল্ডিং। ফ্লাটের পর ফ্লাট। অল্প মানুষ। শান্ত, ছিমছাম। এক পাশে বাগান। এক পাশে লেক। সায়লার বাড়ি।
কাজে আমি ফাঁকিবাজ না। নিয়মিত টিউশনিতে যাই। ক্লাসও করি। ফলাফল বেশ ভালো। ডিপার্টমেন্টে মোটামুটি জনপ্রিয়। দেলোয়ার হোসেন স্যারের প্রিয় ছাত্র। স্যার আগামি তিন বছরের জন্য সভাপতি। আমার পড়াশুনা শেষ করতে লাগবে দু'বছর।
সামনে নির্বাচন। নেতা-কর্মীর রাজপথ থেকে অলিতে-গলিতে আনাগোনো। নির্বাচনী প্রচারণা। প্রচারণা থেকে প্রতারণা। বস্তিতে আনন্দ। মিটিং-মিছিলে গেলেই একশো। ছেলে-বুড়ো, যুবক-শিশু সবার আয় রোজগার। দিন শেষে গরম্নর গোস্তের ঘ্রাণ।
দু'দিন পর থারটি ফাস্ট নাইট। ফ্লাটে ফ্লাটে আলোর সমারোহ। নানা আয়োজন। সায়লার জল্পনা-কল্পনা। এবার নাইটটা সে আমার সাথে কাটাবে। কৌশলী মেয়ে। সিটিং আর ফিটিং-টা বাকি।
যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই। নাস্তিকদের বিচার চাই। জামায়েত ইসলাম নিষিদ্ধ কর। ফ্যাসীবাদ রুখে দাঁড়াও।
হরতাল। অবরোধ। ভাঙচুর। লুটপাট। অগ্নিসংযোগ। গ্রেফতার। সংঘর্ষ। ১৪৪ ধারা।
ডিপার্টমেন্ট বন্ধ। দেলোয়ার হোসেন গ্রেফতার। সভাপতিত্ব বাতিল। বদ্জাত কাদের রহমান স্ব-নির্বাচিত সভাপতি। ক্যাম্পাসে আন্দোলন। রিলেশন স্ট্যাটাস সিঙ্গেল।
বস্তি উচ্ছেদ।
ফ্লাটে ফ্লাটে আলোকসজ্জা। নববর্ষ উদ্যাপন। স্যাম্পেন আর উইস্কি। আনন্দ আর ফূর্তি।
সুব্রত দত্ত। ১৫ মার্চ ২০১৩। টঙ্গী, গাজীপুর।
কুকস অ্যান্ড বুলস স্টোরি
তন্ময় ম্যাথিয়াস গমেজ
-“কেমন আছেন?”
-“ভাল,আপনি ভালো আছেন তো?”
-“এই তো আছি আর কি?”
-“আসু্ন ভেতরে আসুন, আপনার ছবিটা প্যাঁকিং করেই রেখেছি। বসুন আমি নিয়ে আসছি।”
যে ছবিটার কথা তিনি বললেন এই ছবিটা আমি গত সপ্তাহে জার্মান কালচারাল সেন্টার ছবির এক্সিবিশান থেকে দশহাজার টাকা দিয়ে কিনেছি।ছবির বিষয়বস্তু খুবই সাধারণ। একটি নগ্ন তরুণী কাঠের চেয়ারে বসে আছে ।কিন্তু অসাধারণ বিষয় হল তরুণীটির আকর্ষণীয় দেহ । ছবিটির দিকে একবার তাকালে চোখ ফেরানো মুস্কিল।এই ছবির দিকে যে পুরুষই তাকাবে তারই মন খারাপ হবে, ভাববে ইস এমন একটি মেয়ে যদি বিয়ে করতে পারতাম।ভাগ্যিস আমি প্রথম দিকেই গিয়েছি,নইলে এ ছবি থাকত না।
-“এই নিন আপনার ছবি। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি।আপনাকে দিয়ে দিতে হল।তা আমাদের তো অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয় তাই না ?”
আমি কিছু বললাম না। মৃদু হাসলাম।তারপর উঠে দাঁড়ালাম ।
-“আরে কই যান?,বসুন চা খেয়ে যান।এই রুবি চা দাও তো। ”
-“চা খাব না ।শরীরটা ভালো লাগছে না ।আমি বাসায় চলে যাব।”
- “আরে একটু চা খান না, দেখবেন শরীর চাঙ্গা হবে যাবে।”
অগত্যা বসতেই হয় ।আমি বসতে বসতে ভদ্রতা করে বললাম, “আর্টিস্টদের ছবি আকার পেছনে অনেক সময় গল্প থাকে এ ছবি আকার পেছনে আপনার কোন গল্প আছে কি?”
এমন সময় ভদ্রলোকের স্ত্রী ট্রেতে করে চা বিস্কিট নিয়ে ঢুকলেন ।তার স্ত্রীকে দেখে আমি থতমত খেয়ে গেলাম।কালো, টানা চোখ ,বোঁচা নাক,মোটা ঠোঁট,ভাঙ্গা গাল বিশিষ্ট এক রূপহীনা এক তরুণী।ভদ্রলোক আর্টিস্ট মানুষ,কত সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের সাথে পরিচয় আর তিনি এরকম এক রূপহীনা তরুণী বিয়ে করেছেন ভাবাই যায় না।তিনি তার স্ত্রীকে বললেন,“এ আমার নতুন বন্ধু জন,গত সপ্তাহ থেকে পরিচয়।”তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“এ তোমার বউদি, ওর নাম রুবি।”
নমস্কার বিনিময়ের পর ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে বললেন,“তুমি ভেতরে যাও আমাদের একটু প্রাইভেট টক আছে।”
ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন,“ তখন আর্ট কলেজে পড়া সবে শেষ করেছি।আমার বিয়ের এক মাস আগের কথা। এই রুবিকে চিনতাম একটু অন্যভাবে,কিভাবে সেটা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।একদিন বিকেলবেলা রুবি হঠাৎ আমার বাসায় উপস্থিত। অনেকক্ষণ কথাবার্তার পর সে লাজুক ভঙ্গিতে সে তার একটা বেয়ার পোট্রেট এঁকে দেবার অনুরোধ জানাল।রুবির সাথে আমার অনেক দিনের পরিচয় থাকলেও তাকে আমি কখনো আমি সেভাবে দেখিনি।তার মত রূপহীনা তরুণীর নগ্ন দেহ দেখার বা তার ছবি আকার ইচ্ছা কখনই মনে জাগেনি।কিন্তু ফিরিয়ে দিলে মনে কষ্ট পাবে ভেবেই রাজি হলাম।তাকে আমার স্টুডিওতে নিয়ে গেলাম।তারপর তার সব কাপড় খুলে ফেলতে বললাম।সে একে একে সব কাপড় খুলে ফেলল।আমি .....................।
-“আমি বরং আজ আসি ।শরীরটা খুবই খারাপ লাগছে।”
ভদ্রলোক মন খারাপ করে বললেন –“আচ্ছা”
তিনি আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন।
রাস্তায় নেমেই মনে হল প্রতিভাবান সব মানুষেরই মাথায় একটু ক্র্যাক আছে।নইলে নিজের স্ত্রী সম্পর্কে কেউ এসব কথা বলতে পারে।আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তার এই ছবি আকার গল্প আর তিনি শুরু করেছেন,তার বিয়ের পূর্ব গল্প।
বাসায় ফিরে ছবিটার প্যাকিং খুললাম।আবার সেই প্রথম দিনের ফিলিংসই হল।এত সুন্দর আকর্ষণীও দেহ কারো হতে পারে?ইস,এমন একজন স্ত্রী যদি আমার থাকত।
আপাদমস্তক পুরো ছবিটা একবার দেখলাম।
তারপর যেই মুখের দিকে তাকালাম হঠাৎ চমকে উঠলাম।
“রুবি বউদি”
নাম : তন্ময় ম্যাথিয়াস গমেজ
পেশা : ছাত্র (Notredame college)
ঠিকানাঃ ১৮/এ/১, পশ্চিম নাখালপাড়া
ঢাকা- ১২১৫
মোবাইল নো. ০১৬৮৩৭৪৬৪৫৬
শিশিরের শব্দ
স্মৃতিকথা
পুণ্যসঙ্গ : কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত : আবু দায়েন
যে খাবার কেউ যাচে না : বিপ্লব কুমার হালদার
ভোরের শিশির : স্মৃতিকথা
অস্ট্রেলিয়ায় এখনো 'গো ব্যাক টু হয়ার ইউ কাম ফ্রম' বিতর্ক? : আশরাফুল আলম
একজন প্রিয় স্যার : আসাদ
আবু দায়েন
পুণ্যসঙ্গ : কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
এটা আমার বড় পাওয়া। পরশু প্রফেসর হানস হারডার আমাকে বলছিলেন, “দায়েন, অলোকদা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন! আপনার সময় হবে কাল সন্ধ্যায়?” আমি বললাম, “কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আমার স্বপ্রের মানুষ! তাঁর সাক্ষাৎলাভের জন্য আমি মুখিয়ে আছি!” হানস বললেন, “তবে কাল আমরা যাচ্ছি।”
গতকাল সারাদিন আমি একরকম রোমান্স অনুভব করছিলাম। পঞ্চাশের বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত অনুবাদ ও সাহিত্যসমালোচনায়ও অসামান্য অবদান রেখেছেন। “আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাস” দুটো কপি আমার। একখানা বিভাগে রাখি, একখানা বাসায়। আমার খুব প্রিয় বই, যা আধুনিক বাংলা কবিতার সার গ্রহণে সহায়ক। এখানে এসেও দে’জ থেকে বেরোনো তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা বারবার পড়েছি। “যৌবন বাউল” ও “নিষিদ্ধ কোজাগরী” তাঁর অসাধারণ কাব্যমননের সাক্ষবাহী। শক্তি, বিনয়, শঙ্খ ও সুনীলদের সমানতালে চলা ও বেড়ে ওঠা এই কবি দীর্ঘকাল জার্মানপ্রবাসী। জার্মানকন্যা ট্রুডবেরটাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সেই কতকাল আগে। ভালোবাসার মানুষটি তাঁকে একা ফেলে পরপারে চলে গেছেন ২০০৬ সালে। এখন হাইডেলবার্গের কিছুদূর লয়টারহাউজেন নামক এক নিরিবিলি গ্রামে বসবাস করেন। ডুপ্লেক্স বাড়িটাতে তাঁর সঙ্গী গাদাগাদি ঠাসা অসংখ্য বই আর অফুরান প্রাণশক্তি। দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছেন সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটে। এখন অবসর নিয়েছেন। গত ৫ নভেম্বর ছিল এই চিরতরুণের ৮০তম জন্মদিন।
গতকাল দিনের বেলা হানস আমাকে জানান ছ’টার আগেই উনি আমাকে নিতে আসবেন। আমার রোমান্স আরো বাড়িয়ে দিয়ে তিনি আসতে দেরি করছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পর ফোনটা বাজল। তিনি বললেন, “দায়েন, আমি দুঃখিত! ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অলোকদা অপেক্ষা করছেন। তাড়াতাড়ি নামুন। “ আমি তাঁর জন্য আমার দুটো বই আর সুন্দর একটা ডায়েরি সঙ্গে নিলাম। হাইডেলবার্গ থেকে ডসেলহাইম হয়ে হিরশহাইম। তারপর দীর্ঘ নিরবতার গ্রামীণ রাস্তা। দূরে মানহাইম শহরের স্কাইলাইন চোখে পড়ে রাতের আলো-আঁধারে। আমাদের দেশে হলে মনে পড়ত রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত পদ্য “মনে করো যেন/বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে...”। রাস্তার দু’পাশে পতিত জমি। কোথাও কেউ নেই। ধনাঢ্য দেশের বিমূর্ত চাকচিক্যের দেখা-অদেখা আভিজাত্য মাড়িয়ে তুফানবেগে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন হানস। অনন্য দৈহিক ও মানসিক উচ্চতার এই সাহেবকে অলোকদা ঠাট্টা করে ডাকেন লর্ড ক্লাইভ! তাঁর স্ত্রী আন্দ্রিয়া লেডি ক্লাইভ!
আমরা যখন লয়টারহাউজেন গ্রামে ঢুকি আশাপাশে কোনো জনমানব নেই। তখন মাত্র সাড়ে ছ’টার মতো বাজে। রাস্তার পাশে পার্কিং করা কিছু গাড়ি। একসময় থামলেন হানস। বললেন, “চলুন চলুন। দেরি হয়েছে, বকা দেবেন।” বেল চাপতে অল্পক্ষণেই দরজা খুলে একজন সামনে দাঁড়ালেন, আমার ভাবনার মধ্যে যেমনটা ছিল না। অন্নদাশঙ্কর রায় ৯৮ বছর বয়সে যেমনটা বুড়ো খুনখুনা হয়ে উঠেছিলেন, তেমন কিছু একটাই আমার মনে আঁকা ছিল। তাঁর বন্ধুরা কবে মরে সাফ। তিনি এতো তাজা, যার কি-না বউ মরে গেছে। একদম নির্ভেজাল একাকী জীবন। বলছিলেন, এই বাড়িতে একটা ডাক আসে। গ্রহীতার নাম অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, ওপরে লেখা “আশিতম জন্মদিনের শুভেচ্ছা”। তাঁকে দেখে নাকি বিলিকারী বলছিলেন, “না তুমি না। অলোকরঞ্জনকে ডাকো। তোমার ৬৫-এর বেশি হবে না।” বিলিকারী একজনের ৮০তম জন্মদিনের উপহার বিলি করবে বলে নিজে একটা ওয়াইন এনেছিল সেও উপহার দেবে। কিন্তু তাঁকে ৮০ বছরের বুড়ো বিশ্বাস করতে পারেনি। তাই তাঁর সামনে নিজেই ওয়াইনটা খেয়ে শেষ করেছে। তাঁকে একফোঁটাও দেয়নি।
দরজা থেকে পুরো বাড়ি কার্পেটে মোড়া। আমরা ঢুকেই জুতা খোলার চেষ্টা করলাম। তিনি জোর করে জুতাসহ ভেতরে নিয়ে বসালেন। বললেন, “বেশ ঠাণ্ডা। জুতা খোলা যাবে না।” দরজা থেকে ভেতর পর্যন্ত যেতে বললেন, “হানস, আমি কী বলে সম্বোধন করব, আপনি না তুমি?” উত্তরটা আমিই দিলাম, “আলবৎ তুমি।” ড্রয়িংরুমের আলোতে গিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ তো এক উজ্জ্বল বালক। তা তুমি সাতমাস ধরে এখানে আছ, আর এলে আজ? তাও আমাকে ডেকে আনতে হল?” আমি বললাম, “সাতমাস নয়, সাতসপ্তাহ। তবে মার্জনা চাই।” হানস বললেন, “অপরাধ আমার। দায়েন আসতে চেয়েছেন। আমি সময় পাইনি।” তিনি বললেন, “খবর দিতে, আমি যেতুম ওর কাছে।” অনেক গল্প-আড্ডা-ঠাট্টা-মস্করা মিলে সাক্ষাৎপর্বটা যেমন হয়ে উঠল তা আমার কাছে অফুরন্ত বিস্ময়। আমাকে কখনো উজ্জ্বল বালক, কখনো উজ্জ্বল কিশোর বলে সম্বোধন করছিলেন। কখনো কখনো প্রকাশ করছিলেন উচ্ছ্বাস। আমি ভাবছিলাম, এতো উ্চ্ছ্বাসের কারণ কী হতে পারে। পরে মনে হল, হানস হারডার সামনে একবিন্দু প্রসংশা না করলেও নিশ্চয়ই আড়ালে এমন সব কথাবার্তা বলেছেন যার ভার আমার পাওনা নয়। তিনি অনেক বলেন অনেক শুনতে চান। যতটুকু বলি উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন: “তুমি আগে কেন এলে না?” আমি তোমাকে কত জায়গায় নিয়ে যেতুম। কাসেলে থাকেন গুন্টারগ্রাস। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎটা হয়ে যেত। এই কথা শুনেই আমার বিমর্ষ হওয়ার অবস্থা!
টেবিলভর্তি প্রচুর খাবার-দাবার। শরীরভর্তি অদম্য বল। মনভরা রস আর ভালোবাসা। বারবার বলছেন, “সামনে যা আছে খাও, একটু পর ডালভাত খাবে। আজ তোমাদের যেতে দেব না। আমার এক পাতানো বোন আছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট থাকে। সে আর তার ডাক্তার মেয়ে এসেছিল। ওরা চাচ্ছিল আজ আমার কাছে থাকবে। তোমরা আসবে বলে ওদের থাকতে দিইনি।” আমার উপহার মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করে গ্রহণ করলেন। বললেন, “আমি তোমাকে কী দেব?” আমি বললাম, “যা-ই দেন প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করব।” বললেন, “দ্যাখো, আমার কাছে তিনরকম বই আছে। ক্রীত মানে কেনা, ধ্রীত মানে ধার করা আর ম্রীত মানে মেরে দেওয়া। তোমার জন্য অনেক খুঁজছি, ক্রীত বই কোথাও পাচ্ছি না।” অনেকক্ষণ পরে নিজের অনুবাদ করা “ব্রেশটের কবিতা ও গান” বইটা স্বাক্ষর করে দিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কথা আদান-প্রদানের মধ্যে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি বিভাগের অধিকারী?” আমি বললাম, “এই কিশোরের কি অধিকারী হওয়া মানায়?”
--- তবে অধিকারী কে?
বললাম, “অনিরুদ্ধ কাহালি।”
তিনি বললেন, “এমন টাইটেল তো শুনিনি। কোন ধর্ম?”
বললাম, “উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ হিন্দু।”
---তিনি কি লেখালেখি করেন?
বললাম, “তিনি কথাসাহিত্য বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখেন।”
---এর আগে কে অধিকারী ছিলেন?
--- খালেদ হোসাইন।
--- ওর কথা আমি শুনেছি। কবি খালেদ হোসাইন তো?
--- জ্বি। আজ আসার আগে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। আপনাকে সালাম জানাতে বলেছেন।
--- তাঁকে আমার বিনম্র প্রণাম আর কৃতজ্ঞতা পৌঁছে দিও।
আমাকে বললেন, “এ পর্যন্ত কতগুলো কবিতা লিখেছ?”
আমি বললাম, “খুব অল্প।”
তিনি বললেন, “ক’দিন পর যখন বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর হয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট বা বার্লিনে আসবে আমাদের চিনবে তো?”
আমি বললাম, “ওটা কোনোদিনই হবো না। সুতরাং না চেনার কোনো কারণ নেই।”
তিনি বললেন, “কথা দিয়ো না।’
আমি বললাম, “কথা দিলাম ওটা কখনো হবো না।’
আমি জীবনে কী কী করেছি তার অনেক কিছুই জানতে চাইলেন। বিশ্বদ্যিালয়ে প্রভোস্ট ছিলাম শুনে হেসে ফেটে পড়েন: “আহারে তোমার অনেক দুঃখ গেছে। প্রভোস্টকে ছাত্ররা কখনো ভালোবাসে না। তোমার মতো লোক কেন প্রভোস্ট হতে গেলে? “ বিস্তর হাসি-তামাসার মধ্যে প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গে বারবার বলেন, “তুমি আমাকে কথা দাও, আর কখনো প্রভোস্ট হবে না!“
তিনি বললেন, ‘‘বঙ্গবিদ্যা সম্মেলনে যাচ্ছ?”
আমি বললাম, “দাওয়াত পেয়েছি অনেক আগেই। কিন্তু জার্মানি আসাতে ওটা আর হচ্ছে না। ফিরে গিয়ে এতো দ্রুত ভিসা মিলবে না।”
--- আমার সঙ্গে চল। আমি নিয়ে যাব। দেখি কে ভিসা আটকায়। দেখ আমাদের সবকিছু ভেঙে ফেলতে হবে। ভাঙার সাহস আছে? আমি অনেক কষ্ট পাই, যখন ভাবি আমি বাংলাদেশের নাগরিক না। আমি যদি ভারত-বাংলাদেশ দু’দেশেরই নাগরিক হতে পারতাম! দেখ মাঝে মাঝে ভাবি, ভিসা ছাড়াই আমি ঢুকে পড়ি বাংলাদেশে। দেখি আমাকে তারা কী করে? যেই বাংলাদেশকে আমি প্রাণের গভীরে লালন করি, তাতে যাওয়ার ভিসা আমি কার কাছে চাইব?
উনি অনেকক্ষণ আনমনা হয়ে থাকলেন। পরে বললেন, “আমার একবার স্ট্রোক হয়। তাতে শারীরিক কিছু ক্ষতি হয়েছিল। সেটা সেরে গেছে। একবার একদল ছাত্র-ছাত্রীকে ভাষা শেখাতাম যারা স্ট্রোকের কারণে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। অবশ্য মাতৃভাষা হারায় না। আমি তো দেশ-বিদেশ ঘুরে বেশ ক’টা ভাষাই শিখেছি। এখন আমি চাই, আমার আরেকটা স্ট্রোক হোক। সেই স্ট্রোকে যেন আমার ভাষাগুলো হারিয়ে যায়। আমার মুখে থাকে শুধু বাংলা!
যে খাবার কেউ যাচে না
বিপ্লব কুমার হালদার
কবে প্রথম মার খেয়েছিলাম ঠিক মনে নেই। তবে আন্দাজ করতে পারি, প্রথমবার মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়ত মায়ের কাছেই হবে, পেটে কৃমি হবার ভয়কে উপেক্ষা করে ক্রমাগত খেজুর গুড় খাওয়ার জন্য অথবা প্রচণ্ড গরমে ঘোলা জলের পুকুরে ৩ ঘন্টা ধরে জলকেলীর জন্য। শিক্ষাজীবন শুরুই হয় পরিবার থেকে। আর মার ছাড়া শিক্ষা, অসম্ভব! প্রাইমারী স্কুলে থাকতে দ্বীনবন্ধু স্যার প্রকৃতি প্রদত্ত কোনো গুল্মের উপর ভরসা না করে ভগবান প্রদত্ত হাতখানার ব্যবহারে সচেষ্ট ছিলেন। মুষ্টিবদ্ধ হাতের যে অংশে আঙুলের গোড়ার অংশ বেশ শক্ত সেই অংশটি দ্বারা মাথায় ঠোনা দেয়া ছিল স্যারের প্রিয় শাস্তি। এছাড়া ছিল পেটের পাতলা চামড়া ধরে মোচড়ানো, কান দিয়ে সিঙ্গারা বানানো, দুই আঙুলের ফাঁকে কলম রেখে আঙ্গুলে চাপ দেয়া সহ আরও অসংখ্য সৃজনশীল পদ্ধতি (অ.ট. শুনেছি এখন নাকি স্কুলে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পড়ানো হয়, আমি নিশ্চিত এটা বেশ ভালোভাবেই চলছে)। হেড স্যার ক্লাস ফাইভে এসে বিশেষ করে টেনস্ পড়াতে গিয়ে হরহামেশাই আমাদের টেনশানে ফেলতেন, এই বুঝি প্রেজেন্ট পারফেক্ট কন্টিনিউয়াস টেনস্ এর দুটি উদাহরণ দিতে বলবেন আর আমি ভুল করে রোগী আসিবার পূর্বেই ডাক্তারকে মারিয়া ফেলি। ফলস্বরূপ চমৎকার পলিশ করা বেতের আদর অথবা নীলডাউন। মাখন স্যার পছন্দ করতেন ‘গজবুহই‘ নামক একধরনের বুনো গাছের লাঠি। সমাজ কাকে বলে এই প্রশ্নের উত্তরে সমাসের সংজ্ঞা দেবার জন্য প্রায়শই এই লাঠি ভাঙার কাজ আমাদের করতে হত। স্যারের হুকুমে মহা উৎসাহে আমরা লাঠি ভেঙে নিয়ে আসতাম স্যারকে দিয়ে বন্ধুরূপী শত্রুদের শায়েস্তা করার জন্য। এই দুষ্ট চক্র অবশ্য রিসিপ্রোকাল রিলেশান মেনে চলে সবার উপরেই ফিরে আসত।গজবুহই ডালের মার প্রকৃতপক্ষেই গুরুপাক! চারজন শিক্ষকের মধ্যে একজন শিক্ষক ছিলেন আমার মা নিজে। মারের চেয়ে মা সম্ভাব্য শাস্তির রূপরেখা দিতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কোনো এক অজানা কারনে মা‘র ক্লাশে এইসব নিয়ে চিন্তা করতাম না!!!তবে, আমি কারও বিরূদ্ধে মায়ের কাছে অভিযোগ করতে গেলেও উল্টা আমাকেই মার খেতে হত মাঝে মাঝে। আমার প্রাইমারী স্কুলের সব শিক্ষকই বেশ সুস্থ্য আছেন এখনও। এবারে আসি হাইস্কুলের কথায়, হিন্দু ধর্ম শিক্ষা বইয়ের সংস্কৃত শ্লোক ভুল পড়ার জন্য পণ্ডিত স্যারের মার। বাড়ীর কাজ না করার জন্য মহাবুব স্যারের মার। হাতের লেখা না লেখার জন্য গজেন স্যার মৃনাল স্যার এর যথাক্রমে বাংলা ও ইংলিশ মার। মারের জন্য এক একজন স্যারের পছন্দের জায়গা ছিল এক একটি। কেউ মারত হাতে, কেউ পিঠে আবার কেউ বা পশ্চাত...। এবারে বলি আমাদের দু‘জন চাইল্ডহুড হিরোর কথা, চাইল্ডহুড হিরো ১. ওকে পড়া জিজ্ঞেস করলে বেশীর ভাগ সময়ই পড়া মুখস্ত বলার বদলে অনায়াসে হাতদুটো সামনে চলে আসত। স্যারও কথা না বাড়িয়ে সপাং সপাং.....। ওর ক্ষেত্রে এটা একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। পরে ওর হাত দেখে আবিষ্কার করেছিলাম ওর হাত লোহার মত শক্ত। বেতের আঘাতে খুব একটা ব্যথা পায় না, শুধু মার শেষ হলে হাতদুটোকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় একটু ম্যাসাজ করিয়ে নিত। ও নাকি গৃহকর্মে ওর বাবা মাকে খুব সাহায্য করত। মাটি কাটা থেকে শুরু করে হালচাষ সবকিছু। অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা কয়েকদিন চেষ্টা করেছিলাম, পরে বুঝেছি ওটা ওর অনেক সাধনার ফসল, আমাদের দিয়ে হবে না। চাইল্ডহুড হিরো ২. ক্লাশ বাদ দিয়ে কড়ই গাছের কোটর থেকে একবার টিয়া পাখির বাচ্চা নামাতে গিয়ে কট খেয়ে গেল আশরাফ। আমাদের কোনো একজনের বিশ্বাসঘাতকতা অথবা স্যারের প্রতি প্রবল আনুগত্যের দায় মেটাতে হল বেচারাকে। আমরা সবাই স্যারের সঙ্গে বাজারের অপর পাশে কড়ই গাছের নীচে গেলাম। স্যার ওকে ভালোয় ভালোয় নামতে বললেন। প্রথমে একটু গাইগুই করলেও অবস্থা বেগতিক দেখে নেমে পরল আশরাফ। হাতে টিয়া পাখির বাচ্চা। বড় সাধ, টিয়া পাখিকে কথা বলতে শেখাবে, ‘ভক্ত, তক্ত ভাত-তক্ত ভাত‘ (‘তুই রাজাকার না‘, এইটা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ গল্প)। আশরাফকে ক্লাশরুমে না নিয়ে লাইব্রেরীতে (শিক্ষকদের বসার জায়গাকে লাইব্রেরী বলা হত) নিয়ে যেতে দেখে বুঝলাম, ঘটনা খারাপ। আমাদের শঙ্কা বাস্তবে প্রমাণিত হল যখন স্যার আলমারী থেকে জোড়া বেত বের করতে বললেন। সিঙ্গেল বেত টেবিলের উপর থাকলেও কিছুটা সমীহ করে জোড়া বেত রাখা হত আলমারীতে, সবার অগোচরে। ঠিক যে কারণে আমাদের ইন্টেলিজেন্স স্কোয়াডগুলোর অবস্থান কেউ কোনোদিন জানে না। কেউ জানে না সোয়াট কী বা এসএসএফ, ইউ এস নেভি কমান্ডো এর কী কাজ। যা বলছিলাম, আশরাফকে জোড়া বেতের শাস্তি দেয়া হল। পরে দেখেছি ও পাশ্ববর্তী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে গেছে। জানি না, জোড়া বেতের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না কি আধ্যাত্মিক উপলব্ধি! গ্রামের স্কুল বদল করে মফস্বলের স্কুলে গিয়ে দেখলাম প্রাইমারীর ফার্স্ট বয় ওখানে নস্যি। হাই স্কুলের মারের কথা মনে পড়লে এখনও রহমান স্যারের কথা মনে হয়। গুজব ছিল, স্যার নাকি কোনো এক থানার দারোগা ছিলেন। বেদম পিটিয়ে চোর মেরে ফেলার জন্য নাকি তার চাকরী চলে যায়। গুজবের সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করিনি কখনও, কারণ স্যারের কথাবার্তা আর মারের কল্যানে আমরা গুজবটিকে স্বতঃস্বিদ্ধ বলেই ধরে নিতাম। অনেক সময়েই ভয়ে লেইজার এর পরে স্যারের ক্লাশে না এসে বাসায় গিয়ে ধর্মচর্চা করতাম ভগবানকে তুষ্ট করার জন্য। কিন্তু ভগবান আমাদের কথা না শুনে বরং উল্টা স্যারকে ম্যালথাসের সূত্র মনে করিয়ে দিত, একদিন ক্লাশে না যাবার জন্য জ্যামিতিক হারে শাস্তি বৃদ্ধি হত। অর্থ্যাৎ, পাওনা মার, প্লাস ক্লাশে না আসার মার, প্লাস অনুপস্থিত ক্লাশের কাজ না করার জন্য মার। স্যার অংকে খুব ভালো ছিলেন। এবার অন্য এক বিএসসি স্যারের কথা বলি, ক্লাশে অমনযোগী হলে শংকর স্যার চকের টুকরা ছুড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করত। স্যারের হাত যশ ছিল বলার মত। প্রায়শই বাইরে গরুর ঘাস খাওয়ার দৃশ্য অবলোকনকারী ছাত্রের মাথা ছিল স্যারের নিখুঁত নিশানা। স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে যাবার বিষয়টা একবার আঁচ করে ফেললেন মালেক স্যার।দলবেধে ‘রুবেল আমার নাম’ সিনেমা দেখতে গেলাম।বন্ধু ছগীর ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে সবার কাছ থেকে বিশ টাকা করে তুলে কাউন্টারে হাত বাড়িয়ে দিল। টিকেট দেবার বদলে খপ করে ছগীরের হাত ধরে ফেললেন মালেক স্যার।‘কট রেড হ্যান্ডেড’ নামে একটা ফ্রেজ শিখেছিলাম স্যারের কাছ থেকে, উনি এভাবে তার প্রয়োগ ঘটাবেন তা স্বপ্নেও ভাবিনি। ভুত দেখার মত করে চমকে উঠে আমাদের সাহসী ছগীর সেই যে দৌড় দিয়েছিল তার ঘোর কাটতেও ওর অনেক সময় লেগেছিল। পরেরদিন প্রত্যেক ২০ বেত আর কান ধরে উঠবস হজম করার পর মোটামুটি তার একটা রফা হল। কলেজে উঠে শিখলাম যে, এখানে কোন বেত নেই। যাক বাঁচা গেল। কিন্ত শাস্তি না থাকার জন্য চোখের সামনে উচ্ছন্নে গেল অনেকেই। অবাধ স্বাধীনতা যে!! ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার পরে বুঝতে পারলাম যে, স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা করেছি। ভাগ্যক্রমে নিজের ভালো নিজে বুঝেছিলাম, নিজেকে কিছুটা হলেও বাধ্য করেছিলাম স্বাধীনতার গণ্ডি ঠিক করে দিয়ে। শিক্ষকদের মার না থাকলেও কলেজে রাজনৈতিক মারের রেওয়াজ ছিল যদিও এটা খাবার সৌভাগ্য আমার একবারও হয়নি। আমাদের সময়ে হকিস্টিকধারী ক্যাডারকে বেশ সমীহের সঙ্গে দেখা হত। সময় বদলে গেছে, এখন হয়ত ক্যাডাররা রকেট লাঞ্চার নিয়ে ঘুরলেও মানুষ আর অবাক হয় না!!
শিক্ষণীয় মার এর কথায় ফিরে আসি। আমি নিশ্চিত, আমার এই শিক্ষকগন কেউই জন ডিউই, জ্যাক রুশো, হার্বাট স্পেন্সার বা আমাদের রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনীয় শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহল ছিলেন না। তবে তারা অন্তত এটুকু জানতেন যে, কিভাবে শাসন করতে হয় আবার কিভাবে ভালোবাসতে হয়। এই স্যারেরাই আদর করে জিজ্ঞেস করত আজ কী দিয়ে ভাত খেয়েছি, অথবা আমার দাদা কেমন আছেন। যেসব শিক্ষকের শাস্তিপদ্ধতি সম্পর্কে এতক্ষণ বললাম ওনারাই আমার সর্বাপেক্ষা সম্মানীয় শিক্ষক। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি ওনারা শাস্তি না দিলে হয়ত আজ যেটুকু অর্জন করেছি তা অনার্জিতই থেকে যেত। উল্লেখিত স্যারদের কথা মনে হলে এখনও শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন সবসময় চাইব সৃষ্টিকর্তা যেন ওনাদের সমসময় ভালো রাখেন, সম্মানে রাখেন। আমরা একটা কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম, স্যারদের মার নাকি আশির্বাদ সরূপ। যদিও তখন আমরা কেউই এই আশির্বাদের আশা করতাম না। আমরা এখন যে যুগে বাস করছি সে যুগে শিক্ষাদর্শনের প্রচার ও প্রসারের কল্যাণে প্রাইমারী স্কুলে বেতের বদলে শোভা পাচ্ছে বাহারী রকমের খেলার সামগ্রী। বেশ ভালো কথা, শাস্তি দিয়ে শিক্ষা হয় না। শারিরীক শাস্তিকে হাইকোর্ট এর মাধ্যমে নিষিদ্ধও করা হয়েছে।
ভাবছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাদ দিলাম কেন? চিন্তা করে দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে কোনো কিছু লিখব না। একটা কারণ হতে পারে, হয়ত ছেলেবেলার রিসিপ্রোকাল রিলেশানকে এখন ভালোভাবে বুঝতে শিখেছি। যেহেতু নিজে একজন শিক্ষক, আমার স্টুডেন্টরাও আমাকে নিয়ে ইচ্ছেমত লিখতে পারে, তাই না লেখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ! দ্বিতীয় কারণটা হল, আমার স্যারেরা অনেকেই আমার ফেসবুক বন্ধু, আমি মানুষ সুবিধার না, স্যাররা যে মুক্তচিন্তাটুকু শিখিয়েছেন তা ভুলে গিয়ে হয়ত কোনো এক কঠিন সময়ের স্মৃতিচারণ করে ফেলব। তবে, একটা কথা না বলে পারছিনা, ক্লাশে প্রশ্ন করার পর একজন স্যার এমনভাবে বলেছিলেন যে প্রশ্নটা অপ্রাসঙ্গিক, এর পর থেকে স্যারের ক্লাশে প্রশ্ন করার আগে দশবার ভাবতাম। ভেবেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মার বুঝি এইরকমই। তৃতীয় কারণটি হল, স্যাররা কখনও আমাকে মারেননি, আই মিন গায়ে হাত তোলেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়ে হাত তোলা স্বাভাবিক কোনো কথাও নয়। সকালের রোদে ভিটামিন ডি থাকলেও দুপুরের রোদে অতিবেগুনি রশ্মি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না।
নির্ঘন্ট
ঠোনা- ঘুসি প্রজাতির একপ্রকার মার যেখানে ফোর্স এর চেয়ে কৌশলকে গুরুত্ব দেয়া হয়। লেস ডেভাসটাটিং।
নীলডাউন: একটা ইংরেজী ফ্রেজ। স্যারদের বহুল উচ্চারিত একটা ফ্রেজ। অর্থ- হাটু ভেঙে বসা, প্রায়শঃই শক্ত কোন কিছুর উপরে। বেঞ্চ বা ফ্লোর।
গজবুহই: এক ধরনের গাছ যা কোন কাজেই লাগেনা। বেতের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হত স্কুলে। জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার ছাড়া খুব সম্ভব আমাদের মার দেয়াটাই ছিল এর সর্বোচ্চ ইউটিলিটি।
লেইজার: টিফিন পিরিয়ড কে আমরা লেইজার বলতাম। শব্দটির পুঁথিগত অর্থের সাথে এর বাস্তবিক অর্থ বেশ সাংঘর্ষিক ছিল।
ভোরের শিশির : স্মৃতিকথা
অস্ট্রেলিয়ায় এখনো 'গো ব্যাক টু হয়ার ইউ কাম ফ্রম' বিতর্ক?
-আশরাফুল আলম
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মেলবোর্নের সেন্ট আলবানস লাইব্রেরীতে এক লেখক-আড্ডায় নিজের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিলেন স্বনামখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান লেখিকা এলিস পাং। এলিস দ্বিতীয় প্রজন্মের এশিয়ান অভিবাসী, অভিবাসন নিয়েই মূলত লেখেন, এবং সেটা শুধু এশিয়ানদের নিয়ে নয়, সব অভিবাসীদেরকে নিয়েই। তার যখন বয়স দশ বছর, তার মানে আশির দশকের শুরুর দিকে, তখন তাদের পরিবার থাকত ব্রেব্রুক এলাকায়। ওখানে একদিন বিকেলে খেলার মাঠ থেকে ফেরার সময় হঠাতই একটি গাড়ী এসে তার পাশে থামে, জানালা দিয়ে একটা বয়স্ক মতন লোক গলা বের করে চীৎকার করে ওঠে - হেই ইউ, গো ব্যাক টু ইয়োর হোম। গো ব্যাক টু হয়ার ইউ কাম ফ্রম।
আশির দশক একটা অস্থির সময় অস্ট্রেলিয়ার জন্য। দীর্ঘদিনের সাদা-অধ্যুষিত অস্ট্রেলিয়া তার আগ-পর্যন্ত কেবল অল্পকিছু অ-সাদা অভিবাসী দেখেছে। আশির দশকে বানের জলের মতন আসতে থাকে ভিয়েতনামিজ রিফিউজিরা, আসতে থাকে উপমহাদেশের নানান দেশের মানুষেরা। রাস্তাঘাটে, শপিংমলে, বাসে-ট্রামে তাদেরকে দেখা যেতে থাকল আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশী হারে। ফলে অনেক অস্ট্রেলিয়ানের চোখে একটা কালার-শক হওয়াটা অসম্ভব নয়। সবাই তো আর উদার বিশ্বপ্রেমিক নয়; সব সমাজেই বহিরাগতদের ব্যাপারে শুরুতে বেশ খানিকটা সন্দেহ আর বিদ্বেষ থাকে, বিশেষ করে সেই বহিরাগতরা যদি দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে খুব আলাদা হয়। ভেতরে ভেতরে সব মানুষই আসলে এক, কিন্তু এসব দার্শনিক তত্ত্বকথার ধার বেশী লোক ধারেন না।
গত তিন দশকে মারে-ডার্লিং নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে। অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়েছে ক্রমবর্ধমানহারে। অস্ট্রেলিয়া এখন মাল্টিকালচারাল; বহুসংস্কৃতির মিলনমেলা। তবে এখনো এলিসের মতন অভিজ্ঞতা একেবারে বিরল নয়। এই সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তেমনি এক ঘটনা হৈচৈ ফেলে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়াতে। ফাওয়াদ আহমেদ, এলিসের প্রায় সমবয়সী, জন্মেছিলেন উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানে। ইসলামিক উগ্রপন্থী তালিবানদের ভয়ে রিফিউজি হিসেবে দেশ ছেড়েছেন ২০১০ সালে, অস্ট্রেলিয়ায় এসে তার ক্রিকেটীয় দক্ষতার গুণেই এ বছর এখানকার নাগরিকত্ব পেয়েছেন বেশ তড়িঘড়ি করে, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম সময়ে। খেলেছেন স্থানীয় পর্যায়ের ক্রিকেটে, বিগ-ব্যাশ টি-টুয়েন্টি লীগে। অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলে ডাকও পেয়েছেন সম্প্রতি। উসমান খাজার পরে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা মাত্র দ্বিতীয় মুসলিম, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে এখন খেলছেন ইংল্যান্ডে। অস্ট্রেলিয়ান দলের প্রধান স্পন্সর কার্লটন ইউনাইটেড বিয়ার কোম্পানীর লোগোওয়ালা শার্ট পড়তে অসম্মতিজ্ঞাপন করায় ফেসবুকে টুইটারে সম্প্রতি অনেকেই তাকে বীরদর্পে 'গো ব্যাক টু হয়ার ইউ কাম ফ্রম' শুনিয়ে দিয়েছেন।
এলিস অবশ্য সেই সময় বুঝতে পারেননি যে, তার 'হোম' আবার কোথায়। তাকে কোথায় ফিরে যেতে বলছিল ওই পথচারী। যেহেতু অস্ট্রেলিয়াতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সেই কারণেই তার মনে হয়েছিল যে, তার অধিকার এখানে আর কারো চেয়ে কম নয়। কাজেই বিষয়টা তার স্মরণে আছে বটে, তবে গায়ে ততখানি লাগেনি। ফাওয়াদ আহমেদের ব্যাপারটা একটু আলাদা- জীবনের একটা বড় অংশ পাকিস্তানে কাটিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছেন রিফিউজি হিসেবে। কাজেই, আইনগতভাবে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হলেও, 'গো ব্যাক টু হয়ার ইউ কাম ফ্রম' তার গায়ে যে লাগেনি সে কথা বলার উপায় নেই। শুধু সাধারণ মানুষেরা নয়, ফাওয়াদ আহমেদকে নিয়ে এ ধরনের কথা বলেছেন বেশ নামীদামী লোকেরা। পত্রিকায় ব্লগে টিভিতে খেলার মাঠে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে এই নিয়ে। এলিসের মতন এক বিকেলে নাম-না-জানা এক পথচারী শুধু নয়, ফাওয়াদের ইস্যুতে ক্রিকেট-রাগবির সাবেক কিংবদন্তীরা মাঠ গরম করছেন নানান রকমের বাণী দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ানরা সপ্তাহের পাঁচ দিন কাজ করে, বাকী দুই দিন বিয়ার খায় বলে একটা কথা আছে। অস্ট্রেলিয়ার এসে বিয়ার না খাও, অন্তত বিয়ারকে সন্মান করো- বিয়ারের সঙ্গে সহাবস্থান করো, এই হল তাদের মত।
১৯৮০ সালে নয়, ঘটনাটা ঘটেছে ২০১৩ সালে। ব্যাপারটা ভাববার বিষয়। অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকেরই নিজেদের অথবা তাদের পিতামাতার জন্ম বিদেশে। প্রায় একশটি ভাষায় কথা বলে অস্ট্রেলিয়ার মানুষেরা- নানান বর্ণের, নানান ধর্মের। সরকার নীতিমালা দিয়ে এবং আর্থিক সহায়তা দিয়ে অভিবাসীদেরকে নিজেদের সংস্কৃতি ও ধর্ম পালন করতে সহায়তা করে। নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এখানকার মাল্টিকালচারিজম স্থিরতা পেয়েছে, আদল পেয়েছে। কাজেই, যে যাই বলুক, ফাওয়াদ আহমেদের 'হোম' আসলে অস্ট্রেলিয়াই। আর অস্ট্রেলিয়া বলেই এখানে শুধু ক্রিকেটীয় মেধাতেই ক্রিকেট দলে জায়গা পাওয়া যায়, তা আপনি সমাজের মেজরিটি বা মাইনরিটি যে অংশের লোকই হোন না কেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সব জায়গাতেই কিছু লোক থাকবে, যারা উগ্র জাতীয়তাবাদী- এদের সঙ্গে ঢাকার লোকাল বাসের একধরনের যাত্রীদের মিল খুঁজে পাই আমি। ফার্মগেটে যে লোক বাসে তিলধারনের স্থান না থাকা সত্বেও ঠেলেঠুলে বাসে উঠেছেন, বাকী যাত্রীদের 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই' রব উপেক্ষা করে, সেই একই লোক পরের স্টপেজে উচ্চকন্ঠে 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই' জপতে থাকেন, যাতে বাসে আর কেউ না ওঠে।
সিডনীর টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ফাওয়াদের বিয়ার কোম্পানীর লোগোসম্বলিত শার্ট না পরার সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা রিপোর্ট হয়েছিল, যেখানে সাবেক টেস্ট খেলোয়াড় ডাউ ওয়াল্টার্স বলেন, 'আমার ধারণা ফাওয়াদ যদি দলের পোশাক না পড়তে চায়, তাহলে তাকে দলে নেওয়া উচিত না। অবশ্য সে যদি পারিশ্রমিক নিতে না চায়, সেটা অন্য কথা।' এই ওয়াল্টার্স ১৯৭০ সালে এশেজের উদ্দেশে ইংল্যান্ডে যাওয়ার সময় বিমানে মাত্র কয়েক ঘন্টায় ৪৪ ক্যান বিয়ার গিলেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে! এর পরে মুখ খোলেন সাবেক রাগবি খেলোয়ার ডেভিড ক্যাম্পসি - যিনি টুইটারে ডাউ ওয়াল্টার্সকে সমর্থন করে বলেন, 'ওকে বাড়ি ফিরে যেতে বলো'। টাকা পয়সার কথাটা উঠেছে এই কারণে যে, ক্রিকেটারেরা যে মোটা অংকের বেতন পায়, সেটা স্পন্সরদের টাকা থেকেই আসে, আর আজকালকার দিনে বিয়ার ও সিগারেট বিক্রেতারা পয়সার বস্তা নিয়ে খেলাধুলায় ঢালে, সে তো আমরা দেখছি। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া যদি একজন ক্রিকেটারকে স্পন্সরের লোগো ছাড়াই খেলার অনুমতি দেয়, তাহলে স্পন্সরেরা পয়সা কম দিতে পারে, কেননা মাঠে ও টেলিভিশনের পর্দায় তাদের 'জীবন্ত বিলবোর্ড' এর এগারো ভাগের এক ভাগ তখন ফাঁকা। কেউ কেউ বলছেন বিয়ার হল অস্ট্রেলিয়ান সংস্কৃতির একটা অপরিহার্য উপাদান।
এইসব ঘটনার পরে আমার আশেপাশের অনেকেই বলা শুরু করেছেন যে, অস্ট্রেলিয়ানরা কত বর্ণবাদী। সন্দেহ নেই, অস্ট্রেলিয়ানরা হয়তো কিছুটা বর্ণবাদী- আসলে আমরা সবাই একটু আধটু বর্ণবাদী, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে। তবে অস্ট্রেলিয়ানরা ভাগ্যবান যে, এদের কাণ্ডারীরা ঠিক ততটা বর্ণবাদী নয়। শতভাগ সাদাদের দেশে একজন সাদা সরকারপ্রধান নিজের গরজে 'সাদা অস্ট্রেলিয়া নীতি' বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একজন সাদা সরকারপ্রধান এদেশের আদিবাসীদের প্রতি কৃত অন্যায় অবিচারের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, আর্থিক ক্ষতিপূরণের পথও খুলে দিয়েছেন। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাদের স্পন্সরকে বলে দিয়েছে যে, তোমরা পয়সা দাও আর না দাও, ফাওয়াদকে আমরা সমর্থন করি। কার্লটন ইউনাইটেডও ফাওয়াদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। মনে করিয়ে দিই, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার তদবীরের কারণেই ফাওয়াদ অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়ার পরে বেশ তড়িঘড়ি করে মাত্র আট মাসের মাথায় গত জুলাইতে নাগরিকত্ব পান। অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়াতে ফাওয়াদকে নিয়ে এই শোরগোলের একটা কড়া জবাব দিয়েছেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান জেমস সাদারল্যান্ড এভাবে :
"এই সমস্ত মন্তব্য আসলে অবান্তর, এবং অস্ট্রেলিয়ান সমাজের একটা খারাপ চিত্র এতে ফুটে ওঠে। ফাওয়াদ একজন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার, এবং এই দেশের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার আর সবার মতই তারও আছে। গত জুলাইতে সে নাগরিকত্ব পেয়েছে, এখন তার একটি অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট আছে, এবং সে অস্ট্রেলিয়াকে তার নিজের দেশ হিসেবে আপন করে নিয়েছে সঙ্গত কারণে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত সবাই তাকে স্বাগত জানিয়েছে, এবং আমরা তাকে পেয়ে গর্বিত। কারো ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পরিচয় যাই হোক না কেন, প্রতিটি অস্ট্রেলিয়ানেরই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ক্রিকেট খেলার অধিকার আছে, এবং যারা এই খেলায় ভালো তাদেরকে আমরা আমাদের দলে চাই।"
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে যে, ক্রিকেটের মাঠে জিততে হলে স্পন্সরের টাকার বস্তা নয়, দলের দক্ষতা আর সংহতি দরকার। ক্রমবর্ধমানহারে মাল্টিকালচারাল হতে থাকা অস্ট্রেলিয়া যদি তাদের হাতে থাকা সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার না করে, অস্ট্রেলিয়ান দল দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকবে। এক দশক আগে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার এক কনফারেন্সে একজন বক্তা বলেছিলেন, অস্ট্রেলিয়া যদি তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বহুজাতিক সমাজকে ক্রিকেটে আগ্রহী না করতে পারে, তাহলে অস্ট্রেলিয়াতে ক্রিকেটের ভবিষ্যত খুব ভালো নয়। তাদের টনক তখনই নড়েছিল। পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত উসমান খাজা এখানকার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের একজন নামী খেলোয়াড়। আজকাল শ্রীলংকার অনেক অভিবাসী স্থানীয় পর্যায়ের ক্রিকেটে খেলেন- তারাও নিশ্চয়ই একসময় প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এবং জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন। এভাবেই অভিবাসীরা অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজনেই অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিত্ব করবেন সমাজের সকল ক্ষেত্রে। যা হোক, ডেভিড ক্যাম্পসি চাপের মুখে পরে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। এই এক সপ্তাহের যে ডামাডোল, তাতে করে এই ক্ষমা প্রার্থনাটা একটা হাস্যকর ব্যাপার দাঁড়িয়ে গেছে- এর আগেও আমরা দেখেছি হাশিম আমলাকে নিয়ে ডীন জোনসের আপত্তিকর মন্তব্য, অল্পক্ষণ পরেই ক্ষমা প্রার্থনা। তবে তাতে করে কাজ যা হবার সেটা হয়ে গেছে- অস্ট্রেলিয়ার জনগণ বুঝতে পেরেছে যে অস্ট্রেলিয়া বদলাচ্ছে। একে পেছনের দিকে ফেরানোর পথ নেই। সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী টনি এবট নৌকা বন্ধ করতে পারবেন কিনা জানিনা, তবে অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক পরিবর্তন, যেটা সূচিত হয়েছিল সত্তরের দশকে সাদা অস্ট্রেলিয়া নীতি তুলে নেওয়ার সময়ে, সেটা এক উল্টানো-অসম্ভব প্রক্রিয়া। এলিসেরা আজ আর ওয়ান্ডারল্যান্ডে নেই, তারা তাদের 'হোমে'ই আছে। অস্ট্রেলিয়াই এলিসদের কিম্বা ফাওয়াদদের 'হোম'। ইংল্যান্ডের ক্রিকেট দলে সাউথ আফ্রিকায় বা পাকিস্তানে-ভারতে জন্ম নেওয়া অনেক ক্রিকেটার আছেন। কই, তাদেরকে তো কেউ 'গো ব্যাক টু হয়ার ইউ কাম ফ্রম' বলে না? এর একটা কারণ সম্ভবত এই যে, ব্রিটেন অনেক আগে থেকে মাল্টিকালচারাল। আমেরিকায় কেউ কাউকে আর 'গো ব্যাক টু হয়ার ইউ কাম ফ্রম' বলে না, সেও একই কারণে। অস্ট্রেলিয়ার মাল্টিকালচারাল অভিজ্ঞতা এখনো এক প্রজন্ম পেরোয়নি এখনো। গ্রোয়িং পেইন তো কিছু থাকবেই।
মঞ্চে রাজাকারের ভূমিকায় অভিনয় করা এক অভিনেতা একবার বলেছিলেন, একেকটা মঞ্চায়নের পরে তার কাছে অনেক অচেনা মানুষ এসে অভিনয়ের প্রশংসা করে, এবং পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে, ভাবখানা এমন, যেন ওই অভিনেতা বাস্তবেও একজন রাজাকার। তাকে যেহেতু মঞ্চে রাজাকারের ভূমিকায় দেখা গেছে, সেকারণেই সম্ভবত কিছু রাজাকারপন্থী মানুষ তাকে কাছের মানুষ বলে মনে করেন এবং মনের গোপন কথা খুলে বলতে দ্বিধা করেন না। আজকের অস্ট্রেলিয়ান রাজনীতিতে, বিশেষ করে নির্বাচনী মৌসুমে, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ব্যাপারে কে কত বেশী খড়গহস্ত হতে পারেন সেটা যখন ভোট পাওয়ার একটা মোক্ষম অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন যে কিছু সাধারণ মানুষ (এবং কিছু অসাধারণ মানুষ, যেমন সাবেক ক্রিকেটার ও রাগবি খেলোয়াড়) যে অভিবাসীদের ব্যাপারে চুন থেকে পান খসলেই তাদের নিজেদের মনের গোপন কথাগুলো জনসমক্ষে বলার সাহস করবেন, সেটাও স্বাভাবিক। তবে যা হয়েছে, খুব খারাপ হয়নি। অস্ট্রেলিয়ান বলতে কি বুঝায়, অস্ট্রেলিয়ান হতে হলে বা অস্ট্রেলিয়াকে রিপ্রেজেন্ট করতে হলে কি করতে হবে বা কি হতে হবে, তার কোনো চুড়ান্ত ফয়সালা হয়তো হয়নি এই ঘটনার ফলে, তবে ক্রিকেটার ফাওয়াদ আহমেদের 'অস্ট্রেলিয়ান' হওয়ায় কেউ বাধ সাধতে পারেনি। না মিডিয়া, না বিয়ার কোম্পানীর লোগো। অস্ট্রেলিয়া বদলাচ্ছে বেশ দ্রুত, এবং সম্ভবত এই বদলানোর প্রক্রিয়া আর বেশিদিন এখানকার মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে অবাক করবে না।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
ashru12@yahoo.com
একজন প্রিয় স্যার
আসাদ
ঢাবিতে একটি সেমিনার দিতে যাই। সেমিনারটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল আমার প্রিয় মুখগুলোকে আবার দেখা- এর কিছুদিন আগেই আমি ঢাবির চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছি। সেমিনারে বেশ কয়েকজন স্যার এসেছিলেন। সেমিনার শেষে স্যারদের সাথে কথা হল। পুরানো কিছু ছাত্রের সাথে দেখা হলো। খুব ভালো লাগল। কবির স্যার আমার সেমিনার শেষে এসেছিলেন।স্যারের সাথে কথা শেষ করে মোকার্রম ভবন থেকে চলে আসি কার্জন হলে। ডিপার্টমেন্টের বেশ বড় একটা অংশ মোকার্রম ভবনে। কিন্তু ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট বলতে আমরা এখনো কার্জন হলই বুঝি। কার্জন হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরো কিছু পুরানো ছাত্রের সাথে কথা বলছিলাম। ওদেরকে আমি ফোর্থইয়ারে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স পড়িয়েছি। পড়ানোর বাইরে ওদের সাথে দুটো এক্সকারশনে গেছি। একটা ডিপার্টমেন্টের হয়ে, আরেকটার আমি নিজেই ব্যবস্থা করেছিলাম। ওদের সাথে আমার বেড়ানোর সময়টা গেছে এককথায়- উপভোগ্য। এরপর থেকেই ওদের প্রতি আমার অনুভূতিটা ঠিক ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাই কার্জন হলের মাঠে বসে ওদের সাথে গল্প করতে চাই। ওরা রাজী হয়ে যায় আমার প্রস্তাবে। আমরা আরো অনেকের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এর মাঝে আমি আর দিহান কথা বলছিলাম কোর্স আর কোর্স টিচার নিয়ে। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করি ওর প্রিয় টিচার কে।মনে একটি সুপ্ত বাসনা ছিল- আমার নামটা ও বলুক। ওদের প্রতি আমার নিজস্ব যে অনুভূতি তা থেকেই ভেবেছিলাম কথাটা। ও খুব হাসিমুখেই বলল- ওর প্রিয় স্যার হল কবির স্যার। আমার এতে অবাক লাগে না- ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের যে কোনো ছাত্রছাত্রীই যেন এই উত্তরই দিবে। আমার নিজের প্রিয় স্যার হবার সুপ্ত বাসনার আর বিন্দু পরিমাণ অবশিষ্ট নেই। দিহানকে আর কথা বলতে দেই না। আমিই বলে যাই কবির স্যারের নানা কথা। কবির স্যার শুধু আমার আর দিহানের প্রিয় না। তিনি যাদেরই ক্লাস নিয়েছেন তাদেরই প্রিয় স্যার হয়ে গেছেন। যারা স্যারের কোর্স নিয়ে ভালো করেছে তাদের প্রিয় স্যার তিনি। যারা ফেল করেছে তাদেরও প্রিয় স্যার। যাদেরকে হঠাৎ রেগে বকা দিয়েছেন অথবা যাদেরকে কখনই বকা দেননি তারাও স্যারকে প্রিয় মনে করে। শুধু ঢাবিতে তিনি প্রিয়স্যার না। এনএসইউ তে পড়িয়েছেন- ওখানেও সবার প্রিয় ছিলেন। যেখানেই তিনি পড়ান সেখানেই হয়ে যান প্রিয় স্যার। এখানে ওখানে এর ওর প্রিয় স্যার হতে হতে তিনি হয়ে গেছেন একজন প্রিয় স্যার।
সেদিন আমরা কার্জন হলের মাঠে বসে দুপুরে খেয়েছিলাম। আমেনা ম্যাডাম, ইউসুফ স্যার এবং কবির স্যার ও ছিলেন। ওনারা তিনজন আবার ঢাবিতে পড়ার সময় ক্লাসমেট ছিলেন এবং তিনজনই আমার প্রিয়। আমাদের সাথে আরো যোগ দিয়েছিলেন দস্তগীর, নওরীন আপা এবং জিয়া ভাই। সবাই মিলে অনেক গল্প করেছিলাম। ছিলাম বিকেল পর্যন্ত। জীবনের একটি সুন্দর লম্বা সময় পার করেছিলাম সেদিন।ম্যাডাম আর স্যারদের প্রতি আমাদের যে শ্রদ্ধা মেশানো একটা ভয় সবসময় কাজ করত তা সেদিন একেবারেই ছিল না। অদ্ভুত স্বতঃস্ফূর্ততায় বিকেলটা কেটে গিয়েছিল। কেন যেন আমার মনে হয়, সবকিছু হয়েছিল আমার প্ল্যানে। আমিই উদ্যোক্তা, আমিই আয়োজক এবং আমিই পরিচালক। কয়েকজন ছাত্র আর আমিন ভাই শুধু হেল্প করেছিল। বিকেল হলে একজন একজন করে উঠতে থাকে। সন্ধ্যার আগে সবাই চলে যায়। একটি স্বাভাবিক শূন্যতা এসে গ্রাস করে আমাকে। ঠিক তখনি মনে ধরা পড়ে- কবির স্যারকে ডেকে এনে আমি ভুল করেছি। সব ছাত্রছাত্রীরা যখন যার যার বাসায় যাবে তখন ওদের উচ্ছ্বাসের সীমা থাকবে না। যাকে সামনে পাবে তাকেই বলবে- আজ কবির স্যারের সাথে মাঠে বসে খেয়েছি। স্যার আমাদেরকে কফি খাইয়েছেন। কোনোদিন ওদের নিজেদেরও মনে পড়বে না যে আমি ওদেরকে বার্গার খাইয়েছিলাম। কবির স্যার না এলে কেউ কোনোদিন হয়ত বলত- আসাদ স্যার আমাদেরকে কার্জন হলের মাঠে বার্গার খাইয়েছেন। একটু সামান্য ভুলের জন্যএ সামান্য ভুলটি হয়ে গেল আমার জীবনের বড় একটি ভুল!
কবির স্যার অনেক লম্বা এবং ফর্সা। সবসময় শ্রদ্ধাকাড়া একটি লম্বা মুখ। কখনো টি-শার্ট বা হাফ-হাতা শার্ট পরতে দেখিনি। সব সময় স্ট্রাইপের অথবা এককালারের ফুলহাতা শার্ট পরতেন- প্যান্টে ইন করে। শার্টের হাতাটা সামান্য গুটানো থাকে। পায়ে কালো জুতো- কখনো স্যান্ডেল পরে ক্যাম্পাসে আসেননি। হাঁটেন লম্বা লম্বা পা ফেলে। ওরকম সুন্দর করে হাঁটতে পারে এমন আর কাউকে চোখে পড়েনি। কথা বলার ভঙ্গি আর হাসি দুটোই অপূর্ব। আর তাঁর দৃষ্টি একটাই- ছেলে মেয়ে যাই হোক না কেন তাঁর দৃষ্টি কখনো পরিবর্তন হতে দেখিনি। চুল কখনো লম্বা রাখেন আবার কখনো ছেঁটে ছোট করে ফেলেন। ছোট চুলে স্যারকে প্রথম কয়েকদিন স্কুল পালানো ছেলেদের মত লাগে। তাঁর চশমাগুলোও সুন্দর।
কবির স্যারের গল্প শোনা শুরু হয়েছিল যখন আমি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন থেকে। আমাদের ল্যাব গুলো হত তিনটা গ্রুপে। একটা গ্রুপে ল্যাব-টিচার ছিলেন কবির স্যার। আমি অন্য আরেকটা গ্রুপে ল্যাব করতাম। আমাদের মাঝে যারা কবির স্যারের গ্রুপে ছিল তারা প্রায়ই আমাদেরকে তাঁর গল্প বলত। স্যার নাকি ল্যাব ভাইভায় প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর বলে দিতেন। না পারলেও কিছু বলতেন না, বুঝিয়ে দিতেন। আবার কখনো নাকি এমনিই রেগে যেতেন। আমি মাঝে মাঝে স্যারকে দেখতাম ল্যাবের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে। সকালের দিকে ক্লাস থাকলে দেখতাম স্যার কালো একটা ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছেন। তখন স্যারের রুম ছিল নিউ ফিজিক্স বিল্ডিং- এর তিন তলায়। আমি শহীদুল্লাহ হলে থাকতাম বলে দেখতাম স্যার অনেক সময় ছুটির দিনেও অফিসে চলে আসতেন। কখনো কখনো স্যারের রুমে সন্ধ্যার পরেও বাতি জ্বলতো- স্যার তখনো অফিসে কাজ করতেন। আগ্রহ ছিল বলে এরই মধ্যে আমার সাথে স্যারের কয়েকবার কথাও হয়েছে। তাতেই স্যারকে আমার ভালো লেগে যায়। তখন মনে হত যদি তাঁর ল্যাবে যেতে পারতাম!
এরপর সেকেন্ড ইয়ার শেষ করে থার্ড ইয়ারে উঠি। অনার্স পাশ করি- কিন্তু এর মাঝে কবির স্যারের কোন ক্লাস পাইনি। মাস্টার্সে উঠে আমি স্যারের ক্লাস পাই। স্যার আমাদেরকে দুটো কোর্স পড়িয়েছিলেন। একটা কোয়ান্টাম মেকানিক্স, আরেকটা কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি। এই প্রথম স্যারকে দেখলাম ডায়াসের উপর দাঁড়িয়ে পড়াতে। অদ্ভুত সুন্দর করে পড়ান। স্যার আর ফিজিক্স মিলে এমন একটি আবহ তৈরি হত যে ওখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া সম্ভব হত না। ডায়াসের উপর তাঁর হাঁটাচলা, হাত নেড়ে কথা বলা, উচ্চারণ, প্রেজেন্টেশন, বোঝানোর ক্ষমতা- এত সুন্দর কম্বিনেশন আর কোথাও পাইনি (আমি তারপর অনেক কোর্স নিয়েছি আমেরিকায়। দেশে বিদেশে অনেক প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের লেকচার শুনেছি)। ফিল্ডথিওরি লেকচারটা মাঝে মাঝে অনেক লম্বা হত। তখন স্যার মাঝখানে ছোট একটা ব্রেক নিতেন। ব্রেক নিয়ে নিজের রুমে বসে একটু পানি আর সিগারেট খেতেন। স্যারের সিগারেট খাওয়াটা দেখে আমার সব সময় প্রশ্ন জাগত- কেন তিনি সিগারেট খান? তিনি কখনই পুরো সিগারেট খেতেন না। সিগারেটটা ধরালেন- কিছুক্ষণ টানলেন- তারপর ফেলে দিলেন- আবার আরেকটা ধরালেন। কেন? উত্তর জানি না। বের করার চেষ্টা করেছি অনেকবার।
আমাদের ক্লাসমেটদের বেশ কিছুটা অংশ ক্লাস ফাঁকি দিত। একজন স্যারের ক্লাসে শুধু ফাঁকি দিতে চাইত না- সেটি কবির স্যারের ক্লাস। ফিল্ডথিওরি কোর্সটি অপশনাল ছিল- আমরা আটজন নিয়েছিলাম। কোয়ান্টাম মেকানিক্স কোর্সটি সবার নিতে হত। কবির স্যার কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়াতেন বলে সবাই ক্লাসে আসত। সবাই যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স পছন্দ করতো বা বুঝত তা না। যে ভালো বুঝত সে ক্লাসে আসতো। যে বুঝত না সেও ক্লাসে বসে থাকতো- প্রিয় স্যারটিকে দেখতো ডায়াসের উপর। আমাদের অনেক পরে (আমরা ততদিনে টিচার হয়ে গেছি) ডিপার্টমেন্টে ছাত্রদের ক্লাশ ফাঁকি দেয়াটা বেশ বেড়ে যায়। ডিপার্টমেন্ট ভাবতে থাকে এর কারণ কি ? চেয়ারম্যান স্যারের রুমে বসে সবাই আলোচনা করছিলাম। কেউ বলছিলেন ছাত্রদের আগ্রহ নেই। আবার কেউ বলছেন ফিজিক্স কঠিন একটি বিষয়- এতে আগ্রহ আনাটা একটু ডিফিকাল্ট। খালেক স্যারও আলোচনায় ছিলেন এবং এক পর্যায়ে তিনি বললেন - কবিরের ক্লাসেও এখনকার ছাত্ররা আসে না। এরপর আর আলোচনা বেশিক্ষণ চলেনি। আমরা সবাই মিলে খুব সহজেই একটি উপসংহারে স্থির হয়ে যাই- ছাত্রদের নিজেদেরই লেখাপড়ার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। কবির স্যার যেন পড়ানোর মাপ কাঠিতে ডিপার্টমেন্টের সুপার নোভা (গ্যালাক্সির পরিচয় এবং দূরত্ব মাপতে সুপার নোভা বিশেষ ভূমিকা রাখে। আর সুপার নোভা হল একটি বিস্ফোরিত নক্ষত্র- যা সূর্যের চেয়ে মিলিয়ন গুণ বেশী আলো দেয়। যা থেকে খুব সহজেই গ্যালাক্সি চেনা যায়)!
আমি হলে থাকলেও ক্লাসমেটদের বাইরে কারো সাথে মিশতাম না। কেন যেন হয়ে উঠত না। এমনকি ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র কারোর সাথেও আমার তেমন পরিচয় ছিল না। একটা কারণ হতে পারে আমি কারো কাছে নোট চাইতাম না। আমি আমার ক্লাস নোট আর বই পড়তাম। তারপরেও ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন সিনিয়র ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়। তাঁদের কারণেই এই পরিচয়। হলে ছুটির দিনে ওনাদের সাথে দেখা হলে দু-একটা কথা বলার পরেই চলে আসত কবির স্যারের কথা। আমরা অনেকক্ষণ আলোচনা করতাম স্যার কি কি করেছিলেন এবং কি কি করতে পারতেন। চাকরি জীবনে বেশ কয়েকটা স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি। সবখানেই একজন দুজন পেয়েছি যারা আমার ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে পাশ করেছেন। অবসর সময়ে আমরা একসাথে চা খেতাম। গল্প শুরু হলে চলে আসত কবির স্যারের কথা। এটা এমন হয়ে গেল যে বাসায় কেউ (কাছাকাছি বয়সী) বেড়াতে আসলেও ঘণ্টা ধরে বলে যেতাম কবির স্যারের গল্প। এটা খুব বেশি করেছি পিএইচডি করার সময় অন্যান্য পিএইচডি ছাত্রদের সাথে। ওরা প্রায়ই আসতো। একই গল্প বার বার শুনতে শুনতে ওরাও না দেখে চিনে ফেলেছিল কবির স্যারকে। পিএইচডি করে দেশে ফিরে এসে শুনি বিয়াস (ভাইয়ের ছেলে) এনএসইউতে কবির স্যারের ক্লাস পেয়েছিল। তারপর থেকে বিয়াসের প্রিয় স্যার হল কবির স্যার। নাবিলা (বোনের মেয়ে) আমার ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে পড়ে। ওর প্রিয় স্যার কবির স্যার। কোনো একদিন মার্কার থেকে কালি বেরোচ্ছিল না বলে স্যার ওদের ক্লাস থেকে রাগ করে বেরিয়ে যান। সে রাতে নাবিলার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে মন্তব্যটা ছিল এরকম “মনে হয় পৃথিবীর সবগুলো মার্কার এনে কবির স্যারের পায়ের কাছে রেখে দেই”। কবির স্যার নামে একজন যেন আমাদের সবাইকে এনে দিয়েছেন “একটি প্রিয়স্যারের” প্লাটফর্মে। অন্য যে কোনো কিছু নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের মাঝে দ্বিমত চলে আসে। শুধু আসে না কবির স্যারের বেলায়।
মাস্টার্সে থিসিস করার সময় আমি শমসের আলী স্যারের রুমে বসে কাজ করতাম। তখন পাশের রুমটি ছিল কবির স্যারের। স্যারের সাথে কাজ করত মিরাজ। আমি স্যারের সাথে থিসিস করতে চেয়েছিলাম।স্যার আমাকে বলেছিলেন তিনি সেবার কোনো ছাত্র নিবেন না। স্যারের বাবা খুব অসুস্থ ছিলেন তাই তিনি মনে করেছিলেন আমাকে সময় দিতে পারবেন না। কিন্তু পরে স্যার মিরাজকে নিয়েছিলেন। মিরাজ আর স্যারকে দেখতাম অনেকক্ষণ ধরে কাজ করতে। মনে হত স্যারের সাথে কাজ করতে পারলে ভালো হত! কাজের জন্য না স্যারের সঙ্গের জন্য। অনেক পরে মিরাজ আমেরিকায় পিএইচডি করার সময় স্যারকে নিয়ে আমাকে একটা গল্প বলেছিল। গল্পটা ও শুনেছে আরেকজনের কাছে। কবির স্যার নাকি আমেরিকায় পিএইচডি করার সময় একজনের সাথে রুম শেয়ার করতেন। একদিন স্যারের হাত থেকে এক গ্লাস দুধ পড়ে যায় কার্পেটে। স্যার তখনি ওটা ক্লিন করেননি। কিছুদিন পর ওতে পোকা ধরে যায়।স্যারের রুমমেট স্যারকে পোকা ক্লিন করতে বলেন। স্যার ক্লিন না করে আরেকটা ছোট কার্পেট এনে পোকাসহ কার্পেটের বড় একটা অংশ ঢেকে দেন। গল্পটা আমি বিশ্বাস করেছি অনেক পরে। আল আইন থেকে ফিরে এসে স্যারের সাথে দেখা করতে যাই। স্যারের রুমে আগের চেয়ে অনেক বেশি আলমারি আর বই খাতা। সামান্য যেটুকু জায়গা খালি ছিল ওখানে ছোট একটি টেবিল আর দুটো চেয়ার বসানো। স্যার ছোট টেবিলে বসেই কাজ করেন। বড় ডেস্কে আর বসেন না। জিনিস পত্রে এমন ভাবে বড় ডেস্কটা ভরা যে ওতে আর বসা যায় না। বড় ডেস্কটার বই খাতা আর হাবিজাবি জিনিসগুলো সরানোর চেয়ে আরেকটা টেবিল বসানো স্যারের জন্য খুব সহজ কাজ ছিল বৈকি!
একসময় আমাদের থিসিসের কাজ শেষ হয়। থিসিস ডিফেন্সের পরের দিনই কবির স্যারের কাছে যাই। তাঁকে জানাই আমার একটা চাকরি দরকার। স্যার আমাকে স্কলাসটিকা, বিআইটিসহ বিভিন্ন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যেতে বলেন। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কাজ করলে নাকি অনেক কিছু শেখা যায় এবং স্মার্ট লোকেরাই ওগুলোতে কাজ করে। তার দু-সপ্তাহের মধ্যে আমি বিআইটির একটি অ্যাড দেখতে পাই। ওরা একজন ফিজিক্স টিচার নিবে। আমি একদিন খোঁজ নিতে যাই। আমার অনার্সের রেজাল্ট শুনে সাথে সাথে আমার ইন্টারভিউ নেয় এবং দশ হাজার টাকা বেতনে জয়েন করতে বলে। আমি দশ হাজার টাকা শুনে মহা খুশি। জীবনের প্রথম চাকরিতেই দশ হাজার টাকা! দুদিন পরে এসেই স্যারকে আমার বিরাট আনন্দের খবরটা জানাই। আমি চেয়েছিলাম একটা ভালো খবর দিয়ে তাঁকে খুশী করতে। আমি অসম্ভব উৎসাহে স্যারকে আমার চাকরির কথাটা বলি। বেতনের কথাটাও একটু জোর দিয়ে বলেছিলাম। শুনেই স্যার প্রচণ্ড রেগে যান। আমি হতভম্ব- কিছুই বুঝতে পারলাম না। স্যার পরে যা বললেন তার সারমর্ম এরকম- আমি কেন বিআইটিতে চাকরি করতে যাব। আমি টোফেল দিব, জিআরই দিব, তারপর আমেরিকায় যাব পিএইচডি করতে। স্যার আরো অনেক কিছু বলেছিলেন এখন মনে নেই। আমি তখনো বুঝিনি এখনো বুঝতে পারি না কেন স্যার রেগে গিয়েছিলেন। দু-সপ্তাহের মাঝে পৃথিবীতে এমন কি ঘটেছিল যে স্যার চাকরির পরামর্শ দিলেন এবং চাকরি পাওয়ার পর রেগে গেলেন ! যাহোক আমি তাই বলে চাকরি ছাড়িনি। চাকরি চলাকালীন অবস্থায়ই আমেরিকায় পিএইচডির জন্য অ্যাপ্লাই করছিলাম। পিএইচডি এডমিশনের জন্য টিচারদের রিকমেনডেশন লেটার লাগে। স্যারের কাছে আবার যাই। দরজা থেকে সালাম দিয়ে বললাম- ‘স্যার আসতে পারি।’ স্যার আমাকে দেখেই ওনার সুন্দর হাসিটি দিয়ে বললেন- ‘হ্যাঁ, আসাদ আস। একটু সাবধানে ঢুকতে হবে তোমাকে।’ রুমের দিকে এতক্ষণ তাকাইনি। এবার তাকিয়ে দেখি সামনে এক বিরাট বইয়ের জংগল। আলমারি থেকে সব বই নামিয়ে মেঝেতে রাখা। এলোমেলো কলামে বইগুলো দিগ্বিদিক ছড়ানো ছিটানো। হাঁটার মত কোনো জায়গা নেই। যেটুকু ফাঁকা জায়গা আছে তাতে খুব ভালো অ্যাক্রব্যাটিক্স না জানলে কোনোভাবেই স্যারের সামনের চেয়ারে যাওয়া সম্ভব না। কোনোভাবে এক পা এখানে আরেকটা পা খুব আন্স্টেবল ভাবে ওখানে দিয়ে একটা চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছতে পারি। চেয়ারে বসার পর তাঁকে রেকমেনডেশন লেটারের কথা বলি। স্যার সাথে সাথে আমার নাম দিয়ে একটি ফাইল খুলে ফেললেন। আর বললেন তাঁকে একটু মনে করিয়ে দিতে। আমি স্যারকে ফোনে কয়েক বার মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। স্যার কিছুদিন পরেই আমাকে খুব ভালো একটি রেকমেনডেশন লেটার লিখে দেন। আমার মত অনেকেই স্যারের কাছে যায় রেকমেনডেশন লেটারের জন্য। এমন অনেকে আছে যারা স্যারের সাথে কাজ করেনি, এমনকি স্যারের কোনো কোর্সও নেয়নি-তারাও স্যারের কাছে যায় রেকমেনডেশন লেটারের জন্য।স্যার না করতে পারেন না। একটা ফাইল খুলে বসেন। একসময় রেকমেনডেশন লেটার দেন। ছাত্রটি চলে গেলে মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে নিজেই নিজেকে বলেন- আমার কাছে কেন ? ওরা যার সাথে কাজ করেছে ওদের কাছে যায় না কেন?
কিছুদিন পর ডিপার্টমেন্টে দুজন লেকচারার নেয়া হয়। আমি সেই দুজনের একজন ছিলাম। ডিপার্টমেন্টে টিচার হিসেবে জয়েন করতে পেরে ভালো লাগে- ঢাবির চাকরি অনেকেরই জীবনের স্বপ্ন। ডিপার্টমেন্টে কবির স্যারের সাথে দেখা হলেই চা সিঙ্গারা খাওয়াতেন। ক্লাশ না থাকলে স্যারের কাছে এমনিই যেতাম। কিছুক্ষণ কথা বলে চলে আসতাম। একদিন সকালে আমি ক্যাম্পাসে গেছি। বিকালে আমার ক্লাস। স্যার তখন সেকেন্ড ইয়ার ল্যাবে ছিলেন। আমি সেখানেই চলে যাই- স্যারের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলব বলে। স্যার আমাকে বসতে বলেই চা খাব কিনা জিজ্ঞেস করেন। আমি রাজী হয়ে যাই। একটু পর মিলন ভাইয়ের দোকান থেকে ছোট একটি ছেলে (আমি দুঃখিত যে ওর নামটি ভুলে গেছি) চা নিয়ে আসে। চা শেষ হলে ছেলেটি কাপ নিতে আবার আসে। স্যার এবার ওকে বিলের কথা জিজ্ঞেস করেন। ও বলে বাহাত্তর টাকা। বাহাত্তর টাকার কথা শুনে স্যার অবাক হয়ে যান, সাথে স্পষ্ট রাগ। স্যার বলে উঠেন- বাহাত্তর টাকা ! একটা মানুষ সকাল থেকে চা আর সিগারেট খেল তাতেই বিল বাহাত্তর টাকা ! আমাকে হিসাব দে ! সাধারণত স্যার বিলের কথা জিজ্ঞেস করেই একটি আস্ত বড় নোট দিয়ে দেন, তারপরেও ছেলেটার কোন ভাবান্তর নেই। ও মনে হয় স্যারকে আমাদের চেয়ে ভালো চিনত। ও এটা সেটা যা মনে আসে বলে বলে সত্তর টাকা পর্যন্ত হিসাব দিতে পারল। বাকী দু-টাকা মিলাতে পারল না। স্যারের রাগ তখনো একটুও কমেনি। সেই রাগ মেশানো অবাক ভঙ্গীতে বলে গেলেন- দেখছিস তোরা আমাকে ঠকাস ! এরপর থেকে আমাকে আর বাকিতে দিবি না। আমি নগদ পয়সায় চা খাব। আরো কিছু বলে ওকে একশ টাকার একটা নোট বের করে দিলেন। বাকী ত্রিশ টাকা ? এ প্রশ্নের উত্তর কে দিবে ? অন্তত স্যার দিতে পারবেন না। স্যারের এ স্বভাবটি অনেকেই জানত এবং ব্যাবহার করত- সেটা এককের হিসাবে না, অযুতের হিসাবে।
সদা সর্বদা এ সত্য সুন্দর মানুষটি কেন হঠাৎ হঠাৎ রেগে যান তা নিয়ে আমাদের সবারই একটা ব্যাখ্যা আছে। শুধুমাত্র স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা আছে বলেই আমরা তাঁকে নিয়ে ভাবতে পছন্দ করি। একজনের ব্যাখ্যার সাথে আরেকজনের ব্যাখ্যার কোনো মিল নেই। তাতে যেন কিছুই যায় আসে না। আমরা আমাদের ব্যাখ্যা প্রমাণে আগ্রহী নই। স্যারকে নিয়ে কথা বলাতেই আমাদের আনন্দ। তবে অধিকাংশ ব্যাখ্যারই মূলে একটা মিল পাওয়া যায়। অনেকেরই ধারণা স্যারের মনে একটি গভীর ক্ষত আছে। সেটি স্যার আমাদের সবার ভালোবাসা দিয়ে সযত্নে মুড়ে রেখেছেন। ওটিই যেন স্যারের পরম ধন। মনের গভীরে নিভৃতে যতনে আগলে রাখা স্যারের এক সম্পদ। যার খোঁজ তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। জানতেও দেননি কাউকে- কি ব্যথা তাঁর মনে। তবু যেন মাঝে মাঝে বের করে আনেন তাঁর সে পরম ধন। তখন এমনিই যেন একটু খোঁচা লেগে যায়। হঠাৎ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠেন সবার প্রিয় এ স্যারটি।
স্যারের রেগে যাওয়া নিয়ে আমার ব্যাখ্যাটা একটু ভিন্ন। আমার চোখে স্যার একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক এবং নিপাট সত্য মানুষ। তিনি তুচ্ছ নিয়ম কানুনে অভ্যস্ত নন। ছাত্রদের ভালোর জন্য স্যার সবকিছু করতে পারেন। তিনি উত্তর বলে দিতে পারেন- কিন্তু নকল সহ্য করতে পারেন না ( ফিল্ড থিওরিরমিড টার্মেস্যার আমাদের খাতা আর প্রশ্ন দিয়ে চলে যান নিজের রুমে। আমাদেরকে বিশ্বাস করেছিলেন। সেই বিশ্বাস আমরাও কেউ ভঙ্গ করিনি। যে যার মত লিখেছি। পরীক্ষা শেষে স্যার এসে খাতা নিয়েছেন)। কেউ চাইলেই মিনিটের মধ্যে দিয়ে দিতে পারেন পকেটের সব টাকা- তবু পারেন না মিথ্যা বাহানা মেনে নিতে। সিনিয়রদের প্রতি তাঁর সম্মানবোধ অনবদ্য এবং সেদিকে স্যারের প্রখর দৃষ্টি (আসলে তাঁর প্রখর দৃষ্টি নেই। স্যারের শরীরটাই ওভাবে অভ্যস্ত)। তাই কোথাও একবিন্দু ভদ্রতা বোধের কমতি দেখলে তিনি হাঁপিয়ে উঠেন। কিন্তু তাঁর যে ভদ্রতাবোধ তা দিয়ে কখনো কাউকে কিছু বলেন না- তিনি বলতে পারেন না। তাই যেন কোন অবসরে একটি প্রশ্ন উঠে আসে- আমাকেই কেন সব মানতে হবে ! তখন মুহূর্তে হাঁপিয়ে উঠা মানুষটি প্রশ্ন করে বসেন- কেন? উত্তর খোঁজেন না- একটু পর সবকিছু এমনিই মিলিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকলে ওঁকে একটি কথা জানাতাম। উনি ভারতবর্ষকে কেমন চাইতেন তা নিয়ে ওঁর যে কবিতাটা ছিল “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য ... ”- তা ভারতবর্ষের সাথে কতটা মেলে সবারই জানা। আমার জীবনে দুজন মানুষকে পেয়েছি যাদের সাথে মিলে যায় এ কবিতাটির প্রতিটি লাইন। তাঁর একজন কবির স্যার। রবীন্দ্রনাথ জেনে নিশ্চয়ই খুশী হতো- ভারতবর্ষ না হোক ওঁর কবিতায় পুঙ্খানুপুঙ্খ উঠে এসেছে ভারতবর্ষেরই কিছু মানুষ।
একদিন বিকালে বৃষ্টির মাঝে দস্তগীরের সাথে ক্লাবে যাই। পথে গাড়ি থামিয়ে দু’প্যাকেট গরম বাদাম নিয়ে যাই। ক্লাবে গিয়ে দেখি কবির স্যার। তিনি খাচ্ছেন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর ফ্রাইড চিকেন। দুটোই স্যারের শরীরের জন্য খারাপ। খাবারের ব্যাপারে স্যারের পুরোটাই বদ অভ্যাস। বাইরের দোকানের রুটি আর চা, মিলন ভাইয়ের সিঙ্গারা আর তেহারি, চানখার পুলের... যত বাজে জিনিস খেয়েই পার করে দিলেন দিনগুলো। এগুলো একদিন দুদিন খাননি। খেয়েছেন দিনের পর দিন। স্যারের খাবার শেষ হলে আমরা বাইরে গিয়ে বসি। ক্লাবের বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছিলাম। স্যারকে আমি এক প্যাকেট বাদাম সাধি। স্যার হ্যাঁ না কিছু বলেন না। পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনেন আধ প্যাকেট বাদাম।
বৃষ্টিটা চলে গেলে চারদিকে ছড়িয়ে যায় প্রহর শেষের রাঙা আলো। কবির স্যার তাই দেখে বলে ফেলেন- কনে দেখার আলো। কনে দেখার আলো ! এর আগে কখনো শুনিনি। স্যার ঠিকই বলেছিলেন। সে আলোয় যে কাউকেই সুন্দর লাগবে (এরকম আলোতে কাউকে দেখেই হয়ত রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস...”)। কথাটি শুনে ভালো লেগেছিল। আরো ভালো লেগেছিল প্রিয় স্যারের কাছ থেকে জানতে পেরে। তিনি প্রচুর বই পড়েন তাই আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানেন। কখনো কখনো সেই জানা জিনিসগুলোর দুই একটা বলে ফেলেন।
এখন স্যারের কিছুটা বয়স হয়ে গেছে। তার চেয়ে বড় কথা খাবারের নানা অনিয়মে তাঁর শরীরটা ভালো নেই।যার ফলে স্যারকে বয়সের তুলনায় একটু বেশি রকমের শারীরিক ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আমি আমেরিকা থাকাকালে স্যারের একটি স্ট্রোক হয়েছিল। দেশে ফেরার পর স্যার আমাকে স্ট্রোকের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। বলার সময় তাঁর উৎসাহ আর আনন্দ চোখে মুখে স্পষ্ট। যেন নতুন মজার একটা কিছু শিখেছেন। স্ট্রোকের গল্পের সাথে বলে ফেলেন তাঁর ছোট ভাই কীভাবে মারা গেলেন। তাঁর নাকি ক্যান্সার হয়েছিল। কিন্তু তিনি মারা যান নিউমোনিয়ায়। সেটিও বলে ফেললেন, স্যারের স্বভাবজাত উৎসাহে- দেখেছো ! হয়েছে ক্যান্সার অথচ মারা গেল নিউমোনিয়ায়। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় তিনি স্বাভাবিক কষ্ট পান আর মৃত্যুর কারণটি দেখেন একজন বিজ্ঞানীর অনুসন্ধিৎসু চোখে। তাঁর সরল সত্য মনে মৃত্যু নিতান্তই যেন আরেকটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যার ভেতর দিয়ে যেতে হবে সবাইকে।
কবির স্যার শুধু ছাত্রদের মাঝেই প্রিয় ছিলেন না। তাঁর টিচারদের কাছেও আদরের ছিলেন- ছিলেন সম্মানিত। নাথ স্যারের খুবই প্রিয় ছিলেন আমাদের কবির স্যার। নাথ স্যার কবির স্যারকে যেন ধরে ধরে ফিজিক্স পড়াতেন। আমরা ভালো করেই জানি কবির স্যার ফিজিক্স পড়িয়ে আনন্দ পান। কিন্তু ফিজিক্স করে কতটুকু আনন্দ পান তা আমার জানা নেই। ইন্টারনেটে সার্চ দিলে দেখা যায় বিখ্যাত ফিজিসিস্টদের তালিকায় স্যারের নাম নেই। এমনকি বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটেও তাঁর ফিজিসিস্ট হিসেবে কোনো নাম নেই। কিন্তু ফিজিক্স যদি ভালবাসা আর সম্মান জাতীয় অনুভূতিগুলোকে কখনো পদার্থে রূপান্তরিত করতে পারে অথবা পরিমাপ করতে পারে- সেদিন পৃথিবীর সমস্ত ফিজিসিস্টদের মাঝে আরেকটি লিস্ট বানাতে হবে। যে লিস্টে থাকবে একটি নাম- খোরশেদ আহমেদ কবির। আগে পরে আর কেউ নেই।
কবির স্যার এখন আর ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে নেই। ঢাবিতে নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং নামে নতুন একটি ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়েছে। ওখানে চেয়ারম্যান হিসেবে চলে গেছেন। তাই নতুন যারা ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে আসবে তারা কবির স্যার নামে আর কাউকে পাবে না। তাই বলে ওদের জীবনে প্রিয় স্যারের স্থানটি শূন্য থাকবে না। ওদেরও প্রিয় স্যার থাকবে। তাঁকে নিয়ে ওদেরও কথা বলতে ভালো লাগবে। আর তাঁর প্রতি ওদের যে ভালোবাসা তা কবির স্যারের প্রতি আমাদের ভালোবাসার চেয়ে কোনো অংশেই কম হবে না।
পুনশ্চ-১: স্যারের কাছে এ লেখাটি যাবে। মন ভালো থাকলে পড়ার পর বলবেন- দেখেছো! কি সুন্দর বাংলা লিখেছে! ফিজিক্স পড়েছে অথচ সুন্দর বাংলা লিখতে পারে। বাংলা যারা পড়ে ওরা কিন্তু ভালো বাংলা লিখতে পারে না। আরো কিছু বলবেন। যতক্ষণ তাঁর ভালো লাগে। আবার কিছুদিন পর কোথাও আমার নামটি এলে হয়ত রেগে বলবেন- ও তো ফিজিক্স ছেড়ে দিয়েছে। শুনেছি বাংলা লিখছে। বাংলা লেখার জন্য তো ফিজিক্সে পিএইচডির দরকার হয় না। তুমি তাহলে সময় নষ্ট করে পিএইচডি করতে গেলে কেন? পিএইচডি, ইট’স নট এ ডিগ্রী। ইট’স এ কমিটমেনট। একসময় থামবেন। অন্য কথা বলে যাবেন। এ পৃথিবীর কোন কিছুই যেন তাঁকে স্পর্শ করে না। কখন কি বলবেন তা নির্ভর করে স্যারের সত্য আর সুন্দর মনটির অবস্থার উপর।
পুনশ্চ-২ : ছাত্র থাকাকালে স্যারের প্রতি আমাদের আগ্রহ এবং সম্মান দুটোই অকৃত্রিম। পাশ করে যাবার পরেও তাঁর স্মৃতি আমাদের খুব আনন্দ দেয়। অন্যদের কাছে স্যারের কথা বলতে ভালো লাগে। কিন্তু জীবনের একটা পর্যায়ের পর সময় সুযোগ পেলেও আমরা স্যারের কাছে যাই না। আমরা জানি কার কাছে যেতে হয়। তখন আমাদের কাছে পার্থিব পৃথিবীর চাহিদার মূল্য অনেক বেশি হয়ে ধরা পড়ে। তাই কখনো কখনো ক্যাম্পাসে এলেও স্যারের সাথে দেখা করা হয়ে উঠে না। আমরা জানি স্যার বসে আছেন তাঁর বইয়ের জংগল রুমটিতে। হয়ত সাথে আছে মাস্টার্সের একটি ছাত্র। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই স্যার একা থাকেন-অনেকগুলো বইয়ের সাথে। তারই মাঝ থেকে একটি তুলে নিয়েছেন হাতে- গভীর মনোযোগে চলে গেছেন অন্য এক জগতে। যে জগতে যা কিছু আছে- তার সবই সত্য, সুন্দর, আর সরল।