রাহেল রাজিব-এর ‘গুণিন কথা’ : উন্মোচিত কথামালা
রাহেল রাজিব-এর ‘গুণিন কথা’ : উন্মোচিত কথামালা
চিত্তরঞ্জন বর্মণ
গুণিন কথা গৃহীত সাক্ষাৎকারের বই। দুই বাংলার পঁচিশজন সাহিত্যিকদের নেওয়া সাক্ষাৎকার সংগ্রহ এই গ্রন্থটি সূচি দেখলেই দীক্ষিত পাঠক মাত্রেই আকৃষ্ট হবেন। সাহিত্যের সকল শাখায় বিচরণকারী লেখকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে রাহেল রাজিব একটি সমৃদ্ধ তথ্য ভাÐারের সন্ধান দিয়েছেন। প্রাথমিক পাঠক সহজেই গ্রন্থটি পাঠে আগ্রহী হবেন। কারণ লেখক তালিকায় সৈয়দ শামসুল হক, আবু বকর সিদ্দিক, রশীদ করীম, শওকত আলী, রাহাত খান, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, বেলাল চৌধুরী, সেলিনা হোসেন, মাহবুব সাদিক, আনোয়ারা সৈয়দ হক, শামসুজ্জামান খান, আবুল আহসান চৌধুরী, হাসান আজিজুল হক, আলতাফ হোসেন, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সদ্যপ্রয়াত আবদুশ শাকুর ছাড়াও পশ্চিমবাংলার অভিজিৎ সেন, মৃণাল বসুচৌধুরী, শচীন দাশ, ঈশিতা ভাদুড়ী, মিহির সেনগুপ্তও আছেন।
রাহেল রাজিব গ্রন্থমুখে বলেছেন নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার কথা। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী হিসেবে তিনি একথা অকপটে বলতেই পারেন। কিন্তু একজন সাধারণ পাঠকের কাছে এটি একটি বড় বিষয়- কেননা পাঠক সবসময় লেখকের লেখা পড়তেই অভ্যস্ত। লেখকের লেখাই পাঠককে ধরে রাখে, একই সঙ্গে লেখকজীবন সম্পর্কে আগ্রহীও করে তোলে। সিরিয়াস পাঠকের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি গভীরভাবে সত্য। পাঠক লেখকের লেখাকে আশ্রয় করে তাঁর সম্পর্কে কৌতুহলী হয়। রাহেল সাক্ষাৎকার গ্রহণের ক্ষেত্রে দুটি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন; প্রথমটি লেখকের আত্মজৈবনিক প্রসঙ্গ, দ্বিতীয়টি লেখকের লেখার মূল্যায়ণ প্রসঙ্গ। কোনও কোনও সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে দুটো বিষয়েরই সমন্বয় ঘটেছে। সৈয়দ শামসুল হক, সিরাজুল ইসরাম চৌধুরী, শওকত আলী, সেলিনা হোসেন, মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ, মিহির সেনগুপ্তের ক্ষেত্রে প্রথম প্রসঙ্গটি গুরুত্ব পেয়েছে। মৃণাল বসুচৌধুরী, অভিজিৎ সেন, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবদুশ শাকুর, আনোয়ারা সৈয়দ হকের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি গুরুত্ব পেয়েছে। স্মৃতিকাতরতা সব লেখকের ক্ষেত্রেই মহৎ অনুপ্রেরণার অংশ যা মহৎ শিল্পকর্মের জন্য বড় ও শক্ত বুনিয়াদ। সাক্ষাৎকারে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। প্রচলিত ঘরানার বাইরে অন্য স্বাদ দেবার মত কিছু বিষয় পাঠককে আকৃষ্ট করবে। যেমন লেখকের জীবনের স্মৃতিময় লাইব্রেরি, বই হারানোর বেদনা, পারিবারিক প্রসঙ্গ, প্রথম বইয়ের রয়্যালটি পাবার স্মৃতি, আড্ডাপ্রসঙ্গ ইত্যাদি। এছাড়া লেখকের লেখক হয়ে ওঠার পেছনে কোনও বিশেষ ব্যক্তির প্রভাব কিংবা অনুপ্রেরণা প্রবলভাবে কাজ করে। রাহেল এই বিষয়টি প্রায় সকল লেখককেই জিজ্ঞেস করেছেন এবং উত্তর বের করে আনার চেষ্টা করেছেন। সৈয়দ শামসুল হকের ক্ষেত্রে যেমন তার চাচী এবং কাজের লোক ঔষধী গাছের সংগ্রাহক গল্প বলার আগ্রহকে উস্কে দিয়েছেন, তেমনি সেলিনা হোসেনের ক্ষেত্রে তার বাবা তার জীবনকে বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন নিরন্তর। পঞ্চাশ দশকের অনেক সীমাবদ্ধ সমাজব্যবস্থার মধ্যেও সেলিনা হোসেন তার বাবার প্রশ্রয়ে যেভাবে যাপিত জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সম্পৃক্ত হতে পেরেছেন তা সেই সময়ের যে কোনও মেয়ের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য এবং একই সঙ্গে ঈর্ষণীয়। শওকত আলীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তার বেড়ে ওঠার গল্পের সঙ্গে দেশভাগ উঠে আসে। তিনি কতটা প্রতিকূল পরিবেশের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবাংলার রায়গঞ্জ ছেড়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় স্থায়ী হন তার প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, তেমনি উঠে এসেছে তেভাগা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ইতিহাস- যা তার কথাসাহিত্যে প্রবলভাবে প্রভাব রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যতম একটি ঘটনা- কারণ এই জনযুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে আত্মিক ও মানসিকভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন সারা পৃথিবীর প্রথিতযশা শিল্পী ও রাজনীতিবিদগণ। সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদের কথায় তার বিস্তৃত বর্ণনা উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক লেখার প্রসঙ্গও উঠে এসেছে অনেক লেখকের জবানীতে। মৃণাল বসুচৌধুরীর সাক্ষাৎকারে ‘শ্রæতি আন্দোলন’-এর প্রসঙ্গ এসেছে। বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তীকালে এর বিভিন্ন কর্মকাÐ নিয়ে হাসান আজিজুল হক, শামসুজ্জামান খানসহ অনেকেই কথা বলেছেন। পেশাগত বিষয়ের সঙ্গে লেখকজীবনের দ্ব›দ্ব-সংঘাতের বিষয়টি কয়েকজন লেখকের কথায় উঠে এসেছে।
কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধের বইয়ের থেকে সাক্ষাৎকারের বইয়ের মূল পার্থক্য- এখানে লেখক স্বয়ং উপস্থিত। সাক্ষাৎকারে লেখকের ব্যক্তি অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর শিল্পচিন্তার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। ফলে পাঠক সহজে পঠিত বিষয়ের সঙ্গে লেখকের অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে নিতে পারেন। আর এখানেই গুণিন কথা সাক্ষাৎকারের বই হলেও এর মৌলিকত্বও ধরা পড়ে সহজেই। রাহেল রাজিব ভূমিকাতেই স্বীকার করে নিয়েছেন তার পূর্ব পরিকল্পনার কথা- ফলে একজন লেখকের সামগ্রিক বিষয় সম্পর্কে ধারণা নিয়েই তিনি লেখকের মুখোমুখি হয়েছেন এটা বোঝা যায়। প্রতি গ্রন্থেই কিছু সীমাবদ্ধতা তো থাকেই যেমন বইয়ের প্রচ্ছদপট আরো আকর্ষণীয় হতে পারতো- বিশেষত প্রচ্ছদমুখের সঙ্গে পুস্তকপুটের রঙ ও ব্যাকপেজের রঙের অসামঞ্জস্য চোখে লাগে। সাক্ষাৎকার গ্রন্থের গ্রন্থকাঠামো বিবেচনায় আরো অভিনবত্ব আসতে পারতো। এছাড়াও বইতে প্রচুর মূদ্রণপ্রমাদ পাঠকের বিরক্তি উদ্রেগ করে। প্রিন্ট্রাস লাইন থেকে বইয়ের বø্যার্বের ভুলও চোখে পড়ার মতো। ঝকঝকে ছাপা ও পুস্তানির বিশেষত বইটির বাহ্যিক আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছে- এটা বলাবাহুল্য।
গুণিন কথা। রাহেল রাজিব। প্রচ্ছদ: বিপ্লব সরকার। প্রকাশক: মধ্যমা। প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১২