প্রশান্ত মৃধা
কদবানু একসঙ্গে কয়েকটা সমস্যায় পড়েছে। হিসাব করলে তিন চারটি। এর বেশিও হতে পারে। কিন্তু কদবানু একসঙ্গে দশের বেশি গুনতে পারে না। টাকা হলে পারে দশটাকা দশটাকা হিসাবে, পরপর দুটো দশটাকা হলে বিশটাকা। তখনই আসলে তার সুবিধা হয়, এক কুড়ি দুই কুড়ি করে গুনে নিতে পারে দুনিয়ার সকল কিছু। আবার, ব্যথায় পেটের নাড়িভুঁড়ি সবসমেত ছোট শরীরটা কুঁচকে প্রায় বেঁকে গেলে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ে পাক দিয়ে ওঠা শরীরের এই অবস্থায় অন্য সব হিসাবের কথা কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে যায়। তখন না মনে আসে কোনও কুড়ির হিসাব, না অন্য কোনও মুখ। এখন, কদবানু যখন তার সমস্যাগুলো ভাবছিল, তখনও তোর তার সামনে কয়েক সারি মুখ। সে মুখ ছেলের দুই বউয়ের, ওই দুই ঘরের নাতি নাতনিদের, তার ভাইয়ের, ভাইয়ের জোড়াতালি দেওয়া সংসারের, বাড়িওলার, দোকানদারের, দিঘিরপাড়ের আপার আর কোনও পুলিসের, উকিলের, কমিশনারের ! কোনটার পরে যে কোন মুখ এসে হাজির হয় তাও তো সে জানে না।
২
কদবানু দেখল, একমাত্র ছেলে কওসারের এক চিলতে কপালের উপরের দিকে চুল উঠে যাওয়া মুখ ! চোয়ালের দুইপাশ কী শক্ত ! যখন কাওসার দাঁতে দাঁত রেখে চোয়াল চেপে কারও মুখের দিকে তাকায়, কদবানুর মনে হয় এই ছেলের চোখের একদম ভিতরে কোথাও কোনও দয়ামায়া নাই। কদবানু ব্যথায় পাক দিয়ে ওঠা নাড়িভুঁড়িসমেত নিজের চোখ থেকে একটুক্ষণের জন্যে দুনিয়াদারি সরে গেলে চোখ খুলেও দেখে কাওসারের অমন নির্দয় মুখ। কিন্তু ধ্বস্ত, ক্লান্ত আর পরাজিত। কাওসার তার সামনে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। সকালে কাওসার সিএনজি নিয়ে সুনামগঞ্জের দিকে গেল। তখনও কদবানুর জানা ছিল না, দুপুরের আগেই কাওসারকে সে ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে দেখতে যাবে। আর, একে একে এই তার গোনাগুনতিহীন সমস্যার শুরু।
এমনিতে তার সমস্যার অন্ত নাই। দিন যে যায়, কীভাবে যায় তাই আল্লা মালুম। নিজের এই নিয়ে কোনও হিসাব থাকে না। থাকতেও নাই, ছিলও না কোনওকালে। এখনও যে আছে তা বলা যাবে না। তবে কাওসারের এই ঘটনার পরে কদবানু একসঙ্গে অনেকগুলো হিসাব মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করেছে ; একটা দুটো মিলিয়েছেও, কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয় নাই। সব হিসাব কি আর মেলে ? গরিবের হিসাব কে মিলায়। তবু কদবানু জানত, জেনে এসেছে এতকালÑ তার দিনকাল, প্রতিদিনের হিসাব যেভাবে হোক মিলে গেছে। মিলে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ যে কী হলÑ আল্লার এমন গজব যে তার জীবনে কেন নেমে এল সে জানে না। ছেলেকে তার দেখতে হল হাসপাতালে। তাও কোনও সমস্যা না, কাওসারের তেমন কিছু হয়ও নাই। কিন্তু মালিক বলেছে, হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে লেখাতে হবে যে, কাওসার বুকে মারাত্মক ব্যথা পেয়েছে, প্রায় মরার মতন। আর, পুলিস আসার আগে এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে কাওসারকে। পালাতে হবে এমন কোনও জায়গায় যেখানে পুলিশ তাকে ধরতে না পারে। গাড়ি ছাড়ানোর ব্যবস্থা মালিক করবে। শুধু পুলিস কাওসারের কোনও খোঁজ না পেলে হয়। আর তাতেই কদবানুর এতদিনের হিসাব, অন্তত এতদিন যেভাবে দিন চলছিল, তা বদলে গেল।
এই সময়, বাড়িওলার বসার ঘরের ফ্লোরে বসে কদবানু নিজের নিকট অতীতের হিসাব মিলায়। যেন সে আগেই জানত কাওসারের এমন একটা কিছু হবে। কাওসারের এই ক্ষতির কারণ, বড়বউ। কদবানু যাকে বলে হবিগইঞ্জা বেটি। ও বেটি বড় বেহায়া। এই কথা বাড়িঅলার বউ আর ছোট ছেলেবউর সামনে যখন সে বলেছিল, তখন এই ছেলেবউ জানতে চেয়েছিল, কেন, কী হয়েছে ? মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে কদবানু বুঝেছিল, মেয়েটা কিচ্ছু জানে না। জানার কথাও না, নতুন বউ ! গাজিপুরে চাকরির সময় বাড়িঅলার ছোটছেলে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে, আবাদি। একদম পুতুলের মতন মুখ। এই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের ছেলের এইসব কীর্তির কথা বলতে কদবানুর মুখে স্বর আসে না। কিন্তু পর মুহূর্তেই তার মনে হয়, এই মেয়ের স্বামী বড় চাকরি করে, যদি কোনও সাহায্য লাগে সময়ে অসময়ে, তখন সে যদি হাত পাতেÑ তাকে এমন সুন্দর মেয়ে নিরাশ করবে না তো ? নাকি মেয়েটির শাশুড়ির সামনে তার সব কথা বলা উচিত ! ফলে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কদবানু বাড়িঅলার এই নতুন পুত্রবধূকে বলল, কী তা কইতাম গো মাইÑ “লিলির বাপর খতা”। লিলি কাওসারের দ্বিতীয় পক্ষের বড় মেয়ে। ইস্কুলে যায়, লেখাপড়ায় ভালো। এই নাতনিকে সঙ্গে করে কখনও কখনও সন্ধ্যার মুখে এই বাসায় আসে সে। লেখাপড়ায় এমন মনোযোগী নাতনির আলোয় সেই মুহূর্তে কদবানু আলোকিত হয়। আর জানায়, এই বাজারে এই একটা নাতনিকে সে আর কাওসার পড়াশোনা করিয়ে উঠতে পারছে না।
কিন্তু যখনই কদবানু কী তা কইতাম গো মাই বলেছে, তখন বাড়িঅলার ছোটছেলের বউ একবার চাইল শাশুড়ির দিকে, শাশুড়ি একবার বউয়ের দিকে। তাতে কোনও লাভ হল বলে মনে হয় না। না হোক, কদবানুর দিকে কোনও ক্ষতি না হলেই হল। সে জানাল, লিলির বাপের দুই বিয়া। লিলির বাপের ওই ক্ষতির ওই কথা বলেছিল হবিগইঞ্জা বেটি, বড়বউ। থাকে গোবিন্দপুর। কদবানু হাত নেড়ে গোবিন্দপুর কোনদিকে তাও বোঝাল। বউটা তা বুঝল বলে মনে হয় না। তাকিয়ে থাকল। সুনামগঞ্জের আগে শুনে বুঝল, পশ্চিম দিকে কোনও একটা জায়গা, যেখানে থাকে কদবানুর একমাত্র ছেলে কাওসারের বড়বউ। তার তখন একদিন দেখা কাওসারের মুখ মনে পড়ল। সেদিন ড্রাইভার আসে নাই। তার শাশুড়ি বাসার কাজের মেয়েটিকে দিয়ে কদবানুকে ডেকে বলেছিল, কাওসারকে বলার জন্যে যে তিনটার সময় সে যেন সিএনজি নিয়ে এই বাসার সামনে আসে ; নতুন বউ তার এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাবে। বউটা সেদিন দেখা কাওসারকে মনে করে কদাবনুর দিকে তাকিয়ে হাসল। কদবানু তা দেখলও। কিন্তু তাতে তার তেমন কিছু আসা যাওয়ার কথা না। তার এখন প্রয়োজন তার বড়বউ ওর্ফে হবিগইঞ্জা বিটির ভবিষ্যদ্বাণী বা অভিশাপকে এই বউ শাশুড়ির সামনে ঠিকঠাক তুলে ধরা।
ফলে, কদবানু জানাল কওসার কবে প্রথম বিয়ে করেছিল। তখন কাওসার এক হবিগইঞ্জা ব্যাটার সঙ্গে সাতকড়ার ব্যবসা করত ; এজন্যে মাঝেমধ্যে শায়েস্তাগঞ্জের দিকে যেত। একদিন রাতের ট্রেনের এক আধবুড়া মহিলাকে কাওসারের মনে হয়েছিল, কদবানুর হারিয়ে যাওয়া বড়বোন। কাওসার কদবানুর বড়বোনকে মা ডাকত। কেন ডাকত তাও এক ফাঁকে সে জানাল। যদিও এই গল্পের অনেকখানিক বাড়িঅলার স্ত্রী বা বর্তমানে বাড়িঅলির অনেকখানিকই জানা। তবু, এখন শোকগ্রস্ত কদবানুর মুখে নতুন করে তার একমাত্র পুত্র কাওসারের কাহিনি শুনতে তার খারাপ লাগছে না। তাছাড়া, ইতিমধ্যেই সে বুঝে গেছে কদবানুকে কিছু টাকা দিতে হবে ; সেটার পরিমাণ কত সে জানে না। প্রথমে ভেবেছিল কাওসারের এমন অবস্থা যে হয়তো আর বাঁচপে না। এখন যখন জানল, কাওসার হাসাপাতাল থেকে ইতিমধ্যে পালিয়ে গেছে, তখন সে বুঝতে পেরেছে যে, কদবানু না বলা পর্যন্ত টাকার ব্যাপারে সে কিছু বলবে না। তার আগে বেটিকে হালকা হতে দেওয়া দরকার।
ফলে, ট্রেনে দেখা হওয়া কদবানুর বড়বোনের মতন সেই মহিলা, যার কাছে কাওসারের ছোটবেলা কেটেছে। সুনামগঞ্জের হাওড়ের ভেতরে বলতে গেলে। কদবানু সেই গল্প বলল, কিন্তু দ্রুত ; আগের চেয়ে অনেক গুরুত্ব দিয়ে। কদবানু বলল, পরপর তিনটি ছেলে আর একটি মেয়ে মারা যাওয়ার পরে কাওসার ; জন্মানোর পর পরই তাকে তার বড় বোন নিয়ে যায়, কেননা, কাওসারের আগের ভাইদের ও বোনকে বাড়ির কান্দায় (কাছেই, সীমানায়) যেখানে কবর দেয়া হয়েছে, বলতে গেলে এক কবরে, একজনের গায়ের ওপর আর একজন ; কদবানুর বড়বোন স্বপ্নে দেখেছে, ওই না বাঁচা স্বল্পায়ু ছেলেমেয়েরা চাইছে কাওসারকেও ওইখানে নিয়ে যেতে। তা হতেও পারত। কেননা, কাওসারের শরীরের যে গঠন, এখনও পর্যন্ত তাকে দেখলে মনে হয় যে কোনও সময় লোকটা মাটিতে শুয়ে পড়তে পারে। জন্মানোর পরে ছিল আরও খারাপ। শরীরে কোথাও গোস্ত বলতে কিছু আছিল না। এর পর কদবানু একটুক্ষণ তার বড়বোনের বর্ণনা দিল। কদবানুকে দেখতে এমন ছোটখাট দেখালে হবে কী তার বড়বোন ঠিক তার উলটা। অনেক উঁচালম্বা আর দেখতে ভালো। তার ছেলেমেয়েদেরও শরীর স্বাস্থ্য ভালো। কাদবানুর শাশুড়ি পহেলা রাজি না হলেও ওই স্বপ্নের কথা শুনে রাজি হয়েছিল। তার পর কাওসারকে তার বড়খালা নিয়ে যায়। কদবানু মনে করে, তার বড়বোনের স্বপ্ন সত্যিই ছিল ; কারণ, এরপর কদবানুর আর কোনও ছেলেমেয়ে হয় নাই। আর একটা ছেলের জন্যে কদবানু কাওসারের বাপসহ অনেকদিন ওই বড়বোনের বাড়ি যেয়ে থেকে এসেছে। তাতেও কোনও লাভ হয় নাই। আর কাওসার ওই বড়খালার কাছে থেকে গায়ে গতরে ডাঙ্গর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এরপর ওই বোনেরও আর কোনও বাচ্চাকাচ্চা না হওয়াতে তার শাশুড়ি কাওসারকে ফিরিয়ে দিতে বলেছিল। কদবানুর বড়বোন আড়াই বছর পর্যন্ত তা করে নাই। ওই আড়াই বছর তার কোনও সন্তান হয় নাই। তারপর একদিন কদবানু কাওসারকে নিয়ে এসেছিল।
এরপর কদবানুর বড়বোনের যে কয়টি বাচ্চা হয়েছিল, তাদের কেউ বাঁচে নাই। তখন কাওসার আবার খালার কাছে যেয়ে থাকতে শুরু করে। এই সময় একদিন কদবানুর দুলাভাই আর একটি বিয়ে করে নিয়ে আসলে সে কাওসারকে নিয়ে কদবানুর কাছে চলে আসে। তারপর একদিন উধাও হয়ে যায়। কাওসার সেই বড়খালারে আজও ভুলতে পারে নাই। তবে, এই ফাঁকে কদবানু জানিয়ে রাখতে ভোলে না যে, কাওসারের যে আর কোনও ভাইবোন হইল না, এই জন্যে কাওসারের বাপ কোনওদিন অমন কাজ করার কথা ভাবে নাই।
ট্রেনে দেখা সেই মহিলাকে কাওসার খালা ডাকল। বড়খালা মনে করে কাওসার ওই মহিলার সঙ্গে তার শায়েস্তাগঞ্জের বাড়িতে গেল। কয়েকদিন থাকল। মহিলা এমন খাতির যতন করল যেন বহুদিনের চেনা। কাওসারও তার বড়খালারে যেন ফিরে পাইল। এরপর কদবানু জানাল, এইসবই ছিল ওই মহিলার জন্যে একটা সুযোগ। সে কাওসারের সঙ্গে তার মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিল। আসলে ওই বেটি কাওসারকে জাদু করেছিল। কাওসার পরে কদবানুকে বলেছে, ওইদিন রাতে ট্রেনের ওই আলো আর অন্ধকারে ওই মহিলাকে তার বড়খালার মতন মনে হয়েছিল। নাকী ওই মহিলাই তার চেহারা অমন করে রেখেছিল, যাতে তাকে দেখতে তার বড়খালার মতন লাগে। কেননা, এর পরদিন বা তার পরদিন এই দুইদিন পর্যন্ত কাওসারের মনে হয়েছিল, সে তার বড়খালাই। তখন সে বলেছিল, ও বা, আমারে যখন খালাই কইচÑ তখন আমার এই পু’রিরে তুমি লই লও। আমি কু’শি হইতাম। তখন নাকি ওই মেয়েটাও দেখতে খুব সুন্দরী ছিল। কিন্তু ওই মহিলা যে কাওসারের বড়খালার মতন ভালো মানুষ না, তার চেহারাও যে জাদু এইসবই কাওসার বুঝতে পারে আরও দিন দুই গেলে। কাওসার ওই বউরে নিয়ে যাদের সঙ্গে সাতকড়ার ব্যবসা করত, তাদের একজনের বাড়িতে বেড়াতে যায়। ফিরে এসে দেখে, তার ওই শাশুড়ি লাল কাপড় পরে বসে আছে আর এক লাল কাপড় পরা ব্যাটার সঙ্গে। তার দুইজন গাঁজা খাচ্ছে। সারাঘরে ধোঁয়া। কাওসার তার শাশুড়ির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে, তাকে চেনা যায় না ; মুখটা ফুলে ঢোল ; সারা পিঠে চুল ছড়ানো। দেখলেই ভয় করে। ধরা গলায় কাওসারকে সে কী কী বলেছিল কাওসারের মনে নাই। তবে সঙ্গের লোকটা কাওসার গাঁজা খাবে কী না জিজ্ঞাসা করেছিল। কাওসার কিছু না বলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বউ নিয়ে চলে আসে।
কাওসারের বৃত্তান্ত এই পর্যন্ত জানানোর পরে বাড়িঅলার স্ত্রী কদবানুর দিকে তাকাল। কেননা, এই গল্পের পিছনের অন্য গল্প সে জানে। পরে যদি মনে না পড়ে তাহলে আর বউকে জানানো হবে না। তার ইচ্ছা করছে এখনই আসল কাহিনিটা ছেলের বউকে জানাতে। সে কদবানুকে এখন আর কান্নাকাটি না করে বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে পানি দিয়ে আসতে বলে। কদবানু উঠে গেল। আর এই ফাঁকে সে জানিয়ে দিল, কদবানুর অর্ধেক কথা বিশ্বাস না করতে। কদবানু এই রকম গল্প বানাতে ওস্তাদ। ইনিয়ে বিনিয়ে এমনভাবে এইসব গল্প বলবে, যে কোনওভাবে মনেই হবে না যে এটা গল্প। তার আসল উদ্দেশ্য আসলে টাকা হাতানো। বাড়িঅলি জানে, কাওসার কেমন পোলা। ছ্যাচড়া ছেলেও এর চেয়ে ভালো। ওই কাওসার আগেপাছে পু’রি লই (নিয়ে) আকাম কম করে নাই। কদবানু আসার আগে সে ছোটছেলের বউকে আরও জানাল, ওই মেয়ের রূপ দেখে কাওসার ট্রেনেই পাগল হয়ে গিয়েছিল। তাই, ওই মহিলাকে সে বড়খালা ডাকে আর তার সঙ্গে শায়েস্তাগঞ্জে নেমে তার বাড়ি যায়। তারপর মেয়েটিকে বিয়ে করে নিয়ে আসে।
চোখেমুখে পানি দিয়ে আসায় কদবানু আগের চেয়ে একটু ঠান্ডা। একইসঙ্গে একটু নিশ্চিতও যে কাওসারের এই অবস্থায় বাড়িঅলার বউ তাদের দিকে ফিরে চাইছে, অর্থাৎ তাকে কদবানু ভরসা করতে পারে। ফলে, কদবানু এবার আর শায়েস্তাগঞ্জ থেকে শুরু করল না। সে সরাসরি কাওসারের বড়বউর অভিশাপের প্রসঙ্গে গেল। বড়বউ এসেছিল কয়েকদিন আগে, কোলে একমাত্র বাচ্চাকে নিয়ে। কাওসারকে বলেছিল, মাঝেমধ্যে একআধবার গোবিন্দপুর যেতে। তার জন্যে না যাক এই কোলের বাচ্চাটার জন্যে যেন যায়, এতে কাওসারের ছোটবউর সঙ্গে তার ঝগড়া লেগে যায়। আর কাওসার তখন বড়বউকে বলেছিল, সে মাঝেমধ্যে যাবে ; এখন সে তার সিএনজিতে উঠুক, তাকে সে গোবিন্দপুর নামিয়ে দিয়ে আসবে। কিন্তু বউ বলে তার আগে তাকে মাসের হাতখরচ দেয়ার জন্যে। কাওসার তা কোথা থেকে দেয় ? সব সময় কি হাতে পয়সা থাকে ? তারপর এই ঘরে ছয়ছয়টা ছেলেমেয়েÑ চারটাই মেয়ে; তিনটা ইস্কুলে যায়, তাদের খরচ ! সব সামলে কাওসার ওই বউকে সব সময় পয়সা দেয় কীভাবে। এইটুকু বলে কদবানু সময় কাওসারের দোষও বলল। কাওসার দুইখানা বিয়ে করে কাজটা ভালো করে নাই। কিন্তু এর বেশি আর কিছু বাড়িঅলির সামনে বলতে পারল না। কেননা, বাড়িঅলির সব জানা আছে। কাদবানুর ছেলে বলো আর মেয়ে বলো সবমিলে সন্তান এই একখানা। সে সারাজীবন মনে মনে চেয়েছে, তার কাওসারের যেন ঘরভরতি ছেলেমেয়ে থাকে। কিন্তু তা ওই হবিগইঞ্জা বেটিকে দিয়ে কোনওভাবে সম্ভবও না।
এখানে পিছনে কিছু কথা বাদ পড়ে যাওয়ায়, এবার আবারও বাড়িঅলির মনে হল, সেকথা তার ছোটছেলের বউকে জানানো দরকার। ফলে, সে এবার কদবানুর কথার ভিতর ঢুকল। কদবানুকে থামিয়ে দিয়ে বউকে জানাল, কদবানুর মনে মনে ওই একমাত্র ছেলের এক পাল ছেলেপুলের কম ইচ্ছা ছিল না। কদবানু হাসল। তার কী বলার আছে? নিজের গল্পই তো সে প্রায় নতুন করে এতক্ষণ বলছিল। তার ইচ্ছে ছিল, তার কাওসারের আজকের যে অবস্থা তার জন্যে ওই হবিগইঞ্জা বেটিরই সব দোষ এই কথা এই বাড়ির নয়া বউটাকে জানানো। আর এর ভিতর দিয়ে এই কথাও পৌঁছে দেয়া যে, কখনও বউর উচিত না স্বামীর কোনও দোষ, অভাব এইসব নিয়ে খোটা দেয়া। স্বামী তো স্বামী। কিন্তু দেখো, পড়াশোনা জানা বউটার সামনে শাশুড়ি সে কথা ঠিকঠাক বলতে দিল কোথায় ? বরং কদবানুকে থামিয়ে দিয়ে কাওসার আর তার দোষ বলতে শুরু করল। কাওসার এই মেয়েটাকে নিয়েই ছিল, কিন্তু কদবানু যখন দেখল যে এই বউর কোনও বাচ্চাকাচ্চা হয় না তখন কাওসারকে আবার বিয়ে দিয়েছিল। তা কোন্ মেয়ে আছে, যে তার স্বামীর বিয়ে সহ্য করে ? আর যে শাশুড়ি এমন কাজ করেছে এই শাশুড়িকে ভক্তি করে। তাই কদবানু যতই ওই হবিগইঞ্জা বেটির দোষ দিক না কেন, দোষ খালি ওই মেয়ের একলার না। এর ভিতর কদবানু ঢুকে একটু জানাতে ভোলে নাই, ওই মেয়ের তো আসলেই কোনও বাচ্চা হইল না বলতে গেলে। এতদিন বাদে এই একটা বাচ্চা। আর, এদিকে আমার কাওসারের ছোটবউর ঘরে কতগুলান ! তার এই একমাত্র ছেলে, তারও যদি ঘরে ওই একটা বাচ্চাই থাকে, তাহলে সে যায় কোথায়? তাই কাওসারকে আবার বিয়ে দিয়ে সে কী আর এমন ভুল করেছে, কোনও ভুল করে নাই। এই ঘরে কাওসারের ছয় ছয়টা বাচ্চা। লিলি ক্লাস নাইনে পড়ে।
এইসব যুক্তির কোনও অর্থ অবশ্য বাড়িঅলির ছোটছেলের বউর কাছে নাই। সে যেন ঠিক বুঝেও উঠতে পারে না তার শাশুড়ি আসলে কী নিয়ে এত সমস্ত কথা বলছে। তার বরং এখন জানা দরকার কেন কদবানুর মনে হল, ওই হবিগইঞ্জা বেটির জন্যে আজ তার কাওসারের এই অবস্থা ! কাদবানুকে সে সেখান থেকে শুরু করতে বলল। কদবানু হালে পানি পেল। আর মনে হল, বউটার জামাইর উপ্রে ম্যালা ভক্তি। ওই হবিগইঞ্জা বেটি যেমন করেছে তেমন যেন আর কোনও মেয়ে না করে। সেদিন কথায় কথায় যখন দুই বউর প্রায় হাতাহাতিই হয়, সেই সময় কাওসার বলেছিল, তার এইখানে এতগুলো ছেলেমেয়ে, মা আছে, তারপরও তো ওই বউকে সাহায্য করার চেষ্টা করে, তবু সে যদি না বোঝে ! এতে ছোটবউও একটু সুযোগ পায়। সে মনে করেছে, কাওসার না জানি তারে কত টাকা পয়সা দেয় ! তার মানে কাওসার যেদিন যেদিন সুনামগঞ্জের দিকে যায়, সেইদিনই তার আয় কম হয়। সেই তাহলে সব টাকা পয়সা বড়বউকে দিয়ে আসে। তখন বড়বউ হিসাব দিতে শুরু করে গত কয়েক মাসে কী দিয়েছে তার জামাই তাকে। যা দেয় মাঝে মধ্যে তার মায়। ছোটবউ তখন বলে যে, মায়ের কাছে যেয়ে থাকলে পারে। তার মার তো অনেকগুলান জামাই (স্বামী)। এইসব কথার এক সময় কদাবানু আর না পেরে বড়বউ, ওই হবিগইঞ্জা বেটিকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছিল। একইসঙ্গে সে ভেবেছিল, যেন কাওসার কোনওভাবে ওই বেটিকে এগিয়ে না দিয়ে আসে। তাতে প্রায় দিনের অর্ধেক যাবে। আর ফিরে আসার পরে ছোটবউর সঙ্গে তার ঝগড়া হবে। এই সব মনে করে সে বড়বউকে বাড়ির বাইরের দিকে দেখিয়ে দিলে, বউটা কদবানু আর কাওসারের দিকে তাকিয়ে ছোটবউকে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল, খাওয়া লাগবে নাÑ কাওসার যদি হাত পা ভেঙে ঘরে পড়ে থাকে। বেশি দিন বাকি নাই, কাওসারের এই অবস্থাই হবে। এইসব।
কদবানুর ধারণা, ওই বেটিও তার মার মতন জাদুটোনা জানে। শয়তানের সাথে মোলাকাত হয়। নইলে, সে জীবনে এমন কী অপরাধ করেছে, তার কাওসারের এই অবস্থা হয়। সুস্থ ছেলেটা তার বাসা দিয়ে গেল, আর এখন কোন জায়গায় না কোন জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে, কে জানে। ওই বেটিই ওই শয়তানকে পাঠিয়েছে। বলা নাই কওয়া নাই, ভালো রাস্তায় হঠাৎ ওই আট দশ বছরের ছেলেটা রাস্তার উপর দিয়ে দৌড়ে যাবে কেন। আর কাওসার ছেলেটারে বাঁচাতে যেয়ে একটা ট্রাকের পিছনে সিএনজি নিয়ে ওই ভাবে ঢুকেই বা যাবে কেন। তবু ছেলেটা বাঁচল না। ছিটকে উলটা দিক দিয়ে আসা বাসের তলে পড়ে মরে গেল।
কদবানু বিশ্বাস করে, ওই হবিগইঞ্জা বেটির পক্ষে এইসব সম্ভব। ওই জায়গাটা গোবিন্দপুর ব্রিজের খুব কাছেই। এই জাদুটোনা আবার সব জায়গায় কাজ করে না। যেখানে বসে শয়তানকে এই কাজ করতে বলা হয় তার কাছাকাছি ভালো কাজ করে। এই ঘটনা ব্রিজের কাছাকাছি হলে কাওসার মরেই যেত। ওই বেটি ব্রিজের কান্দাৎ (কাছে) এক বাড়িতে থাকে।
৩
বাড়িঅলির কাছে থেকে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কদবানু ভাবল, একটু আগে সে কী কী বলেছে, আর কী কী বলা হয় নাই। আসলে সব কথা তো বাড়িঅলির কাছে বলতেও যায় নাই। সে জানে, সব কথা সবখানে বলা উচিতও হবে না। কাওসার মানা করছে। তাই কোনওভাবেই তার মনেও আসে নাই যে এখন কাওসার কোথায় আছে এই কথা কাউকে বলবে। বাড়িঅলি জিজ্ঞাসা করলেও সে বলত না। কিন্তু আর কয়েক পা এগলে তার ভাইয়ের পান সিগারেট ও চায়ের ছাপড়া দোকান, ভাই তার কাছে জানতে চাবে এখন কাওসার কেমন আছে, আর কোথায় আছে, গাড়ি ছাড়ানোর কী হবে ? গাড়িটারই বা অবস্থা কী ?
বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কদবানু দম নিল। একটু আগে বাড়িঅলির ছোটবউটাকে যেমন সামনেই বলেছিল, আল্লায় ভালা করব। বউটার দেয়া টাকা পাঁচশো শাড়ির আঁচলে বাঁধতে বাঁধতে আবার সেকথা বলল। তারপর নিজের এতক্ষণের গল্প বানানোর ক্ষমতায় নিজেকে নিয়ে হাসলও একটু। কিন্তু এর সব গল্প কি বানানো ? সবই তো সত্যি ! এক রত্তি মিথ্যা কথাও তো সে বলে নাই। কদবানু আসলেই বিশ্বাস করে যে, কাওসারের বড়বউর জন্যেই এই অবস্থা। স্বামী তোরে দেখে না, সেই জন্যে তুই স্বামীর এমন ক্ষতি চাবি ? বদমাইশ মেয়েমানুষ। মা খারাপ হইলে ছেলেমেয়ে খারাপ হবেই। এই শয়তান মেয়েটারও তাই হইচে। টাকা পান ও একটা ছোট্ট চাবি বাঁধা আঁচলটা পিঠের দিকে ছুড়ে দিয়ে কদবানু এখন কোথায় যাবে, তাই যখন ভাবছে, তখনই দোকান থেকে তার ছোটভাই তাকে ডাকল। আর কদবানু যেতে যেতে আবারও ভাবল, কী কথা সে ভাইকে বলবে, আর কী বলবে না।
কিন্তু, কী ভেবে ভাইর দোকানের কাছে যেয়ে আবার দাঁড়াল। তার হাতে আরও কাজ আছে এমন তৎপরতা দেখাল। দাঁড়িয়ে ভাইকে বলল যে, সে দিঘিরপাড়ের আপার বাসায় যাবে। কাজ আছে। ভাই যেন পারলে লিলিকে সেখানে পাঠায়। এসময় কদবানুর ভাই দোকান থেকেই জানতে চাইল, কদবানু কাওসারের কোনও খোঁজ পেয়েছে কী না ? কদবানু জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে ভাইর দোকানের দিকে চাইল। দোকানে এখন কারা কারা আছে তা দেখল। ভাইয়ের চা বানানো দেখতে দেখতে ভাবল, ভাই যদি এই প্রশ্নটা ভুলে যায়, তাহলে ভালো হয়, তার আর কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয়া লাগে না। কদবানুর জানা আছে, এই মুহূর্তে আরও একবার জানল যে, তার ভাইটা বলদ। বলদ না হলে এই এমন খোলা যায় জায়গায় এত লোকের সামনে এই প্রশ্ন করে ? তোর কি জানা নাই যে হাসপাতাল থেকেই কাওসার পালিয়েছে। কোথায় পালিয়েছে তা তার বা কাওসারের মালিকের জানা থাকলেও এই জায়গায় তা কি বলার কথা? কিন্তু তুই কোন পাগলের মতো জানতে চাইলি কাওসারের কোনও খোঁজ আমি জানি কী না? কী দরকার? তোর যদি এতই কাওসারের খোঁজ জানা দরকার, তাহলে তোর বউকে ঘণ্টা কি আধঘণ্টার জন্যে দোকানে বসিয়ে তুই আমার সাথে দিঘিরপাড় পর্যন্ত চল, যদি আমার কাছে কোনও খবর থাকে তোকে বলব। তা না, তুই ওই জায়গা থেকে জানতে চাইলি কাওসার কোথায় ?
কদবানু আর দাঁড়াল না। একবার শুধু নিচু গলায় বলল, বাদে কইরাম। তারপর হাঁটতে শুরু করল। আর, এই সময় দিনের এই প্রায় শেষ দিকে, এক ফোঁটা এক ফোঁটা বৃষ্টির ভিতরে গত সন্ধ্যা থেকে এই সারাদিনের ধকলে কদবানুর পেটের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠল। সে জানত এমন কিছু ঘটতে পারে। ঘটাই স্বাভাবিক। ডাক্তাররা কেউ বলে টিবি, কেউ বলে যক্ষ্মা। সে জানে ক্ষয় রোগ। তার মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে না। তবে, যখন কাশির দমক ওঠে, তখন তো মাঝে মধ্যে মনে হয় চোখ দুটো খুলে পড়ে যাবে। আর জিহ্বাটা মুখ থেকে বের হয়ে একেবারে সামনের মাটিতে এসে পড়বে ; তখন আর কোনওদিনও কোনওকিছু খেয়ে দেখতে হবে না। কিন্তু এর কোনও কিছুই সব সময় ঘটে না। মাঝেমধ্যে ঘটে। শরীরের দিকে এই বয়সে যতœ নেওয়া বলো, আর তাকানো বলো আর সব সময় তাকানো হয় কোথায়। কাওসারের মতন অমানুষ ছেলে পেটে ধরে সেই মার জীবনে আর যাই থাক সুখ আর আসে কই থেকে ?
এই প্রায় এক দিনে এই প্রথম কাওসারকে মনে মনে গালমন্দ করল কদবানু। তাও করত না যদি এখন তার নিজের শরীরটা ভালো লাগত। প্রতিদিন যেমন থাকে তেমন থাকত। কিন্তু তা তো থাকার কথা না। কোনও কারণ আছে ? কাল সন্ধ্যা থেকে এই পর্র্যন্ত বলতে গেলে পেটে তেমন কিছু পড়ে নাই। সন্ধ্যার মুখে যখন সে ওসামানী হাসপাতাল থেকে ফিরে এল তখনও পর্যন্ত জানে না, কাওসার কোথায় যাবে। কাওসারের মালিকের সঙ্গে কথা বলে, বুঝতে পেরেছিল, সে বুঝেছে কাওসারের কোনও দোষ নাই। কাওসার ইচ্ছা করে ওই একসিডেন্ট ঘটায় নাই। তবুও তো মার্ডার কেস। কদবানু একবার ভেবেছিল, কাওসারের সিএনজির সঙ্গে ধাক্কা লেগে যে ছেলেটা ছিটকে পড়ে বাসের নিচে গেল, তার লাশও তো এই হাসপাতালে আছে, সে একবার লাশটাকে দেখে আসবে। কিন্তু সে কথা সে ভেবেছে এই ভালো কোনওক্রমে যেন মুখে না আনে। কাওসারের আশেপাশে ঘুরঘুর করা দুই একজনের কাছে শুনেছে, ওই ছেলের লোকজনরা এখনও ভালোমতো জানে না। জানলেও তাদের রাগ যতটা না কাওসারের ওপর তার চেয়ে বেশি ওই বাসের ড্রাইভারের ওপর। সেই ড্রাইভার পালিয়ে গেছে। ফলে, বিষয়টা কাওসারের ওপর বর্তালেও বর্তাতে পারে। সেই জন্যে ওই ছেলেটার মুখ দেখার চেয়ে নিজের ছেলেকে যত তাড়াতাড়ি এখন থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারে, তার জন্যে সেটাই মঙ্গল। তখন একবার তার মাথার ভিতর পর্যন্ত চক্কর দিয়ে উঠেছিল। হাসপাতালে গন্ধের পেটের নাড়িভুড়ির সবও তো তখন প্রায় উলটে গিয়েছিল। পেট খালিÑ মনে এসেছিল ; আর খিদেও পেয়েছিল। মুখে বারবার থুথু এসে জমা হচ্ছিল। কিন্তু হাসপাতালের ওই জায়গায়, আশেপাশে যেখানে থ্যাতলানো লাশরাখা তার কাছে দাঁড়িয়ে খাওয়ার কথা ভাবে কোন্ মানুষ ?
কদবানু ভেবেছিল। তার জন্যে ওইসময়ে খাওয়ার কথা ভাবা স্বাভাবিক ছিল। কল্পনায় কয়েকটা থ্যাতলানো লাশ দেখতে দেখতে সে যেখানে কাওসারকে দেখেছিল, সেখানে আর কাওসারকে দেখে না। আর কী আশ্চর্য ! এই না হলে মায়ের মন। কদবানুর এতক্ষণের খাওয়ার কল্পনা উধাও ! পেটে আর খিদা নাই। মাথাও ঘুরানি নাই। বরং ওইখানে কাওসারকে না দেখে তার মাথাটা উলটা দিকেই আর একটা পাক খেল। সে সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশে কোথাও পুলিস আছে কী না দেখল। না পুলিস নাই। তাহলে কাওসার গেল কোথায় ? কাওসার যদি এখান থেকে চলে যেয়ে তাকে তাহলে কোথায় গেছে ? যেখানেই যাক সে জানতে পারবে তো ? না জানলেও কোনও ক্ষতি নাই, যদি কাওসার ভালো থাকে। এসময় তার সামনে এসে দাঁড়াল রহমত, কাওসারের সাথে একই মালিকের সিএনজি চালায়; এই স্ট্যান্ডে দাঁড়ায়। রহমত বলেছিল, কাওসার চলে গেছে। কোথায় গেছে পরে রহমত জানাবে, কাওসার বলে গেছে, তাকে বাসায় চলে যেতে ; বাসায় যেয়ে পারলে যেন কিছু টাকার যোগাড় করে। এইসঙ্গে রহমত কদবানুকে আরও জানিয়েছিল, এক্সিডেন্টের সময় কাওসারের পকেটে টাকা পয়সা যা ছিল সব খোয়া গেছে। কত ছিল তা অবশ্য কদবানু জানতে চায় নাই। এখন আর তা জানতে চেয়ে কী লাভ ? রহমত চলে যেতে যেতে বলেছিল, হাজারখানেক টাকা ছিল। সেই টাকা হাসপাতালে আসার পরে কাওসার তার পকেটে আর পায় নাই। মনে হয়, যারা তাকে উদ্ধার করেছে, তারা নিয়েছে।
এরপর কদবানু আর কাওসারের পকেটের টাকা নিয়ে ভাবে নাই। সেকথা ভাবার সময় তার ছিল না। সে বরং নিজের কথা ভেবেছিল। কাওসার তাকে টাকার কথা বলে গেছে, কোথায় গেছে সে জানে না, এই টাকা সে কোথায় পায় ? আর, এই সময় কদবানু একে একে হিসাবগুলো মিলাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু, তার সামনে তখন যতগুলো সমস্যা তাতে কোনও হিসাবই তার মিলছিল না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসাবে তখন সামনে এসেছিল একটাই, কাওসার যে টাকার কথা বলেছে, তা কতটাকা ? কতটাকা হলে এই সমস্যার সমাধান ? পাঁচশো বা হাজারখানেক ? কত ? পাঁচশো হলে কোথায় পাবে তার একটা হিসাব সে করে। এক হাজার হলে কোথায় পাবেÑ সেই হিসাব মেলায়। আর ভাবে, কাওসার কোথায় গেল ? এইভাবে কতদিন কোথায় না কোথায় কাওসারকে থাকতে হয় তার ঠিক আছে। তাই যদি হয়, যদি সত্যি সত্যি কাওসার আর গাড়ি চালাতে না পারে, যদি কাওসারের লাইসেন্স বাতিল হয়, যদি কাওসারের মালিক গাড়ির ক্ষতিপূরণ চায় ? তাহলে এগুলো নাতি নাতনি নিয়ে সে কোথায় যাবে ? হাসাপাতাল থেকে ফিরে আসতে আসতে কদবানুর মাথা সত্যি চক্কর দেয়। এবার খিদায় না এই চিন্তায় না তার বহুদিনের ক্ষয় রোগে, এর কোনওটাই সে বুঝতে পারে না।
গতরাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে দিঘিরপাড়ে আপার বাসায় এসেও কদবানুর খাওয়া হয় না। বাসায় তালা দেখে খাওয়ার কথা মাথায়ও থাকে না। ততক্ষণে রাত্তির হয়ে গেছে। কদবানু ফিরতে ফিরতে হিসাব মিলিয়েছে, সে ওই বাসায় কিছু খাওয়ার জন্যে এসেছিল না টাকার জন্যে। বাসায় নাতিনাতনিগুলোর রাতের খাওয়া আছে, বাসায় গেলে সেও ডাল আর আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেতে পারবে, কিন্তু কাল সকালে কী খাবে তার কিছুই ঠিক নাই। আইজ সন্ধ্যায় কাওসারের বাজার করার কথা ছিল। তা তো হলই না, আরও কত সন্ধ্যায় বাসায় বাজার হবে না তার ঠিক নাই। আর লিলির কী হবে ? হয়তো তার নাতনিটার আর ইস্কুলেই যাওয়া হবে না।
৪
ভাই কাহেরের বলদামিতে একটুক্ষণ নিজের ভিতরে গজরাতে গজরাতে কদবানু দিঘিরপাড়ের দিকে হাঁটল। এক দুইবার পিছনে তাকাল। এর ভিতরে একবার ভেবেছে, কাহের তারে পিছন থেকে ডাকে। আসলে কাহের তারে ডাকে নাই। তার মনে হয়েছে, কাহেরকে বুঝিয়ে বলে আসা উচিত ছিল, যদি কেউ তারে কিছু জিজ্ঞাসা করে সে যেন বলে, সে কিছুই জানে না। এই সময় আগে যে মেসে সে রান্না করত, সেখানের একটা ছাত্র তারে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করল। কদবানু ছাত্রটাকে দেখে নাই। পরে আবার ছাত্রটা তাকে ডাকল। কাদবানু ফিরলে ওই ছাত্র তারে বলল, সে একা একা বিড়বিড় করতে করতে কোথায় যায় ? কদবানুর তখনই মনে হল, সে বিড়বিড় করছিল। হয় কাহেরকে গালমন্দ করছিল, অথবা, নিজের করণীয় নিয়ে ভাবছিল। সেইকথা বিড়বিড় করে বলতে বলতে যাচ্ছিল। এর যে কোনওটা হতে পারে। কাদবানু, ‘জি ভাইয়া, ভালো আচোইন ?’ বলে তার যে পান খাওয়া হাসি এতকাল দিয়ে এসেছে, তাই দিল। কিন্তু সেই হাসি তার ফুটল কোথায় ? পানই তো বলতে গেলে সারাদিন সেভাবে খাওয়া হয় নাই। ভাত খেয়েছে সেই সকালে, তারপর আর পেটে বলতে গেল কিছু পড়ে নাই। তারপরও সেই হাসি ! ছাত্রটা তা বুঝতে পারল। জানতে চাইল, কী হয়েছে। কদবানু জানাল তার ছেলে একসিডেন্ট করেছে। কোথায় আছে সে জানে না। তারপর চোখের জল ছেড়ে সামনে হাঁটল। আর, এখন আবার নিজের হিসাবগুলো মেলাতে শুরু করল। দিঘির পাড়ের আপার বাসায় যেয়ে কী বলবে। লিলি আসলে সে একভাবে কথা বলবে, লিলি না আসলে আর একভাবে। কাহের কি লিলিকে বলেছে দিঘিরপাড়ের ওই বাসায় যাওয়ার কথা। যদি না বলে থাকে, তাহলে ? কদবানু ওই বাসায় নিজের এখনকার অবস্থার কথা জানাবে।
কিন্তু কদবানু এর কোনওটাই করল না। দিঘিরপাড়ের রাস্তায় হাঁটার আগে মোড়ে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পিছনে তাকাল। লিলি আসছে কী না দেখল। লিলিকে দেখা যাচ্ছে না। কদবানু একবার ভাবল কাহেরকে গালমন্দ করে ; আবার ভাবে, যদি কাহের লিলিকে বলে থাকে তাহলে লিলির হাতে এমন কী কাজ যে দাদি আসতে বলার পরেও এতক্ষণ দেরি করে ? নবাবের বেটি নি ? নবাবের বেটি না হলে বাপের এই অবস্থায় কোন্ বুঝমান মেয়ে এতক্ষণ দেরি করে আসে ? বুড়া অসুখের দাদি এইরকম দরজায় দরজায় মানুষের কাছে হাত পাতে আর উনি ইস্কুলে যায় ! কদবানুর আগেও মনে হয়েছে, এখনও মনে হল, যখন তার দিনকাল খারাপ যায় তখন আশেপাশে কেউ তার মনের অবস্থা বুঝতে চায় না। এমন কী লিলির মতন পড়াশোনা করা মেয়েও না। তবু, কদবানুর সকল চেষ্টা লিলির জন্যে। সেটা লিলি যেমন জানে, জানে কদবানুও। কিন্তু এখন যে ফাঁড়ায় সে পড়েছে, এই সময়ও যদি লিলি এমন করে তাহলে সে কোথায় যায় ?
এই সময় তার মাথায় একদম ভিতরে চাপা ব্যথা শুরু হল। অনেকদিন বাদে আবার শুরু হওয়া এই ব্যথায় কদবানুর সুযোগ থাকলে শুয়ে পড়ত। সারাদিন এইরকম প্রায় না খাওয়া থাকলে আর এত সমস্ত চিন্তা করলে তার এই দশা হয়। ফলে, কদবানু আর কিছু ভাবল না। ঘুরে পিছনের একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একটা বনরুটি আর দুটো কলা ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করল। তার জানা আছে, এইসব দোকনদাররা প্রায় সবাই তারে চেনে। আঁচলে একটা পাঁচশো টাকার নোট আছে। যদি এই টাকা ভাঙ্গিয়ে তারা টাকা নিতে পারে তো নেবে, না হলে পরে দেবে। আর, একইসঙ্গে তার মনে হল, এত দ্রুত সে বহুকাল খায় নাই। একদম যেন তার ছোট্ট নাতনিটার মতন খাচ্ছে। এক গ্লাস পানি খেয়ে যখন ঢেঁকুড় উঠল, তখন এক বারে সমস্ত ক্লান্তি ঝরে গেলে। আর, এই রুটি ও কলা খাওয়ার সময়ে কদবানু বারবার তাকাচ্ছিল, লিলি আসে কী না। পানি খাওয়ার পর পরই ধীর পায়ে লিলিকে হেঁটে আসতে দেখতে পেয়ে কদবানু একটু হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকল।
লিলি কদবানুর কাছে এসে জানতে চাইল, তার বাপের এখন কোথায় আছে, সে জানে কী না ? কদবানু বলল। লিলি বারবার দাদির দিকে তাকাচ্ছি এই জন্যে যে, সে জানে তার বাপের এই ঘটনায় দাদির ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে। সেই সকালে বেরিয়েছে বুড়া মানুষটা, তারপর আর বাসায় যায় নাই। সারাদিন কোথায় কোথায় ছিল কে জানে। যদিও লিলি দাদির সারাদিনের দুই একটা গন্তব্য অন্তত জানে। লিলি জানতে চাইল, কদবানু ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে গিয়েছিল কী না ? কদবানু কোনও উত্তর দেয়ার আগে আরও জানতে চাইল, গাড়ির মালিকে যে বলেছিল উকিলের কাছে যাওয়া লাগবে, উকিলের কাছে কে যাবে লিলির বাপ না গাড়ির মালিক নাকি দাদি ? এই প্রশ্নেরও কোনও উত্তর কদবানুর জানা নাই। সে কিছু বলল না। তারপর লিলি জানতে চাইল, তার বাপের নামে কেস হয়েছে কি না ? এর উত্তরেও কদবানু কিছু বলল না। শুধু বলল, পরে বলবে। এখন লিলির সাথে তার অন্য কথা আছে। সেই অন্য কথাগুলো বলার আগে কী মনে করে কদবানু বলল, সকালে সে কমিশনারের কাছে গিয়েছিল, কমিশনার বলেছে, কাওসাররে এমন জায়গায় পালিয়ে থাকতে যেন কোনও ভাবে কেউ তার খোঁজ না দিতে পারে। তখন লিলি আবার জানতে চাইল, তার বাপ এখন কোথায় আছে ? কদবানু বলল, সে জানে না। আসলেই কদবানু জানে না এখন কাওসার কোথায় আছে। দুপুর পর্যন্ত কোথায় ছিল সে জানত। তারপর দুপুরের কাহেরের দোকানের পাশের গ্যারেজে মোল্লার মোবাইলে ফোন করেছিল কাওসার ; বলেছে, পরে জানাবে সে কোথায় আছে। তখন লিলি কদবানুকে বলল, তার কাছে তো এইমাত্র কাহের ভাই জানতে চেয়েছে সে কাওসারের কোনও খোঁজ জানে কী না। শুনে, কদবানু হাসল। লিলিকে জানাল, তখন মোল্লার কাছে অন্য একজন ফোন করে জানিয়েছে কাওসারের কথা, কাওসার নিজে ফোন করে নাই। লিলি এই নিয়ে আর কথা বাড়াল না।
এরপর লিলি জানতে চাইল, কদবানু এখন তাকে ডেকেছে কেন ? কদবানু বলতে চাইছিল, লিলির চেহারা দেখতে। কিন্তু সেকথা বলল না। লিলি না হয়ে অন্য যে কোনও নাতনি হলে সে এই কথা বলত। ওদিকে লিলির তা জানতে চাওয়ার কারণ আছে। এখন বাসায় থাকলে পড়তে পারত। ভাইবোন দুই একটারে পড়াতে পারত। যদিও এই সময়ে তার নিজের পড়ায় কোনও মনোযোগ আসত না সে জানে। যার বাপের এই অবস্থা, সেই মেয়ের নিজের পড়ায় মন বসে কীভাবে। দুই দিন বাদে শহরেই আর থাকা হয় কি না হয় তার কোনও ঠিক নাই। গ্রামের বাড়িও তো বলতে গেলে নাই। আছে একমাত্র দাদির ভাইয়ের একখান বাড়ি, সেইখানে এতজন মানুষ যেয়ে যদি একবারে ওঠে তাহলে কী অবস্থা হবে তাই বা কে জানে। লিলি নিজের দিক থেকে এসব ভাবতে চেয়েছিল, ভেবেও ছিল, কিন্তু সেই ভাবনার কোনও কূলকিনার করার আগে তার চোখ জলে ভিজে এসেছিল। এমনকী দাদির সামনেও সে এসব কথা মনেও করতে চায় না। লিলি জানে, বাপের এই ঘটনায় দাদি ভিতরে ভিতরে কেমন ভেঙে পড়েছে। এমননিতে দাদি আশেপাশের অন্য যে কোনও মহিলার চেয়ে অনেক শক্ত। বাপকে কতটুকু আর রেখে মরেছে দাদা, সেই থেকে এই দাদিই তার বাপকে বড় করল। বাপেরও যে কোনও হিসাব আছে, তাও না। একে একে দুটো বিয়ে করল। এতগুলো ভাইবোন তারাÑ সবই দাদির হাতে মানুষ। কিন্তু তার বাপের কালকের ঘটনার পরে দাদিকে লিলি যেমন দেখছে এমন আর কখনও দেখে নাই।
একথা এখানে মাথা নিচু করে হেঁটে আসতে আসতে লিলি ভেবেছে। কিন্তু সে ভাবনায় কাল কী হবে তা তার জানা নাই। এমনকী তার এও জানা নাই যে, কাল সে আদৌ ইস্কুলে যেতে পারবে কী না। ফলে, লিলি কদবানুকে এখানে কেন ডেকেছে জানতে চেয়েই বুঝল, এটা জিজ্ঞাসা নাও করলে পারত। বরং সে ভাবল, তার বলা উচিত ছিল, কী করতে হবে। কাহের ভাই যেভাবে তাকে ডেকেছে, তাতে তাই হত তার জন্যে ঠিক বলা। কদবানু আঙুলের চুন মুছে লিলির দিকে ঠিকমতো তাকানোর আগে লিলি আবার জানতে চাইল, দিঘিরপাড়ে ওই আপার বাসায় কেন যাবে ? কদবানু লিলিকে জানাল, কেন দিঘিরপাড়ের আপার বাসায় যাবে। সেখানে যেয়ে কী কী বলবে আর লিলির কী কী বলতে হবে। লিলি কদবানুর কথায় মাথা নাড়ল। তারপর দাদির সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকল। আর কদবানু নিজেও নিজের জন্যে এবার কাওসারের এক্সিডেন্ট আর এই বাসায় যেয়ে কী কী বলতে হবে তা ঠিক করল। বাড়িঅলিকে সে যা যা বলছে, বাড়িরঅলির ছোটছেলের বউকে যা বলছে তার অনেক কিছুই এই বাসায় বলা যাবে না। যেমন, কাওসারের বড়বউয়ের কথা। বড়বউর বদদোয়ায় যে আজ কাওসারের এই অবস্থা একথাও না। কদবানু জানে এই কথায় এইসব মানুষ হাসবে। এরা শিক্ষিত। এদের সামনে এই কথা বলে কোনও লাভ হবে না। বরং, বলতে হবে লিলি আর তার ভাইবোনদের পড়াশোনার কী ক্ষতি হবে ; সে জানে না, কীভাবে এই তিনচারজন নাতি নাতনির পড়াশোনা সে চালিয়ে যাবে। আপা আর তার পরিচিতরা যদি পারে তারে যেন সাহায্য করে এই কয়টা ছেলেমেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে।
৫
দিঘিরপাড়ের আপার বাসায় যেয়ে কদবানু সত্যি সত্যি একদম নতুন করে তার বর্তমান অবস্থা বলা শুরু করল। লিলিকে বুঝিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সে নিজের জন্যে ঠিক করে নিয়েছিল কী বলবে ; ফলে, তার জন্যে তা তেমন সমস্যা হল না। সমস্যা যা হল তা লিলির জন্যে। লিলি দাদির বলার ভঙ্গি দেখে পহেলা বুঝতে পারে নাই, তার কী করণীয়। তাছাড়া, এতক্ষণ তার সামনে যে দাদি ছিল, গতকালের আগে এতদিন যে দাদিকে দেখেছে, সেই দাদিই বা গেল কোথায় ? আর লিলি বুঝতে পারল, সে তার বাপের সমস্যা যেমন ভেবেছিল, ভেবেছিল যত সহজে তার বাপের এই সমস্যা মিটে যাবে, তার মনে হল, সমস্যা তার চেয়ে অনেক গুরুতর। লিলি কদবানুর দিকে চেয়ে বসে থাকল।
কদবানু প্রথমেই ঢুকে দেখল কোন্ আপা আছে। সে ভেবে এসেছিল, দুই আপাকে পেলে ভালো হয়। তাই সে প্রথমে যাকে সামনে পেল তাকে জানাল, গতকাল সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে প্রথমে এখানেই এসেছিল, এসে দেখে তালা দেয়া। তখন তার মনের অবস্থা যে কী তা সে বলে বোঝাতে পারবে। এখনও যে তার সমস্যার সমাধান হয়েছে তা না, কিন্তু বাড়িঅলার বাসায় যেয়ে বাড়িঅলিকে সব বলে এসেছে ; বাড়িঅলি তারে বলেছে, আপাতত যদি কয়েক মাসের ভাড়া দিতে নাও পারে, তবু তাদের বাসা ছাড়তে হবে না। কাওসারের এই অবস্থা ! বাড়িঅলি মানুষ ভালো আছে। আগে তো এইরম কোনও কারণে কদবানু যায় নাই, তাই সে বুঝতেও পারে নাই, বাড়িঅলি এত সহজে বাসার ব্যাপারটা মেনে নেবে। কদবানু তো জানে না, কাওসার কাজ ছাড়া, গাড়ি ছাড়া কতদিন থাকবে। আবারও সে জানাল, হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই সে তাদের কাছে এসেছিল। তখন তার মাথার ভিতরে শুধু কাওসারের চিন্তা। এসময় কাওসারের মালিকের গাড়ি চালায় রহমত নামের একটা ছেলে এসে যখন তাকে বলেছে বাসায় চলে যেতে আর পারলে কিছু টাকার যোগাড় করতেÑ তখনও কদবানু জানে না, সে কোথায় যাবে। কার কাছে যাবে। বাড়িঅলির ছোটছেলের বউ তাকে কিছু টাকা দিয়েছে। এই পর্যন্ত জানিয়ে কদবানু চোখের পানি ছেড়ে দিল। প্রয়োজনে আরও দেবে। কিন্তু বাড়িঅলির ছেলের বউর দেয়া টাকাটার কথা বলেই ভাবল, এটা বলা ঠিক হল কী না। যদি না বলত তাহলে এই আপাদের কাছে তার টাকা চাওয়াটা আরও জোরালো হত ? তারপর এখন লিলি পড়াশোনার প্রসঙ্গে বলবে না আরও কিছু সময় নেবে এই জন্যে একটুক্ষণ চুপ থাকল।
এই বাসায় যে দুজন মহিলা থাকে তাদের নাম শায়লা ও সাইদা। কদবানু অন্য জায়গায় তাদের নাম বলতে গেলে এখনও মাঝেমধ্যে গুলিয়ে ফেলে ; এমনকী একজনের নাম অন্যজনের কাছে বলতে গেলেও। এখনে সে ছুটা বুয়ার কাজ করে তাও মেলা দিন। যাদের মারফত পরিচয় তারা দুজন পুরুষ, থাকত এই বাসার নিচের তলায়। এরা দুইজন সিলেটে চাকরি নিয়ে আসার পরে নিচের তলায় ওই দুইজনের সঙ্গে এদের আগেই পরিচয় থাকায় তাকে এ বাসায়ও কাজ করতে বলে। এরপর ওই দুই স্যার অবশ্য এ বাসা ছেড়ে পাঠানটুলার দিকে চলে যায়। কদবানু এখনও তাদের বাসায় কাজ করে। এখন শহরে একজন আছে, অন্যজন ঢাকা। কাল রাতের পর আর সে বাসায় যেতে পারে নাই। লিলির ছোটবোনটাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে, দাদি দুইদিন আসতে পারবে না, ওর বাবা এক্সিডেন্ট করেছে। কদবানু জানে, তাদের কাছে সে যে কোনও সাহায্য পাবে, আর এই যে তার এই অবস্থায় সে যেতে পারবে না, তারা কিছু মনে করবে না। একজন মানুষ দুপুরে খায় অফিসে, রাতে দরকার হলে হোটেলে খেয়ে নেবে। আর নয় একটু ভাত ফুটিয়ে নেবে। ফ্রিজে তরকারি রান্না করা আছে। কদবানু জানে, এখন তার সামনে বসা শায়লা আপাকে জানাতে হবে, কিন্তু সাইদা আপা কোথায়? সে ভেবেছে হয়তো ঘুমিয়ে আছে। একবার ভেবেছে জিজ্ঞাসা করে। আবার কী ভেবে সে লিলির পড়াশোনার কথা জানানোর জন্যে ভিতরে ভিতরে তৎপর হয়ে ওঠে।
কদবানু বসার ঘরে যেখানে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কথা বলছিল, সেখানে বসে পড়েছে। শায়লা তাকে উঠে পাশের মোড়ায় বসতে বলেছে। কদাবনু তা বসবে না। লিলি তার পাশে দাঁড়ানো। নিজের ভিতরে বার দুই হিসাব মিলিয়ে সে ঠিক করছে, লিলির কথা দিয়েই শুরু করবে। কিন্তু শায়লা তার কাছে জানতে চাইল, তার ছেলে একন কোথায় ? কদবানু একটু আগে যে জায়গাটা কাওসার আছে জানত সে জায়গার নাম বলল না। শুধু বলল, দুপুরে কোথায় ছিল সে জানত। তাকে ওই রহমত বলেছিল, তার ভাই কাহেরের দোকানেরে পাশে যে সাইকেল রিকশার গ্যারেজের মোল্লার কাছে ফোন করে জানাবে। জানিয়ে ছিল। তারপর দুপুরের পরে বলেছে, সেই জায়গা থেকে কাওসার অন্য জায়গায় চলে গেছে। সেই জায়গাটা কোথায় সে জানে না। জায়গাটা নিশ্চয়ই শহরের ভিতরে কোথাও নয় ? এই প্রশ্ন শায়লা করেছিল ঠিক কিছু বুঝে নয় ; শায়লা মনে মনে ঠিক করেছে, এই মুহূর্তে শহরের ভিতরে কোথাও থাকা কাওসারের জন্যে নিরাপদ নয়। কাওসার যেন শহরের বাইরে যেয়ে থাকে। কদবানুও তাকে সমর্থন করল। তবে জানাল, যে জায়গায় গত রাতে কাওসার ছিল, সে জায়গাটা ঠিক শহরের বাইরে না ভিতরে তা ঠিক সে জানে না। তবে কদবানুর ধারণা, শহরের ভিতরে ওইরকম কোনও জায়গা নাই। তারপর শায়লা যখন এই বিষয়ে মন্তব্য করল, তাহলে তো সে বেশ টেনশনেই আছে। তার ছেলেটা কোথায় সে জানে না। এতগুলো নাতিনাতনিÑ এতজন মানুষের সংসার, লিলির পড়াশোনা ! এসময় কদবানু একবার বলতে চেয়েছিল, এইসবই কাওসারের বড়বউর জন্যে হয়েছে। সেই হবিগইঞ্জা বেটি কাওসাররে কয়দিন আগে বদদোয়া দিয়ে গেছে। সেই কারণে তার কাওসারের আজ এই অবস্থা ! কী মনে করে এসব কিছুই বলল না। সে জানে, এরা এইসব বদদোয়ার কথা শুনলে হাসবে। বলবে আপনার ছেলেরও দোষ আছে। ওই বউর মা যত খারাপ হোক, ওই মহিলা তো কাওসারের বউ, কাওসার তারে দেখে না কেন? এমন কি এই দোষের ভাগ তার ওপরও একটু দেবে। বলবে, আপনিই তো ছেলেরে আবার বিয়া করিয়েছেন। এই বাজারে মানুষ এমনে চলতে পারে না, একটা দুইটা বাচ্চা নিয়াই মানুষ বাঁচে না, আর আপনার ছেলের দুইঘরে সাতজন বাচ্চা ! কিন্তু লিলির সামনে শায়লা তা বলল না।
কিন্তু শায়লার লিলির পড়াশোনা নিয়ে মন্তব্যে কদবানু হালে বেশ পানি পেল। সে বলতে শুরু করল, শায়লার তো সবই জানা আছে। তারা দুইজন মাঝে মধ্যেই কদবানুর দিকে যেভাবে চাই দেখইন এমন আর কেউ দেখে না। আর ওই যে দুই স্যারÑ তারাও মানুষ ভালা আচে। তবু, এখোন কদবানু কোতায় যায়, কই যায়? মাস দুই বাদে লিলির এই ক্লাসের শেষ পরীক্ষা। সেই পরীক্ষা ফিস লাগব। সামনের বার ভরতি হইতে কতগুলান টাকা লাগবÑ এইসব সে কোথায় পাবে ? যদিও এসবই শায়লা জানে। আগেও শুনেছে। এমনকী লিলির ব্যাপারে সে কদবানুকে বলেছে, তার এই নাতনিটা পড়াশোনা করতে চায়, যেন করায়। যেন বিয়ের কথা চিন্তা না করে। কদবানুর কথা শুনতে শুনতে শায়লা ভাবছিল অন্য কথা, যদি কাওসারের কোনও প্রকার পুলিশি সহায়তা লাগে, তার এক বন্ধুকে বলবে। কিন্তু কাওসারের বর্তমান অবস্থায় সে কদবানুকে এখন আর বুঝে উঠতে পারল না। অথবা হতে পারে তার বুঝতে একটু সময় লাগল, কদবানু তাকে কাওসারের কথা সেভাবে বলতে চাইচে না।
কদবানু প্রসঙ্গ পালটাল। সে জানতে চাইল, সাইদা আপাকে দেখছে না। সে কোথায় ? শায়লা বলল, সে বাইরে এখনও আসে নাই। আসবে আর কিছুক্ষণের ভিতরে। আর জানতে চাইল, কদবানুর তার কাছে কোনও দরকার আছে কী না ? কদবানু বলল, না তার এই অবস্থার কথা যদি তার সঙ্গে দেখা না হয়, তা সে যেন বলে। সামনে কয়দিন কখন আসতে পারে আর না পারে তার কোনও ঠিক নাই। এসময় শায়লা জানতে চাইল, কাওসারের মালিক তাকে কিছু বলেছে কি না। কদবানু তা জানাল। গাড়ি থানায় কি না ? ছাড়ানো লাগবে কি না ? কাওসারের নামে কি মার্ডার কেস হয়েছে, না ওই বাসঅলার নামে ? কদবানু জানাল, এটা ঠিক সে জানে না। আর এই সময়ে এসে শায়লা বুঝতে পারল যে, কাওসারের ব্যাপারে কদবানুর মুখ থেকে তেমন কোনও কথাই সরছে না। এর কারণ সে খুঁজতে গেল না। বসা থেকে উঠে ভিতরের রুমে গেল। একটু পরে ফিরে এল। কদাবনুকে চা বানাতে বলল। লিলিকে ফ্রিজ খুলে একটা মিষ্টি দিল। কদবানু আর তার খাওয়ার জন্যে বিস্ক্টু বের করল। তারপর বসার ঘরে জানালার পাশে একটা চেয়ারে যেয়ে বসে থাকল চুপচাপ।
একটু পরে লিলির কাছে জানতে চাইল, লিলির ঠিক মনের জোর আছে কী না, বাপের এই অবস্থা, পড়াশোনা, এতগুলো ছোট ছোট ভাই বোন, দাদি এইভাবে তারে পড়াশোনা করাতে চায়, লিলি পড়াশোনা ঠিকমতো করবে তো ? লিলি প্রথমে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। এমন সে প্রায়ই দাঁড়িয়েই থাকে। আজও তাই থাকলে, একটু বাদে শায়লা লিলিকে কাছে ডেকে হাত ধরে ঝাঁকাল। তখন লিলি বলল, সে পড়াশোনা করবে। ইস্কুলের এক স্যার বলেছে, তাকে এমনি এমনি প্রাইভেট পড়াবে, কিন্তু তার ক্লাসে কেউ কেউ অন্য ইস্কুলের এক অংকস্যারের কাছে পড়তে যায়, সেখানে পড়তে যেতে পারলে হত। এই সময় কদবানু চায়ের কাপ আর বিস্কুট নিয়ে শায়লার সামনে এসেছে। সে লিলির এই কথা শুনে খুশি হল। বলতে গেলে, গত কালের পর এই প্রথম তার কোনও কথা শুনে খুশি হওয়া। সে লিলির মুখের দিকে চেয়ে থাকল। এতে কদবানু নিজের জন্যেও একটু বল ভরসা পেল। লিলিকে সে এতদিন ভিতরে ভিতরে খুবই নরম মেয়ে মনে করে এসেছে, কিন্তু এখন তার মনে হল, না, লিলি ভিতরে ভিতরে যথেষ্ট শক্ত। বরং, লিলি মা আর কাহেরের বউ অনেক ভেঙে পড়েছে। কদবানু তো আজ সারাদিনে যে এক দুইবার বাসায় গেছে, তখন তাদের মুখের দিকে তাকাতে পারে নাই। এর পাশাপাশি কদবানু আর একটা কথাও ভাবল, যদিও সে জানে এটা তার জন্যে ভাবা ঠিক না। সে ভাবল : না কি কাওসারের এই অবস্থায় লিলির ভিতরে তেমন কিছু ঘটে নাই। সে যেমন ছিল, সেইরকমই আছে ? নিজের পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু ভাবতে চায় না লিলি ?
কদবানু মাথা নিচু করে লিলিকে বলল, আপারে ভালো করে বলতে সে পড়াশোনা করতে চায়। লিলি আর কী বলে। এমনতিই তো সে তেমন কথা বলে না। দাঁড়িয়ে থাকল। কদবানু বরং লিলির পক্ষ থেকে বলে গেল, তার বাপের আজ এই অবস্থা। কয়দিন বাদে সে বড় ক্লাসে উঠবে। তখন কত প্রকারের প্রয়োজন, এই আপারা যদি তার দিকে ঠিকমতো না তাকায়, তাহলে ? লিলি তবু কিছু বলল না। একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। শায়লাও লিলির মুখ থেকে কিছু শুনতে চাইছিল না। সে লিলিকে চেনে। কোনও কথা জিজ্ঞাসা না করলে এই মেয়ে কথা বলে না। শায়লা বলল, লিলিকে এখন থেকে ইস্কুলের বেতন আর হাত খরচের জন্যে প্রতি মাসে কিছু টাকা দেবে। আজ তার হাতে একেবারে টাকা নাই, কদবানু কাল দুপুরের দিকে এসে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়। বেশি দিতে পারবে না সে। আর যে কয়দিন কদবানুর এই সমস্যা না মেটে ততদিন কদবানুর আসার দরকার নাই।
কদবানু চলে আসার আগে সাইদা আপা কখন আসবে জানতে চাইল। শায়লা জানাল, আসবে, বাসার মেয়েটাকে নিয়ে বাইরে গেছে। চলে আসবে। আসা তো উচিত। এতক্ষণ যে কেন আসল না। সে ফোন করে দেখছে কোথায় আছে। কদবানুর সাইদার কাছে কোনও দরকার কী না জানতে চাইল। কদবানু বলল, না, সে যেন তাকে বলে কদবানুর এই অবস্থার কথা।
লিলিকে নিয়ে কদবানু বেরিয়ে যাওয়ার সময় শায়লা তাকে ডাকল। জানতে চাইল, আজ সারাদিনে কিছু খেয়েছে কী না। কদবানু কোনও কথা বলল না। দাঁড়িয়ে থাকল। তার চোখ ভিজে গেল। আর জানাল, বাড়িঅলির ছোটছেলের বউ যে টাকা দিয়েছে, তা দিয়ে এখন যেয়ে বাজার করবে। তারপর রাতে তাদের খাওয়া হবে। শায়লা বলল, কদবানু যেন বাসায় বাজার করে দিয়ে চলে আসে, রাতে এখানে খেয়ে যাবে। শুনে, কদবানু কিছু বলতে পারল না। তার চোখ আবার ভিজে গেল।
বাইরে এতক্ষণে অন্ধকার। রাস্তার আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে কদবানুর চোখ জ্বলল। কেন জ্বলল সে জানে না। হয়ত, সারাদিন পেট ভরে কিছু খাওয়া হয়নি, এই জন্যে। হতে পারে, একটু আগে সে যে কেঁদেছে, এই জন্যে। হয়তো, এর কোনটা না। এই যে একটা দিন গেল, কীভাবে গেল সে জানে নাÑ এখন সন্ধ্যার পরের এই রাত তার কাছে মোটেও স্বস্তিকর ঠেকছে না। তার মনে হচ্ছে, এই রাতটা হয়তো কাল সকাল পর্যন্ত পোহাবে না। পোহালে আর একটা দিন। সেই দিনটার ভার সে বহন করতে পারবে না। হয়ত, আজ রাতেই তার জন্যে এমন কোনও খবর এসে পৌঁছবে যে রাতটুকুও সে পার করতে পারবে না।
হাঁটতে হাঁটতে কাহেরের দোকানের সামনে আসার আগে কদবানু লিলির কাছে জানতে চায়, লিলি তার সঙ্গে বাজারে যাবে কি না। তারপর নিজেই বলল, দরকার নাই। লিলি বাসায় যেয়ে দেখুক, বাসার কী অবস্থা। তার মা কী করে। ভাইবোনগুলো কেমন আছে। আর পারে যদি নিজের পড়া একটু পড়–ক। কদবানু বাজারে যাক। তার আগে, লিলিকে নিয়েই সে কাহেরকে ডাকল। কাহের কাছে আসলে জানতে চাইল, কাওসার রহমতের কাছে কিছু জানিয়েছে কি না। মোল্লা দোকান বন্ধ করে কখন গেছে। কাহের বলল। আর, কদবানুর এইসব প্রশ্নে কাহের বুঝতে পারল, কাওসার এখন কোথায় আছে কদবানু তা জানে না। দুপুর পর্যন্ত কোথায় ছিল তা তো কাহেরও জানত। কদবানু কাহেরকে বলল, কাহেরের বউ দোকানে আসলে সে যেন সিএনজি স্ট্যান্ডে যেয়ে দেখে রহমতকে পায় কিনা। রহমত জানতে পারে। সে এখন লিলিকে বাসার গলির মুখে দিয়ে বাজারে যাবে। আর পারলে কাওসারের মালিককে ফোন করবে।
৬
পয়েন্টের একটা ফোনের দোকান থেকে কাওসারের মালিককে ফোন করে কদবানু শুনল, আপাতত কোনও সমস্যা নাই, শুধু কাওসার যেন পালিয়ে থাকে। কাওসারের সঙ্গে তার মালিকেরও কথা হয়েছে, কাওসার ভালো আছে। কোথায় আছে বলে নাই। তবে কাওসার যখন মালিকের সঙ্গে কথা বলেছে, তখন সে ছিল টুকরেবাজার বাসস্ট্যান্ডে। মালিক জানতে চেয়েছিল, সে কোথায় যায়? কাওসার তাকে বলছে, সুনামগঞ্জের দিকে।
এরপর বাজার করল কদবানু। বাজার করে বাসায় ফিরে তার নিজের ভিতরে এক প্রকার স্বস্তি টের পেল। এখন কাওসারের কোনও খোঁজ না পেলেও অন্তত কয়েকটা দিন এই নাতি নাতনিগুলো না খেয়ে মরবে না। কাওসারের ছোটবউকে যখন ভাত চড়িয়ে তরকারি ও কিনে আনা একভাগা পাঁচমিশালি মাছ কুটতে বসেছে, তখন কদবানুর আবারও মনে হল, না আপাতত আর শহর ছেড়ে যেতে হচ্ছে না। কাওসারের মালিক যেভাবে বলল, তাতে কয়েক দিনের ভিতরে কাওসার এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
এরপর কদবানু যখন দিঘিরপাড়ে শায়লা ও সাইদার বাসায় গেল, তখন কাহের তাকে বলেছে রহতমকে পায় নাই। এর কিছু পরে রহমতের সঙ্গে দেখা হল কাহেরের। কদবানু ফেরার সময় কাহের জানাল, রহমত তাকে বলেছে কাওসার সুনামগঞ্জের দিকে গেছে। কোথায় গেছে, কার কাছে গেছে রহমত জানে না। তবে, অনেক রাতে অথবা ভোরে রহমতের এক বন্ধু রহমতকে জানাবে কাওসার কোথায় আছে। অথবা, কাওসার পরিচিত কাউকে পেলে তাকে রহমতের ফোন নাম্বার দিয়ে জানাবে সে কোথায় আছে। কদবানুকে চিন্তা করতে মানা করেছে রহমত। রহমত সকালে তাদের বাসায় আসবে।
এতে অবশ্য কদবানু আবার কাওসারকে নিয়ে চিন্তায় পড়ল। বাসায় যেয়ে বউকে কী বলবে। কাহেরকে বলল, কাউকে এই কথা না বলার জন্যে। এমনকি কাহেরের বউকেও না। কদবানু হিসাব করে পায় না কাওসার কেন সুনামগঞ্জের দিকে গেল। নিশ্চয়ই মালিক বলেছে। হয়ত মালিকের কোনও হিসাব আছে। হয়ত মালিক বলেছে একটু সুস্থ হলে কয়দিন সুনামগঞ্জেই যেন সে সিএনজি চালায়। কিন্তু কাওসারের এখন শরীরের অবস্থা কী, কেমন আছেÑ এই চিন্তায় কদবানু আবার গুটিয়ে গেল। রাতে লিলির কাছে শুয়ে বারবার বিলাপ করল, তার ছেলেটা যে কেমন আছে ? লিলি কদবানুর এই বিলাপ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেল। একসময় কদবানুও।
পরদিন সকালে রহমত এসে জানাল, ভালো আছে কাওসার। এখন আগের চেয়ে সুস্থ। বুকে ব্যথা নাই। কাল পারলে সুনামগঞ্জ শহরে যাবে। মালিকে কয়েকদিন সুনামগঞ্জে গাড়ি চালাতে বলেছে। কিন্তু পহেলা এখন কোথায় কাওসার আছে তা কদবানুকে বলল না রহমত। কদবানু বারবার জানতে চাইলে বলল, গোবিন্দপুর। বিস্ময়ে রহমতের দিকে চেয়ে থাকল কদবানু। গোবিন্দপুরে কোথায় ? কার কাছে ? রহমত বলল, কাওসারের বড়বউর কাছে।
কাওসার বড়বউর কাছে ? কাওসার বড়বউর কাছে কেন ? কাওসারের দুর্ঘটনা পরবর্তী সকল হিসাব মিলিয়ে এনেও এই হিসাব মিলল না কিছুতেই কদবানুর।