সভ্যতার সঙ-১
সভ্যতার সঙ-১
নাজিয়া ফেরদৌস
সভ্যতার জাজ্জ্বল্যমানতায় আজ নিজেদের বড়ই সভ্য ভাবতে শিখেছি আমরা। প্রাচীন থেকে আধুনিক আর আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিক! কি চমৎকার উত্তরণ। কিন্তু যে সভ্যতার সভ্য আবরণ ধারণ করে আমরা বুক চিতিয়ে চলি আদৌ তা কতটুকু আমাদের সভ্যতা তা কি বিবেচনা করি? অবশ্য, এমন অহেতুক বিষয় নিয়ে অযথা কাল ক্ষেপণের সময় আমাদের কই?
আজ আমাদের নিরন্তর প্রয়াস, অক্লান্ত পরিশ্রম, যারা সভ্য হয়েছেন তাদের থেকে ধারকৃত সভ্যতায় সভ্য হওয়া। এই ঝকঝকে সভ্যতাকে মালিশ করতে গিয়ে কখন যে আমরা নিজেদের চামড়ার রং হারিয়ে ফেলেছি কেউ জানতেও পারি না।
আমাদের জ্ঞানের গণ্ডি এখন বিদেশি শিক্ষার দ্বারা অধীত। আমরা ভুলে গেছি– যখন বিদেশিরা এদেশে এলো তখন আমরাই ছিলাম আর্য, আমরাই ছিলাম সভ্য, আমরাই ছিলাম সংস্কারে পরিপূর্ণ, আমরা ছিলাম প্রকৃত স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি। তারা প্রবেশ করলো আলোর ঝলক নিয়ে আর সভ্যতার ফর্সা তেল কালো গায়ে মালিশ করার লোভ আমাদের দ্বারা সংবরণ করা গেলো না বলে মাথা নত করে বনে গেলাম অনার্য, অসভ্য, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতি, ‘ব্লাডি নিগার’।
কারো ভাষ্য যদি এমন হয়– ‘যদি তা না হত তবে তো আমরা সেই তমসাচ্ছন্ন যুগেই পড়ে থাকতাম।’ তবে সেই সব চিন্তাশীল বিজ্ঞজনের প্রতি আমার বক্তব্য হল আমাদের দেশ কখনোই অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল না। যারা ইউরোপের উন্নয়নের জোয়ার আর সংস্কারকে, অত্যুচ্চ স্বাধীনতা আর পারিবারিক বিকেন্দ্রীকরণকে সভ্যতা বলে মান্য করেন তাদের জন্য সূর্যকে স্বদেশের মাটিতে এনে দিলেও অন্ধকার দূর হবে না কারণ প্রকৃত আলোর স্বরূপ সর্ম্পকেই তারা অজ্ঞাত।
যদি কেউ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলেন ধুতি, লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট শার্ট পরেই তো আমরা সভ্য হয়েছি; সভ্য হয়েছি যন্ত্র সভ্যতার যান্ত্রিকতায়, এসি চালিয়ে, ল্যাপটপের যথেচ্ছ ব্যবহারে আর ইন্টারনেট ব্রাউজিংএ, ঔষধে আর প্রসাধনীতে। তাহলে বলতেই হয় তারা গায়ে পোশাক চাপাননি বরং পোশাকে নিজের চামড়াকেই চাপিয়েছেন।
যখন রোমানরা গ্রিক জয় করেছিলো বিজিতের সব কিছুই ছিল তাদের অধিকৃত। কিন্তু তখন তারা গ্রিসের সংস্কার আর সাহিত্যকে ধারণ করেছিল নিজেদের সাহিত্য ভাণ্ডার ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে, নিজেদের সংস্কৃতিকে গ্রিক সংস্কৃতিতে পরিণত করতে নয়। আমরা আজ যা করছি তা উন্নয়ন নয়, সভ্যতা নয় বরং রং মেখে সং সাজা।
ভাবতে অবাক লাগে যে জাতি ভাতে তৃপ্ত সে কীনা জোর করেই অভ্যস্ত হতে চাইছে চাইনিজ আর জাপানিজ খাবারে আর অবলীলায় হাম-বার্গার, হট-ডগ আরো যে কত কি অধিকার করছে দেশীয় বাজার। দেশের পিঠা পুলির ঠাঁই আজ পিঠামেলা আর লোকশিল্প জাদুঘরে আর আধুনিক সভ্যতা নামক পিঠার রসে এখন প্রতিনিয়ত সিক্ত আমরা। এখন তো আর মন চাইলেও পিঠা পিঠা করে উদগ্রীব হতে পারব না – লোকে যে অসভ্য বলবে!
সভ্যতার স্বাক্ষর রক্ষার্থে আজ আমরা মাকে মা না বলে মাম্মীতেই শান্তি খুঁজি আর বলি এ দেশের কিচ্ছু হবে না। এফএম রেডিও আর ডিস্ সার্ভিস এর বদৌলতে আজ ২১ শতকের বাংলা সজ্জিত হয়েছে বাং-হিং-লিশ (বাংলা+হিন্দি+ইংলিশ) ভাষায়। যেমন খিচুড়ি আমাদের পোশাক-আশাক তেমন খিচুড়ি ভাষা। বিচিত্র কী?
আজ লোকসঙ্গীত আমাদের সভ্য মনকে তৃপ্তি দিতে ব্যর্থ বলেই আমাদের শ্রবণেন্দ্রীয় মুগ্ধ পপ সংগীতের ঝংকার ধ্বনি শোনে অথচ ভুলক্রমেও একটি মুহূর্তও সভ্য মনটাকে নিজ সংস্কৃতির দোর গোড়ায় নিয়ে যেতে আমরা নারাজ। উৎকৃষ্টই উপাত্ত ধারণ করে নিজের অতি সাধারণ সম্পদগুলোকে উন্নত করে তুলতে আমরা আদৌ শিখিনি বরং নিজের যা ছিল, যতটুকুই ছিল সমূলে সমর্পণ করতে বসেছি ধৃত সংস্কৃতির পদতলে। কিন্তু কেন?
ইউরোপ কি এদেশ থেকে সম্পদ লুট করে নিয়ে সমৃদ্ধ হয়নি? তারা তো অন্যের সংস্কারে নিজেদের ভাসিয়ে দেয়নি বরং অধিকৃত পুষ্টিকে নিজেদের ঐতিহ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে নতুনভাবে। উনিশ শতকে যে নবজাগরণ সর্বক্ষেত্রে সভ্যতার তোলপাড় এনেছিলো তাও মূলত রং মাখার মত। যদি সভ্য হতে চাও তবে নিজের চামড়া পাল্টে ফেল নয়ত রং মাখো। আমরাও নিজেদের সভ্য করার অজুহাতে এক মোক্ষম পন্থা অবলম্বন করলাম। বিদেশি সংস্কৃতির রং ঘষে ঘষে মাখতে শুরু করলাম – কালো চামড়ার কলঙ্ক তো ঘোচাতে হবে।
যে চিকিৎসা শাস্ত্রে এক কালে ভারত ছিল শীর্ষে তা এখান থেকেই পাশ্চাত্যে গিয়ে রূপান্তরিত হল চিকিৎসাবিজ্ঞানে। জ্যোর্তিবিজ্ঞান আর দর্শন পরিণত হল মডার্ন সাইন্সে। আমরা বললাম– ওরে বাবা!! ওরা কত সভ্য! বিষয়টা হয়ে গেল কৈ এর তেলে কৈ ভাজার মত। আমাদের সম্পদ দিয়ে আমাদেরই বশ করলো সভ্য দেশগুলো। আর আমরা সেই তখন থেকে এখন অব্দি তাদের সেই বশীভূতকারী রং এ সঙ সেজে বসে থাকলাম।
এই নকল রং এর আবরণে আবৃত যে সভ্যতাকে আমরা বয়ে চলেছি তা সভ্যতা নয় বরং উপনিবেশায়নের আরেকটি নতুন রূপ। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হলে মিথ্যা সভ্যতার ভয়ংকর রাসায়নিক রং-এ আমাদের প্রকৃত চামড়াই নষ্ট হয়ে যাবে নিভৃতে। না তখন আমরা আমাদের থাকবো না অন্য কারো হয়ে যাবো। আরোপিত সংস্কৃতি কখনো মৌলিক সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে না, যা পারে তা সভ্যতা নয় বরং পরনির্ভরশীলতার শৃঙ্খল।