স্বপ্নের ভিতর যখন ক্রমাগত স্বপ্ন চাষাবাদ হয়
মায়ের খাতাটি কবে থেকে আমার দখলে আছে তা সহজে স্মরণ করতে পারি না। এখন, এই যে এই সময়, তাতে আমার মনে হচ্ছে, তা যেন কখনই আমার হাতে আসেনি! তাই আমার মাকে জানাতে গেলে দেখি, ছায়াসহ মা-আমার কোথায় হারিয়ে গেছে। আমি আমার কথাকে ডানে দাঁড়ানো আমার মেয়েকে বলতেই সে কুটকুট করে হাসে। তার হাসি না-থামলে তো আমি আমার কথা শুরু করতে পারি না! আমাকে অপেক্ষা করতেই হয়। কিন্তু আমার মেয়ের হাসি লুপ্ত হওয়ার আগেই আবারও মায়ের খাতাটি খুঁজে বের করার বাসনা হয় আমার। আমি হয়ত সেই ধান্ধাতেই জানালার পাশে যাই। সেখান থেকে সকালের তেরছা রোদ সরে গেছে। কিন্তু সেখানে যে রোদ-রোদ ছায়া জমেছে তা মূল ছায়ার আদল নয়। কারণ তাতে খুনে রক্তের নেশা আছে। এমন আজগুবি অবস্থার মাহাত্ম্য জানতেই আমার মেয়ের হাসিকে অনুসরণ করি। কিন্তুএখন তার হাসির স্থলে তার চোখের দৃষ্টিতেই এমন এক শাসন আছে যে আমি আর একটা কথাটাও বলতে পারি না। মা, ছায়া কিংবা রোদ নয়, এখন আমার মেয়ের শাসনেই আমি নিয়ন্ত্রিত হই। এখানে একটা স্বপ্নের কথা থাকতে পারে, কারণ আমাদের মেয়েটার যখন জন্ম হয়, যখন তার বয়স একটা সপ্তাহও পার হয়নি, তখনই মেয়ের মা তার কাচা শরীর নিয়ে আমাকে নিখুঁত ঘুম থেকে জাগায়, তার দেখা টাটকা স্বপ্নের কথা বলে। তার আজগুবি বয়ানে আমি হৈহৈ করে উঠি। কারণ সে রূপকথার মতোই বলে, মেয়ের বাসনার বাইরে থাকার কোনো বুদ্ধি তোমার নাই। কী আশ্চর্য- এই সব ফালতু বচনের মানে কি? এই সেলফোন, ইন্টারনেট আর ক্যাবল মিডিয়ার যুগে একটা মানুষের, যেই মানুষ এখনও কথাই বলতে জানে না, তার কাছে আমার যাবতীয় স্বপ্ন এভাবে সমর্পণের মানে কী!
তারও পর অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও আমারই স্বপ্নের ভিতর মেয়ের স্বপ্ন মিশে যায়! কারণ আমি যে-স্বপ্নের কথা বলব বলে আমার মুখ খুলতে চাই, ১০ বছরের নোভা আমার দেখা খোয়াব তার জবানিতে বলতে থাকে! আমি অবাক হয়ে থাকে দেখি, আমার স্বপ্ন তার স্বপ্নের ভিতর হানা দেয় কী করে! আমার এ কথাকে কোনো দিন সে পাত্তা দেয় না। এখনও দিচ্ছে না। কারণ এখন সে আমার মায়ের কাছে থাকা পারিবারিক খাতার কথা বলতে থাকে। অনেক জনম আগেই নাকি সে খাতার জগতে বিচরণ করে এসেছে। সে বলে, খাতাটার ভিতর তোমার স্বপ্ন আমি বুনে দিয়েছি! কী সেই স্বপ্ন? সে বলে, তোমার মা অর্থাৎ আমার দাদীর খাতায় তুমি আনন্দের জোয়ার পাবে। জোছনার মায়াবী প্রলেপও পাবে। এমনকি মায়াময় আনন্দকে নিজের মতো করে বিলাতেও পারবে।
আমি ভয়ে ভয়ে কাঁপি- খাতা খুলি। স্বপ্নের রেশের ভিতর সত্যিই আমি সেখানে সর্বজনীন গোলাপের গন্ধ পাই!
১১.১১.১২
অবশেষে মায়ের চোখও চিহ্নিত হয়
মিছিলের মতো চিৎকার করতে করতে একঝাঁক দমনমুখর পুলিশ আমারে চুদন লাগায়, ‘মান্দার পো, তুই স্বপ্নের ভিত্রেও মা’র খোয়াব লইয়া নাচানাচি করোছ!’ ‘আরে না, ক্যাডায় কয়?’ ‘তুই না-ও করোছ! মাঙ্গীর পুত্!’ ‘না না।’ তুই কছ নাই, আমরা কুত্তা সিধা করা ¯েপ্র দিয়া মাইনষেরে পুন্ মারি!’ তাদের এমনসব কথা শুণতে শুনতে আমার চলাচলও এলোমেলো হওয়া শুরু করে। আমার এই স্বপ্নের খবর তারা নাকি তাদের ঘামের স্রোতের ভিতর দিয়াই জেনে নিয়েছে! তারা জানে ঘামে রক্ত সৃজিত হয়। মায়ের রূপটি যে আমার জন্য আলাদা একটা সাম্রাজ্য সৃজিত হওয়া শুরু করছে, এইটা তাদের শর্টলিস্টেও আছে- আচানক কারবার! আমি বহুবার চেষ্টা-তদ্বির করে মায়ের রূপটি স্পষ্ট রাখি। ঘিয়ে রঙের ভেজা-ভেজা চামড়ার ভিতর মাথার শাদা চুল বেশ মিশে আছে, অনেক দূর থেকে তা যেন উড়ে-উড়ে আসে! মায়াবী দিঘির জলে তিনি নাকি প্রতি সন্ধ্যায় গোসল করেন। তার কথা আমি কাউকে বলি না। কারণ আমি মাকে কথা দিয়েছি, তার এই বচন আমি কারোর সাথেই শেয়ার করব না। আমি বার বার স্মরণও করছি যে, আমি আমার মায়ের কথা রাখতে পারছি। কিন্তু পরদিন, বা তার পরদিন, কিংবা সেই দিনের দুপুরের পরের দুপুরে মা আমায় শাসায়, আমি নাকি তার কথা রাখিনি। আমি নাকি সূর্যের ঘামে ভিজা-ভিজা কথাকে স্বপ্নের ভিতর টেনে নিয়ে আসি। আমি যতই বলি, আমার জন্মের দোহাই, আমি তোমার কথা আর কাউরে বলিনি! মা আবার কথা বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না; বরং দিনের বেলায় মানে জাগরণে আমি কি বলেছি তাই স্বপ্নে বয়ান করতে থাকেন। আমি ভেবে পাই না, স্বপ্ন আর জাগরণ এক হয় কেম্বা কইরা! মা কি স্বপ্নের ভিতর দিয়াই তামাম দুনিয়া ভরাট করা শুরু করল। তা-ই পাশের খাকি-পোশাককে বলি, সে আমার কথা শুনে অট্টহাস্য সৃজন করে, তার হাসিতে দুপুরের রোইদ কাঁপে, কবরের বুকে লাগানো রক্তজবা থিরথির কইরা নড়ে! এ কাঁপুনির ভিতরই আমারেও জানায়, এই জমানায় কারও কথাই আর কারও পেটে থাকবে না, রাস্তা রাস্তায় ঘুইরা বেড়াবে! কী বলে মানুষটা! আমার শরীরে অবুঝের মতোই ঘাম বয়। কাঁপে। সেই কাঁপুনি এত ঘষা-ঘষা আর আর্তনাদময় হয় যে, আমি আমার ভিতরেই ক্রমাগত ঘামতে থাকি। সেই ঘামাঘামি থেকে উদ্ধার পাওয়ার মানসে বায়ে ডায়ে উপরে-নিচে তাকাই, মাকে খুঁজি- কাউরেই দেখি না। পাশের জন আমার এমন নাড়াচাড়া দেখে আরও চুপ হয়া যায়। এখন আমি কী করতে পারি, তাই তাকে জিগাই। সে আরও-আরও সময় ধরে আমায় অপেক্ষা করতে বলে। আমি কতকাল অপেক্ষা করেছিলাম জানি না। সেই অপেক্ষার ভিতর আলাদা একটা জগৎ তৈরি হয়। সেইখানে আমার মা আমার জন্য অপেক্ষা করে। এমন নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি অনবরত অপেক্ষা করি। কিন্তু সেই অপেক্ষার কাল আর নড়তে চায় না; আমায় একজন আবারও ধমকায়, আমি আমার স্বপ্নের ভিতরই স্বপ্নের জন্য কী করে অপেক্ষা করি, তাই জানতে চায়। আমি এর জবাব খুঁজে না-পাওয়াতে লোকটি আমার নীরবতা ধরে টান দেয়, আমি সব-কথাই স্বপ্নের ভিতর দিয়েই পাচার করে দিয়েছি, তাই জানায়। আমি এসব অস্বীকার করতে গেলেই আশপাশ থেকে শত শত জলকামান দৌড়ায়। তারা হুঙ্কার দেয়। এবং তাদের পেটের ভিতর থাইকা মরিচের গুড়ামিশাইন্যে এককিসিমের জল বের করে। তাই সমানে আমায় ভিজাতে থাকে- জলের এমন রং আমি বাপের জন্মে দেখি নাই। আমি এসব থাইকা বাঁচার মানসে চোখ বুঁজেই সমানে দৌড়াতে থাকি। আমার চারপাশ থেকে কবরের আর্তনাদের মতো চিল্লানি বেরোয়। আমি দৌড়তে দৌড়তে একসময় ভাবি, এখানে তো মরিচের গুঁড়ার জল নাই মনে হয়, তবু আমার এ চোখ-জ্বলুনির কারণ কি? তবে আমার আশপাশের বান্দারা আমার কথাকে আমারই ঘাম দ্বারা প্যাঁচায়। হিহিহি করতে করতে আমার চারপাশে দৌড়াদৌড়ি খেলে, আমার সর্বাঙ্গে যেন মরিচের গুঁড়া দিয়া পিষতে থাকে। হঠাৎই এত গণ্ডগোলের ভিতর মাকে দেখি। মা এখানে এল কী করে! তার এ অবস্থা কেন! তার চোখও দেখি রক্তাক্ত জলে সয়লাব হওয়া শুরু করেছে, জলের এ কেমন ধারা- যেন তার চোখ দুটি গলে গলে পড়ছে!
২৫.১.১৩