নারীবাদ ও কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাসের নায়িকারা
মোহাম্মদ ছাদিকুর রহমান
আদিম ব্যবস্থা চালু হবার পর থেকেই নারীরা অবহেলিত হয়ে এসেছে। নারীরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। সব জায়গায়ই নারীরা পুরুষের অধীনস্থ থাকে । নারীর ব্যক্তিগত মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই বরং তাদেরকে দাসী হিসেবে দেখেছে এমনকি ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখতেও কার্পণ্য করেনি। আবার প্রয়োজনে দেবীর আসনে বসিয়েছেন । উল্ফের মতে, মহাজাগতিক আলোচিত প্রাণী নারী । নারী এবং পুরুষের অধিকার সমান, মূলত ধরা যেতে পারে এটাই নারীবাদের মূলকথা। পুরুষরা নারীদের অবদমিত জায়গা থেকে দেখেছে, অধিকারের জায়গা থেকে নয়। নারীবাদীরা মনে করেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের নিকৃষ্ট একটা অবয়ব দান করেছেন, বাকস্বাধীনতা এমনকি চিন্তার স্বাধীনতা পর্যন্ত হরণ করেছে । এ আপাতসৃষ্ট ঘৃণ্য অবস্থান থেকে নারীদের উত্তরণ ঘটাতে হবে, পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তবে কী পরিবর্তন ঘটাতে হবে, সে সম্পর্কে তাঁরা পোষণ করেন নানামত।
হিন্দু পুরাণে নারীকে বলা হয়েছে ‘প্রজননার্থম’। অর্থাৎ নারী শুধু প্রজননের জন্য। নারীর যে কোন কাজকে বলা হল ‘Shadow Work’। নারীবাদের ছয়টি ইস্যু বিশেষভাবে লণীয়:
১. পিতৃতন্ত্র
২. ব্যক্তি-পরিসর ওঁ গণ-পরিসরের মধ্যে বিভাজন
৩. জৈবিক লিঙ্গ ও সামাজিক লিঙ্গের মধ্যে বিভাজন
৪. সমতা ও ভিন্নতা
৫. যৌনতা
৬. নারী ও অর্থনীতি
আধুনিকতা আর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বিত কমলকুমারকে আমরা চিনি, কিন্তু তাঁর উপন্যাসে নারীচরিত্রের যে সঙ্কট আর শঙ্কা তা আমাদের নতুন করে চিন্তার যোগসূত্র ঘটায়। কয়েকটি উপন্যাস –অন্তর্জলী যাত্রা, সুহাসিনীর পটেটম, অনিলা সুন্দরী, গোলাপসন্দুরী ইত্যাদি উপন্যাস আমাদের নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির খোরাক জন্মায়।
অন্তর্জলীযাত্রা ব্রাহ্মণকন্যা যশোবতীর প্রতিবাদ করার ভাষা নেই, হিন্দু রীতিনীতি তাঁর রক্তের শিরায় শিরায় এমনকি মগজেও এঁটে আছে। সে স্বাধীন হতে চায় কিন্তু পারে না । কারণ সে ভারতবর্ষের দীর্ঘদিনের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার শিকার । রামমোহন রায়ের সংস্কারধর্মী কাজের মধ্যে সতীদাহ প্রথা বিলোপ একটি অন্যতম উদ্যোগ। আইন পাশ হলেও সবেেত্র কার্যকর হয়নি । গোপনে গোপনে সতীদাহ হত। এর একমাত্র কারণ পুরুষতান্ত্রিকতা । এর থেকে উত্তোরণের জন্য আইনের দরকার হয় না, যেটা দরকার সেটা হলো উচ্চপর্যায়ের মানসিকতা। উপন্যাসে কবিরাজ বিহারীনাথ ল্মীনারায়ণকে বোঝায় যে অল্পবয়সী বিধবার ভার কোন বাপ নেয় না। সমাজ ধর্মের শিকার হয় নারী এভাবেই। কৌলিন্য প্রথানুসারে পিতাকে দায় থেকে মুক্ত করার জন্য যশোবতীকে সহজ সত্যের মতো মেনে নিতে হয়েছে এ বিয়ে। স্বামী কেমন হবে, কে হবে এটা যশোবতী জানে না, কারণ সমাজ তাকে সে অধিকারটুকু হরণ করেছে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পুরুষের নিজেদের ভোগ-সুখের জন্য পতিব্রত্যের মাহাত্ম্য অর্জনের ভার নারীদের ওপর চাপিয়েছে, মহিমান্বিত হবার ভার শুধু নারীর একার, পুরুষের নয়। আর মহিমান্বিত হবার জন্য সমাজ যেন যশোবতীকেও প্রস্তুত করে দিয়েছে। ‘যাও, স্বামীর সাথে যাও। ওখানেই তোমার স্বর্গ ।’ উপন্যাসের আরেক সজীব চরিত্র বৈজু । যাকে বিবেক চরিত্রও বলা যেতে পারে । সেই বৈজুও যশোবতীকে পালিয়ে যাবার কথা বলেছে। স্বাধীন হতে বলেছে। কিন্তু যশোবতী ধর্ম-সংস্কারের কারণে তা পারেনি। বৈজু যশোবতীকে সতীদাহ থেকে রার জন্য রাতের আঁধারে সীতারামকে গঙ্গার জলে ফেলে দেবার জন্য নিয়ে গেলে যশোবতী উন্মাদিনীর মতো আচরণ করে যা বহুদিনের সংস্কার-ভাবনাজাত আচরণ। কিন্তু একমুখী বিদ্বেষই শুধু বৈজুর প্রতি যশোবতীর ছিল না, অজান্তেই মনে হয় গড়ে ওঠেছে আদিম অনুভব। কোটাল বান দেখে বৈজু যেতে চাইলে যশোবতী বজ্রমুষ্ঠিভাবে বৈজুর হাত ধরেছিল। বৈজু কোটালের জল দেখে বৃদ্ধ সীতারামের সম্ভাবব্য দুর্দশার কথা যশোবতীকে জানালে যশোবতীর ‘মরুক’ কথাটা উচ্চারণ মনে হয় বহুদিনের অবদমিত মুক্ত হৃদয়ের এক স্বতঃস্ফূর্ত ধ্বনি। কমলকুমার মজুমদার অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলাদেশের প্রোপটে তাঁর অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাস রচনা করে দেখিয়েছেন নারীর নিজস্ব সত্তা উপলব্ধির আর স্বাতন্ত্র্যের অন্তরায়গুলোকে। যশোবতীর ণকাল স্বাধীন উপলব্ধির মধ্য দিয়ে কমলকুমার মজুমদার সূচনা করেন যশোবতীর তথা নিজের বন্ধনমুক্তির পথ। নারীর জন্য আয়োজিত বহুবিধ ধর্ম-সংস্কারের এই শৃঙ্খল ভেঙ্গে যশোবতীর সংস্কার শেষ পর্যন্ত যশোবতীকে সলিল-সমাধি দিয়েছে। কিন্তু পূর্বমুহূর্তের অবদমনমুক্ত স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্তধ্বনিটুকু আধুনিক মুক্তিচন্তার নারীর পথ প্রদর্শক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
অন্তর্জলী যাত্রার মতে সুহাসিনীর পমেটম উপন্যাসে নারীবাদ তেমনভাবে আসেনি। কিন্তু লখাই-র মার চরিত্রে এবং শিশু মনে যৌন সংগমের প্রতিক্রিয়া বর্ণনাকালে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অপরিপূর্ণতা আমরা দেখতে পাই না। নারীবাদে যৌনতা নামে একটি ইস্যু রয়েছে যা ‘Defines Feminism' -র পরের ধাপ । নারী যৌনতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। নারী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দিক দিয়ে যদি ল করি তাহলে দেখা যায় লখাই-র মা সমাজের বিধি-নিষেধ ও নিয়মের তোয়াক্কা করেনি। তিনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের স্বাতন্ত্রিক ঔজ্জ্বলতার বলিষ্ঠ এক ভাবমূর্তি । নারীবাদী সমালোচকরা মনে করেন, প্রতিটি নারী নিজের ইচ্ছে ও শক্তি অনুসারে নিজের ভূমিকা বেছে নেয়ার অধিকার রাখে। আর এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা শব্দটি অনেক বেশি প্রাধান্য বহন করে। তার নারীর ক্ষেত্রে স্বাধীনতা হচ্ছে নিজের ইচ্ছের পথে কোনো বাধা না থাকা । লখাই-র মার ক্ষেত্রেও একই জিনিস প্রত্য করা যায়। কারণ লখাইর মা তার নিজস্ব স্বাধীনতাকে বড় করে দেখেছে। এ ক্ষেত্রে পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজকে কীভাবে কোনদিক দিয়ে কী ভাবছে তা দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। তাইতো সে নারীবাদী সমাজের যৌনতার ধারক হয়ে উঠেছে আস্তে আস্তে।
অনিলা স্মরণে উপন্যাস নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে– ভারতীয় ধর্মসংস্কারাচ্ছন্ন নারীর সাথে সাদৃশ্যের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না এখানে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী পুরুষের ভোগের সামগ্রী। সমাজ তাকে ধর্মীয় অনুশাসনের গ্যাড়াকলে বেধে রাখতে চায়। আর এ থেকে উত্তোরণের প্রচেষ্টায় নারী তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। নিজের আমিত্বকে বড় করে দেখে ঠিক যেমনটি দেখেছিলো লাবণ্যদেবী । ভারতীয় সংস্কারাচ্ছন্ন মনোনিবেশ লাবণ্যদেবীর মধ্যে লক্ষ করা যায় না, কারণ সে তথাকথিত নারীদের মতো স্বামী মরার সাথে সাথে নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দেয়নি। ঠিক যেমনটি দিয়েছিলো যশোবতী। তাইতো বাবার অনুরোধে বিয়ে করতে এসে স্বামী সীতারামকে দেখে বাবার কাছে প্রশ্ন করেছিলো ‘বাবা তুমি!’ ঠিক পরণই সংস্কারের চোরাবালিতে নিমজ্জিত হয়েছিলো। সমাজের কাছে, ব্যক্তির কাছে, পরিবারের কাছে, নিজের কাছে যশোবতী নিজেকে বিসর্জন করেছিলো। কিন্তু লাবণ্যদেবী তা করেনি। কারণ তার কাছে মৌলিক নিজস্বতা বড় হয়ে উঠেছিলো। তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারালো ও নিষ্ঠুর আইনে সে নিজেকে হারিয়ে যেতে দেয়নি বরং প্রস্ফুটিত লাল রক্তজবার পেলবতার ন্যায় নিজেকে সমর্পন করেছে স্বামীবন্ধু রঞ্জিতের কাছে। এমনকি মেয়ের কাছে বিয়ের সংবাদ দিতেও সে ণটি ভাবেনি। ঠিক উদারসর্বস্ব নারীবাদে যেমনটি বৈশিষ্ট্য।
গোলাপ সন্দুরী-তে নারীর “Jouisance ”-কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নিও-ফ্রেঞ্চ ফেমিনিজম বা নব্য ফরাসী নারীবাদী স্কুলের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল নারীর যৌন অবদমন। কিন্তু Post Feminism ইতিমধ্যেই একটি নতুন নারী প্রতিমা (icon) সৃষ্টি করেছে ‘Jouisance' বা যৌনপুলক অর্জন। নারী সবদিক থেকে পুরুষের আত্মস্থ এটাই প্রথাগত নিয়ম হয়ে আসছিল । গোলাপ সুন্দরী- তে মনিকা চরিত্রটি একই অনুষঙ্গে সৃষ্ট। তাকে বিলাসের জীবনতৃষ্ণা পরিস্ফূটনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তার জন্ম বিলাসের চেতনাতেই । বিলাস যে গোলাপ ফুটিয়েছে তার প্রতিকল্পে একজন নারী কল্পনা করেছে; যে মনিকা গোলাপ বাগানের পাশে এসে তার দাড়ানো, বিলাসকে দেখা, চলে যাওয়া, নিমন্ত্রণে না আসা আবার পরে নিজেই এসে সে প্রসঙ্গ উত্থাপন কিঞ্চিৎ কৌতূহলের জন্ম দেয় বইকি । ভারতীয় রতিশাস্ত্রের অনুরাগ-বিরাগ ধারণা মনে হয় কমলকুমার ব্যবহার করে থাকবেন । কিন্তু যে মনিকা ছিল বিলাসের মানসী, গৃহে সে শারীরিক উপস্থিতি নিয়ে এসেছে। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে মনিকা যৌনতার ুধাতুর একজন কামনায়িকা, শরীরী আখ্যানটিকে সে বড় করে দেখেছে। নারীর অবদমনের জায়গা থেকে সে নিজেই নিজেই বের করে এনে আলোকসজ্জা দান করেছে । কামকাতর ইচ্ছাটাকে বড় করে দেখেছে। সে নিজেই নিজের দ্বারা Objectifz হয়েছিলো। তাইতো যৌবন সলিলে ডুব দিয়ে নিজের আকাঙ্খার শৃঙ্খলে বাধা পড়ে গেছে। স্বচ্ছতার বা পবিত্রতার বেড়াজালে বন্দী হওয়াকে নারীবাদীরা বিরোধিতা করেছেন । মনিকা সেই উদ্ভাসিত নারী। যে নিজে গোলাপ সুন্দরীর প্রতীকী উদ্ভাসনে নিজের যৌন পুলকতায় নিজেই পুলকিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সংস্কারাচ্ছন্ন না হয়ে আধুনিকতায় পরিস্ফূট হয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নারী হয়ে উঠেছে, যা নারীর দমনরীতির বেড়াজালে ছিন্ন করে ফেলেছে।
কমলকুমার মজুমদার নারীবাদী দৃষ্টিকোণ দিয়ে কোনো উপন্যাস রচনা করেননি। নারী সব সময়ই তাঁর উপন্যাসে গৌণ বিষয় হিসেবে থেকেছে। কিন্তু চরিত্রের বিস্তৃতের বিকাশে যশোবতী, লাবণ্যদেবী, লখাইর মা, সুহা, মনিকা এরা সবাই নারীবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে । ব্যক্তিত্ব ও সৃষ্টিশীলতার কর্ণধার কমলকুমার সমাজের বৈপরীত্যের দিকটা তাই উপন্যাসের নারীদের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ করেছেন এবং যতদূর সম্ভব সফল হয়েছেন।