শুভাশিস সিনহা’র ডেকেছিলাম জল
শুভাশিস সিনহা’র ডেকেছিলাম জল
ডেকেছিলাম জল ; কবিতা ও গীতের অভিসার
সামজীর আহমেদ
---------
কবিতায় সুর আর সুরেলা কবিতার এক অনন্য উদাহরণ শুভাশিস সিনহার ডেকেছিলাম জল কাব্যগ্রন্থটি। ডেকেছিলাম জল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় একক সুরের জগত। আর এই একক সুরের কারণেই এটি একটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ। একটা কবিতা থেকে আরেকটা কবিতার গ্রন্থন এখানে বেশ স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। এই গ্রন্থন দাঁড়িয়ে আছে সুরের উপর।
সারাদিন এক বাঁশিওয়ালা ধূলির উপর দিয়ে
রোদের উপর দিয়ে, হাওয়া রেখা ধরে ধরে
বাঁশি বাজিয়ে গেল
ডেকেছিলাম জল এর প্রতিটি কবিতাজুড়ে এই বাঁশিওয়ালার সুরের কাজ। সব কিছু ভালো লেগে গেল কিংবা কবিতা ও কবিতার ভার এর মতো নিপাট গদ্যকবিতাও এখানে মিঠা সুরে ভেজা।
সব কিছু ভালো লেগে গেল, কবিতা ও কবিতার ভার, অমসৃণতার জাদু, ভাব, প্রথমে শিশির ঝরেছিল, ছদ্মসম্ভবার কাছে- এসব কবিতা পড়তে পড়তে টের পাওয়া যায় কবিতা আর গানের অভিসার। যদিও এই অভিসার কম বেশি সবকটি কবিতাতেই টের পাওয়া যায়।
সুরের কারণেই শুভাশিস সিনহা একজন সহজ, সাবলীল, সহজাত কবি। ডেকেছিলাম জল এর কোন অংশেই মেকি ভাবটা পাওয়া যায় না। সুর আর গতির কারণে ডেকেছিলাম জল এক প্রবাহমানতার নাম। কাব্যগ্রন্থটি এর উৎসর্গপত্র থেকেই গীতিময়, কাব্যময়। উৎসর্গ অংশটুকু তুলে দেয়ার লোভ এখানে সামলানো গেল না-
মা ও বাবাকে
জরায়ুর ঘর ভেঙে গেলে
শুরু হল সন্ন্যাসজীবন
যত ঘর বানিয়েছি
হয় না সে ঘরের মতন
শকুন্তলার মতো নিরলঙ্কার সুন্দর এই অংশে তিনি যেমন উৎসর্গের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন তেমনি কবিতা তিনি কেন লিখছেন তারও আভাস দিয়েছেন। কবিতা মানেইতো আসলে এক ধরনের সন্ন্যাস বয়ান, কবিতা মানেইতো এক ধরনের ঘর বানানোর চেষ্টা, কবিতা মানেইতো পরবর্তী কবিতার সম্ভাবনাময় কবি কেননা ঐ ঘর অবানানোই থেকে যায় চিরকাল।
শুভাশিস একজন নিপাট কবি। কারণ তিনি প্রকৌশলী নন, কারণ তিনি সংবাদ উপস্থাপক নন।
কবিতায় নির্মাণের কারুকাজ থাকতেই পারে, থাকতেই পারে কবি মনের সংবাদ তবে তা কবিতাকে ছাপিয়ে নয়। সবার আগে কবিতাকে কবিতা-ই হতে হয়। আর তাই সহজাত কবির কাছে নির্মাণ প্রকৌশল আর সংবাদ বাহুল্যই হতে পারে। সেই ব্যাপারটিই ঘটেছে শুভাশিসের কবিতায়। উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা সে কারণে একদম খুঁজেই পাওয়া যায় না শুভাশিসের কবিতায়। আর এই না থাকার সংবাদটুকু উপলব্ধিজাত নয়; এই সংবাদ গবেষণালব্ধ। অর্থাৎ কবিতার পাঠক এই না থাকার সংবাদ পান না। কেননা প্রতিটি কবিতাই পাঠককে পূর্ণ কবিতার স্বাদ দেয়। সেই সাথে আরেকটি বাড়তি ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পাঠক এখানে তওফা হিসেবে পান; তা হল আবেশ। এই কাব্যগ্রন্থে কবিতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কবিতার রেশ, কবিতার আবেশ। সুর এখানে আবেশের অনুঘটক, আবেশের প্রভাবক। আর তাই শুভাশিসের উচ্চারণ কবিতা ও কবিতার ভার এ-
এ - কবিতা দীর্ঘ যত - তারও চেয়ে দীর্ঘ এই কবিতার ভার, যতটা বলছি - তার অর্থ আরও গভীর আড়াল
কিংবা
তোমার বয়স যত তারও চেয়ে বয়সতো তুমিহীনতার ; তুমিহীন তুমি আর আমিহীন আমি লাল-নীল তারায়িত অধিরাত্তিরের চরে বালির ঘরের মতো মিশি আর ভাঙি...
আগেই বলেছি শুভাশিস নির্মাণাগ্রহী কবি নন কিংবা উপস্থাপনের কলাপ্রেমী নন। তিনি সহজাত কবি। তবু শব্দগঠনে, বাক্যগঠনে,দীর্ঘ কিংবা হ্রস্ব কবিতায় এবং ছন্দের চালে তাঁর বিশেষত্ব, তাঁর স্বাতন্ত্র্য ঠিকই ধরা পড়ে। আর তাই তাঁর সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যকেই অনেকে নির্মাণ কৌশল ধরে নিতে পারেন। এমনটা ধরে নিলে কিঞ্চিৎ ভুলের সম্ভাবনা থাকে বলেই আমার মত।
শুভাশিসের বিশেষ মনোযোগ সুরেলা শব্দের দিকে। প্রায়ই দীর্ঘ সমাস-নিষ্পন্ন শব্দ ডেকেছিলাম জল এর সবখানে ছড়িয়ে আছে। কয়েকটা শব্দ তুলে দিচ্ছি- বৌ-সম্ভবা, শুচিশুভ্রধারা, বহুমুখবিস্তারিত, প্রতিরূপকথাপটে, ফুলপাতাপল্লবিত, ধ্বনিসুরমগ্ন, স্মৃতিকামপরম্পরা, মায়াচিড়াধান, ভিন্নধ্বনিউচ্চারণজাদু, ভিনদৃশ্যউপভোগমধু, পলিকাদাসোনামাখা। এইসব শব্দগুলো নির্মিত হয়েছে মূলত সুরের টানে। তাই একে নির্মাণ না বলে সুরের টান বলাই শ্রেয়।
শুভাশিসের দীর্ঘ কবিতাগুলো আলাদা করে চিনে নেয়া যায়। গদ্যছন্দের দীর্ঘ কবিতা প্রায়শ শামুক গতির হয় কিন্তু শুভাশিসের দীর্ঘ কবিতা সবগুলোই সুরে বাঁধা। ফলে এসব কবিতা এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত গতি লাভ করেছে।
একটি বিকল্প কবিতার পাণ্ডুলিপি ভেসে গেল বানে কবিতাটি থেকে কিয়দংশ উদ্ধৃত করছি--
আশেপাশে চারিধারে স্মৃতিবিস্মৃতির পারে সুপ্তিকালে লুকিয়েছে কন্যা-জায়া-জননী সবাই, কবিতা তাদের চায় প্রকাশের ক্ষুৎপিপাসায়, আর সারি সারি ভিখারিকবির পথে কারা যেন নিলাম সাজায়।
কোনো এক মাথাতোলা কবিতার পাণ্ডুলিপি বানে ভেসে যায়।
ডেকেছিলাম জল এর সবকটি দীর্ঘ কবিতা পড়তে গেলে সুরের ভেতর দিয়ে দৃশ্যের পর দৃশ্য দর্শিত হয়। একেকটা কবিতা একেকটা আবেশি ভ্রমণের স্বাদ। শুভাশিসের গীতল দৃশ্যময়তার উদাহরণ হিসেবে সব কিছু ভালো লেগে গেল থেকে কিয়ৎ দীর্ঘ অংশ তুলে দিচ্ছি--
সব কিছইু ভালো লেগে গেল আজ, একটি গাছের পেটে কান পেতে শুনি ঢেকুর উঠছে, মনে হচ্ছে গান, শিকড়ে সেতার বেজে উঠল, একটি নদীর স্রোতে পা ভেজালে পলকেই ভিজে গেল চোখ, পা ভিজল না, তবু দুটো চিকন, ক্লান্ত পা ডুবে রইল আশ্চর্য নদীর বুকে, একটি পাখির পালক পড়ে গেল মাঠে, সেদিকেই ছুটে যেতে যেতে মাঠভর্তি অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম আমি, তবু আজ আমাকে টেনে তুলো না কেউ, ঘোমটার আড়াল থেকে আঁধাররমণী এক চেয়ে দেখছে ওই।
গীতলতা, দৃশ্যময়তা, গতি আর শব্দের কোমলতা মিলে ডেকেছিলাম জল এক নিরালা জগতের অধিষ্ঠাত্রী। শূন্য দশক, মডার্নিটি, পোস্ট-মডার্নিটি দিয়ে একে খাপবন্দি করা যায় না। তবে একে খাপছাড়াও বলা যায় না। বরং একে বলা যায় কাব্যজননীর সহজ সন্তান। প্রভাবের দিক থেকে নয়, পুরুষাণুক্রমের বিবেচনায় শুভাশিস সম্ভবত জীবনানন্দের উত্তর-পুরুষ। পাহাড়, ঝরনা, নদী, গোয়ালে গাভী, আকাশের মেঘের হাজিরায় শুভাশিসের যে দৃশ্যজগত তা মোটেও “রূপসী বাংলা”র মতো নয়; তবু “রূপসী বাংলা”র গন্ধ এখানে কিয়ৎ সেন্সিটিভ নাকে ধরা পড়তেই পারে।
ছন্দের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। ডেকেছিলাম জল কোথাও কোনখানেই ছন্দহীন নয়। এমনকি ভুলেও ছন্দ কেটে যায় নি কোথাও। পূর্ণ ও অপূর্ণ পর্বে যথাক্রমে ১২ ও ৮ মাত্রার চালে চলা আত্ম- অধ্যাত্মের পাঠ থেকে দুই লাইন এখানে কুড়িয়ে দিলাম--
তোমাতে আদিম জ্বলছে পিদিম, নীল-নীল-রং জ্বালা
বোধে নির্বোধে ব্যাখ্যামাতাল আমাদের পাঠশালা।
ছন্দে আর সুরে একটি কবিতা কতটা গীতল হতে পারে তার অভাবনীয় উদাহরণ দ্বন্দ্বগীতিকা কবিতাটি। কলমের ডগায় কিছু অংশ গেঁথে নেয়ার লোভ সামলানো গেল না বলে-
দুপুর তোমাকে ডেকে নিয়ে গেল আজ পুকুরে
বড়শিটি হাতে গান শুরু করে দিলে কী সুরে
ফেললে তবুও ছিপ স্রোতহীন জলে
মাছেরা বিনয় করে নেমে এসো বলে।
ডেকেছিলাম জল পড়তে পড়তে যে প্রশান্তির স্বাদ পাওয়া যায়, তা সম্ভবত এই কারণে যে- এই কাব্যগ্রন্থ প্রকৃতির আদরমাখা। বিলম্বিত ও ধার করা আধুনিকতা বাংলা কবিতাকে অনেক দিন ভূমিহীন করে রেখেছিল। অথচ বাংলা এখনও অদ্ভুত অসাধারণ উর্বরভূমি। বিদেশী বীজের হাইব্রিড কবিতা ছাড়াও এখানে কবিতা হতে পারে। ডেকেছিলাম জল পাঠককে এমনতরো বোধে আক্রান্ত ও বিহ্বল হওয়ার সুযোগ দেয়। ডেকেছিলাম জল এর অন্দরে- বন্দরে কখনো অবগাহন, কখনো উড্ডয়ন আর প্রায়শই ছড়ায়ে আছে আত্মবিলোপ ও আত্মপ্রসারণের আনন্দ। এখানে ছড়িয়ে আছে ভয়, নিশ্চিত দুঃখের নিশ্চয়তা তবু আছে আত্মবিলোপ ও আত্মপ্রসারণের আনন্দ।
আর তাই শুভাশিসের কন্ঠে পাই,
আমার জন্য শেষে হাহাকার, অশ্রুবমি,
আত্মখুন নির্ধারিত আছে
নিজেকে হারায় যারা নাটাইয়ের সুতোছেঁড়া
বেদনাব্যকুল বালখিল্যে
কিংবা
তখনই আবার আমি
ও ঘুম ও ঘুম বলে শয্যা পাতি, চাদর বিছাই
আকাশে নির্ঘুম তবু সুতোছেঁড়া বেপথুনাটাই।
ডেকেছিলাম জল এর ধড়কাঠামোয় যেমন পাওয়া যায় বাংলার বহুমুখিন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারবোধ, তেমনি এর অন্তরে পাওয়া যায় প্রকৃতির ভিন্নতর পাঠ। আর তাই বৃষ্টি কবিতাটি দাবি করে-
আমরা তো সব বৃষ্টি নিরক্ষর
কণায় কণায় অক্ষরপাঠে ব্যর্থ
কবি বিনয় মজুমদার একবার এক সাক্ষাৎকারে সম্ভবত এমন বলেছিলেন, “ এই পৃথিবীতে একজন কবি বিস্ময়বোধ করা ছাড়া আর কিইবা করতে পারে. . .”। কবির এই বিস্ময়বোধ “ডেকেছিলাম জল” সবখানে ছড়ানো।
ডেকেছিলাম জল পাঠে পাঠকের বিস্ময় জাগে তখনই, যখন কবির বায়ুদূতী সখির থেকে গোপনবিবৃতির রূপে পাওয়া চিত্রায়িত মধুভাষা শ্রুতির শোণিতে মিশে হয় প্রাণকণা।
প্রকৃতির আদরমাখা সন্তান বলেই ডেকেছিলাম জল দীর্ঘায়ু হওয়ার কথা।