রঙহীন রঙিন স্বপ্ন
রঙহীন রঙিন স্বপ্ন
ফাহাদ ফাহমি
অনবরত কেশেই যাচ্ছে ইসহাক আলী। বুঝলেন তো ভাই মানুষ জাতি বড় স্বার্থপর জাতি। কতো হাতজোড় কইরা কইলাম, দেননা ভাই দুইডা হাজার টেকা। গঞ্জে একটা ব্যবসা করমু, এক মাসের মধ্যে আপনের টেকা ফিরত দিমু। যেমনে পারি দিমু, দরকার হইলে নিজের রক্ত বেইচ্যা দিমু। গায়ের মেম্বাররে কইলাম, চেয়ারম্যানরে কইলাম, মোড়লরে কইলাম, টেকাওলা বাবুরে কইলাম। কেও দিল না, কেও না। ইসহাক আলীর সাথে আমার দেখা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে । জীর্ণ শীর্ণ মানুষ। রোদে পোড়া ক্লান্ত চেহারা, সেই ক্লান্ত চেহারায় বিষাদ যেন ঘিরে ধরেছে অক্টোপাসের মতো। বয়স চল্লিশের কোঠায় হবে। গায়ে ছেঁড়া ফতোয়া, লুঙ্গিতে যে কয়টা তালি দেওয়া আছে তা দেখা সম্ভব হল না আলো আধারির উদ্দম খেলার কারণে। চুলগুলো হয়তো বা কাটা হয়নি বছরখানেক হবে, চিরুনির আদরও হয়তো পরেনি দীর্ঘ দিন ধরে । চোখের কোনে ময়লা জমে আছে বিচ্ছিরি ভাবে। গা থেকে আসছে বিকট একটা গন্ধ। একটা পা না থাকার কারণে বাঁশের একটা লাঠিকে ভর করে দাড়িয়ে ছিল ইসহাক আলী। কিন্তু মায়াবী একটা হাসি তার সমস্ত বাহ্যিক খারাপ ভঙ্গিকে আড়াল করে ফেলেছে। ভাই পেরেম কইরা বিয়া করছিলাম ময়নার মায়রে। নদীর ঘাটে পানি নিবার আইত, নাইবার আইত। পরে সম্বন্ধ কইরা বিয়া কইরা ফেলাইলাম। নদীর পাড়ে আছিল আমাগো গেরাম, যাত্রাপুর নাম। তিন শতক জমির উপর একটা দোচালা ঘর, পাশে একটা ছনের রান্ধন ঘর। নদী থাইক্যা ফুরফুর কইরা বাতাস আইত। যাত্রাপুর হাটে আমার একটা চায়ের দোকান আছিল। দোকান থেক্ক্যা ফিরা দুয়ারে বইয়া সুখ দুঃখের কথা কইতাম ময়নার মার লগে। দিন আইনা দিন খাইতাম। কিন্তু আমরা অনেক সুহি আছিলাম। এক্সিডেন্টে একটা পা হারাইলাম। একটা কাজে শাহাবাগ এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে আসছি। কোন একটা কাজে ও আটকে গেছে। আরও ঘণ্টা দেড় দেরি হবে ওর আসতে। সময় কাটানোর জন্য প্রবেশ করলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। একটা বেনসন ধরিয়ে ধীর গতিতে হেঁটে চলছি। অন্ধকার এসে ঘিরে ধরেছে আরও আধঘণ্টা আগে । ল্যাম্প পোস্টের কৃত্রিম আলো ভালো লাগছিলনা। তাই আঁধারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। চাঁদটা পূর্ব আকাশে । অর্ধচন্দ্র। ভাই লাগবো নাকি-হঠাৎ করে দুটু ইটের উপর বসে থাকা একটা লোক বলে উঠলো। আমি উৎসুক হয়ে বললাম কি? লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ''ভাই দেড়শ টেকা। ভালা সুন্দর মাইয়্যা, ফিগারও ভালা। আফনের জন্য আরও বিশ টেকা কমাইতে পারমু। যদি লাগে কন, খালি আছে।'' আমি যাবনা শোনে ইসহাক আলীর মন খারাপ হয়েছে। মুখটা মলিন হয়ে উঠেছে। জানি না কেন যেন একটু কথা বলতে ইচ্ছে করলো ইসহাক আলীর সাথে। আমি আমার হাতের সিগারেটটা এগিয়ে দিলাম তাঁর দিকে। সাদরে গ্রহণ করলো ইসহাক আলী। “ভাই মনডা আমারও কান্দে, বড় কান্দে।কিন্তু এইযে পেটটা বানাইছে আল্লায়, এই পেট বড় হারামজাদা ভাই। ছিনাল পদ্মায় ভাইঙ্গা নিলো সব, ঘর বাড়ি, দোকান, সুখ ,ভালোবাসা সব। কেও আমারে টেকাডা দিলো না। ঢাকায় আইলাম, কাম কইরা খামু। পাই নাই। পুরা তিন ডা দিন না খাইয়া ছিলাম। থাকার জায়গা নাই। রাস্তায় রাস্তায় কুত্তার মতো ঘুরছি। ডাস্টবিন থেকা পচা খাবার খুইটা খুইটা খাইছি। আফনেরা তো প্রতিদিন কতো খাবার ফেইল্যা দেন। ঐ গুলান আমাগো দিলেও তো খাইবার পারি। কেও দেই নাই ভাই কেও না। এই সহোরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকার জায়গা কইরা দিলো আনিছের মায়। বড় ভালা মানুষ। রাস্তায় টানানু ব্যানার ছিইরা আইন্যা ডেরা তুইল্যা দিলো। ইটের উপর বসে পড়েছে ইসহাক আলী। চোখের নিচে জমে থাকা পানি হালকা আলোতে চিকচিক করছে । না জানি কতো কষ্ট ঘনীভূত হয়ে আছে ঐ লোনা পানিতে। হয়তোবা চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার, পারছে না। কতো দিন এইভাবে থাকন যায়। আল্লায় তো পাডা কাইরা নিলো । শরীরডাও ভালো যায়তাছেনা। কোন কাম করতে পারি না। একদিন আনিছের মায় এই কামে নামনের বুদ্ধি দিলো। কথাডা শুইনা মনে অইল বুড়িরে মাইরা ফ্যালাই। একদিকে ক্ষুধার জ্বালা অন্য দিকে, ময়না আমার না খাইয়্যা কাঠের মতন হইয়্যা যায়তাছে। এইযে এইহানে ডেরা তুলছি এর জন্য প্রতি মাসে মজিদ গুণ্ডারে পাঁচশ টেকা দিতে হয়। না দিলে থাকার জায়গা দিবো না। ভাই অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়। বউরে নামাইলাম এই কাজে। কিচ্ছু করার ছিল না ভাই সব পেটের দায়। আল্লায় কেনে আমারে মাইরা ফেলাইলো না। এই কাম কইরাও ভাই ভালভাবে চলবার পারি না। প্রতিদিন যে ইনকাম হয় তার মধ্যে থ্যাইকা একটা ভাগ পুলিশরে দিতে অয়, এক ভাগ মজিদ গুণ্ডারে দিতে অয়। সব দিয়্যা আমাগো দুই বেলার ভাত খাওনের টেকা থাকে কোন মতন। কেন জানি আজ আর কোন কিছুতেই কষ্ট লাগে না। ইসহাকের ধরা গলার কথা গুলো আমার কাছে যেন গল্প মনে হচ্ছিল । তার জন্য খুব একটা দুঃখ অনুভব করতে পারছিনা আমি। আমি কি আমার মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছি? আমাকে কি পশুত্ব কিনে নিয়েছে? তবে কি আজ আর আমি মানুষ না, পশু। আমার কি কিছুই করার নাই। যান্ত্রিক সভ্যতার ভালো মুখোশ ধারী মানুষ বা রোবট আমি। ভাই পদ্মার বুকে চর জাগতাছে । মাঝে একবার গেরামে গেছিলাম। মেম্বার সাহেব কইলো আমাগো জমি ফেরত দিবো, পাঁচ হাজার টেকা লাগবো। সব মিথ্যা, আমার জমি আমারে ফেরত দিবার লাইগা আবার টেকা লাগবো ক্যান। ওরা খাইব, আমার গরিব মানুষ দিতে অইব। আমাগো তো চুইস্যা খাইতেই ওরা মজা পায় । দুই এক টেকা কইর্যা জমাইতাছি। চইল্যা যামু। একটা ছোট ঘর তুলমু। পাশের গ্রামের বাজারে একটা চায়ের দোকান দিমু। আর এই কাম করতে হইব না ময়নার মারে। আমার ফোন বেজে উঠেছে। আমার বন্ধুর ফোন। চলে এসেছে ও। আর এখানে থাকার কারণ নেই। আমাকে যেতে হবে, অনেক কাজ পড়ে আছে । ইসহাক নিচু হয়ে হয়তো চোখের পানি ফেলছে। ফেলুক না কিছুক্ষণ। কষ্ট হালকা হবে। ওকে বিরক্ত করা উচিৎ হবে না। তাই কিছু না বলেই উঠে দাঁড়ালাম আমি। আসার সময় একবার পিছে ফিরে তাকালাম আমি। ইসহাক আলী সে ভাবেই বসে আছে। হয়তো স্বপ্ন দেখছে ও। রঙিন স্বপ্ন। পদ্মার বুকে জায়গা ফিরে পেয়েছে , ঘর বেঁধেছে সেখানে। বাতাসে কাশফুল দুলছে। পড়ন্ত বিকেলে আকাশের নিচে দুয়ারে খেজুর পাতার পাটিতে বসে আছে সে, দোকান থেকে ফিরে দখিনা বাতাসে ক্লান্ত দেহকে আরাম দিচ্ছে। ময়নার মা ময়নাকে রাজপুরীর গল্প শোনাচ্ছে তার পাশে বসে। আর কোন কষ্ট নাই , আর কোন আঁধার রাতে তাকে বসে থাকতে হবে না সহোরাওয়ার্দী উদ্যানে মানুষ রূপী পশুদের অপেক্ষায়। কোন হিংস্র থাবা পরবে না আর তার বুকে.........।
২৩/১১/২০১৩
পাথরের মতো মানুষ
গণেশ গাওয়াল
ছেলেটার বয়স ৩ বছর। আজ সকালে পাশের পুকুরে ডুবে গেছে। বাবা দরজায় মাথা ঠুকিয়ে কাঁদছে, ৯ বছরের বোনটা চিৎকার করছে, দাদি লাঠিাটা হাতে নিয়ে নির্বাক। এইতো আজ ভোরে মায়ের কাছ থেকে ঘুম ভেঙে উঠে দাদির শোবার ঘরে গিয়ে দাদির কোলে একবার ঝাঁপ দিয়েছে। দাদার মুখে আদার দিয়ে বারান্দায় খেলছিল। সবাই তাকে খেলতে দেখেছে বারান্দায়। কখন যে সে গেলো ঐ কালের পুকুরে কে জানে !
হয়তো ভূতে নিয়ে গেছে, নইলে সবার চোখ ফাকি দিয়ে কীভাবে মনি গেলো পুকুরে ! পাড়ার লোক এসেছে- নানা জনের নানা কথা। হারুনের বউ ময়নার মাকে বললো-‘দেখলি বু, মনি’র মা কেন্তে না, ও মাগি পাষাণ মাগি। ময়নার মা বললো, হু...
ত্রয়ী
সুব্রত দত্ত
বেশ চলছে জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্নাস পড়ছি। ঝামেলাহীন জীবন। একটি প্রেম ও একটি টিউশনি। মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকা। সপ্তাহ শেষে একটি দিন ডেটিং।
বাসস্ট্যান্ডের পাশে বয়ে যাওয়া মৃত নদী। অল্প পানি। ফ্যাক্টরির বর্জ্য পদার্থে ভর্তি দূষিত কালো পানি। তার উপর তীর ঘেঁষে বস্তি। বসতি থেকে বস্তি। বাঁশের ঘর। ভাঙাচোরা। একটি ঘর। সাত জন মানুষ। পাঁচ জনই শিশু।
রাস্তার দু'ধারে বিল্ডিং। উঁচু উঁচু সারিবদ্ধ বিল্ডিং। ফ্লাটের পর ফ্লাট। অল্প মানুষ। শান্ত, ছিমছাম। এক পাশে বাগান। এক পাশে লেক। সায়লার বাড়ি।
কাজে আমি ফাঁকিবাজ না। নিয়মিত টিউশনিতে যাই। ক্লাসও করি। ফলাফল বেশ ভালো। ডিপার্টমেন্টে মোটামুটি জনপ্রিয়। দেলোয়ার হোসেন স্যারের প্রিয় ছাত্র। স্যার আগামি তিন বছরের জন্য সভাপতি। আমার পড়াশুনা শেষ করতে লাগবে দু'বছর।
সামনে নির্বাচন। নেতা-কর্মীর রাজপথ থেকে অলিতে-গলিতে আনাগোনো। নির্বাচনী প্রচারণা। প্রচারণা থেকে প্রতারণা। বস্তিতে আনন্দ। মিটিং-মিছিলে গেলেই একশো। ছেলে-বুড়ো, যুবক-শিশু সবার আয় রোজগার। দিন শেষে গরম্নর গোস্তের ঘ্রাণ।
দু'দিন পর থারটি ফাস্ট নাইট। ফ্লাটে ফ্লাটে আলোর সমারোহ। নানা আয়োজন। সায়লার জল্পনা-কল্পনা। এবার নাইটটা সে আমার সাথে কাটাবে। কৌশলী মেয়ে। সিটিং আর ফিটিং-টা বাকি।
যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই। নাস্তিকদের বিচার চাই। জামায়েত ইসলাম নিষিদ্ধ কর। ফ্যাসীবাদ রুখে দাঁড়াও।
হরতাল। অবরোধ। ভাঙচুর। লুটপাট। অগ্নিসংযোগ। গ্রেফতার। সংঘর্ষ। ১৪৪ ধারা।
ডিপার্টমেন্ট বন্ধ। দেলোয়ার হোসেন গ্রেফতার। সভাপতিত্ব বাতিল। বদ্জাত কাদের রহমান স্ব-নির্বাচিত সভাপতি। ক্যাম্পাসে আন্দোলন। রিলেশন স্ট্যাটাস সিঙ্গেল।
বস্তি উচ্ছেদ।
ফ্লাটে ফ্লাটে আলোকসজ্জা। নববর্ষ উদ্যাপন। স্যাম্পেন আর উইস্কি। আনন্দ আর ফূর্তি।
সুব্রত দত্ত। ১৫ মার্চ ২০১৩। টঙ্গী, গাজীপুর।
চল ঈশ্বরকে দেখে আসি
আব্দুর রহমান
একটা রোঁয়া উঠা ভগ্ন নেড়ি কুকুর বেশ খানিক ক্ষণ ঘুর ঘুর করছে। দক্ষিণ দিকটাতে কিছু পঁচা ভাত ও কয়েক টুকরো হাড় পড়ে আছে। এর মধ্যে পলিথিনের কানি ধরে সেটাকে বেশ খানেক ছড়িয়ে দিয়েছে। এখন সেগুলোকেই একত্র করতে ঘুর ঘুর করছে। ওপাশে দুজন একের পর এক, টেনে চলছে আবর্জনা। একজন শিশু, নিজের চেয়ে তার বস্তার দৈর্ঘ্য একটু বেশি তাই অগত্যা রেকসিনের বস্তাটাকে ঝুলিয়ে নয়, এক প্রকার হেঁচড়ে টেনে চলছে ছেলেটা। হার্ডবোর্ড, কাগজ, পাস্টিকের ভাঙা-চোরা অংশ, পলিথিন, দুই-এক টুকরো লোহা, যা পাচ্ছে সব একের পর এক ঝোলার মধ্যে ভরছে। খালি গা, পরনে হাফ প্যান্ট, কিন্তু তার ঠিক নিচের দিকটাতে ছিঁড়ে গেছে। দু-পা দু-দিকে দিয়ে দেওয়ার মত অবস্থা আর নেই; একাকার হয়ে গেছে। যখন হেট হয়ে ময়লা ঘাটছে তখন পেছন থেকে মনে হচ্ছে, পেছনের দিকটাতে পরা আর না পরা সমান হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তার নাক থেকে দু-এক ফোঁটা বাজারের ঘিয়ের মত হলুদ বর্ণের পোটা গড়িয়ে পড়ছে। কখনো তা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে জিবটা সর্বোচ্চ বের করে টেনে নিচ্ছে, আবার কখনো বিপুল শক্তি ব্যয় করে নাক টেনে চলছে জন্ম জন্মের সঞ্চিত অমূল্য নাসিকা রস। আর দু-হাতে প্রাণপণে সরাচ্ছে ডাস্টবিনের জঞ্জাল। সি আর দত্ত রোডে; কাঁটাবন মসজিদ ও হাতির পুল বাজারের মাঝখানে এই ডাস্টবিন।
আর একজনও ঠিক তাই, ওর বয়স সতেরো থেকে চল্লিশের মধ্যে যে যেমন ধরে নিতে পারে। এক মাথা সরু চুল তার একগাল সরু দাঁড়ির সাথে মিলেই তার বয়সের এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কিছুটা অপ্রকৃতস্থ মনে হচ্ছে। পরনে তার পুরানো ছেঁড়া জিন্সের প্যান্ট; এক পাশে একটু বেশি গোটানো। গায়ে একটা ময়লা তেল-চিটচিটে ফুল-শার্ট, বুকের উপরের প্রথম তিনটা বোতাম খোলা। কোন দিকে নজর নেই তার; সেও আপন মনে সরাচ্ছে জঞ্জাল। এরই মধ্যে বস্তাটা বেশ ভরে উঠেছে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে, পাশের ছেলেটার দিকে বার দুই তাকিয়ে, মুখ-খিঁচিয়ে, বিচ্ছিরি রকমের গালি-গালাজ ছুড়ে দিলো লোকটা। কিন্তু ছোট এই ছেলেটার সুদ মুখের কাছে পরাজিত হয়ে বিবাদ ছাড়াই সরে পড়লো সে। রাস্তার ফুটপাতে গিয়ে বসেছে সে। কি যেন কি ভেবে সে একটু অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়লো। কোত্থেকে এক পুরানো ইনজেকশন বের করলো, সাথে সাথেই প্যান্টের পকেটগুলো হাতড়াতে শুরু করলো সে। যেন জীবনের অতি মূল্যবান কি একটা হারিয়ে গেছে তার! হঠাৎ চোখে-মুখে হাসি ফুটলো; হাতে একটা মৃত-সঞ্জীবনী বিশল্যাকরণীর ছোট কৌটা উঠে এসেছে। বেশি দিনের পুরানো নয়। তবু সামান্যই আছে তাতে। ইনজেকশন দিয়ে সেই সামান্য সঞ্জীবনীটুকু নেওয়ার চেষ্টা করছে সে। আস্তে আস্তে এখন হাত কাঁপা শুরু করেছে তার। সমস্ত শরীরের মাংস-পেশীগুলো টান দিয়ে বার দুই খিঁচিয়ে উঠলো শরীর। গায়ের রগগুলো শক্ত হয়ে এলো কিছুক্ষণের জন্য। ততক্ষণে ইনজেকশনে ভরা হয়ে গেছে শেষ সঞ্জীবনীটুকু। এর পর একজন অভিজ্ঞ গ্রামের পশু ডাক্তারের মত ঘ্যাচাং করে ফুঁড়ে দিলো হতের উপরে। যেন এক অজানা স্বস্তি এসে ভরেছে শরীরে। এখন সে রাণীক্ষেতে আক্রান্ত মুরগির মত ঝিমোতে শুরু করেছে। হয়ত এক সময় ঘুমিয়ে পড়বে সে দুরন্ত মরফিনের তেজে।
তখনো ডাস্টবিনের ময়লা কুড়িয়ে চলেছে ছেলেটি। হঠাৎ উল্লাসে চিল্লাত শুরু করলো সে; একটা ভাঙা মোবাইলের অংশ পেয়েছে। হয়ত এই অমূল্য সম্পদের জন্যই এতক্ষণ ছাই উড়িয়েছে সে। উল্লসিত মন নিয়ে বস্তাটা টানতে টানতে চলে গেল পশ্চিম দিকে। এখন ডাস্টবিনটা নীরব একাকী। নেড়ি কুকুরটাও তাকে ছেড়ে গেছে। হয়ত ক্ষুধার পরিতৃপ্তি হয়েছে তার।
হাতির পুল বাজার, ভূতের গলি, এলিফ্যান্ট রোড, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের এই বিশাল এলাকার ময়লা সব এখানেই ফেলা হয়। এ ডাস্টবিনের অপর পাশে সুরম্য সব প্রাসাদ, বড় বড় মার্কেট। মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় থেকে শুরু করে বিলাসবহুল জিনিস সব যেমন দোকানদাররা দিতে প্রস্তুত, এ অঞ্চলের সমস্ত বর্জ্য, ময়লা, আবর্জনাও এ তেমনই বুকে নিতে প্রস্তুত। মানুষের ঘরের জঞ্জাল প্রতিনিয়ত বে বহন করে চলেছে সে। কত হাতের স্পর্শ তার কাছে সঞ্চিত। কত গলিত-বস্তুর সঞ্চায়ক সে। নোংরা বলে মানুষের সর্বোচ্চ ঘৃণার বস্তু সে। কিন্তু এ কথা সত্য যে, সে যত নোংরা হবে এ প্রাণের শহর তত পরিষ্কার থাকবে।
এই ডাস্টবিনের পাশে একটু নিরিবিলি স্থান পেয়ে; কয়েকটা পরিবার তারই পাশে শান্তিতে ফুটপাতে বাস করতে শুরু করেছে। এদেরও মধ্যে আছে রিক্সাওয়ালা, শ্রমিক আর আছে একজন ভিুক। তার ডান পায়ে বিশাল গোদরোগ। ফুলে যেন কলা গাছ হয়ে আছে। সেটাকেই পুঁজি করে সে আজ ছয় বছর ধরে ভিক্ষা করে চলছে। এ বস্তিতে তারই ইনকাম সবচেয়ে বেশি। এই পুঁজির জের ধরেই সে দিনে প্রায় ২০০ থেকে ৬০০ এর কাছাকাছি টাকা ইনকাম করে। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই তার বয়স তবুও কিছুদিন আগে একটা নতুন বিয়ে করেছে সে। বেশ ভালই সুখে আছে এরা কজনা ।
ইতোমধ্যে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে, লোকালয় থেকে বেশ কিছু ভ্যান এর মধ্যে এখানে এনে ঢেলে রেখে গেছে। এখন বেশ কিছু লোক জুটেছে এখানে, একই খাবারের আশায়, যেমন একাধিক কুকুর এসে জুটে একটা কেউ কেউ, ঘেউ ঘেউ শুরু করে দেয় তেমনই কেইমেই শুরু করে দিয়েছে এরা। এভাবেই চার-পাঁচজন লোক ক্রমাগত ময়লা খুঁজে চলছে। এদের মধ্যে দুজন শিশু, একটা মহিলা ও সকালের সেই দাঁড়িওয়ালাও রয়েছে। ডাস্টবিনটা যেন বুকের সঞ্চিত-পদার্থগুলো এদের জন্য একের পর এক মেলে ধরছে।
আংটি
মুহম্মদ মাহমুদুর রহমান
আর বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারল না সাদেক আলি। বিছানা ছেড়ে উঠে ষাট পাওয়ারের বাতিটা অন করল সুইচ হাতড়ে।
একটা জর্দার কৌটায় জিনিসটা। সাদেক আলি কৌটার মুখ খুলল। আঙ্গুলে ঢুকিয়ে জিনিষটা বের করে আনল। একটা আংটি। সোনার আংটি। সাদেক আলি চোখের সামনে এনে আংটি টা ধরে। বয়স হয়েছে তার। তিন কুড়ি। চোখে ভাল দেখতে পায় না। খিদে এখন আছে আগের মতোই। চোখের খুব কাছে এনে সাদেক আলি বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানাভাবে দেখতে থাকে আংটি টা। দাম কত হবে এর ? এই আংটি বিক্রি করলে কয় দিন যাবে সাদেক আলির ?
আজ বিকেলে আংটি টা চুরি করেছে সাদেক আলি। ট্রেনের এক যাত্রির কাছ থেকে। বিমান বন্দর স্টেশনে যখন ট্রেন টা থামল তখন সাদেক আলির নজরে পড়ল যাত্রীটাকে। ট্র্বেনের প্রথম শ্রেণীতে বসে আছে। জানালা দিয়ে বাইরে একটা হাত বের করে রেখেছে। সেই হাতেই ছিল আংটি।
সাদেক আলি দেখল ট্রেন টা ছেড়ে দিয়েছে। কিছু টা গতিও নিয়েছে, কিন্তু প্লাটফরম থেকে এখনও বের হয় নি। এখনি সুযোগ।
সাদেক আলি প্লাটফরমের শেষ মাথায় দাড়িয়ে আছে। এখনি গ-নম্বর বগিটা এগিয়ে আসবে তার দিকে।
গ বগিটা এগিয়ে আসছে। এখনও আংটি পড়া যাত্রীটা আংটি সমেত হাত বের করে রেখেছে জানালার বাইরে। সাদেক আলি দেখতে পাচ্ছে যাত্রিটার চোখ বন্ধ। বাইরে বের করা একটা হাত দিয়ে ট্রেনের দেয়ালে আলতো ভাবে টোকা দিচ্ছে আর কি একটা গানের সুর ভাজছে।
সাদেক আলি হেঁচকা টান দিয়ে আংটিটা খুলে ফেলল যাত্রীটার আঙ্গুল থেকে। কাকপক্ষীও টের পেল না। কেবল সেই যাত্রীর গানের তাল গেল কেটে। কিন্তু ট্রেন এখন আর প্লাটফরমে নেই। সাদেক আলি রেল লাইনের পাশে তার বস্তিতে তার রুমে, তথা বাড়িতে ফিরে এল। এক রুমের বাড়ি।
আংটি টা হাতে নিয়ে নানাভাবে দেখতে লাগল সাদেক আলি। কখন আলোর কাছে নিয়ে দেখে, কখন চোখের সামনে নিয়ে দেখে।
বাচ্চুর সাথে কথা হয়েছে সাদেক আলির। বাচ্চু সোনার ব্যবসায়ী। এ পর্যন্ত সাদেক আলি বাচ্চুর কাছেই চুরি করা সোনাদানা বিক্রি করে এসেছে। চুরির মাল বলে সঠিক দামটা পায় না সাদেক আলি। অনেক কম দামে বাচ্চুর কাছে এইশব জিনিষ বরাবর বিক্রি করে আসছে সে। আগামিকাল সকালেই এই আংটিটা বাচ্চুর কাছে বিক্রি করে আসবে সাদেক আলি। তাতে করে কিছুদিন চলবে তার।
আংটি কোন হাতে পরে মানুষ ? ডানহাতে নাকি বামহাতে ? বোধহয় বামহাতে। কোন আঙ্গুলে ? যে লোক টার আংটি চুরি করেছিল সাদেক আলি সে কোন আঙ্গুলে পরেছিলো আংটি টা ? মনে নেই। সাদেক আলির মনে নেই।
সাদেক আলি প্রথমে ভাবল একটার পর একটা আঙ্গুলে আংটি পরা যাক। যে আঙ্গুলে সবচেয়ে বেশি মানাবে সেই আঙ্গুলেই থাকবে আংটি।
প্রথম বিবেচনায় বুড়ো আঙ্গুল ও কনিষ্ঠাকে বাদ দিতে হল। বুড়ো আঙ্গুলে আংটি ঢুকছে না, কনিষ্ঠায় আংটি থাকছে না। অনামিকায় বেশ দেখাচ্ছে আংটিটা। সাদেক আলি বারবার হাত উঠিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দেখতে লাগল আংটিটা। ভাগ্যিস তার বউ-বাচ্চা নেই। নইলে এই গভীর রাতে ষাট বছরের এই বুড়ো শিশুটির খেয়ালি আচরণে নির্ঘাত তারা আপত্তি জানাত।
মধ্যমাতেও চমৎকার মানিয়েছে আংটিটা। সাদেক আলির উচ্ছ্বাস যখন কিছু অর্থহীন শব্দের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল, তখনই তার মনে পড়ল যে ট্রেনের যাত্রী আংটি পড়েছিল তর্জনীতে। মনে হওয়ার সাথে সাথেই সাদেক আলি আবিষ্কার করল যে আংটির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হল তর্জনী।
বিপত্তিটা দেখা দিল তখনই। আংটি কিছুতেই মধ্যমা থেকে আর বের করা যাচ্ছে না। আঙ্গুলের গিটে এসে বারবার আটকে যাচ্ছে। কেমন করে পরাবার সময় পরানো গেল কে জানে। পরানো গেলে এখন আর বের করা যাচ্ছে না কেন ?
তেল খুঁজতে থাকে সাদেক আলি। নারকেল তেল তার বাসায় নেই। মাথায় চুল খুব কম। তাই নারকেল তেল ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। আর সাদেক আলি চুল চেহারা পোশাক সম্বন্ধে সচেতন-ও নয়। চুরি করতে চেহারা লাগে না।
কেরসিন তেল বাসায় নেই। তাছাড়া কেরসিন তেল বোধহয় স্বর্ণের উপর প্রয়োগ করা ঠিক নয়।সরিষার তেল পাওয়া গেল। মুহূর্তেই চোখদুটো চকচক করতে থাকে সাদেক আলির। ডান হাতের আঙ্গুল গুলো দিয়ে যতটুকু সম্ভব সরিষার তেল নিয়ে ডলতে থাকে বাম হাতের তর্জনীতে। এই তো, আরেকটু। পিচ্ছিল হয়ে এখুনি খুলে আসবে আংটিটা।
এতক্ষণ হয়ে গেল এখনও খুলছে না কেন আংটিটা ? সমস্যাটা কোথায় ? আর কিছুক্ষণ পরেই তো মোরগ ডাকবে। ভোর হবে। তুর্ণা-নিশীথা এসে বিমান বন্দর স্টেশনে থামবে। সেখানেও তো ওকে যেতে হবে দাও মারার জন্য। কিছুখন ঘুমিয়ে না নিলে মাথা তো কাজ করবে না। আংটি আপাতত তর্জনীতেই থাকুক। একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। ঘুম থেকে উঠে ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করা যাবে আংটির ব্যপারে।
না, ঘুমানো চলবে না। ঘুমের মধ্যে বেখেয়ালে আংটি তে যদি চাপ পড়ে ? আংটি যদি ভেঙ্গে যায় ? না, ঘুমানো চলবে না।
ভোরের আজান শোনা যাচ্ছে। হাতে আর বেশি সময় নেই। যে করেই হোক আংটি টা বের করতে হবে বাম হাতের তর্জনী থেকে।
সাদেক আলি সারা ঘরে পায়চারি করতে থাকে অস্থিরভাবে। ঘরের নানা জিনিষপত্র হাতাতে থাকে। কী খুঁজছে সে কে জানে।
হঠাৎ একশো পাওয়ারের বাল্বের মতো সাদেক আলির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তোশকের তলা থেকে পুরনো একটা ছুরি বের করে আনে। মাঝে মধ্যে চুরি করতে গেলে আত্মরক্ষায় এই ছুরি কাজে লাগে। আশ্চর্য ! এই সহজ সমাধানটার কথা এতক্ষণ তার মাথায় আসে নি ! এবার আংটির বাপের-ও সাধ্য নেই সাদেক আলির তর্জনী কামড়ে তাকে উপহাস করতে থাকবে।
- সাদেক ভাই যে ! তা কেমন শরীর ?
- ভাল। বাচ্চু, কাল তোমাকে যে আংটিটা দেব বলেছিলাম, এনেছি। এই দেখ।
- এতো অনেক দামি জিনিস। আপনাকে আমি আরো একশো বাড়িয়ে দেব।
- তা তোমার যদি ইচ্ছে হয় দেবে না কেন, অবশ্যই দেবে।
- এই নিন আপনার আংটির দাম। আংটিটা রেখে তাড়াতাড়ি বাসায় যান। সকাল হয়ে গেছে। লোকজন রাস্তায় বেড়িয়েছে। এ সময় চোরাই মাল নিয়ে আর আলোচনা নয়।
- যাই।
- সাদেক ভাই, আপনি, মানে আপনার-
- কী ?
- আপনার আঙ্গুলে এতো বড় ব্যান্ডেজ কেন?
সন্ধ্যার কাছাকাছি
সীমান্ত সওদাগর
উঠোন বৃষ্টিতে ল্যাটোর-প্যাটোর। হাঁসের পাল কাদার খোঁচে মুখ ঢুকিয়ে অযথা হাসাহাসি করছে। বাড়ির বড় বউ ‘আয় আয় চইচই, আয় আয়....’ বলে হাঁসগুলোকে কুড়ো দিতে ডাকছে। মানুষের মতো স্বভাব নিয়ে একঝাঁক হাঁস নতুন বউটার দিকে এক নজর তাকিয়ে সমবয়সী অন্যান্য হাঁসের সাথে ফিসফিস করে কী যেনো বলছে আর খিলখিল করে
হাসছে। বউটা হাঁসের পালের দিকে তাকিয়ে আছে। কী যেনো ভাবছে। সে... ভাবনার শেষ নেই.... অযাচিত ভাবনা... ভাবনাগুলোও যেনো কাদায় ল্যাপটা-ল্যাপটি করছে.... আহারে ! হঁসেরাও এভাবে খেলে ! প্রেমিকার পাখনার ভেতর মুখ ঢুকিয়ে শরীর চুলকে দেয় ! এমন করে
খুনসুটিতে মেতে থাকে সারা উঠোন জুড়ে ! ধুর ছাই! এমন উন্মুক্ত সঙ্গমে
ওদের লজ্জা করে না ? বেহা হাঁস, হাঁসিনীও বেহা, লজ্জা নেই-শরম নেই, আমি হলে.....। এমন দৃশ্য আমার কাছে সত্যি অবাক হওয়ার মতো। আমি শহরের ইট-পাথরের দেয়ালের ভেতর শরীরের পরিধি বাড়িয়েছি। জীবনের গতি থাকে শুনেছিলাম, আজ দেখছি। কতো ভালবাসার গল্প শুনেছি, আজ বর্তমান। আহ ! আমার প্রেমিক যদি আমার পালকের
ভেতর মুখ গুজে দিয়ে শরীর চুলকে দিতো ! এমন খুনসুটিতে মেতে
থাকতো সারাবেলা ! এমন উন্মুক্ত সঙ্গম......
ভুলুমিঞা
সামিন রহমান
তিতাসের তীর।
আকাশ কেমন যেন কালো কালো, মেঘাছন্ন।
একটি পোড়া শীতল পাটির উপর ভুলুমিঞা হাঁটু গেড়ে নিঃসঙ্গ বসে আছে। স্থির দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে দূরে, নদীর দিকে। ডান হাতের মুঠোয় ভরা তিনজোড়া করবী ফল, ডান হাতটি হালকা হালকা কাঁপছে। পেছনে আট-দশ হাত দূরে কতগুলো আধপোড়া ঘর হতাশ মুর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ জোরে বাতাস বইতে শুরু করলো। ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠল নদী। এই নদীকে নিয়ে নানান স্মৃতি রয়েছে ভুলুমিঞার। আজ হঠাৎ করেই একের পর এক মনে পড়ে যাচ্ছে তার।
এক বিকেলের কথা।
চারপাশ কেমন যেন লাল হয়ে এসেছে। একটুপরেই সমাপ্ত হবে দিনের খেলা। ভুলুমিঞা তখন নদীতে নৌকা বাইছে। নৌকায় গোটাকয়েক যাত্রী।লাল ভুলমিঞার সন্তান।সে ভুলুমিঞার কাছেই বসেছিল; আর একমনে নিজের বাবাকে দ্বার বাইতে দেখছিলো।
যাত্রীদের মধ্যে গ্রামের মাস্টার সাহেব ছিলেন। মাস্টার সাহেবের পাশে ডান হাত তুলে বসেছিলো তোতামিঞা। সে খুবই উত্তেজিত, মাস্টার সাহেবকে সে প্রশ্ন করতে ইচ্ছুক।এটা তোতামিঞার অন্যতম অসহনীয় স্বভাব।মাস্টার সাহেবকে দেখলেই তার ভেতর কি যেন হয়ে যায়। আপনা আপনি ডান হাতটা উপরে উঠে যায় আর মুখটা অনবরত বিরক্তিকর সব প্রশ্ন করতে চায়। মাস্টার সাহেব যথেষ্ট ধৈর্য ধরে সেসব প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রায় সময়ই, সেই ধৈর্য উনার পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হয় না।
মাস্টার সাহেব প্রশ্ন করলেন-
“কি বলতে চাও?”
“মাস্টারসাহেব, একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিলো।”
“সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ?”
“জ্বি মাস্টার সাহেব”
“তাহলে বলো।”
“আচ্ছা মাস্টার সাহেব, পানি খাইলে পিপাসা নিবারণ হয়, কিন্তু থুতু খাইলে হয় না কেন?”
“পানি আর থুতু কি এক জিনিস?”
“একই তো মনে হয়।”
“তোমার মনে হইলে তো হবে না।”
“কেন হবে না মাস্টার সাহেব?”
“হবে না বলছি এজন্যে হবে না।”
“মানেটা ঠিক বুঝলাম না মাস্টারসাহেব। একটু খুলে বলেন।”
“কি খুলে বলবো?কাপড় খুলে বলবো? বলদ। না বুঝলে চুপ থাকবি।”
“কেন চুপ থাকব মাস্টার সাহেব?আমি মুখ্য সুখ্য মানুষ। আপনি বিরাট জ্ঞানী হইছেন।বইপত্র সব খাইয়া ভূড়ি বানাইয়া বসে আছেন। আপনের কাছ থেকে কিছু জানতে হইলে তো শব্দ করতে হবে। চুপ থাকা যাবে না।”
মাস্টার সাহেব আরেকবার তোতামিঞার দিকে রূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে তারপর ঝিম ধরে বসে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর অধৈর্য হয়ে ভুলুমিঞারে ডাকলেন।
“ভুলুমিঞা”
“জ্বি মাস্টার সাহেব।”
“ভালো আছনি?”
“ভালো আছি মাস্টারসাহেব।আপনে কেমুন আছেন?”
“ভালো নাইরে ভাই। ছাগলের পাল্লায় পড়েছি।খালি ম্যা ম্যা করতেই আছে।তুমি ভাই একটা গান ধরো, অনেকদিন তোমার গান শুনিনা।”
যাত্রীদের অনেকেই সায় দিল।
“হ ভুলুমিঞা গান ধরো। তোমার গান বড়ই মিঠা।”
ভুলুমিঞা ঈষৎ হাসে। তারপর দ্বার বাইতে বাইতেই গান ধরে।
আমি খুঁজিতে যাই,খুঁজে না পাই
মনের মাঝে চাইরে
দেখি সবই ঢাকা,সবই ফাঁকা
তারে দেখি নাইরে।
আমি হারায় খুঁজি, খুঁজিই হারাই
তারেই বুঝি ভাইরে
দেখি সবই আছে, তবু পাছে
তারে দেখি নাইরে।
গান চলতে থাকে বেশ। কিন্ত বাকি সবকিছু কেমন স্থির হয়ে থাকে। প্রকতি হঠাৎ করেই অনুভব করে,গভীর কোন ঘোরের মধ্যে সে লুপ্ত। এবং এরকম ঘোরেই তাকে লুপ্ত থাকতে হবে। এটা যেন নিয়ম। আর এর মধ্যে সময় কিন্ত চামে অনেকটুকু সময় পেয়ে যায় সুন্দর কিছু দেখে নিতে, সুন্দর কিছু লিখে নিতে,সুন্দর কিছু বুঝে নিতে। সময় কিন্ত জানে এই অসম্ভব সুন্দর পৃথিবীতেও কখনো কখনো সুন্দর কিছু খুব দুর্লভ, খুব সুপ্ত।
পরিশেষে গান শেষ হলো।
ততক্ষণে নিভে গেছে আকাশের আলো।
পাড়ে এসে ভিড়েছে নৌকা।
যাত্রীরা একে একে সবাই নেমে গেছে।
বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন ভুলুমিঞা। তীরে দাঁড়িয়ে লাল বাবাকে দেখছে। হঠাৎ সে বাবাকে ডাকলো,
“বাপজান”
ভুলুমিঞা লালের কাছে এগিয়ে এলো। গামছা দিয়ে মুখ হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হইছেরে বাপ, ক্ষুধা লাগছে?”
“বাপজান আপনার কাছে একটা আবদার করুম।”
“কি আবদার?”
“আপনে রাগ করবেন নাতো?”
“না। তুই বল।”
“বাপজান আপনের গান আমার খুব ভালো লাগে। আপনে আমারে গান শিখায়বেন?”
নিজের ছ’ বছরের পুত্রের মুখে এ আবদার না জানি কেন, ভুলুমিঞার অন্তরে এক গভীর প্রশান্তির ভাব এনে দিলো। ভুলুমিঞা লালকে বুকে জড়িয়ে নিলো। নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেললো।
এর বেশ কয়েক বছর পর এই নদীরই একপাশে একাত্তরের এক বর্ষনমুখর দিনে ভুলুমিঞা তার যুদ্ধে যাওয়া ছেলের বেয়োনেট খোঁচানো রক্তাক্ত নগ্ন মৃতদেহ খুঁজে পায়। ভুলুমিঞার মনে হচ্ছিলো মৃতদেহটি জীবন্ত, কি যেন খুব কাঁদতে কাঁদতে বলছে। ভুলুমিঞা শোকে জড়ছিল। তাই সে কিছু বোঝে নি। বোঝবার চেষ্টাও করেনি।
এরপর আরও একটি স্মৃতি।
কি সুন্দর! কি সুন্দর!
ভুলুমিঞার দিনটি খুব মনে পড়ে। নদীর ওপাড়ে তার বিয়ে হচ্ছে। বউ দশ বছর বয়সী কুমারী কন্যা। নাম রাধা। বিয়ে শেষে ভুলুমিঞা রাধাকে নিয়ে এপাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
সুন্দরী নববধুকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাভ্রমণ যদিও মন্দ হবার কথা নয় তবু ভুলুমিঞার সময় কাটছিলো বেশ ভয়ে ভয়ে। নৌকায় উঠবার আগেই রাধা খুব ভালোমত শাসিয়ে দিয়েছে,” সাবধান, গায়ে হাত দেবেন না কিন্তু, সঙ্গে চাক্কু আনছি।"
ভুলুমিঞা ভগবানের নাম নিতে নিতে বৈঠা বাইছে। রাধা নৌকার ছইয়ের ভেতর ঘোমটা টেনে বউ সেজে বসে আছে। ভুলুমিঞা বার কয়েক দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করেছে। লাভ হয়নি। রাধা সাড়া দেয়নি। ঘোমটা পড়া সদ্য নববধূকে ভুলুমিঞা দূর থেকেই দেখতে লাগলো। যদিও ঘোমটার উপর রাধার মুখোবয়ব বেশ অস্পষ্ট তবু সেই মুখোবয়বই ভুলুমিঞার মনে গভীর শূন্যতার জন্ম দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। তবে সে সব ঠিক টিকছে না। লাশ হবার দুশ্চিন্তায় কর্পুরের মত হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
ভুলুমিঞা তখনো নৌকা বাইছে। বাড়ি পৌছাতে এখনো ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। ভুলুমিঞা আকাশের পানে চাইলো। সেখানে কালো মেঘ এসে জমা হচ্ছে। চারপাশের চঞ্চল হাওয়া নদীকে প্রভাবিত করতে পারলেও, মেঘগুলোকে নড়াতে পারলো না। ভুলুমিঞা নৌকা বাইবার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো।
হঠাৎ চারিদিক ছাপিয়ে নামতে লাগলো বৃষ্টি। ভুলুমিঞা ঝাপসা চোখে চারপাশে তাকালো। লক্ষ্য করলো নৌকার ছই হতে রাধা বেরিয়ে এসেছে। তার মাথায় ঘোমটা নেই। সে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টিতে ভিজছে এবং হাসছে। ভুলুমিঞা অভিভূত হলো।
হঠাৎ ভুলুমিঞা লক্ষ করলো নিজের অজান্তেই তার হাত থেকে বৈঠাটা পড়ে গেছে। ভুলুমিঞা সচকিত হলো। এক মুহূর্ত দেরী না করে নদীতে ঝাঁপ দিলো।
মিনিট চারেক পর ভুলুমিঞা নৌকায় উঠে এলো। দেখতে পেলো রাধা কাঁদছে। ভুলুমিঞা জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলো? কাঁদো কেন?”
রাধা ভুলুমিঞাকে দেখে হঠাৎ কান্না থামালো। কিছুক্ষণ বড় বড় চোখে চেয়ে থেকে বললো,
“ঠিক আছে, আর কাঁদবো না। তয় আপনার মত বুকা মানুষ আমি আমার জিন্দেগিতে দেখি নাই।”
এই বলে রাধা আগের মতন নৌকার ছইয়ে ঢুকে বসে রইলো। ভুলুমিঞা শুকনো মুখে দ্বার বাইতে লাগলো আর মনে মনে গভীর আনন্দে আনন্দিত হলো।
এর অনেকদিন পর একাত্তরের এক দিনে পাকিস্তানী হানাদার কর্তৃক অপহৃত, ধর্ষিত এবং জবাইকৃত অবস্থায় ভুলুমিঞা তার সঙ্গিনীকে এবং লাল তার মাকে এই নদীরই একপাশে খুঁজে পায়। মূলত সেদিন তারা কিছু বলতে পারেনি, কিছু বুঝতে পারেনি। কি এক অদ্ভুত ঘোর যেন তাদের জাপ্টে ধরেছিলো। আর...
আর কিছু নয়।
এরপর, এখন পর্যন্ত অনেক সময় চলে গেছে। ভুলুমিঞা কখনো এমনটা অনুভব করেনি,যে অনুভবটা এখন তাকে ভীষণ অসহায় করে তুলছে। ভুলুমিঞা ভাবে,সকল স্বপ্ন হঠাৎ কেন এভাবে নিরর্থক হয়ে যাবে,কার দোষে?
ভুলুমিঞা ভাবে। হঠাৎ ভুলুমিঞা একটি ডাক শুনতে পায়।
“ভুলুমিঞা নাকি?”
ভুলুমিঞা চমকে উঠে দাঁড়ায়।
“সালাম,মাওলানা সাহেব।”
“বস ভাই, আমিও তোমার পাশে বসি।”
মাওলানা সাহেব ভুলুমিঞার পাশে বসে পড়লেন।এতে অবশ্য আধপোড়া শীতল পাটিটার কোন কষ্ট হল না।যদিও ওর প্রাণহীন প্রানে অজস্র স্মৃতি,অজস্র অনুভব।
“ভাই, তোমাদের ঘর বাড়িতো সব শেষ।এখন কি করবা?”
“কিছু চিন্তা করি নাই মাওলানা সাহেব।”
“ভাই মন খারাপ কইরা থাকবা না বুঝলা। কঠিন সময় যেমন থাকবে সহজ সময়ও কিন্তু থাকবে। এই দুই নিয়াইত মানবজীবন।তয় ভাই এটাই কিন্তু মানবজীবনের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। অনেকে এইটাই মাইনা নিতে পারে না।যারা পারে তাগোর জীবনে কিন্তু দুঃখ বইলা কিছু নাই,বুঝলা।”
ভুলুমিঞা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে,
“আচ্ছা মাওলানা সাব ঐ সাদা টুপি পড়া দাড়িওলা পোলাপানগুলা আমাগো ঘর পোড়াইল কেন?আমাগোর দোষটা কি কনতো?”
“তোমাগোর তো কোন দোষ নাই ভাই। ওরা অবুঝ পোলাপাইন।আল্লা ওগোরে বুঝ দেন নাই।ওগোরে বুঝ দিছে মানুষ,শয়তান মানুষ। ওরা যুয়ান পোলাপাইন,রক্ত গরম,মাথাও গরম। যা করতে বলছে তা না বুঝেই করে ফেলছে।আল্লা পাক সবই দেখতাছেন।তিনি নিশ্চয় ওগোরে হেদায়েত করবেন।”
ভুলুমিঞা চুপ করে থাকে।মাওলানা সাহেব বেশ সময় নিয়ে বলেন,
“ভুলুমিঞা,আমি সারাটা জীবন মানছি সব ধর্মের মানুষকে পাশাপাশি একে অপরের ভাই হয়ে মিলেমিশে থাকা উচিত।কিন্ত সারাটা জীবন এমনটা দেখছি খুব কম।তবুও ভাই যা হওয়া দরকার,যা হওয়া উচিত,তা তো সব সময় হয় না।তাও বেঁচে থাকতে হবে।যতদিন না পর্যন্ত উনি উপরে ডাইকা নেন,ততদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার মধ্যেই সব।আমি তাই ভাই বাঁচবার চেষ্টা করি।ভরসা হারাই না।যা হবার তা তো হবেই।”
ভুলুমিঞা চুপ করে থাকে।
“ভুলুমিঞা, তোমার তো ভিটা বাড়ি সব শেষ।আর তোমার তো কেউ নাইও।তাই বলি কি তুমি আপাতত আমার সাথে আইসা থাকো।পরে কোন গতি হইলে চইলা গেলা।”
ভুলুমিঞা চুপ করে থাকে।
“কিও ভাই কথা বলো।চুপ কইরা আছ কেন?”
ভুলুমিঞা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল।
“আরে মিঞা পোলাপানের মত কাঁদার কি হইল,কান্না থামাও।”
মাওলানা সাহেব ভুলুমিঞাকে জড়িয়ে ধরেন। এক সময় ভুলুমিঞা কান্না থামায়।
“আমি নামায পড়ে আসতেছি। তুমি জিনিসপত্র কি নিবা নিয়া নেও।ঠিক আছে?”
ভুলুমিঞা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। মাওলানা সাহেব চলে যান।
ভুলুমিঞা উঠে দাঁড়ায়। নদীর বুকে আরো একটি বার তাকায় সে।কি যেন খোঁজবার চেষ্টা করে।সম্ভবত নিজের জীবন। আসলে নদীর এ ব্যাপারটি ভুলুমিঞা জেনেছিল অনেক আগেই। নিজের সামান্য এ জীবনে সে দেখেছেও অনেকবার। নদী আসলে তার সেই জন্মকাল থেকে প্রতিটি দিন, প্রতিটি সময়, প্রতিটি ক্ষণ,সমস্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি মুহুর্মুহু নিজের অঙ্গে ধারণ করে আসছে। তাই নদীর দিকে তাকালে সহজেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। ভুলুমিঞা খুঁজে পায় অনেকটুকুই, নিজেকে, নিজের জীবনকে। ভুলুমিঞা অনুভব করে এক বড় শান্তির মত ভালোলাগা ধীরে ধীরে ডানা মেলে উঠছে তার অন্তরের ভেতর। সে নতুন করে বুঝতে পারে, এতগুলো বছর চলে গেছে, এখনো তো এ জীবন ভেঙ্গে পড়েনি।
ভুলুমিঞা আর বিলম্ব করল না।
করবী ফলগুলো সজোরে ছুঁড়ে মারল নদীর বুকে।
হঠাৎ প্রতিটি বিন্দু বিন্দু জল নিজেদের প্রাণের স্পন্দন নতুন করে অনুভব করল।
কুকস অ্যান্ড বুলস স্টোরি
তন্ময় ম্যাথিয়াস গমেজ
-“কেমন আছেন?”
-“ভাল,আপনি ভালো আছেন তো?”
-“এই তো আছি আর কি?”
-“আসু্ন ভেতরে আসুন, আপনার ছবিটা প্যাঁকিং করেই রেখেছি। বসুন আমি নিয়ে আসছি।”
যে ছবিটার কথা তিনি বললেন এই ছবিটা আমি গত সপ্তাহে জার্মান কালচারাল সেন্টার ছবির এক্সিবিশান থেকে দশহাজার টাকা দিয়ে কিনেছি।ছবির বিষয়বস্তু খুবই সাধারণ। একটি নগ্ন তরুণী কাঠের চেয়ারে বসে আছে ।কিন্তু অসাধারণ বিষয় হল তরুণীটির আকর্ষণীয় দেহ । ছবিটির দিকে একবার তাকালে চোখ ফেরানো মুস্কিল।এই ছবির দিকে যে পুরুষই তাকাবে তারই মন খারাপ হবে, ভাববে ইস এমন একটি মেয়ে যদি বিয়ে করতে পারতাম।ভাগ্যিস আমি প্রথম দিকেই গিয়েছি,নইলে এ ছবি থাকত না।
-“এই নিন আপনার ছবি। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি।আপনাকে দিয়ে দিতে হল।তা আমাদের তো অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয় তাই না ?”
আমি কিছু বললাম না। মৃদু হাসলাম।তারপর উঠে দাঁড়ালাম ।
-“আরে কই যান?,বসুন চা খেয়ে যান।এই রুবি চা দাও তো। ”
-“চা খাব না ।শরীরটা ভালো লাগছে না ।আমি বাসায় চলে যাব।”
- “আরে একটু চা খান না, দেখবেন শরীর চাঙ্গা হবে যাবে।”
অগত্যা বসতেই হয় ।আমি বসতে বসতে ভদ্রতা করে বললাম, “আর্টিস্টদের ছবি আকার পেছনে অনেক সময় গল্প থাকে এ ছবি আকার পেছনে আপনার কোন গল্প আছে কি?”
এমন সময় ভদ্রলোকের স্ত্রী ট্রেতে করে চা বিস্কিট নিয়ে ঢুকলেন ।তার স্ত্রীকে দেখে আমি থতমত খেয়ে গেলাম।কালো, টানা চোখ ,বোঁচা নাক,মোটা ঠোঁট,ভাঙ্গা গাল বিশিষ্ট এক রূপহীনা এক তরুণী।ভদ্রলোক আর্টিস্ট মানুষ,কত সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের সাথে পরিচয় আর তিনি এরকম এক রূপহীনা তরুণী বিয়ে করেছেন ভাবাই যায় না।তিনি তার স্ত্রীকে বললেন,“এ আমার নতুন বন্ধু জন,গত সপ্তাহ থেকে পরিচয়।”তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“এ তোমার বউদি, ওর নাম রুবি।”
নমস্কার বিনিময়ের পর ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে বললেন,“তুমি ভেতরে যাও আমাদের একটু প্রাইভেট টক আছে।”
ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন,“ তখন আর্ট কলেজে পড়া সবে শেষ করেছি।আমার বিয়ের এক মাস আগের কথা। এই রুবিকে চিনতাম একটু অন্যভাবে,কিভাবে সেটা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।একদিন বিকেলবেলা রুবি হঠাৎ আমার বাসায় উপস্থিত। অনেকক্ষণ কথাবার্তার পর সে লাজুক ভঙ্গিতে সে তার একটা বেয়ার পোট্রেট এঁকে দেবার অনুরোধ জানাল।রুবির সাথে আমার অনেক দিনের পরিচয় থাকলেও তাকে আমি কখনো আমি সেভাবে দেখিনি।তার মত রূপহীনা তরুণীর নগ্ন দেহ দেখার বা তার ছবি আকার ইচ্ছা কখনই মনে জাগেনি।কিন্তু ফিরিয়ে দিলে মনে কষ্ট পাবে ভেবেই রাজি হলাম।তাকে আমার স্টুডিওতে নিয়ে গেলাম।তারপর তার সব কাপড় খুলে ফেলতে বললাম।সে একে একে সব কাপড় খুলে ফেলল।আমি .....................।
-“আমি বরং আজ আসি ।শরীরটা খুবই খারাপ লাগছে।”
ভদ্রলোক মন খারাপ করে বললেন –“আচ্ছা”
তিনি আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন।
রাস্তায় নেমেই মনে হল প্রতিভাবান সব মানুষেরই মাথায় একটু ক্র্যাক আছে।নইলে নিজের স্ত্রী সম্পর্কে কেউ এসব কথা বলতে পারে।আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তার এই ছবি আকার গল্প আর তিনি শুরু করেছেন,তার বিয়ের পূর্ব গল্প।
বাসায় ফিরে ছবিটার প্যাকিং খুললাম।আবার সেই প্রথম দিনের ফিলিংসই হল।এত সুন্দর আকর্ষণীও দেহ কারো হতে পারে?ইস,এমন একজন স্ত্রী যদি আমার থাকত।
আপাদমস্তক পুরো ছবিটা একবার দেখলাম।
তারপর যেই মুখের দিকে তাকালাম হঠাৎ চমকে উঠলাম।
“রুবি বউদি”
নাম : তন্ময় ম্যাথিয়াস গমেজ
পেশা : ছাত্র (Notredame college)
ঠিকানাঃ ১৮/এ/১, পশ্চিম নাখালপাড়া
ঢাকা- ১২১৫
মোবাইল নো. ০১৬৮৩৭৪৬৪৫৬