যে নগরে কুড়ি থেকে কুড়ি হাজারে সম্ভ্রম কেনা যায়
যে নগরে কুড়ি থেকে কুড়ি হাজারে সম্ভ্রম কেনা যায়
সকাল রয়
০১.
আজ এই ভোর বেলাতে স্বাভাবিকের চেয়েও যেন একটু বেশি করে কাক ডাকছে। সারা আকাশ জুড়ে কা-কা রব।
কাক গুলো স্থির থাকে না শুধু একটানা মাথাধরা শব্দে ডেকে যায়। কি যেন বলতে চায়? এ-ডাল ও-ডাল ঘরের চাঁতালে জং ধরা জানালায় কিংবা আস্তাকুঁড়ের পাশে একটানা ডাকে। যদিওবা একটু থামে পরবর্তিতে আরো জোর গলায় ডেকে উঠে !!! তাড়িয়ে দেবার ভয় দেখালেও যায় না,ডাকে করুণ সুরে। ডানা ঝাপটায়। যেন প্রতিবাদ করছে ভয়ংকর কোন অপরাধের। ওরা ক্রমশই জটলা বাধায়। এক,দুই,তিন এভাবে কুড়িতে দাঁড়ায়। দলভারি করা ডাকে আশেপাশের কানগুলো গরম হয়ে উঠে এই চৈত্রের সকালেও। ওরা থামে না আকাশময় উড়ে উড়ে একটানা ডাকে,ওরা দলবেঁধে ঘোরে পুরো শহরতলীতে।
সেই সাত সকালে অবিনেশ ভিখেরির থালায় তখনও দুই টাকার একটা কয়েন ও আজ জমা পড়েনি। সে একটু অবাকই হয়েছ আজ। দৈন্যতায় গ্রাস করলো কি নগরবাসীকে,নাকি বাবু-বিবিদের দয়ার নৌকা চরে এসে ঠেকলো;নাকি দেশে পয়সার বিলুপ্তি ঘটলো।
কে জানে বাবা! অস্বাভাবিক কিছু নয়,রাজাদের পালাবদলে পয়সা বিলুপ্তি হওয়া স্বাভাবিক । কেননা নাম বদলের ধান্ধায় যদি দুই টাকার কয়েনটাকে গর্তে ফেলে নতুন আর একটা ছাপওয়ালা দুই টাকার কয়েন গজানো যায় তো মন্দ হয় না। ভিখেরি অবিনেশ এই সব ভাবতে ভাবতে ডানে বায়ে তাকায়। প্রতিদিন নিয়ম করে যে দুই টাকার কয়েনটা ওর থালায় পড়তো সেটা আজ পড়েনি আর সেই ভাবনাটা চাগিয়ে উঠে ভেতর থেকে। শুধুমাত্র অসুস্থতা থাকলে ঠিক সময়ে জমা পড়তো না। তবে দুপুরের আগে সেই কয়েনটা তার পক্ষ থেকে কেউ এসে থালায় রাখতো। আর তাই স্বভাবতই তার কণ্ঠে বেরিয়ে আসতো ঈশ্বর যেন সহায় থাকে তার প্রতি। সত্যিই কি তার প্রতি ঈশ্বর সহায় আছে কিংবা ছিলো?
ভাবনাটা ভিখেরি মনেও দোলা তোলে ক্রমাগত প্রশ্নজাগে মনে কিছু হলো কি?
এ সময় খোঁড়াতে খোঁড়াতে আধভাঙ্গা ঝাড় নিয়ে সিদ্ধির মা ঝাড়ওয়ালী দাড়ায় অবিনেশের সামনে। অবিনেশ তাকায়,মুখ ঘুমড়ো কেন রে সিদ্ধির মা?
-অবিনেশ দেশে পঁচন ধইরছে রে,লেকের ধারে একটা মাইয়্যা মাইনষের লাশ পইড়া রইছে।
০২.
নাম তার সমুদ্রা।
একটু সৌন্দর্য,মাধুর্য কিংবা সে একটু মিশুক সেই সাথে একটু চঞ্চলতা;মুখে তার হাসির ছড়া। মন খারাপ করা দিন ছিলো কম। বৃষ্টি কিংবা কাব্য বন্ধনা একসাথে জুটাতে চাইতো। বৃষ্টির আঙিনায় নিজেই কাব্যের বন্ধনা গাইতো। মায়া ছিলো বেশি পথ-পাখি-পথিক এই তার প্রিয়।
যখন হৃদয়ে দোলা জাগছে তার একটু একটু করে;ঠিক পিছে তারই বন্ধনা গাইছে কেউ কেউ এটা ভালো লাগার প্রথম দৃশ্য। পথে যেতে বখাটেরা পিছু নেয় প্রায় প্রতিদিন। সৌন্দর্য ভোগ করবার লালসাও হয়তো জাগে ওদের মনে। তাই ইনিয়ে বিনিয়ে বলে ভালোবাসার কথা।
সমুদ্র ফিরিয়ে দেয় সে সব হয়তো ভালো লাগে না বলেই।
কিন্তু বখাটেরা মানতে পারে না। যৌবন তো কাউকে দিতে হবে তাই না? তাহলে দিবি না ক্যান ? এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার ইচ্ছে হয় না । সমুদ্রা কখনও নত মুখে চলে;ভাবে সত্যিকার রাজপুত্রের আবির্ভাব হবে একদিন যে তাকে রক্ষা করবে এই নরান্তদের হাত থেকে। রূপকথার সেই ভুবনে তো যাওয়া তো সম্ভব নয়। নরান্তরা তাই ভীড় করেই থাকে সমুদ্রার পাশে। লালসার জিব গুলো বাড়তে বাড়তে এক নদী পেরুতে চায়। চায় জোয়ারে ভাসতে কখনো ইচ্ছামৃগ হতে চায়;ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় ইন্দুমতির শরীর তলে।
ও সেদিন কলেজ শেষে করে বাড়ি ফিরছিলো । পথে তখন ভীড় নেই। শ্রান্ত দুপুর। মোড়ের লন্ড্রি থেকে খুচরো পাচঁটা দুই টাকার কয়েন নিলো। প্রতিদিন কলেজ আসবার পথে অবিনাশ ভিখেরি পাবে একটি করে;আর বন্ধের দিন পাবে দুপুর বেলায়। পাবেই মিস হবে না। লন্ড্রিওলা সপ্তাহে দু’বার ভাংতি দেয়। জীবনটা সরল তুলসী গাছের মতোই ভাবে ও। প্রতিদিন কেউ ভক্তি ভরে কিছু দিলে সেটা হাত পেতেই হয়তো নেয় অবিনাশের মতো লোকেরা।
বা পাশের বুটিক হাউস পাড় হলে একটু নিরিবিলি রাস্তা । নিরিবিলি এ পথে আজ একটা চার চাকার ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে। পা ছেড়ে ছেড়ে হেটে যাচ্ছে সমুদ্রা; আজ রোদের আলো ওকে খানিকটা তাতাচ্ছে। চারচাকার পাশে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওদের পাশ কাটিয়ে সমুদ্রা এগিয়ে গেল কিন্তু মনে হলো পেছনে কে যেন আসছে।
আচমকা একটা হাওয়া নাকে লাগতেই আচমকা কে যেন ওর মুখটা ঝাপটে ধরলো । মুহূর্তেই দুলে উঠলো সামনের দৃশ্যগুলো। চারচাকাটা ওকে নিয়ে মিলিয়ে গেলো পথের সমুদ্রে।
নেই!
নেই সমুদ্রা কোথাও
সন্ধ্যে থেকে রাত……..
০৩.
দেহটা ঝাঁপিয়ে পড়ে গোলাপরাঙা শরীরটার উপর । যে দেহটা এতকাল পিছু ছুটে কুকুর হয়ে গিয়েছিলো; আজ সময়ে প্রয়োগে বাড়ে কঠিন ভাবে। যেন হাতের চাপে কেউ কচলে নিংড়ে নিচ্ছে রস।
ফুলটা এখনো ফুটতে পারেনি; সবে আধ ফোটা হয়েছিলো। শীৎকারের সাথে সাথে কান্নার একটা কঠিন শব্দ ছিটকে দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধন্নি হয়। জমাটবাধা ছোট্ট একটা রক্তের ফোটা মেঝেতে পড়ে।
একসময় ক্ষান্ত হয় !!
নিস্তব্ধ প্রকৃতি। বাকশূন্য চারদিক শুধু দেয়ালটা নিরব গর্জন করছে । হাওয়াটা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। কোথায় যেন নক্ষত্রের পতন ঘটলো। যেন এক প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছিটকে গেল নক্ষত্রটা। পশুত্বের সুখে;পশুত্বের আকাঙ্ক্ষার বলি হলো একটা সতীত্ব !!
যে কিনা পুরো ফুটতে পারেনি। যার অসহায়ত্ব দেয়ালে ঠেকে গেছে ভেদ করতে পারেনি। যার আর্তচিৎকার নগর দেবতার কানে যায়নি। যে অদম্য শখের ভেলায় ভাসতে গিয়ে ডুবে গেছে অতল সমুদ্রে। যে হাবুডুবু খেতে পারেনি পর্বত সমান বরফশৈল আছড়ে পড়ে পুরো ডুবে গেছে।
বাচঁতে পারেনি ওই কুকুরটার হাত থেকে। নেড়ি কুকুরটারও বোধহয় মায়া জাগে কখনো কখনো। কিন্তু কান্নাকন্ঠের চিৎকার,হাতে পায়ে ধরা কিছুই ফেরাতে পারেনি পশুত্বের জোয়ারে মনুষত্ব বড় অসহায় হয়ে গিয়েছিলো !!!
বিন্দু কনা মায়া জাগলো না হায় !! সতীত্ব মুছে গেল পশুত্বের জোয়ারে !!
০৪.
স্যালোয়ারের একপাশটা রক্তে ভেজা। কামিজটাও ছেড়া ! কপোলের পাশটায় ক্ষত হয়ে আছে সেই সাথে রক্তের দাগ। মুখটা শুকনো। উবু হয়ে পড়ে আছে লাশটা। সবুজ ঘাসটার উপর কা- কা- রবে মাত করছে কাকগুলো চক্রাকার ভাবে ঘুরছে যেন ওরা কি হারিয়েছে। নেড়ি কুকুড়টাও পাশে চুপটি মেরে বসে আছে আজ।
উৎসুক ক’জোড়া চোখ ছিদ্রান্বেশী হয়ে দেখছে। হয়তো এখানেই আছে সেই নরাধম। চিনতে পারবে কি করে মুখোশ আছে যে !!
যে নগরে কুড়ি থেকে কুড়ি হাজারে সম্ভ্রম কেনা যায়;কিংবা কুলটা বলে মিথ্যে দাবীতে কুড়ি হাজারে মূল্যমান দাড়ায় সম্ভ্রমের দাম;সে নগরে কুড়ি দিনে কুড়িটা সম্ভ্রম খোয়া লাশ এভাবে পড়ে থাকা অসম্ভব কিছু নয়!! অর্ধনগ্ন লাশ দেখে কেউ নাক সিটকায় ঘৃণায় থু-থু ফেলে। নিশ্চই প্রেমিকের হাতে বলি হইছে বলে কেউ কেউ কথা ছড়াচ্ছে।
শহরতলীর লোকেরা দেখছে- ওই তো পড়ে আছে সমুদ্র । সেই জলপাই রঙা ওড়না,হাতে প্লাটিনামের কঙ্কন। মা আছড়ে পড়ে লাশের অশ্রু দিচ্ছে;উপর থেকে বাবা নিস্তব্ধ। কাল বিকেল থেকে কোথাও খুজে পায়নি ওকে তন্ন তন্ন করে খুজেও হদিস মেলেনি।
কাকগুলো প্রতিবাদ জানাতে চায় !!
না জানি প্রতিদিন কতজনের সম্ভ্রম এভাবেই নিঃশ্বষ হচ্ছে;মুখোশ আটা নরাধম গুলোর পাশবিক অত্যাচারে। কাকগুলো উড়ে উড়ে ফিরে আসে লাশের কাছ আহাজারি করে মরে। খোড়াতে খোড়াতে অবিনাশও এসে যায় সেই ভীড়ের কাছে। ওই তো শুয়ে আছে সমুদ্রা ঘাসের চাদরে। যেন এখনি এসে বলবে,কি অবিনেশ দা কেমন আছো ? অবিনাশের মাথাটা ঘোরপাক খায় মেয়েটার কি দোষ ছিলো? ভালো ছিলো খুব মিশুক। কেন মারলো ওরা?
কিন্তু প্রশ্নের উত্তর আর মেলানো হয়ে উঠেনা অবিনেশের। তার তো আজ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না পেটের দায়ে পথে বসতেই হবে। কিন্তু সমুদ্রা কেন পড়ে আছে ঘাসের উপর ? তারও একটি মেয়ে আছে ঘরে তার যদি এমন হতো আজ তাহলে কি করতো সে;এখন সে ভাবনাটাই তাকে ধরছে ধীরে ধীরে।
পুলিশ এসে ভীড় জমাচ্ছে।
কাক গুলোর কা-কা- ডাক ছড়িয়ে পড়ে দূর থেকে বহু দূরে। কি যেন আজ বলতে চায় ওরা ? কাক যেন বুঝে নিয়েছে তাকে ? কিন্তু বুঝতে পারেনি এই বিবেকওলা দম্ভকারী মানুষগুলো।