হারুকি মুরাকামির সাক্ষাৎকার
হারুকি মুরাকামির সাক্ষাৎকার
প্রখ্যাত জাপানি কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির সাক্ষাৎকার
অনুবাদ : আদনান সহিদ
১৯৪৯ সালে জাপানের কিয়োটো শহরে জন্মগ্রহণকারী হারুকি মুরাকামি উত্তর আধুনিক কালের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং ডিজে (ডিস্ক জকি)। তাঁর অসংখ্য গ্রন্থ জাপান ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বাধিক বিক্রি হয়েছে এবং লক্ষাধিক কপি ৫০টির বেশি ভাষায় অনূদিত হয়ে জাপান ছাড়াও বিভিন্ন দেশে বিক্রি হয়েছে। মুরাকামির সাহিত্য কর্মসমূহ মূলত সমকালীন, মনস্তাত্ত্বিক ও জীবনমুখী। উপন্যাসের চরিত্রগুলো প্রায়শই বিষাদময়,বর্ণনাকৌশল বিস্তারিত এবং বর্ণিত খুঁটিনাটি বিষয়গুলো পাঠককে সরাসরি ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।
কথাসাহিত্যে প্রশংসনীয় অবদানের জন্যে হারুকি মুরাকামি জাপান ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর অর্জিত পুরস্কারের মধ্যে গুন্জো অ্যাওয়ার্ড ফর নিউ রাইটার্স (১৯৭৯),ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড (২০০৬), ফ্রাংক ও'কনার আন্তর্জাতিক ছোটগল্প পুরস্কার, ফ্রান্ৎস কাফকা পুরস্কার (২০০৬), জেরুজালেম পুরস্কার (২০০৯) , হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন সাহিত্য পুরস্কার (২০১৬) এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লেখালেখিতে আজীবন অবদানের জন্য সাহিত্যে আমেরিকা পুরস্কার (২০১৯) অন্যতম।গত এক দশকে কয়েকবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত বাছাই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে ইতোমধ্যেই নিজের সক্ষমতার সীমা জানান দিয়েছেন এই কথাসাহিত্যিক। তাঁর মৌলিক রচনার মধ্যে এ প্রথম উপন্যাস 'হিয়ার দা উইন্ড সিঙ্গ' (১৯৮৭), ওয়াইল্ড শিপ চেজ (১৯৮২), নরওয়েজিয়ান উড (১৯৮৭), দি উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল (১৯৯৪-১৯৯৫), কাফকা অন দি শো'র (২০০২) এবং ওয়ানকিউএইটফোর (২০০৯-২০১০), 'কিলিং কমেন্ডেটর'(২০১৮ সালে ইংরেজিতে অনূদিত) অন্যতম। দ্যা এলিফ্যান্ট ভ্যানিশেস (১৯৯৩), আফটার দ্য কোয়েক (২০০২), ব্লাইন্ড উইলো, স্লিপিং ওম্যান (২০০৬), মেন উইদাউট উইমেন (২০১৭) এবং ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার (২০২১) তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প সংকলন।এছাড়া বহু সংখ্যক ইংরেজি সাহিত্যকর্ম জাপানি ভাষায়ও অনুবাদ করেছেন মুরাকামি।
গত ২৫ মে, ২০২১ ওয়েব পোর্টাল,ইন্সাইড হুক-এ প্রকাশিত লেখক ও সম্পাদক শন উইলসিকে ইমেইলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সঙ্গীত, বর্ণবাদ, নারীবাদ, তাঁর সাহিত্য ও লেখালিখির প্রক্রিয়া নিয়ে বিশদ কথা বলেন হারুকি মুরাকামি। পাঠকের জন্য দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি ঈষৎ সংক্ষেপ করে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন আদনান সহিদ।
____________________________________________________________________
পাঠকদের তো অনেক আনন্দ দিয়েছেন। আপনার নিজের ক্ষেত্রে আনন্দের সংজ্ঞা কেমন?
হারুকি মুরাকামি:সত্যি বলতে কাউকে আনন্দ দেওয়ার জন্য লিখেছি-এভাবে কখনও ভাবিনি।নিজের রচনাশৈলী সম্পর্কেও বিশেষভাবে সচেতন ছিলাম না।লেখার সময় একটা ব্যাপারই মাথায় থাকে তা হলো কিভাবে বিষয়বস্তুগুলো যথাসম্ভব সহজভাবে জুড়ে দেওয়া যায় এবং বাক্যগুলো সাবলীল করা যায়।দুর্বোধ্য ভাষা বা ঘোরপ্যাঁচ বর্ণনা এড়াতে চেষ্টা করি।যা বলতে চাই তা যতটা সম্ভব স্পষ্ট এবং বোধগম্যভাবে বলে ফেলি।কেবল লেখার অর্থই নয়, বরং লেখায় যে চিত্রগুলি ফুটিয়ে তুলি তাও পাঠকদের দেখানো ও শোনানোর ইচ্ছা থাকে আমার।
কিন্তু আপনার 'আনন্দের' ধারণা—এটা কি লেখায় থাকে? আপনার লেখার কথা ভাবলে মনে হয়, একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহের মধ্যে আছেন এবং তা রক্ষা করে চলেছেন।বব মার্লের সেই গানের লিরিকটি মূর্ত হতে দেখি আপনার লেখায়ঃ "সঙ্গীতের একটি চমৎকার ব্যাপার হল যখন এটি আঘাত করে তখন কোন ব্যথা অনুভূত হয় না।" আপনার গান হল সেই গল্প।
হারুকি মুরাকামি: ফিকশন লেখার বিষয়ে যা জানি বা শিখেছি তার বেশিরভাগেরই উৎস হলো সঙ্গীত।লেখা আমার শরীরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। আর আমার মতে, লেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কখনোই বিষয়বস্তু নয় (যদিও বিষয়বস্তু অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ) বরং লেখার গতিবিধি। নিজ লেখা যথার্থভাবে লিখতে পারলে বিষয়বস্তু আপনা-আপনিই এগিয়ে যাবে।
অতীতের তুলনায় আপনার পুরানো কাজ নিয়ে অপেক্ষাকৃত সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে আপনাকে।অবাক হয়েছিলাম যখন, বছরের পর বছর নেতিবাচক থাকার পরেও আপনার প্রথম দুটি উপন্যাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন কেন?
হারুকি মুরাকামি: ঐ কাজ দুটি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম না।কারণ,ওগুলোর মধ্যে তখনও আমার নিজ শৈলীর অভাববোধ করছিলাম। ফলশ্রুতিতে, বরাবরই ওগুলো কোনও ভিনদেশী ভাষায় অনুবাদ করতে অস্বীকার করে আসছিলাম। শেষ পর্য্ন্ত আমার প্রথম দুটো বই পছন্দ করেছে এমন পাঠকের সংখ্যা নেহায়েত কম না হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে অন্য কিছু না হলেও অন্তত রেফারেন্স হিসেবে বইগুলি প্রকাশিত হোক।
নিজের লেখা 'হার্ডবয়েল্ড ওয়ান্ডারল্যান্ড' এবং 'দ্যা এন্ড অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড' এখনও কি আপনার প্রিয় বইয়ের তালিকায় আছে?.
মুরাকামি: নিজের কাজে সহজে সন্তুষ্ট হই না।তাই কেউ 'আমার প্রিয় লেখা কোনটি' বললে উত্তর দেওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে।হয়ত 'রূপকটি' যথার্থ হবে না তবুও বলব, যে বইটি লেখা শেষ করি তা লন্ড্রির জন্য খুলে ফেলে দেওয়া একজোড়া অন্তর্বাসের মতো মনে হয় আমার।
করোনা মহামারি কি আপনার রেকর্ডের কেনাকাটায় হস্তক্ষেপ করেছে কিংবা দৈনন্দিন রুটিনে উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন এনেছে?
মুরাকামি: ভিনদেশের রেকর্ড স্টোরে ঘোরাঘুরিটা মিস করি। সাধারণত সারা বিশ্ব জুড়ে সেকেন্ডহ্যান্ড রেকর্ড স্টোরে যাই আমি ।আর সময়ে সময়ে টোকিওর রেকর্ড স্টোরগুলোতে যাওয়া পড়ে। ইদানিং মূলত পুরানো ক্লাসিক্যাল রেকর্ডগুলো কিনছি।এখন আর বেশি একটা জ্যাজ সঙ্গীতের রেকর্ড কেনা হয় না।
আপনার নতুন গল্প সংকলনে নারী চরিত্রের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।এই গল্প সংকলনের শিরোনাম গল্পের শেষের দিকে এক প্রতিদ্বন্দী নারী বার পৃষ্ঠপোষককে সেই পরিবর্তনের প্রতীক বলে মনে হয়।লেখায় নারী সংশ্লিষ্ট এই পরিবর্তন কি সচেতনভাবে নিয়ে আসছেন?
হারুকি মুরাকামি: বিষয়টা ঠিক এভাবে বলতে পারছি না। এটা নিয়ে আগে ভাবিনি।
এ ধরনের প্রশ্ন করছি কারণ ঔপন্যাসিক মিকো কাওয়াকামি যখন আপনার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তখন তিনি আপনাকে জোর দিয়ে বলেছিলেন, “পুরুষ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় জন্য নারীদের বলিদানের এক অবিরাম প্রবণতা রয়েছে।প্রশ্ন হলো,মুরাকামির উপন্যাসে নারীদের এই ভূমিকা পালনে এতবার আহ্বান জানানো হয় কেন?" আপনার নতুন গল্পগুলো এ বিষয়ে সাড়াও জাগিয়েছে বেশ।কাওয়াকামির পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে আপনার মতামত কি?.
মুরাকামি: ধরা যাক, পরের মাসে কোনও বিপ্লব ঘটল। তখন উল্টোপাল্টা চিন্তা ভাবনার অপরাধে আমাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে, আমার মাথায় তিনকোণা লাল রঙ আটকে থাকতে পারে, জনগণের দ্বারা অভিশপ্ত হতে পারি, কিংবা নিকটতম কোন ল্যাম্পপোস্টেও বাধা থাকতে পারি। এভাবেই আসলে সবকিছু চলে। আমি আমার জীবনযাপন নিজের মতো করে উপভোগ করে চলেছি। উপন্যাসগুলি রচনার সময়েও জনমতের স্রোত উপেক্ষা করেছি।আর এখনও যে সবার মতকে পাত্তা দেওয়া শুরু করব এমনটিও নয়।
আমার কিশোরী কন্যা আমাকে বলেছিল, "মুরাকামিকে বস্তুত 'নারীবাদী' মনে হয় না, আবার 'নারীবাদী নন' এমনও মনে হয় না। তিনি এসব বিষয়গুলো খুব একটা পাত্তা দেন না।'' যখন তাকে বিস্তারিত বলতে বললাম, সে বলল," মুরাকামি নারী ও পুরুষের মধ্যে মূলত খুব বেশি ফারাক রাখতে চান না।" এ বিষয়ে আপনি কি একমত?
হারুকি মুরাকামি: আমার যাপিত জীবনের সাথে এসব 'বাদ' (যেমন: নারীবাদ ইত্যাদি) এর মূলত কোনও সম্পর্ক নেই। নির্দিষ্ট কোন 'মতবাদী' নই আমি।কেবল এমন কিছু লেখা পরিহার করি যাতে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে কেউ আঘাত না পান কিংবা তাদেরকে অবজ্ঞা করা না হয়।এখন আমার এই মতবাদ বা বোধকে কি কোন 'বাদ' এর অন্তর্ভুক্ত করবেন? যদি করতে চান তবে একে 'মুরাকি-ইসম' বা 'মুরাকি-বাদ' হিসেবে অভিহিত করতে পারেন।
কাওয়াকামি আপনার ১৯৯২ সালে লেখা গল্প, 'স্লিপ' এর প্রশংসা করে বলেছেন, "আমি 'স্লিপ'-এর মতো এমন আর অন্য কোনও নারী চরিত্রের মুখোমুখি হইনি৷বেশ একটি অসাধারণ অর্জন এটি৷'। এর সূত্রপাত হলো কিভাবে?
হারুকি মুরাকামি: 'স্লিপ' গল্পটা রোমে থাকাকালীন হঠাৎ মাথায় এসেছিল।তখন ভ্যাটিকানের কাছে এক অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম।সেখানে আমার জানালার ঠিক বাইরে একটি প্রোফুমেরিয়া (যেখানে সুগন্ধি তৈরি ও বিক্রি হয় ) ছিল। উচ্চস্বরে সমস্ত রোমান নারীরা সেখানে জড়ো হতেন।জানালা দিয়ে দেখা সেই দৃশ্যটাই মনে গল্পটির জন্ম দিয়েছে।এখন কেবল রোমের সেই দৃশ্যটুকুই মনে আছে।
আপনার সর্বাধিক বিক্রিত উপন্যাস, 'নরওয়েজিয়ান উডের' সাফল্য ও প্রচারণা থেকে দূরে থাকতেই তখন রোমে গিয়েছিলেন এবং ব্যাপারটা ভালো কাজ করেছে। এরকম পরিস্থিতিতে এখন কি করেন?
হারুকি মুরাকামি: ইতালিতে বসেই 'নরওয়েজিয়ান উডের' বেশিরভাগই অংশ লিখেছিলাম।তাই সব ধরনের প্রচারণা থেকে পালাতে সেখানে গিয়েছিলাম এমন বলাটা ঠিক হবে না। যাহোক,পরে বইটা বেস্টসেলার হয়ে উঠলে মনে হলো জাপানে ফিরে যাওয়ার ঝামেলা না করলেও তো হচ্ছে।তাই দীর্ঘ সময়ের জন্য ইতালিতেই থেকে যাই।আর এখন?এখন মনে হয়,জাপানের মানুষের সাথেই বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছি, ঠিক যেমন তারাও আমার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।সাবওয়ে বা বাসে যখন ভ্রমণ করি বা সেকেন্ডহ্যান্ড মিউজিক স্টোরে যাই,তখন আমাকে কেউ অস্বাভাবিক বা বিশেষভাবে খেয়াল করে বলে মনে হয় না।ব্যাপারটা বেশ সহজভাবে নেই…যদিও এখনও বেসবল খেলতে গেলে ভক্ত-পাঠকেরা মাঝে মাঝে আমার কাছে চলেই আসে।
সম্প্রতি কি অনুবাদ করছেন?
মুরাকামি: এফ স্কট ফিটজেরাল্ড এর 'দ্যা লাস্ট টাইকুন'।তরুণ বয়সে বইটি পড়ে খুব বেশি মুগ্ধ হইনি।পরে, পরিণত বয়সে পুনরায় পড়ার পর মনে হলো দুর্দান্ত একটা বই!
আপনার লেখায় কোনও পরিবর্তন এসেছে কি? 'উইন্ড-আপ বার্ড' কিংবা 'ওয়ানকিউএইটফোর' বা নতুন গল্প সংকলনের গল্পগুলো কি কোনও বিশেষ পাঠককুলকে উদ্দেশ্য করে লেখা?
মুরাকামি: আমার ভাবনা হলো, এখন থেকে ১০০ বা ১৫০ বছর পরেও কি মানুষ আমার বই পড়বে?পড়ে তারা কী ভাববে?বর্তমান নিয়ে খুব কমই চিন্তিত আমি। সত্যি বলতে আমার বইগুলো অনেকটা বোতলে পুরে রাখা বার্তার মতো।
এশিয়া বিরোধী সহিংসতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খবরের শীর্ষে রয়েছে।অনেক দিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে এই বিষয়ে আপনার মতামত কি?
মুরাকামি: ১৯৯১ সালে ম্যাসাচুসেটসে থাকাকালীন দেখেছি যে, মানুষজন জাপানি গাড়িগুলো ভাঙচুর করছে।তখন এক ডলারের বিনিময়ে একটি বড় হাতুড়ি ধার করা যেত এবং টয়োটা করোলা ভেঙে চুরমার করে ফেলা যেত। আসলে জাপানকে সেসময় আমেরিকার অর্থনীতির জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হতো। বর্তমানে চীন জাপানের সেই অবস্থান অনেকটাই দখল করে নিয়েছে।
আমেরিকানদের জেনোফোবিয়ার (ভিনদেশী আতঙ্ক) নেপথ্য কারণ কি বলে মনে করেন ?
হারুকি মুরাকামি: শুধু আমেরিকাতেই নয়, সারা বিশ্বেই আসলে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে। মানুষ পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন,এবং সেই উদ্বেগই তাদের আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে। আমি কেবল উপন্যাস লিখে উদ্বেগের অনুভূতিগুলিকে হ্রাস করে ফেলতে পারি।এক ধরনের উদ্বেগ সম্ভবত অন্য আরেক ধরনের উদ্বেগকে শোষণ করতে সক্ষম।
এবার মুরাকামি-বাদের ভিন্ন একটা অংশ নিয়ে কথা বলা যাক।কীভাবে রেডিও শোতে ডিজে (ডিস্ক জকি) হিসেবে আবির্ভাব হলো আপনার? [উল্লেখ্য, মুরাকামি টোকিও এফএম-রেডিওতে মাসে একবার রাতের শো-তে ডিজে হিসেবে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন]
মুরাকামি: কেন রেডিওতে ডিজে হিসেবে কাজ শুরু করলাম শুনতে চান?আসলে বাসায় একা একা গান শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই দলবদ্ধভাবে আমার প্রিয় সংগীতগুলো শুনতে চেয়েছিলাম (প্রায় ১৫,০০০ রেকর্ড এবং বহু সিডি একা একা শোনা সহজ কথা নয়)। তাই বয়স ৭০ হওয়ার পরপরই এফএম রেডিও শো করা শুরু করি।আবার হতে পারে, হয়ত ডোনাল্ড ফ্যাগেনের "দ্য নাইটফ্লাই" এর কভারের ফটো দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। আসলে ডিজে'র কাজটা খুব পছন্দ করি।
আপনার জাপানি সম্পাদক, রিকি সুজুকি বলেছেন যে তিনি পিটার ক্যাট (যে জ্যাজ ক্লাবটি আপনি পরিপূর্ণ লেখক হওয়ার আগে চালাতেন) এর গ্রাহক ছিলেন। আপনার গ্রাহকরা কি আপনাকে কথাসাহিত্য লিখতে উৎসাহিত করেছেন? পিটার ক্যাট-এর গ্রাহকদের পরিপূরক কি বা কারা ছিল?
মুরাকামি: এটা ছিল অতীত জীবনের একটা অধ্যায়।সৌভাগ্যবশত,এ বিষয়ে কিছুই মনে করতে পারছিনা এবং পরবর্তী জীবনে কি হতে পারে তা নিয়েও ভাবতে চাই না।
আপনার বেসবল বিষয়ক কবিতাগুলো সত্যিই আমাকে হাসিয়েছে। "অন এ স্টোন পিলো' গল্পে উল্লেখিত ‘টাঙ্কা পোয়েম’ আমার বেশ পছন্দের। আর আপনার বাবার হাইকুর উদাহরণ দ্বারা তো বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম যেমনটি তাঁর সম্পর্কে নিউইয়র্কার পত্রিকার একটি অংশে উদ্ধৃত করেছিলেন আপনি । মুরাকামির আরও কবিতা সামনে পাবো কি?
মুরাকামি ,: আমি যে টাঙ্কা এবং অন্যান্য কবিতা লিখি তা সবই হয় আমার গল্পের জন্য সাজানো বা সরাসরি রসিকতা। এগুলো খুব গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার দরকার নেই। গদ্য লেখক হলেও সবসময় পদ্যের জগতে আমি এক গভীরতা অনুভব করি। অবশ্যই ভাল কবিতা, টাঙ্কা বা হাইকু পড়ি ও উপভোগ করি কিন্তু তা কেবল নিজের লেখার বেলায়। অন্য কেউ গানের কথা লিখতে বললে সবসময়ই তা প্রত্যাখ্যান করি। এ কাজটা ঠিক আমাকে দিয়ে হয়না (যদিও, কাজুও ইশিগুরো বেশ কিছু ভাল গান লিখেছেন।)
একবার প্রয়াত রেমন্ড কার্ভারকে বলেছিলাম, "আপনার গদ্য কবিতার মতো, এবং আপনার কবিতাগুলি গদ্যের মতো।" এতে তিনি খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।। তিনি তাঁর স্ত্রী কবি, টেস গ্যালাঘেরকে গর্বিতভাবে চিৎকার করে বললেন, "আরে, টেস, তিনি (মুরাকামি) আমাকে যা বলেছেন তা কখনই বিশ্বাস করবে না তুমি!"
__________________________________________________________
*আদনান সহিদ-কবি, অনুবাদক ও শিক্ষক (ইংরেজি ভাষা ও যোগাযোগ), বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়