‘দশমাতৃক দৃশ্যাবলি’
‘দশমাতৃক দৃশ্যাবলি’
‘দশমাতৃক দৃশ্যাবলি’: জীবনবোধের নান্দনিক উৎসারণ
হারুন পাশা
কবি হিমেল বরকতের (জন্ম : ১৯৭৭) প্রকাশিত তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দশমাতৃক দৃশ্যাবলি’। বইটি পাঠে মনে হল তিনি জীবনকে যে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন, পর্যবেক্ষণ করেছেন তারই সারাৎসার দশমাত্রা ও দশপদে শৈল্পিকতায় উপস্থাপন করেছেন। জীবনের বিচিত্রতাকে তিনি ‘ছুঁয়ে-ছেনে’দেখতে চেয়েছেন। জীবনকেই আলেখ্য করেছেন কবিতার পংক্তিতে। কোনো কল্পনার বিশ্ব নয়, বাস্তবজীবনকেই দেখিয়েছেন বিচিত্রভঙ্গিতে।
জীবনে পথ চলতে গেলে ভালো এবং মন্দের দেখা মেলে, আর আমরা কেবল ভালোকেই গ্রহণ করি মন্দকে বাদ দিয়ে। কিন্তু কবি এই মন্দকেও পাশাপাশি গ্রহণের কথা বলেছেন কবিতায়। কেবল ভালো নয় মন্দের দিকটাকেও উপেক্ষা না করে আদৃত করতে হবে। কেবল বকুল নয় বিষাদে সুতা পরিয়েও মালা তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে। আমরা বর্তমানে বসবাস করে ফিরে যাই হারানো অতীতে, সেই অতীতের সুখ-দুঃখ আমাদের ভাবায়। চাইলেই ভোলা যায় না সেই অতীত, কারণ আমাদের রক্ত-মাংসে সেই অতীতের চিহ্ন রয়ে যায়। অতীত জড়িয়ে থাকেই আমাদের চেনা বর্তমানে; সেই কথাও কবি বলেছেন অত্যন্ত সহজ ও সাবলীলভাবে ‘স্মৃতিস্মর’কবিতায়। কবি জীবনে পথ চলতে গিয়ে ঘৃণাকেও অবলম্বন করতে চান, ঘৃণা করেও দেখতে চান জীবনকে। যাপিত জীবনে দীর্ঘদিন বসবাস করলেও নিজেকে দেখা বা চেনা যায় না, কবি চিনতে পারেন না নিজেকে। শুধু কবি নন আমরাও সেই সংকটের যাঁতাকলে পিষ্ট হই। বাস্তবজীবনে আমরা দ্বিধার মুখোমুখি হই, এটা নিবো না ওটা নিব এই দ্বন্দ্বে দুলতে হয়। কবিও লিখে ফেলেন তেমন কথা, সেই দ্বিধার কথাকে বিশ্লেষণ করেছেন ‘দ্বিধা’কবিতায়। প্রত্যাশিত মানুষটি কবির জীবনে না আসলে ব্যথাহত হন, কষ্ট পান। আবার কবি জোর করে সম্পর্ক নির্মাণের পক্ষপাতিও নন। তিনি জীবনের বাস্তবতা থেকেই দেখতে পান সম্পর্ক একবার ভেঙে গেলে সেই সম্পর্ক জোড়া লাগানোর নয়। জোড়া লাগলেও তাতে থাকে না পূর্বের মতো মধুরতা, একটি না না ভাব থেকেই যায়। যেমন ভাঙা গ্লাস জোড়া লাগলেও সেখানে দাগ থেকে যায় তেমনি সম্পর্ক ভেঙে গেলে একটি দূরত্ব বিদ্যমান থাকেই (দাগ)। আমাদের জীবনে একটি চরম সমস্যা হলো অন্যের চোখে দেখতে চাওয়া বিশ্বকে, নিজের বিচার-বিশ্লেষণকে গুরুত্ব না দিয়ে। আমরা সৃষ্টিশীলতাকে ধ্বংস করে চর্বিত চর্বণে বিশ্বাসী হয়ে উঠি। কিন্তু কবি চান প্রত্যেকে তার বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলুক : ‘সব কেন শুনতে চাও মুখে?/নিজে কিছু পড়ো। নিঃশ্বাসের/তাপ, ঘামের গরিমাÑছুঁয়ে/দ্যাখে।/ ভেজা চোখ দেখে শেখো’(প্রস্তাবনা)।
আমাদের জীবনে জৈবিক সত্তার কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কেউ কেউ ভদ্রতার মুখোশ পড়ে কামনাকে আড়াল করে রাখে, আবার কেউ সেটাকে সংকোচ ছাড়াই প্রকাশ করে। অবস্থা যাই হোক কাম-বাসনা সবাইকেই কম-বেশি পেয়ে বসে। এই কামনার কথাই কবি বলেছেন ‘স্বপ্নঘ্রাণ’, ‘দেহতত্ত্ব’কবিতায়। মিলনের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা, আবার মিলনের শেষে ক্লান্তির কথাও বলেছেন।
ছেলে এবং মেয়ের মনস্তত্ত্বকে নিয়ে লেখেন ‘অভিমান’, ‘ঈর্ষা’নামক দুটি কবিতা। ছেলেরাই কেবল মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে তা নয় মেয়েরাও তাদের দিকে তাকায়- আমাদের জীবনের এই সত্যের কথাও বলেন ‘শুভদৃষ্টি’কবিতায়। এটি এ কাব্যে নতুন সংযোজন। মেয়েটি ছেলেটাকে চায় না, আবার ছেলেটি মিলির কাছে গেলে রাগে জ্বলে-পুড়ে মরে, নিজেকে মিলির চেয়ে সুন্দরী ভাবতে থাকে ‘অভিমান’কবিতায় : -ও কেন মিলির কাছে যায়/মিলি কি আমার চেয়ে ভালো’। ছেলের কাঙ্ক্ষিত মেয়েটি অন্য ছেলের কাছে বসলে সেও যন্ত্রণাবিদ্ধ এবং ব্যথিত হয় ‘ঈর্ষা’কবিতায়।
বাস্তবজীবনের দ্বিধাবিভক্ত সম্পর্কের কথাও তিনি বলেন; যে সম্পর্কে প্রবেশ করেছে তৃতীয় ব্যক্তি। যেখানে সম্পর্কের কোনো সুনির্দিষ্ট বন্ধনী থাকে না। স্বামী ছেড়ে চলে যায় মন আরেকজন পুরুষের কাছে, আবার পুরুষও স্ত্রীর পাশে শুয়ে স্মৃতিতে জাগিয়ে রাখে পুরানো প্রেমিকাকে। এই বিশ্বায়নের যুগে সম্পর্ক যে কতো জটিল হয়ে গেছে, বিচ্ছিন্নতা হয়ে ওঠেছে আরাধ্য সে সম্পর্কেও কবির দৃষ্টি নিবদ্ধ। দুজনে মুখোমুখি বসেও কেউ কারো সঙ্গে কোনো কথা বলে না। প্রিয় স্মৃতি আড়ালে ঢাকা পড়ে নীরবতা হয়ে ওঠে মুখ্য। অসুরের ন্যায় জেগে রয় নৈঃশব্দ (মুখোমুখি)। দূরত্বই প্রিয়া কামনা করে, প্রিয়ার অনুপস্থিতি কবিকে পোড়ালেও সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। সম্পর্কের ভেতরে ঢুকে যায় অবিশ্বাস। প্রেমিক নিজের প্রেমিকাকে বিশ্বাস করতে পারে না। প্রেমিকার গর্ভে যে সন্তান সে সন্তান কি আসলে প্রেমিকের না অন্য কারো এমন প্রশ্ন মনে দোলা দেয় (রূপান্তর)।‘বাকুম বাকুম’কবিতায় কবি পরকীয়া প্রেমের কথা বলেন, যে পুরুষ বেলা অবেলায় এসে পরস্ত্রীকে জ্বালাতন করে।
মানুষ শেষ পর্যন্ত একা, সেই একাকিত্বের কথাই প্রকাশ পেয়েছে ‘অলিখিত ব্যথা’, ‘একাকিত্ব’, ‘শূন্যতা- সুর’কবিতায়। সকলের সঙ্গে চললেও দুঃখকে কুড়াতে হবে একা। বিশ্বায়নের যুগে প্রেম-ভালোবাসা যে পণ্য হয়ে গেছে সে কথা বলেন ‘বিশ্বায়ন’কবিতায়। কবি বিশ্বায়নের ঘোর বিরোধী, তাই বলেন : ‘লক্ষ্মী বউ ফেলে, আমি/ ও যোনীতে পেচ্ছাবও করি না।’
কবি জীবনের ভিটে-মাটি খুঁড়ে দেখতে চেয়েছেন তার রং কেমন, তার স্বাদ কেমন। প্রমিত এবং আঞ্চলিক বয়ানে কবি দেখিয়েছেন জীবনে যেমন প্রেম-ভালোবাসা আছে, আছে তেমনি বিচ্ছেদ, যৌনতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই, জীবনের রন্দ্রে ঢুকে যায় অবিশ্বাস, সম্পর্ককে তিক্ত করতে আসে পরকীয়া প্রেম, বিশ্বায়ন মানুষকে করে তোলে যান্ত্রিক, সব কিছুকে বিচার করে যন্ত্রের মতোই। বাস্তবজীবনের এমন নানা অনুষঙ্গের আয়োজনে অনন্য হয়ে উঠেছে ‘দশমাতৃক দৃশ্যাবলি’কাব্যগ্রন্থটি।