নীলাকাশের নীলিমা
নীলাকাশের নীলিমা
বেলাল উদ্দিন সৌরভ
ময়মনসিংহ সরকারী কলেজে কেমেস্ট্রি বিভাগের অনার্স ২য় বর্ষে আজ খুব একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় নিয়ে লেকচার হচ্ছে। লেকচারার হচ্ছে এই কলেজে সদ্য নিয়োগ পাওয়া শিক্ষিকা ইসরাত জাহান নীলিমা। সে আজ বক্তব্য দিচ্ছে পারমাণবিক বিভাজন তত্ত্বের উপর। জার্মান বিজ্ঞানী অটোহান তার কয়েকজন সহকর্মী বিজ্ঞানীর সাথে গবেষণা করে প্রথম পারমানবিক বিভাজন আবিষ্কার করেন। নির্দিষ্ট কোন ভারী পরমাণু একের পর এক পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়াকে সমপ্রতিক্রিয়া ধারা বলা হয়। এটাকে নাম দেওয়া হয় পারমাণবিক বিভাজন প্রক্রিয়া। এতে সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড শক্তির। উল্লেখ্য যে, এই তত্ত্বই ছিল পারমাণবিক চুল্লী এবং পারমাণবিক বোমা তৈরির মূল রহস্য। লেকচার দিতে গিয়েই নীলিমার চোখ পড়ে পল্লব নামের ক্লাসের সবচাইতে সুদর্শন ছাত্রটির উপর। সে জিজ্ঞেস করে-বলতো পল্লব, অটোহান অপরিশোধিত রেড়িয়াম পরীক্ষা করতে গিয়ে যে আরো একটি নতুন পদার্থ আবিষ্কার করেন তার নাম তিনি কি দিয়েছিলেন ? পল্লব কয়েকমূ্হুর্ত চিন্তা করে জবাব দেয়- ‘‘রেড়িওথেরাম” (raditharium)। ভেরি গুড, তোমাকে ধন্যবাদ। নীলিমা বলল।
ক্লাস শেষ করে নীলিমা যখন টিচার রুমের দিকে যাচ্ছিল তখন পথে বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কুমার নন্দীর সাথে দেখা হয়ে যায়। উনি নীলিমাকে দেখে একটু মুচকি হেসে বললেন, আপনাকে দারুণ লাগছে ম্যাড়াম ; আসলে আপনার ফিগারটা না ক্যাথারিন হ্যাপবার্ণের মতো। আপনি লেকচারার না হয়ে নায়িকা হলে দারুণ মানাতো। নীলিমা এ কথায় একই সাথে বিরক্তি এবং অস্বত্বি বোধ করে। মনে মনে বলে- বাংলা সাহিত্য নিয়ে যারা পড়ে তাদের বোধয় একটু লজ্জা -শরম কম , মুখে যা আসে তাই বলে ফেলে । কিন্তু সেও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। বলল- আচ্ছা শ্যামলদা, আপনার বড় ছেলেটাতো আমাদের কলেজেই আই এস সিতে পড়ছে। কিন্তু আপনি এখনও আপনার মধ্যম নামটা কুমার লেখেন কেনো? আপনি কি ভাবছেন আপনার ঐ নামটা দেখেই কলেজের কুমারী ছাত্রীরা আপনার গলায় ঝুলে পড়বে? নীলিমার কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে অধ্যাপক শ্যামল কুমার নন্দী হু হু করে হেসে চলে যায়।
এরপর বি এস সি (পাস) কোর্সের আরো একটি ক্লাস নিয়ে নীলিমা একটি রিক্সা নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। কলেজ থেকে তাদের বাড়ি মাত্র আড়াই মাইল। এখন ফেব্রুয়ারী মাস। আশপাশের বৃক্ষগুলিতে নব কিশলয় গজিয়েছে, বাহারী বর্ণের ফুল ফুটেছে। সেদিকে তাকাতেই নীলিমার অজান্তেই তার হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়ে বাগযন্ত্র দিয়ে বেরিয়ে আসে রবীন্দ্রনাথের কিছু কথামালা :
হে বসন্ত, হে সুন্দর, ধরনীর ধ্যান ভরা ধন;
বৎসরের শেষে
শুধু একবার মর্তে মূর্তি ধর ভুবনমোহন
নববরবেশে।
রেলওয়ে কর্মকর্তা আকাশের বাবা মনতাজুর রহমানের সাথে নীলিমার বাবার কী উপলক্ষ্যে যেন বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তাই আকাশের পরিবারের সাথে নীলিমাদের পরিবারের যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রেই আকাশের সাথে তার পরিচয় ও সম্পর্ক। সময়ের স্রোতধারায় তা যে এতদিনে ডালপালা গজিয়ে মহিরুহে পরিণত হয়েছে তা নীলিমা টেরই পায়নি। আকাশের অবর্তমানেই আজ সে প্রথম উপলব্ধি করতে পারছে আকাশ তার হৃদয় মনের কতখানি অংশ জুড়ে বিরাজ করছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে আকাশ একটি টিভি চ্যানেলে সাব নিউজ এডিটর হিসেবে জয়েন করেছিল। এর এক বছর পর সে আরেকটি টিভি চ্যানেলে একটি রাজনৈতিক টক শো উপস্থাপন শুরু করে। টক শো টি বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল। কিন্তু কি কারণে সে আজ দু’সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ? আকাশের কথা ভাবতে ভাবতেই রিক্সা তার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।
মা খাবার রেডি করে টেবিলে ঢেকে রেখেছিল। ইলিশ মাছ, পাট শাক, মিকস সালাড আর মুগ ডাল। তরকারীর স্বাদ থাকলেও সে সামান্যতম মাত্র খেয়েই ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয়। পাশে সেলফের উপর থাকা ক্যাসেট প্লেয়ারটা অন করতেই বেজে ওঠে :
আমার সকল দুঃখের প্রদীপ
জ্বেলে দিবস, গেলে করব নিবেদন
আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন।
গান শুনতে শুনতে সে যখন একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল অমনি মোবাইলটা বেরসিকের মতো বেজে ওঠে। কলার আইডিতে দেখে শওকত মামার ফোন। নীলিমা হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে মামা বলে- বল ইশরাত, ঐ ব্যাংকার ছেলেটার ব্যাপারে তোমার মতামত কি? উল্লেখ্য সবাই তাকে নীলিমা বললেও মা এবং শওকত মামা তাকে ইশরাতই ডাকে। মামার প্রশ্নে ইশরাত একটু আমতা আমতা করলে ওপাশ থেকে বলে- শোন ইশরাত অত ভাবাভাবির দরকার নেই। নাইম ভাল ছেলে। হিস্ট্রি থেকে এম এ করে ঢাকা ব্যাংকে ঢুকেছে। খুব করিৎকর্মা ছেলে। কম্পিউটারের উপর একটা কোর্স করে সে এখন কম্পিউটারের দিকটাও ভালভাবে সামাল দিচ্ছে। আগামী কয়েকমাসের মধ্যে সে এ্যসিসট্যান্ট ম্যানেজার হবে।
ইশরাত মামাকে কি করে জানাবে যে আকাশকে ছাড়া সে অন্য কাউকে কোনদিন ভাবতে পারে না। অথৈ জলে তৃণখণ্ড আকঁড়ে থাকার মতো হঠাৎ সে একটা অজুহাত খুজেঁ পায়। কে যেন একবার বলেছিল নাইম নামের ব্যাংকার ছেলেটার গোফঁ আছে। সে সাথে সাথে মামাকে বলে - মামা, আমি গোঁফওয়ালা ছেলেকে বিয়ে করব না। আমার বড়দার গোঁফওয়ালা এক বন্ধুকে দেখেছিলাম ভাত খাওয়ার সময় ওর গোঁফে মাছের কাটা লেগে সে কি বিশ্রি কাণ্ড! এরপর আমি প্রতিজ্ঞা করেছি জীবনে আর কোনদিন গোঁফওয়ালা ছেলেকে বিয়ে করব না। তার কথা শুনে মামা ওপাশ থেকে হা হা করে হেসে উঠে।
গোঁফের কেস কোন সমস্যা না । বিয়ের পর বউয়ের অনুরোধে কত ছেলেইতো গোঁফ কামাই করে ফেলে। আমারও তো গোঁফ আছে। ভাবছিলাম বিয়ের পর হয়তো আমারও অনেক সাধের এই গোঁফের বিলোপ সাধন করতে হবে। কিন্তু বিয়ের পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময় তোর মামী যখন বলল- তোমাকে না এই গোঁফটাতে বলিউডের নায়ক জ্যাকিস্রুফের মত লাগে। এই গোঁফ দেখেই তো আমি তোমাকে পছন্দ করেছি । তখন আমি খুশীতে গদগদ হয়ে সেদিনই বসুন্ধরা সিটি মার্কেট থেকে তোর মামীর জন্য সবুজ জমিনের উপর একটা লাল পাড়ের শাড়ী কিনে এনেছিলাম। আচ্ছা; গোঁফের ব্যাপারে তোর মতের পরিবর্তন হলে আমাকে জানাইস।
ফোন রেখে নীলিমা আবার বিছানায় এলিয়ে পড়ে। ভাবে এক একটা অজুহাত দিয়ে সে আর কয়টা বিয়ের প্রস্তাব এড়াতে পারবে ? বাবা-মা তার বিয়ে নিয়ে সারাক্ষণ টেনশনে থাকে। গতমাসে তার মুবীন আংকেল একটা ছেলের প্রস্তাব এনেছিল ।
কিন্তু নীলিমার রিটায়ার্ড কলেজ প্রিন্সিপাল সৎ মানুষ বাবা যখন জানল ছেলেটার বাবা ঢাকায় রাজউকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার সময় অজস্র দুর্নীতি আর ঘুষের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে দুদকের মামলা খেয়ে অসময়ে চাকরী খোয়াতে বাধ্য হয়েছে তখন বাবা সাথে সাথে না করে দিয়েছিলেন। কারণ জেনে শুনে তিনি একজন ঘুষেখোরকে বেয়াই বানাতে চাননি। অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় মাহতাব নামের যে ছেলেটা তাকে দেখতে এসেছিল নীলিমা বোধয় তার উপর একটু বেশী রূঢ় হয়েছিল। ছেলেটা নাকি হিসাব বিজ্ঞান থেকে এম কম করে একটা মোবাইল কোম্পানিতে জয়েন করেছিল। পরিচয় পর্বটা না সারতেই ছেলেটা বলতে শুরু করেছিল- জানেন আমাদের মোবাইল কোম্পানির সার্ভিসেই সবচেয়ে কম রেটে কথা বলা যায়। ত্রিশ টাকা দিয়ে একটা সীমকার্ড কিনলে আপনাকে ৫০০ মিনিট টক এবং ১০০টি এস এম এস ফ্রি দেওয়া হবে। দিনের বেলায় কথা বললে প্রতি মিনিটে মাত্র দশ পয়সা আর রাত আটটা থেকে সূর্যোদয় পর্য্ন্ত টোটালী ফ্রি। ইচ্ছেমতো সারারাত বিনে পয়সায় কথা বলতে পারবেন। কথাগুলি শুনে নীলিমার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল। সে বলল- গালভরা বুলিবাজ বাঙালিরা এমনিতে অযথা অন্যের গীবত সমালোচনা আর নিন্দায় চা -এর কাপে ঝড় তোলে। সেখানে বাণিজ্যের খাতিরে তাদেরকে এত সস্তায় কিংবা ফ্রিতে কথা বলতে উৎসাহিত করে আপনারা কি দেশটাকে রসাতলে নিয়ে যাবেন? টেলিভিশন খুললেই মোবাইল কোম্পানির ঘেচাং ঘেচাং প্যাচাং প্যাচাং বিজ্ঞাপন। বাংলা ভাষাকে পর্যন্ত ওরা বিকৃত করে ফেলছে। ছিঃ!
অতঃপর একটু থেমে নীলিমা আবার বলল- আপনিতো মোবাইলের প্যাকেজের কথা বললেন, কিন্তু আপনার নামটাতো বললেন না। ছেলেটি নীলিমার কথায় একটু থতমত খেয়ে বলেছিল, জি আমার নাম মাহতাব উদ্দিন ভূইয়া।
--শুধু মাহতাব উদ্দিন হলেই তো ভাল হতো, শেষে আবার ভূইয়া একটা লেজ জুড়ে দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল ?
আসলে আমার দাদাদের বেশ কিছু জমিজমা ছিল বলে ওরা নামের শেষে ভূইয়া লিখত। আমার বাপ-চাচারা সেই টাইটেল ব্যাবহার করেছে, আমিও করছি; তাতে দোষের কি? আসলে আমি জমিদারের নাতি।
বাহ! চমৎকার! একবিংশ শতাব্দীর ছেলে হয়েও আপনি দেখছি সামন্তবাদী মানসিকতা লালন করে আছেন। এসব যে আর এযুগে চলে না তা বুঝেন না কেনো? আপনি কি ভেবেছেন জমিদারের নাতি বললেই আমি ইমপ্রেসড হয়ে আপনার গলায় মালা পরিয়ে দেব? আপনি এখানে আসার আগে আমি এক বন্ধুর মাধ্যমে আপনাদের ব্যাকগ্রাওন্ড জেনে নিয়েছি। আপনার বাবা এবং চাচারা নাকি আপনার বৃদ্ধ দাদাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে অথবা ভয় ভীতি দেখিয়ে ব্ল্যাক মেইলিং করে আপনার আট ফুফুকে ওদের ন্যায্য পাওনা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন। যেখানে ওঁরা জন প্রতি ৫ একর করে সম্পত্তি পাবেন সেখানে তারা পেয়েছেন মাত্র এক একর । তাও আবার ঝোপ-ঝাড়ে পানির নীচে মূল্যহীন জায়গা। ধর্মীয় বিচারে এবং মানুষের বিচারে এটা জঘন্য অপরাধ। আপনার বাবা আর চাচারা নাকি সেই সম্পত্তির উপর ভর করে এমনকি প্রয়োজনে বিক্রি করে আপনাদেরকে ঢাকা শহরে লেখাপড়া করিয়েছেন, যার ফলে আজ এখানে চাকরি করতে পারছেন। আপনাদের উচিত ফুফুদের পায়ে ধরে মাফ চেয়ে আসা ওদের পবিত্র হক আপনার বাবারা লুণ্ঠন করেছিল বলে।
নীলিমার কথায় মাহতাব উদ্দিন ভূইয়া কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়ে। কি দজ্জাল মেয়েরে বাবা, সব খবর কালেকশন করে নিয়েছে। সে আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু নীলিমা তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর সামনে থেকে হন হন করে উঠে এসেছিল।
বিয়ে নিয়ে বিগত দিনের কথা ভাবতে ভাবতেই আকাশ যেন স্মৃতির জ্যোৎস্না প্লাবিত কুহেলি পথ বেঁয়ে আবার ফিরে আসে, ছায়া ফেলে তার মনের অন্তরীক্ষে । সে পাশ ফিরে ঘুমুতে চেষ্টা করে। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে জানালা দিয়ে দেখে জুঁই ফুলের গাছটাতে দু’টি ছোট্ট পাখি ঠোঁটে ঠোঁটে যেন কী কথা বলছে । ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে মিহি সুরে ভেসে আসছে অনুরাধা পাড়োয়ালের মেলোডি কণ্ঠ :
“বাঁধিনি হৃদয় পিঞ্জরে রেখেছি মুক্ত করে
যাবেই যদি দূরে পাখি যারে উড়ে
করব না মানা তোরে”
নীলিমার মন ভালো নেই, তবুও চাকরীর খাতিরে তাকে কলেজে যেতে হয়। আজ সে কলেজে পড়াচ্ছে জিনের উপর । ছাত্র- ছাত্রীরা মন্ত্র-মুগ্ধের মতো তার লেকচার শুনছে। জিন হল ক্রোমোজমের সেই একক খণ্ডাংশ যা বংশগতির ধারক ও বাহকের ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ জিন থাকে মানুষের প্রতিটি কোষের ভিতরে অবস্থিত নিউক্লিয়াসের ভিতরকার ক্রোমোজমের মধ্যে। আমাদের শরীরে একশ ট্রিলিয়ন কোষ আছে। প্রতিটি কোষে ক্রোমোজমের সংখ্যা ৪৬টি।
ক্লাস শেষে টিচার রুমের দিকে যেতেই পথের মধ্যে কলেজের দফ্তরী হরে কৃঞ্চঘোষ তাকে থামিয়ে বলল- আপনাকেই খুঁজছিলাম ম্যাড়াম, এই নিন আপনার চিঠি।
নীলিমা চিঠিটা হাতে নিয়েই তাড়াতাড়ি প্রেরকের ঠিকানাটা পড়ে ...
ফয়সাল শাহরিয়ার আকাশ
৪২০ ইওকন ড্রাইভ
ফেয়ারব্যাংকস, আলাস্কা- ৯৯৭০১
ইউ এস এ।
আকাশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিঠি লিখেছে। তাহলে সে বেচেঁ আছে। নীলিমা এ আনন্দ রাখে কোথায়। তার হৃদয়ের আবদ্ধ খাচাঁ থেকে হঠাৎ এক ঝাঁক হংস বলাকা যেন উন্মুক্ত নীল গগনাঙ্গনে উড়াল দিল। সে তাড়াতাড়ি টিচার রুমে গিয়ে দেখে সেখানে ভাইস প্রিন্সিপাল ছাড়া কেউ নেই। নিজের চেয়ারটায় বসে সে আকাশের চিঠিটা পড়তে শুরু করে ...
নীলিমা ;
আমার নিখোঁজ সংবাদে এতদিন যদি তোমার মনের আকাশে কষ্টের নীল মেঘ জমে থাকে এই চিঠি পাওয়ার পর আশা করি তা গলতে শুরু করবে। তোমাকে আমি টেলিফোন করতে পারতাম, ইমেইল করতে পারতাম অথবা ফেসবুকে ম্যাসাজ পাঠাতে পারতাম। কিন্তু টেলিফোন, ইমেইল- ফেসবুকে কি সবকথা বলা যায় ? তাছাড়া কলম দিয়ে মাতৃভাষায় চিঠি লেখার আনন্দটাই তো আলাদা। নীলিমা, আমি সব সময় বিশ্বাস করেছি এই বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, বি এন পি , জাতীয় পার্টি, জামাত কিংবা হেফাজতিদের দেশ নয়, এই দেশ ষোলকোটি মানুষের। আমি ষোলকোটি মানুষের কথাই বলতে চেয়েছি। রাজনীতিক দলগুলো কীভাবে সব মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে , মন্ত্রী, এম পি এবং বিভিন্ন স্তরের নেতারা কীভাবে সরকারী সম্পদ, খাস জমি, বনাঞ্চল, চিংড়িঘের দখল করে নিচ্ছে, প্লট বাগিয়ে নিচ্ছে, পেশী শক্তি প্রদর্শনের জন্য কীভাবে ওরা গুণ্ডাবাহিনী লালন করছে সেই কথাই বলতে চেয়েছি। এজন্য আমাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল। তাই দেশ ছেড়ে গোপনে মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি জমিয়েছি। তবে আমি বিদেশে গাটঁছড়া বাঁধার লোক নই। যেদিন মিড়িয়ার স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে সেদিন অবশ্যই আমি দেশে ফিরে যাব।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী রিয়াজ আলাস্কায় থাকে। আপাতত আমি তার বাসায় আছি। গ্যাস, তেল এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ আলাস্কা পাহাড়, সাগর, নদী এবং অসংখ্য লেক নিয়ে ছবির মতো সুন্দর একটি রাজ্য। বাংলাদেশের কক্সবাজারের সাথে আলাস্কার অনেক মিল আছে। পরিবার প্রতি বার্ষিক এভারেজ আয়ের বিচারে এটা মেরিল্যান্ডের পরে যুক্তরাষ্টের দ্বিতীয় ধনী স্টেট।
নিউইয়র্কে পরিবার প্রতি যেখানে বার্ষিক আয় ৫৫,২৫০ ডলার সেখানে আলাস্কায় পরিবার প্রতি বার্ষিক আয় ৬৮,০০০ ডলার । বাঙালিরা কেনো যে নিউইয়র্কে পড়ে থাকে বুঝি না। আমার বন্ধু রিয়াজ অনেক বছর নিউইয়র্কে ছিল। সে বলল- নিউইয়র্কে বাঙালির সংখ্যা যত বেড়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে তত বেড়েছে সংগঠন, সমিতি, গ্রুপিং, দলাদলি, রেষারেষি আর কাদাঁ ছোঁড়াছুড়ি। তা না হলে যে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে এ প্রবাদটা মিথ্যে হয়ে যেত। সেখানে নাকি কিছু লোক ডলার পেয়ে বড্ড বেয়াড়া হয়ে গেছে। রিয়াজদের গ্রামের কয়েক মাইল দূরে হরিপুর গ্রামের আদ্দু করিম নামের একটা ছেলেকে নাকি সে চিনত যে তার কয়েকজন বখাটে বন্ধুকে নিয়ে গ্রামের বাজারে চাঁদাবাজি করত। পরে কি যেন কি উছিলায় সে যুক্তরাষ্ট্র আসার সুযোগ পেয়ে যায়। মার্কিন পাসপোর্ট এবং কিছু ডলার তার হাতে আসলে সে নিজেকে একটা কিছু ভাবতে শুরু করে। নিউইয়র্কে সে নাকি এখন একটা রাজনৈতিক সংগঠনের আপ্যায়ন করে ! আর একটা এসোশিয়েসনের নাকি যোগাযোগ সম্পাদক ! আগের আদ্দু করিম নামটার লেজে চেীধুরী জুড়ে দিয়ে সে নাকি এখন সংক্ষেপে এ কে চৌধুরী লেখে। হরিপুর গ্রামের আদ্দু করিম আমেরিকা এসে হয়েছে এ কে চৌধুরী।
রিয়াজের কথা শুনে আমি দুঃখের মধ্যেও অনেক হাসলাম এবং তাকে বললাম- তাতে কী? আমাদের গ্রামের চোরা কারবারী, ইয়াবা ব্যাবসায়ী বদর মিয়াও তো গত বছর হজ্জ্ব (!) করে এখন নামের আগে আলহাজ্ব লেখে। বাদ দাও নিউইয়র্কের কথা। আলাস্কাতে সময়টা খুব ভাল কাটছে। রিয়াজ ডাকযোগে “ঠিকানা” নামের একটা পত্রিকা নেয়। দেশের বাইরেও যে বাংলা ভাষায় এ রকম একটা পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা বের হয় তা আমি কল্পনাও করিনি। আজ থেকে কয়েকযুগ আগে এম এম শাহীন নামে এক ভদ্রলোক নাকি এ পত্রিকাটি বের করেছিলেন। পত্রিকাটি বের করে ভদ্র লোক নিশ্চয়ই বাংলা ভাষার অনেক উপকার করেছেন। আজ তিনি যেখানেই থাকুন না কেন তাকে আমি আলাস্কার প্রান্ত থেকে স্যালুট জানাই। গত পরশু পাহাড় ঘেষাঁ একটা লেকে কিছু লোককে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে দেখে শিশু বয়সে যে আমি খুলনার সর্বশ্রদ্ধেয়আধ্যাত্মিক পুরুষ হযরত খান জাহান আলী (রঃ) এর মাজার থেকে মাইল দেড়েক দূরে আমাদের গ্রামের বাড়ির পুকুরটায় ছিপ ফেলে মাছ ধরতাম তা মনের দৃশ্যপটে ভেসে উঠল। খুলনার রূপসা নদী আর সুন্দরবনের যে কল্যাণরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, সেই রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সেই রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত মন্দারের মত চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে।
ঢাকায় পিঁপড়ার মতো মানুষের ভীড়ে, যানজটে, ধূলোবালিতে হাফিয়ে উঠছিলাম। ইচ্ছে ছিল এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে ময়মনসিংহে যাব, ঝিরঝিরে বাতাসে, জোৎস্নালোকিত রাত্রিতে তোমার সাথে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে হাঁটব। তোমাকে নিয়ে গারো পল্লীতে ঘুরব। যদি কোনদিন দেশে ফিরে যাই তবে ময়মনসিংহের গারো, খাসিয়া আর পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তংচংগ্যা এবং অন্যান্য উপজাতিদের সুখ-দুঃখ, জীবন সংগ্রাম নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাব। ষোলকোটি মানুষের বাংলাদেশে শতকরা নিরান্নব্বই জনই তো বাংলাভাষী বাঙালি। যে একভাগ ভিন্নভাষী, ভিন্ন সংস্কৃতির উপজাতি গোষ্ঠী আছে তা আমাদের মূল সংস্কৃতির আবহে যোগ করেছে এক ভিন্ন মাত্রা। বৈচিত্র্য তো সৌন্দর্যের প্রসূতি। সেই সৌর্ন্দয্যকে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। আমার জন্য অপেক্ষা করো না। একটা ভাল ছেলেকে বিয়ে করে সুখী হও। বড় প্রেমতো শুধু কাছেই টানে না , দূরেও ঠেলে দেয়। ইতি, তোমার আকাশ আলাস্কা, যুক্তরাষ্ট্র।
চিঠিটা পড়ে নীলিমার কেমন যেন লাগে। তার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ভাইস প্রিন্সিপালকে বলে সে আজকের মতো ছুটি নিয়ে নেয় । রিক্সা নিয়ে যাওয়ার পথে নীলিমার চোখ পড়ে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের উপর যার পাতাগুলি ক্রমশ লাল হচ্ছে। সেই লাল কৃষ্ণচূড়ার পাতায় মধ্যাহ্নের সূর্য্যকিরণ পড়ে ঝিকমিক করছে। কিন্তু নীলিমা সেদিকে না তাকিয়ে আরো উপরে নীল গগনাঙ্গনের দিকে তাকায় আর ভাবে বাংলাদেশের ময়মনসিংহের উপর যে আকাশ আমেরিকার আলাস্কার উপরও নিশ্চয়ই একই আকাশ। তার মিডল নামটাতো জাহান, যার অর্থ পৃথিবী। বিধাতার অনন্যসাধারণ আর্কিটেকচার পিলারবিহীন এই আকাশ সমগ্র পৃথিবীটাকে ছাঁদের মতো ঢেকে রেখেছে। যখন আকাশকে সে খুব মিস করবে তখন সে পৃথিবীর ছাঁদরূপী ঐ আকাশের দিকেই তাকাবে।
ম্যাসাসুসেটস যুক্তরাষ্ট্র থেকে sauravbelal@gmail.com