যে ধ্রু ব প দ দি য়ে ছ বাঁ ধি
সৈ ক ত আ রে ফি ন
যে ধ্রু ব প দ দি য়ে ছ বাঁ ধি
সৈ ক ত আ রে ফি ন
যে সমুদ্র সবচেয়ে সুন্দর তা আজও আমরা দেখি নি
সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলি আজও আমরা পাই নি
মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই
তা আজও আমি বলি নি।
--নাজিম হিকমত
শিল্প হল সৃষ্টি, পরিবর্তন ও সীমাহীনতার মুখপত্র
রাজশাহীর রোদে ঘুরে ঘুরে শরীর তামাটে করে ফেলার দিনগুলোতে ফিরে গেলে, হেমন্তের ধানখেতের মতন লেপ্টে থাকা পদ্মানদী, দিগন্তে অবতরণশীল আকাশ, আকাশের গায়ে ছবির মত আটকে থাকা শাদা মেঘ ও গোধূলীর হরিদ্রাভা আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যত এক অপার্থিব নৈসর্গকে অবমোচন করে। সেইসব রোদ্দুরদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্যারিস রোডে গগনশিরিষের ফাঁকে ফাঁকে রোদ ঢুকে আলো-ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে আমরা দলবেঁধে চিহ্নআড্ডা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল¬াহ কলাভবনের ১৩০-এ যাই। শহীদুল¬াহ কলাভবন যেন আমাদের তীর্থস্থান। আরো পড়ুন
যে ধ্রু ব প দ দি য়ে ছ বাঁ ধি
সৈ ক ত আ রে ফি ন
যে সমুদ্র সবচেয়ে সুন্দর তা আজও আমরা দেখি নি
সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলি আজও আমরা পাই নি
মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই
তা আজও আমি বলি নি।
—নাজিম হিকমত
শিল্প হল সৃষ্টি, পরিবর্তন ও সীমাহীনতার মুখপত্র
রাজশাহীর রোদে ঘুরে ঘুরে শরীর তামাটে করে ফেলার দিনগুলোতে ফিরে গেলে, হেমন্তের ধানখেতের মতন লেপ্টে থাকা পদ্মানদী, দিগন্তে অবতরণশীল আকাশ, আকাশের গায়ে ছবির মত আটকে থাকা শাদা মেঘ ও গোধূলীর হরিদ্রাভা আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যত এক অপার্থিব নৈসর্গকে অবমোচন করে। সেইসব রোদ্দুরদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্যারিস রোডে গগনশিরিষের ফাঁকে ফাঁকে রোদ ঢুকে আলো-ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে আমরা দলবেঁধে চিহ্নআড্ডা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলাভবনের ১৩০-এ যাই। শহীদুল্লাহ কলাভবন যেন আমাদের তীর্থস্থান। এখান থেকেই আমরা শিখি, কীভাবে সতীর্থের সুখে ও শোকে নিজেকে মেলাতে হয়, বিলাতে হয়, অসংবৃত ভাবনাসমূহকে ঐক্যে বেঁধে একটি আপাততুচ্ছ সরলরেখা হতে আমরা শিখেছিলাম এই আড্ডায় বাক্যরচনা করে; ভয়হীনতার সূত্রকে অগ্রাহ্য করে চিহ্নআড্ডায় নতুনরকমের জলবায়ু প্রচালনা করতে পেরেছিলাম রবিবারের সন্ধ্যায়। তখন ১৩০-এর বাইরে, ক্যাম্পাসের রাস্তায়, কাজলায়, ইবলিশ চত্বরে, লাভ স্কয়ারে, রোকেয়ায়, তাপসির মাঠে মিউনিসিপ্যালেটির নিয়ন আলো জ্বলে ওঠে। ১৩০-এর পর্দা তুলে দিয়ে আমরাও আলো জ্বালি; আসলে আমরা আলো জ্বালি দুটো— একটা ঘরে শাদা টিউব, অন্যটা আমাদের ভেতরে, যেখানে অন্ধকার মধ্যরাত হয়ে ছিল, সেখানে আমরা সবাই এক একটা পিলসুজ-দীপ জ্বালিয়ে দিয়ে ইকবাল স্যারের কথা শুনি। ডক্টর শহীদ ইকবাল তখন একদিন আমাদের বলেন— বাংলা পদ্যসাহিত্যে শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রেরও কিছু অবদান আছে। তখন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথা আমাদের মনে পড়ে। সেইসময়গুলোতে আমরা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসে ডুবে আছি। মানবজমিন, পার্থিব, দূরবীন, পারাপার, যাওপাখি, উজান-এর মত উপন্যাস তখন তৈরি করছে আমাদের সংবেদনশীল মনোজগতকে। ততদিনে আমরা জেনে গেছি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিষ্য এবং সেজন্যেই তিনি তাঁর সব বইয়ের শুরুতে লিখে রাখেন রা স্বা। ডক্টর শহীদ ইকবাল সেই সন্ধ্যায় আমাদের জানান শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রায় ৮৮২৯টি পদ্য লিখে আমাদের সাহিত্যকে একটি স্পিরিচুয়াল তত্ত্বাদর্শে সমৃদ্ধ করেছেন। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরে ১৩০-শহীদুল্লাহ কলাভবনের একটি অপরিসর ঘরের আলোআঁধারীতে বসে শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের পদ্যপাঠের জন্য যখন আমাদের মন উন্মুখ হতে শুরু করে, আমরা বুঝি— শিল্প তাই, যা হয়তো সত্য নয়, কিন্তু সত্য কী, সেই সত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। এবং শিল্প তাই, যা মনকে উসকে দেয়, পরিবর্তন ও সীমাহীনতার অনেকগুলো পথ একসঙ্গে উন্মোচিত করে।
ভালবাসার টান / কর্মে আনে সফলতা / জীবনে উত্থান ।
চর্যাপদের কবি ভুসুকুপাদানাম ‘বাজ ণাব পাড়ী পঁউআ খালেঁ— বলে যে খাল অর্থাৎ নদীটর কথা বলেছিলেন, সেই ভাঙনমুখর প্রমত্তা পদ্মাতীরবর্তী হিমাইতপুর ধামে শুভ তালনবমী তিথিতে যে শিশুটি জন্ম নেয় ১২৯৫ সালের ৩০শে ভাদ্র, তার জন্মের আগেই এক সন্ন্যাসী বলেছিলেন— ‘এমন এক মহান শক্তিমান পুরুষের জন্ম হবে যিনি নিজ চরিত্রবলে জগতের মহামঙ্গল সাধন করবেন’; অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে পিতা শিবচন্দ্র চক্রবর্তী ও মা মনমোহিনী দেবী শিশুটির নাম রাখেন অনুকূল। কালে এই শিশু অনুকূলই হয়ে ওঠেন শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। শৈশবের দুরন্ত অনুকূলের হৃদয় ছিল কোমলতায় ভরা; তিনি মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন ভালবাসার মন্ত্রে। বলেছেন— ‘দেহের রোগ সাময়িক, কিন্তু মনের ব্যাধি মানুষকে বহুদিন কষ্ট দেয়, মনের রোগেরই সমস্ত রোগের আধার।’ শ্রীশ্রীঠাকুর মনের পবিত্রতার কথাও বলেছেন পদ্যে—
মনটা দুষ্ট হলেই জানিস, রোগের আথাল হয়
ঐটাকে তুই এড়িয়ে চলিস, করবি ব্যাধি জয়।
শাসন, তিরস্কার ও উপদেশে যে মানসিক দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে প্রতিনিবৃত্ত করা যায় না, শুধু ভালবাসা আর সহযোগিতাই পারে মানুষকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে, পারে সাফল্যের পথে জীবনকে প্রণোদিত করতে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সেই গভীর কথাটি বললেন সহজ করে, পদ্যে—
ভালবাসার টান
কর্মে আনে সফলতা
জীবনে উত্থান ।
মানুষ আপন টাকা পর / যত পারিস মানুষ ধর।
পুঁথিগত শিক্ষায় শ্রীশ্রীঠাকুর খুব বেশি শিক্ষার সুযোগ পান নি; আর্থিক দীনতা তাঁকে সেই সুযোগ দেয় নি। কিন্তু সহজাত শিক্ষায় শিক্ষিত ও অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ঠাকুর আলোকসম্পাত করেছেন অবিদ্যা ও সংস্কারচ্ছন্ন সমাজের মূলকেন্দ্রে। প্রত্যক্ষ বোধ তাঁকে যে অবস্থানে দাঁড় করায়, সেই অবস্থিতি এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। লক্ষণীয়, সমাজের যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কুসংস্কার ও অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে আছে তাদের জন্য শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কর্মপ্রয়াস আমাদেরকে মানবিক বোধে প্রবুদ্ধ করে। তিনি বলেন— ‘আমি বইটই পড়ি নি। কিন্তু নিজের জীবনে যা অনুভব করেছি সেই দাঁড়ায় ফেলে সব কিছুর মূল স্পন্দনটা যেন ঠাহর করতে পারি।’ শ্রীশ্রীঠাকুর বইয়ের শিক্ষার ভিতর দিয়ে জীবনের বাস্তবতাকে দেখেন নি বলেই, অর্থবিত্তের চেয়ে, প্রতিপত্তির চেয়ে মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস যেমন বলেছিলেন— ‘শুনহ মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই’; যদিও চণ্ডীদাসের সেই মানুষ ছিল মনের মানুষ, সচরাচর স্বাভাবিক মানুষ থেকে সেই মানুষ পৃথক; কাজী নজরুল ইসলামও মানুষের এই মহত্বের কথা আমাদের শুনিয়েছেন ‘মানুষ’ কবিতায়— ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান! নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/ সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জাতি।’ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রও তাঁর আশ্রমিকদের বলেন—
মানুষ আপন টাকা পর
যত পারিস মানুষ ধর।
বাস্তব মানুষের জীবন বাস্তবতাও কখনও কখনও জটিল হতে পারে। জটিল মানে, মানুষ শুধু মনুষ্যত্বেই সবসময়ই স্থির থাকে না, তার মধ্যে কখনও কখনও মাথাচাড়া ওঠে পশুসত্তা। কিন্তু বাহ্যভাবে মানুষকে নির্ভুল সনাক্ত করতে পারা তত সহজ নয়। পদ্যবাণীতে শ্রীশ্রীঠাকুর তাই বলেন—
টাকা রেখো গুণে গুণে
মানুষ নিও চিনে-শুনে।
ঝোঁক না বুঝে শিক্ষা দিলে / পদে পদে কুফল মিলে
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘চিত্ররূপময়তা’র কবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশের কাব্যরচনার কথা আমরা জানি। ‘আমাদের দেশে হবে/ সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে/ কাজে বড় হবে’ —কুসুমকুমারী দাশের এই কবিতা আমাদের কাজে বড় হবার প্রাণনা দেয়। ঠাকুর জননী মনোমোহনী দেবীর কাব্যপ্রয়াসের কথাও কেউ কেউ জেনে থাকবেন। তিনি লিখেছিলেন—
অকূলে পড়িলে দীনহীন জনে,
নুয়াইও শির কহিও কথা।
কূল দিতে তাতে সেধো প্রাণপণে
লক্ষ্য করি তার নাশিও ব্যথা।
মাতৃদেবীর দীনহীনে দয়া করার এই উপদেশবাণী যেমন আমাদের সকলকে মানবিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ করে তেমনি এই কবিতার প্রতিটি লাইনের প্রথম বর্ণ নিয়ে যে নামটি হয়, অনুকূল; সেই সন্তানের প্রতি মায়ের উপদেশও বৃথা যায় নি। জীবনের নিষ্করুণ বাস্তবতায়, প্রতি কর্মপ্রয়াসে তিনি প্রমাণ করেছেন মা মনমোহিনী দেবীর কবিতার সার্থকতা। মায়ের আশীর্বাদধন্য অনুকূল ক্রমে হয়ে উঠেছেন মানবপ্রেমিক শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল। তিনি যেমন মাকে ভালবাসতেন, তেমনি ভালবাসতেন বাংলাকেও। বঙ্গভূমির প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা শ্রীশ্রীঠাকুর গোপন করেন নি। বলেছেন— ‘কত ভাগ্যে সোনার বাংলার জন্মলাভ করেছি, ইচ্ছা করে এর ফল-জল, আলো-হাওয়া, খাদ্য-খাওয়া, স্নেহ-প্রীতি, প্রাকৃতিক মাধুর্য প্রাণভরে উপভোগ করি। বাঙালির মহৎ কিছু দেবার আছে জগতকে। বাংলা জাগবে...জগৎ জাগবে।’ বাঙালির জাগানোর প্রয়াসে তিনি শিশু শিক্ষার প্রতি দিয়েছিলেন সবিশেষ গুরুত্ব। শিশুর আত্মবিকাশের জন্যে তিনি শিশুর আগ্রহের মূল প্রবণতা আবিষ্কারের কথাও বলেছিলেন এভাবে—
ঝোঁক না বুঝে শিক্ষা দিলে
পদে পদে কুফল মিলে।
বর্তমানে, মনোবিজ্ঞানীরা যখন নানারকম গবেষণা করে বলতে পারছেন শিশু মনস্তত্ত্ব, আবিষ্কৃত হচ্ছে শিশুর বিকাশের সূত্র, সেসব বহু আগে, শ্রীশ্রীঠাকুর গবেষণা ছাড়াই, প্রত্যক্ষবোধে বলেছেন পদ্যের মাধ্যমে—
শিশু যখন আধবুলিতে
যে লক্ষ্যেতে যা যা কয়—
তা না বুঝে চাপান কথায়
আনেই বোধের বিপর্যয় ।
শিশুকে কখনও শাসনের নামে নির্যাতন না করে, ভালবাসলে; ভর্ৎসনার বদলে উৎসাহ দিলে যে শিশু কাজেকর্মে অনুপ্রাণিত হয়, সেকথাটিও শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেছেন সহজ সরল ছন্দে—
ভাল কিছু করতে গিয়ে
আসে যদি হটেই ছেলে
এমনি করেই উস্কে দিবি
বাহবা নিতে করেই ফেলে।
তবে, শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের জন্য সুন্দর পরিবেশের অনিবার্যতা অস্বীকার করা যায় না। অস্বাস্থ্যকর ও অশ্লীল পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ায় শিশুর সুন্দর মনোদৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সুস্থ পারিবারিক আবহ শিশুকে যথাযোগ্য মানুষ করে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে ঠাকুরের পদ্যউপদেশটি মনে রাখলে আমাদের সকলেরই লাভ—
নিজ অভ্যাস ব্যবহার ঘৃণ্য রেখে যদি
সন্তানের হতে ভাল বলিস নিরবধি
উল্টো হবে পারবি না তা ক্ষোভে ভরবে মন
অভ্যাস আর ব্যবহারে থাকিস সচেতন।
সুস্থ ও মধুর দাম্পত্য সম্পর্ক পারিবারিক সুখের উৎসকেন্দ্র। দাম্পত্য সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটলে, সংসারে সমূহ বৈনাশিকতা ছায়াপাত করে। তাতে জীবনে উদ্ভুত হয় চরম বিপর্যয়। এই বিপর্যয় এড়িয়ে চলার জন্য ঠাকুর সাবধান করেছেন এ বলে—
স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া করে ছেলে-পুলেয় দেখে
গোল্লায়েরই সদর দ্বারে বাছাগুলোয় রাখে ।
অভ্যাস, ব্যবহার ভাল যত / শিক্ষাও তার জানিস্ তত
শিক্ষা এমন এক ব্যবস্থাপনা যার মাধ্যমে একজন মানুষের সুষম বিকাশ সম্ভব হয়। মানবসভ্যতার উৎকর্ষও রচিত হয় শিক্ষার মাধ্যমেই। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের ভাষায়—‘শিক্ষা তাই যা মানুষকে স্ববৈশিষ্ট্য ও সহজাত সংস্কারের উদ্বোধনায় বোধি ও ব্যক্তিত্বে একটা সহজ মানুষে পরিণত করে তোলে।’ এই সহজ মানুষের সঙ্গে বাউলকবি ফকির লালন শাহের ‘সহজ মানুষের’(সহজ মানুষ ভজে দেখ নারে মন দিব্যজ্ঞানে) সমরূপতা হয়তো নাই, এ সহজ দৃশ্যত সারল্যকেই প্রতিচিত্রিত করে। কবি নির্মলেন্দু গুণ যেমন বলেন—‘আনন্দ সহজ নহে, বেদনা সহজ নহে/ বিরহ সহজ সহে, মিলন সহজ নহে।/ কী তবে সহজ?’(কিছুই সহজ নহে : অচল পদাবলী) বস্তুত ঠাকুর অনুকূল শিক্ষালব্ধ যে সহজ মানুষের কথা বলেন সেই সহজাত সহজতা আসে সুশিক্ষার মাধ্যমেই। গ্রন্থবিদ্যা শুধু ডিগ্রি অর্জনে সীমায়িত হলে তা দিয়ে সমাজমানুষের কোন কল্যাণসাধন হবে না। ঠাকুর বলেন—
বই পড়ে তুই হলি যে বই
বইয়ের নিদান ধরলি না,
ধরে ধরে না চললে কি
জাগবে বোধের নিশানা? ’
আবার যে শিক্ষা মানুষকে মানুষ বলে শ্রদ্ধা করতে শেখায় না, অবমানিতের বেদনাবোধ উপলব্ধি করাতে ব্যর্থ হয়, বাহ্যিক বেশভূষায় ও মুখের কথায় গণ্ডীবদ্ধ হয়ে পড়ে তার কোন দাম ঠাকুরের কাছে নাই—
মুখে জানে ব্যবহারে নাই
সেই শিক্ষার মুখে ছাই।
অন্যত্র তরুণ সম্প্রদায়ের উদ্দেশে ঠাকুরের উপদেশ—
১. শিখলি যে তুই কত শত, বোধ তো কিছুই ফুটলো না,
স্মৃতির বলদ হলি শুধু , এক মুঠো ভাত জুটলো না !
২. বই পড়ে তুই হলি যে বই, বইয়ের নিদান ধরলি না,
ধরে ধরে না চললে কি, জাগবে বোধের নিশানা? ’
কেন পদ্য
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাই যে শ্রীশ্রীঠাকুরের আরাধ্য ছিল এ আমরা জানি। তাঁর মনন ও চিন্তাকেন্দ্র জুড়ে ছিল বিশ্ব মানবতার সমূহ কল্যাণ। এজন্য, মানুষকে কল্যাণের পথে প্ররোচিত করার জন্য ঠাকুর অনুকূল আশ্রয় নিয়েছিলেন ছন্দের। ছন্দযুক্ত পদবন্ধ যে মানুষকে সহজে আকৃষ্ট করতে পারে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের দিকে তাকালে সেই সত্যটিই আমরা উপলব্ধি করি। গোটা মধ্যযুগ জুড়ে ছন্দবদ্ধ কাব্য সাহিত্য আমাদের চেতনাকে অধিকার করে রেখেছিল। কিন্তু আধুনিক যুগের কবিতা সাহিত্যের সঙ্গে এই কাব্যধারার একটা দৃশ্যগ্রাহ্য পার্থক্য রয়েছে। ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ থেকে শুরু করে বাঙালি কবি বুদ্ধদেব বসু পর্যন্ত যাঁরাই কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, সবচেয়ে শুদ্ধ সাহিত্য হল কবিতা। আর বলা বাহুল্য, শুদ্ধ সাহিত্য ইঙ্গিতমাত্র দেয়, আঙুল তুলে নির্দেশ করে না এমন কি ছড়াও তাই করে। ছড়াকে চিত্রশিল্প ও সঙ্গীত শিল্পের দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । লোকসাহিত্য সংক্রান্ত বিভিন্ন রচনায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে আমরা দেখেছি ছড়াকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিচারের জন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। মুহম্মদ এনামুল হক সুকুমার সেনের মতো ছড়ায় লোকসাহিত্যের প্রাচীন রূপের সন্ধান করেছেন। ডাক ও খনার বচন এবং মন্ত্রের সাথে ছড়ার পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে তিনি তাঁর মণীষা-মঞ্জুষা গ্রন্থে মন্তব্য করেন যে—‘ছড়ায় উপদেশ নাই, চিত্র আছে।’ কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা গ্রন্থে সৈয়দ আলী আহসান লোকসাহিত্য প্রসঙ্গে ছড়া-নির্মাণের পদ্ধতিকে অসচেতন প্রয়াস বলে মন্তব্য করেন যে, ‘সচেতন বুদ্ধির কুশলতায় ছড়াগুলো নির্মিত হয়নি-এগুলো অপরিমিত অবকাশের আনন্দ সঞ্চয়।’ নীলরতন সেন ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সঞ্জীব সরকার সম্পাদিত লোকায়ত সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিত ও রূপরেখা সংকলনে লোককাব্যের ছন্দ বিষয়ে বলতে গিয়ে ছড়ার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন— ছড়ায় আবৃত্তির সুর বা গীতের পঠন ভঙ্গি থাকায় তা ঝোঁকালো, সুরাশ্রয়ী এবং উচ্চারণে দ্রুত সংকোচন-বিবর্ধন মাত্রিক। স্বভাব আবৃত্তির ব্যত্যয় এতে বাঞ্ছনীয় নয়।’
ছড়া আবৃত্তি বা ধ্বনিনির্ভর, ছড়ার সুর একটানা বৈচিত্র্যহীন। ছড়ার বিষয়বস্তু উদ্ভট, অসঙ্গত, অন্যদিকে এমনকি শিশুতোষ কবিতার বিষয়বস্তুও সাধারণত সুসঙ্গত হয়ে থাকে। ছড়ার আকার হ্রস্ব, ছন্দ শ্বাসাঘাত প্রধান প্রাকৃত বাংলা ছন্দ অর্থাৎ স্বরবৃত্ত। এর পরিণতিও আকস্মিক।
ফলত, কবিতার শুদ্ধতা ও ছড়ার বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে আমরা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের নীতিকথা জাতীয় ছন্দশীল পদবন্ধগুলোকে যেমন কবিতা বলতে পারি না, তেমনি একে ছড়া বললেও যথার্থ বলা হয় না। এজন্য, কবিতা ও ছড়া শিল্পের মধ্যবর্তী একটা অবস্থানে ঠাকুর সাহিত্যচর্চাকে প্রচিহ্নিত করা যায়। মধ্যবর্তী এই অবস্থানকে পদ্য নামে নির্দিষ্ট করলে সম্ভবত, দ্বিমত করার সুযোগ খুব বেশি থাকে না। বিভিন্ন প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র আশ্রমিকদের জন্য যে পদ্য রচনা করেছিলেন তার কিছু উদাহরণ সন্নিবেশ করা যায় :
ধর্ম বিষয়ক
১. ধর্মে সবাই বাঁচে-বাড়ে সম্প্রদায়টা ধর্ম নারে ।
২. ধর্মে জীবন দীপ্ত রয়, ধর্ম জানিস্ একই হয়।
কৃষি বিষয়ক
১. ক্ষেতের গুণে বীজের বাড়
যেমনি বীজ তেমনি ঝাড়।
২. চোত-বোশেখের মাঝখানে র্ক
আশুব্রীহির বপন শেষ
খরা ঝরা হোক না যেমন
প্রায়ই ফসল পাবি বিশেষ।
৩. উর্বরা নয় ক্ষেতটি যেথায়
সুবীজও কি ফলবে সেথায়?’
৪. জমিজমা কৃষিভরা ধান্য-গোধুম-শালী
প্রলয়েও সে নষ্ট না পায়, যাপে স্বজন পালি।
শিক্ষক বিষয়ক
১. চরিত্রহীন শিক্ষক, ছাত্রের জীবন ভক্ষক।
২. শিক্ষকদের প্রতিপালন ভার
গ্রামের কিন্তু নেওয়া ভাল,
নইলে শিক্ষক চাকুরি বশে
হয়ে উঠে ক্রমেই কালো।
৩. শিক্ষকের নাই ইস্টে টান
কে জাগাবে ছাত্র প্রাণ
থাকলে ছাত্রের ইস্টে টান
তবেই জাগে করার প্রাণ।
পিতামাতাভক্তি বিষয়ক
১. মাতৃভক্তি অটুঁট যত, সেই ছেলে হয় কৃতি তত।
২. পিতায় শ্রদ্ধা মায়ে টান, সেই ছেলে হয় সাম্যপ্রাণ।
৩. বিদ্যাসাগর, স্যার আশুতোষ, কোথায় পেলেন শক্তি?
দেখ্ না চেয়ে তার পিছনে, আছেই মাতৃভক্তি।
ব্যবসা বিষয়ক
১. মূলধনে দিলে হাত
ব্যবসা হবে চিৎপাত।
২. দোকান করিস্ দোকানদার!
রাখিস্ নিপুণ সদ্-ব্যবহার,
লাভের অর্ধেক পেটে খাবি-
এই নিয়মে চলতে থাকবি,
মনে রাখিস— রাখিস্ নে দেনা—
বাঁচার পথে বিষম কাঁটা
বিশেষ করে জানিস সেটা।
চিকিৎসা বিষয়ক
১. চিকিৎসাতে চাস্ যদি তুই, আত্মপ্রসাদ টাকা,
টাকার পানে না তাকিয়ে তুই রোগীর পানে তাকা।
খাবার বিষয়ক
১. টক দই কিন্তু নেহাৎ ভাল, ঝোলাগুড়ে খাস্ যদি,
অনেক বালাই দূর করে এই প্রাচীন নীতি টক দধি।
২. খাবার পাতে শেষ কালেতে, খাস্ যদি তুই নুনে-টকে,
অনেক আপদ কাটবে তাতে, জানে অনেকে ঠকে-ঠকে।
উপদেশ বিষয়ক
৩. উপদেশ তুই দিস্ না যতই
উদাহরণ হ’ আগে,
সঞ্চারণায় দীপ্ত করিস্
তৃপ্ত দীপন রাগে।
সাহিত্যের গন্তব্য মানুষ
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র যে শুধু শিষ্যদের ছন্দবদ্ধ পদাবলির উপদেশ বিলিয়েছেন তা নয়, নিজের জীবনে তা প্রতিপালন করে দেখিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও।’ পদ্যের সাহায্য নিয়ে ঠাকুর ভক্তদের যেমন অনুপ্রাণিত করেছেন, তেমনি তাঁর কাছে প্রাণিত হতে এসেছেন অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কথাসাহিত্যিক বিমল মিত্র, কবি বন্দে আলী মিয়া প্রমুখ। ১৩৩২ সালে যখন শরৎচন্দ্র ঠাকুরের আশ্রমে আসেন, শরৎচন্দ্রের লেখায় বিয়োগাত্মক পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে বলেন—‘ ...‘সমাজ পঁচে গিয়েছে সত্য কিন্তু তাই বলে আমরা যদি দুঃখের চিত্র, হতাশার ছবি, বিকৃত মনস্তত্ত্বের অভিব্যক্তি তুলে ধরি তবে কারো কোন উপকারই আমরা করতে পারি না। সাহিত্যিকের দায়িত্ব গঠনমূলক চিত্র তুলে ধরা, যার ফলে তারা হতাশার মধ্যে আলো ও দুঃখের মধ্যেও পায় শান্তির ইঙ্গিত। বাস্তববাদের সঙ্গে যদি আদর্শবাদের সমন্বয় না থাকে তবে কোন সুফলই হবে না। আদর্শ চরিত্র রূপায়ণ করলে তা থেকে মানুষ পাবে উদ্দীপনা— বাস্তব অসুবিধা এবং ভাগ্যবিপর্যয়কে প্রতিহত করে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে। সাহিত্যিক যদি পাঠকের মনে ভরসার সৃষ্টি করতে না পারে, কল্যাণের ইঙ্গিত দিতে না পারে তবে সে সাহিত্যের মূল্য কতটুকু?’ উনিশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সাহিত্যে যে সাহিত্যতত্ত্বের উদ্ভব হয়েছিল—‘শিল্পের জন্য শিল্প’ না ‘মানুষের জন্য শিল্প’—এই তত্ত্ববাজির বহুদূরে অবস্থান করেও শ্রীশ্রীঠাকুর ঠিকই বুঝেছিলেন সাহিত্যের লক্ষ্য শেষপর্যন্ত মানুষই হওয়া উচিত। ১৩৬৮ সালে বিমল মিত্রের সঙ্গে দেওঘরে যখন ঠাকুরের দেখা হয়েছিল, তখন জড়বিজ্ঞানের যুগে প্রায় অপসৃয়মান, ঠাকুরের প্রেমময় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। সেদিন দেওঘরের বিপুল জনারণ্যে বিমল মিত্র ভাবাকুল হয়ে বলেছিলেন—‘স্বামী বিবেকানন্দ এমন একজন লোক পেয়েছিলেন যাকে বলতে পারতেন— তোমার পায়ে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত হলাম— এখানে আমি এই প্রথম এলাম, এঁদের দেখে মনে হচ্ছে এঁরা এমন একজন মানুষ পেয়েছেন যাঁর উপর নির্ভর করে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।’কবি বন্দে মিয়া তো শ্রীশ্রীঠাকুরের শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন। কবির ভাষায়—‘তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে থেকে আমি আত্মোপলব্ধির চেতনা লাভ করেছি। আশ্রমের পত্রিকা ‘সৎসঙ্গী’র সম্পাদকও ছিলেন কবি বন্দে আলী মিয়া।
লেখাটি শেষ করার আগে ফিরতে চাই এর শীর্ষদেশে, নাজিম হিকমতের কবিতায়—‘যে সমুদ্র সবচেয়ে সুন্দর তা আজও আমরা দেখি নি/ সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলি আজও আমরা পাই নি/ মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই/ তা আজও আমি বলি নি’— বলা বাহুল্য আমরা সেই নিবিড় সৌন্দর্যের কাছে নিশ্চিত করেই পৌঁছতে চাই। এক্ষেত্রে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জীবন ও পদ্যসাহিত্য আমাদের সকলের জন্য প্রণোদনার উৎস হতে পারে। ঠাকুর যে ধ্রুববাণী আমাদের জন্য রেখে গেছেন আমরা যেন তা ধারণ করতে পারি।