‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ : গদ্য-ভাবনার প্রবন্ধ
‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ : গদ্য-ভাবনার প্রবন্ধ
সৌমিত জয়দীপ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আগে কলকাতার আশুতোষ কলেজে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তিনদিনব্যাপী 'সর্বভারতীয় প্রগতিশীল লেখক-সম্মেলন'। এসব আয়োজনে সাধারণত বিভিন্ন অধিবেশনে বিভিন্নজন সভাপতিত্ব করেন। সেই সম্মেলনের তিন নম্বর
সভাপতি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। সভাপতিত্বের ভাষণটা তিনি দিয়েছিলেন ইংরেজিতে। বাংলায় দেওয়ার সুযোগও ছিল না। যেহেতু সর্বভারতীয় আয়োজন। এক স্থানে তিনি
বলেছিলেন : 'দ্য এজ অব রবীন্দ্রনাথ ইস ওভার'। পরে, 'অমৃতবাজার' কথাটাকে
শিরোনাম করে বিতর্ক উস্কে দেওয়ার গণমাধ্যমীয় দায়িত্বটা সম্পন্ন করেছিল!
বুদ্ধদেব বসু ত্রিশের দশকের কবি। তাঁর 'রবি-এজ ওভার' ঘোষণার খাঁটি কারণ
আছে। ত্রিশের পঞ্চপাণ্ডব -- জীবনানন্দ-বিষ্ণু-সুধীন্দ্রনাথ-অমিয়-বুদ্ধদেব
-- তাঁদের কবিতার বারান্দায় খুঁটির গাঁথুনি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ নামক
শক্তিশালী-স্থিতিশীল খুঁটিকে অতীত জ্ঞান করে। রবীন্দ্র বলয়কে তাঁরা
অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বুদ্ধদেবকে এক চিঠিতে
জানাচ্ছেন : 'সুধীন্দ্র দত্তের কবিতার সঙ্গে প্রথম থেকেই আমার পরিচয় আছে
এবং তার প্রতি আমার পক্ষপাত জন্মে গেছে। তার একটি কারণ, তাঁর কাব্য
অনেকখানি রূপ নিয়েছে আমার কাব্য থেকে -- নিয়েছে নিঃসঙ্কোচে -- অথচ তার
প্রকৃতি সম্পূর্ণ তাঁর আপন।' সুধীন্দ্রনাথের এইটুকু মিল-অমিল বাদে এবং
অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব থাকার পরও, কারোরই
রবীন্দ্রনাথীয় কাব্যজগত ছিল না। তথাস্তু!
রবীন্দ্রনাথ তাতে ব্যথা পেয়েছিলেন বলে শোনা যায়নি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
সবকিছুই বাঁক নেয়। বাংলা কবিতাও নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মতো পণ্ডিতের তা
বুঝতে না পারার কথা না। সে-ই তিনিই কিনা ব্যথা পেলেন বুদ্ধদেবের ঐ কথায়!
আর বুদ্ধদেবকেও তাঁর স্মৃতিকথা 'আমাদের কবিতাভবন'-এ লিখতে হল : 'শুনেছি
রবীন্দ্রনাথও ব্যথিত হয়েছিলেন কথাটা শুনে; তিনি কি জানতেন না ঘোষণাকারীর
এক দণ্ড রবীন্দ্রনাথ বিনা চলে না?' কী বিপদ! মান-অভিমানের খেলা!
তবে, কোন কথাই ভুল বলেননি বুদ্ধদেব। দুটোই সর্বসত্য। আজকের দিনে তো
আমাদেরও বলতে পারা উচিত 'দ্য এজ অব জীবনানন্দ, ইভেন শামসুর রাহমান, আল
মাহমুদ, ইভেন সৈয়দ হক ইস ওভার।' কেন উচিত? কারণ, দেখা যাচ্ছে, বাংলা
সাহিত্যে কবিতার-কবি দুর্লভ হয়নি এখনও। কবিতা হয়ে ওঠার মতো কবিতা,
হৃদয়গ্রাহী কবিতা অনেকেই লিখছেন, লিখেছেন তো। ফলে, রবীন্দ্রনাথ যদি সে
যুগে 'বাসি' হতে পারেন, তো এ যুগে তাঁর বহু-পরবর্তী সময়ের কবিরাও 'বাসি'
হতে বাধ্য। শুধু বুদ্ধদেবের মতো হুঙ্কার দিয়ে বলা দরকার কথাটা। কিন্তু,
বুদ্ধদেবের দ্বিতীয় কথাটা কি প্রথমটার সাপেক্ষে সাংঘর্ষিক বা 'ঠেলা
সামলানো'র মতো মনে হচ্ছে? ভুল তিনি বলেননি-- সেটা বিবেচনা করেও কি এমন
মনে হচ্ছে?
বন্ধু উন্মেষ ও আমি আলোচনা করছিলাম ব্যাপারটা নিয়ে। আমাদের কাছে
রবীন্দ্রনাথ বরাবরই বুদ্ধদেবের দ্বিতীয় কথাটার মতো। কিন্তু প্রথম কথাটার
ব্যাপারে আমাদের পঠন-পাঠন-লেখনের সিদ্ধান্ত এই যে, রবীন্দ্রনাথের কালিক
গুরুত্ব, ঐতিহাসিক গুরুত্বের পুরুত্ব আসলে সেই সময়েই শেষ হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু যে গুরুত্ব চিরঅমলিন, বলা যায় প্রায় অমোঘ, যে গুরুত্বের জন্য
বুদ্ধদেবের দ্বিতীয় বচনটা প্রায় অমরত্বের দাবিদার, সেই গুরুত্ব আসলে
সামাজিক-সাংস্কৃতিক। এই গুরুত্বই রবীন্দ্রনাথকে সর্বকালিক করে দিয়েছে।
আমরা আসলে রবীন্দ্র-বলয়েই ঘুরছি -- এটা অস্বীকার করতে গেলেই ভাইভা
অত্যাসন্ন!
এই তো মাত্র কয়েকদিন আগে সৈয়দ শামসুল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন --
রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে সম্ভবত মনের মতো কথা অনেকদিন পর শুনলাম; আমি দিব্য
জ্ঞান করি, রবীন্দ্রনাথ ব্যতিত আমরা আজোব্দি ভাষার এই স্তরে আসতে পারতাম
না -- 'তিনি ভাষার সবচেয়ে বড় কারিগর। এত বড় কারিগর, ভাষার কারিগর আমাদের
ভাষায় আর আসেননি। সেই কারিগরের কাছ থেকৈ তার কারিগরি দিকটা আমি পাই, নিই,
দেখি এবং বুঝে দেখার চেষ্টা করি এবং আমি কী করছি তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার
চেষ্টা করি।'
সাহিত্যই যেহেতু ভাষার বাঁক তৈরি করে দেয়, ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে সেহেতু
একজন সাহিত্যিক হিসেবে, ভাষাশিল্পী হিসেবে সৈয়দ হকের কথার নিশ্চয়ই
গুরুত্ব আছে। সে কারণে ঐ সাক্ষাতকারেই বিধৃত তাঁর আরেকটি কথা উদ্ধৃত না
করে পারছি না-- কথাটা গদ্য প্রসঙ্গে -- 'গদ্যের খুব খারাপ অবস্থা
বাংলাদেশে। খুব খারাপ অবস্থা। আর গদ্য তো কেবল সাহিত্যে কেন সারা দিন
সারাজীবন ভরেই দেখ না, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখ না, গদ্যের খুব খারাপ
অবস্থা। বাংলা রাষ্ট্র ভাষা জন্য রাজপথে রক্ত দিয়েছি, বড় বড় কথা বলি-
শব্দ ব্যবহারে অসচেতনতা। যারা সৃজনশীল গদ্য লেখক তাদের গদ্যে আমি দেখতে
পাই অমনোযোগিতা। পদবদ্ধ, বাক্যের পর বাক্যে যে একটা স্পন্দন তৈরি হয়-
কোথায়? পাই না।'
সৈয়দ হকের কথায় একটা হাহাকার! প্রলাপ-অপলাপ নয় মোটেও। গদ্যে আমরা পিছিয়ে
পড়েছি। আমাদের গদ্যশৈলী যাচ্ছেতাই। শৈলী বলি কী! কোন শৈলীই নেই। কারও কোন
ছাঁচ দাঁড়ায়নি। এজন্যই বলছিলাম, আমরা তো অনেক কবি পাচ্ছি, দাপটের সঙ্গে
অমুক-তমুকের এজকে ওভার করে দিতে পারব বলেই মনে হয়। কিন্তু, নব্বই পরবর্তী
সময়ে আমাদের গদ্যশিল্পী কয়জন? গল্পকার কয়জন? ঔপন্যাসিক কয়জন? তুলনায়
দেখুন, কবি কতজন! তাহলে কি কবিতা লেখা সহজ? গদ্যলেখা এত কঠিন! আসলেই কি
কবিতা লেখা সহজ? সহজ হয়তো। ছোটবেলায় তো ঐ রবীন্দ্রনাথের মতো করেই
ছন্দ-অন্তানুপ্রাস মিলিয়ে মিলিয়ে জমিয়ে জমিয়ে 'পদ্য' লেখার কম চেষ্টা কি
করিনি আমরা! কিন্তু পরে দেখা যায়, কবিতার-কবি পাওয়া সহজ না! তাই কবিতা
লেখাও সহজ না। গদ্যের গদ্যকার পাওয়া, শব্দকে নিয়ে খেলার মতো গদ্যশিল্পীর
আজ আকাল। গদ্য লেখা কত সহজ!
রবীন্দ্রনাথ পড়তে পড়তে ভাবি, ছোটবেলায় তো রবীন্দ্রনাথের মতো করেই
ছন্দ-অন্তানুপ্রাস মিলিয়ে মিলিয়ে জমিয়ে জমিয়ে 'পদ্য' লেখার কম চেষ্টা কি
করিনি আমরা! কিন্তু পরে দেখা যায়, কবিতার-কবি পাওয়া যাওয়া না! ঠিক তেমনই,
গদ্যের গদ্যকার পাওয়া, শব্দকে নিয়ে খেলার মতো গদ্যশিল্পীরও আজ আকাল। অথচ
আমরা ভাবি, গদ্য লেখা কত সহজ! বাংলা গদ্যের আকালের কথা মনে হলেই
রবীন্দ্রনাথের ঐ গানটা উঁকি দেয় : মাঝে মাঝে তব দেখা পাই/ চিরদিন কেন পাই
না'!
(চলবে…)