টিনের তলোয়ার নাটকের ঐতিহাসিক ও ভাবগত বিভ্রাট
টিনের তলোয়ার নাটকের ঐতিহাসিক ও ভাবগত বিভ্রাট
মোহাম্মদ আজম
টিনের তলোয়ার উৎপল দত্তের সেরা নাটক, আর বাংলা নাট্যজগতেরও অন্যতম প্রধান কীর্তি—নাটকটি সম্পর্কে দর্শক-পাঠক-সমালোচকের এই সিদ্ধান্তে অসম্মতির কোনো কারণ নাই। নাট্যকার নিজে নিজের পরিচয় দিতেন‘প্রপাগান্ডিস্ট’ বলে। সেই প্রপাগান্ডা এই নাটকেও আছে। কিন্তু প্রচারণার জন্য যে সামগ্রিক শিল্পভাষা এ নাটকে প্রাণ পেয়েছে, তার তুলনা বাংলা সাহিত্যে বোধকরি দ্বিতীয়টি নাই। নাটকটি শুরু হয়েছে শ্রেণিচেতন সংলাপমালায়, আর শেষ হয়েছে জাতীয়তাবাদী অনুপ্রেরণায়। নাটকের প্রেক্ষাপট ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের এক তুঙ্গ মুহূর্ত। ব্রিটিশরা তখন প্রধান শোষক-পক্ষ, আবার জাতীয়তাবাদী সংগ্রামেরও প্রধান প্রতিপক্ষ। ফলে শোষণ আর বিদেশি শাসনকে মিলিয়ে পড়া সম্ভব ছিল। উৎপল দত্ত যথাসম্ভব নিপুণভাবে কাজটা করেছেন।
কাজের ক্ষেত্র হিসাবে তিনি খোদ নাট্যমঞ্চকেই বেছে নিয়েছেন। সেখানে বাংলা নাটকের ইতিহাসের এক
গুরুত্বপূর্ণ পর্ব আর নাটক সম্পর্কে নাট্যকারের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। শ্রেণি-রাজনীতির জন্য দরকার অগ্রপথিক—ভ্যানগার্ড। দরকার এমন মানুষ, যারা কোনো-না-কোনো মাত্রার শ্রেণিচ্যুতি ঘটিয়ে শোষিত মানুষের দুস্থতাকে নিজের করে অনুভব করতে পারবে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্যও দেশ ও দশের সাথে একাত্মতার বোধ জরুরি। টিনের তলোয়ার নাটকে এই দুই দায়িত্বই পালন করেছে
একজন — প্রিয়নাথ। সে নিজে নাট্যকার হওয়ায় তার পক্ষে নাট্যমঞ্চে সক্রিয় হতেও কোনো অসুবিধা হয়নি। তার প্রতিপক্ষও বড্ড বেশি রকমের স্পষ্ট: বড় পরিসরে শাসক-শোষক ইংরেজ আর ছোট কিন্তু অপেক্ষাকৃত কার্যকর পরিসরে দেশীয় মুৎসুদ্দি ওরফে বাবুসমাজ।
কোন ভাবের বশে প্রিয়নাথ এই তিন বড় দায়িত্ব স্বাচ্ছন্দ্যে পালন করে, সে সম্পর্কে নাট্যকার বাড়তি বাক্যব্যয়ের দরকার বোধ করেননি। একটি পরিচয়ই যথেষ্ট গণ্য হয়েছে: প্রিয়নাথ একজন ডিরোজিয়ান, একজন ইয়ংবেঙ্গল। মুশকিল হল, যে ধরনের অনুমান থেকে নাট্যকার ডিরোজিয়ান আর বাবুসমাজের ভাগাভাগিটা করলেন, যেভাবে ইয়ংবেঙ্গলকে টেনে নিয়ে গেলেন ১৮৭৬ পর্যন্ত, উনিশ শতকের উপনিবেশিত বাংলার ইতিহাসে তার সমর্থন মেলে না। শিল্পকর্মের ঐতিহাসিক বিবৃতি ইতিহাসের তথ্য-উপাত্তকে হুবহু অনুসরণ করবে—এমন ফতোয়া বিপজ্জনক। তাই এ নাটকের ঐতিহাসিক গোলমালকে আমলে না আনলেও চলত। কিন্তু টিনের তলোয়ার নাটকের ঐতিহাসিক বিপত্তি একরাশ ভাবগত বিপত্তির কারণ হয়েছে। বলা দরকার, আলো-ভালো-উন্নতি-মুক্তির যেসব ধারণায় ভর করে এ নাটকের শ্রেণি-রাজনীতি আর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম দাঁড়িয়েছে, উপনিবেশিত ইতিহাসতত্ত্বের ঔরসেই সেগুলোর জন্ম।
১
টিনের তলোয়ার নাটক যেসব কারণে গুরুত্বপূর্ণ, তার একটা কাজ-চলতি ফর্দ প্রথমেই পেশ করা যাক।
এক. নাটকের কাহিনিটি বেশ জমজমাট। কাহিনির এই জমানো ভাবটা ঘটনার উচ্চগ্রাম, নাটকীয়তা, উৎকণ্ঠা থেকে আসেনি। যদিও এ উপাদানগুলো গরহাজির নয়। পূর্ববর্তী নাটক রাইফেলের (১৯৬৮) সাথে তুলনা করলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। টিনের তলোয়ার বিনোদন-জগতের কাহিনি। কিন্তু ওই জগতের অচিনলোকের তুলনায় পাত্র-পাত্রীর প্রাত্যহিকতা এখানে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। আরোপিত মতাদর্শের চাপ কাহিনি ও চরিত্রায়ণে যথেষ্ট আছে; কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মানুষের জীবনের সার্বিক পরিচয় এখানে এমন ঘন ও আন্তরিক ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে, সাধারণভাবে উপন্যাসেই যার দেখা মেলে।
দুই. এক অর্থে এটা নাটক-সম্পর্কিত নাটক। নাটকের উৎপাদন-বিপনন-ভোগের নানা স্তর ও মুহূর্ত এখানে অন্য উপাদানগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়েছে। মুহূর্তগুলো একদিকে সর্বজনীন; এ অর্থে যে, পারফরমেন্স শিল্পের প্রায় যে কোনো ধারার যে কোনো কালের অভিজ্ঞতা এখানে অল্প-বিস্তর ধরা পড়েছে। অন্যদিকে আবার বাংলার সাধারণ রঙ্গালয়ের এক বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতারও এ এক প্রামাণ্য উপস্থাপনা। ময়নার নায়িকা হয়ে ওঠার পথে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিস্থিতি, তার শিক্ষানবিশ দশা ও নারী-জীবনের বাস্তবতা, পারফরমেন্সের সঙ্গে ব্যক্তি-কুশীলবের সম্পর্ক আর নাট্যদলের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ে এক প্রভাবশালী ছাঁচ তৈরি হয়েছে এ নাটকে। এ ছাঁচ পরবর্তীকালে বিভিন্ন মাধ্যমের বহু রচনাকে প্রভাবিত করেছে।
তিন. নাটককে কেন্দ্রে রেখে উনিশ শতকের কলকাতার বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্ত তৈরির ক্ষেত্রে নাট্যকার
উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছেন। বাংলার উনিশ শতক-সম্পর্কিত যেসব সামাজিক-ঐতিহাসিক বয়ান পাওয়া যায়, নিঃসন্দেহে সেগুলোর অনুসরণ করেছেন তিনি। কিন্তু সামাজিক স্তরবিন্যাস, ভিতর-বাইরের দ্বন্দ্ব, উৎপাদন ও বণ্টন-সম্পর্ক ইত্যাদি মিলিয়ে যে সামগ্রিক আবহ রচিত হয়েছে টিনের তলোয়ারে, তা খুবই উপভোগ্য হয়েছে।
চার. নাটকটি উৎপাদন-সম্পর্ক আর ক্ষমতা-সম্পর্কের ব্যাপারে বিশেষভাবে সচেতন থেকেছে। সাধারণভাবে এটা যেকোনো সফল সাহিত্যকর্মের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য; কিন্তু মার্কসবাদী লেখক হিসাবে উৎপল দত্ত বিষয়টিতে বাড়তি মনোযোগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। নানা ধরনের অপ্রাপ্তির বোধ আর নিপীড়নই তো চরিত্রগুলোর সামষ্টিক বিদ্রোহের উৎস। উৎপাদন-বণ্টন আর ক্ষমতার প্রত্যক্ষ আঁচ ছাড়া এই বিদ্রোহ এতটা বৈধতা পেত না।
পাঁচ. ভাষা এ নাটকে খোদ বিষয়ের রূপ নিয়েছে। উনিশ শতকের উপনিবেশিত কলকাতায় বাংলা ভাষারও
নানামাত্রিক গড়া-পেটা চলছিল। কর্তাপক্ষ হিসাবে ছিল ইংরেজি, আর সংস্কৃত ছিল প্রভাবশালী সহায়কের
ভূমিকায়। একদিকে চলছিল ভাষার ভদ্রজনোচিত অদল-বদল; অন্যদিকে মুখের ভাষার ‘অপ্রমিত’ রূপগুলো নাগরিক পরিমণ্ডলেও সক্রিয় ছিল। আর ছিল প্রমিতভাষী হয়ে ওঠার নিরন্তর সাধ্য-সাধনা। আলবেয়ার মেমির (গবসসর ১৯৭৬: ১০৭-০৮) ভাষা ধার করে উপনিবেশিত কলকাতার এই পরিস্থিতিকে বলতে পারি ‘ভাষিক রঙ্গ [লিঙ্গুইস্টিক ড্রামা]। টিনের তলোয়ার নাটকে এ ভাষা-পরিস্থিতি প্রায় নিঃশেষে ব্যবহৃত হয়েছে। পরিস্থিতি বা চরিত্র ভাষার ভিন্নতায় পষ্ট হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, ভাষাই হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি বা চরিত্র।
ছয়. মতাদর্শিক নিয়ন্ত্রণ আর শিল্পিতার সহাবস্থানের এক সফল নমুনা টিনের তলোয়ার। নাট্যশিল্পী হিসাবে উৎপল দত্ত এখানে প্রকাশ করেছেন নিজের সবচেয়ে কার্যকর ইশতেহার। টিনের তলোয়ারকে আসল তরবারিতে রূপান্তরিত করা ‘প্রপাগান্ডিস্ট নাট্যকার’ হিসাবে তাঁর নিজের আকাক্সক্ষাকেই বৈধতা দেয়। অন্যদিকে, যে রাজনীতির মর্মে আছে শোষিতের পক্ষে লড়াই, সে রাজনৈতিকতার মূর্তি প্রণয়নেও তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়। নাট্যতত্ত্ব আর রাজনীতিতত্ত্বের প্রচারণা নাটকের প্রাঞ্জলতা ক্ষুণ্ন করেনি।
এখানে টিনের তলোয়ার নাটকের গুরুত্বের কয়েকটি দিকের উল্লেখ করা হল। এ সংখ্যা আরো বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু যা বলা হল তাতেই, আশা করা যায়, বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে নাটকটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যাবে। বলে রাখা দরকার, মঞ্চায়নের দিক থেকে এই পর্যালোচনা নয়; এখানে কেবল মুদ্রিত রচনা হিসাবেই বিবেচনা সীমিত রাখা হয়েছে।
২
এবার আসা যাক নাটকটির বয়ানকৌশলের কিছু দিক প্রসঙ্গে।
প্রথম দৃশ্যে মাতাল বেণীমাধব মুখোমুখি হয় ‘কলকাতার তলায়’ থাকা এক মেথরের। মেথর তাকে কলকাতার নাট্যশালার অবস্থা সম্পর্কে ভালোই জ্ঞান দিয়েছে। মেথরের এই ‘জ্ঞান’ বাস্তবসম্মত কিনা, সে প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক। বেণীমাধব তখন ‘চার পাঁইটে’র মাতাল বলে তার পক্ষে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়নি। কিন্তু পাঠক-দর্শকের জন্য মেথরের কথাগুলোর বাস্তবসম্মত ভিত্তি খুঁজে নেয়া খুব সহজ নয়। অগত্যা নাটকের প্রথম পরিচ্ছেদটিকে লেখকের প্রকল্প-পরিচিতি হিসাবে নেয়া ছাড়া খুব একটা উপায় থাকে না, যেখানে মেথরের মুখ দিয়ে আসলে নাট্যকারের বাসনাই প্রকাশিত হয়েছে। এ থেকে আমাদের জোরালো অনুমান হয়, নাটকটি কাজ করবে বাংলা নাট্যমঞ্চের বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে; আর তা শ্রেণি-বাস্তবতা আর শ্রেণি-শোষণ সম্পর্কে বিশেষ মনোযোগ দেবে। বেঙ্গল অপেরাসহ কলকাতার নাট্যপরিস্থিতির পরিচয় দেয়ার বাইরে প্রথম পরিচ্ছেদ আরেকটি কাজ করেছে। নাটকের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ময়না ওরফে শঙ্করী এ দৃশ্যেই আবির্ভূত হয়েছে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদটি মূলত পরিচয়জ্ঞাপক। প্রথম দৃশ্যে যদি বাংলার রঙ্গমঞ্চের সাধারণ পরিচয় থাকে, তাহলে এই দৃশ্যে আছে বেঙ্গল অপেরার বিশেষ পরিচয়। পত্রিকা ও প্রতিবেশীর বরাতে নাট্যদলের প্রতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এখানে প্রকাশ পেয়েছে। নাট্যদলের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক, তাদের দুর্দশা আর মালিকের সাথে দলের সম্পর্ক পষ্ট হয়েছে। বেণীমাধব এখানে তার সমস্ত প্রতিভা, অহঙ্কার আর কর্মতৎপরতা নিয়ে উপস্থিত। আমরা পেয়ে গেছি সাচ্চা যুবক প্রিয়নাথকেও।
ময়নার প্রশিক্ষণপর্ব শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় দৃশ্যেই। তৃতীয় দৃশ্যে ভীরু-অনভিজ্ঞ পদক্ষেপে মঞ্চে তার সফল সূচনা। দর্শকদের ঘোরতর অপ্রস্তুতি এ দৃশ্যের অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য। এক থেকে তিন নম্বর পরিচ্ছেদকে বলা যায় নাটকের প্রস্তুতিপর্ব। চতুর্থ দৃশ্যে সেই প্রস্তুতিপর্বের ফলপ্রাপ্তি। অবশ্য এ দৃশ্য নতুন পর্বের প্রস্তুতিও বটে। এ অর্থে যে, সাম্রাজ্যবাদী শাসন আর শোষণ এ দৃশ্যেই প্রথমবারের মতো খোলাখুলি প্রকাশ পেয়েছে। ব্রিটিশ-বিরোধী যে উচ্চারণের মধ্য দিয়ে নাটকটির সমাপ্তি, তার সূচনা এখানেই। তারও আগে দ্বিতীয় ও শেষবারের মতো মঞ্চে এসেছিল মেথর। ময়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের অপরিবর্তিত অবস্থার সাপেক্ষে ময়নার শ্রেণিচ্যুতিটা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় হয় সে। এরপর আসে প্রিয়নাথ — এ নাটকের আরেক শ্রেণিচ্যুত চরিত্র। তার চ্যুতি অবশ্য ময়নার বিপরীত। শ্রেণিচ্যুতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রমাণ করে, উৎপল দত্ত এ জাতীয়তাবাদ-উচ্চকিত নাটকেও শ্রেণি-রাজনীতির প্রকল্প ত্যাগ করেননি।
পঞ্চম দৃশ্যের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নাট্যদলের মালিকানা-বদল। ময়নার বিনিময়ে বীরকৃষ্ণ লাভ করে স্বাধীন নাট্য-নির্দেশনার অধিকার। এই হাতবদলের ঘটনায় মঞ্চস্থ হয়েছে টিনের তলোয়ার নাটকের সবচেয়ে জমজমাট ‘নাটকীয়’ দৃশ্য। ময়নার বিনিময়ে শিল্প-স্বাধীনতা অর্জনের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সবাই; কিন্তু বেণীমাধবকে টলানো যায়নি। নাট্যকারের পক্ষপাতটা অবশ্য এক্ষেত্রে খুবই অস্পষ্ট। তিনি প্রত্যেক পক্ষকেই ন্যায্য হিস্যা দিয়েছেন। এর ফলে নারীর দৃষ্টিভঙ্গির এক দুর্দান্ত নমুনা পাওয়া গেছে বসুন্ধরা ও ময়নার প্রযোজনায়। বেণীমাধবের কাজটা সহজ করে দিয়েছে অবশ্য ময়নাই। ফাঁপা ভদ্রলোকী জীবনে অভ্যস্ত ময়নার পক্ষে কোনো বিপ্লবী সিদ্ধান্ত নেয়া আর সম্ভব ছিল না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে স্বাধীন নির্দেশক হিসাবে বেণীমাধব প্রিয়নাথের তিতুমীর নাটকেরই রিহার্সেল করছিলেন। কিন্তু তদ্দিনে নাট্য-নিয়ন্ত্রণ আইন পাশ হয়েছে। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের লোকজন ইংরেজ-বিরোধী নাটক মঞ্চায়নের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে। কাজেই রিহার্সেল-করা তিতুমীর রেখে আবার মঞ্চে আসে সধবার একাদশী। এভাবেই এক সন্ধ্যার মঞ্চ প্রস্তুত হয় সপ্তম দৃশ্যের চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য। নাটকের ভিতর নাটক, তার ভিতর আরেক নাটকের জন্য। নাটকের ছলে মঞ্চে-দর্শকসারিতে ক্ষোভ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। প্রথম দৃশ্য থেকেই চলেছে এই শেষ দৃশ্যের প্রস্তুতি। তৈরি হয়েছে সংলাপের ভিতর আরেক সংলাপ ঢুকে যাওয়ার বাস্তবতা। তৈরি হয়েছে নাটকের প্রতিটি চরিত্র। বাস্তব হয়ে উঠেছে তাদের ব্যক্তিজীবন আর মঞ্চজীবন একাকার হয়ে যাওয়ার বিশেষ মুহূর্ত। বেণীমাধবের সামনে স্বয়ং ইংরেজ শাসক আর দেশীয় অনুচর। বেণীমাধবের সামনে বীরকৃষ্ণের মতো মূর্তিমান তিক্ততা। তার স্মৃতিতে মেথর আর প্রিয়নাথের চোখা সংলাপ। তার মনে তিতুমীর করতে না পারার ক্ষোভ। তার মাথায় বাংলা মদের উত্তেজনা। তার রক্তে জাত শিল্পীর গর্জে ওঠা ব্যক্তিত্ব। তাই সহসাই সংলাপ বদলে সে হয়ে ওঠে তিতুমীর। তার আবেগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মঞ্চের বসুন্ধরা আর দর্শকসারির ময়নার মধ্যে। তিতুমীর নাটকের রিহার্সেল চলছিল দীর্ঘদিন। মঞ্চ বদলে যেতে দেরি হয় না। ওই নাটকের বিশেষ নাট্যমুহূর্ত আর টিনের তলোয়ারের প্রস্তুত মুহূর্ত একাকার হয়ে পাল্টে দেয় খোদ মঞ্চকেই। মঞ্চ হয়ে ওঠে লড়াইয়ের ময়দান। প্রচলিত নাট্যমঞ্চের খেলনা তলোয়ার ফেলে দিয়ে সে লড়তে চায় খোদ শাসক-শোষক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। বহু বিষয়কে একসাথে মোকাবেলা করা, ওই বিষয়গুলোকে কাহিনির পর্দায় যথাসম্ভব ঢেকে রাখা, আর কোনোটিকে ফেলে কোনোটিকে রেখে কার্যকর নাট্যমুহূর্ত তৈরি করার ক্ষেত্রে টিনের তলোয়ার এক স্মরণীয় আয়োজন। কিন্তু যে অনুমানগুলোর ভিত্তিতে রচয়িতা ঘটনা-চরিত্র-সংলাপ সাজান, যে ঐতিহাসিক তথ্য-সত্য বা মিথে ভর করে লেখক নিজের ঝোঁক বা পক্ষপাত প্রকাশ করেন, সেগুলোর পর্যালোচনা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কাজ। আমরা এখন সে কাজেই অগ্রসর হব।
৩
টিনের তলোয়ারের প্রেক্ষাপট ১৮৭৬ সালের কলকাতা। ভূমিকাপত্রে নাট্যকার নিজেই তা উল্লেখ করেছেন। অবশ্য নাটকের মধ্যেও অন্তত দুই দফা প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথম দৃশ্যে বেণীমাধব মধুসূদন দত্তের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছে: ‘দুই বৎসর হয় আমাদের সকলকে শোকসাগরে নিমজ্জিত করে তিনি মহাপ্রয়াণ করেছেন’ (উৎপল ১৯৯৭: ৭৮)। আর ষষ্ঠ দৃশ্যে পাওয়া যাচ্ছে নাট্য-নিয়ন্ত্রণ অর্ডিন্যান্সের কার্যকর হওয়ার খবর (উৎপল ১৯৯৭:১৩৩)। এই অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছিল ১৮৭৬ সালে। দুই সাক্ষ্য মিলিয়ে বলা যায়: নাটকটির পটভূমি ১৮৭৫-৭৬ সালের কলকাতা। তাহলে ওইসময়ের কলকাতার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের যেসব বিবরণ পাওয়া যায়, মোটাদাগে তার সঙ্গে এ নাটকে উপস্থাপিত ঘটনাবলির মিল থাকার কথা। মিল খোঁজার বিশেষ কারণ এই যে, নাট্যকার নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মুহূর্তকেই মূর্ত করতে চেয়েছেন বলে টেক্সটে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া যেসব বর্গ বা ক্যাটাগরির বরাত দিয়ে তিনি নাটকের ভাবগুলোকে আকার দিতে চেয়েছেন, সেগুলো ইতিহাসসম্মত বর্গই বটে।
প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় প্রিয়নাথের কথা। দ্বিতীয় দৃশ্যের শুরুতেই প্রিয়নাথের পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে:‘কেতাদুরস্ত ইয়ংবেঙ্গল পোশাক পরা প্রিয়নাথ’ (উৎপল ১৯৯৭: ৮১)। উনিশ শতকের শেষ চতুর্থাংশে ‘ইয়ংবেঙ্গল’যুবক মোটেই তথ্যসম্মত নয়। নাট্যকার নিজেও এই কাল-দূরত্ব সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। প্রিয়নাথ ডিরোজিওর শিষ্যই বটে। কিন্তু স্বয়ং ডিরোজিও যে বছর পঞ্চাশেক আগের ঘটনা, তা উল্লেখিত হয়েছে প্রিয়নাথের এক সংলাপে: ‘মাই ফলেন কান্ট্রি! ওয়ান কাইন্ড উইশ ফ্রম’ দী! এ কবিতা লিখেছিলেন ডিরোজিও। তারপর পঞ্চাশ বৎসর কেটে গেছে, কোনো বাঞ্চৎ জাগলো না’। (উৎপল ১৯৯৭: ১২০)
প্রশ্ন হল, কালবিভ্রাট ঘটিয়ে লেখক একজন ডিরোজিয়ানকে আনার প্রয়োজন বোধ করলেন কেন? উনিশ শতকের শেষপাদে কলকাতায় ইংরেজি-শিক্ষিত উদ্যমী তরুণবর্গের তো অভাব ছিল না। তদ্দিনে বহু বঙ্গসন্তান ডেপুটি হয়ে গেছেন; কেউ কেউ স্বয়ং আইসিএস। কয়েকটি কলেজ ছাড়াও তদ্দিনে ভারতবর্ষের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া শত শত তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। স্বাধীন পেশাজীবীদের প্রতাপ বাড়ছে। সে এতটাই যে ব্রিটিশইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন পুরানা জমিদারদের দিয়ে আর ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছে না। শিক্ষিত নব্যশ্রেণিকে জায়গা করে দিতে হচ্ছে। আর মাত্র বছর দশেক পরেই গড়ে উঠবে নতুন পাটাতন—কংগ্রেস; যেখানে নব্যশ্রেণিই প্রায় একচেটিয়া রাজত্ব করবে। তাহলে ইংরেজিনবিশ বর্গের প্রিয়নাথের এই নিঃসঙ্গতা কেন? এখানে গোরার (১৯০৯) নজির টানা সম্ভবত উপকারী হবে। গোরা উপন্যাসও কলকাতার প্রায় একই সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা। কিন্তু সামাজিক স্তরবিন্যাস ও দ্বন্দ্বের শনাক্তিতে দুই রচনার ফারাক দুস্তর। গোরা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি ইতিহাসসম্মত। গোরাও নিঃসঙ্গ। কিন্তু তার একাকিত্ব শ্রেণিগত নয়। নিজের ভাব ও তৎপরতায় সে আলাদা হয়ে গেছে তার শ্রেণির অন্য দশজন থেকে। রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক সমাজে গড়ে ওঠা নতুন
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভ্যন্তর-দ্বন্দ্বগুলোর জাতীয়তাবাদী মীমাংসা (মোহাম্মদ আজম ২০১১)। যাকে তিনি‘বাস্তব’ হিসাবে সাব্যস্ত করেছিলেন, তার নিরিখেই ঘটনা-বিবরণী প্রণয়ন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল। কিন্তু উৎপল দত্তের লক্ষ্য বাস্তব ইতিহাসের মধ্যে ‘বিপ্লবী’ ভবিষ্যতের সম্ভাব্য উপাদান চিহ্নিত করা। এজন্য দরকার ছিল খোদ ইতিহাসের নতুন পাঠ। তা না করে ‘প্রচলিত’ ইতিহাসেই তিনি ‘আদর্শ’ চরিত্র তালাশ করেছেন। কী এ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য? প্রিয়নাথ এক বাবুর সন্তান। কিন্তু বাবুসমাজকে সে ঘৃণা করে। এমনকি নিজের বাপকেও। শ্রেণিচ্যুত হয়ে সে নেমে এসেছে বিত্তহীনের কাতারে। সাম্রাজ্যবাদী শোষণে সর্বস্বান্ত মানুষদের প্রতি তার সহানুভূতি অপরিসীম। দেশের দুর্দশার জন্য যে বিদেশি শাসনই দায়ী, সে জ্ঞান তার টনটনে। মুখে তার ইংরেজি লব্জ। কিন্তু বাংলা আর সংস্কৃতও ভালো জানে। ইংরেজি শিক্ষার সুন্দর সারটুকুই সে শুধু গ্রহণ করেছে। যে অনুভূতি বসুন্ধরা বা ময়না অর্জন করেছে নিজেদের নারী জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, সেই একই অনুভূতি প্রিয়নাথ হাসিল করেছে তার শিক্ষার দৌলতে। নাট্যকার হিসাবে সে খুবই সরস। স্বয়ং বেণীমাধবের উপলব্ধি: ‘হিন্দু কালেজের বাবু প্রিয়নাথ মল্লিক নাটক লেখেন ভালই’ (উৎপল ১৯৯৭: ১৩১)। তদুপরি ব্রিটিশ-বিরোধী অবস্থানেও সে অকুতোভয়। দেখা যাচ্ছে, টিনের তলোয়ার নাটকের প্রধান চার প্রকল্প — শ্রেণি-রাজনীতি, জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়নে নারীর প্রতিবাদ এবং নাট্য-বিদ্রোহ—প্রিয়নাথকে ঘিরেই বাস্তবায়িত হয়েছে। মুশকিল হল, ‘প্রচলিত’ ইতিহাসে ইয়ংবেঙ্গলের যে অজস্র বিবরণ পাওয়া যায় (ঝধৎশধৎ ১৯৮১, ঝধৎশধৎ ২০০০), তার সাথে এ প্রিয়নাথকে মিলানো কঠিন। ইংরেজি শিক্ষা, পোশাক-পরিচ্ছদ আর উদ্যম-আয়োজনে মিল আছে।
কিন্তু শ্রেণিচেতনা বা ইংরেজ-বিরোধী মনোভাব ইয়ংবেঙ্গলদের মধ্যে অচিন্তনীয়। ইতিহাস বলছে, ইয়ংবেঙ্গলের অনেকেই ডেপুটি হয়েছিলেন, কেউ কেউ উত্তরকালে হয়েছেন খ্রিস্টান পাদ্রি বা আদর্শ হিন্দুত্বের প্রচারক, আর সকলেই মিলেমিশে যাপন করেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অনুগত প্রজার জীবন। তা সত্ত্বেও একজন লেখক কোনো‘আদর্শ’ চরিত্র তৈরি করতেই পারেন। কিন্তু তার জন্য ইয়ংবেঙ্গল নাম নেয়া বিভ্রান্তিকর। কারণ, এটি একটি ইতিহাসসিদ্ধ বর্গ। ইয়ংবেঙ্গল বা ডিরোজিওর নামে বিপ্লব-বিদ্রোহের যে কিংবদন্তি ভদ্রলোকসমাজে জাহির আছে, নাট্যকার কি তাতে প্রতারিত হয়েছেন? নাকি এ চরিত্রটিকে আমরা ‘পুনর্নির্মিতি’র মহিমা দেব? এই সওয়ালে ঢোকার আগে প্রিয়নাথের শত্রুপক্ষের হদিশ নেয়া জরুরি।
প্রিয়নাথের শত্রুপক্ষ পুরোপুরি স্পষ্ট। মুখ্যত দেশীয় বাবুসমাজ আর গৌণত ইংরেজ শাসক। এরা আসলে
নাট্যকারেরও প্রতিপক্ষ। অনুমান করি, নাটকে অন্তত দুইবার স্বল্পসময়ের জন্য আবির্ভূত বাচস্পতি মশায়ও শত্রুসমাজে পড়বে। এ ব্যাপারে প্রিয়নাথের ভিন্নমতের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। বাবুসমাজের অপরাধ মোটের উপর দুটি। এক. এদের জীবন-যাপনে সুরুচির পরিচয় নেই। দুই. এরা শাসকপক্ষের সহচর, তাদের সমর্থক এবং অনুগ্রহভোগী। গুরুতর অভিযোগ, সন্দেহ নাই। কিন্তু স্বয়ং শাসকপক্ষের তুলনায় শাসন-সহযোগীদের প্রতি বেশি উষ্মার কারণ পরিষ্কার নয়। একটা কারণ এই হতে পারে যে, মালিক বা দর্শক হিসাবে বাবুসমাজ নাটকের সাথে যুক্ত। দুই ক্ষেত্রেই তারা নাটকের ‘সুষ্ঠু’ বিকাশের অন্তরায়। স্মরণীয়, নাটকের অধিকাংশ কুশীলব ইংরেজ-বিরোধী মনোভাবে ফেটে পড়েছে নাট্য-নিয়ন্ত্রণ অর্ডিন্যান্স জারির কারণে, খোদ শাসনটির জন্য নয়। কলকাতার বাবুসমাজের যে পরিচয় টিনের তলোয়ারে আছে, তা মোটের উপর ইতিহাসসম্মত। অর্থাৎ ইতিহাসের প্রভাবশালী বয়ানগুলোতে উদ্বৃত্তভোগী নাগরিক ধনিকশ্রেণির যে পরিচয় পাওয়া যায়, এখানে তার মোটামুটি বিশ্বস্ত বয়ান আছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও ঘটেছে সে একই কালবিভ্রাট। শেষ উনিশ শতকে বাবুসমাজ কলকাতায় ছিল। কিন্তু তাদের যে প্রতাপশালী সর্বময়তার ছবি এ নাটকে আছে, তা উনিশ শতকের প্রথমভাগের ছবি। এই সমাজের সাথেই নব্যশিক্ষিত ইয়ংবেঙ্গলের বিরোধ ও খুনসুটির নানারকম কাহিনি প্রচারিত আছে। এই সামাজিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস বা মিথকে নাটকের কাজে খাটাবার প্রয়োজনেই নাট্যকার সম্ভবত ইয়ংবেঙ্গলের ধারণা ব্যবহার করেছেন। ইতিহাসের কালক্রম লঙ্ঘন করে পুরো ব্যাপারটাকে পিছিয়ে দিয়েছেন অন্তত পঞ্চাশ বছর। আরেকটি গভীর কারণও অনুমান করা যায়। যেসব গুণে প্রিয়নাথ ধনী, তার অনেকগুলোই ওই শতকের শেষাংশে গুণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। যেমন, জাতীয়তাবাদী মনোভাব। উনিশ শতকের শেষদিকে শিক্ষিতসমাজ আবিষ্কার করতে থাকে, ঔপনিবেশিক শাসনে তাদের সন্তোষজনক ভবিষ্যত আর অবশিষ্ট নাই। মুখ্যত এই বোধই তাদের ইংরেজ-বিরোধী মনোভাবের উৎস। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৮৮১ সাল নাগাদ মোট ১৭০০ স্নাতকের অর্ধেকই ছিল বেকার (ঝবহ ১৯৭৭: ৯৫)। এই পরিস্থিতিজাত ইংরেজ-বিরোধিতা মোটেই দেশমূলক নয়, বরং শ্রেণিমূলক। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল যে জাতীয়তাবাদী তৎপরতায়, তাও ছিল মুখ্যত হিন্দুত্বমূলক। ফলে প্রিয়নাথের শিক্ষা ও উপলব্ধিজাত দেশপ্রেমমূলক ব্রিটিশ-বিরোধিতা বানোয়াট। কিন্তু ওই সময় থেকে ইংরেজবিরোধিতা ক্রমে ভদ্রলোকের গুণ হিসাবে স্বীকৃতি পেতে থাকে। এর আগ পর্যন্ত কলকাতার ভদ্রসমাজে এ বস্তু অচেনা ছিল।
প্রিয়নাথের আরেক গুণ সুরুচি। মদ্যপানে তার অনীহা। বহুগামিতা তার কাছে অসহনীয়। প্রিয়নাথের এই গুণকে জোরালোভাবে প্রকাশের স্বার্থে চতুর্থ পরিচ্ছেদে লেখক আমদানি করেন এক অনামা যুবককে। যুবকটি ‘গুপ্তকন্যার গুপ্তকথা’ বিক্রি করতে চায় প্রিয়নাথের কাছে; আর প্রিয়নাথ এই অশ্লীলতার বিরুদ্ধে নিজের তীব্র ক্ষোভ জাহিরের সুযোগ পায়। তরুণ ইয়ংবেঙ্গল সমাজে এ মনোভাব অভাবনীয়। ইয়ংবেঙ্গলদের সামগ্রিক মাতলামি, বেশ্যাপ্রীতি আর সামাজিক অনাচার বহু গালগল্পের উৎস হয়ে আছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, কলকাতায় শ্লীলতা ও রুচির একটি ক্ষীণ কিন্তু প্রভাবশালী ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে উনিশ শতকের শেষাংশে (নীরদ ১৪০৮), যার উৎস ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ আর খ্রিস্টীয় নৈতিকতা থেকে উৎসারিত ব্রাহ্ম-নৈতিকতা। প্রিয়নাথের মধ্যে এই বস্তুরই দেখা মেলে।
দেখা যাচ্ছে, টিনের তলোয়ারের প্রিয়নাথ ১৮৭৫-৭৬ সালেরই চরিত্র। এর সাথে লেখক পুরানা ইয়ংবেঙ্গলকে মিশিয়ে খিচুড়ি রেঁধেছেন। সঙ্গে খলচরিত্র হিসাবে রেখেছেন অনাচারী বাবুসমাজকে। একটা অত্যন্ত জটিল আর স্তরবহুল বাস্তবকে নাট্যকার এভাবে সরল করে এনেছেন। আমরা পরে দেখব, ব্যাপারটা কেবল সারল্যেই সীমিত থাকে নাই; বেশকতক তরলও হয়েছে।
৪
প্রিয়নাথকে ফলিয়ে তুলতে গিয়ে নাট্যকার কলকাতার ইংরেজি-শিক্ষিত ভদ্রলোকসমাজকে অপরিমেয় রেয়াত দিয়েছেন। তিনি আসলে উনিশ শতকের কলকাতা-সম্পর্কিত এক বহু-প্রচারিত মিথের আক্ষরিক অনুসরণ করেছেন। মিথটি এই: কলকাতার সমাজ তখন ‘প্রগতিশীল-রক্ষণশীল’ বৈপরীত্যে বিভক্ত ছিল। পরবর্তী বিবরণগুলোতে প্রগতিশীলতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইংরেজি শিক্ষা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম ইত্যাদি। আর রক্ষণশীলদের পরিচিতি হয়েছে আধুনিক-শিক্ষা-বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল হিসাবে। বাস্তবতা হল, কলকাতার সমাজে ‘প্রগতিশীল’,‘রক্ষণশীল’, ‘সংস্কারপন্থি’ বা ‘উদারনীতিবাদী’ বলে আলাদা বিভাজন কখনোই ছিল না; আর ভদ্রলোকদের সব পক্ষই সাহেবদের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল (দেবেশ ১৯৯০, মোহাম্মদ আজম ২০১৪)। ইংরেজি-শিক্ষার সাথেও ‘রক্ষণশীল’দের আবশ্যিক কোনো বিরোধ ছিল না। হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের প্রায় সবাই ছিলেন তথাকথিত রক্ষণশীল সমাজের নেতা (বিনয় ২০০০: ২১)। আর ইংরেজি-শিক্ষিত ভদ্রলোকদের ইংরেজবিরোধিতার প্রশ্নই আসে না। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-ইয়ংবেঙ্গল তো নয়ই, এমনকি শতাব্দীর শেষাংশের সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির মতো বিদ্রোহীরাও আসলে বিদ্রোহ করেছে শ্রেণি-সুবিধার প্রশ্নে, খোদ শাসনের বিরুদ্ধে নয়। উল্লেখ করা দরকার, উনিশ শতকের শেষাংশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুধু ধর্মকেন্দ্রিক ছিল না, ইংরেজশাসনের বাস্তবতা মেনে নিয়েই তার উৎপত্তি ও বিকাশ।
প্রিয়নাথের নৈতিকতা ও তৎপরতার একমাত্র উৎস তার ইংরেজি-শিক্ষা। তা হতেও পারে। কিন্তু নাট্যকার যে বিকল্প যে-কোনো সম্ভাবনা কঠিন হাতে দমন করেছেন, দেশীয় শিক্ষা ও চর্চার সাথে যুক্ত কোনো ব্যক্তির মধ্যে যে এক টুকরা আলোও দেখেননি, তা অভাবনীয়। প্রিয়নাথের যাবতীয় চেতনার উৎস ইংল্যান্ড। পশ্চিমা শিক্ষাই তার নৈতিকতা আর উপলব্ধির একমাত্র উপাদান। এমনকি দেশপ্রেমের উৎসও তা-ই। ডিরোজিওর কবিতা উদ্ধৃত করে সে, দেশপ্রেমের নমুনা হিসাবে। নাট্যকার এখানেও মিথকেই প্রশ্রয় দেন। ডিরোজিওর প্রামাণ্য জীবনীকাররা বলছেন, তিনি তাঁর ছোট কিন্তু অসম্ভব কর্মমুখর জীবনটি অতিবাহিত করেছেন মূলত নিজ সম্প্রদায় অ্যাংলোইন্ডিয়ানদের সেবায় (ঝধৎশধৎ ২০০০: ৩১)। তাঁর কবিতাটি — সম্ভবত ইংরেজি কবিতার সমরূপ উপলব্ধির অনুসরণে লেখা—সাহিত্যের ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে প্রথম দেশপ্রেমমূলক কবিতা হিসাবে। এ ব্যাপারে উৎপল দত্তও কোনো আপত্তি জানাননি। কিন্তু তিনি এমন ইঙ্গিত একেবারেই দেননি যে, কথিত বাবুসমাজও আসলে ইংরেজ-শাসনেরই প্রত্যক্ষ ফল, আর এ নামে বর্ণিত মানুষদের মধ্যে ইংরেজি-শিক্ষিত লোকের সংখ্যা রীতিমতো প্রচুর। উনিশ শতকের সাহিত্যিক বয়ানগুলো মূলত জাতীয়তাবাদী নির্মাণের ফল; আর এর গোড়ায় আছে রেনেসাঁ-মিথ। ভদ্রলোকশ্রেণি প্রথমবারের মতো কার্যকর ইংরেজ-বিরোধিতা করেছে বিশ শতকের গোড়ায় — স্বদেশী আন্দোলন আর ‘সন্ত্রাসবাদী’ আন্দোলনে। তার সঙ্গে মিল রেখে পরবর্তীকালে পেছনের ইতিহাসটা গড়াপেটা করা হয়েছে।‘পশ্চিমায়ন’কেই ভাবা হয়েছে ‘আধুনিকায়ন’। মোটেই খেয়াল করা হয়নি যে, উনিশ শতকের ভদ্রলোকশ্রেণি গড়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটাই আসলে উপনিবেশায়ন-প্রক্রিয়া মাত্র। সেখানে ব্যক্তির বা শ্রেণির সক্রিয়তা ‘আমাদের’নিজস্ব ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের বাস্তবতা বাদ দিয়ে, ভদ্রলোকশ্রেণির সাথে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বাদ দিয়ে সে ইতিহাস প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। ভালো-খারাপের সরল বৈপরীত্যে, প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার সরল ছাঁচে ইতিহাসটাকে কিছু ব্যক্তির অর্জনের সাথে মিলিয়ে সাফসুরতা করে নেয়া হয়েছে। উৎপল দত্তও এই সরল ছাঁচের খপ্পর এড়াতে পারেননি।
৫
আধুনিক বাংলার ইতিহাস ও সাহিত্যাঙ্গনের অধিকাংশ চর্চাকারী এই ছাঁচ এড়াতেই চাননি। বরং পুনরুৎপাদনের মধ্য দিয়ে একে শক্তিশালী করেছেন। এর কারণ, যেমনটা রণজিৎ গুহ বলেছেন (এঁযধ ১৯৮৮), এ ইতিহাসদৃষ্টি ভদ্রলোকশ্রেণিরই দৃষ্টিভঙ্গি; দেখার এই ধরন ওই শ্রেণির, যার জন্ম হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের সুবিধাভোগী হিসাবে। উৎপল দত্তের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি বিশেষভাবে পর্যালোচনার কারণ, তিনি নাটকে একদিকে শ্রেণিচেতনাকে উচ্চকিত করেছেন, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিপ্লবী ধারণাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। ফলে তাঁর ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বিভ্রাট ভাবগত সংকট তৈরি করেছে।
উদাহরণ হিসাবে নাট্যতত্ত্বকেই নেয়া যাক। টিনের তলোয়ার নাটকের দৃশ্যবিভাজন পশ্চিমা ক্লাসিক নাট্যরীতির অনুসারী নয়। প্রিয়নাথও একই ধরনের নাটক লিখেছে। নিজেই বলেছে: ‘আমার নাটকে অঙ্কভাগ নেই। অঙ্ক-গর্ভাঙ্ক এ সব কৃত্রিম ভেদাভেদ নেই। আমার নাটক দশ অধ্যায়ে বিভক্ত, একাধারে নাটক ও নভেল’ (উৎপল ১৯৯৭: ৯৩)। বোঝা যায়, পশ্চিমা নাট্যরীতির সাথে ভিন্নতা রক্ষার একটা সচেতন চেষ্টা নাট্যকারের ছিল। কিন্তু চেষ্টাটাকে নাট্যকার নাটকের উৎপাদন-বিতরণ-ভোগ পর্যন্ত টেনে নিতে পারেননি। যদি দেশীয় নাট্যপ্রচেষ্টাকে মদদ জোগাতেই হয়, তাহলে তার উৎপাদন-ব্যবস্থাও বদলানো দরকার। যারা এর দর্শক তাদের মতো করেই বা অন্তত তাদের উপযোগী করেই তা পরিবেশন করা দরকার। এ অভিজ্ঞতা উৎপল দত্তের নিজেরই ছিল। তিনি যাত্রাদল তৈরি করে, যাত্রা লিখে, পরিচালনা করে মঞ্চায়নের বন্দোবস্ত করেছিলেন (দর্শন ২০০৭)। সেরকম বন্দোবস্তের কথাই লিখতে হবে, তা নয়। কিন্তু যে সমস্যাটা অনেক জটিল আর জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক অবস্থার সাথে যুক্ত, সে অবস্থাকে নাট্যকার প্রকাশ করলেন খুব সরল করে; পর্যবসিত করলেন ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বে। দায়ী করলেন বাবু বীরকৃষ্ণকে। বীরকৃষ্ণ তো ক্ষমতা খাটিয়ে কোনো নাট্যদলের মালিকানা দখল করেনি। পুঁজির নিয়মেই লাভজনক খাত ভেবে দল গড়েছে। নাটকের বিবৃতি অনুযায়ী অন্য বিকল্পও ছিল না। ‘শিক্ষিত’ ভদ্রলোকশ্রেণির ওই বিকাশ তখনো হয়নি যে, কেউ লাভজনক খাত হিসাবে নাট্যদলে বিনিয়োগ করবে বা শৌখিন দল গড়ে স্বাধীন ও রুচিসম্মত নাট্য-পরিচালনায় সহায়তা করবে। বীরকৃষ্ণের অন্য সমস্যা তার অতিরিক্ত
ইংরেজপ্রীতি। কিন্তু বলতেই হবে, এ ক্ষেত্রে সে সৎ। যে শাসনের আনুকূল্যে তার যাবতীয় চাকচিক্য, তার প্রতি সে তো কৃতজ্ঞ থাকবেই। প্রিয়নাথই বরং অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করেছে। তার যাবতীয় চেতনা আর অনুভূতির উৎস ইংরেজ ও ইংরেজি। আবার শোষণের ফলে সৃষ্ট মানবেতর অবস্থারও সে প্রত্যক্ষদর্শী। এ দুয়ের সমন্বয়মীমাংসা তাকে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়ার কথা। নাট্যকার এ সম্ভাব্য দ্বন্দ্বের ইশারা পর্যন্ত দিলেন না। ইয়ংবেঙ্গলবাবুসমাজ দ্বন্দ্বে ভর করে বাবুটিকে অন্যায্যভাবে পর্যুদস্ত করলেন। প্রিয়নাথের গড়ন নাটকের রাজনৈতিক প্রকল্পকেও নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রথম দৃশ্যে মেথর মথুর তার উচ্চকণ্ঠ উচ্চারণে
শ্রেণি-রাজনৈতিক প্রকল্পের যে ঘোষণা দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত তা আর অক্ষুণ্ন থাকেনি। প্রিয়নাথের শ্রেণিচ্যুতি তাকে অন্তত একবার মথুরের উপলব্ধিতে উপনীত করেছিল। বাংলার নাট্যশালার বিদ্যমান অবস্থা সম্পর্কে প্রিয়নাথের মন্তব্য শুনে বেণীমাধবের হঠাৎ মনে পড়ে: ‘কাল রাত্রে একজন মেথর আমাকে ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিল’(উৎপল ১৯৯৭: ৯২)। শ্রেণিচ্যুত প্রিয়নাথের পক্ষেই কেবল এরূপ উচ্চারণ-সাম্য অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু তার শ্রেণির সেকালের রাজনীতি অনুযায়ী তার নাটকও শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী প্রকল্পেই পর্যবসিত হয়। এর মধ্যে শ্রেণিগত মুক্তির প্রশ্নটা অনুল্লেখ্য থেকে যায়। তিতুমীরকে নাটকের বিষয় হিসাবে গ্রহণ অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ। তিতুমীরের বিদ্রোহ একদিকে প্রান্তবাসীর ভাব-ভাষার এক উৎকৃষ্ট নমুনা; অন্যদিকে ভারতের জাতীয়তাবাদী আখ্যানে অপেক্ষাকৃত কম উল্লেখিত ইতিহাস। কিন্তু প্রিয়নাথের তিতুমীর তার বাস্তবতা থেকে বিযুক্ত হয়ে ভদ্রলোক-সমাজের জাতীয়তাবাদী আখ্যানের খণ্ডিত উপাদান হয়ে ওঠে। আশ্রয় নেয় ‘সোনার ভারত ছারখারে’র প্রচলিত ছাঁচে।
৬
প্রিয়নাথের সংকট আসলে উপনিবেশিতের সংকট। উপনিবেশের সমাজে বিপুল জনতার সাথে নতুন
ভদ্রলোকগোষ্ঠীর বিচ্ছেদ অনিবার্য। এর প্রধান কারণ আরোপিত মতাদর্শ আর চেতনার প্রতাপ। কেবল শিক্ষা আর সহানুভূতি দিয়ে এ দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব নয়। প্রিয়নাথ রিফর্মেশনের আলো বিলাতে চেয়েছে। সবাইকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা দিতে চেয়েছে। কেউ জাগেনি। তার ক্ষোভ: ‘যারা দেখতে চায় না, তাদের দেখাবো কি করে? অন্ধকারের জীবেরা আলো সইতে পারবে কেন’ (উৎপল ১৯৯৭: ৯৫)। কিন্তু যাকে সে ‘আলো’ আর‘অন্ধকার’ বলে সাব্যস্ত করেছে, সেই সংজ্ঞায়নে কোনো গোলমাল আছে কিনা, এ প্রশ্ন সে একবারও তোলেনি। যাদের কল্যাণের জন্য তার জীবনপণ, তাদের নিজেদের কল্যাণের উপলব্ধিটা কেমন, তা সে কখনো জানতে চায়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ দৃষ্টিভঙ্গিতে নাট্যকারের যথেষ্ট সায় আছে। এ প্রসঙ্গে আরেকবার গোরার উদাহরণ টানা যাক। চরঘোষপুরের অভিজ্ঞতা গোরাকে খুবই হতাশ করেছিল। তার মনে হয়েছিল, যাদের নিজেদের কল্যাণ সম্পর্কে কোনো ধারণা নাই, তাদের কল্যাণ কিভাবে সম্ভব? তার উপলব্ধ আলোর পাশে সে দেখতে পাচ্ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার। কিন্তু কোনো জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের সাথে সম্পর্কিত কল্যাণ সম্পর্কে তাদের নিজেদের কোনো ধারণা থাকবে না — এই চিন্তাই তো হাস্যকর। যে শিক্ষা জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা থেকে উৎসারিত নয়, যে শিক্ষা বহিরাগত এবং আরোপিত, সে শিক্ষাই কেবল এমন চিন্তা-পদ্ধতির জন্ম দিতে পারে।
গোরা বিশ শতকের প্রথমাংশের রচনা। এর প্রকল্প বিশুদ্ধতা জাতীয়তাবাদী। টিনের তলোয়ার বিশ শতকের
সাতের দশকের রচনা। এর প্রকল্প শ্রেণি-রাজনৈতিক এবং বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী। কিন্তু আরোপণমূলক ‘আলো’র ধারণা এখানেও রাজত্ব করছে। রাইফেল নাটকে উৎপল দত্ত দেখিয়েছেন, শ্রেণিচেতনাহীন জাতীয়তাবাদ কেবল কাগুজে স্বাধীনতাই হাসিল করতে পারে। জনগোষ্ঠীর মুক্তি দিতে পারে না। প্রত্যক্ষ উপনিবেশের অবসান হলেও শাসকগোষ্ঠী কাজ করে সাম্রাজ্যবাদের দেশীয় এজেন্ট হিসাবে। টিনের তলোয়ারে এ মাপের কোনো প্রকল্পের মুখোমুখিও হতে চাননি নাট্যকার। উনিশ শতকের কাহিনি বলে? ‘আধুনিকতা’ আর ‘রেনেসাঁ’ মিথ মোকাবেলায় কি তিনি যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করতে পারেননি?
ইতিহাসদৃষ্টির এই ধরনই সম্ভবত আমাদের জাতীয়তাবাদী আর শ্রেণি-রাজনীতির প্রধান সমস্যা।
সহায়কপঞ্জি
উৎপল দত্ত ১৯৯৭, নাটকসমগ্র, পঞ্চম খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা
দর্শন চৌধুরী ২০০৭, থিয়েটারওয়ালা উৎপল দত্ত, সাহিত্য প্রকাশ, কলকাতা
দেবেশ রায় ১৯৯০, উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য, প্যাপিরাস, কলকাতা
নীরদচন্দ্র চৌধুরী ১৪০৮, বাঙালী জীবনে রমণী, চতুর্দশ মুদ্রণ, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কলকাতা
বিনয় ঘোষ ২০০০, বাংলার বিদ্বৎসমাজ, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, কলকাতা
মোহাম্মদ আজম ২০১১, ‘গোরার ‘জাতীয়তাবাদী’ প্রকল্পের বিচার’, প্রভাতসূর্য (রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষস্মরণ) গ্রন্থভুক্ত, সম্পাদক:
অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী সম্পাদিত, নবযুগ, ঢাকা
মোহাম্মদ আজম ২০১৪, বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ, আদর্শ, ঢাকা
Guha, Ranajit 1988, An Indian Historiography of India: A Nineteenth-Century agenda and its
implication, K P Bagchi & Company, Calcutta, New Delhi
Memmi, Albert 1976, The colonizer and the colonized, Translated by Howard Greenfeld, Beacon Press,
Boston
Sarkar, Sumit 2000, A Critique Of Colonial India, 2nd edition, Papyrus, Calcutta
Sarkar, Sushovan 1981, Bengal Renaissance And Other Essay, second print, People’s Publishing House,
New delhi
Sen, Asok 1977, Iswar Chandra Vidyasagar and his illusive milestones, Riddhi-India, Calcutta