জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’
মোহাম্মদ আজম
মোহাম্মদ আজম
জীবনানন্দের আর দশ কবিতার মতো ‘আট বছর আগের একদিন’ও সরল চালু শব্দের আয়োজনে বিশিষ্ট। শব্দের অর্থ বোঝার জন্য অভিধান খুলতে হয় না, বাক্যের পদক্রম বোঝার জন্য দ্বিতীয়বার পড়তে হয় না। বোঝাবুঝির ব্যাপারটা অবশ্য ভিন্ন, এবং তার মাত্রা নির্ণয় করাও সহজ নয়। কিন্তু এ কবিতার কথাগুলো পাঠ করে গেলে কিছু ‘বুঝ’, কিছু ‘অনুভব’, কিছু ‘সিদ্ধান্ত’ মনে সঞ্চারিত হয়—সামগ্রিক বোঝাপড়ার আগেই। কথাটা আরেকটু বিশদ করা দরকার। কবিতার কিছু পংক্তি মনোহর ছবি তৈয়ার করে; কিছু পংক্তি বিশেষভাবে সাঙ্গীতিক আবেশে পাঠককে বশীভূত করে। আর শব্দের অভাবনীয় অন্বয়—কবিতার যা কুলগৌরব—তো থাকেই। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা এসব বৈশিষ্ট্যে বিশেষভাবে ধনী। কবিতার সামগ্রিক প্রকল্প—যদি সেরকম কিছু থেকেই থাকে—সম্পর্কে বিশেষ উদ্বিগ্ন না হয়েই এ উপাদানগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ভোগ করা সম্ভব।
উপরে যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বলা হল, জীবনানন্দের বেশিরভাগ ‘ভালো’ কবিতার ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। এটা আসলে তাঁর কবিভাষারই মূল স্বভাব, যে ভাষায় কয়েক দশক ধরে বুঁদ হয়ে আছেন বাঙালি কবি-পাঠক, অথচ ভাষাটির কুললক্ষণ সম্ভবত আজও জুতমতো বিশ্লেষিত হয় নাই। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা দুই জায়গায় বিশেষভাবে আলাদা। এক. কবিতাটি কাহিনিধর্মী। কাহিনিরেখা অনুসরণ করা যায় বা অন্তত অনুসরণের আমন্ত্রণ আছে, এমন কবিতা জীবনানন্দ-সমগ্রে খুব বেশি নাই। দুই. কবিতাটি সুস্পষ্টভাবে এক দার্শনিক সমস্যা তুলেছে, এবং কাব্যিক আয়োজনের সীমা লঙ্ঘন না করেই কিছু সিদ্ধান্তও জানিয়েছে। ‘মানুষ আত্মহত্যা করে কেন?’ এ জাতীয় প্রত্যক্ষ সওয়াল জীবনানন্দের মতো ‘মননশীল’ কবির কাব্যেও খুব সুলভ নয়। আর এ কবিতার সিদ্ধান্ত জানানোর পদ্ধতিও আলাদা। তাহলে সাকুল্যে কথাটা দাঁড়াচ্ছে এই: সরল-সাঙ্গীতিক-চিত্রময় ভাষায় ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা একটি কাহিনি বর্ণনা করেছে; সেই কাহিনিতে একটি দার্শনিক সমস্যা ‘যথাযথ’ মাত্রায় চিহ্নিত হয়েছে, অথচ কবিতায় ‘কাব্যময়তা’র টান পড়েনি। সামগ্রিকভাবে বয়ানরীতির কোন কোন গুণে এটা সম্ভবপর হল, তার খোঁজখবর নেয়াই বর্তমান রচনার লক্ষ্য।
২.
উচ্চারণভঙ্গির দিক থেকে এ কবিতার সুস্পষ্ট তিন ভাগ। প্রথম ভাগটি শুরু হয়েছে বেশ নাটকীয়ভাবে—আচানক এক অপঘাত-মৃত্যুর খবর দিয়ে। খবরটা অন্যদের কাছ থেকে পাওয়া। ‘শোনা গেল’ কথাটা পরিষ্কারভাবে জনশ্রুতির ইশারা দেয়, যদিও পরের অংশের অনুপুঙ্খ বিবরণীর নিশ্চয়তা ঠিক জনশ্রুতিতে সম্ভব নয়। এ এমন এক মানুষের বয়ান, যে কিনা অনুসন্ধানী প্রতিবেদকের ঔৎসুক্যে আর সক্রিয়তায় পুরো ঘটনার তদন্ত করেছে। এই আত্মহত্যা সম্পর্কে লোকে যা বলে, জনমানুষের মনে যেসব প্রশ্ন-কৌতূহল-সিদ্ধান্ত বিস্ময় ও রহস্যময়তার সঙ্গে মিশে গিয়ে আমজনতার ভাষ্য হিসাবে জারি আছে, তাকে পরম মূল্য দিয়েই বিবরণীটি তৈরি হয়েছে। কিন্তু কবি কথাগুলো নিপুণভাবে সম্পাদনা করেছেন। নিজের ঝোঁক বা পক্ষপাত গোপন করেননি। বলা যায়, দশের এক হয়েই তিনি নিজ দায়িত্বে কথাগুলো উপস্থাপন করেছেন। তাতে নিজের স্বর এতটাই প্রভাবশালী হয়েছে যে, দ্বিতীয় পর্বে যাওয়ার আগে কথাগুলো যে কথক-কবির একান্ত নয় তা মনোযোগেই আসে না।
দ্বিতীয় ভাগটি নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে ‘শোনো’ অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। শব্দটিকে আলাদা পংক্তির মর্যাদা দেয়ায় পরের তুলনামূলক লম্বা পংক্তির ‘কোনো’র সঙ্গে দারুণ এক অন্তমিলের সাঙ্গীতিকতা পাওয়া গেছে; কিন্তু একই সঙ্গে আলাদা পংক্তির আলাদা অবস্থান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বয়ানধারায় তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। কথক-কবি এবার নিজের জিম্মায়, নিজের জবানিতে, নিজের কথা বলবেন। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ অংশে দুটি ভিন্নতা পাওয়া যায়: অংশটি বিশ্লেষণাত্মক এবং মন্তব্যপ্রবণ। দুটি প্রায় সমান, প্রায় একই গড়নের স্তবক আছে এ অংশে। প্রথমটিতে নৈর্ব্যক্তিক বিবরণীর চেয়ে আত্মহন্তা ব্যক্তির বাস্তবতা প্রাধান্য পেয়েছে। দ্বিতীয় স্তবকে আছে সামান্য বিবরণ, যদিও শেষ পর্যন্ত তা ওই ব্যক্তির পরিণতিতে গিয়েই থেমেছে। দুই স্তবকের শেষ তিন পংক্তি যে একই, আমরা পরে দেখব, তা মোটেই কাকতালীয় নয়।
ছোট দুই স্তবকের শেষ অংশে কবি হাজির হয়েছেন ‘আমি’ হয়ে। ‘আমি’ অবশ্য আগেও আছে। তবে আড়ালে। উত্তম পুরুষের ক্রিয়াপদে। দ্বিতীয় অংশে আছে ‘আমাদের’। দুই বার। শব্দটি ঘোষিতভাবেই আত্মহন্তা ব্যক্তিসহ পুরা মানবসমাজকে কবির প্রকল্পের অংশ করে নেয়। কিন্তু তৃতীয় অংশের ‘আমি’ স্পষ্টতই আলাদা। প্রথম দুই অংশের ‘আমি’ বা ‘আমরা’র ধারাবাহিকতায় এই ‘আমি’কে পাঠ করা মুশকিল। জীবনানন্দের কবিতায় শেষ পংক্তিগুচ্ছ সাধারণত ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই শেষ হয়। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার শেষাংশ বাহ্যত ধারাবাহিক, কিন্তু অন্তর্গত মেজাজে বিপরীত আর শ্লেষাত্মক।
৩.
আত্মহত্যার প্রতি এই কথক-কবির দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? এক কথায় বলা মুশকিল। আত্মহন্তার পরিণতি প্রকাশের জন্য যে শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে, আলঙ্কারিকতার যে ধরনের এনতেজাম করা হয়েছে, তাতে অনুমোদনের চিহ্ন নাই। এই বিবরণীতে প্রাধান্য পেয়েছে ‘লাশকাটা ঘর’। বিবরণীটিকে ‘বাস্তববাদী’ বলা যায় না। যদি ওই ব্যক্তির পরিবার-পরিজন থেকেই থাকে, এবং পরিজনের সঙ্গে সে ‘প্রেম’ বা ‘আশা’র মতো স্বাভাবিক সম্পর্কে সম্পর্কিত থাকে, তাহলে মৃত্যুর পর আবেগ-অনুভূতির কিছু প্রকাশ হওয়ার কথা। কবি তার ধারে-কাছেও যান নাই। লাশটিকে সোজা নিয়ে তুলেছেন লাশকাটা ঘরে। কবিতাটি যে শুরু হয়েছে লাশকাটা ঘরে, তা দৈবচয়ন নয়। অর্থাৎ এমন নয় যে, শুরু করার অনেকগুলো বিকল্প থেকে কবি যাচ্ছেতাইভাবে একটিকে বেছে নিয়েছেন। বরং এই মৃতের পরিণতিবাচক যে ইমেজ অন্তত বার দুয়েক ব্যবহৃত হয়ে কবিতাটির ভাবগত কাঠামোর একাংশ নির্মাণ করেছে, এ নির্বাচন তার সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ। ইমেজটিতে কবি প্লেগগ্রস্ত ইঁদুরের উপমা এনেছেন:
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর।
বোঝাই যাচ্ছে, এ বিবরণ লাশকাটা ঘরে রাখা লাশের ‘বাস্তব’ বিবরণ নয়। বরং গভীর বাস্তবতা প্রকাশক এক্সপ্রেশনিস্ট ছবি। আত্মহত্যার পরিণতি সম্পর্কে কবির অনুমোদনহীন মনোভাবের বিকট প্রকাশ ঘটেছে এই ছবিতে। অন্যত্র এ ছবিটিই একটু অন্যভাবে ব্যবহৃত হয়েছে:
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো
মর্গে—গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে!
ততক্ষণে প্রকৃতির আর মনুষ্যেতর প্রাণীর গভীর জীবনতৃষ্ণার একরাশ উদাহরণ দেয়া হয়ে গেছে। বিপরীতে স্থাপিত হয়েছে এক জীবনবিমুখ ব্যক্তি। তার উদ্দেশ্য ছিল—হয়ত—মরে গিয়ে বাঁচা। কিন্তু উপরের বাঁকাহাসিমাখা ছোট্ট পংক্তি তিনটি পরিষ্কার সাক্ষ্য দেয়—অন্তত কথক-কবির বিবেচনায়—সে লক্ষ্য হাসিল হয় নাই।
তার মানে এ নয়, এই নিপুণ কথক লোকটির মুক্তিলাভের উদ্যমকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। বরং ঘটেছে তার উল্টো। এই শোচনীয় পরিণতির কথা লোকটির অজানা ছিল না। তবু একগাছা দড়ি হাতে সে এগিয়ে যায় মরণের দিকে। তার মানেই হল, তার ‘মানবীয় পরিস্থিতি’ জীবন চালিয়ে নেয়ার উপযোগী ছিল না। পরম যত্নে ও কুশলতায় কবি এই পরিস্থিতির ভাষ্য তৈয়ার করেছেন।
তিন দফায়। কবিতাটির যে তিন অংশের কথা আগে বলা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই পরিস্থিতি বর্ণিত হয়েছে। প্রথমাংশের বর্ণনা কতকটা অনিশ্চিত মেজাজের, আর রহস্যময়। বলা হয়েছে, লোকটি হয় বহুদিন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছিল, অথবা এইমাত্র ঘুম থেকে জেগে পঞ্চমীর চাঁদের আলোয় ‘ভূতে’র মন্ত্রণায় আত্মহত্যার প্ররোচনা পেয়েছে। যে মন্ত্রণা বস্তু-পৃথিবী অথবা যুক্তির দুনিয়া থেকে পাওয়া নয়, যে অনুভবের জন্ম ব্যক্তির বোধ-বোধির অতল গভীরে, সেই বিমূর্ততা ছবিতে মূর্তিমান হয়েছে ভূতের কারসাজিতে। ভূত আছে এবং নাই; ভূত দেখা যায় এবং দেখা যায় না। যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে, এবং দৃশ্যত—আমরা পরে দেখব—কোনো কারণ ছাড়াই, তার মন ভূতগ্রস্ত তো বটেই। কিন্তু জীবনানন্দ কথাটা বলেন ছবি বানিয়ে। ছবিতে বস্ত-দুনিয়ার কায়দা-কানুন অক্ষুণ্ণ রাখেন। বাস্তবের যুক্তি অনাহত রেখেই ছাড়িয়ে যান চেনাজানা বাস্তবের সীমানা। যেমন ভূত দেখার ইনতেজাম করলেন তিনি জ্যোৎস্নায়, যাকে রহস্যময় আলোজনিত বিভ্রম ভাবার যথেষ্ট সুযোগ আছে; আর জ্যোৎস্না মিলিয়ে যাবার পর আমদানি করলেন নতুন বিস্ময়:
চাঁদ ডুবে চলে গেলে—অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো-এক নিস্তব্ধতা এসে।
‘অদ্ভুত’ কথাটা কর্তার মনোভঙ্গির দিক থেকে পাঠযোগ্য, কিন্তু এর বস্তু ও বাস্তব গুণও উপেক্ষণীয় নয়। এইমাত্র জ্যোৎস্নায় গত হয়েছে, রেশ এখনো মিলিয়ে যায়নি; সে রেশের অবশেষ আঁধারের রূপকে করে তুলতে পারে বিভ্রমময়। এই বিভ্রমে মূর্তিমান হতে পারে বিমূর্ত ‘নিস্তব্ধতা’—উটের গ্রীবার বেশে। জীবনানন্দের এই বিখ্যাত উপমা নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। এখানে শুধু নিস্তব্ধতায় প্রাণযোগের কথা বলতে চাই। সশব্দ হয়ে ওঠার কথা বলতে চাই। [তুলনীয়: শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে।] এই নিস্তব্ধতা চলে এবং বলে। লোকটির অন্তরের সপ্রাণ অস্তিত্ব মরণের বার্তা নিয়ে আসে।
দ্বিতীয় অংশে লোকটির আত্মহত্যাকালীন পরিস্থিতির যে পরিচয় আছে তা মেজাজের দিক থেকে নিশ্চিত, কিন্তু খুব যে স্পষ্ট তা বলা যাবে না। বিবরণীটিতে সাধারণীকরণের ঝোঁক পরিষ্কার:
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়—
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
এ ব্যক্তি, দেখা যাচ্ছে, সে গোত্রের যারা অস্তিত্বের গভীরে বিপন্নতা বোধ করে, যাদের অপ্রতিরোধ্য ক্লান্তির ভার বইতে হয়। কবিতার তৃতীয় অংশ সাক্ষ্য দেয়, মানুষমাত্রই এ বিপন্নতা, এ ক্লান্তির অংশীদার নয়। কেউ কেউ এই দুর্বহ নিয়তির ভাগিদার হয়। ওই নিয়তির দায় মেটাতে গিয়েই অর্থহীন পরিণতি মেনে নিতে বাধ্য হয়। লাশকাটা ঘরে প্লেগগ্রস্ত ইঁদুরের পরিণতি মেনে নিয়ে সে হয়ত অধিকতর শোচনীয় জীবিতদশার সাথে আপসরফা করে। তার আত্মহনন তখন শুধু বৈধই হয় না, প্রয়োজনীয়ও হয়ে ওঠে।
৪.
দেখা যাচ্ছে, এ কবিতার পক্ষ-বিপক্ষ শুধু জোরালোই নয়, প্রয়োজনীয়ও বটে। এই বৈপরীত্যের—দ্বন্দ্বমূলকতার—ভাবগত দিক আছে, শৈলীর দিকও আছে। বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, পুরো কবিতার শরীরী ও অন্তরের প্রতিভা দাঁড়িয়ে আছে এই দ্বন্দ্বমূলক উপস্থাপনার বিচিত্র বিন্যাসের ভিতে। প্রথমে শরীরী প্রতিভার দিকে নজর দেয়া যাক।
প্রথম স্তবকেই আমরা পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে যাওয়ার সংবাদ পাই। আট বছর আগের ওই ‘দিন’টি অমাবস্যার হতে পারত, এমনকি পূর্ণিমারও। চাঁদের বা দিনের আলোয় আত্মহত্যা বিশেষভাবে না-জায়েজ নয়। তবে এ কবিতায় কাজটা গলায় দড়ি দিয়ে করার বিশেষ দরকার ছিল। উদ্বন্ধনে মৃত্যু হলে শরীর বিকৃত হয়। কবি মৃতদেহের ইমেজে যে বীভৎস কারুণ্য ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন, তার জন্য এ ধরনের বিকৃতি সম্ভবত সহায়ক হয়েছে। ঘোর গ্রামে অশ্বত্থ গাছের ডালে ঝুলে পড়ার জন্য অন্ধকারের আড়াল দরকার হওয়ার কথা। কবি বেছে নিয়েছেন এমন তিথি যখন জ্যোৎস্নার ‘ভূত’ আর ‘প্রধান আঁধার’ দুইই পাওয়া যায়। এ কবিতায় দুটিই নিঃশেষে ব্যবহৃত হয়েছে।
চাঁদ ডুবে গেলে পরে ‘মরিবার সাধ’ হওয়াকে আলো-আঁধারের প্রথানুগ ব্যবহার বলা যায়। তবে এ ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্ত নেয়ার উপায় নাই। জীবনানন্দের অন্য অনেক কবিতার তুলনায় এ কবিতা কম বর্ণিল। সাদা-কালো ছবিই বেশি। এর মধ্যে সোনালি রঙের ব্যবহার আছে দুবার: ‘সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা ...’ এবং ‘জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে ...’। দুটিই মনোরম ছবি। গ্রাম-বাংলার নিত্য অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে ছবি দুটি খুবই বাস্তবসম্মত, আবার উপস্থাপনার সরল মুনশিয়ানায় দারুণ কাব্যিক। আমাদের জন্য এখানে জরুরি তথ্য হল, রঙিন দুটি ছবিতেই আলোক উজ্জ্বলতা জীবনের জয়গান প্রচার করেছে। আলোর এ ব্যবহার শুধু কাব্যজগতেই প্রথাগত নয়, দৈনন্দিন ভাষার জগতেও সুলভ। কিন্তু জীবনানন্দ এরকম সরল সমীকরণে ভাবতে দেন না। বরং চিন্তার এ ধরনের সরল কোনো সূত্র যদি জমে উঠতে চায়, তাকে বিস্রস্ত করে দিয়েই এগিয়েছে কবিতাটির বয়ান। লোকটি চাঁদ-ডোবা অন্ধকারে মৃত্যুর নিস্তব্ধতা দেখেছে, আর জ্যোৎস্নায় দেখেছে ভূত—এ দুই তথ্যই সরল কোনো সমীকরণের সম্ভাবনা শেষ করে দেয়। তবে ছকটি জটিলতর হয়ে উঠেছে অন্ধকারে জীবনোল্লাস প্রকাশের দুই আয়োজনে মধ্য দিয়ে। একটি আয়োজন মশাকে ঘিরে। মশারির বাধা ডিঙানোর জন্য মশাদের সামষ্টিক সংগ্রাম উপস্থাপিত হয়েছে আঁধারে সংঘটিত জীবনের আলো হিসাবে। অন্য উদাহরণটি পেঁচার। আমরা পরে দেখব, পেঁচার দৃষ্টান্ত কবিতাটিতে নির্মিত বাস্তবতা ও যুক্তি-উপস্থাপন-শৈলীর অনন্য নমুনা হিসাবে পাঠযোগ্য। আপাতত বলা যাক, চাঁদ-ডোবা অন্ধকার ওই ব্যক্তির জন্য মরণের বার্তা বয়ে আনতেও পারে, অন্য অনেক অস্তিত্বের জন্য স্থবিরতার কারণ হতে পারে, কিন্তু পেঁচার জন্য তা সর্বার্থেই আশার স্মারক। আলো পেঁচার শত্রু—এই সাধারণ সত্য কবিতার আর-আর আবহের সঙ্গে মিলিয়ে নির্মিত হয়েছে বৈপরীত্যের তাৎপর্যপূর্ণ ছবি।
অন্তরের সত্যের দিক থেকেও কবিতাটির উপস্থাপনা গভীরভাবে দ্বন্দ্বমূলক। প্রথম চার স্তবকে মৃত্যুর ফিরিস্তি শেষ করেই কবি প্রবেশ করেছেন জীবনোল্লাসের তালিকায়। এখানে পেঁচা, ব্যাঙ, মশা, মাছি, ফড়িং, অশ্বত্থ গাছ আর জোনাকির কথা আছে। প্রতিটি ছবিই প্রাত্যহিক বাস্তবের নিপুণ বিবরণী। নির্বাচিত জুতসই বিশেষণের প্রয়োগে ছবিগুলো বিচিত্র ‘বিকীর্ণ জীবনে’র কথা বলে। জীবনানন্দের কবিতার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য এই—তিনি অবলম্বন করেন নিত্যদিনের বাস্তব, আবিষ্কার করেন বাস্তবের সূক্ষ্মতম বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক সত্য, আর আবিষ্কৃত ওই বিশেষ থেকে পৌঁছান সার্বিক সিদ্ধান্তে। এরকম সার্বিক সিদ্ধান্তজ্ঞাপক একটি মন্তব্য এই:
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের—মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা
এ পংক্তির ‘ফড়িং’ ও ‘দোয়েল’ বিপুল-সংখ্যক প্রাকৃতিক উপকরণ ও মনুষ্যেতর প্রাণীর ডাকনাম মাত্র; আর ‘মানুষ’ কথাটা আত্মহন্তা ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য থেকে পাওয়া সার্বিক সত্তা। যে বৈপরীত্য আর দ্বন্দ্বমূলকতার ঢঙে আগের বিবরণীটি তৈরি হয়েছে, সিদ্ধান্তবাক্যটিও নির্মিত হয়েছে সে একই ঢঙে।
জীবনানন্দের কবিতায় ড্যাশের প্রাচুর্যের অন্যতম প্রধান কারণ ‘বিশেষ’কে উপস্থাপনার চাপ। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে চান যৌক্তিকভাবে, অভিজ্ঞতাবাদীদের মতো বিপুল তথ্য-উপাত্ত থেকে। তাই উদ্ধৃত তথ্য-উপাত্তের পাশে রেখে দেন ড্যাশের নীরবতা, যা না-বলা সমধর্মী অনেক তথ্যের প্রতিনিধিত্ব করবে। যখন বলা হয়, ‘নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ—নয় সবখানি’, তখন আসলে পরের সিদ্ধান্তের জন্য একটা ভিত্তিবাক্য তৈয়ার হয়। এ ভিত্তিবাক্যের নামশব্দ চারটি ভিত্তিহীন নয়। ওগুলো এসেছে কবিতার আগের অংশের বয়ান থেকে। কিন্তু তবু সার্বিক সিদ্ধান্তের জন্য উপাদান চারটিকে কবি যথেষ্ট মনে করেননি। প্রতিটির ডানে ড্যাশ বসিয়ে তৈরি করেছেন পরিসর, যেখানে সমধর্মী অনেক অকথিত উপাদান নৈঃশব্দ্যের মধ্যে অবস্থান করে।
বলে রাখা ভালো, পুরো ব্যাপারটিই এক ধরনের ‘বাস্তববাদিতা’র সঙ্গে যুক্ত, বিশেষ রকমের ‘বস্তুবাদিতা’র সঙ্গে যুক্ত। বস্তুগত উপাদান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে স্পর্শযোগ্য বা উপলব্ধিযোগ্য বাস্তবের নিকটবর্তী থাকা—সে বাড়ির কাছের ঘাস-ফুল-লতা-পাতা হোক আর হংকং, মিশর বা পুরানা দুনিয়ার কোনো উপকরণ হোক, এবং সে উপাদানের বস্তুধর্ম মান্য করে কাব্যকলা উদ্ভাবন করা জীবনানন্দের কবিতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ‘আট বছর আগের একদিন’ থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করা যাক:
অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলেনি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার!—
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’
জানায়নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?
এ অংশটিতে কয়েকটি উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে—অশ্বত্থ, জোনাকি, পেঁচা, চাঁদ, ইঁদুর। উপাদানগুলো যে নিপুণ ভাবগত ঐক্যে বিন্যস্ত হয়েছে তা বস্তুত অসাধারণ। কিন্তু প্রথমেই বিশেষভাবে চোখে পড়ে স্থানগত ঐক্য। বিজন মাঠের এক অশ্বত্থ গাছের ডাল বাতাসের স্বাভাবিক প্রবাহে সাড়া দিয়ে দুলতে পারে, এবং সে দুলুনি হাতনেড়ে বা মাথানেড়ে ‘না’ বলার সমার্থক গণ্য হতে পারে। এ ধরনের জায়গা দলবদ্ধ জোনাকির অবাধ বিচরণক্ষেত্র। পেঁচা আর ইঁদুরেরও স্বাভাবিক আবাস। এখন এই সবগুলো উপাদান একত্রে যদি একটা চলচ্ছবি তৈয়ার করে, যদি এর মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় উপাদান হিসাবে—মূল ফোকাস হিসাবে—দড়ি-হাতে আত্মহত্যা করতে যাওয়া লোকটিকে যোগ করা হয়, তাহলে আমরা উপরের কবিতাংশে বর্ণিত ‘স্বাভাবিক’ ছবিটি পাব। স্বাভাবিক এ অর্থে যে, উপাদানগুলোর স্থানান্তর বা পুনর্বিন্যাস ব্যতীতই এ ছবি সম্ভবপর। বলা যায়, কবিতাংশটি প্রাথমিকভাবে বাস্তবের সীমা আক্ষরিক অর্থে মান্য করেই নির্মিত হয়েছে। সবগুলো ছবিই উপস্থাপিত হয়েছে আত্মহত্যার বিপরীতে জীবনের ‘তুমুল গাঢ় সমাচার’ হিসাবে। আগে ব্যাঙ, মশা, মাছি বা ফড়িঙের যেসব ছবি ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে এ অংশের একটা গোড়ার ফারাক আছে। ওই ছবিগুলোও প্রাত্যহিক বাস্তব থেকে নেয়া। উপাদানের বস্তুধর্ম রক্ষা করেই বানানো। কিন্তু ওগুলো অন্তত বাংলা অঞ্চলের মানুষের অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে সর্বস্থানিক এবং সর্বমানবিক। উপস্থাপনের ধরনটাও সেরকম। আর উপরে উদ্ধৃত অংশটি বিশেষ স্থান-কালে এক ব্যক্তির বিশেষ মানসিক অবস্থার বাস্তবতায় নির্মিত। এই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে কবি এরপর অনায়াসেই বলতে পারবেন, এসব প্রাণচঞ্চল উপভোগ্য উপাদানগুলো কখনো কখনো অর্থহীন হয়ে ওঠে। যেমন হয়েছিল এ লোকটির ক্ষেত্রে, আট বছর আগে।
জীবনানন্দের কবিতা বাস্তববাদী নয়, কিন্তু—দেখা যাচ্ছে—তিনি বাস্তবের ভিত্তিতেই কথা গড়েন। বাস্তবকে উপস্থিত করেন দ্বান্দ্বিক মেজাজে, আর বক্তব্যকে গ্রাহ্য করতে প্রায় প্রাবন্ধিক গদ্যের ধরনে যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাঁর কবিতার বহু-ব্যবহৃত ‘তবু’ আর ‘তাই’ যথাক্রমে দ্বান্দ্বিক মেজাজ আর যৌক্তিক বিবরণীর চিহ্ন হিসাবেই পাঠযোগ্য।
৫
ঘটনা ঘটার বহুদিন পর কবি এই আত্মহত্যা-বিষয়ক সন্দর্ভ রচনা করেছেন। রচনাভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, তিনি ভাবনাচিন্তার জন্য যথেষ্ট সময় নিয়েছেন। বিচিত্র সম্ভাব্য দিক খতিয়ে দেখেছেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—এ সম্পর্কে কোনো স্থির সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। খুবই মার্জিত চৌকস এক ভঙ্গিতে তিনি তাঁর কথাগুলো উপস্থাপন করেছেন। বস্তুত, উপস্থাপনার বিশিষ্ট ভঙ্গির কারণেই কেবল কথাগুলো কার্যকরভাবে বলা গেছে।
বিবরণীটি আছে আমাদের আগে-বলা দ্বিতীয় অংশে। দুই স্তবকে। প্রথম স্তবকে বলা হয়েছে, এই ব্যক্তি জাগতিক প্রাপ্তির বর্ণাঢ্যতায় জীবনযাপন করছিল। তার জাগতিক অভাব-অনটন ছিল না। আবেগ ও মননের অভাবজনিত সঙ্কটও ছিল না। সবকিছুর পরও সে আত্মহত্যা করেছে। এ স্তবকের সিদ্ধান্তটি খুব মজার। বলা হচ্ছে, তার কোনো সমস্যা নাই বলেই সে আত্মহত্যা করেছে: ‘তাই/লাশকাটা ঘরে/চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।’ পরের স্তবকে কারণ ব্যাখ্যার চেষ্টা আছে। স্তবকটি কথা বলেছে সাধারণ সূত্রের মতো করে। বলেছে, মানুষের জাগতিক প্রাপ্তিকে তার চূড়ান্ত মোক্ষ ভাবার কোনো কারণ নাই। সব থাকার পরও এক ‘বিপন্ন বিস্ময়’ তাকে অভিভূত করতে পারে। সব থাকা যেমন ক্লান্তির জন্ম দিতে পারে, তেমনি ওই বিপন্নতাও ঘাতক ক্লান্তির জন্ম দিতে পারে। পরিণতি একই—আত্মহত্যা। আগের স্তবকের কথাগুলো এ স্তবকেও সিদ্ধান্ত-বাক্য হিসাবে বলা হয়েছে। ‘তাই’ অব্যয়টি প্রমাণ করে, কবি যৌক্তিক সিদ্ধান্তই নিতে চেয়েছেন। কিন্তু দুই কার্যকারণের একই পরিণতি প্রমাণ করে, কোনো একাট্টা সিদ্ধান্ত নেয়া মোটেই সম্ভবপর নয়।
কারণ অনুসন্ধানের স্তবক দুটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য হল, কী কারণে লোকটি আত্মহত্যা করে নাই, তা সাড়ম্বরে বলা হয়েছে; কিন্তু কী কারণে করেছে তার স্থিরনির্দিষ্ট নির্দেশনা নাই। দ্বিতীয় স্তবকের ‘বিপন্ন বিস্ময়’কে এবং তজ্জনিত ক্লান্তিকে যদি কারণ হিসাবে ধরি, তাহলে কারণটি এতই অনির্দিষ্ট এবং বিমূর্ত হয় যে, একে ঠিক কারণ বলা যায় না। বরং কারণ নির্ণয় করা যে দুরূহ, সে বোধই প্রবল হয়ে ওঠে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র বিখ্যাত ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পে এ ধরনের কৌশল পাওয়া যায়। তুলসী গাছটি কেন উপড়ে ফেলা হল না, কিংবা গোপনে কে এর যত্ন নিচ্ছে, তার তদন্ত গল্পের এক পর্যায়ে জরুরি হয়ে উঠেছিল। তখন বলা হল, কারণটি এরকম নয়, ওরকম নয়, সেরকমও নয়। কিন্তু কী রকম তা আর বলা হল না। তাতে করে ওই না-বলা কারণটাই হয়ে উঠল গল্পের গভীরতর মূল। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার ক্ষেত্রেও এ ধরনের কাব্যকৌশলের কারণে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, মানুষের আত্মহত্যার যতগুলো কারণ কল্পনা করা যায়, যতগুলো কারণ অতীত ইতিবৃত্ত বা বাস্তব তথ্য-উপাত্ত থেকে শনাক্ত করা যায়, এ লোকটি তার বাইরের কোনো কারণে আত্মহত্যা করেছে। ঠিক এখানে এসে কবিতাটি আর বিশুদ্ধ আত্মহত্যার কবিতা থাকছে না। বরং হয়ে উঠছে মানুষ-বিষয়ক এক নিগূঢ় সন্দর্ভ। কারণ আত্মহত্যার কারণজনিত এই অনির্দিষ্টতা স্পষ্টতই প্রমাণ করে, মানুষ সম্পর্কে বস্তু বা যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে নেয়া সম্ভব নয়। ইতর প্রাণী সম্পর্কে নেয়া যায়। প্রকৃতি সম্পর্কে নেয়া যায়। মানুষ সম্পর্কে নয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। এ মানুষ কোন মানুষ? কী তার ভাব-স্বভাব?
কবিতাটিতে মানুষ সম্পর্কে একটি সাধারণ সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রবণতা আছে। ‘আমরা’, ‘মানুষ’ ইত্যাদি শব্দের বিচিত্র ব্যবহারের মধ্যে তা স্পষ্ট। কিন্তু এই ‘মানুষে’র মধ্যে সব মানুষ সম্ভবত অন্তর্ভুক্ত নয়। কবি সরাসরি মানুষকে ইতর প্রাণী থেকে আলাদা করে নিয়েছেন। ঠিক তেমনি ‘বিপন্ন বিস্ময়’ বোধ-করা মানুষদের থেকেও বিপুল আম-জনতাকে আলাদা করেছেন। ব্যাপারটি বিশেষভাবে ঘটেছে কবিতার শেষ-অংশে।
কবিতার তৃতীয় অংশের জটিলতা আর দ্ব্যর্থকতার মূলে আছে ‘আমি’। এ ‘আমি’ পেঁচার সাথে একাত্ম হয়ে ‘দুজন’ তৈরি করলে হিসাবটা আরো জটিল হয়ে যায়। ফলে ভিন্ন রকম পাঠ তৈরি করা ছাড়া উপায় থাকে না। প্রাথমিকভাবে এ ‘আমি’ কথক ‘আমি’ই বটে। আগেই বলা হয়েছে, তিন পর্বে কথক-কবির অবস্থান তিন রকমের। প্রথমে একজন অনুসন্ধানী তৃতীয় পক্ষ—আম-জনতার একজন হয়েও সক্রিয়তায়-লিপ্ততায় আলাদা, কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ নয়। দ্বিতীয় ‘আমি’ এ স্তর ছাড়িয়ে উঠে গেছে অনেকদূর—ঠিক কবি অথবা সৃষ্টিকর্তার বার্তবাহকের মতো। সিদ্ধান্ত জানিয়েছে কোনো রাখ-ঢাক ছাড়া, নিশ্চিন্ত মেজাজে। মনে রাখা দরকার, ওই সিদ্ধান্তের যে রহস্যময়তা, তা কিন্তু বলা হয়েছে রহস্য না-রেখেই; যে অস্পষ্টতা, তা বলা হয়েছে স্পষ্ট করে। তৃতীয় অংশের ‘আমি’ আসলে নেমে গেছে জনতার কাতারে। মানুষের স্বাভাবিক-সাধারণ জীবনস্পৃহা ও চৈতন্য প্রকাশ পেয়েছে এই ‘আমি’র সংক্ষিপ্ত তীর্যক জবানিতে। পেঁচা-প্রসঙ্গের নিপুণ ব্যবহারই এই ‘আমি’র সংজ্ঞায়ন ঠিক করে দিয়েছে।
পেঁচা প্রথমবার এসেছে ইতর প্রাণীগুচ্ছের একটি হয়ে। ব্যাঙ, মশা, মাছি ও ফড়িঙের সহযাত্রী হয়ে। কিন্তু প্রথম উল্লেখেই পেঁচা আলাদা অস্তিত্বেরও জানান দিয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তবুও তো পেঁচা জাগে’। এ উল্লেখ স্বয়ং কোনো অর্থ প্রকাশ করে না, যেখানে মশা বা মাছির প্রসঙ্গগুলো বিস্তারিত বিবরণীর সুবাদে নিজেরাই অর্থবহ হয়ে ওঠে। পেঁচা-সম্পর্কিত এই সংক্ষিপ্ত পংক্তিটি কেবল তখনই অর্থবহ হয়, যখন আগের চাঁদ-ডোবা প্রসঙ্গটিকে মিলিয়ে পড়া হয়। দ্বিতীয় উল্লেখে সে কথাটিই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। চাঁদ ডুবে অন্ধকার হলেই কেবল পেঁচার জীবন শুরু হয়। তার মানেই হল, অন্ধকার কোনো সর্বজনীন অর্থ বহন করে না, যেমন করে না আলো। দ্বিতীয় উল্লেখে ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে’ পংক্তিতে দুটি নিরীহ কিন্তু কার্যকর বিশেষণ ‘বুড়ি’ আর ‘বেনো’ পেঁচার প্রচণ্ড জীবনতৃষ্ণাই প্রকাশ করে এবং পেঁচাকে তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। কবিতার শেষাংশে এই প্রতিষ্ঠিত চরিত্রের সুবিধাই নিয়েছেন কবি। শেষ অংশে পেঁচা প্রসঙ্গে ‘চোখ পালটায়ে কয়’ ইত্যাদি উল্লেখ চরিত্রটিকে আরো দৃঢ় ভিত্তি দেয়। কী সেই ভিত্তি?—
নিঃশর্ত জীবনতৃষ্ণা। মন ও মনন-নিরপেক্ষভাবে অভ্যস্ত পুনরাবৃত্তি আর জৈবিক চাহিদার পরিপূরণই সে জীবনতৃষ্ণার মূলকথা। এ চরিত্রের সমতলে নেমে এসে ‘আমি’ চরিত্রটি আসলে মানুষের মধ্যেও সমধর্মী জীবনতৃষ্ণার প্রতিনিধিত্ব করেছে। আর এভাবে আলাদা হয়ে গেছে ওইসব মানুষ থেকে, যারা অন্তর্গত রক্তের ভিতর বিপন্ন বিস্ময় অনুভব করে।
‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অতিশয় প্রকট। একে পুরুষের দৃষ্টিতে, পুরুষ নিয়ে পুরুষের জন্য লেখা কবিতা বলা যেতে পারত। কিন্তু দ্বিতীয় অংশে—সাধারণীকৃত ধারণা সিদ্ধান্ত আকারে উপস্থাপিত হয়েছে যেখানে—‘নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ’ ইত্যাদি উচ্চারণ নারীকে এ কবিতার দুনিয়া আর আবহ থেকে সম্পূর্ণ বাইরে ঠেলে দেয়। প্রতিষ্ঠা করে এক পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকাঠামো। ‘ক্যাম্পে’, ‘বোধ’ ইত্যাদি কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে এ পুরুষতন্ত্রের দোসর জীবনানন্দের কবিতায় আরো অনেক মিলবে। অন্যদিকে আবার এ কবিতা গভীরভাবে মানবকেন্দ্রিক [এনথ্রোপসেন্ট্রিক]। মনুষ্যেতর প্রাণীর সঙ্গে মানুষের প্রভেদ নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এখানে। শুধু তাই নয়। এই ‘প্রকৃতির কবি’ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের পার্থক্য প্রতিষ্ঠা করে মানবপ্রকৃতির এক অন্যতর মাত্রার জানান দিয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক মানবকেন্দ্রিকতা আর প্রকৃতির বিপরীতে মানুষকে প্রতিষ্ঠা করার এ উদ্যোগ একটি খাঁটি ‘আধুনিকতাবাদী’ কাব্যপ্রকল্প। সমধর্মী গভীর আধুনিকতাবাদী আরো নানা বৈশিষ্ট্য জীবনানন্দের কবিতায় সুলভ।
তিরিশি কবিদের সামগ্রিক কাব্যপ্রকল্পের সঙ্গে জীবনানন্দের পার্থক্য ক্রমশ অধিকতর পষ্ট হয়ে উঠছে। কিন্তু আধুনিকতাবাদী জীবন ও শিল্পবোধের কিছু বনিয়াদি উপাদানে এঁদের মিলও উল্লেখযোগ্য। পার্থক্য এই যে, অন্যরা যেখানে আধুনিকতার উপাদানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘোষণা আকারে পেশ করেছেন, জীবনানন্দ সেখানে অবলম্বন করতে চেয়েছেন—করতে পেরেছেন—পরোক্ষতা; রূপকল্পের অসামান্য সব আয়োজনে বলার বদলে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন বোধ-বোধি। এ ধরনের এক পুনরাবৃত্ত আয়োজন ‘ক্লান্তি’।
‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার যেসব পাঠক একে ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’র কবিতা বলেছেন, তাঁরা আসলে খুব বাড়িয়ে বলেননি। বস্তুত ক্লান্তিজনিক সঙ্কটের কারণে আত্মহত্যা যদি বৈধ হয়, তাহলে খোদ ক্লান্তিরই মহিমায়ন ঘটে। আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর যদি এক বিপন্ন বিস্ময় খেলা করেই থাকে, তবে তা থেকে শুধু ক্লান্তি নয়, অন্য নানা রস জন্মানোরও সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু জীবনানন্দ বিশেষভাবে ক্লান্তি আবিষ্কার করেছেন—বিপন্ন বিস্ময় থেকে ‘বিপন্নতর’ ক্লান্তির উদগমের কথা বলেছেন। সমধর্মী উপলব্ধির পরিচয় আছে জীবনানন্দের বিপুল কবিতায়, যেমন ‘বনলতা সেন’-এ, যেখানে দীর্ঘ মানব-অভিজ্ঞতার উত্তরসূরি হিসাবে কবি-কথক কেবল ক্লান্তিরই ভাগিদার হয়েছিলেন।
আগেই বলা হয়েছে, আত্মহত্যা-বিষয়ক এই কাব্যিক সন্দর্ভ শেষপর্যন্ত হয়ে উঠেছে মানুষতত্ত্বের এক জটিল সমীক্ষা। সে মানুষ প্রকৃতি থেকে আলাদা, ইতর প্রাণী থেকে ভিন্ন, এমনকি জীবের জীবন যাপন করে যে বিপুল আম-জনতা, তাদের থেকেও আলাদা। এ অবস্থান বিপজ্জনক। সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপের লিবারেল আলোকপর্ব যে ধরনের ‘মানুষ’-ধারণা উৎপাদন করেছিল, এটি তারই জাত-ভাই। সিদ্ধান্তের এ সঙ্কীর্ণতা থেকে ‘আট বছর আগের একদিনে’র জীবনানন্দ যে বেশ অনেকটা বেঁচে গেছেন, তার প্রধান কারণ ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী’ পন্থায় বক্তব্য উপস্থাপন। ব্যাপারটা একবার খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
এ কবিতায় আত্মহত্যাকে বিশেষ পরিস্থিতিতে যতই অনিবার্য করে দেখানো হোক, মৃত্যু-পরবর্তী অবস্থার প্রতি কিন্তু কোনো অনুরাগ বা পক্ষপাত দেখা যায়নি। বরং জীবনদায়িনী সংবাদকে ‘তুমুল গাঢ় সমাচার’ বলে সংবর্ধিত করা হয়েছে। অর্থাৎ মানবিক পরিস্থিতি হিসাবে আত্মহত্যার পরিস্থিতি আর প্রচণ্ড জীবনতৃষ্ণার চাঞ্চল্য—এ দুই ছবিকে পাশাপাশি স্থাপন করা চলে। এর মধ্যে কবির প্রত্যক্ষ টান প্রথম দলের দিকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিপুল দলটিও ন্যায্যভাবে হাজির থাকায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া অসম্ভব নয় যে, মানুষ জীবনবাদী সত্তা, কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে জীবন নাশ করাও মানবিক পরিস্থিতিই বটে। অন্তর্নিহিত এই বৈশিষ্ট্যই মানুষকে ‘বস্তু’ বা ‘যুক্তি’র স্তরে নিঃশেষ করে দেয় না।
৬.
‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা অবলম্বনে জীবনানন্দের কবিভাষা, বয়ানরীতি আর জীবনদৃষ্টি সম্পর্কে কিছু কথা বলতে গিয়ে খুব সামান্যই বলা গেল। ছন্দ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ছন্দযতি আর অর্থযতির নিখুঁত বন্ধনে মুক্তক অক্ষরবৃত্তের যে বর্ণাঢ্য আয়োজন রয়ে-সয়ে এই গল্প-বলা সম্ভবপর করে তুলল, তা অকথিতই থেকে গেল। পংক্তি-দৈর্ঘ্যের লীলাচাপল্য, মিল-অনুপ্রাস-পুনরাবৃত্তির সাঙ্গীতিকতা, গতি আর বিরতির সমানুপাতিক বণ্টন ইত্যাদি সম্পর্কেও বলা দরকার ছিল। মুক্তকের ঔদার্যে সুর-লয় অনাহত রেখে কয়েক পংক্তির আস্ত সংলাপ যে ঢুকে পড়ল বার কয়েক, তাও তো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষত, ভূতের মন্ত্রণায় আত্মহননের আহ্বান এবং পেঁচার মন্ত্রণায় জীবনের জয়গান—এই দুই প্রধান প্রতিপক্ষ যখন কবিতায় নিজ নিজ স্বর অক্ষুণ্ণ রেখে প্রবেশ করে, তখন ভাষার কার্যকরতা অন্য এক মাত্রায় উন্নীত হয়। মৃদু, বিষণ্ণ, দূরাগত সুরটির কথাও বিশেষভাবে বলা দরকার ছিল, লম্বা ক্রিয়াপদ আর থেমে থেমে বলা গল্পে যা সম্ভবপর হল। কিছুই বলা হল না। শরীরের কথা হল খানিকটা, খানিকটা মনের কথাও; কিন্তু শরীর-মনের প্রত্যক্ষতার বাইরে ওই শরীর-মন-জাত যে লাবণ্য বা আধ্যাত্মিকতা, তার কথা অধরাই থেকে গেল।
ইত্তেফাক/আরএ