রুগ্ণতার গলি-ঘুপসি : চন্দন আনোয়ার
রুগ্ণতার গলি-ঘুপসি : চন্দন আনোয়ার
কোথাও ফেসাদ দেখলে সেখানে মাথা ঢুকিয়ে দেওয়া আমার জেনেটিক প্রবলেম। শুনেছিÑবাবা নাকি যৌবনে ভাড়ায় চোর পিটাতেন। কোথাও গোলমাল হলে সেখানে বাবাকে ভাড়ায় নিয়ে যেত প্রতিপক্ষ ঘায়েলে। আমার দাদাসাহেব নাকি নামকরা ঠেঙাড়ে ছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই কী কারণে যেন মারপিট করতে ভাল লাগত! মারপিটে ওস্তাদি দেখাতে এগ্রেসিভ্ মুডে থাকতাম। খুব সখ ছিল, বড়ো হয়ে পুলিশ হব। পুলিশ হলে মানুষ পিটানোর লাইসেন্স মিলে। খর্বকায় বডি সাইজের কারণে সেই আশা ছেড়ে ভর্তি হই ভার্সিটিতে। সেখানে অবশ্য ফেসাদ-গোলমাল লেগেই থাকে। পলিটিক্স না করলেও মিছিল বা গোলাগুলি দেখলেই ছুটে যেতাম। এমনি ফাটা কপাল! গুলি খেয়ে দুইটা চারটা মরছে, শ’য়ে শ’য়ে চালান হচ্ছে হাসপাতালের বেডে, কিন্তু আমি থাকছি দিব্যি। যখন হাসপাতালে গিয়ে দেখতাম, আমার বন্ধুরা কপালে ব্যান্ডেজ প্যাঁচিয়ে বেডে শুয়ে কমলা লেবু খাচ্ছে! তখন কী যে ভীষণ লোভ হত! ওদের ছাত্র-শিক্ষক দেখতে আসত, পত্রিকায় ছবি ছাপা হত, একদিনেই ক্যাম্পাসের হিরো বনে যেত। হাসপাতাল থেকে ফিরত নেপোলিয়নের মতো দিগি¦জয়ী বীরের বেশে। সুন্দরী মেয়েরা মৌমাছির মতো ভোঁ ভোঁ করত বীরদের ঘিরে। যায় যায় করে তেত্রিশ বছর চলে গেল লাইফ থেকে! এখন তো আর স্বপ্ন-স্বাদ-আহলাদকে ঠেক্ দিয়ে রাখা উচিৎ না। বউয়ের সাথে টুকটাক হেচাং বাঁধে বটে, তবে তা নিতান্তই ঘরোয়া। গোলমাল করার জন্য আমি যতই চেতি, সে ততই ফাঁদ পাতে। ঘুঘুর ফাঁদ।
তোর মায়েরে বাপÑ বলে গালি ছুঁড়ি বউয়ের নাক বরাবর।
বউ হাসে, আমার মা-বাপ তোমার কী হয়?
আমি তখন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলি, এই যে এইটা হয়।
তাই নাকি? আমি তোমার কী হই?
এ রকম খেলে খেলে আমাকে খেলু করে বউ তখন চাপা ঠোঁটে চাপা হাসবে, নাক টিপবে, গাল টিপবে, ধাক্কাধাক্কি করবে, আমি যেন সের দরে কেনা আটার বস্তা।
কবিতা-টবিতা লিখি বলেই কি না, কিংবা কী জানি কী কারণে, আমি ফেসাদ চাই, কিন্তু ফেসাদ আমারে চায় না। হাসপাতালের বেডে শুয়ে কমলালেবু খাওয়ার আব্দারÑএই কি খুববেশি দামি আব্দার? তেত্রিশ বছরেও পূরণ হল না! আরো একটা স্বপ্ন বহুদিন আমাকে তাড়া করে ফিরেছে কিন্তু সে আর কোনমতেই সম্ভব না বলে আপাত সেই আশা ছেড়েছি। আমাদের গলির মোড়ে একটি মুদিখানার দোকান আছে। সেই দোকানের সামনে গলির মোড়ের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে এক কাগজ কুড়ানি বালক, একদিন একটি আধা-হাত সাইজের সাগরকলা পুরোটা ন্যাংটা করে নিজ মনে খাচ্ছে, সে নিজেও ন্যাংটা, নিচে ঝুলছে ছোট্ট আর একটা। এদিকে রিক্সার জ্যাম বাড়ছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, কলা খাওয়ায় এত সুখ! দু’একবার এটেম্পট নিয়ে ব্যর্থ হয়ে এই সুখের আশা ছেড়েছি। এই সুখ নিতে গেলে বউ নাকি ফাঁস নিবে! বলে, সোসাইটিতে মুখ দেখাতে পারবে না।
আমি তাকে বোঝাই, ধুস! সোসাইটি! সোসাইটি কাকে নিয়ে রে! সোসাইটি বরং দেখিস কী মজা লুটে নিবে- যখন গলির মোড়ে দিগম্বর হয়ে সাগর কলা দিগম্বর করে খাব আর লাফাব।
তোমার মাথায় গোলমাল আছে মনে হচ্ছে!
ধুর! ইয়ার্কি না, আমি সিরিয়াস।
কপাল চাপড়ে বউ বলে, হায় হায়! বলে কী রে। আমার সর্বনাশ হল রে! তিনমাস পরে টের পেলাম, তুমি আস্ত পাগল! আমি পাগলের সাথে ঘর করছি। ঠকিয়েছ! অবলা পেয়ে ঠকিয়েছ! তোমাকে ছাড়ব না। ভ-! চিট! প্রতারক! কাঠ ঠুকরার মতো দেওয়ালে কপাল ঠুকে রক্তাক্ত করে ফেলছে।
মর, শালি মর তুই-মরে যা তুই, জাহান্নামে যা। আমিও ছেড়ে কথা বলছি না। রক্ত উজানে উঠে গেল।
রক্ত ছিটাতে ছিটাতে ছুটে আসল আমার দিকে, আমি একা জাহান্নামে যাব কী করে ভাবছিস। তোকেও নিব, তোর মরা বাপ-মা চৌদ্দগোষ্ঠীও নিব।
থার্ড পারসন নিয়ে টানাটানি করিস না মাগি, ক্লিয়ারকাট বলে দিচ্ছি কিন্তু।
কিন্তু? কিন্তু কী?
দেখবি কিন্তু কী! দেখবি! বলেই সাপাট সাপাট কিল-থাপ্পড় ...
লাথ্থি মারি তোর মুখে! পেচ্ছাব করি তোর সংসারের মুখে! লাথ্থি মারি তোর তোর... করে সেই যে ক্ষিপ্রবেগে ঘর ছেড়ে গেল, সপ্তাহ ঘুরে মাস ঘুরে শেষে বছর ঘুরে এল তাকে আর ফেরাতে পারা গেল না। বড়ো চোটে বড়ো অভিমান। তাই অপেক্ষায় আছি অভিমান কবে ভাঙবে।
বছর ধরে হাত পাকিয়েছি, শর্টকাট ভাত-ভর্তা করে চটপট খেয়ে দরজায় সোনালি রঙের একটা তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শুক্রবারের দিন। দৈনিকের সাহিত্যের পাতাগুলো বিনা পয়সায় দেখে নিতে হবে, তাই সকাল সকাল বড়ো ব্যস্ততা নিয়ে হাঁটছি। বিহারি কলোনির প্রবেশমুখে একটা হেচাং দেখে আমার মনটা কেমন নাচানাচি করে উঠল, যাই যাব করে শেষে চলেই গেলাম স্পটে। গোলমালের স্পিরিট খুব একটা সুবিধাজনক বলে মনে হচ্ছে না। নিরাপদ দূরত্বে থেকে দুইজনেই হাত পা ছুঁড়ে মুখে চালাচ্ছে। সীমানা লংঘনের আইন কেউ-ই প্রথমে ভাঙতে চাইছে না। একতলার শরীর ঘেঁষে তিনতলা, তারই চারতলার কাজ চলছে, যা থেকে কিছু পানি চুইয়ে, ইট-সুরকি ছিটকে পড়ছে একতলার উপরে।
একতলাওয়ালা ভয়ানক আগ্রাসী মুভমেন্টে আছে, কেননা ক্ষতির শিকার সে।
তিনতলাওয়ালা শান্ত মেজাজে বলে, কী করবেন ভাই, পানির ধর্মই তো হচ্ছে নিচে গড়িয়ে পড়া, বস্তুর আকর্ষণও তো নিচের দিকেই।
ভাঁড়ামির একটা লিমিট আছে! আমাকে নিউটনের সূত্র শিখাতে আসে! আর এক ফোঁটা পানি আমার বিল্ডিং এ পড়লে, নিউটনের সূত্র কী জিনিস টের পাবে।
আমাকে দেখে তিনতলাওয়ালা দুই পা এগিয়ে এসে বলল, দেখেন ভাই, দেখেন, কেমন মূর্খের মতন কথা বলছে! এমন প্রতিবেশীর সাথে কী করে এক সাথে বাস করা যায়। কী কুক্ষণে যে এখানে বাড়িটা করতে গেলাম।
আমি বললাম, বাদ দেন তো ভাই। আপনার চারতলা হচ্ছে, আর উনার সবে একতলা, মানতে পারছেন না আর কী, তাই একটু উচ্চবাচ্য করছেন, ঠিক হয়ে যাবে পরে।
আর যায় কোথায় সোনার চান্দু- প্রতিপক্ষ লাফিয়ে চেঁচিয়ে বিকট চিৎকার করে উঠল, ওহ! এরিমধ্যে ভাড়াটে দালালও নিয়োগ হয়ে গেছে? অ্যা!
মাথায় রক্ত চড়ে গেল । শালা বলে কিরে, আমি নাকি ভাড়াটে দালাল! কী বলছেন আপনি? ফের বলেন তো শুনি।
বলেছি, ভাড়াটে দালাল।
কাকে বলেছেন?
এখানে আর কেউ আছে নাকি?
মাদারচোদ, কাকে বলিস ভাড়াটে দালাল। জুতিয়ে পিঠের ছাল উঠিয়ে দেব। বলেই জুতা খুলতে খুলতে ছুটে যাই। পিছন থেকে পিঠে চিলথাবা টের পাই, বড়শি গিলা মাছের মতো টানছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, বিশালাকায় এক হস্তিযুবক শক্তি প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত। আমি তো ওভার প্রস্তুত! মারামারিতে সাইজ ম্যাটার না-বলেছেন আমার গোলমালের গুরু সৈকত ভাই। টেকনিকটাই এখানে মেইন ফ্যাক্টর। তুই যদি প্রথমেই শরীরের স্পেশাল কিছু পয়েন্টে হিট করতে পারিস তবে সাইজে যত বড়ো হোক কুপোকাত হবেই। যেমন ধর, তুই যদি প্রথমে অ-কোষে লাথি চালাতে পারিস তবে তো খেল্ ফিনিস, না পারিস তো সেকেন্ড টার্গেট চোখ। থার্ড টার্গেট নাক। তো গুরুর নাম নিয়ে প্রথমেই নাক বরাবর ঘুষি ছুঁড়লাম। ট্রাকে ধাক্কা খাওয়া শিয়ালের মতো হস্তিকায় যুবক ছিটকে পড়ল দুই হাত দূরে। নাক থেকে কলকল করে রক্ত গড়াচ্ছে। বাংলা সিনেমার নায়কের মতো প্রথমে মার খেয়ে পরে হুংকার দিতে দিতে তেড়ে কাছে আসতেই ডিগবাজি দিয়ে বুকে চালায় একমণি এক লাথি। হস্তিযুবক এবার ছিটকে পড়ল পাঁচ হাত দূরে। আমার ভিতরে তখন হাসি দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে, যা শালা, কোথায় আমি পত্রিকায় কবিতা পড়তে যাব! বেমালুম ভুলে চান্স নিচ্ছি হাসপাতালের বেডে যাবার। শালার বাপ সমুন্দিও কেমন, ছেলে মার খাচ্ছে, আর দাঁড়িয়ে সিনেমা দেখছে! দেব নাকি ও শালার নাকেও এক ঘুষি, ভাড়াটে দালাল বলার খেসারত টের পাবে!
হঠাৎ বজ্রপাতের মতো শব্দ করে চিল্ল¬¬ায়ে উঠে ছেলেকেই বরং শাসায় বাবা- খাসির মতন বডি বানাইছে, এইটুকু ইঁদুরের ঘুষিতেই দেখো কেমন গলা কাটা মোরগার মতো ধড়পড়াচ্ছে!
বাপের তিরস্কারে কাজ হয়। ছেলে ঘুরে উঠে রেসলিং খেলোয়াড়ের মতো শরীরের মাংসকে আটার দলার মতো চাকা চাকা করে হুংকার ছিটাতে ছিটাতে আমার দিকে আসছে। এবার টার্গেট অ-কোষ। প্রতিপক্ষ এই হিরণপয়েন্ট টার্গেট করবে, তা সে মাথায়ই নেয়নি। নিলে কিছুটা সতর্ক হত হয়ত। আর সে নিবেই কী করে, আমার মতো গোলমালের কোর্স করে এই লাইনে নামেনি তো। তা বাছাধন, এইবার অ-কোষে লাথি খেয়ে মাগো মাগো বলে কুঁকাতে কুঁকাতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যাও। এরিমধ্যে একজনও দর্শকের উপস্থিতি না দেখে আন্দাজ করে নিলাম, এই রকম গোলমাল এই স্পটে নিয়মিতই হয়। এর আরো একটি প্রমাণ, তিনতলাওয়ালা হিস্ হিস্ করছে, আর বলছে, ছেলেটা বাড়ি নাই বলে সুযোগ বুঝে বাহাদুরির চান্স নিচ্ছিল। অ্যা! এইবার বাহাদুরির খেইল দেখ! এছাড়া বিষয়টি এমনও হতে পারে, যেহেতু বিহারি কলোনির দুই বাঙালি বাবুর গোলমাল, সেহেতু এই বিষয়ে বিহারিরা মাথা ঢুকানো বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেনি। এমনিতেই ওদের ঝামেলার শেষ নেই, দিনে দিনে ওদের কলোনি বেদখলে যাচ্ছে, নিয়মিত বড়ো বড়ো বিল্ডিং উঠছে।
যা হোক, গোলমালের সমাপ্তি ভেবে আমি যেই না পিঠ ফিরিয়েছি রাস্তায় উঠার জন্যে, অমনি দেখি, দুই যুবতী দুই তরকারি কাটার দা হাতে, তাদের মধ্যবয়সী মা ঝাঁটা হাতে নিয়ে যুদ্ধংদেহি। এখন যাই কোথায়? আমার গোলমালের কোর্স তো শুধু পুরুষ ঘায়েলের, নারী ঘায়েলের কৌশল তো জানা নেই। কিংবা এই রকম হতে পারে, তা কখনোই ভাবিনি। তাছাড়া দেশের আইন-আদালত সব নারীর দখলে। তা হোক, আরো বছর দুয়েক আগে হলে অবশ্য এইটাকে জেলে যাবার মোক্ষম চান্স হিসেবে লুফে নিতাম কিন্তু এখন আমার হাসপাতালের বেডে শুয়ে কমলালেবুর খাওয়ার স্বপ্নটাই বেঁচে আছে, বাকি সবই কবর দিয়েছি।
কী টেকনিক এ্যাপ্ল¬াই করা যায় তাই ভাবছি, নাকে ঘুষি চালালে তো বিপদ! যুবতী মেয়ে ওরা, নাকের কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলে বিয়ে-টিয়ের ঝামেলা হবে। বুকে তো পা চলবেই না, মা জাতির অভিশাপ লাগবে। বাকি থাকে অ-কোষের এ্যাকশন। কিন্তু সেই আশাও গুড়েবালি।
ফলে দাঁড়িয়ে থেকে মার খাওয়া ছাড়া গত্যন্তর খুঁজে পাচ্ছি না। তা মারুক, কিন্তু কপাল তো ফাটবে না। পেটে-বুকে দা চালালে ব্লি¬ডিং হবে খুব। ওরা কি নেবে হাসপাতালে? বউ নেই ঘরে। হঠাৎ করে মাথায় একটা আইডিয়া খেলল, স্বামী হাসপাতালের বেডে, বউ কি না এসে পারবে? আর তখনই ওর হাত ধরে বলব, গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে কলা খাওয়ার স্বপ্ন এখন আর দেখি না রে বউ। একটাই স্বপ্ন দেখতাম, হাসাপাতালের বেডে শুয়ে কমলালেবু খাব একদিন। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন আর আমি স্বপ্ন দেখব না, কবিতা-টবিতা লিখব না, নেশাভাং সব ছেড়ে দিব। তুই ঘরে থাক, টুয়েন্টি ফোর আওয়ার রিজার্ভ। সম্ভাব্য আক্রমণের অপেক্ষায় আছি। কিন্তু সেই আক্রমণের সাহস এই তিন রমণীর কারোরই নেই। বরং ওদের মা রণেভঙ্গ দিয়ে ছুটে গেল অন্দরমহলে। ছেলের খবর নিতে হয়ত। দুই যুবতীর আগুনের গোলার মতো দুই দুই চার চোখ কামানের মতো আমার দিকে তাক করে আছে। আমি তাকাতে গিয়েই হোঁচট খায় চোখ। সমানে নাচছে চোখ-বুক। বুকের ওড়নার আঁচল সরে আছে দুজনেরই। নিজেদের বুকের কোন খবরই নেই।
আমি কি তবে নজরনষ্ট মানুষ হয়ে গেছি নাকি? অসভ্য চোখ শালাদের শরমভরম নেই। কন্ট্রোলে থাকছে না। ঘুরে ঘুরে সেখানেই যাবে! আমার রক্তেরই বদমায়েশি! সুন্দরী ঢাউস মেয়েমানুষ দেখলে রক্তের ছুটোছুটি বেড়ে যায়। উজানে দৌড়ায়। এখন কী করি কী করি ভাবতে ভাবতে টপাস করে মুখ থেকে পড়ে গেল- শালার মাল রে! রসে টইটুম্বুর।
দুই যুবতী সামনে, পিছন থেকে কে যেন জিনেদিন জিদান স্টাইলে কিক্ করে আমাকে গোল পোস্টে ফেলে ধ্যাবড়া পায়ে থ্যাতলাতে লাগল। চোখ ভরে অন্ধকার নামল।
কে বা কারা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এনে ফেলে গেছে, তার হদিস কেউ দিতে পারল না। কপালে হাত ফেলে ব্যা-েজ দেখতে না পেয়ে যারপরনাই মনটা খারাপ। শালার স্বপ্নটা পূরণ হতে গিয়েও ফেইলিওর। কী একটা বিশ্রী ওয়ার্ড, রোগীর চিৎকার চেঁচামেচি, ছুটোছুটিতে গমগম করছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, ঢাউস দেহের এক মেয়েমানুষ। চেনা চেনা লাগছে। বউয়ের মতো পিঠ, ছাটা চুল, চিবুক, মুখটা ঠিক বউয়ের মতো হলেও নাকটা থ্যাবড়ানো মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের। আমিই প্রথমে ইশারা করলাম, হ্ইা, হ্যালো, আমি কামরুল, তুমি কে?
মেয়েমানুষটা একবার দাঁত দেখিয়ে জাবর কাটতে লাগল।
আমার বদমায়েশ রক্ত নড়েচড়ে বসল।
কথা বলবে না? তুমি দেখতে আমার বউয়ের মতো! নাকটাই কেবল ডিফারেন্ট। আর সব ওকে।
হাত ইশারায় আমাকে তার বেডে আমন্ত্রণ জানিয়ে হি হি হি করে হেসে উঠল।
আমার বদমায়েশ রক্ত সুনামির মতো তোড়ে মস্তিষ্ক ভাসিয়ে দিল, শিশ্নের শিরা-উপশিরাতেও রক্তের আগুন জ্বলে উঠল। লাফিয়ে যেই না বউয়ের মতো মেয়েমানুষটার বেডে যেতে চাইছি, তখনই ছুটে আসে দুই জল্ল¬াদ! এক ডাক্তার এক নার্স। দুই হাত, দুই পা দড়ির আন্ধাগিঁট দিয়ে বেডের পায়ের সাথে বেঁধে ফেলল। একটা ইনজেকশন পুস করে দিল নিরাপদে। চোখে অন্ধকার নেমে আসল। অন্ধকারে আর দেখতে পাই না বউয়ের মতো মেয়েমানুষটাকে।
অন্ধকার চোখ ছাড়ার পরে দেখি, পাশের শূন্য বেড খাঁ খাঁ করছে। খাঁ খাঁ করে উঠল আমার বুকের পিঞ্জরে। মেয়েমানুষটার কী দয়া! বউয়ের মতো দেখতে বলতেই আমার দুঃখটা ধরতে পারল। ও শালার জল্ল¬াদ দুইটা না আসলেই চুটিয়ে একচোট হয়ে যেত। রক্তও ঘুমাত। কিন্তু এখানে কেন ওরা আমাকে এভাবে বেঁধে রাখল, এ যে চরম হিউম্যানরাইট বিরোধী। ওরা কি জানে, আমি কে? কাকে এভাবে হাতে-পায়ে দড়ির শিকল দিয়ে আটকে রেখেছে! আলতো করে টান দিতেই ডান হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। মিরাকেল তো! এরপর একে একে বাম হাত, দুই পা মুক্ত করে পূর্ববৎ শুয়ে থেকেই ভাসা ভাসা চোখে দেখে নিলাম হাসপাতালের লোকদের খবরদারি। ইউনিটের পশ্চিম সাইডে সাদা এ্যাপ্রোন পরিহিতা দুই যুবতী, তার পাশে এক ডাক্তার ডিমে ওম্ দেওয়ার মতো গোল হয়ে বসে আছে। দুই যুবতীর চার চোখ ডাক্তারের দুই চোখের সাথে যেন হা-ডু-ডু খেলছে। চোখের ক্ষুধা মগজে উঠলেই ওরা আড়ালে যাবে। আড়ালে নিয়ে একে একে দুইটাকে বানাবে ডাক্তার। সেই অপেক্ষাতেই ফাঁদ পাতা চোখে চেয়ে আছি। তখনই সুযোগ বুঝে চম্পট দিতে হবে। না হলে শালারা ইনজেকশন দিয়ে দিয়ে আমাকে পাগল বানিয়ে শেষে পাবনা পাগলা গারদে রেফার্ড করে পাঠিয়ে দিবে। যেই মতো ভাবা ঠিক তাই ঘটল। এক যুবতী বসে আছে, এক যুবতী ও ডাক্তার নেই। যা শালা! এখানে কোন গণতন্ত্র নেই। কী বলব, দেশেই গণতন্ত্রের বদলে জোরতন্ত্র চলছে। না হলে, বউয়ের মতো দেখতে মেয়েমানুষটা আমাকে ডাকল, আর আমি যেতে চাইলাম, ও চুদিরভাই ডাক্তার আমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে গেল। এখন দেখ, পরের বউ কী মেয়ের শরীরের দৌলত লুটে-চেটে খাচ্ছে নিজেই। একবার ভাবি, যাব নাকি শালার স্পটে। বিষয়টা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। উল্টো আমাকেই দড়ি ছেঁড়ার অপরাধে ইনজেকশন পুস করে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। খাক! শালার ডাক্তার খাক। আমি পালাতে পারলেই বাঁচা। মিনিট পাঁচেক ব্যবধানে দ্বিতীয় যুবতীও আর বসে থাকতে পারল না। এই সুযোগে বেড থেকে পালিয়ে বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে গেটে এসে দেখি, দুইজন প্রহরী। তবে ওরা বেহুঁশ ঘুমে। সামান্য যা ফাঁক ছিল গেটের, তার ভিতর দিয়েই শরীর চালিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে জোর পায়ে হাঁটতে থাকলাম। হাসপাতালের গেটে দুই-চারজন রিক্সাওয়ালা আছে বটে, তবে ওরা সবাই ঢুলছে। পকেটে তো পয়সাপাত্তি নেই। শালবাগানে হেঁটে যেতে গেলেও রাত ফুরোবে, কী করা যায় কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই বউয়ের কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল দুই নার্স ও রসিক ডাক্তারের কথা। বউয়ের মতো দেখতে মেয়ে মানুষটার কথা। বহরমপুর হেঁটে যেতে ঘণ্টা দেড়েকেই হবে। আমাকে পাগল মনে করে এক বছর ধরে স্ট্রাইক করে আছে বউ। খবর পেয়েছি এখন আছে বহরমপুরে বোনজামাইয়ের বাসায়। মধ্যরাতে গিয়ে সারপ্রাইজ দিতে হবে।
দুপুর রাতের জনহীন রাস্তায় হাঁটতে গা ছমছম করছে। তবে কিছুদূর বিরতিতে প্রহরীর বাঁশির ফুঁ আর কুকুরের হাকডাকে গা ছমছম করা ভাবটা কিছুটা শিথিল হয়ে আসে। হাঁটতে আছি বেদম জোরে। কিন্তু খুব বেশি এগুতে পারছি না। শালারা আমার শরীরে ইনজেকশন পুস করে করে রক্ত পানি করে ফেলেছে । শরীরের পয়েন্টে পয়েন্ট ব্যথা, হাঁটতে গিয়ে টালমাটাল বেসামাল হয়ে পা ফেলছি। নিশ্চিন্তপুরের মোড়ে আসতেই হি হি করে মেয়েকণ্ঠের হাসি কানে ঠেকল। অবিকল আমার বউয়ের মতো কলকল হাসি! কে যে এই মেয়েমানুষটা? কেনই বা দুপুর রাতে মোড়ের উপরে দাঁড়িয়ে কেলাচ্ছে! আমি দুই পা এগিয়ে তার সামনে যেতেই নাক ঝাপ্টা মেরে হু করে মুখ ফিরিয়ে নিল।
আপনি কে? এখানে এত রাতে কি করছেন? আর একা একাই বা হাসছেন কেন?
মেয়েমানুষটা তেড়ে ওঠে, পাগলাশালা, হট্! এখান থেকে হট্।
আমি ঝাঁঝিয়ে উঠলাম, হঠবো মানে! কার ঘরের বউ কী মেয়ে! দুপুর রাতে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ তুমি? শহরের লাফাঙ্গারা টের পেলে তো তোমার সর্বনাশ করবে। তোমার হাসিটা আমার বউয়ের মতো কলকলে, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
মেয়েমানুষটা এবার অধৈর্য হয়ে বলল, পাগলাশালা তো ভারি বদমায়েশ! কিছু উত্তম-মাধ্যম না দিলে হটবে না।
আমার রক্ত উঠে গেল মাথায়, এই খান্কি, কাকে তুই বদমায়েশ বললি। জানিস, আমি কে? আমি বি এ অনার্স।
বি এ অনার্স কথাটায় কাজ হয়েছে। এবার সে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফাস করে বলল, কত আছে?
কী কত আছে?
ন্যাকা! দুপুর রাতে আধ-ন্যাংটা হয়ে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছো মাগি চুদার ধান্ধায়। আর তুমি বুঝো না। টাকা কত আছে?
আমার কাছে কোন টাকা-পয়সা নেই।
যা, হটে যা ভালই ভালই। নইলে চেঁচালে কিন্তু তোকে এখনি হাসপাতালের বেডে পাঠিয়ে দিবে।
না, এখানে আর দাঁড়ানো যায় না। মেয়েমানুষটা জানল কী করে, আমি হাসপাতালের বেড থেকে পালিয়ে এসেছি। হাসপাতালের লোকেরা কি এরিমধ্যে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে খবর লাগিয়েছে! ক্ষিপ্রবেগে হেঁটে বহরমপুর পৌঁছেই নিজের ভিতরে অন্যরকম একটি উত্তেজনা টের পেলাম। বউয়ের এক বছরের অমথিত শরীর! কিন্তু বউয়ের অসুর বোনজামাইয়ের কথা মনে করে রক্ত জমে আসছে। সে আমাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। শুশ্বর-শাশুড়ি অবশ্য আমাকে প্রিফার করে, আর এইজন্যে সেখানে বউয়ের আশ্রয় মেলেনি। কী মওকা যে এখানে পেয়েছে! কেন যে যেতে চায় না! ওর বোনজামাই মানুষটা খুব সুবিধের না। চোখ-মুখ রক্তখেকো বাঘের মতো। ধ্যাত! এইসব কী বাজে ভাবছি। আমার বউ সতী-সাধবী। বাসর ঘরে বলেছে, তুমি ছাড়া আমার জীবনে দ্বিতীয় বলে কিছু নেই। তুমিই প্রথম, তুমিই শেষ। একটু অভিমান করে আছে বলে, নিজের বউ সম্পর্কে এসব বাজে ভাবা কি উচিৎ! আমি কি তবে নষ্ট মানুষ হয়ে গেছি নাকি! মেয়েমানুষ দেখলেই রক্ত কেমন চটকায়। বউয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। বলতে হবে, কপালে ব্যা-িজ প্যাঁচিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে কমলালেবু খাওয়ার সাধ আমি ছেড়েছি চিরতরে। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই বুক ধড়ফড় করে ওঠে। মাস দুয়েক আগে একবার এসেছিলাম বউকে নিতে। গেল না। তখনই পরিকল্পনাটা করে ফেলেছি, বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতে গেলে রাত দুপুরে চোর ভাবতে পারে। বরং পশ্চিমের প্রাচীর টপকে লাফিয়ে পড়লে কেউ টের পাবে না। ছয়ফুট প্রাচীর টপকে লাফিয়ে পড়তেই আমার হার্টবিট অস্বাভাবিক উঠানামা শুরু হয়ে গেল। বউয়ের ঘরে লাইট জ্বলছে! হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি বউয়ের কাছে আগেভাগেই খবরটা পৌঁছে দিয়েছে নাকি? নাকি স্বামীর বিরহে রাত দুপুর পর্যন্ত এভাবেই জেগে কাটায়। বউ যে ঘরটায় থাকে সেই ঘরের জানালা অব্দি পৌঁছাতে আমার শরীরের রক্ত উজানে বইতে বইতে বিপদসীমা অতিক্রম করে চলছে। দশ নম্বর সিগন্যাল দিচ্ছে শিশ্ন। বানরের মতো লাফিয়ে জানালার গ্রিল ধরে উঠতেই দেখি, আমার বউ চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। বুকের উপর হামলে পড়ে ননস্টপ কোমর দোলাচ্ছে ওর অসুর বোনজামাই!
বেশ্যার বেটা আমার বউ ছাড়্! ছাড়্ বলছি। দাঁড়া তোর বউকেও বানাব আমি। এরপর তোকে খুন করব। আকাশ ফাটা চিৎকার দিতে দিতে এসে দরজা ঠেলতেই খুলে গেল সাপাট করে। বউয়ের বোন লাল চোখ করে পথ আটকালো। ডাকু শিয়ালের মুরগি ধরার মতো খপ করে বউয়ের বোনের দুই স্তন দুই হাতে ধরে আছড়ে ফেলে দিলাম নিচে। এরপর উপরে উঠার জন্য এটেম নিতেই পিছন থেকে বিভীষণ এসে রড দিয়ে মাথায় বসালো এক ঘা। ভাগ্যিস মাথা হেলিয়ে নিয়েছি, তবে কপালে রড লেগে র্গর্গ করে রক্ত বেরুতে লাগল। যা শালার, সেই তো কপাল ফাটল!
বউয়ের অসুর বোনজামাই আসুরিক হুংকার ছেড়ে দ্বিতীয়বার রড চেতাতেই বউ কোমর প্যাঁচিয়ে ধরে বলল, থামো দুলাভাই, পাগল হলেও তো আমার স্বামী। ডিভোর্স তো হয়নি।
বুঝলাম, বউয়ের কর্তব্যজ্ঞান এখনো আছে। স্বামীর জন্য দরদও আছে।
ওর পাগলামি ছুটিয়ে দিতাম, আমার বউয়ের শরীরে হাত দেয়। কত্ত বড়ো শয়তান! বলে লাঠি খেলোয়াড়ের মতো রডটা আমার মাথার উপরে ঘুরাতে লাগল। আমার মুখ থেকে রা শব্দ বেরুলেই মাথায় রড ফেলে দুই ফালা করে দিবে।
তখন বউ সোহাগভরা কণ্ঠে আমার মাথায় হাত রেখে বলল, সোনা, তুমি চলে যাও।
বউ মাথায় হাত দিতেই আমার ভিতর থেকে বমি ঠেলে আসতে লাগল। আমি বললাম, আমাকে দুইশো টাকা দেবে। বউয়ের বোনজামাই এদিক থেকে বড়ো দিলবান! বলার সাথে সাথেই চট করে পাঁচশো টাকার নোট বের করে নাক বরাবর ছুঁড়ে মারল।
শরীরের শক্তি না থাকলেও, মনের শক্তিতে জোরে জোরে পা ফেলে নিশ্চিন্তপুরের মোড়ে হাজির হলাম। সেই মেয়েমানুষটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে। রাতের এখন শেষ প্রহর। আযান দেবে দেবে ভাব। আমাকে দেখেই এগিয়ে আসল সে। কপালের রক্তের দিকেই প্রথমে চোখ গেল তার। কী আশ্চর্য, একটানে কালোকিষ্টি কাপড়ের আঁচল ছিঁড়ে আমার কপালে ব্যান্ডেজ পরিয়ে দিল। বলল, চল্ পাগল, আমার ঘরে চল!
chondon_anwar@yahoo.com