আমার কবিতা
আমার কবিতা
খালেদ হোসাইন
কবিতা বিষয়ে আমার কথাগুলো
সবচেয়ে ভালো বলতে পারবে
আমার কবিতা।
কোনো-একটি কবিতার সঙ্গে হয়তো
সংঘর্ষ রচনা করবে অন্য-একটি কবিতা,
তবু তারা যখন সমস্বরে কথা বলবে,
তখন তুমি বুঝতে পারবে কবিতা সম্পর্কে
আসলে আমি কী বলতে চেয়েছিলাম।
এমনও হতে পারে তারা সবাই
এক সুরে কথা বলছে না,
এমনও হতে পারে প্রকৃতপক্ষে তারা তৈরি করেছে
এক দুঃসহ হট্টগোল
এমনও হতে পারে
কথা না-বলে তারা ঘটিয়ে দিল
মর্মান্তিক বিস্ফোরণ
এমনও হতে পারে তারা ছড়িয়ে দিল
শীতাভ নীরবতা
যা সমস্ত চরাচরে বয়ে আনবে এক
স্তব্ধ অন্ধকার।
এমন-কি তারা আবির্ভূত হতে পারে
হন্তারক হিসেবেও অথবা আত্মহন্তারক।
হতে পারে একটি কবিতা অকালের শিশিরে ভিজে
এমনই মিইয়ে যাবে যে, তার মুখে ভালোবাসার কথা
শোনাবে নিতান্তই হাস্যকর। হয়তো একটি কবিতা
অকথ্য দুর্ঘটনায় হারিয়ে ফেলেছে তার
ডান হাতের সমস্ত আঙুল, যা কোনো
পিচঢালা পথের কিনারে
টিকটিকির লেজের মতো
অদ্যাবধি লাফিয়ে চলেছে।
একটি কবিতা বেড়াতে গেছে
টেংরাটিলায়--
পাহাড়ি কন্যা কল্পনার মতো
যে আর-কোনোদিন ফিরে আসবে না
স্বেদাক্ত মর্মের মৃত্তিকায়।
অথবা কল্পনা চাওলার মতো চিরকাল
মহাকাশে ভেসে বেড়াবে, এই তার পণ। জীবনের
অন্তর্গত মানচিত্র বদলাবে বলে
একটি কবিতা বছরের পর বছর
মধ্যপ্রাচ্যে নাইটশিফটে
কাজ করছে। একটি কবিতা ফ্লোরিডায়
নিগ্রোকন্যাকে ভালোবেসেছে গ্রিনকার্ডের মোহে,
এখন সে সারাসপ্তাহ টেক্সি চালিয়ে
উইক-এন্ডে রাতভোর মদ্যপান করে।
একটি কবিতা আটকে পড়েছে জয়পুরের
জি হোটেলের লিফটে, একটি চুম্বনের আকাঙ্ক্ষায়
সে থরথর করে কাঁপছে। ডিএমসির গাইনি ওয়ার্ডের
বারান্দায় রুক্ষচুল খুঁটেখুঁটে একটি কবিতা
বের করে আনছে রক্তভুক ঢাউস উকুন; বলাইবাহুল্য,
এ-কুমারী মাতার সঙ্গে
মেরিনাম্নী বিখ্যাত মহিলার কোনো
সম্পর্ক নেই, এমন-কি মেয়েটি তার
নামও শোনেনি; কোনো মিশনারি
এখনো তার ছায়া মাড়ায়নি।
আমার গরিব কবিতাগুলোর সঙ্গে
তোমার কি কথা বলবার সময় হবে,
অপুষ্টিতে যাদের স্তন কীটদষ্ট লাউয়ের মতো
ঝুলে পড়েছে?
একটি কবিতার জরায়ুতে কর্কট রোগ;
তার নিজের ধারণা এটা খুবই সুখকর, তাই
সে এখন সোনামুখে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে।
খিস্তি-খেউড়ে এদের দক্ষতা মন্দ নয়, তবে
ভদ্রলোকদের সঙ্গে মিতবাক। তা-নাহলে
তুমি জানতে পারতে, এদের প্রত্যেকের
হিরন্ময় ডানা আছে। এমন-কি মাঝেমধ্যে
এরা পেটে-ভাতে দিনভর পলিটিক্স করে। ফলে
কদাচিৎ মরতেও হয়। তবে এরা কেউ
মৃত্যুভীতু নয়।
বিকারগ্রস্ত একটি কবিতা ভাগ্য বদলাবে বলে
কয়েক বছর যাবৎ খুঁজে ফিরছে হাওয়ার বাড়ি।
একটি কবিতা খুবই আশাবাদী, কারণ তাকে
প্রায়ই ৩২ নম্বরের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে
দেখা যায়।
একটি কবিতা উত্তর-চল্লিশের বেদনায়
জর্জর। তার ধারণা প্রয়োজনীয় যৌনচর্চার অভাবে
তার জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে, তাই
সম্প্রতি এস্তেমাল করে ফিরছে অন্য-রকম নারী।
সর্বশেষ সাক্ষাতে সে তার
সাফল্যের বয়ান দিতে দিতে
ভাদ্রের একটি দুপুরকে অন্তঃসারশূন্য করে
চলে গেছে চোখে গাঢ়-নীল
সানগ্লাস পরে।
রাত যত বাড়ে
একটি পরকীয়া কবিতা আমাকে তত
আহ্বান করে; সে তার গোলাভরা শস্য
আমাকে দেখাবে বলে নিয়তির মতো টানাটানি করে।
সে এত অসঙ্কোচ ও দুঃসাহসী যে, আমাকে
পালিয়ে বেড়াতে হয় একটি সত্তা থেকে অপরসত্তায়,
এক কানাগলি থেকে অন্ধকূপের মর্মান্তিকতায়। আর
গত ফাল্গুন মাসে
আমি খুঁজে-পেতে ডেকে এনে বুকে বসিয়েছি
আমার মৃত্যুদূতকে। সে এখন
মাঝে-মধ্যে আমার শরীরে ছড়ঘষে
সুরের সিম্ফনি ছড়ায়।
শিলটন হোটেলের ছাদে
আমার উচিৎ হয়নি যাওয়া, কেননা,
আমি জানতাম, আমার মতো গোবেচারাদের জন্য
গ্রীষ্মের পূর্ণিমা কখনো নিরঙ্কুশ
আনন্দ বয়ে আনে না। উনিশ-বর্ষীয়া একটি কবিতা
আমাকে ঠেলতে ঠেলতে উঠিয়ে দিল
সর্বনাশের চূড়ান্তে আর আমাকে দেখতে হল
রসুনের খোসায় ঢাকা মৃত্যুর রহস্যময় মুখ--
লুম্বিনী গ্রাম থেকে ঢের দূরে।
আমি স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের জন্য দীর্ঘকাল
চুম্বন করেছি ছন্দের বাঁট,
রঙ ও রেখার সমান্তরালে লালন করেছি
পদিপিসির বর্মিবাক্সের চোখ-ধাঁধানো
অলঙ্কার, যা আমাকে একদিন বীতস্পৃহায়
ছুঁড়ে দিল দূরতম মেরুর শেষবিন্দুতে।
ততক্ষণে আমার ভাণ্ডারে এক দানাসর্ষেও
সঞ্চিত হয়নি বা একরত্তি চন্দনের সুবাস।
আমাকে তাই করতেই হল শিকার-যাত্রার
আয়োজন।
গত রাতে একটি কবিতা
ধল প্রহরে আমাকে ডেকে তুলল
নিদ্রার গহীন ডুব-সাঁতার থেকে,
বলল, অনেক স্বপ্ন দেখেছ, এবার একটু
বাস্তবতা দেখ। আমি
নিষ্কলুষ চোখে চারপাশে তাকাতেই দেখি, সবকিছু
গলিত লাভা হয়ে অপূর্ব সব দৃশ্য
রচনা করতে করতে
দিগন্তের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
দিগন্ত-- যেখানে সব সময় বাতাসে উড়তে থাকে
আবছায়ার অখণ্ডিত উত্তরীয়।