শঙ্খ ঘোষের কবিতায় শব্দের আড়ালের সত্য
মেহেদী উল্লাহ
শঙ্খ ঘোষের কবিতায় শব্দের আড়ালের সত্য
মেহেদী উল্লাহ
কবি শঙ্খ ঘোষের (জ. ৬ ফেব্রয়ারি ১৯৩২) নব কাব্য বিকিরণের মধ্যে অন্যতম প্রবণতা,তিনি সহজ করে বলতে পারেন। পঞ্চাশের দশকের গুরুত্বপূর্ণ এই কবি কবিতায় সহজ শব্দের আড়ালে জটিল জীবনের মর্মান্তিকতার উচ্চারণই করে গেছেন। বাংলা কবিতায় কবিকুলে স্পষ্টভাবে পরিলতি হয়, দু’টি জাত। একদল আছেন যারা কঠিন করে বলেন, হোক তা সহজ কিংবা জটিল সত্য। অন্যদলটি সহজ করে প্রকাশ করেন কঠিন সত্যকে। একেক কবির কাছে সত্যের রূপ ভিন্ন, তার প্রকাশও ভিন্ন। শঙ্খ ঘোষের সত্যের রূপ কঠিন ও জটিল হলেও প্রকাশ করেন সহজ-সাবলীল শব্দে। তাঁর কবিতার নির্মিতি বাংলা কবিতা ভুবনে এই জন্য নতুন, এর আগে চল্লিশ কিংবা ত্রিশের দশকে এত সহজ করে কঠিন সত্যকে প্রস্ফুটিত করার প্রবণতা কোনো কবির মধ্যে দেখা যায় নি। সুজিৎ ঘোষের ‘শব্দের শিল্পী শঙ্খ ঘোষ’ পড়তে গিয়ে এই প্রসঙ্গটির দেখা পেলাম।
‘শঙ্খ ঘোষের কবিতার শব্দ নির্বাচন সহজ, কিন্তু সেই নির্বাচিত সহজ শব্দ নিয়তই তার অভিধার অর্থকে অর্থহীন করে ব্যঞ্জনায় নতুন অর্থ পায়’
(‘শব্দের শিল্পী শঙ্খ ঘোষ’, সুজিৎ ঘোষ, পৃষ্ঠা: রা)
সমালোচকের এমন মত প্রকাশ করবার যথেষ্ট যুক্তিটি হলো, প্রকৃত কবির মতা থাকে অভিধানে একটি শব্দ যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সেই অর্থকে বদলে ফেলার। একই শব্দের ব্যবহার কিন্তু অর্থ ভিন্ন। একেই বলে শব্দের মুক্তি। শঙ্খ ঘোষ নিজেও এবিষয়ে তাঁর ‘শব্দ আর সত্য’ বইতে বলেছেন।
কবির কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের আড়ালে-সারল্যে-ছদ্মবেশে যে ব্যঞ্জণা তৈরি হয় তা অবধারিত ভাবে জীবন সত্যের ব্যঞ্জণা। কবি তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকাতেও এমন মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন,‘সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার’। প্রকৃতপে কবি কোন সত্যকে প্রকাশ করেন, যা তাঁর ব্যবহৃত শব্দের আড়ালে নিহিত! সেই শব্দের আড়ালের সত্যরা জন্ম, মৃত্যু, যৌনতাকে ছাপিয়েও জীবনের আরো গভীরতম তাৎপর্য। এবিষয়ে শঙ্খঘোষের নিজেরই স্বীকারোক্তি আছে। তিনি বলেছেন,
‘জন্ম আকস্মিক, মৃত্যু অনিবার্য, যৌনতা অমোঘ: এই সব নিত্য সত্যের ঘোষণাটুকুই কবিতার সব নয়, এই সব সত্যের উপর ভর করে আছে যে জীবন, তাকে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সংঘর্ষে দেখাই কবিতার সত্য।’
(‘শব্দ আর সত্য’, শঙ্খ ঘোষ, পৃষ্ঠা: ৩৭)
অর্থাৎ, শঙ্খ ঘোষ কবিতায় যে সত্য প্রকাশ করেন তা জীবন কেন্দ্রিক সত্য। এই সত্য প্রকাশ করে জীবনের জটিলতা বা জটিল জীবনের মর্মান্তিকতাকে। তিনি সহজ করে বলেন কঠিনতম ভাবকে। কিন্তু তাঁর কবিতা পাঠের সঙ্গে সঙ্গেই কি পাঠকের বোধে ধরা পড়ে সেই সত্য? অধিকাংশ ক্ষেত্রে না। এই বিষয়ে একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি কলেজবেলা থেকেই একটু-আধটু শঙ্খ ঘোষের কবিতার সঙ্গে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়তে এসে তো খুশি আর ধরে না। সেই খুশিতে শঙ্খ ঘোষ বেশ পাকা-পোক্ত ভাবেই পড়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু, একদিন জানলাম, শ্রম পণ্ড হয়েছে। তাঁর কবিতা পড়ে যে সত্য নিজের বোধে তৈরি করেছি, তার চেয়েও বেশি কিছু আসল সত্য। একটা বই মাথাটা বিগড়ে দিল। শঙ্খের নিজেরই লেখা বইটি। নাম ‘কবিতার মুহূর্ত’। পড়ার পর বুঝলাম, শঙ্খ কী ভেবে লিখেছেন, আর আমি ভেবেছি কি! অবশ্য, ভাবনা যে মিলতে হবে এমন কোনো শর্ত নেই। তবে কবি যখন নিজেই নিজের কবিতার শানে নযুল জানান পাঠককে, তখন আর নিজের মতো অর্থ বিবেচনা দাঁড় করাতে মন চায় না। কবিই সত্য তখন। বইটা পড়ে সেই রকম হয়েছে আর কি! তবে, সত্যটা কবিতার শব্দের আড়ালে। এই রকম কসরত করে খুঁড়েখুড়ে বের করতে হয় তাঁর কবিতার সত্য। নইলে যে অর্থ তৈরি হয়, তা নিজের মতো একটা অর্থ। এই অর্থেরও অবশ্যই একটা মজবুত ভিত্তি আছে। তবে নিজের সত্য আর কবির সত্য মিলে সত্যটা হয় পাকাপাকি ষোলআনা। নইলে আটআনা ভাগিদার থেকে যাবেন সারাজীবন। এর আগে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে’র কবিতায় দেখেছি, কঠিন শব্দবন্ধের ভেতর দিয়ে ভাব প্রকাশ করার পারদর্শিতা। অথচ শঙ্খ ঘোষ কঠিন কথা সহজ করে বলার বিরল মতা দেখিয়েছেন। এখানে একটি উদাহরণ প্রযোজ্যÑ
‘ঘর, বাড়ি, আঙিণা,
সমস্ত সন্তর্পনে ছেড়ে দিয়ে মামিমা,
ভেজা পায়ে চলে গেল খালের ওপারে সাঁকো পেরিয়েÑ’
(রাঙামামিমার গৃহত্যাগ, শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা)
উপরিউক্ত কবিতায় কত সহজভাবে কবি দেশ ভাগের যন্ত্রণা ও প্রতিবেশ নির্মাণ করেছেন। খুবই অবাক হতে হয়। কত সহজে, সাদা চোখে তা ধরা পড়বে না। সাঁকোর এপার-ওপার, দু’টি দেশ, ভারত-পাকিস্তান। বলে ফেলেছেন ১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক ইতিহাস।
এখন আমরা একনজরে শঙ্খ ঘোষের কিছু কবিতার শব্দের আড়ালের সত্যদের প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা করছি।
কবিতা ও আড়ালের সত্য:
যমুনাবতী- -ক্ষুধা, বিদ্রোহ ও বিদ্রোহের দমন
চাবি--ব্যক্তির আত্মবিহ্বলতা
পুনর্বাসন--নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি
কাগজ--বর্বরতার স্বরূপ
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে--পুঁজিবাদের আগ্রাসন
বাস্তু--নারী অপহরণ
ভীড়--মানবাত্মারা অসম্মানা
রাস্তা--নৈতিকতার বিনির্মাণ
পিঁপড়ে--পরধনে লোভ
ইট--ঈশ্বরের আকুলতায় আরাধনা
রাঙামামিমার গৃহত্যাগ--সাতচল্লিশের দেশভাগ
এবার আমরা শব্দের আড়ালের সত্যের বিস্তারিত আলোচনা করবো।
‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে।’
(যমুনাবতী’)
এই কবিতার বিষয় ক্ষুধা ও বিদ্রোহ। ১৯৫১ সালে কুচবিহারে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল। শঙ্খ ঘোষ ‘কবিতার মুহূর্ত’ বইয়ে তা তুলে ধরেছেন। এই কবিতার পেছনে যে একটা গোপন সত্য আছে, সেই সত্য এই আন্দোলন। অন্নের দাবিতে যখন আন্দোলন চলছিল তখন বিদ্রোহ দমন করতে গুলি চালায় রাষ্ট্রের পোষা বাহিনী। সেই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল এক কিশোরী। তারই নাম হয়তো যমুনাবতী। বেঁচে থাকলে বিয়ে হতো মেয়েটার। বিয়ের উপযুক্ত হয়েছিল। তাও কবিতায় এসেছে,‘যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে’। কিন্তু রাষ্ট্র তার আশ্রয় হলো না, উলো জীবন বলি দিতে হলো। এভাবেই বারুদ বুকে নিয়ে যমুনাবতী চলে গেল। পুলিশের নলের মুখে নির্যাতিত, ুধিত মানুষের আন্দোলন নিষ্ফল হলো। কবি সেই সত্যকেই তুলে ধরেছেন কবিতায়।
‘বাস্তু’ কবিতার আড়ালে লুক্কায়িত, নারী অপহরণের বিষয়টি। কবি তার শানে নযুল বলেছেন ‘কবিতার মুহুর্ত’ বইতে।
কবিতায় এজন্য তিনি বলেন,
‘আজকাল বনে কোনো মানুষ থাকে না,
কলকাতায় থাকে।’
(বাস্তু)
এক কিশোরীর অপহরণ আর কবির মেয়ের মুখের বুলিই এই কবিতার উপল। একদিন বিকেরে বেলগাছিয়ার ইন্দ্ররোডে কবি নিজ মেয়েকে নিয়ে হাঁটছিলেন। কবির মেয়ের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের একপর্যায়ে ওহির মতো কবিকন্যার মুখে আবির্ভূত হয় এই কবিতার প্রথম লাইনটি।
কবি এভাবেই সত্যকে আড়ালে রেখে কবিতা করে তুলেছেন। কবিতাটি পড়ে এমন কিছুই মনে হয় না। মনে হয় কোনো প্রকৃতিবাদী কবিতা। অথচ শানে নযুল জানার পর বেরিয়ে আসে থলের সত্য।
‘ভীড়’ কবিতায় তিনি বলেছেন মানবাত্মার অসম্মানের কথা। সহজ-সরল-সাবলীল উপস্থাপনায় আড়ালে এক গভীর সত্যকে রেখে তিনি সংকটটি নির্নয় করেছেন।
‘ছোট হয়ে নেমে পড়–ন মশায়
সরু হয়ে নেমে পড়–ন মশায়
...............................
আমি কি নিত্য আমারও সমান
সদরে বাজারে আড়ালে?’
(ভীড়)
মানুষকে তাঁর দেহের সমান হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। মানুষ তার দেহের মতোই ঠিক ‘সাড়ে তিন হাত’ নয়। মানুষ তার দেহের চেয়ে বড়ো। মানুষের বড়ত্বের জায়গাটি তার মস্তিষ্কে। মানুষ শারীরিকভাবে যত না বড়, চেতনায় মানসিক ভাবে সে তারচেয়ে শত-সহগ্রগুণে বড়। কবিতার মুহুর্ত বইয়ে কবিতাটির যে শানে নযুল পাওয়া যায় তা হলো, কবি একবার ভীড়ওলা একটা বাসের ভেতর থেকে নামতে যাচ্ছিলেন। আর তখনই সেখানে এমন কিছু ঘটে, যা কবিতাটির জন্ম দেয়। মূলত, বাস থেকে নামার প্রতিবেশ নিয়ে কবিতা লিখলেও তার আড়ালে এই জীবন সত্য প্রকাশিত,মানুষ অনেক বড়, মহান, সৃষ্টিউন্মুখ, সৃজনশীল। মানুষ সম্ভাবনাময়। মানুষ চলে গেলেও মানব থেকে যায়।
‘রাস্তা’ কবিতায় তিনি বলেন,
‘কেউ রাস্তা দেবে না, রাস্তা করে নিন।’
(রাস্তা)
অর্থাৎ, সময় বদলে গেছে। অতীতে মানুষ মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতো। এখন আর এগিয়ে আসে না। মানুষকে এখন নিজেকেই নিজের স্বার্থ দেখতে হবে। মানুষ আর সামষ্টিক চেতনায় নেই, সমাজে জন্ম নিয়েছে ব্যষ্টিক চেতনা। তাই মানুষের স্বার্থে এখন আর অন্যের সাহায্য যোগ নেই, বরং একে অপরের স্বার্থ নিয়ে বিয়োগের পথে। এই সব জীবন সত্যই কবিতার আড়ালে সত্য।
‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কবিতায় কবি প্রকাশ করেছেন পুঁজিবাদের আগ্রাসনকে। সমাজে এর প্রভাবে বদলে যাচ্ছে মানুষের সম্পর্কের রূপ। যেমনÑ
‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাবো
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’
(মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে)
অর্থাৎ, ভালোবাসার মানুষ আর ব্যক্তির নিজের মাঝের দেয়ালটি যেন পুঁজি। এই কবিতা প্রসঙ্গে পুঁজির সঙ্গে মানুষ ও সমাজের সম্পর্কের রূপটি আমি তুলে ধরছি। “উত্তরাধুনিকতা, পুঁজিবাদ, ব্র্যান্ড কালচার ও শিল্পী সুমনের ভাস্কর্যের ‘ব্র্যান্ড’” লেখায় আমি ব্যাখ্যা করেছি,
বর্তমান বিশ্বের উদ্ভাসন ও বিকাশের ধারাবাহিক গতিশীলতার অন্যতম নিয়ামক রূপে বিবেচিত হওয়ার পরিধির মধ্য থেকে ‘হেগেমনি’ বলবৎ রাখবার জন্য অধিপত্যবাদী ও আগ্রাসী মানসিকতা থেকে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের ধারণাজাত পরবর্তীকালের প্রসারণ ‘পন্য সংস্কৃতি’র যুগ সৃষ্টি। এমনতর ঐক্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করতঃ পুঁজির প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের অভ্যন্তরীন কাঠামো থেকেই তৈরি করে নিয়েছে কোন কোন পন্থায় পুঁজির প্রসার ঘটানো সম্ভব আর নিজেদের ব্র্যান্ডিংয়ের শুধু প্রসার বা সুনামই নয়, সেই সঙ্গে আপাদমস্তক ‘ইমেজ’ ভাবনা-ভাবনান্তরের মধ্যেই নিয়তি নিহিত। বিশ্বব্যাপী পন্যসীমায়িত দৃষ্টিকোণ থেকেই সবকিছু বিচারের মানদ- বিচারের অব্যবহিত পরেই আরম্ভ হয়েছে মানবিকীকরণ ক্ষুন্ন করার প্রচেষ্টা। ভেঙ্গে পড়েছে অর্গানিক সোলিডারিটি, যান্ত্রিক একটা সংহতির বলয়ে দাঁড়িয়ে একুশ শতকের মানবসভ্যতা মেনে নিয়েছে ঔপনিবেশিক ও পরাশক্তির জাদুটানা, তৎপরবর্তীকালের ব্রা- নিয়ন্ত্রণকর্তাদের তরফ থেকে যে নীতি-নৈতিকতা আর আদর্শ তৈরি হচ্ছে তারই সফল আমদানীকারক রূপে অভির্ভূত হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। যার লনাক্রান্ত দশাগ্রস্ততার অ্যাসেন্সগুলো তৈরি হতে শুরু করেছে ঔপনিবেশিককাল পর্ব থেকেই। বর্তমানে এর সংক্রমিত দশা আচারে-স্বভাবে। এই আচরণ-স্বভাবের যে নির্দিষ্ট স্বভাবিককরণ তার মধ্যেই অন্তর্বিভাগ পন্যসংস্কৃতি। যেহেতু আচারণ সমষ্টির ব্যপ্তিই ঠিক করে সংহত জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি। বৈশ্বিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির বীক্ষণ ও বৃত্তান্ত আক্রান্ত হচ্ছে এমন এক নিয়ন্ত্রণ তাড়িত জগত থেকে যেখানে মূলত সত্তা বাধিত হয় পন্যসংস্কৃতির রোগগ্রস্থতার দশাগ্রস্ততায় নিজেকে সমর্পিত করতে, যাতে প্রস্ফুটিত হচ্ছে ব্যক্তির কেবল অন্তর্র্বতী সত্তা, অতিবর্তী সত্তার নাগাল পাচ্ছে না স্বয়ং পন্যসংস্কৃতির হোস্ট বা দাতাগোষ্ঠীর জন-মানব। এই কালপর্বে দাঁড়িয়ে একজন পুঁজিরক বক্তা শুধুই এমন বক্তব্য দিতে পারেন যা তাকে উদ্ধুদ্ধ করায় পন্যের বিপননব্যবস্থায় ও প্রসারণে। মানে, এই সত্যে উপনীত করে যে, তারা শুধুই এমন একটা প থেকে পৃথিবীর তরফে কথা বলেন যে তারা উৎপাদকপ, যা তাদের উৎপাদনশীল মানসিকতাকেই তরান্বিত করছে। পুঁজির সঙ্গে ওৎপ্রোত ও নিবিড় সম্পর্কের বন্ধনে কাস্টমস ও এর প্রথার বিধা সমূহ একপ্রকারের বিধান তৈরি করছে।
এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য সত্য এই, উত্তরাধুনিক থিওরি সুদৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছে পুঁজিবাদের বিকাশের নীত-নৈতিকতা ও তত্ত্বসমূহ। তাত্ত্বিকদের এপ্রোচে ধরা পড়ছে বিনির্মিত সত্য-পৃথিবীর মানুষ একদল উৎপাদন করবে, অন্যদল কিনবে। অর্থাৎ মানবগোষ্ঠী দুটি সুস্পষ্ট ধারায় বিভক্ত- বিক্রেতা ও ক্রেতা। এর বর্হিবিভাগে অন্য কোনো সত্যে উপনীত হতে পুঁজিবাদী বা উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকগোষ্ঠী কুণ্ঠিত হবেন বৈকি। দেশ-কালের সীমা-পরিসীমা ভেঙ্গে, কেন্দ্র ও প্রান্তিক সীমা ভেঙ্গে এই তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে মানুষের সেই স্বাতন্ত্র্য যাতে মানুষ কেবল পন্য কেনার সমতার যেন তৈরি হচ্ছে কিনা। ফলে লাভবান পুঁজিগোষ্ঠী বৈশ্বিক সীমারেখা ভেঙ্গে ‘এক বিশ্ব এক গ্রাম’ বা ‘গোবালাইজেশন’ প্রোজেক্ট হাতে নিয়েছে। আর মানবমনে সেই চেরাগীকরণ করেছে, যাতে সে ভাবে তার কেনার মতা কতটা তৈরি হলো? বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের মানুষ এমন ক্রয়ে অভ্যস্ত হয়, যাতে সে নিজ ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-বিশ্বাস সব থেকে দূরে সরে এমন একটা সত্যাক্রান্ত হয় যাতে তার ভেতর উদিত হয় সে বৈশ্বিক। বস্তুত, এই বৈশ্বিকপনা তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে ঔপনিবেশিত জগতে। ব্যক্তির সত্তা এমন একটি অনুক্রমিক পরিম-লে আবর্তিত হতে যাচ্ছে অথবা হয়ে গেছে, সেখানে ধরা পড়েÑআমি তাই, যা আমি কিনি। এর ব্যাখ্য দিতে গেলে এই পর্যায়ে ভাবনাকে উন্নীত করতে হবে যেখানে পুঁজিবাদের তত্ত্বসমূহ এমন ভাবে ঘায়েল করেছে, একটা হেজমনি তৈরি করেছে যে ব্যক্তির স্বতন্ত্র আর দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে না। বহুজাতিক কম্পানীর মগজদখলের প্রতিযোগিতায় ব্যক্তি ন্যস্ত করছে নিজেকে। অজান্তে নতজানু হয়ে ওঠছে ব্যক্তি। কিসের প্রতি? যার আগে যে বিজ্ঞাপনের সত্য তৈরি হচ্ছে ব্যক্তির মাথায়, তারই। পুঁজি ব্যক্তির দৈন্য-হাতাশা-গানি-কেদ-দুঃখ-যন্ত্রণা-নৈরাশ্য-পীড়ন এসবের অনুসন্ধান করতে নারাজ। সে শুধু দখল করে নিতে চায় এমন কিছু যা ব্যক্তির হাতে আছে। তার তাকে রূপান্তরিত করতে ইচ্ছুক অর্থে। এর একটা মুদ্রামান সে তৈরি করবেই। পুঁজি ব্যক্তির সময়ের হিসাব করতেও নিমরাজি। শপিংকমপেক্সে এই কারণে বোধ হয় ঘড়ি থাকে না। যা এর রিয়েলেটিতে প্রকাশ।
‘রাঙামামিমার গৃহত্যাগ’ কবিতায় ভারতীয় জাতীয় জীবনের অন্যতম বাস্তবতা ইতিহাসের পাতা থেকেই যেন উদ্ধৃত করেছেন কবি। জীবনের বদল ঘটে অবস্থানের বদলের ফলে। দেশভাগের ফলে দুইদেশে এর যে প্রভাব, সমাজ- সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি প্রভৃতির পালে যাওয়া সমীকরণ,মাত্র কয়েক লাইনে সহজে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কবি। সহজ শব্দ আর শব্দের ছদ্মবেশে কবি প্রকাশ করেছেন দেশভাগের মর্মান্তিক যন্ত্রনা, জটিল জীবনসত্যকে।
‘প্রতিদিন ভোরের কাগজে
বর্বরতা শব্দ তার সনাতন অভিধার নিত্যনব প্রসারণ খোঁজে।
(কাগজ)
খবরের কাগজ খুললেই প্রতিদিন চোখে পড়ে দুঃসংবাদ। বোঝা সহজে দেশ ভালো চলছে না। দেশের মানুষ শান্তিতে নেই। প্রতিদিন ব্যক্তি মানুষ নিজেকে শুধরে রাতে ঘুমিয়ে পড়ে, আর ভোরে কাগজের সংবাদ তাকে হতাশ করে। খুবই কম শব্দ ব্যয়ে ও সহজ ভাবে কবি যে ভাবকে প্রকাশ করেছেন তাকে প্রকাশ্যে দিবালোকে আনলে এমন সত্যই পাওয়া যায়।
কলকাতা নগরে মানুষ সুখে নেই। অসুখী নগর জীবন। মন্দ খবরে ঠাসা খবরের কাগজ। এসব নিয়ে খুব সহজে বলতে পারাটা কঠিন।
‘জাল করেছি আমি আমার সর্বনাশের চাবি।’
(চাবি)
এই কবিতায় কবি সহজেই বোঝাতে পেরেছেন আÍবিহ্বল মানুষের যন্ত্রণা। মানুষটি প্রথমে ভেবেছে, কেউ বোধ হয় তাঁর চাবি নকল করেছে। তাই সে ব্যথিত। একপর্যায়ে মানুষটি বুঝতে পেরেছেন তিনি নিজেই জাল করেছেন তার স্বরূপের চাবি। এই কবিতায় কবি নিয়ন্ত্রণ হারা, স্বতন্ত্রবিস্মৃত মানুষের জীবন সত্যকে তুলে ধরছেন।
এভাবেই কবি তাঁর বিভিন্ন কবিতায় শব্দের আড়ালে সত্যের জš§ দিয়ে গেছেন। সত্যরা পাঠকের অনুভূতিতে ও বোধের চেতনাগত স্তরে এসে যখন ধাক্কা দেয়, পাঠক মাত্রই অনুধাবণ করতে পারেন, কতটা জোরালো উপস্থাপন, শঙ্খের সত্যের ভার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ও দেশভাগ পরবর্তী কলকাতার মানুষের জীবন ও জীবনসত্যের রূপটিকেই মূলত কেন্দ্রে রেখেছেন শঙ্খ ঘোষ।
‘নষ্ট হয়ে যায় প্রভু, নষ্ট হয়ে যায়।’
(ইট)
এই কবিতায় কবি ঈশ্বরের কাছে আÍসমালোচনার মাধ্যমে প্রার্থনা করেছেন। মূলত, জাগতিক অসত্য আর পাপের জটিল আবর্ত থেকে মুক্তি লাভের জন্যে।
এভাবেই শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘মাতাল’, ‘মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়’ সহ এই মাত্রিক কবিতার মধ্য দিয়ে জটিল জীবনের মর্মান্তিকতার স্বরূপ দেখিয়েছেন, যার নির্মিতি শব্দের আড়ালে। বস্তুত, সারল্য আর ছদ্মবেশের মধ্য দিয়ে, শব্দকে আভিধানিক অর্থ থেকে মুক্তি দিয়ে যেভাবে জটিল জীবনের মর্মান্তিকতার ইতিহাস বিবৃত করেছেন, আড়ালে যে সত্য ঢাকা পড়ে আছে তাঁর কবিতায়, বাংলা কবিতার ইতিহাসে তা বিরল।