লীলাবতী
আরিফ ওবায়দুল্লাহ
লীলাবতী
আরিফ ওবায়দুল্লাহ
লীলাবতী,
তোমার প্রতি জাগে প্রেম
তীব্র, অতি।
কবি খালেদ হোসাইন,
লীলাবতীকে পাই তোমার প্রেরণায়।
এক.
এ এক ক্রীড়াময় উপাখ্যান, তরঙ্গায়িত নদী!
বাগানে ফুল-ফল, সুগন্ধ বাহার
আর ডমরুর নিনাদ। থেকে থেকে বাজে
হংস-সুন্দরীর গান এই লীলাবঙ্গে।
অঙ্গে সাঁটা শাদাপালক-অঞ্চলে শোভন
অঞ্জলি-পটে আঁকা বাঁকা তলোয়ার,
মনে হয় কোন এক আদিম সওয়ার
আরাধ্য যুদ্ধে মেতে মায়া হাতে ফিরে গেছে
ত্রিবেণীর তীরে। তিনবার তলোয়ার দেখে দেখে
চোখ আসে আঁচলের খুঁটে, যেন ঝালরে মোরগঝুঁটি!
তার টুঁটি চেপে ধরে সুখদ সময় ধীরে
লুটোপুটি খেলে করপুটে, বিটনিক আলো
আর লু বাতাস মেখে মিথুন আসনে বসে
চার ফালি নব-চাঁদ! বাঁধ ভেঙে ভেসে যায় দিগন্তে।
সাপের মতন লকলকে জিভে লাঙলের ফলার মতো
কর্ষণে নিমগ্ন চাষা। খুলে যায় পুবের দুয়ার!
ভাঁজ করা খোঁপায় নামে নামহীন অস্ফুট গোঙানি।
তকমা খোলায় নিহত হতে হতে
তের পাক চুলে বাঁধা রাধাচূড়া বলে ওঠে
‘কালো যমুনার জলে লাল রঙা মীন খেলে
মওশুমে মওশুমে’।
ঋতুকালীন এইসব তরলের খেলা শেষে
সুখকর সাতদিন পলাতকা মীন,
ভয়হীন পানসি চলে উথাল-পাথাল মন্থনে।
সেপথে পাট করা জরিন ফিতে, চশমা
আর রূপালি বাটি হাতে ডিঙিয়ে শত নদ—
মহুয়ার আবেশ যেন, ভূগোল-নন্দন পর্যটন
চোখের দূরবীনে। দর্শনে ভ্রমণ-বিলাসী
বিস্ময়ে ধায়, এমন বিশ্বায়ন! একই পথে
খাল-নদ, বন-বাদার, পাথার, ভূস্বর্গ-খাদ।
অমরাবতীর কোল থেকে উড়ে আসা পরাগ
মেখে নেয় বেতাল শ্বাস। হায় কালিন্দি!
ডুবে ডুবে ডুবুরির ফনা কেমন নিস্তেজ।
জীর্ণ ভূধরের নিচ ছিঁড়ে-খুঁড়ে বেরোয়
উন্মাতাল ফেনিল বর্জ্য পৃথিবীর; সেখানে
বেল-ফুলের সুবাস, আতপ চালের ঘ্রাণ,
অদৃশ্য ধূপের ধোঁয়া, সোঁদাগন্ধ মিলে যায়
মুক্তো দানার ঘামে। ভিজে ভিজে জলাধারের
মসৃণ ডালপালা হেঁটে কেমন স্নিগ্ধ-আভা
যেন ভোর হাসে সুচিস্মিতার মতন।
দুই.
নিঃসঙ্গ নও তুমি লীলাবতী
সেই আদম শুরু থেকে
কোন এক আদিম মানব
আরাধ্য সাধনায় মেতে
তোমার উপর বর্ষিত হতে হতে
এই লীলাবঙ্গে।
কে বলে নিঃসঙ্গ তোমায়?
শীতনিদ্রায় এতোকাল নিমগ্ন থেকে
জেগেছে হাওয়ার গাড়ি
তোমার দরদালানের ভেতর
বুক ভরে শ্বাস নাও
নিয়ে দেখ ফুসফুস ভরে গেছে
ছেয়ে গেছে সুবাতাস, সুবাসে
কে বলে নিঃসঙ্গ তোমায়?
তিন.
পৃথিবীর সমস্ত কবি আর কবিতার কসম
যদি বৃষ্টি ঝরাও বুকে
আমি পেতে দেব সমস্ত ফুল আর ফসলের শয্যা
কর্ষণে কর্ষণে বিরাণ ভূমিও আজ আবাদী হবে
চাও যদি পলিমাখা সৌরভ
ভিজে মাটি আর তার সোদা গন্ধ
অন্ধ হয়েই নেমে আসো এই জ্যোতির্ময় আলোক গুহায়
এর চেয়ে অধিক চাওয়ার কিছু হয় না লীলাবতী।
চার.
মন বাড়াও লীলাবতী
আমি কি চেয়েছি হাত?
অতি দূর দেশ থেকে আনা বৃক্ষ
দেখ সেও সুগন্ধ ছড়ায়।
ফুলবতী হও লীলাবতী
আঁধারে আলোক যদি না জ্বলে
কী এক আকাল হবে লীলাবঙ্গে!
মন বাড়াও, মন বাড়াও লীলাবতী
আমি কি চেয়েছি হাত?
পাঁচ.
তকমা খোলো লীলাবতী
নিহত আমি তোমার করণ দোষে
শবযাত্রার শয্যা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে
এই দ্যাখো যে প্রাণ গেঁথেছি সমূলে
তার কি বিনাশ আছে স্নিগ্ধ শ্যামল লীলাবঙ্গে?
অঙ্গে সাঁটা তোমার পালক অঞ্চল
লাল পাড় তার খুঁটে বাধা মোরগ ঝুটি
আমিতো বুলাই তাতে কোমল পরশ
তকমা খোলো লীলাবতী, তকমা খোলো।
ছয়.
মন বাঁধো লীলাবতী, মন বাঁধো
এখনি নামবে যে বসন্ত বৃষ্টি
পুষ্প সৌরভে ভিজে ভিজে
আমরা এসে দাঁড়াবো
কোন এক খোলা ময়দানে
আদম হাওয়ার বেশে
এতোকাল সাধনা শেষে
বুঝিবা মিলন হবে এই লীলাবঙ্গে
মন বাঁধো লীলাবতী, মন বাঁধে।
সাত.
মন খোলো লীলাবতী, মন খোলো
আমিতো জমিয়েছি কথার পাহাড়
অবিরল ঝরনা ধারা
লীলাবতী মন খোলো
আহা! মধুর পাহাড় কেটে কেটে আমি
বানাবো হ্রদ, সমতল আর শ্যামল ভূমি
খেই হারাই যদি লীলাবতী
কথার মালা গেঁথে নিয়ে তোমার সমুদ্রে
দেব ঝাঁপ।
মন খোলো লীলাবতী, মন খোলো।
আট.
সামনেই বকো লীলাবতী
ভীষণ করে বকো
কোনো অসত্য বলিনি
কবিরা বলে না।
না পাই অমৃত পেয়ালা
গরল বিষই ঢালো
ভীষণ করেই মারো
লীলাবতী আড়ালে বকো না।
নয়.
লীলাবতী, গ্রীষ্মের এমন দাবদাহ
আমিতো তৃষিত থাকি অহরহ
খরায় পুড়ছে লীলাবঙ্গ দেশ
এখনই অমৃত ঢালো
আবেশে পান করি বেশ বেশ।
তুমি তো জলপরী
জল ঢালো, ঢালো জল অশেষ!
দশ.
মন বাড়ালে কী হয় লীলাবতী?
আগুন ঝরা দিনে
বিচ্ছেদে ভীষণ ভয়?
শেকল দেব তুলে
মন বাঁধলে কী হবে লীলাবতী?
এমন খরার দিনে
টুটে যাবার ভয়?
অভয় দিলাম তুলে
মন ছুঁয়ে যাও লীলাবতী
মন ছুঁয়ে যাও।
এগারো.
প্রসন্ন হও লীলাবতী, আমাকে গ্রহণ কর।
কৃষ্ণের বাঁশি আমার হাতে, তুমি রাধা হও।
রাধা হইও তুমি লীলাবতী
আরও হও মহুয়া মাতাল।
আমিতো থাকি সারাক্ষণ উথাল পাথাল।
প্রসন্ন হও লীলাবতী, আমাকে গ্রহণ কর।
বারো.
লীলাবতী, তোমায় আমি আগুন আভা ভালোবাসি
আমায় তবে পুড়িয়ে করো খাঁটি সোনা
স্বর্ণ দিয়ে মুড়িয়ে দিও হৃদ-কমল
সবাই যেন অবাক করে তাকিয়ে দেখে
ভালোবাসার স্নিগ্ধ কোমল এমন মহল আমরা গড়ি
তোমায় ছাড়া কেমনে বাঁচি
আগুন আভা গায়ে মাখি
লীলাবতী, পুড়িয়ে করো খাঁটি সোনা।
তের.
আমাকে হরণ করে রেখেছ বহু বিনিদ্র রাত্রি
তোমাকে সুপ্রভাত লীলাবতী
নক্ষত্র খচিত আকাশ পার হয়ে
তোমাকে ছুঁতে আসা।
আমার এ অভিবাদন তুমি গ্রহণ কর,
গ্রহণ কর লীলাবতী।
রাতঘুমে থাকি না বলে
দিবাস্বপ্নে মেতে থাকা যদি ভুল হয়
সকালের প্রশান্তিটুকু নিয়ে লীলাবতী
বলো সে কথা
তোমাকেই সুপ্রভাত প্রিয়তমা।
চোদ্দ.
তোমাকেই কেবল ভালোবাসি লীলাবতী
মেঘ কেটে কেটে দ্যাখো
ভরা চাঁদ উছলায়, জোছনায় মন জমে যায়
হাতে যদি পাও আলোটুকু মেখে গায়
মুখের উপর বিছাও কথার চাদর।
লীলাবতী বসে বসে আঁকো আঁকিবুকি আল্পনা
কল্পনায় এসে যায় আমার আঙিনা জুড়ে
উঠোনটুকুর পরে আমাদের চন্দ্র-বিহার
হাড়ে হাড়ে টের পাও— মেঘ কেটে কেটে
জোছনার আলো পেরে লীলাবতী
কেবল তোমাকেই দেখাই।
পনের.
লীলাবতী, মানুষ কেবল চলে যায়
শুধু মায়া বাড়ে, একদিন সব চুকে যায়
ভুল করে ভুলে যায়, কেন যায়
জান তুমি লীলাবতী?
আমিও যাব একদিন আকাশের ওপারে আকাশ
নীল প্রজাপতি হই যদি
লীলাবতী চাও যদি ভুলে যেও
ক্ষণিকের তরে মনে রেখ আমাদের ভালোবাসা
আর তার সব কীর্তি।
ষোল.
লীলাবতী, প্রতিদিন তোমাকে ছুঁয়ে যাই
কাছে এসে দেখি আর খুন হই
বেমালুম ভুলে যাই তোমাকে পেয়ে
অনেক কথা, বলা আর না বলা
এসব থাক চলো চুপচাপ
মেতে উঠি ছন্দে-দোলায়
মন বাড়াই, হাত বাড়াই
লীলাবতী, প্রতিদিন আমি ডুবে যাই
ভেসে উঠি, তোমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাই।
সতের.
লীলাবতী তোমায় আমি প্রাচীনকাল ভালোবাসি
আমায় তবে সিন্ধু নদের দোলা দিও
পুণ্ড্রনগর থেকে আনা অসীম তেজের ঘোড়া দিও
বঙ্গভূমির পড়ে থাকা উর্বরতার জমিন দিও
চর্যাগানের ছন্দ মাঝে মায়াজালের সুর তুলো
শূন্যপুরাণ তুলে ধরে হাজার কথার তর্ক জুড়ো
তুমি আমার জোছনামতি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
আঠারো.
লীলাবতী, কেন তুমি বল না কথা
ধর না মুঠোতে ফোন
দেখ এসেছি কাছে কত
ছুয়েছি মন।
লীলাবতী, কেবল বকো পিছে পিছে
যদি না আসো কাছে, না বসো পাশে
মিছে সব, পনের আনা মিছে।
উনিশ.
লীলাবতী, তোমায় আমি হিমেল হাওয়া ভালোবাসি
প্রভাত বেলার ঝিরি বাতাস যেমন দোলা জাগায় গায়
তেমন করেই দুলি আমি যখন তোমায় কাছে পাই।
আমার হাতের তানপুরাটা দিলাম তুলে তোমার হাতে
ভালোবাসার সুরের মায়া ছড়িয়ে পড়ুক সব প্রভাতে।
বিশ.
সুগন্ধি রুমাল চাই না লীলাবতী
একশ আটটি নীলপদ্মও খুঁজি না।
শুধু চাই শান বাঁধানো দিঘীর জলে
চাঁদের ছায়াটুকু পড়ুক
একটি দুটি পদ্ম ফুটুক সেখানেই।
সমস্ত উঠোন জুড়ে হাসনাহেনা আর বেলী সুগন্ধ ছড়াক।
খুব করে চাই তুমি পাশে থাকো
জোছনার আলো বাহুতে ধর।
একুশ.
লীলাবতী,
সকাল বেলা সন্ধে আলোয়
নিত্য তোমার ছবি
তুমি যে আমার স্বপ্নলোকের
দুয়ার খোলার চাবি।
বাইশ.
লীলাবতী, তোমায় আমি আদিগন্ত ভালোবাসি
মেঘের ভাঁজের জলকণা বৃষ্টি হয়ে যেমন ছোটে
তেমন করেই ভালোবাসার বর্ষা নামে
তোমার আমার বুকের পরে।
সাত দিগন্তে ছড়িয়ে পড়া ভালোবাসা
এক দিগন্তে নামিয়ে আনি।
মেঘের পালক সঙ্গে করে দাঁড়িয়ে আছি তোমার ভরে।
তোমায় আমি অনেক দুপুর ভালোবাসি।
তেইশ.
শীতঘুমে থেকো না লীলাবতী
এখনতো গ্রীষ্মকাল
নামাও ঘোর বর্ষা অতি
মুছে যাক সব জঞ্জাল
পুষে থাকা কথা খুব ক্ষতি
পাশাপাশি চলো হাঁটি
এখনতো সকাল।
চব্বিশ.
তোমার ছবি ভেসে ওঠে তাই
আয়নায় নিত্যদিন নিজেকে খুঁজি
আমার ভেতরে তোমার স্থিতি
জান তুমি লীলাবতী?
যখনই মরে যাই তোমা পানে ছুটে ধাই
আমিতো তোমার শরীর!
জানো তুমি লীলাবতী?
পঁচিশ.
মন ছুঁয়েছি লীলাবতী, মন ছুঁয়ে যাও
ভেতরে আমার অদম্য সাহস তুমি দেখতে পাও?
ছাব্বিশ.
লীলাবতী জানে ভালোবাসার ঝাঁড়ফুঁক
তবু আমার প্রাণ করে ধুকধুক
এতো দেখি কঠিন অসুখ!
সাতাশ.
লীলাবতী খুব জানে ভালোবাসার মানে
লীলাবতী তাই আছে এখানে ওখানে,
সবখানে।
আটাশ.
লীলাবতী তোমায় আমি সকাল সন্ধ্যা ভালোবাসি
আমার চোখে হাজার হ্রদ, সিন্ধুমালা
তাকিয়ে দেখ, দেখতে পাবে পাল্টে গেছে আমার জগৎ
চোখের তারা দেখেছিল অযুত-নিযুত স্বর্গ-সোপান
এখন কেন ফিকে হলো
কেমন করে বলতে পার?
ঊনত্রিশ.
লীলাবতী তোমায় আমি অনেক প্রহর ভালোবাসি
আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে অনেক তারা
আলোর মিছিল
তাদের থেকে একটি তারাই খসে পড়ে আমার বুকে
প্রতিদিন।
এমন করেই হাজার বছর জমে জমে
আলোর পাহাড় আমার বুকে
ভালোবাসার।
ত্রিশ.
লীলাবতী তোমায় আমি শ্যামল বরণ ভালোবাসি
আমায় তবে কলাপাতার ছাউনি দিও
শিশির ভেজা দুর্বাঘাসের সকাল দিও
কচি ডাবের কোমল খোসার রূপ দিও
শস্যে ভরা সবুজ সতেজ মাঠে নিও
চুলের খোঁপায় বুনো ফুল গুঁজে নিও
কানের মাঝে স্বর্ণলতার দুল পড়ো
তুমি আমার উপকথা, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
একত্রিশ.
মন পোড়ে লীলাবতী, মন পোড়ে
ফুঁ দিলে হাওয়ায় চুল ওড়ে
বাতাসে ভেসে যায় সুগন্ধি তেলের ঘ্রাণ
গালের ভাঁজে হামেশা ফোটাও হাসি লীলাবতী
চুলের কাঁটায় তবু বিঁধেছে মন
মন পোড়ে লীলাবতী, মন পোড়ে
ফুঁ দিলে হাওয়ায় চুল ওড়ে।
বত্রিশ.
তোমাকে ছেড়ে যাই যদি লীলাবতী
কভু মহাশূন্যে
যে তারা ছড়ায় আলো অধিক
প্রগাঢ় নিশীথে
নিয়ত আমাকে পাবে তুমি সেখানে।
লীলাবতী কভু যদি মেঘে ঢাকে আকাশ
হাওয়ায় তাড়িয়ে দিও তাদের দেশে
আকাশের গায়ে মিশে থাকা আমার অবয়ব
লীলাবতী, জমিনে তুমি থেকো আবেশে।
তেত্রিশ.
লীলাবতী মাঝে মাঝে যাঁতাকলে পেশে
আমাকে তুলোধুনো করে
ভেঙেচুড়ে হই একাকার
লীলাবতী মাঝে মাঝে ভালো
খুব করে বাসে
নেয় খুব কাছে, তার পাশে
আবেশে পাড়ি দেই পারাবার।
চৌত্রিশ.
মাঝে মাঝে ভাবি
লীলাবতীর সাথে পাহাড়ে যাবো
ওকে সবুজে মেশাবো
ধুর ছাই! লীলাবতী এসবের কিছুই বোঝে না
শুধু এঘর ও ঘর করে, পালিয়ে বেড়ায়।
মাঝে মাঝে ভাবি
লীলাবতীর সাথে সাগরে যাবো
ওকে জলে ভেজাবো
শুধু ভয় ভয় করে
আমাকে জাপটে টেনে ধরে।
লীলাবতী ডুবসাঁতার জানে না।
পঁয়ত্রিশ.
লীলাবতী ভাবে আর ভাবায়
লীলাবতী কাঁদে আর কাঁদায়
লীলাবতী বুক ভাসায়।
ছত্রিশ.
লীলাবতী মাঝে মাঝে আমাকে বোঝে না
কী সব বলে আর বকে!
আমি নাকি চলি ঝোঁকে
লীলাবতী, শুনে যাও
আমার জীবন চলে না ছকে।
সাইত্রিশ.
লীলাবতী, তুমি দূরে গেলে
তোমাকে বকতে পারি ভীষণ
কেন এতো কাছে আসো
মিছেমিছি?
লীলাবতী, তুমি পাশে এলে
ভুলে যাই অভিমান
শিমুল তুলোর মতো
উড়ে যায় মন দূর দেশে
জোয়ারে ভেসে যাই সারাক্ষণ
লীলাবতী তুমি কাছে এলে খুন হই,
মরে যাই!
আটত্রিশ.
লীলাবতী দেখ ফুটেছে টগর, ডালিয়া, সূর্যমুখী
তবে তুমি ক্যান হবে পোড়ামুখী!
ঊনচল্লিশ.
লীলাবতী, তোমায় আমি কাজল কালো ভালোবাসি
আমায় তবে সুরমা আঁকা আাঁখি দিও
চোখের পানে তাকিয়ে থেকে পলক ফেলো
মেহেদি রাঙা হাতের পরে হাতটি রেখো
ঘোমটা খুলে আঁচল তুমি মেলে ধরো
হাতের পাতার উপর হাত যত্নে রেখো
পরীর দেশের অনেক কথার গল্প বলো
গল্প কথায় রাত্রি তুমি পাড়ি দিও
জানলা খুলে জোৎস্না আলো ধরতে দিও
তুমি আমার স্বপ্নচূড়া সত্যকথন
ভালোবাসি, ভালোবাসি।
চল্লিশ.
লীলাবতী তোমায় আমি শুভ্র সাদা ভালোবাসি
আমায় তবে তোমার ফুলের মালা দিও
বাগান বিলাস, বকুল আরো চম্পা দিও
চাঁদনী রাতের মধুমাখা হাসি দিও
ভালোবেসে হাত বাড়িয়ে পাশে নিও
আঁচল বাঁধা আধুলিটা খুলে দিও
এমন করেই সারা বিকেল রাঙিয়ে তুলো
তুমি আমার টগরমতি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
একচল্লিশ.
লীলাবতী, তুমি আমার সন্ধ্যাতারা
ভালোবাসি, ভালোবাসি।
বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা অনেক নীল
পদ্ম হয়ে ফোটে এখন ভালোবাসার দীঘির জলে
শান বাঁধানো ঘাটের উপর পা ডুবিয়ে অনেক বিকেল
মুখর সন্ধ্যা জমে ওঠে জলপরীর গল্পকথন
পরীর দেশের কয়টি তারা খসে পড়ে দীঘির জলে
হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ঝলমলিয়ে হেসে ওঠে
অবাক করা পদ্মগুলো মাথা নাড়ে কাছে এসে
আমায় তবে ভালোবেসে সুবাস মেখে দেয় যে শেষে
তোমার কাছে যাবো বলে লীলাবতী আসছি পথে।
বিয়াল্লিশ.
লীলাবতী, কভু যদি মরে যাই
সমাধির ঘাসে ফুল দিও
খুব করে বলো ভালোবাসি
জানি না শোকার্ত মেঘেরা বৃষ্টি ঝরাবে কিনা
তবে তোমার চোখে নুহের প্লাবন আসবে জানি লীলাবতী
এলোচুলে সবাই বিলাপ দেখবে তোমার
যদি মরে যাই কভু অগোচরেই চোখ মুছো,
তারপর মুছে ফেলো সব স্মৃতি
লীলাবতী খুব করে বলো ভালোবাসি।
তেতাল্লিশ.
ডানা ছিন্ন করো না লীলাবতী
যদি তোমার পাখায় ভর করে বাঁচি
কী ক্ষতি?
পালকবিহীন তোমার উড়ে চলা
ভাবা যায় লীলাবতী?
তোমার পাখায় আমার রঙিন পালক
পলকে উড়ে যাই চলো লীলাবতী
ডানা থাক, ছিন্ন করো না
ছিন্ন করো না লীলাবতী।
চুয়াল্লিশ.
খুব সকালে তোমার কাছে যাবো
একটুখানি আলতো পরশ
বুলিয়ে তোমায় দেবো
জমিয়ে রাখা ক্লান্তিগুলো
আমার কাঁধে নেব
লীলাবতী খুব সকালে
তোমার কাছে যাবো।
পঁয়তাল্লিশ.
জানি তোমার মন ভালো নেই লীলাবতী
আড়ালে কেবল চোখ তুমি ঢাকো
মুছে ফেল বেদনার ক্ষত
সব কি বাঁধা যায় বলো?
লীলাবতী আমরা সবাই জাগতিক বাঁধনে চলি
আমরা শুধু মনে থাকার কথা বলি
দূরে গেলে সব কি সরে যায় লীলাবতী?
থাকে প্রেম তীব্র অতি
লীলাবতী, চোখ মেলে থাকো।
ছেচল্লিশ.
লীলাবতী, এই যে আবার কেমন করে দেখা হলো
ভাবো কিছু?
কেমন করে আমরা এখন একই বাতাস গায়ে মাখি, ঘুরি ফিরি
পৃথিবীটা কেমন জানি বেশি ছোট
আরো খানিক বড় হলে কিবা এমন ক্ষতি হতো?
যখন খুশি হারিয়ে যেতাম বালুর চরে
খড়ের গাদায় জলের ভেতর ডুবে ডুবে
তোমার নাকের নোলক ধরে
কিবা এমন ক্ষতি হতো?
লীলাবতী এমনি হয়, পৃথিবীটা বেশি ছোট
কেমন করে দেখা হলো
ভাবো কিছু?
সাতচল্লিশ.
লীলাবতী চলনা এমন করে
আমরা দুজন ভেসে যাই পলকে
শূন্যে, মেঘের পালকে
খুশি হবে সুনীল আকাশে
ত্বরাসে চমকিবে পাহাড়ে
কী যে ভালোবাসা আহারে!
লীলাবতী চল ভেসে যাই জোয়ারে
আমি দাঁড়িয়ে তোমার দুয়ারে
প্রেমকাব্য গাঁথা শিয়রে
পৃথিবী দেখবে বিভোরে
লীলাবতী চল অমর হই।
আটচল্লিশ
ধানের অবারিত মাঠ, সর্ষের জমিন, মটরশুঁটির ক্ষেত
এসবে দারুণ লোভ জাগে লীলাবতী
তোমার লীলাবঙ্গ থেকে একখণ্ড জমিন দিও
ভালোবাসার চাষ হবে সেখানে।
অঙ্গে ধুলোবালি, গায়ে কাদা ঘাম মেখে
খামারের অনেক ফুল আর ফসল নিয়ে
লীলাবতী তোমার সামনে এসে দাঁড়াবো
একখণ্ড জমিন দিও লীলাবতী
আমাদের যৌথ খামার হবে সেখানে।
ঊনপঞ্চাশ
লীলাবতী তোমায় আমি অনেক প্রহর ভালোবাসি
আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে অনেক তারা
আলোর মিছিল
তাদের থেকে একটি তারাই খসে পড়ে
আমার বুকে প্রতিদিন।
এমন করেই হাজার বছর জমে জমে
আলোর পাহাড় আমার বুকে
ভালোবাসার।
পঞ্চাশ
লীলাবতী কী খোঁজো তুমি?
বারবার কেঁপে ওঠে ভূমি!
একান্ন
লীলাবতী,
লু বাতাস গায়ে মাখি
আকাশে উদাস দৃষ্টি
কখন ভেজাবে মাটি
ঝরাবে অঝোর বৃষ্টি।
বায়ান্ন
আমার যত পূর্বপুরুষ আর উত্তরসূরীর কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
মসজিদের তারকা খচিত গম্বুজের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
সুদীর্ঘ রাত্রি আর সুদীর্ঘ দিনের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
আমার যত বলা আর না বলা কথার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
হিমালয়ের সুউচ্চ পর্বতমালা আর সাত সমুদ্রের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
সমস্ত আসমান-জমিন আর সিদরাতুল মুনতাহার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
রংধনুর সাতরং আর বৃষ্টির অগণিত ফোঁটার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
বাগান বিলাস, বকুল আর টগর ফুলের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
মটরশুঁটি, পুঁইলতা আর সজনে ডাঁটার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
জেগে ওঠা অজস্র চর আর নিঝুম দ্বীপের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
পলিমাখা ভূমি আর সকল আবাদী জমির কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
জামদানি শাড়ি, সুগন্ধি তেল আর নাকফুলের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
হাতপাখা, শেতলপাটি আর নকশি কাঁথার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
চুন-সুপোরি, মসলা আর তবক দেওয়া পানের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
তোমার বিছানো আাঁচল আর মুছে দেওয়া ঘামের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
মরুর লু হাওয়া আর উটের গ্রীবার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
দারুচিনি, শুকনো লঙ্কা আর চালতার আচারের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
ঘাসফড়িঙ, নীল প্রজাপতি আর পরিযায়ী পাখিদের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
তোমার মধুর হাসি আর গালের ভাঁজের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
উনুনের হাড়ি, ভাতের থালা আর পানির পেয়ালার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
শতবর্ষী বটের ছায়া আর কোটি কোটি নক্ষত্রের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, আরো অনেক ভালোবাসার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
জিব্রাইলের ডানা, নুহের প্লাবন আর তুর পাহাড়ের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
গাঁয়ের মেঠো পথের বালক আর ঘর ছাড়া কিশোরীর কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
মহুয়া, হিজল-তমাল আর গহীন বনের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
তোমার সমস্ত ভালোলাগা আর না লাগার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
আদম, ইভ আর সমস্ত সত্তার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
দোয়াত-কলম, বর্ণমালা আর সমস্ত ভাষার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
তোমার ফুসফুস ভরে দেয় এমন বাতাসের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
পেন্ডুলাম, ঘড়ির কাঁটা আর অসীম কালের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
শালি ধান, ভুট্টার খই আর সরিষা দানার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
পাহাড়ি ঢল, তুষারপাত আর সাইমুম ঝড়ের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
আমার জেগে থাকা রাত আর দীর্ঘ কবিতার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
আযানের মধুর ধ্বনি আর সুবেহ সাদেকের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
আমার ছেলেবেলা আর বেড়ে ওঠা গল্পের কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
মায়ের অগাধ স্নেহ আর তার মুখচ্ছবির কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
বাবার তসবি আর সফেদ পাঞ্জাবির কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
ফ্রেমে আঁটা তোমার সাদা-কালো ছবির কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
পৃথিবীর তাবৎ মানুষের সমস্ত ভালোলাগার কসম
লীলাবতী তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালোবাসি।
লীলাবতী তোমাকে ভালোবেসে জেনেছি
আমাদের পথ কী মধুর আর গতিময়।
তেপ্পান্ন
লীলাবতী তোমায় আমি অনেক দুপুর ভালোবাসি
আমায় তবে শীতল মাখা শান্তি দিও
ক্লান্তি শেষে ফিরে এলে তালপাখাটা নাড়িয়ে দিও
যত্ন করে তোমার গড়া নকশি কাঁথা বিছিয়ে দিও
মাগুর মাছের বেনুন বাটি যত্ন করে তুলে দিও
আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম আলতো করে মুছে দিও
লীলাবতী তোমায় আমি অনেক বিকেল ভালোবাসি।
চুয়ান্ন
লীলাবতী তোমায় আমি জ্যোৎস্নামাখা ভালোবাসি
আমায় তবে বর্ণছটা আলোক দিও
উঠোন জুড়ে মাদুর পেতে অনেক কথার গল্প বলো
বসে বসে হাতের বালা পায়ের নুপুর
রিনিঝিনি শব্দ তুলো
কাঁধের উপর এলিয়ে দেওয়া তোমার মাথা
হাতের পরে না হয় হাত একটু রেখো
লজ্জা ঢাকা চাওনি তুলে আদর করেই বকে দিও
তোমায় আমি দিবানিশি ভালোবাসি।
পঞ্চান্ন
লীলাবতী, আমরা দুজন হাত ছুঁয়েছি মাটির পর
হাতের উপর নীল ফড়িংটা দারুন খুশি
আমরা দুজন পণ করেছি তুলবো ঘর
পূর্ণ আভায় লাল দেয়ালটা কে যে দোষী!
আমরা দুজন সুখ ভুলেছি বালুর চর
তপ্ত হাওয়ায় রাঙা হবো দিবানিশি।
ছাপ্পান্ন
লীলাবতী,
তোমায় আমি অযুত-নিযুত ভালোবাসি
আমায় তবে একটুখানিই সোহাগ দিও
শিশির ভেজা শিউলি ফুলের পরশ দিও
কুড়িয়ে আনা বকুল ফুলের মালা দিও
হাতের পরে পরাগ রেণু মাখিয়ে দিও
খুঁটিনাটি খুনসুটিতে মাতিয়ে তুলো
তুমি আমার পুষ্প সুবাস, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
সাতান্ন
লীলাবতী,
ভালোবাসার একটি বিন্দু দিচ্ছি তোমায় প্রতিদিন
বিন্দু বিন্দু মহাসিন্ধু উঠছে বেজে সুরের বীণ
ভালোবাসার অতল তলে হারিয়ে যাওয়ার ভীষণ সুখ
আমায় তবে নিয়ে যেও অচিন পথের অনেক দূর।
আটান্ন
লীলাবতী,
তোমায় আমি দিঘীর জল ভালোবাসি
আমায় তবে শান বাঁধানো ঘাটে নিও
জলের মধ্যে পা ডোবানো বিকেল দিও
ফুটে থাকা পদ্ম কিছু তুলে নিও
খোঁপায় তোমার একটি দুটি গুঁজতে দিও
স্বচ্ছ জলের ঝাঁপটা তুমি ছিটিয়ে দিও
ভালোবাসার বাহুডোরে বেঁধে নিও
তোমায় আমি অনেক প্রহর ভালোবাসি।
ঊনষাট
লীলাবতী, চাই আমি তোমাতে মন ডুবে থাকি
চোখ দুটো রাত-দিন তাই মুদে রাখি
চাও যদি ঠোঁটে নাও বিষলখা ছুরি
মুখেতে বিধাও তুমি আমি প্রাণে মরি!
জান যদি বের হতে দেরি হয় অতি
প্রেমের ফাঁসেই মেরো না হয়, তুমি লীলাবতী।