দ্রুত পট পরিবর্তন
দ্রুত পট পরিবর্তন
এ কে এম, জাকারিয়া
মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক প্রতিযোগীতামূলক একটি বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে, প্রকৃতনগরের নাগরিকত্ব লাভ করে অভি। প্রকৃতনগর, মহানগরের খুব কাছাকাছিই। কথিত আছে যে, সর্বময় সাফল্যের ধারক ও বাহক যাবতীয় সিনিয়র সিটিজেনদের আমলে প্রকৃতনগর থেকে বিরতীহীন বাসে মহানগর পৌছাতে সময় লাগত মাত্র আধঘন্টা। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর ‘যোগাযোগ বিপ্লব’ হাওয়া লাগাতে পারেনি প্রকৃতনগরে। এখন সময় লাগে নূন্যতম দেড় ঘন্টা। না, রাস্তা বেড়ে যায়নি। প্রকৃতনগর থেকে মহানগরে যাবার পথে ‘ট্রাফিক জ্যাম’ নামে এক ওয়েটিং রুম স্থাপিত হয়েছে। হুটহাট চলন্ত বাস ব্রেক কষে থেমে যায় এবং তারপর অনির্দিষ্ট কালের জন্য বসে থাকতে হয়। তারপর যতদূর চোখ যায়, নানা পদের যানবাহন দেখা যায় আর শোনা যায় ঘন ঘন হর্নের বিদঘুটে শব্দ”...
সুমিতের প্রথম গল্প ভাবনাটা ছিল এরকমই। তারপর দ্রুত লিখে ফেলে সে আবিষ্কার করল, পুরো লেখায় একবারই চরিত্রের নাম উল্লেখ করেছে, তাও আবার শুরুর লাইনেই। আর কোথাও নাম নেই, কেবলই বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তরের মত অমূলক কথা বাড়ানো। এই ভেবে লেখাটা আর এগোতে দেয়নি, শুরুতেই শেষ। তারপর ডান থেকে বাম, গুলিস্তান থেকে ধামরাই, আব্দুল্লাহপুর থেকে নবীনগর পর্যন্ত রাস্তা মাপতে মাপতেই কেটে গেছে কয়েক মাস। নানা কাজের ভিতরও সুমিত নিয়ম করে মনে রেখেছে দুটি বিষয়। ১.গ্যাসবাতি সাথে রাখা ২.একটা গল্প লেখার ইচ্ছা।
একবার নারিকেল জিঞ্জিরা থেকে বয়ে আনা ‘জিনি মার্টিনি’র অর্ধেকটা গিলে ফেলে সুমিত ভেবেছিল, যেহেতু নাম নিয়েই এতো বিড়ম্বনা, তাই সে নামের বদলে সর্বনাম ব্যবহার করে গল্প লিখবে, তবুও লিখবে। আরোপিত মানসিক শক্তির প্রভাবে টানা দুইরাত শিরদাঁড়া সোজা করে বসে থেকে, সুমিত সিদ্ধান্ত নিলো তার গল্পের নারী চরিত্রের নাম হবে ‘আপনি’ আর পুরুষ চরিত্রের নাম হবে ‘তুই’। এই পরিকল্পনা প্রকৃতনগরের কয়েকজন স্বঘোষিত বিদ্বান এবং সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগা জীবন সমালোচকদের বলতেই, তারা যেন হালে পানি পেলেন। দাঁতে দাঁত পিষে, প্রাগৈতিহাসিক লিংকেজ তৈরি করে, সিলেক্টিভ বই, সিনেমা আর কবিতাগুলো থেকে উদাহরণ টেনে, সাল-টাল উল্লেখ করে মহাজ্ঞাণী-মহাজনেরা জানালেন, “না না, এ হতে পারে না, আপনি নায়িকার নাম, নায়কের নাম দিতে চান ঠিকই কিন্তু ব্যবহার করতে চান সর্বনাম, এইটা কিছু হইল... এটা রীতিমত অমুক সালের তমুক অধ্যাদেশের সাড়ে বাহান্ন ধারার সরাসরি লঙ্ঘন”। কুঞ্চিত ভ্রু, বুকের বাম দিকের দ্রুত ওঠা নামা আর একধরনের অস্থিরতা নিয়ে জ্ঞানের ঠিকাদারদের লম্বা বক্তব্য শুনে যায় সুমিত। আর নিজের প্রচ্ছন্ন একটা সত্তাকে মনে মনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে যায়, অপাত্রে ঘি ঢালার অভিযোগে। কিন্তু জ্ঞানের আসর ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত মুখের সাইনবোর্ড হাসিটা ধরে রাখে।
“এই রকম লোক দেখানো ভদ্রতা করার কি কোন দরকার আছে”?... এই প্রশ্ন থেকে শুরু হয়েই শেষমেশ তুমুল ঝগড়া হয়ে গেল সুমিত আর চিত্রা’র। অতীতের আমলনামা ধরে টানাটানি হল, সুমিত চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকল উপায়ন্তর না দেখে চিত্রা কান্নাকাটি করতে করতে ফিরে গেল। তারপর টানা দশ দিন কথা বলেনি, ফোন ধরেনি, এসএমএস করেনি এমনকি ফেসবুকেও ব্লক করে রেখেছে। চিত্রার সাথে সাময়িক টানাপোড়েন এর প্রভাবে সর্বনাম ভিত্তিক গল্প লেখার প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করে সুমিত। নানা ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আর কাঠ খড় পুড়ানোর পর অভিমান ভেঙে চিত্রা ঠিকই ফিরে আসে সুমিতের কাছে, কিন্তু গল্পটা আর আসে না।
দিনকে দিন স্মৃতিশক্তি আস্থাহীন হয়ে পড়ে, অভাব অভিযোগ বাড়ে, জ্ঞানের স্থান দখল করে তথ্য, প্রকৃতনগরের ব্রাক্ষণগণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে দল-মত-জাত-পাত ভুলে একই পাত্রে খাওয়া দাওয়া শুরু করেন, খলিফা পদে পরিবর্তন আসে, জীবন ও নাটক সমান্তরালে চলতে চলতে একে অপরকে গুলিয়ে ফেলে, স্বপ্ন দেখার উপর এক বছরের প্রশাসনিক স্থগিতাদেশ জারি হয় আর আলস্যও কিছুটা পেয়ে বসে সুমিতকে। এক ধরনের বিলাসী অসন্তোষ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক। চায়ের কাপের তলানিতে ক্যামেরার ‘ফিস আই ভিউ’ দেখতে দেখতেই একটা সিগারেট উল্টা করে জ্বালিয়ে দেয় সুমিত। তারপর কি ভেবেই যেন এই ঘটনার কথা কবিতার মত করে লিখে ফেলে। সেই থেকে কাব্য, ছন্দ, জীবন, দ্বন্দ্ব, লক্ষণ এবং পর্যবেক্ষণে দারুন মজা পেয়ে যায়। মাসে অন্তত একবার এধরনের ঘটনার বর্ণনা নিয়ম করে লিখতে থাকে। একে ওকে পড়তে দেয়।
প্রকৃতনগরে সুমিতের প্রথম বন্ধু শোভন, শোভনের সাহিত্য সমালোচক প্রেমিকা সুপ্তি একদিন একটা কবিতা পড়ে সুমিতকে এসএমএস করল :
“ইফ ইউ ডণ্ট মাইন্ড,আই ওয়ানা নো~আর ইউ নার্সিসিস্ট? মানে, ডু ইউ ফিল দ্যাট?”
ফিরতি এসএমএসে সুমিত এরকম প্রশ্নের কারন জানতে চাইলে, সুপ্তি জানালো :
“তোমার কবিতাগুলোতে যেভাবে তুমি ‘তোমার’ উপস্থিতি জানাও, তাতে অন্যসব কিছুর বর্ণনা মার খেয়ে যায়”।
সম্ভবত সুপ্তির জানার গভীরতা সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ধারণা থাকার কারণেই, নিজের কবিতাগুলো আবার পড়ে সুমিত, বারবার পড়ে। মাঝরাতে একসময় সুপ্তির অনুযোগ সত্যি মনে হয়। কিছুদিন এই ‘নার্সিসিস্ট’ শব্দটাই ঘুরতে থাকে মাথায়। তারপর একদিন প্রকৃতনগরের আবহমান ঐতিহ্য ‘বৈরাগ্য’ এর কাউণ্ট ড্রাকুলা পেয়ে বসে সুমিতকে। ফুটেজ খাওয়ার জন্যেই হোক আর পরাণের গহীন ভেতর থেকেই হোক, সুমিত একদিন ঘটা করে ঘোষণা দেয় যে- “কবিতা-টবিতা বন্ধ, অনেক হইছে, আর না”।
হঠাৎ করেই চিত্রা খুব অদ্ভূত আচরণ করতে থাকে। সকালের কথা সন্ধ্যায় ভুলে যায়, ক্লাসে যায় না আর কি নিয়ে যেন ভাবতে থাকে। গভীর রাতে সুমিতকে ফোন করে চার পাঁচ মিনিট চুপ করে থাকে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফোন রাখার আগে নিচু স্বরে বলে “একটা গল্প বলো না, সুমিত”। প্রথম দুই তিন দিন সুমিত খুব বিরক্ত হতো, বলতো “আমার তো কোন গল্প নাই”। তারপরও ধারাবাহিকভাবে একই ঘটনা ঘটতে থাকে। দিনকে দিন চিত্রা আরো ভাবলেশহীন হয়ে পড়ে। সুমিত গোপনে চিত্রার জন্য একটা গল্প খুঁজতে থাকে, কিন্তু কাউকে জানতে দেয় না।
কিন্তু কি নিয়ে গল্প হবে? সুমিতের মনে হয় সবকিছুই বলা হয়ে গেছে, আর নতুন কিছুই বলার নেই। বলবার জন্য নতুন কিছু খুঁজতে খুজতেই, বর্ষাপীড়িত গোলাপের গন্ধে এগলি ওগলি ঘুরে বেড়ায়। প্রবল জাতীয়তাবোধে ভুগে ধমক খায়। পাবলিক বাসে ‘ইস্টুডেন্ট’ পরিচয়ে অর্ধেক ভাড়া দেয়া নিয়ে, হেলপারের সাথে উচ্চবাচ্য করে। মধ্য দুপুরে অবাক কুকুরের ছবি তুলতে গিয়ে সাটার স্পিড, আইএসও, এপারচার বিষয়ক ছোট্ট লেকচার শোনে। রেল লাইন ধরে সোজা হেঁটে যায়। ফাল্গুনের বৃষ্টি উপেক্ষা করে চাঁদের উজ্জ্বল আলোর বার্তা পৌঁছে দেয় কীর্তনখোলা পাড়ের জীবনানন্দ দাশকে। একক এবং অনন্য হবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে এটা সেটা লিখে। প্রাক্তন ভালোবাসাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা পত্র, নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, স্কুল ছাড়ার সাত বছর পূর্তিতে লম্বা ফেসবুক স্ট্যাটাস, প্রোগ্রাম রিভিউ, ছড়া-টড়া বিভিন্ন কিছু। অতিক্রান্ত প্রতিটি মুহূর্তই সুমিতের কাছে গল্প মনে হয়।
প্রায় তিনদিন একই ঘরে কাটানোর পর, বাইরে এসে সুমিতের কেমন যেন নেশা নেশা লাগে। সুমন ভাইয়ের সাড়ে সাত তলার ছাদে উঠে এদিক ওদিক তাকায়। দূরে একটা বাড়িতে একই ঘরে দশ বারো জন মানুষ এমাথা থেকে ওমাথা হাঁটাহাঁটি করে। এই প্রথমবারের মত সুমন ভাইয়ের ছাদে গিয়েও সুমিতের মনে হয় এরকম ঘটনা সে আগেও দেখেছে। মুহূর্তেই সুমিত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, দূরবর্তী জানালায় একই ঘরে দশ বারোজন মানুষকে নিয়েই সে গল্প লিখবে। কিন্তু, একটা ঘরে এতগুলো মানুষের গল্প কেমন হবে? সুমিত ভাবে, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা গল্প এসে ঐ ঘরে মিলিত হবে। ঐ ঘরে কি কোন নারী আছেন? নাকি সবাই পুরুষ। গল্পটা কি ‘জেন্ডার বায়াসড’ হয়ে যাচ্ছে? এইসব ভাবতে ভাবতেই সুমিত দেখে তার দৃষ্টিসীমার খুব কাছে দিয়ে একঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে। এতো ভালো করে আর কাছাকাছি থেকে কোনদিন পাখির উড়ে যাওয়া দেখেনি সে। একটা প্রশান্তির বাতাস কানে হাওয়া লাগিয়ে যায়। পাখিদের হালচাল ভাবিয়ে তোলে সুমিতকে। সে ভাবে পাখিদের জীবনেরও তো একটা গল্প আছে। সেটা কি রোমান্স, ট্রাজেডি, থ্রিলার, স্যাটায়ার নাকি ড্রামা? সেই গল্পটাও কি লিখবে সুমিত?
চিত্রা ফোন করে জানতে চায় “তুমি কি আজও মহানগরেই থাকছ”? “ফিরবা না”? সুমিত সংক্ষেপে জানিয়ে দেয় “ফিরবে, রাত হবে”। তারপর আবার সর্বশেষ পাখিদের গল্প নিয়ে ভাবতে থাকে। কানের দুই পাশে খুব তীক্ষ্ণ একটা শব্দ শোনে সুমিত, চোখ দুটোও ঝাপসা হয়ে আসে, চারদিকটা খুব অন্ধকার মনে হয় ওর কাছে। হঠাৎই বাতিল করে দেয়া সবগুলো গল্পকে একসাথে দেখতে পায় সুমিত। গল্পগুলো প্রবল গতিতে ওর মাথার ভেতর ছুটে আসছে। দুই তিন পাতা লিখে কুঁচি কুঁচি করে ছিড়ে ফেলা গল্প আসে প্রথমে, তারপর আসে অর্ধেক লিখে আর শুরু না করা গল্প, এরপর আসতে থাকে নিছকই গল্পের ছলে বলা গল্প, গুজবের গল্প, গোপন আঁতাতের গল্প, মনগড়া গল্প। এমনকি দীর্ঘ প্রেমপত্র আর ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলোও মগজের কোষে কোষে ঢুকে পড়ে। জ্ঞান হারাবার আগে সুমিত শুধু বলতে পেরেছিল “স্বাভাবিকের চেয়ে খুব দ্রুতই গল্পের পট পরিবর্তন হচ্ছে, এতো দ্রুত হচ্ছে কেন? তোমাদের সবারই কি এরকম হচ্ছে? দ্রুত পট পরিবর্তন”...