ভিন্নচোখে ম্যাক্সিম গোর্কি
ফাহমিদ আল জায়িদ
ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার পূর্বে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তসলিমা নাসরিন পড়তাম। আমার আম্মা কেন জানিনা তসলিমার লেখা বেশ পচ্ছন্দ করতেন। ২০০০ সালের পূর্বে তসলিমার লেখা প্রায় সকল বই আমাদের বাসায় ‘বুকসেলভ’এ দেখেছি। তবে সবার প্রথমে পড়েছিলাম ‘নির্বাচিত কলাম’। পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি উপন্যাসও পড়েছিলাম [যাবো না কেন যাবো, শোধ, ফেরা, ভ্রমর কৈয় গিয়া- এই কয়েকটির নাম এখন মনে পড়ছে, তবে এটি সত্য যে ‘নির্বাচিত কলাম’ আমার মনে দাগ কেটেছিল]। এরপর কিছুটা না বুঝে হুমায়ন আজাদের ‘নারী’ গ্রন্থটি পড়ার চেষ্টা করেছি। ‘নারী’ আমার পড়ার টেবিলে ছিল বেশ কয়েক মাস। আমার এহেন পাঠ্যরুচি লক্ষ্য করেই সম্ভবত আব্বা কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললেন ‘ক্লাসের পড়ার দিকে একটু মনযোগী হও।’ এমন উপদেশ বাণী তেমন গ্রাহ্য করছিনা দেখে তিনি একদিন ‘বুকশেলভ’ থেকে মাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটি দিয়ে বললেন ‘পড়তেই যদি হয়, তো এটিই পড়।’ আমি একটানে বইটি শেষ করলাম। কিন্তু তেমন ‘টাচ’ করলো না; কেননা ততোদিনে আমি শরৎবাবুব উপন্যাস গ্রোগাসে গেলা শুরু করেছি আর মাঝে মাঝে বালিশে মাথা গুঁজে চোখের পানিও ফেলি! [‘দেবদাস’ পড়ে আমি সত্যি সত্যিই খুব কেঁদেছিলাম! বই পড়ে অথবা সিনেমা দেখে কান্নাকাটি করার ‘বদ’ অভ্যাসটি আমি আম্মা এবং আম্মার বোনদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলাম অথবা বলতে পারি রপ্ত করেছিলাম!] খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি সেই বয়সে ভুলে গেলাম বিখ্যাত রুশ লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির কথা। তার বহু বছর পর, যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষে পড়ি, তখন ‘সেন্ট্রাল’ লাইব্রেরীর ছাড়পোকা সম্মৃদ্ধ চেয়ার টেবিলে বসে ২ দিন একটানা পড়েছিলাম মস্কোর প্রগতি প্রকাশনার অনুবাদে গোর্কির আত্নজীবনীর তিনটি খন্ড- ১)আমার ছেলেবেলা ২) পৃথিবীর পথে এবং ৩) পৃথিবীর পাঠশাল। এককথায় অসাধারন। আত্নজীবনীর বহু লাইন, ঘটনা এখনও আমার মনে আছে হুবুহু, কারন আমি পড়ার সময় একটি ছোট্ট প্যাডে পচ্ছন্দের লাইনগুলি তুলে নিতাম এবং বন্ধুমহলে সুযোগ বুঝে সেগুলি প্রায়ই ‘বাণী’ হিসাবে শুনিয়ে দিতাম! পরবর্তীতে গোর্কির লেখা নাটক ‘পাতিবর্জুয়া’, ভ্রমন কাহিনী ‘পীত দানবের পুরী’, গুটি কয়েক ছোটগল্প, কিছু রাজনৈতিক প্রবন্ধ, সমসাময়িক বিখ্যাত লেখকদের কাছে লেখা চিঠিপত্র, বাংলা একাডেমী থেকে গোর্কির একটি অনুবাদ বই [‘প্রসঙ্গ: সাহিত্য’]- গোর্কির সাহিত্য বলতে এতটুকুই পড়েছি। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নে তার রচনাসমগ্র ৩০ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছিল বলে শুনেছি। তো রীতিমতো ম্যাক্সিম গোর্কি আমার অন্যমত প্রিয় লেখকদের মধ্যে একজন। আমাদের বাংলাদেশে লেখক গোর্কির যে ইমেজ, তাতে তিনি ‘হিরো’ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তাকে সবাই ‘মা’ উপন্যাস দিয়েই চেনে। কিন্তু বছর দুয়েক আগে গোর্কিকে নিয়ে আমার আগ্রহ অজানা কারনে কিছুটা বৃদ্ধি পায়। গোর্কির একটি জীবনীগ্রন্থ হাতে পাই [Maxim Gorgky: A political biography]। বইটি শুরু করার আগে ইন্টারনেটে একটু দৌড়াদৌড়ি করি গোর্কির ব্যাপারে কিছু ‘ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফরমেশান’ জানতে। এরপর হাতে পাই হাসান ফেরদৌসের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘গুলিস্তাঁ থেকে মিরজাফরের নাতি’। সবশেষে খোঁজ পাই ‘The Murder of Maxim Gorky: A Secret Execution’ গ্রন্থটি। সব কিছু ‘দেখে শুনে’ গোর্কিকে নিয়ে কেন জানিনা আমার ‘ফিলিংস’টা পাল্টাতে থাকে! এই নিবন্ধটি গোর্কিকে নিয়ে আমার পাল্টে যাওয়া সেই অনুভূতিটি নিয়ে। লেখাটির সকল তথ্য নানা গ্রন্থ এবং ইন্টারনেট থেকে নেয়া হলেও অনুভূতিটুকু আমার একান্তই ব্যক্তিগত।
ম্যাক্সিম গোর্কির প্রকৃত নাম আলেক্সজান্ডার পেশকভ। ১৮৮৬ সালে দরিদ্র পিতামাতার ঘরে তিনি জন্ম দেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি পিতাকে হারান। মা আরেকটি বিয়ে করলে গোর্কি দাদীর কাছে বড় হন। ১৮৮০ সালে তিনি বাড়ী থেকে পালিয়ে কাজানের একটি রুটির কারখানায় কাজ শুরু করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি একবার আত্নহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা চালান। এরপর তিনি পাঁচ বছর পায়ে হেঁটে রুশ সাম্রাজ্যের বিশাল অঞ্চলে একাকী ঘুরে বেড়ান, নানান ধরনের কাজ করেন জীবিকার তাগিদে, আর বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেন যা পরবর্তীতে তার লেখনিতে নিয়ে আসেন। পরে প্রাদেশিক সংবাদপত্রে সাংবাদিক হিসাবে লেখালেখি শুরু করেন। গোর্কি ছদ্দনাম নিয়ে [‘গোর্কি’ নামের রুশ অর্থ হল ‘তিতা’] ১৮৯৮ সালে প্রথম গ্রন্থ [Essays and Stories] প্রকাশিত হলে তা বেশ সাড়া ফেলে দেয় এবং এভাবেই সাহিত্যিক গোর্কির আত্নপ্রকাশ ঘটে। সমাজের নিচু তলার মানুষদের জীবন নিয়ে লেখালেখি শুরু করায় এবং সাহিত্যকে একটি রাজনৈতিক এবং নৈতিক কর্ম [যার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব] হিসাবে ধরে নেয়াতে ১৮৯৯ সাল থেকেই তিনি রুশ সাম্রাজ্যে মার্ক্সবাদী সমাজ-গনতান্ত্রিক আন্দোলনের সহযোগী হয়ে উঠেন, পার্টিকে টাকা দিয়ে সাহায্যও করেছেন। এছাড়া গোর্কি জারের শাসনামলের বিরুদ্ধে বরাবরই বলে এসেছেন এবং বেশ কয়েকবার গ্রেফতারও হয়েছিলেন। পরে তিনি এবং অন্তন চেখভসহ জারের সাথে বিবাদ লিপ্ত হন রুশ সাহিত্য একাডেমী নিয়ে। আর ১৯০২ সালে লেলিনের সাথে সাক্ষাতের পর তারা দু’জনে বন্ধু বনে যান।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মহান রুপকার বলে পরিচিত, ‘মা’ উপন্যাসের লেখক, ম্যাক্সিম গোর্কি ব্যক্তিগত জীবনে লেলিনের বন্ধু ছিলেন। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের আগ পর্যন্ত তিনি সে বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু বিপ্লবের পর রাষ্ট্র কিভাবে রাজনৈতিক অত্যাচার ও শোষণের হাতুড়ি হয়ে পড়ে, এমনকি শ্রমিক শ্রেণীর নামেই কিভাবে সেই শোষণ পরিচালিত হয়, তা দেখে গোর্কি প্রবল উদ্বিগ্ন ও আহত হন। নিজের পত্রিকা ‘নোভাইয়া জ্বিঝন’-এ এই প্রশ্নে ক্ষমতাসীন বলশেভিকদের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় তিনি লেলিনের বিরাগভাজন হন। আমার মনে হয় গোর্কি না হয়ে অন্য কেউ হলে তাকে নির্ঘাত জেলে যেতে হতো না হলে গুলি খেয়ে মরতে হত। পরে লেলিনের উৎসাহ এবং ঠেলাঠেলিতে গোর্কিকে ইতালিতে পাঠিয়ে দেয়া হয় ১৯২১ সালে। সে সময় লেলিন মন্তব্য করেন ‘গোর্কি লেখক মানুষ, বড়ই সংবেদনশীল লোক। ওর বিদেশ যাওয়াই ভালো। দূর থেকে দেখুক এই দেশটা নিয়ে আমরা কী করছি। তারপর, সব জনঞ্জাল ধুঁয়েমুছে সাফ করার পর ও না হয় ফিরে আসবে।’
১৯২২ সালে লেলিন মারা যাবার পর ক্ষমতায় আসেন স্তালিন। লেলিন মারা না গেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতে পারতো। তবে স্তালিন যে জনঞ্জাল সরাতে পারেননি, উল্টো তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে কি উপহার দিয়ে গেছেন, সেটি সকলেই জানেন, সেটি আর নাইবা উল্লেখ করলাম। এই স্তালিন ১৯২৮ সালে গোর্কিকে আবার সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরে আনেন ব্যক্তিগত উদ্দোগে। আবার গোর্কিও ফিরে আসেন নানা কারনে। সন্তানের ভবিষ্যত, তার পাঠক কমে যাওয়া, বিদেশে বসে বই বিক্রির রয়্যালিটির টাকা কমে আসা এবং সর্বোপরি মাতৃভূমিতে ফিরে আসার টানেই সম্ভবত তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে আসেন। তবে কাগজে কলমে দেশে ফেরার প্রস্তাব গোর্কি নিজেই দেন সোভিয়েত রাষ্ট্রীয় প্রকাশনা কাছে যে তিনি নতুন সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে একটি বই লিখতে চান। দেশের প্রধান প্রধান শিল্পকেন্দ্র, বন্দর, কৃষি খামার, গ্রাম ও নগর তিনি গোপনে, কাউকে না জানিয়ে ঘুরে দেখতে চান। যেমনটি তিনি বহু পূর্বে রাশিয়ার বিশাল অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছিলেন একসময়। প্রস্তাবটি লুফে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফিরে এসে শুরু হয় গোর্কির সফর, নতুন সোভিয়েত ইউনিয়নে, বলা ভালো স্তালিনের সোভিয়েতে। কিন্তু এবার আর একা নয়, তিনি সদলবলে, সেলিব্রিটি লেখকের পূর্ণ মর্যাদায় এক সরকারি জাহাজে করে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এবং এরই ফলাফল সুবৃহৎ গ্রন্থ ‘In and Around Soviet Union.’
গোর্কির ঘুরে বেড়ানোর একটি অন্যতম স্থান ছিল ‘হোয়াইট সি’-এর পাশে কুখ্যাত সলোভকি শ্রমশিবির। ‘শ্রেনীশক্র’ হিসাবে অসংখ্য ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি ও ধর্মযাজক অন্তরীণাবন্ধ ছিলেন সেখানে। এমনকি আলেক্সান্ডার জলঝেলিৎসিনের ‘গুলাগ আর্কিপেলাগো’ গ্রন্থেও এই শিবিরের বিস্তারিত বর্ননা আছে। এই শ্রমশিবির নিয়ে বেশ দুর্নাম ছিল। ১৯২৬ সালে সের্গেই মাসলাগভ এই শিবির থেকে পালিয়ে গিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন যা সোভিয়েত রাষ্ট্রের জন্য ছিল বিব্রতকর। সেই গ্রন্থের একটি শক্ত জবাব দেবার সুযোগ পেয়ে যায় গোর্কির মাধ্যমে। গোর্কির বিবরন পড়ে যে কারো মনে হবে এই সলোভকি শিবির যেন একটি আনন্দ উদ্দান। সবাই সেখানে হাসিমুখে অতি আনন্দের সাথে মিলেমিশে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। গোর্কির ভিজিটের দিনে সবাইকে নতুন কাপড় দেয়া হয়েছিল, ছিল বাড়তি ভোজের আয়োজন। বিস্তারিত বর্ননায় আর নাইবা গেলাম। আমাদের দেশে এন.জি.ও-দের বিদেশি ডোনার’রা যখন ফিল্ড ভিজিটে যান, তখন যেভাবে কর্মকর্তারা ‘ফিল্ড’ গুছিয়ে রাখেন, ব্যাপারটা সেরকম আর কি [আমার ২ বছরের এন.জি.ও চাকুরীর অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বানিয়ে বানিয়ে বলছিনা!] এখানেই শেষ নয়, সেই সফরের সময় গোর্কি কয়েকটি শিশু শ্রমিকদের কেন্দ্রও ঘুরে দেখেন। সলোভকিতে অবস্থিত সে রকম একটি কেন্দ্রে ১৪ বছরের একটি বালক সবার সামনে গোর্কিকে অভিযোগ জানায় ‘আপনি এখানে যা দেখছেন, তার সবটাই সাজানো, সবই মিথ্যা। আপনি যদি সত্য শুনতে চান তো আমি তা বলতে পারি। গোর্কি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে ছেলেটি এক ভয়ংকর বর্ননা দেয়। গোর্কি মন দিয়ে তার কথা শুনলেও বিদায় নেবার পূর্বে অতিথিদের জন্য রাখা পরিদর্শন বইতে লিখেন ‘রুশ বিপ্লবকে টিকিয়ে রাখার জন্য তার সদাজাগ্রত প্রহরীদের কর্মতৎপরতায় তিনি মুগ্ধ এবং বিষ্মিত।’ তবে গোর্কি না জানলেও [হয়তো তিনি শুনেও থাকতে পারেন!] ইতিহাস জানে যে সেই ১৪ বছরের বালকটিকে ২৪ ঘন্টা পরই গুলি করে হত্যা করা হয়।
আরও আছে। গোর্কির তত্বাবধানে সোভিয়েত ইউনিয়ন আরও একটি বই প্রকাশ করে। ১২০ জন শীর্ষস্থানীয় লেখক ‘বেলামোর কানাল’ নামের এই গ্রন্থটি লেখেন যা প্রধানত বন্দি শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক শ্রমের মাধ্যমে ‘হোয়াইট সি’ থেকে ‘বলটিক সি’ পর্যন্ত ১৪০ মাইল দীর্ঘ এই হ্রদ নির্মানের কাহিনী। তারা সবাই লিখেন যে এই নির্মান খুব শ্রমসাধ্য ও বন্ধুর ছিল কিন্তু প্রতিটি শ্রমিক হাসিমুখে সে বেদনা মেনে নিয়েছে। মজার ব্যাপার হল গোর্কির সাথে এই গ্রন্থটির সহযোগী সম্পাদক ছিলেন বেলামোর কানাল শ্রমশিবিরের কমান্ডার সেমিওন ফিরিন। এখানেই শেষ নয়। স্তালিনের নির্দেশে গোর্কি সোভিয়েত লেখক ইউনিয়নের প্রধান হয়েছিলেন। এই সংস্থাটিও সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টির একটি শাখা। ১৯৩৫ সালের সেখানকার এক ভাষনে গোর্কি স্তালিনের সকল কাজে সমর্থন প্রদান করেন। তার প্রতি ব্যক্তিগত স্তুতি প্রকাশেও দ্বিধাবোধ করেন নি তিনি। আবার ১৯৩৪ সালে লেখা একটি প্রবন্ধে গোর্কি স্তালিনকে লেলিনের যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে বাহবা দেন। কিন্তু এখন ইতিহাস আমাদের সাক্ষী দিচ্ছে যে স্তালিন কি করেছিলেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর সরকারি মহাফেজখানা খুলে দেয়া হয়। আর সরকারি সকল কাজের নথিপত্র রাখা হত, সংরক্ষন করা হত। সেই সুবাদে বহু তথ্য বেরিয় আসে। আমি এটি বিশ্বাস করিনা যে গোর্কির মতো লেখক এবং বুদ্ধিমান মানুষ জানতেন না যে স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে কি হচ্ছে, তিনি যখন ফিরে আসেন ১৯২৮ সালে, তখন ইউক্রেনে চলছে দুর্ভিক্ষ, জমির collectivization শুরু হয়েছে, আর রাজনৈতিক নির্যাতন তো চলছেই স্তালিন ক্ষমতায় আসার পর থেকে। সুতরাং, এতো কিছু জেনেও গোর্কি যা লিখলেন তা সরকারি প্রচারপত্র ছাড়া আর কিছুই না। আর এ জন্য সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ গোর্কিকেই বেছে নিলেন কারন এতে করে মানুষ এবং বহির্বিশ্বে বিশ্বাস করানো সহজ হবে কেননা ততদিনে গোর্কি খুবই বিখ্যাত। তবে এটি ভুলে গেলে চলবে না যে সোভিয়েত ইউনিয়নে আসার পর স্তালিনের রোষ থেকে বেশ কয়েকজন লেখককে নিজ উদ্দোগে রক্ষা করেন ম্যাক্সিম গোর্কি।
কিন্তু, এত কিছুর পরও শেষ রক্ষা হলনা। গোর্কির ছেলেকে খুন করা হয় ১৯৩৪ সালে, গোর্কির মৃত্যুর ঠিক দুই বছর পূর্বে। এতে তিনি খুবই ভেঙ্গে পড়েন। যাই হোক, স্তালিন গোর্কিকে তার জীবনী লিখতে অনুরোধ করেন। কিন্তু গোর্কি সেটির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কথিত আছে শেষ সময়ে গোর্কির সাথে স্তালিনের সম্পর্কটি নষ্ট হয়ে যায়। যদিও গোর্কি অসুস্থ ছিলেন, দীর্ঘদিন যক্ষায় ভুগছিলেন, এবং স্তালিন দু’বার অসুস্থ গোর্কিকে দেখতে তার ফ্ল্যাটে যান। অবশেষে ১৯৩৬ সালের জুন মাসে গোর্কি মৃত্যুবরন করেন। কিন্তু এটি প্রমান হয় যে গোর্কির স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেনি। অভিযোগ আছে যে তাকে স্তালিন বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছে। Genrikh Yagoda কে, যিনি ছিলেন স্তালিনের গোপন পুলিশ বাহিনীর প্রধান [১৯৩৬-৩৮], হত্যাকান্ডের দায়ে বিচার করেন স্তালিন। ‘রিউমার’ আছে যে Genrikh Yagoda ১৯৩৮ সালে বিখ্যাত মস্কো ট্রায়ালের সময় বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন যে স্তালিনের আদেশেই ম্যাক্সিম গোর্কিকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল।
আমি ঠিক জানিনা আমার এই ‘লেখাটি’ পাঠ করে পাঠকের কি ধরনের অনুভূতি হচ্ছে! আমি কোনদিনও বামপন্থী রাজনীতি করিনি, তবে এটির প্রতি আমার ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক বিরাগও বিশেষ নেই। বরং ছাত্র জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু ছিল যারা সরাসরি বামপন্থী রাজনীতি করতো। তারা সবাই ছিল আমার অসাধারন ‘ইনটেলেকচ্যুয়াল’ বন্ধু, তারা এখনও এমনটিই আছে। প্রিয় লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি সম্পর্কে নতুনভাবে জেনে গোর্কির পূর্বের যে ‘ইমেজ’ আমার কাছে ছিল, সেটি বেশ ভালোভাবেই চুরমার হতে থাকে। জার্মান দার্শনিক কার্ল পপারের একটি চমৎকার কথা আমার প্রায়ই মনে আসে। তিনি কোথাও বলেছিলেন ‘Freedom is more important than equality.’ আমি পুজিঁবাদী যুগের মানুষ, নিজ অভিজ্ঞতায় সমাজতন্ত্রের কিছুই প্রত্যক্ষ করিনি, নিজেও একজন পাতি বর্জুয়া, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি। কিন্তু এই পূঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতরে বসবাস করতে করতে মাঝে মাঝে মনে হয় কার্ল পপার ঠিক কথাটি বলেননি। তখন তার কথাটি উল্টিয়ে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে ‘Equality is more important than freedom’। আবার আমি এও জানি যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ‘Freedom is not free’। এটির জন্য আমাদের প্রায়ই উচ্চমূল্য দিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে, আমি এই কথাগুলি দিয়ে সমাজতন্ত্র এবং পূঁজিতন্ত্রের ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত ‘কনট্রাডিকশান’কে পাশ না কাটিয়ে ‘ফেইস’ করার চেষ্টা করছি। এটি আমার সৎ অনুভূতির প্রকাশ বলতে পারি; এর বেশি কিছু নয়। আপাতত গোর্কিকে নিয়ে আমার কাছে এটুকুই ছিল। তাই আর কথা না বাড়িয়ে সবার জন্য একটি প্রশ্ন দিয়ে শেষ করি। ধরুন, আপনাকে হিটলারের ইহুদী ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’ অথবা গুয়েতামালায় মার্কিন বন্দি শিবির পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখান থেকে ঘুরে এসে আপনি আপনার ব্যক্তিগত ডায়েরীর পাতায় ঠিক কি লিখবেন??? ধৈর্য ধরে নোটটি পড়ার জন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ।
নভেম্বর, ২০১৩
ধানমন্ডি, ঢাকা।