মনিরউদ্দীন ইউসুফ
‘আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতা’
মনিরউদ্দীন ইউসুফ
‘আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতা’
বিবেকের উদ্বোধন ও বিকাশ
মুবিনুর রহমান
পৃথিবীতে বহু মানুষের বাস। বিচিত্র জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণীর মানুষে ঠাসা বসুন্ধরার বুক। কারও সঙ্গে কারও মিল নেই, আবার অমিলও যে বিস্তর সেটাও নয়। কোথায় যেন সাদৃশ্য আবার কোথায় যেন পার্থক্য। তবুও জীবনের তাগিদে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মানুষ গড়ে নিয়েছে আপন আপন দেশ, ভাষা, ধর্ম, আচার, সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতিও ঠিক তেমনি। কিন্তু বাঙালি আর বাংলাদেশীর মধ্যেও কোথায় যেন সামান্য বৈসাদৃশ্য রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ তাই বাঙালি হয়েও মুসলমান, মুসলমান হয়েও বাঙালি। বাঙালি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও বেশি করে যেন বাংলাদেশী। কবি মনীষী মনিরউদ্দীন ইউসুফ তার জীবন অভিজ্ঞতা দর্শন ভাবনা আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতা আত্মজীবনী গ্রন্থে চিত্রিত করেছেন। একজন বাংলাদেশীর আত্মআবিষ্কার ও বিবেকের উন্মোচনের জীবনাচরণ আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতা।
ছোট বেলায় আমার অপছন্দের একটি ফল ছিল আমলকি। খেতে কেমন বিস্বাদ। প্রথমে মুখে দিলে জিভ উল্টে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। তেতো, কষ্টা। কিন্তু বিস্ময়কর হলো ফলটি খাওয়ার শেষ দিকে কেমন যেন একটি সুমিষ্ট স্বাদ জিহ্বায় অনন্য অনুভূতি জাগায়। আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতা গ্রন্থের পাঠ অভিজ্ঞতা আমার কাছে আমলকি খাওয়ার মতোই মনে হয়েছে। পাঠের শুরুতে লেখকের বংশপরম্পরা, জন্মস্থানের বর্ণনা, পারিবারিক ঐতিহ্য বিবৃতি, কিশোর ও যৌবনকালের জীবন, পড়াশোনা, পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধ বর্ণনা ইত্যাকার ইতিহাস বহুল বিস্তৃত আকারে পড়তে পড়তে বারবার সূত্র হারিয়ে ফেলেছি। এ সময়ের জীবনাভিজ্ঞতা বর্ণনায় উঠে এসেছে লেখকের কাব্য-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ। চলচ্চিত্রের প্রতি লেখকের উত্তুঙ্গ আগ্রহ ও চলচ্চিত্র নির্মাণের তুমুল আকাক্সক্ষা। কথা প্রসঙ্গে উঠে এসেছে ইংরেজ বিদ্বেষ, ইউরোপীয় কালচারের অসারতা ও অমানবিকতার ফাঁপা দিকগুলোও। বাদ যায়নি শিলং ভ্রমণ, কলকাতা, দিল্লি, আগ্রা, বোম্বাইয়ের ভ্রমণ ও কর্মজীবনের স্মৃতিও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে ভারত উপমহাদেশের মানুষের যে প্রতিক্রিয়া তিনি লক্ষ্য করেছেন, তাও উঠে এসেছে নির্মোহ আবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
বাঙালি মুসলিম পরিবারে লালিত এবং আধুনিক চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রাণিত মুক্ত ও যুক্তিসিদ্ধ মেধা-মননের অধিকারী মনিরউদ্দীন ইউসুফ তার সমসাময়িক একজন সোচ্চার সাহিত্য প্রবক্তা। কিশোরগঞ্জের বৌলাই অধিবাসী মনিরউদ্দীন ইউসুফ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তার ইচ্ছেঘুড়ি তিনি উড়িয়েছেন ইচ্ছে মতন স্বপ্ন আকাশে। মনিরউদ্দীন ইউসুফ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় উড়িয়েছেন প্রতিভার নিশান। একে একে কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাসে বাঙালির জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি জিজ্ঞাসা এবং সম্পর্কসূত্র খুঁজে নিয়ে নিজস্ব একটা শিল্পবোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। মনিরউদ্দীন ইউসুফ যত কাজ করেছেন তার মধ্যে মহান কাজটিই হলো তার শাহনামার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। তিনি শাহনামার সাহিত্যরূপকে যথাযথভাবে রেখে বাংলা ভাষাভাষি সাহিত্য অনুরাগীদের দিয়েছেন অমূল্য উপহার। লেখকের এই সাফল্যের পেছনে ছিল পারিবারিক পরিম-লের অনুপ্রেরণা আর শুভাকাক্সক্ষীদের সীমাহীন সহযোগিতা, উৎসাহ।
‘আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতা’কে লেখক চিহ্নিত করেছেন এভাবে, আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতা বইয়ের নাম হলেও, প্রধানত এতে আমার সাহিত্যিক জীবনের অভিজ্ঞতা, বিবেকের উদ্বোধন ও বিকাশের কথাই বলা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে অন্য কথা। পরিবেশ চিত্রণ ছাড়া ‘সেসব অন্যকথার’ গুরুত্ব বিশেষ কিছু নেই। এই আত্মজবানবন্দিই বলে দেয় লেখক মূলত আত্মজীবনীর মলাটে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যিক হয়ে ওঠার অম্লমধুর অভিজ্ঞতা ও বেদনাবিধুর কণ্টকাকীর্ণ পথনকশার চিত্র। মনিরউদ্দীন ইউসুফ রবীন্দ্রানুসারী হয়েও কেমন যেন ইকবাল অনুরাগী। ‘রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য কথা তার কবিতায় যেমন বৈচিত্র্য নিয়ে প্রকাশ করেছে, ইকবালে তা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অতীত ও বর্তমানের সঙ্গে সেতুবন্ধন রচনা করেছে।’ পুরো গ্রন্থে যত পদ, কবিতার শ্লোক তিনি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন তার প্রায় সবই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। অথচ তিনি রবীন্দ্রনাথকে ঠিক যুৎসই সাহিত্যিক হিসেবে মেনে নিতে অপারগ। তিনি রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, সৌন্দর্যের জন্যই সৌন্দর্য নয়, জীবনের জন্যই সৌন্দর্যের প্রয়োজন। জীবনের সঙ্গে গাঁটছড়া ছিঁড়ে গেলে, ‘সৌন্দর্য’ শুধু স্বৈরিণী হয়েই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াবে। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক সৌন্দর্যের জগৎ থেকে মনিরউদ্দীন ইউসুফের সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে।
মনিরউদ্দীন ইউসুফ কবি-সাহিত্যিক পরিচয়ে পরিচিত হলেও অন্তরে তিনি ছিলেন একজন আধুনিক, চিন্তাশীল, মেধাবী দার্শনিক। একাধারে তিনি হিন্দু ধর্মের বিচ্যুতি, ইসলাম ধর্মের কতিপয় গোঁড়ামিকে জ্ঞানের তীরে বিদ্ধ করেছেন। তার কাছে কাঠ মোল্লাও যেমন অমানবিক, সুবিধাভোগী; তেমনি ব্রাহ্মণ-পুরোহিত আপসকামী, স্বার্থপর। তিনি মার্কসবাদ আর ইসলামের তুলনামূলক আলোচনায় স্পষ্ট করতে চেয়েছেন যে, মার্কসবাদ সঙ্কীর্ণভাবে একটি সময়কে ব্যাখ্যা করে পথ দেখাতে সক্ষম, মার্কসবাদ বা কমিউনিজম শাশ্বত ও চিরন্তন নয়। বরং ইসলাম শাশ্বত, মহান, চিরন্তন ও সর্বজনীন। ইসলামে মানুষকে মর্যাদা দেয়া হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে, এখানে কোনো বিভেদ, বৈষম্য, অন্যায় আচরণ সর্বৈব পরিত্যাজ্য। মানবাধিকারের মৌলিক দলিল হিসেবে তিনি হাদিস, কোরআনসহ অন্যান্য কিতাবকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।
সমগ্র গ্রন্থে ইতিহাস বারবার উঠে এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে। হয়তো সন-তারিখ সেভাবে উল্লেখিত হয়নি। কিন্তু ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক নির্যাস পাঠক উপভোগ করতে পারবেন খুব সহজেই। ইংরেজ-পরবর্তী পাকিস্তান আন্দোলন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, স্বপ্নভঙ্গ, সত্তরের নির্বাচন, প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাস, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের বিশৃঙ্খলা, হঠকারিতা, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যা, জিয়াউর রহমানের উত্থান ও পতন উঠে এসেছে সংক্ষেপেÑ তবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণভাবে। অন্ধ সমর্থকের মতো তিনি বিচার করেননি ইতিহাসের পাঠ। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার সাহস দেখিয়েছেন তিনি সততার সঙ্গে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তাকে বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি তার ক্ষোভ ও হতাশা অকপটে লিখে রেখেছেন আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতায়।
মনিরউদ্দীন ইউসুফ শুধু ‘একজন সাহিত্যিক নন, তিনি ইতিহাসজ্ঞ ও শাস্ত্রজ্ঞ। তিনি মানব দরদি, বৈষম্যবিরোধী। তিনি ভাবুক ও চিন্তাশীল।’ একটি মানুষ সারা জীবন ধরে বৈষম্যের কথাটা ভেবেছেন, ভেবেছেন জীবন বোধের কথা। শেষ পর্যন্ত তিনি জীবন বোধকে পূর্ণ প্রত্যয়ের সঙ্গে উপস্থাপিত করতে পেরেছেন। মানবিক অনুভূতিতে সমুন্নত ও উৎকৃষ্ট চিন্তার খোঁজে কেটেছে তার সারাজীবন। এমন অনুভূতিসমৃদ্ধ জীবন ও চিন্তার উৎকর্ষের সন্ধানেই জীবনযাপন করেছেন ‘আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতা’ গ্রন্থের লেখক মনিরউদ্দীন ইউসুফ।