জীবনানন্দ দাশের প্রধান কবিতা : রহমান মতি
জীবনানন্দ দাশের প্রধান কবিতা : রহমান মতি
১৩৮২ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যার দেশ পত্রিকায় বলা হয়েছে ‘কোথায় যেন পড়েছিলাম, কবিতাকেই জীবনানন্দের “প্রথমা” বলা হয়েছে’। সত্যিই তাই। কবিতায় জীবনানন্দ দাশের প্রকৃত পদচারণা। জীবনানন্দের কবিতার বহু বিস্তৃত পথ আছে। তাঁর কবিতা বিষয়ে নিজস্ব ভাবনার মহৎ অভিজ্ঞতা হল কবিতার কথা প্রবন্ধগ্রহটি। কবিতা পড়ার প্রস্তুতি এবং নানারকম পরীা-নিরীাকে একজন পাঠক প্রথমেই ধারণ করতে পারেন কবিতার কথা-র মাধ্যমে এবং তা অবশ্যই মানসিকভাবে ঘটে। কবিতার কথা-র ‘দেশ কাল ও কবিতা’ অংশে জীবনানন্দ বলেছেন-‘যে কোনো সাধারণ বুদ্ধিমান পাঠকই অনেক কাব্যপড়ে পণ্ডিত হতে পারে, কিন্তু সুজাত সমালোচক ওরকম পাঠকের চেয়ে কম কবিতা পড়েও কাব্যজিজ্ঞাসা সম্বন্ধে বেশি জ্ঞানগভীর হবে’। এর সঙ্গে আরো যোগ করা যায় কবিতার কথা অংশের শেষের লাইনগুলো- ‘তার প্রতিভার কাছে কবিকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে; হয়তো কোনো একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে তার কবিতাবৃত্ত প্রয়োজন হবে সমস্ত চরাচরের সমস্ত জীবের হৃদয় মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসলের খেতে বুননের জন্যে’। কম কবিতা পড়া কিংবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে কোনো মহৎ কবির কবিতাবৃত্তের প্রয়োজনীয়তা দুই-ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কম কবিতা পড়ার মধ্যে ভালো বা টিকে থাকার মত প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা নির্বাচন একজন সমালোচক করতে পারেন। কবিতা নির্বাচনের তাগিদেই ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ এ সংকলনের ভূমিকা লিখেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেছেন কাব্যপাঠ ও কবিতাসৃষ্টি দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিমনের ব্যাপার। এসবই জীবনানন্দ দাশের কবিতার সংকলনে এবং ক্রমে এক একটা যুগে কবিতা নির্বাচনে ভূমিকা রেখেছে। আধুনিক একুশ শতকে এসে আমাদের মনে হয় আজও জীবনানন্দ কত অপরিহার্য কবি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোনো কবির কবিতাবৃত্তের পাশে জীবনানন্দ অনায়াসে তাঁর কবিতার মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। সেটি বোদলেয়ার, এলিয়ট, ইয়েটস, অ্যালান পো বা রিলকে-রাও হতে পারেন। অবশ্যই ‘প্রভাব’ তত গুরুত্বের নয়। আমাদের সমালোচনার জগতে প্রভাবকে অনেক মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু, নিজস্বতা প্রত্যেক কবিরই আছে। এই সময়ে জীবনানন্দের প্রকাশিত কবিতার পাশাপাশি তাঁর অপ্রকাশিত কবিতার প্রতিনিধিত্বশীলতা ও অসামান্য গুরুত্ব বহন করে। প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কবিতা মিলে তাঁর কবিতার সংখ্যা এবং এ দুই দিক থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে জীবনানন্দের প্রধান কবিতাকে আমাদের দেখার সময় এসেছে। যে কবিতাগুলো স্বর, বক্তব্য, শিল্পদৃষ্টিতযুগ যুগ প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। কবিতা পড়ার এবং উপলব্ধি করবার অনিঃশেষ আগ্রহ থেকে সেটি হয়ে যায়। ধারাবাহিকভাবে কালানুক্রমিক নির্বাচনে জীবনানন্দ দাশের প্রধান কবিতাগুলোকে আমরা দেখব।
ঝরা পালক (১৯২৭)
মৃত্যুর পূর্বে যে সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ঝরা পালক তার মধ্যে সর্বপ্রথম। ঝরা পালক জীবনানন্দ দাশের কাব্যসাধনার প্রস্তুতিকে শাণিত করেছে। দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন তাঁর জীবনানন্দ দশ: উত্তরপর্ব গ্রন্থে। জীবনানন্দকে ঝরা পালক কাব্যগ্রন্থটির ব্যাপারে তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে এ কাব্যটির বিশেষ কোনো গুরুত্ব আছে কিনা। জীবনানন্দ ‘নীলিমা’, ‘পিরামিড’ ও ‘সেদিন এ ধরণীর’ কবিতাগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। বলাকা-র প্রভাব স¤পর্কে আলোচনা বা ঝরা পালক স¤পর্কে রবীন্দ্রনাথের ‘সেরেনিটি’ ভিত্তিক জিজ্ঞাসা ইত্যাদিও আলোচনার জন্য তাৎপর্যের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ‘নীলিমা’ কবিতা পড়ে কল্লোল যুগ গ্রন্থে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের যে অনুভূতি তা ছিল এমন-‘হঠাৎ কল্লোলে একটা কবিতা এসে পড়ল- নীলিমা। ঠিক এক টুকরো নীল আকাশের সারল্যের মত’। সত্যিই নীল আকাশের সারল্যের মত। বর্ণনা কিংবা চিত্রকল্পের স্বতঃস্ফূর্ততায় চমৎকার কবিতা। ‘পিরামিড’ কবিতাটি সেসময় আলোচিত ছিল। ‘হিন্দু-মুসলমান’ কবিতাটি ভারতবর্ষীয় রাজনৈতিক প্রোপট রচিত বিশেষ কবিতা। কবিতাগুলো আবেদন রাখে কাল থেকে কালে।
ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
কবির ভাই অশোকানন্দ দাশ ধূসর পান্ডুলিপি-র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে গিয়ে প্রথম সংস্করণে জীবনানন্দের প্রণীত ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। জীবনানন্দ তাঁর অনেক অপ্রকাশিত কবিতাও ধূসরতর হয়ে বেঁচে থাকার কথা বলেন এবং গ্রন্থিত কবিতার থেকে তাদের দাবি কোনো অংশে কম নয়। অশোকানন্দ দ্বিতীয় সংস্করণে জানাচ্ছেন-‘ধূসর পান্ডুলিপি-র সুর ও সাময়িকতা যেসব কবিতার মধ্যে প্রখর সেসব কবিতাই অগ্রাধিকার পেয়েছে’। জীবনানন্দের জীবনের শেষ কয়েকটি দিন শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করবার অদম্য সাহস এ সবকিছুর সঙ্গে কাব্যচর্চার সংযোগে ধূসর পান্ডুলিপি-ই যেন জীবনের অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভূমেন্দ্র গুহ তাঁর আলেখ্য জীবনানন্দ গ্রন্থের ‘ধূসর পান্ডুলিপি-র সারা আকাশ জুড়ে’ অংশের শেষের কিছু লাইনে জানান জীবনানন্দ ভূমেন্দ্র গুহকে বলেছেন ধূসর পান্ডুলিপির রং সারা আকাশ জুড়ে। অত্যন্ত স্পর্শকাতর সেই বর্ণনা। কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে এই অভিজ্ঞতার একটা রেশ পাওয়া সম্ভব। যে কবিতাগুলো ধূসর পান্ডুলিপি-তে সংকলিত হয়েছে তার মধ্যে জীবনের ধূসরতর সেই সুরই প্রধান। শুরুটা হয়েছে ‘নির্জন স্বার’-এর মাধ্যমে। নিবেদিত এক প্রেমিক বলছে-‘তুমি তা জানো না কিছু না জানিলে/আমার সকল গান তবুও তোমারে ল্য করে’। সমস্ত কাব্যে ঘুরেফিরে হেমন্ত ঋতু একটি সংকেতপ্রিয় আবহ রচনা করেছে। হেমন্তেযে ঝড় হয়- এ অনুভূতি জীবনানন্দই প্রথম আনেন। আর্কেটাইপ গতি পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়ম এবং উপাদানগুলোও তার নির্ধারিত থাকে। পেঁচার ফসলরা এবং পৃথিবীতে অবদান সৃষ্টিতত্ত্বের চক্রাকার আবহকে নির্দেশ করে। ‘পেঁচা’ কবিতায় সেই সুর আছে। সবাই ঘুমালেও পেঁচা ঘুমায় না কারণ-‘কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের কোনো সাধ’। জীবনানন্দ যে যুগপ্রবর্তক কবি একথা দেবেশ রায় জোর দিয়ে বলেছেন। তিনি বলেন- ‘জীবনানন্দ দুর্বল পাঠকের কবি নন’। শুনে খুব শক্তি জন্মে। জীবনানন্দের যুগপ্রর্বিতত নতুন কবিভাষার সেই প্রধান কবিতা ধূসর পান্ডুলিপি-র ‘কয়েকটি লাইন’ কবিতা। অবিচল বিশ্বাস নিয়ে বলে যান-‘আমার মতন আর নাই কেউ!/সৃষ্টির সিন্ধুর বুকে আমি এক ঢেউ আজিকার’। তার সঙ্গে আরো যোগ করা যায়-‘আমার পায়ের শব্দ কোনো নতুন এ/আর সব হারানো পুরনো’। কল্লোল যুগের নতুন কবিভাষা বা তিরিশের পঞ্চপাণ্ডব গোত্রের সবচেয়ে প্রধান স্বর জীবনানন্দের কাব্যিক ভাষায় নিজস্ব শক্তির পরিচয় এভাবেই প্রকাশ পায়। ‘বোধ’ কবিতা আশ্চর্যরকম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এবং ব্যক্তিক পরিভ্রমণ শেষে তা সামষ্টিক পরিমন্ডলের চেতনায় প্রধান হয়ে ওঠে। ‘বলি আমি এই হৃদয়েরে/সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে এক কথা কয়!’- বহুল পঠিত একটি চিত্রকল্প এটি, বলার মধ্যে কত শক্ত বুনিয়াদ। মানুষের মধ্যে যারা সৃষ্টিশীল অর্থাৎ শিল্পমনা তাদেরও একটি সাধারণ জীবনাযাপন থাকে। সে জীবনের সত্তায় কেউ প্রেমিক, কেউ কৃষক, কেউ অসুস্থ ব্যক্তি। এ সত্তাগুলোর ব্যক্তিক জগতকে উপলব্ধি করবার পূর্বেই মানুষ তার নিজ স্থানে চিন্তার পরিশীলন করতে পারে। ‘বোধ’ কবিতার বক্তব্য সেটাই। ‘যে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে, সেই সব’- এই ‘সেই সব’ শব্দবন্ধেই সমগ্র কবিতার বক্তব্যের ডিটেইল বলা আছে। সভ্যতার বিকৃত আধিপত্যবাদী মানসে ‘চিতা’ ও ‘হরিণ’-কে প্রতীকীভাবে নিয়ে ‘ক্যাম্পে’ কবিতার বক্তব্য। যে চিতা মৃগকে শিকার করছে সাম্রাজ্যবাদী সেই চিতা-ই জিঘাংসার সময় হয়তো ব্যথিতও হয় কিন্তু তা আমাদের বিশেষ কোন কাজে লাগে না। কবি বলছেন-‘বসন্তের জোছনায় অই মৃত মৃগদের মত আমরা সবাই’। আমরা সবাই সভ্যতার আধিপত্যবাদী কবলে এক একটি মৃত মৃগ হয়েই আছি। একুশ শতকে এর বাস্তবতা আরো ভয়ানক। সজনীকান্ত দাস ‘শনিবারের চিঠি’-তে ‘ক্যাম্পে’-র বিরুদ্ধে হুল ফোটালেও পরে নিজেই জীবনানন্দকে স্বীকার করেন বড় কবি হিসেবে। দীর্ঘ কবিতার একটি বড় নিরীা ধূসর পান্ডুলিপিতে আছে। ‘প্রেম’ সবচেয়ে বড় দীর্ঘকবিতা। ‘প্রেম’ কবিতা প্রেম ও পৃথিবীর যাবতীয় পারিপার্শ্বিকতায় কিছু অনুভূতি নিয়ে আসে। সাম্রাজ্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, বাস্তবতা সবই থাকে উপাদানরূপে। আছে কিছু অসাধারণ লাইন-‘পাখির মায়ের মতন প্রেম এসে আমাদের বুক/সুস্থ করে দিয়ে গেছে আমাদের রক্তের অসুখ’। অথবা-‘একদিন একরাত করেছি প্রেমের সাথে খেলা/একরাত একদিন করেছি মৃত্যুরে অবহেলা’। অসাধারণ কবিতা ‘মৃত্যুর আগে’। এ কবিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দকে লিখেছেন-‘তোমার চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে’। চিত্রকল্পের কবিতা মূলত একটি প্রধান বোধ থেকে সৌন্দর্যকে ধারণ করে। ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাও সেরকম বাস্তবতার কথা বলে। হূুমায়ুন আজাদ তাঁর আধুনিক বাংলা কবিতা-র সংকলনে এ কবিতাকে প্রথমে রেখেছেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমাদের জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতা, আকাক্সা বা অনাস্বাদিত নানা মুহূর্তকে এক করেই একটা সামগ্রিক হিসাব কষতে চাই। ¯পষ্ট করে বলা আছে-‘আমরা মৃত্যুর আগে কী বুঝিতে চাই আর? জানি নাকি আহা/সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে ধূসর মৃত্যুর মুখ’। ধূসর মৃত্যুর কাছেই সব কামনার সমাপ্তি। মৃত্যুকে বলা হয়েছে দেয়ালের মতো। অসাধারণ উপলব্ধি। ‘অবসরের গান’-কে দেখে মনে হয় এক একটি সুন্দর খ-চিত্র। ‘প্রকৃতি’ এই কবিতার বড় চরিত্র। যেমন- ‘বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট করে দেবে তার সাধের সময়’। কত সময়ই এভাবে প্রাকৃতিক মোহে নষ্ট হয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনই তার বড় প্রমাণ। জীবনানন্দ যখন কবিতা লিখছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন সমাগত ছিল। ধূসর পান্ডুলিপি বৈশ্বিক রাজনীতিক অবস্থায় সেই বাস্তবতাকে সমানভাবে উপস্থাপন করল। যেমন-‘শকুন’ কবিতা।‘পড়ে গেছে পৃথিবীতে এশিয়ার তে মাঠ প্রান্তরের পর’- এভাবেই শকুনের আবির্ভাব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরূপে। ‘স্বপ্নের হাতে’ কবিতায় ‘মানুষেরও আয়ু শেষ হয়’ বা ‘নত্রেরও আয়ু শেষ হয়’-একটু তুলনামূলক অবস্থানে এসে কবিতার ইতি টেনেছে। মানুষ ও নত্র- তে তফাত খুব বেশি না। মানুষই তার স্বপ্ন দিয়ে জীবন জয় করে আর নত্রের মতই হয়ে যায় পৃথিবীতে যেহেতু মানুষই মানুষকে মনে রাখে। কিন্তু ‘সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব/নত্রেরও আয়ু শেষ হয়’। সময় এই ব্যবধান গড়ে দেয়।
রূপসী বাংলা (১৯৫৭)
বাংলার ত্রস্ত নীলিমা নামে জীবনানন্দ দাশ রূপসী বাংলা-র কবিতাগুলো লিখেছিলেন। কবিতাগুলোর নামকরণ ছিল না। সনেটের গঠনে শুধু সংখ্যা দিয়ে কবিতাগুলো লেখা। জীবনানন্দ সুদূরপ্রসারী চেতনার কবি। তাঁর ভবিষ্যৎকে অনেক দূর থেকে দেখার এক ধরনের অভিপ্রায় ছিল। রূপসী বাংলা-কে ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ প্রাথমিকভাবে কেনা বলা হয়েছিল তার কারণটি খুব পরিষ্কার দেশজ চেতনা বা স্বাদেশিকতায় তিনি উদ্বুদ্ধ এবং বারবার মনে হয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য-বিবর্তনেরপ্রেক্ষিতে বাংলার রূপসী রং মলিন হতেও পারে। তাই বাংলাদেশের নদীমাতৃকতা, মাছে-ভাতে বাঙালির খেতাব, মনসামঙ্গল বা চন্ডীমঙ্গলের সেই ঐতিহ্যিক চেতনা কিংবা রূপকথা, পরণকথা ইত্যাদির যোগসাজশে যে সমগ্রতা তার জন্যও আমাদের হাহাকার হয়তো বেড়ে যাবে। এখন তাই হচ্ছে। রূপসী বাংলা আজকাল নাগরিকতার যাত্রায় চলমান। কবিতার ভিন্নতায় রূপসী বাংলা-রও প্রধান কিছু কবিতা টিকে থাকে নিজস্বতায়। অশোকানন্দ দাশের ভূমিকায় এ কাব্য স¤পর্কে বলা হয়েছে-‘এরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা স্বতন্ত্র সত্তার মতো নয় কেউ, অপরপে সার্বিকবোধে একশরীরী’। প্রতিবেশ বড় তাই কবিতাও সামগ্রিকতায় আবদ্ধ। প্রথম কবিতা ‘সেই দিন এই মাঠ’- এ কবি বলছেন-‘আমি চলে যাব বলে/চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে’। সব চাওয়ার পরেও যত স্বপ্ন থাকে তাঁর জন্য আবার বলেন-‘পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল/এশিরিয়া ধুলো আজ- বেবিলন ছাই হয়ে আছে’। ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’,‘তোমার সেখানে সাধ’ বা ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাগুলো স্বাদেশিকবোধে অসাধারণ। বক্তব্যগুলো পরিষ্কার এবং ছাঁকা ‘পাড়াগাঁর দু’পহর’ নস্টালজিকতায় মোহিত করবে নিঃসন্দেহে। এ কবিতাগুলোর থেকে আলাদা হচ্ছে ‘তোমার বুকের থেকে’,‘জীবন অথবা মৃত্যু’ এবং ‘মানুষের ব্যথা’ কবিতাগুলো। নান্দনিকতার শুরু হয়ে পুরাণ বা ঐতিহ্যিক বন্ধনে এক হয়ে যায় ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতা। বাংলার স্নিগ্ধ রূপটি এই কবিতার মূলকে ধারণ করেছে যে স্নিগ্ধ রূপের পরিবেশে মুগ্ধ হয়ে চণ্ডীমঙ্গল লিখছে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। মধ্যযুগীয় কাব্যচেতনার ঐতিহাসিক নির্মিতি এ কবিতার পাশাপাশি অন্যান্য কবিতাতেও প্রবাহিত হয়েছে। অপ্রত্যাশিত একটি আবহের কবিতা ‘হৃদয়ে প্রেমের দিন’। পুরো রূপসী বাংলা যে কাব্যিক আবহ দেয় তার থেকে একদম আলাদা বক্তব্য কবিতাটির। প্রেম, বিষয়ে যেভাবে কবিতা শুরু হচ্ছে তাও নান্দনিক এবং চিরকালীন ‘হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয়- চিন্তা শুধু পড়ে থাকে তার/রূপ, প্রেম- এই ভাবি- খোসার মতন নষ্ট ম্লান/একদিন তাহাদের অসারতা ধরা পড়ে’। লাইনগুলো সত্য। প্রেম সবসময় সুখী অনুভব নিয়ে নয়। খোসার মত বা অসারতা ধরা পড়ার বিষয়গুলো চিরকালীন। কিন্তু এটাই যে সার্বিক সত্য তাও নয় তবুও প্রেম থাকে কিন্তু কীভাবে থাকে। এই সত্যও কবিতার শেষে বলা হয়েছে-‘জানি আমি, প্রেম যে তবুও প্রেম; স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে রবে, বাঁচিতে যে জানে’। আকারে ছোট একটি কবিতা ‘সন্ধ্যা হয়- চারিদিকে’। শেষের লাইনগুলো-
পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব রূপ প্রেম আমাদের দুজনার মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।
পৃথিবীতে যত ঘুঘু, রূপ বা প্রেম সব একটি সুনির্ধারিত চিত্রেই আবদ্ধ হয়ে আছে। ঘুঘু ডাকছে হিজলের বনে, সব রূপ ঘাসেই আছে যার রং শুধুই সবুজ, সব প্রেম প্রেমিক-প্রেমিকার মনে- অনুভূতিগুলো অতুলনীয়। অনুভূতিগুলোর একটাই শক্ত জায়গা ভীষণ আবেগঘনভাবে কোনো পাঠককে দেখাবে ত্রে বিশেষে কাব্যিক শক্তি কোথায় থাকে। ‘নির্জন স্বার’ কবিতায় আছে ‘আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে’। তার সঙ্গে শেষের লাইনটিতে ¯পষ্ট পার্থক্য ‘শান্তি’ হয়ে ছড়িয়ে থাকা। ভিন্ন প্রেক্ষিতের একটি শব্দের স্থানবদলে কবিতা পায় নতুন ভাষিক স্তর।
বনলতা সেন (১৯৪২), পুনঃমুদ্রণ (১৯৫২)
বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি জীবনানন্দের কাব্যচর্চায় বাঁক আনে। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবন থেকে প্রকাশিত হয়। রোমান্টিকতার পাশাপাশি বৈশ্বিক যাত্রা এ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমেই বড়ভাবে বাঁক নিয়ে নেয় এবং সেই রেশ মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির বা বেলা অবেলা কালবেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রথম কবিতা ‘বনলতা সেন’ নামে যেমন একবারেই চেনা যায় তেমনি জীবনানন্দকে কবি হিসেবে এখনকার পাঠকও ‘বনলতা সেন’-এর কবি হিসেবে বেশি মনে রাখেন। এটি প্রত্যেক কবির ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। জনপ্রিয়তা বা শক্ত অবস্থান তৈরির ব্যাপারও থেকে যায়। প্রেম, বিচ্ছেদ, চিত্রকল্পের, উপমার বা কবিতার সমগ্রতার বোধ ইত্যাদি নিয়ে ‘বনলতা সেন’-অসাধারণ কবিতা। জীবনানন্দের জীবদ্দশা থেকে এখন পর্যন্ত এ কবিতা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’- এই একটি লাইন ‘বনলতা সেন’-এর শীর্ষবিন্দু। ঘুরেফিরে আসলেও পুরো বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থে ‘বনলতা সেন’-এর নারীরূপ অন্যান্য নারী নামের কবিতা যেমন সুচেতনা, শেফালিকা, সুদর্শনা, শ্যামলী, সুরঞ্জনা এদের মাধ্যমে উঠে আসে। ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’ কবিতাটিতেও বনলতা সেন নামটি ব্যবহৃত হয়েছে। তীব্র বেদনাবোধের কবিতা ‘কুড়ি বছর পড়ে’। এ কবিতার-‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার/তখন হঠাৎ যদি মেঠোপথে পাই আমি তোমারে আবার’- এ দুই লাইন কবিতার শাঁস-কে ঐ বেদনাবোধের আভাসে বেঁধে ফেলে। রাত নিয়ে চমৎকার নিরীক্ষার কবিতা ‘হাওয়ার রাত’। ফরাসি কবি বোদলেয়ার ইন্দ্রিয়সংবেদী কবিতার এক ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন উনিশ শতকে। জীবনানন্দের ‘হাওয়ার রাত’ এ ধরনের কবিতা। গভীর হাওয়ার রাত বা ‘অসংখ্য নত্রের রাত’ কিংবা ‘কাল এমন চমৎকাল রাত ছিল’ এ অনুভূতিময়তা নান্দনিক ও ইন্দ্রিয়ের সংবেদনায় আদিষ্ট। ণিক মিলন ও বিরহ নিয়ে নিঁখুত কবিতা ‘আমি যদি হতাম’।‘হায় চিল’-এর ‘বেতের ফলের মত ¤ান চোখ’ বা ‘হƒদয় খুড়ে বেদনা জাগাবার’ ইচ্ছা দুই-ই অতুলনীয়। ‘শিকার’, ‘ঘাস’-এ দুটি কবিতাও নান্দনিক। ‘অন্ধকার’কবিতার সমস্ত বেদনা জাগ্রত হয়ে থাকে-‘আমাকে জাগাতে চাও কেন?’- এই জিজ্ঞাসায়। নানা স্তর পেরিয়ে শেষে বলা হয়েছে-‘কোনোদিন জাগব না আমি- কোনোদিন আর’। ‘আমার’,‘তোমার’ বা ‘তোমাদের’ পৃথিবী এ ধরনের বিভাজনে গভীর অন্ধকারের বৈশ্বিক আবহাওয়া আন্তর্জাতিক আবহ গড়ে দেয়। ‘সুরঞ্জনা’ কবিতার নাস্তিক্যবোধ প্রবলভাবে বাস্তবাদীতার কথা বলে। মানুষ সেই উজ্জ্বল কিছুকে চায় যা মূলত ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোনো সাধনাকে তুলে ধরে। অস্তিত্ব রায় মানুষ সময়ের সঙ্গে আত্মসংবেদী হয়। স্বার্থপরতাই তখন মূল। প্রাচীন থেকে নবসভ্যতার যাত্রা সেভাবেই চলছে। ‘সুচেতনা’ অসাধারণ দার্শনিকতায় ছড়ানো কবিতা। কবিতাটির অনুবাদ করেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত। তিনি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলেন-‘মূলের অনেক গভীরে থেকেই অনুবাদ হয়েছে’। ‘মহৎ চেতনা’-কে সুচেতনা বলা হয়েছে। এই লাইনগুলো দেখে যেতে পারি আমরা-
মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি
না এলেই ভালো হত অনুভব করে;
এসে যে গভীরতর লাভ হলো সে-সব বুঝেছি।
জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবনের চরম দুর্দিনের প্রতিনিধিত্ব করে এই কবিতাই। তিনি এত দিলেন বাংলা কাবিতাকে অথচ পেলেন যা তা সামান্যই। সামান্য পাওয়াই তাঁর কাছে ‘গভীরতর লাভ’। এটাই ‘মহৎ চেতনা’।
‘বেড়াল’ কবিতা নিয়ে কবিতা অনুসন্ধানী সমালোচকদের আগ্রহ প্রচ- রকমের। কবিতাটি কিছু সংকেত দেয়। সংকেতগুলো চেতনা ছড়ায়। জীবনানন্দের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এ কবিতাটি। কবির বোন সুচরিতা দাশের স্মৃতিচারণায় দেখা যাচ্ছে-‘একটা বেড়াল একদিন এপাশ-ওপাশ ঘোরাঘুরির পর নিজের মধ্যেই নানা পরীা করে যাচ্ছে। মাটির বুকে, কৃষ্ণচূড়া গাছে আঁচড় দিচ্ছে’। এটা দেখে জীবনানন্দ কৌতুক করেন এবং ‘বেড়াল’ কবিতাটি রচনা করেন। কবিতার মধ্যে সেই অভিজ্ঞতায় কৃষ্ণচূড়া গাছ বা রোদের সঙ্গে খেলা করে নিজের নিরীাপ্রিয়তাকে তুলে ধরেছে ‘বেড়াল’। সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া অন্ধকার তখন কবিতার বিশেষ অংশ হয়ে পড়ে। একক কোনো অংশ নয় বিস্তার ঘটায় অজগ্র সত্তার পৃথিবীতে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এ কবিতার একটি জ্যামিতিক পাঠও করেছেন যেখানে ‘বিষয় ও বিষয়ী’ সত্তায় বেড়ালের বিস্তার ঘটান তিনি।
মহাপৃথিবী (১৯৪৪)
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সমালোচক পূর্বাশা পত্রিকায় মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ নিয়ে লেখেন-
মানুষের আদিম সভ্যতার সঙ্গে আজকের দিনের মানুষের নাড়ীর টানকে তিনি নিজের মনে আবিষ্কার করতে পারেন, পারেন সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতির প্রাণসত্তার সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন আবিষ্কার করতে। এই আবিষ্কারক মনের কাছে পৃথিবী শুধু আজকের দিনের পৃথিবী নয়, মানুষের নিতান্ত প্রয়োজনের পৃথিবীও নয়; সে পৃথিবীর সময়ের পরিধি বিশাল, জীবন্ততার ক্ষেত্রেও বিচিত্র। তার সার্থক সংজ্ঞা তখন মহাপৃথিবী।
অনামিত সেই সমালোচক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ চেতনাকে ধারণ করে মহাপৃথিবী-কে কত অসাধারণভাবে বিশ্লেষণ করেছেন যা এখনকার সময়েও আকর্ষণ করার মত। মহাপৃথিবীর বিশ্বপ্রকৃতি যে ক্রমে ছড়িয়ে যাচ্ছিল তার ডাক বনলতা সেন-ই দেয়। তাই আদিম-মধ্য-আধুনিক বা উত্তরাধুনিক যুগেও ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা এত প্রাণচঞ্চল কবিতা হয়ে ওঠে। লাশকাটা ঘর, স্বামী-স্ত্রী সন্তান বা থ্যাঁতা ইঁদুর-মশা-ফড়িং-দোয়েল ইত্যাদি জৈবিক সত্তার সঙ্গে মৃত লাশকে ছিন্নভিন্ন করার পার্থক্য জটিল জীবনের পরিচায়ক। আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করা‘বিপন্ন বিস্ময়’মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থকেই বিশিষ্ট করে তুলেছে। একটি চেতনার উজ্জীবনই কাব্যগ্রন্থের প্রাণ যুগিয়েছে। চিরপদার্থ যে গুণের ব্যাপারে জীবনানন্দ কবিতার কথায় বলেছেন এ ধরনের উপাদান ‘বিপন্ন বিস্ময়’। বিস্মিত হয়ে নারীর হৃদয়কে বুঝতে না পারার বিপন্নতায় যে লোকটি আত্মহত্যা করে তার দুঃখ সবারই জীবনের বোধ। সেকালে ‘বিপন্ন বিস্ময়’ সমালোচক, কবি সবার মধ্যে একটা জোয়ার এনেছিল। বুদ্ধদেব বসুর চোখে এটি হল-‘জীবনের জয়ধ্বনি’; সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেছেন- ‘আমাদের রক্তে যে বেদনা প্রবাহিত সেই বেদনার সন্তান হওয়ার জন্যেই তাকে বিস্ময় বলা হয়েছে’; হুমায়ুন কবিরের মতে ‘আত্মহত্যাকারী লোকটি হল এক আউটসাইডার, যে মর্বিডিটি চেতনাক্রান্ত এবং সে অর্ন্তমুখী চরিত্রের। সংসার ও সুখকে আলাদা করার চেতনা সেখান থেকেই এসেছে তার এবং সে বিপন্ন হয়ে পড়েছে’; অম্বুজ বসু বলেছেন-‘মহত্তর মূল্যবোধ’। জীবনানন্দ কবিতাটিকে বলেছেন-‘কবিতাটি Subjective নয়, একটা Dramatic Representation মাত্র’। নাটকীয়তাই জীবনের ধর্ম তাই তিনি এটাই বলেন। ‘আদিম দেবতারা’ চরিত্র দিয়ে তৈরি নাটকীয় কবিতা। আগুন, বাতাস, জল এ উপাদানগুলো দিয়ে আদিম দেবতারা যে রূপ দিল কবিকে তা থেকে কবি তাঁর কবিতা বা সৃষ্টির চরিত্র ‘তুমি’ নামের কাউকে তৈরি করছেন। এক সময় সেই ‘তুমি’ আর স্বাভাবিক থাকে না। ব্যবহৃত হয়ে ‘শূয়রের মাংস হয়ে যায়?’ এই বক্তব্যেই কবিতার উন্মোচন ঘটে। ‘ব্যবহৃত’ শব্দটি নয়বার প্রয়োগ করার পুনরুক্তিগত বিষয় কবিতায় বাড়তি আবেশ যুক্ত করে। জ্যোতির্ময় দত্ত এ কবিতাটির অনুবাদ করেন ‘দ্য প্রিমিভ্যাল গডস’ নামে। গুরুত্ববহ কবিতা ‘ফুটপাথে’, ‘চলন্ত জীবনপ্রবাহ’ এবং ‘ট্রাম লাইন’ দেখার অভিজ্ঞতায় জীবনানন্দের নিজস্ব মৃত্যুর ‘ট্রামলাইন’ দুয়ে মিলে কোমল অথচ গভীর মৃত্যুচেতনারও অংশ কবিতাটি।
সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)
জীবনানন্দের কবিতার আন্তর্জাতিক দিকটি পোক্ত স্থান পেয়েছে এ কাব্যগ্রন্থে। তাঁর কবিতার স্তরান্তর নিয়ে গবেষণা সমালোচনার বহু পথ নির্ণীত হয়েছে এ কাব্যগ্রন্থ দিয়েই। নরেশগুহ লিখেছেন-‘বুঝতে পারি জীবনানন্দ এতকাল পরে শহরে এসেছেন’। অশোকমিত্র লিখেছেন-‘অনেক ক্ষেত্রেই এই গ্রন্থের কবিতা রূপ নিয়েছে দার্শনিকতায় এবং সে দর্শনও অবোধ্য’। এ মূল্যায়নগুলো জীবনানন্দের কাব্যের ক্রমশ পরিণত রূপের প্রকাশ। প্রচন্ডভাবে বৈশ্বিক হয়ে ওঠেন এক একটি কবিতার মাধ্যমে। ‘আকাশনীলা’ কবিতাটি বির্তকের জন্মও দিয়েছিল। ‘তোমার হৃদয় আজ ঘাস’- লাইন নিয়ে কথা ওঠে। ‘ঘাস’ মূলত হৃদয়কে প্রতীকীভাবে তুলে ধরার এক কঙ্কালরূপ। বিরহবোধ প্রেমকে কত গভীর করে তোলে তার লণ কবিতাতে মিলবে। ‘তাহার সাথে’ কিংবা ‘তার সাথে’ দুই ধরনের সর্বনাম ব্যবহারে সাধু ও চলিত প্রয়োগের এমন শিল্পরূপ জীবনানন্দের কবিতার নতুন চিন্তাকেও তুলে ধরে। সময়চেতনায় মহৎ কবিতা ‘ঘোড়া’। কেউ বলেছেন ‘চিহ্নের ঘোড়া’। সার্বিকভাবে বিবর্তনরেখায় পৃথিবীর চলিষ্ণু রূপ ‘ঘোড়া’। ‘আর্কেটাইপ’ বক্তব্যে প্রাচীন থেকেই আসে সেই বিবর্তনের ধারা। দৃষ্টিপাতে দেখা যায় একটা ঘোড়া নিয়ে কবিতার বক্তব্য এগুচ্ছে না, বলা হচ্ছে ঘোড়াগুলো ঘাস খায়। নিওলিথ স্তব্ধতার মধ্যেও সেই ঘোড়ার আবেদন ফুরায় না। শেষেও বলা হচ্ছে এইসব ঘোড়াদের। পাঠক একসময় হয়ে যায় সমালোচক। কবিতার কথায় যে সৎ সমালোচকের কথা বলেন জীবনানন্দ সে বক্তব্য আসে সৎ কবিতা বা মহৎ কবিতার সূত্র ধরেই। কিন্তু সমকালে জীবনানন্দ প্রচুর পরিমাণে অসৎ সমালোচনা দেখে দেখে জবাবস্বরূপ লিখেছেন একটি কবিতা। এ কবিতাই ‘সমারূঢ়’। অধ্যাপকদের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সূচক অ্যাকাডেমিক সমালোচনার জন্য বা অন্যান্য সমালোচনা যা তিকর তাদের বিরুদ্ধে তীব্র শ্লেষ এই কবিতা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং নরেশগুহ ‘গৌধূলিসন্ধির নৃত্য’ কবিতাটি নিয়ে কথা তোলেন। তাঁরা একে ‘ঠাট্টা’ বলেছেন। অরুণকুমার সরকার আবার বিষাদের গভীরতা দেখেছেন এ কবিতায়। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেছেন-‘ঐশিতা ও নাটকীয়তার সংমিশ্রণ’। বিশিষ্ট সৃষ্টি না হলে এত মূল্যায়ন হয় না। অদ্ভুত সুন্দর কবিতা ‘রাত্রি’। সুগভীর বিষয় কবিতার শেষে উঠে আসে- ‘নগরীর মহৎ রাত্রিকে মনে হয়/লিবিয়ার জঙ্গলের মতো/তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব-অতিবৈতনিক/বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত’। এলিয়টের ‘ওয়েস্টল্যান্ড’-এর নগরসভ্যতা যে পোঁড়ো জমির মতই ফাঁপা সে বাস্তবতা ছিল বিশ্বযুদ্ধকেন্দ্রিক। নগরীর ত যখন লিবিয়ার জঙ্গল হয়ে যায় তখনই আসে অতিবৈতনিক চেহারা। এর ত্রে যা লজ্জা নিবারণ করার জন্যই নিজেকে ঢাকে। সুররিয়ালিস্টিক আবহের অন্তর্গত। ‘প্রতীতি’ উল্লেখযোগ্য কবিতা। সৃষ্টির তীরে কবিতার দুটি লাইন চিরকালীন সভ্যতার পরিচয় দেয়-‘মানুষেরই হাতে তবু মানুষ হতেছ নাজেহাল/পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি’। এই ‘বিশুদ্ধ চাকরি’ শুধুই কর্মজীবনে পাস করা বিদ্যার ওপরে গঠন করা চাকরি নয়। কাজের ত্রে অনুসারে সেই ‘বিশুদ্ধ চাকরি’-কে নির্দেশ করা হয়েছে। এটি আসে কবিতার একটি অ্যালেগোরিক্যাল অবস্থানরূপে।
‘জনান্তিকে’ কবিতাও আন্তর্জাতিক চেতনাসমৃদ্ধ। বলা হয়েছে-‘যে মানুষ- যেই দেশ টিকে থাকে- সেই ব্যক্তি হয়, রাজ্য গড়ে-সাম্রাজ্যের মতো কোনো ভূমা চায়’। ব্যক্তি ক্রমে আধিপত্যবাদী হয় এভাবেই। আবার যখন বলছেন পঙ্গপালের মতো মানুষেরা চরে, ঝরে পড়ে- তখনও বিশ্বাস করতে হয় এ সত্যকে। গ্রোতোশীল প্রবাহ এ ধরনের বাস্তবতাই মানে। সেই ব্যক্তির ক্রাইসিস আরো কঠিন হয়ে পড়ে শেষ কবিতা ‘সূর্যপ্রতিম’-এ। বলা হয়েছে-‘কেবলই ব্যক্তির- ব্যক্তির মৃত্যু শেষ করে দিয়ে আজ/ আমরাও মরে গেছি সব’। অমলেন্দু বসু সাতটি তারার তিমির এর সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা বলেছেন ‘সময়ের কাছে’ কবিতাটিকে। তাঁর মতে এটি হল-‘অস্তিপ্রত্যয় ও সমগ্র জীবনদর্শন’। শুরু হয়েছে অসাধারণভাবে-‘সময়ের কাছে এসে স্যা দিয়ে চলে যেতে হয়/কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি’। জীবন সংগ্রামে যত কিছুই ঘটুক না কেন সবই ঐ সময়চেতনার অংশ। প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব সময় আছে এবং তার কাছে তাকে অবশ্যই জবাবদিহিতায় যেতে হয়। চিরন্তন সত্য বক্তব্য এটি। আর জীবনের সেই জবাবদিহিতার সূত্রেই যদি বলা হয় ‘আমরা কি তিমিরবিলাসী?’ তখন কেউই জীবনে অন্ধকারের স্থায়ীত্ব চাইবে না। তাই সকলের চাওয়া হবে ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’। এভাবেই আসে ‘তিমিরহননের গান’ নামে অসাধারণ আরেকটি কবিতা।
বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)
বেলা অবেলা কালবেলা নামকরণটি তিনটি বিশেষ নিরীাপ্রধান অংশ। ‘সময় বা অমেয় সুসময় কিংবা অসময়’ এরকম নিরীার কথাও বলেছেন জগদীশ ভট্টাচার্য। অশোকানন্দ দাশ বলেছেন-‘সাতটি তারার তিমির ও তার একেবারে শেষের দিকের অতি পরিচিত কবিতাগুলি মধ্যকালীন অপোকৃত অল্পপরিচিত কালপর্যায়ের সেতুবন্ধ’। সে সূত্রে সাতটি তারার তিমির-এর সঙ্গে একটি আন্তঃস¤পর্কে যুক্ত এ কাব্য। নিরন্তর সময়চেতনা সেই আন্তঃসম্পর্কের মূল সুর। ‘সময়সেতুপথে’ কবিতায় বলেছেন-‘পুরুষ নারী হারিয়ে গেছে শম্প নদীর অমনোনিবেশে/অমেয় সুসময়ের মতো রয়েছে হৃদয়’। বিশুদ্ধ অনুভূতির কবিতা ‘আমাকে একটি কথা দাও’। প্রথম লাইনে আছে-‘আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো/সহজ মহৎ বিশাল’। সময়চেতনার বৃহৎ পরিসরে ‘সময়ের তীরে’ বা ‘ইতিহাসযান’ কবিতার স্থান গুরুত্বপূর্ণ। ‘মহাত্মা গান্ধী’ কবিতায় গভীর বোধ আছে এরকম-
যেই সব অভিজ্ঞতা বস্তুত শান্তির কল্যাণের
সত্যিই আনন্দসৃষ্টির
সে সব গভীর জ্ঞান উপেতি মৃত আজ, মৃত,
জ্ঞানপাপ এখন গভীরতর বলে
আমরা অজ্ঞান নই- প্রতিদিনই শিখি, জানি, নিঃশেষে প্রচার করি, তবু
কেমন দুরপনেয় স্খলনের রক্তাক্তের বিয়োগের পৃথিবী পেয়েছি।
মহাত্মা গান্ধীর মত মনীষীর শান্তির বাণী আজকের পৃথিবীর চিত্র নয়। সর্বত্রই আজ স্খলন। শেষের দিকের দুইটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘মানুষ যা চেয়েছিল’ এবং ‘হে হৃদয়’।
শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৬)
শ্রেষ্ঠ কবিতা-র কয়েকটি কবিতা এর পূর্বে ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা-য় গৃহীত হয়েছিল। সেখানে বেলা অবেলা ও কালবেলা কাব্যের অন্তর্গত হয়েছিল শ্রেষ্ঠ কবিতার কিছু কবিতা। প্রথম কবিতা ‘আবহমান’ স্তবকের পর স্তবকে অসাধারণ হয়ে ওঠে বোধের পরিসীমায়। আবহমান পৃথিবীর রূপ একটি নিরন্তর সৃষ্টি প্রক্রিয়া। চমৎকার কবিতা ‘একটি নত্র আসে’। জীবনানন্দকে নত্র মনে করে অম্বুজ বসু একটি নত্র আসে নামে একটি বইও লিখেছেন। ‘ট্রাম বা নত্র’ দুটিই প্রতীক এ কবিতায়। ‘লোকেন বোসের জর্নাল’ বিবরণধর্মী কবিতা। শেষ লাইনে বলা হয়েছে-‘প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়’। লাইনটি প্রবল জীবনবোধের। প্রতিটি দিনই নতুন মানুষের জন্য তাই জীবনের জীবাণুও ক্রমেই বাড়ে। রোমান্টিক কবিতা আবার বিরহের কবিতাও ‘তোমাকে ভালোবেসে’ পদ্মপাতার জলে প্রেমিকসত্তার আবির্ভাব এবং ঐ পদ্মপাতার ণস্থায়ী জলের খেলায় প্রেম ও জীবেনর দ্বৈত চিত্ররূপ অসাধারণভাবে উঠে এসেছে কবিতায়। সবচেয়ে বলিষ্ঠ কবিতা ‘মানুষের মৃত্যু হলে’। এ কবিতার তিনটি ¯পষ্ট বক্তব্য আছে। প্রথমটি-‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়/অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষে কাছে/প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে’। দ্বিতীয়টি- ‘আজকের আগে যেই জীবনের ভিড় জমেছিলো/তারা মরে গেছে/ প্রতিটি মানুষ তার নিজের স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে অন্ধকার হারায়েছে’। শেষেরটি- ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়/অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে আরো ভালো/আরো স্থির দিকনির্ণয়ের মতো চেতনার পরিমাপে নিয়ন্ত্রিত কাজ/কতদূর অগ্রসর হয়ে গেল জেনে নিতে আসে’। তিনটি বক্তব্যই ছাঁকা, সুস্পষ্ট এবং পরিপূরক। ‘রাত্রিদিন’ কবিতার কিছু লাইন-‘তবুও তোমাকে ভালোবেসে/ মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে/ বুঝেছি অকূলে জেগে রয়/ঘড়ির কাঁটায় আর মহাকালে সেখানেই রাখি ও হৃদয়’। অনুভূতির গাঢ়তায় অতুলনীয়। প্রেমিক হৃদয়ের একান্ত অনুরণন।
অপ্রকাশিত কবিতা
জীবনানন্দ দাশের কিছু অপ্রকাশিত কবিতাও প্রতিনিধিত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। প্রকাশিত কবিতার থেকে তা কোনো অংশে কম নয়। ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতাটি চিরন্তন ভূমিকা রেখেছে। এমন একটি কবিতা যার প্রতিটি লাইন সত্য বক্তব্যকে ধারণ করে আছে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কবিতাটিকে একসূত্রে গেঁথে তিন প্রেেিতই প্রতিনিধিত্বশীল হয়েছে। ‘কবি’ নামে একটি কবিতা রয়েছে। কবির ব্যক্তিক জীবন ও শিল্পসৃষ্টির দ্বন্দ্ব বেদনার আখ্যানে উঠে এসেছে। কবিতাটির শেষে সৃষ্টির আয়োজনকে স্বাগত জানিয়ে কবির কবিতার প্রতি আশাবাদী মনোভাবকে বড় করেছেন। বলেছেন-‘এসো আমরা তার কবিতা পড়ি/অজস্র আশাপ্রদ কবিতা/টইটম্বুর জীবনের স্ট মেশিনে তৈরি/ এক একটা গোল্ডফেক সিগারেটের মতো’। ‘নদী’ কবিতাটি অসাধারণ। ‘নদী, তুমি কোন কথা কও?’ লাইনটি গাঢ় অনুভূতির। নদী সমস্ত হৃদয়ে গভীর চেতনাপ্রবাহ হয়ে আসে। নদী হয়ে ওঠে অনেক বাস্তবতার স্বাী। কবিতার গাল্পিক আবহ ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাতে আছে। ‘আমার এ ছোট মেয়ে’ নামের অপ্রকাশিত কবিতাটি সেই গাল্পিক আবহকে সঙ্গে করে আনে। কথোপকথন ভঙ্গির কবিতা। গাঢ় বেদনাবোধ কবিতাটির শক্তি। গভীর জীবনবোধের একটি কবিতা ‘আমাদের অভিজ্ঞতা নষ্ট হয় অন্ধকারে’। প্রথম দুটি লাইনে আছে- ‘আমাদের অভিজ্ঞতা নষ্ট হয় অন্ধকারে/তারপর পান্ডুলিপি গড়ি/পুরনো জ্ঞানের খাতা রক্ত কেশ রোমহর্ষ চুপে চুপে করি সঞ্চয় অন্ধকার’। পৃথিবীকে প্রতীকীভাবে বলা হয়েছে ‘চামড়া ও কাগজ’ সমেত এক ‘বিষণ্ন বিস্ময়’-এ কবিতায় ‘বিপন্ন বিস্ময়’-এর মত বিষণ্ন বিস্ময় জাত এক ধরনের কাব্যিক উন্মোচন পেয়ে যাই আমরা। মৌলিক জীবনদর্শন নিয়ে রচিত দুটি কবিতা ‘মৃত, বর্তমানে উপেতি কবিদের ওপর অনেক সমালোচনা পড়ে’ এবং ‘শিল্পী’। প্রথমটি ‘সমারূঢ়’ কবিতার মত কিন্তু ধারণার দিক থেকে শুধু বক্তব্যে আলাদা। ‘শিল্পী’ কবিতার বক্তব্য চিরকালীন-
জীবন কাটায়ে দেয় যে মানুষ সূক্ষ্মতর শিল্পচিন্তা নিয়ে,
ফলকের পর ক্ষুদ্র নিয়ন্তা রেখার টানে ফেলেছে যে সীমানা হারিয়ে,
সেই সব মানুষের আত্মা যেন বিগ্রস্তমুকুরে
কেবলই নড়িতে আছে জলের আভার মতো উদবিগ্ন দুপুরে।
শিল্পীর বাস্তবতা এভাবেই করুণ ও জটিল।
‘বেড়াল’ কবিতার সঙ্গে তুলনীয় একটি কবিতা ‘পথের কিনারে’। যে বেড়ালটিকে একদিন সাাৎ দেখে কবিতা লিখেছিলেন জীবনানন্দ সেই বেড়ালের মৃত্যু প্রদর্শিত চিত্র এই কবিতা। সে বেড়ালটি কবির মনে চিন্তা হয়ে এল তখন বেড়াল হয়ে উঠল একটি কণ্ঠস্বর-
আমার কবিতার ভেতর এল-
বললে, এর চেয়ে অসাধারণ দাবি কোনোদিন করব না আমি আর।
আবহ পরিবর্তনের এমন সুর কবিতাটিকে হৃদয়গ্রাহী করে দেয়।
অমিতাভ দাশগুপ্ত নামে একজন সমালোচক তাঁর বন্ধুর স্মৃতিচারণায় বলেছেন-‘তাঁর বন্ধুটি বলতেন হাতে গোনা কয়েকটি জিনিসকে আমরা ভালোবাসা দিই। জীবনানন্দের কবিতা সেরকম প্রাণপণ ভালোবাসা’। অনুভূতিটি নিরেট ভালোলাগার। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতার কথা-য় মহৎ কবিতা, সৎ কবিতা-র পাশাপাশি কবিতা কী হিসেবে শাশ্বত হয় তারও ব্যাখ্যা দেন। সব মিলিয়ে জীবনানন্দ দাশই তাঁর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রধান কবির ধ্রুপদী স্থান দখল করেছেন। তাঁর প্রধান কবিতাগুলো অনাগত কালকেও ধ্রুপদী করে রাখবে এটি বিশ্বাস করতে বেগ পেতে হয় না।