"...তারপর তিন বছর কেটে গেছে, আমাদের প্রেমের বয়সটাও বেড়েছে, একটু একটু করে সেই সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেটা গোছানো জীবনযাপন করা শুরু করেছি, পড়াশোনার ব্যস্ততাও বেড়েছে, মাথায় একদিকে ক্যারিয়ারের চিন্তা, একটা ভালো চাকরি, পরিবারের কাছ থেকে আসা প্রচ্ছন্ন একটা অর্থচিন্তা। পৃথিবীতে মনে হয় মানুষ সবচেয়ে বেশি কনফিউশনে থাকে এই সময়টায় এসে। বেশিরভাগের লক্ষ্য ঠিক থাকে না, আর যাদের থাকে, তাদের মধ্যেও কেন যেন বেশিরভাগই কোন স্টেপ অনুযায়ী যাওয়াটা ঠিক হবে সেটা বুঝতে পারেনা।
আমাদের এখন আগের মতো প্রতিদিন ঘুরতে যাওয়া হয়না, তবে প্রেমটা আছে আগের মতোই। প্রতিমাসে নিয়ম করে দুইটা ছুটির দিনে আমরা বের হই, রূপকথাও এসবে মানিয়ে নিয়েছে, সে তার নিজের মতো করে ক্লাস করে, ছুটির পরে কয়েক মিনিটের জন্য দেখা হয়, মাঝেমাঝে ক্যাফেটেরিয়ায় লাঞ্চ করে একসাথে তার বাসা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া হয়।
এই তিন বছরে অনেক বদলে গেছি আমি। চালচুলোহীন অগোছালো একটা ছেলে এখন সকাল ৮ টায় ক্লাসে যাই, পরীক্ষার সময় ছাড়াও নিয়ম করে লাইব্রেরিতে যাই, সবচেয়ে বড় কথা, যে আমি টেক্সটবই পড়তেও চাইতাম না, সে এখন লিটারেচারও পড়ি! একটা মেয়ে এসে, আমার অনিয়মের জীবনটাকে সুন্দর করে দিয়েছে। ও হ্যা, এর মাঝে একবার রূপকথার বাসায়ও গিয়েছিলাম, সে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সবার সাথেই, যদিও বন্ধু হিসেবে।
সেদিন সন্ধ্যায় তার বাসার ছাদে বসে কথা বলছিলাম, এগারো তলার ছাদ থেকে দূরের আকাশটা ভালোই দেখা যায়। একটু রসিকতা করেই বলছিলাম, "আচ্ছা, আমি যদি হারিয়ে যাই, দূরের আকাশে চলে যাই, তুমি কি কখনো আমাকে ভুলে যাবে? তুমি কি কখনো আমাকে মনে রাখবে? আমাদের স্মৃৃতিগুলো কি কখনো তোমাকে আটকে রাখবে?"
কয়েক মিনিটের নীরবতা। আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। হঠাৎ সে আমায় অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কোনো কথা নেই, কোনো শব্দ নেই, শুধু হঠাৎ বুঝতে পারলাম, এগারো তলার ছাদে বসে সন্ধ্যার দূর আকাশকে সাক্ষী রেখে একটা মেয়ে তার ভালোবাসার মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, অঝোর ধারায় কাঁদছে। সেই কান্নার অনেক অর্থ, সেই কান্নায় অনেক শক্তি।....
অতীতের ঝাপসা ফ্রেমে ফিরে গেলে এখন প্রেম নিয়ে আমার খুব ছোট্ট একটা অভিমত হল, পৃথিবীতে দুইটা মানুষ প্রথম যখন প্রেমে পড়ে, যে মুগ্ধতা কাজ করে তাদের দুজনের মধ্যে, সেটা নিশ্চয়ই প্রকৃতি আগে থেকেই ঠিক করে দেয়। প্রকৃতির আরো অন্য অনেক অনুষঙ্গের সাথে তাদের প্রেমটাও যেন একটা অনুষঙ্গ হয়ে যায়। বৃষ্টি পড়ে, সেই বৃষ্টিতে তাদের একসাথে ভেজার মধ্যে, দুইজনের কাছাকাছি আসার মধ্যে যেন সেই অনুষঙ্গগুলোর পূর্ণতা পায়। বৃষ্টি ব্যাপারটাও অনেক রহস্যের। কিছু বৃষ্টিতে প্রকৃতির দুঃখ প্রকাশ পায়, কিছু বৃষ্টিতে সুখ। মানুষ কি কখনো সেই পার্থক্যটা বুঝতে পারে এটা?
................................................................
আজ আমাদের তিন বছর পূরণ হলো। মুগ্ধতার কথা বলছিলাম। পৃথিবীতে মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রেম বলতেই বুঝে শুধুই একে অপরের প্রতি মুগ্ধতা, দেখে ভালোলাগার ব্যাপারটা। এর বাইরেও অনেক বড় কিছু ব্যাপার কাজ আছে, হয়তো যে ধাপগুলোতে যাওয়ার আগেই প্রেমটা নাই হয়ে যায়। প্রথম দিকের মুগ্ধতা, ধীরেধীরে একে অপরকে বুঝতে পারা, দুইদিক থেকে স্যাক্রিফাইস, সবই তো এটার অংশ।
আজ আমাদের তিন বছর পূরণ হলো। আমরা কেউই প্রথাগত অ্যানিভার্সারি উদযাপনে বিশ্বাস করতাম না, আমাদের কাছে প্রতিটা দিনই ছিল একইরকম। তবুও ভেবে রেখেছিলাম এবার তাকে কিছু একটা দিবো। তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা ছিল চিঠি। পৃথিবীতে মনে হয় মানুষ তার অনুভূতি প্রকাশের যতগুলো মাধ্যম আবিষ্কার করেছে, সবচেয়ে সুন্দর মাধ্যম এটাই। একটা সাদা কাগজ, তার মাঝে কালিতে লেখা কিছু অক্ষর, যার প্রতিটি বর্ণে স্পর্শ লেগে থাকে, অনুভূতির স্পর্শ। পৃথিবীতে মানুষ যান্ত্রিক হবে অনেক, যেদিন থেকে চিঠি লেখার কেউ থাকবেনা, হয়তো সেদিনই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি গুলো মরে যাবে...
আজ আমাদের অ্যানিভার্সারি। আমি আজ সাদা শার্ট পড়েছি, সাথে বুকপকেটে একটা সাদা কাগজে লেখা চিঠি। রূপকথা একটা লাল শাড়ি পড়েছে, একপাশে সিঁথি করে রাখা চুল, আমি দূর থেকে তাকে দেখছি, রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষায়। আমি আসছি, দূরে তার মুখে একটা স্নিগ্ধ হাসি, এই হাসির প্রেমে আমি অনেকবার পড়েছি, তবুও কেন যেন আজ নতুন করে প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি আসছি, খুব কাছাকাছি আসতেই, ঠিক রাস্তার এক পাশে ছিটকে পড়লাম আমি..
আর তারপর, একটা রক্তাক্ত সাদা শার্ট, তার বুকপকেটে কালো অক্ষরে লাল রক্ত...
আচ্ছা, কালো অক্ষরে যখন লাল রক্তের ফোঁটা এসে পড়ে, অনুভূতিগুলো কি রক্তাক্ত হয় কখনো?
_________________________________
গল্পঃ "রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ" (৪র্থ অংশ)
পরবর্তী অংশের লিংকঃ রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ (শেষ অংশ)
১ম অংশের লিংকঃ রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ (১ম অংশ)
২য় অংশের লিংকঃ রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ (২য় অংশ)
৩য় অংশের লিংকঃ রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ (৩য় অংশ)
(আমার ওয়েবসাইটে পর্যায়ক্রমে লেখাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে)