"অপারেশন কিং প্যালেসঃ ১ম অংশ
(গল্পটা পুরোপুরি কল্পনাপ্রসূত। তাই ভুলত্রুটি ক্ষমা করে বিনোদনের স্বার্থে পড়ার অনুরোধ রইলো)
______________________________________
ভোর ৬ টা। লা মনরো সমুদ্র সৈকত, মরিশাস। সূর্যরশ্মি সকালের আকাশ ভেদ করে এসে পড়ছে ভারত মহাসাগরের স্বচ্ছ জলের মাঝে। সেই জল ভেদ করে কিছুক্ষণ পর পর উঁকি দিচ্ছে ডলফিনেরা। অনেকেই এসেছে এখানে, কেউ হানিমুনে সঙ্গীকে নিয়ে একান্তে সূর্যোদয় দেখার জন্যে, কেউ বা অল্প আঁচে সূর্যের আলোয় সৈকতে শুয়ে বিশাল আকাশের নিচে চোখ বন্ধ করে সময়টা অনুভবে। আকিব একটা ফ্রুট জুসের ক্যান নিয়ে বসেছে, ছুটিতে সময়টা ভালোই কাটছে তার। দেশ থেকে বহুদূরে, কাজের চাপ নেই, তাই সমুদ্রের তীরে কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া। আকিব একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আন্তর্জাতিক সিভিল ক্রাইম ডিটেকটিভ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্সিগুলোর সাথে কাজের অভিজ্ঞতা আছে তার। অতীতে সামরিক প্যারাট্রুপার ও নেভীর অপারেশনগুলোতে অফিসার হিসেবে থেকে কাজের সুযোগ হয়েছে, মাল্টিফাংশনাল যেকোনো সশস্ত্র ইউনিটে কাজের জন্য তার বেশ সুনাম আছে দেশে। তবে আকিব নিজেই যেন একটু অন্য ফ্লেভার চাইছিল, কাজের ক্ষেত্রে কিছুটা ফ্লেক্সিবিলিটি চাইছিল, তাই সিক্রেট সার্ভিসে যোগ দেয়া। এখানেও ধীরে ধীরে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে এগিয়ে গিয়েছে, এখন তো বলা যায় ইন্টার-কন্টিনেন্টাল বিভিন্ন সিভিল ক্রাইম এজেন্সিগুলোর মধ্যে পরিচিত মানুষ। বিভিন্ন সিক্রেট অপারেশনগুলোতে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষ তাকে মেন্টর হিসেবে চায়। সমুদ্র তীরে আছড়ে পড়া ছোট ঢেউয়ের শব্দের মাঝে হারিয়ে যেতে আকিব যেন ফিরে যায় তার জীবনে। হঠাৎ তার স্যাটেলাইট ফোনে একটা কল এলো। "না, এসময় আবার কে ফোন করলো" বিরক্তির সাথে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কারো জন্য কন্ঠ, কেউ যেন খুবই টেনশন নিয়ে বলছে, "হ্যালো, হ্যালো, আ-আ-আপনি কি ডিটেকটিভ আকিব বলছেন? আ-আমি রিমা। বাংলাদেশ থেকে বলছি। চিফ সিভিল ক্রাইম ডিটেকটিভ, সাউথ জোন। আপনার সাথে কি আমি একটু কথা বলতে পারি?"
....
সময়টা ২০৫০..
রিমা। বাংলাদেশের সাউথ জোনের চিফ সিভিল ক্রাইম ডিটেকটিভ। সম্পূর্ণ বেসামরিক পর্যায় থেকে উঠে এসে নিজের কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে যাওয়া একজন কর্মকর্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পাশ করা এই দক্ষ অফিসার বর্তমানে সারাদেশেই তরুণ গোয়েন্দাদের জন্য একজন অনুপ্রেরণা। চট্টগ্রামের মেয়ে রিমা বর্তমানে কাজও করছেন এই জোনেই। সাউথ জোনের সব কুখ্যাত সন্ত্রাসী, সিরিয়াল কিলার, আলোচিত মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধীদের কাছে রীতিমত আতঙ্ক তিনি। তার বন্ধু ও একান্ত সহকারী এবং মিডিয়া উইংয়ের অ্যাডিশনাল দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য লাবণ্য, একজন চৌকস অফিসার। তবে এর বাইরে তিনি একজন মুক্ত মনের মানুষ, রবীন্দ্র সংগীত শুনতে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন বই পড়তে। এছাড়া ছবি আঁকায়ও তার হাত সিদ্ধহস্ত। তিনিও রিমার সাথে একই বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন, বলা যায় মানিকজোড়। তাই তাদের মধ্যে রসায়নটাও জমেছে বেশ ভালোই। দুজনেই সাউথ জোনে আছেন। তবে তিনি রিমার মতো ইস্পাত-দৃঢ় না, কিছুটা ফ্লেক্সিবল, প্রথমেই অপরাধীকে ইন্টেরোগেশনে না নিয়ে, একটু তার সাথে মাইন্ড গেইম খেলতে পছন্দ করেন। হঠাৎ তার ফোনে একটা কল এলো, "হ্যালো, আপনি কি ডিটেকটিভ লাবণ্য বলছেন? আমি চ্যানেল ফোরটি এইট থেকে রিপোর্টার আসিফা বলছি, চট্টগ্রামের ব্যুরো চিফ । আমি কি একটু আপনাদের সংস্থার চিফ ডিটেকটিভের সাথে কথা বলতে পারি? দিস ইস আর্জেন্ট"
...
সাংবাদিক আসিফা। চট্টগ্রামের সাংবাদিক জগতের এক পরিচিত মুখ৷ তিরিশ বছর আগে রোহিঙ্গা সংকটের সময়ে মায়ানমার সীমান্তে তীব্র ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে একটা রিপোর্টের মাধ্যমে দেশব্যাপী আলোচিত হন তিনি। এরপর তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি, ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারে অর্জনের ঝুলিতে যোগ হয়েছে অনেক কিছুই। তবে তিনি কখনোই অফিসে বসে কাজ করায় ইচ্ছুক ছিলেন না, সবসময়ই তাকে টেনেছে বিভিন্ন রোমাঞ্চ, কখনো চলে গেছেন সীমান্তে, কখনোবা চলে গেছেন বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের কাছাকাছি, সংগ্রহ করেছেন অসংখ্য আলোচিত ফিচার। আজ সন্ধ্যায় হঠাৎ তার কাছে খবর এলো, খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে একটা সড়কের পাশে একটা বড় প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখা যায়, তাতে লেখা ছিলঃ "কেবল পুলিশ সদস্যরা এটি খুলতে পারবেন"। খবর পেয়ে স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর দুইজন সদস্য সেখানে যান এবং প্যাকেটটা খোলার সাথে সাথেই ভয়াবহ বিস্ফোরণে তারা উভয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। দ্রুত সাংবাদিক আসিফা ও তার টিম সেখানে গিয়েছেন। আহত দুই সদস্যকে ইতিমধ্যেই হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। একজনের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন, হয়তো ঢাকায় নেয়া হতে পারে। পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জায়গাটি ক্রাইম জোন হিসেবে চিন্হিত করেছেন, আলামত সংগ্রহ ও ছবি তোলার কাজ শেষ। পুলিশের পূর্বাঞ্চলের টিমের পক্ষ থেকে সেখানে আছেন অফিসার রাহাত।
...
পুলিশ অফিসার রাহাত। ৪৫ তম বিসিএস এর র্যাংকধারী একজন দক্ষ অফিসার। তার বড় চাচা ছিলেন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার। চাচাকে দেখেই রাহাতের এই পেশায় আসার অনুপ্রেরণা। সৎ ও কর্মঠ অফিসার হিসেবে সারাদেশে সেরা দশ পুলিশ অফিসারের তালিকায়ও নাম উঠেছে তার। পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন অপারেশনে সাফল্যের সাথে অপরাধীদের ধরার রেকর্ড রয়েছে, রক্তপাতহীনভাবে অপারেশন পরিচালনা করে চিন্হিত অপরাধীদের ধরার সুনাম রয়েছে। তবে এখন তিনি অত্যন্ত চিন্তিত। তার এরিয়ার মধ্যেই দুইজন পুলিশ অফিসার বিস্ফোরণে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। গত এক বছরে এই এলাকায় এমন কোনো অপরাধী চক্র নেই যাদেরকে তিনি সাইজ করেন নাই। তাহলে এরা কারা? অফিসার রাহাতের কপালে চিন্তার ছাপ।
ইতিমধ্যেই ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে। রাহাত দূর থেকে আসতেই দেখলেন রিপোর্টারদের টিম তাকে ছেঁকে ধরলো। গতানুগতিক উত্তর দিতে রাহাত কখনোই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না। সবসময়ই তার উত্তরে নতুন কোনো চাঞ্চল্য থাকে। তাই সাংবাদিকদের কাছেও তিনি আকাঙ্খিত এক ব্যক্তি। রাহাত এদিকে আসতেই রিপোর্টার আসিফা সবার আগে তার দিকে গেলেন, "অফিসার রাহাত..কি মনে হয়? এতটা দুর্গম এলাকায় আগে কখনো এভাবে ওপেনলি পুলিশের ওপর হামলা হয়নি। আপনি কি মনে করেন না এটি দেশের এবং এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি? আপনার ক্যারিয়ারে কি এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে আপনি মনে করেন?"
রাহাত আজ কিছু বলতে চাইছেন না। শুধু বললেন, "দেখুন, আজ আমাদের খুবই প্রিয় দুইজন জুনিয়র সহকর্মী আহত হয়েছেন, আমার এই পরিস্থিতিতে শোক প্রকাশের ভাষা নেই। এই এলাকার শৃঙ্খলা রক্ষার্থে যা যা করা দরকার, আমার টিম সবকিছুই করবে।"
...
চ্যানেল ফোরটি এইট হেড অফিস, মহাখালী। ব্যুরো চিফ (কান্ট্রি নিউজ সেকশন) লাবিবা তৈরি হচ্ছেন, তার "Labiba's Live Cast" অনুষ্ঠানের জন্য। অভিজ্ঞ এই সাংবাদিক প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের পাশাপাশিও নিজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে সারাদেশে বিখ্যাত। তীর্যক ও ভয়ডরহীন প্রশ্নবাণে প্রায়ই নাস্তানাবুদ করেন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সেলিব্রেটিদের। আজ তার অনুষ্ঠানে স্পেশাল অতিথি থাকবেন দেশের ইকোনমিক অ্যারিনার বিগ বস বিজনেস ম্যাগনেট সাদাবী। ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এই ব্যক্তি একইসাথে দেশের একজন ভিভিআইপি পার্সন। বলা যায় বেসরকারি ব্যাংকিং খাত ও পোর্টের শিপমেন্টের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তার পরামর্শ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। তবে বিভিন্ন সময়ে ক্রমবর্ধমান মাদক ও স্বর্ণের চোরাচালান চক্রের সাথে তার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সম্পৃক্ত থাকার গুজব বাতাসে ছড়িয়েছে, তবে বরাবরের মতোই সুচতুর ও বুদ্ধিমতী এই বিজনেস ম্যাগনেটের সামনে সেগুলো কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।
"Labiba's Live Cast" চলছে, দশ মিনিট যেতেই হঠাৎ সাদাবী বলে উঠলেন "লাইভ বন্ধ করুন, আমার একটা ফোন এসেছে, আমাকে এক্ষুণি বেরোতে হবে। ইটস ভেরি আর্জেন্ট"। লাবিবা কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না, এর আগেই সাদাবী বেরিয়ে গেলেন। অগত্যা দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলে তিনি একটা বিজ্ঞাপন বিরতির নির্দেশ দিয়ে তার অফিস রুমের দিকে গেলেন। তিন দিন ধরে এই পর্বের অপেক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ কি বলো যে গেস্ট উঠে চলেই গেল? কি ছিল তার সেই ফোন কলে?" ভাবতে ভাবতেই রুমে এসে স্ক্রিনে দেখলেন ব্রেকিং নিউজ, খাগড়াছড়িতে হঠাৎ এক বিস্ফোরণে দুই পুলিশ সদস্য মারাত্মকভাবে আহত, একজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। এর সাথে রিপোর্টার আসিফার রিপোর্ট, স্থানীয় এক পুলিশ অফিসারের কথোপকথন। লাবিবা দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। অনুষ্ঠানের দশ মিনিটের মাথায় সাদাবীর চলে যাওয়া, খাগড়াছড়িতে বিস্ফোরণ, আহত পুলিশ সদস্য, পুলিশ অফিসারের থমথমে মুখ, এসবের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই তো??
.....................
ডিটেকটিভ লাবণ্য ফোনটা চিফ ডিটেকটিভ রিমার কাছে দিলেন। "কার ফোন?", রিমার প্রশ্ন। " একটা নিউজ চ্যানেল থেকে ফোন করেছে, তোর সাথে কথা বলতে চায়, খুব আর্জেন্ট বললো"। রিমা ফোন কানে নিতেই, 'হ্যালো, আমি রিপোর্টার আসিফা। বিস্তারিত পরিচয় পরে জানাচ্ছি। এক ঘন্টা আগে খাগড়াছড়িতে একটা বিস্ফোরণে দুই পুলিশ সদস্য মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে দেশের কোনো ক্ষতি করতে চায় এমন কোনো চক্র এটি করে থাকতে পারে। আপনারা প্লিজ কিছু করুন। এখন রাখছি।" বলেই ফোন কেটে দিলো।
রিমা চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে, এরই মাঝে তার ফোনে মেসেজ "হ্যাল্লো, হিকোচগামা কিং বলছি ফ্রম দ্যা কিং প্যালেস। খাগড়াছড়িতে আইসো না, আসলেই খেলা হবে। আমরা কি করতে পারি এটা জানতে চাইলে, এই মেসেজের রিপ্লাই না দিয়ে ছাদে যাও, দুই বিল্ডিং পরের বিল্ডিংটা দেখো, এরপর খেলতে চাইলে, আসো। কাকে নিয়ে আসতে পারো দেখবো। তোমার ক্যারিয়ার ছিঁছকে সন্ত্রাসীদের ধরা পর্যন্তই। এর বেশি যেন না হয়, হাহাহাহা"
রিমা ছাদে এসে দূরে তাকাতেই, বুমমমমমম!!!!! ঠিক তার দুই বিল্ডিং পরের পুরোনো বিল্ডিংটা যেন বিস্ফোরণে উড়ে গেল!!! ওখানেই তো তাদের কিছু লুকোনো যন্ত্রপাতি!!!
....
আকিব ফোন ধরেছে। সকালে তার নিজের সময়টায় কেউ বিরক্ত করায় ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে দেবে ভাবলেও, অপরপাশের কথাগুলো শুনে তার ভেতরের পেশাগত সত্তাটা যেন জেগে উঠলো। পোর্ট লুইসের এয়ারপোর্ট থেকে আজকেই চার্টার্ড বিমানে আকিবকে দেশে যেতে হবে, বিভিন্ন দেশে অনেক অপারেশনের পর এবার তার নিজের দেশের ডাক চলে এসেছে।
অপারেশন কিং প্যালেস, টাইম টু বিগিন!!!
___________________________
পরবর্তী অংশের লিংকঃ অপারেশন কিং প্যালেস (২য় অংশ)
লেখাঃ রাহবার-ই-দ্বীন
(গল্পগুলো আমার ওয়েবসাইটেও যুক্ত করা হচ্ছে)