(গল্পের ২য় অংশ)
........................
ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফেরার পর কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে তাওসীফ।তার এখনো মাথায় আসছে না একটা মেয়ে এত সুন্দর হয় কেমন করে?সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ক্যাম্পাসে আজ চার বছর হলেও সে এই মেয়েটাকে এর আগে কখনোই দেখেনি...
...
আমজাদ স্যারের নোটগুলো টেবিলেই পড়ে থাকে।সেগুলো আর পড়া হয় না সেদিন।তাওসীফ ভাবনাতে ডুবে যেতে থাকে।তার বয়স যখন নয় বছর,সেসময় ব্রেইন স্ট্রোকে তার বাবা মারা যায়।দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তাওসীফ বড়।মা এই ছোট বাচ্চাগুলোকে নিয়ে এই দুঃসময়ে কোথাও স্থান না পেয়ে তাদের নিয়ে গেলেন নিজের বাবার বাড়িতে।স্বামী মৃত্যুর পর পৃথিবীর সব জায়গায় অবহেলা পেলেও নিজের বাড়িতে তাকে সেটা পেতে হয় নাই।সেসময় থেকে তাওসীফ আর তার ভাই-বোনেরা তাদের মামা-মামির হাতেই মানুষ।মা একটা ছোট্ট টেইলার্সের কাজ করতো,বাকিটা মামা-মামির অবদান।আস্তে আস্তে তাওসীফ বড় হয়,নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়ে সে কখনো খুব উঁচুতে স্বপ্ন দেখেনাই,আশা-আকাঙ্খাকে সীমার মধ্যেই রেখেছে।ভাবছে পড়ালেখা শেষ হলেই পরিবারের আর্থিক দিকটা নিজেই দেখবে,ভালো কোথাও যদি চাকরি হয়ে যায়।তার রেজাল্টও মোটামুটি ভালোই।
...
ভার্সিটি লাইফে তার বন্ধুদের অনেকেই বিভিন্ন রিলেশনে জড়িয়ে পড়েছে,তাওসীফের অবশ্য সেসব ব্যাপারে কখনোই তেমন ইন্টারেস্ট ছিল না।সে তার পড়ালেখা,সেমিস্টার ফাইনাল,এইসব নিয়েই ছিল।মেসে থাকে,ঘুমের ঠিক নাই,খাওয়ার ঠিক নাই।যখন ইচ্ছা ঘুমায়,যখন ইচ্ছা হয় খেতে বসে,মুভি,পড়ালেখা,বন্ধুদের সাথে আড্ডা,এসব মিলিয়েই চলে যাচ্ছিলো দিনগুলো...
...
পৃথিবী হয়তো সবাইকে সবকিছু তাড়াতাড়ি দেয় না,দীর্ঘসময় অপেক্ষা করায়।কিন্তু যখন দেয়,শুধু দু হাত না,চার কিংবা আট হাত ভরেই দেয়।না হলে যে ছেলে জীবনে কোনো মেয়ের প্রতি অনুভূতি তো দূরের কথা,তাকায় নাই পর্যন্ত,তার কেন আজ এমন হচ্ছে! এই প্রশ্নের উত্তর তাওসীফের জানা নেই।
...
সেদিন রাতে সে ভাত খেতে পারেনাই।মেসের সিনিয়র বড় ভাই আছেন একজন,রাতুল ভাই।পড়ালেখা শেষ করে চাকরির জন্য এপ্লাই করছেন।তাওসীফ সহ মেসের অন্যান্যদের কাছে তিনি রীতিমত অভিভাবকের মত।
-"কিরে ভাইয়া খাইবা না?
-"না রে ভাই,আপনি খায়া নেন।"
-"কি হইলো তোমার আজকে?খাইবা না ক্যান?"
-"ভাই আপনে অহন যান তো।আমারে একটু একলা থাকতে দেন।আমি পরে খামু"
..
রাতুল ভাইয়া নিজের রুমে চলে যায়।এই মেসে তিনি প্রায় আড়াই বছর,কখনো তাওসীফকে এমন দেখেন নাই।হয়তো মন খারাপ কোনো কারণে,ভাবলেন তিনি।
এইদিকে ধীরে ধীরে রাত পার হয়,তাওসীফ আর খেতে যায় না।আমজাদ স্যারের নোটগুলোর ব্যাপারেও তার আর খেয়াল নেই তেমন।হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত প্রায় সাড়ে চারটা!!! সময়টা কিভাবে চলে গেলো সে বুঝতেই পারেনাই!!!
...
ডিসিশনটা তখনই নিল সে।পরের দিন আবার সে ক্যাম্পাসে যাবে।মেয়েটাকে যে ভাবেই হোক খুঁজে বের করতেই হবে।পরিচিত হওয়া দরকার।অপরিচিত একজনকে সে খুঁজে বের করতে পারবেনা,ভালো করেই জানে।তাই মাহিরের হেল্প দরকার।এসব ব্যাপারে মাহির ছেলেটা অতিরিক্ত চালু।
...
সকাল সাতটা বাজার আগেই মাহির এসে হাজির হয় তাওসীফের মেসে।ঝড়-বৃষ্টি,গরম-শীত যাই থাকুক,ফ্রেন্ডদের জন্য সে এক পায়ে খাড়া সবসময়।
-"এত সকালে আইতে কইলি হঠাৎ?"
-"দোস্ত তোরে একটা কথা কই।তুই তো জানোস আমি কেমন।লাইফে কোনো মাইয়ার দিকে তাকাই নাই কোনোদিন।"
-"হইসে থাম,পুরান রেকর্ড আর বাজাইস না।নতুন কাহিনী বল আমারে।"
-"ঐ তো কালকে ক্যাফেটেরিয়ায় চা খাইতেসিলাম,দেখলাম একটা মেয়ে..."
-"একটা মেয়ে,তো?"
-"আরেহ দেখলাম একটা মেয়ে..."
-"ছাগলের মত মে মে করোস ক্যান।কইয়া ফালা কুইক"
"মেয়েটা কোন সেমিস্টারে পড়ে,কই থাকে কিছুই তো জানিনা।আগে কখনো দেখিনাই।"
-"আরে সালা,তুমি কি বইসা বইসা মেয়েদের আদমশুমারি করো ক্যাম্পাসে? সব মাইয়া তোমার পরিচিত হওন লাগবো?" :p
-"ধুর ঐটা বলিনাই।মেয়েটার ব্যাপারে জানা দরকার।তুই একটু আমার সাথে থাকবি আজকে ক্যাম্পাসে।"
-"মানে কি!তুমি এইডা কওনের লাইগা আমারে সাতসকালে ডাইকা আনছো? হুনো,আমার দশ কথার এক কথা,আজকে ক্যাম্পাসে যাইবার পারতাছিনা।আজকে রাধিকা যাইবো না,আমি ক্যান যামু তাইলে? তোমার মত তো আদমশুমারি করি না মাম্মা"
-"সবকিছু নিয়া ফান করোস ক্যান? আয় না আজকে।আমার সাথে থাকবি,দেখি খুইজা পাই কিনা মেয়েটারে।"
-"হ বুঝছি।তোমার অবস্থা সিরিয়াস মাম্মা।অবশ্য আমি গতকালই বুইঝালাইছি।কাল তো চা শুকাইয়া গেছিল,আজকে মনে হয় তুমি নিজেই শুকাইয়া যাইবা!" :v
-"আর লজ্জা দিস না রে।"
-"হইছে রেডি হইয়া নে অহন।আমি কিছুক্ষণ ঘুমাই।ক্যাম্পাসে যাওয়ার টাইমে আমারে কল দিস"
.......
সকাল ৯.৩০টা।এই ক্যাম্পাসের প্রতিটা ইট তাওসীফের তালুর মত চেনা।তাও আজ সে গেইট দিয়ে ঢোকার সময় কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি পাচ্ছে।কোথায় যেন পড়েছিল,"কিছু অনূভূতি জীবনে একবারই আসে।সেই অনুভূতিটা প্রাণভরে উপভোগ করতে হয়।"আচ্ছা,এটাই কি সেই অনুভূতি?
.
পাশ থেকে মাহির কিছুক্ষণ পর পর বলেই চলেছে,"আমার ঘুম ভাঙায়া গেলো গো মড়ার কোকিলে","লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প,তারপর হাতছানি অল্প"...আরো কত কিছু! তাওসীফ অবশ্য সেদিকে খেয়াল করছে না।বন্ধু তো,ফান করতেই পারে। সে আজ খুঁজছে এক অপ্সরীকে,প্রথম দেখাতেই যাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল...
...
স্কাল্পচার ফ্যাকাল্টির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দূর থেকে দেখলো একজনকে।এটাই কি সেই মেয়েটা?বোঝা যাচ্ছে না পেছন থেকে।অবশ্য গতকালের মতই ঘাড়ের এক পাশে এলিয়ে দেয়া চুল,একটা বেগুনী রংয়ের ক্লিপ।অবশ্য তাওসীফ যে মেয়েটাকে নাম ধরে ডাকবে,সেটারও কোনো উপায় নেই।মেয়েটার নামই যে জানেনা!!!
.
পাশ থেকে মাহির বললো,"হঠাৎ দাঁড়ায় গেলি ক্যান? পাইসোস?"
-হ দোস্ত।ঐ যে...ফ্যাকাল্টি বিল্ডিংয়ের পাশের রাস্তাটায় মেয়েটা।"
-"আবালের মত খাড়ায় আছোস ক্যান? যা,গিয়া কথা বল।"
-"প্রথম টাইম,নামও জানিনা।জানাশোনা নাই হঠাৎ যদি খারাপ কিছু মনে করে?"
-"কথা না বললে নাম জানবি কেমনে?"
-"নার্ভাস লাগতেসে রে দোস্ত"
-"হ,দুই ঘন্টা আমারে ঘুরাইয়া এখন কইতেসোস নার্ভাস লাগে! দে,আমারে দে,আমি প্রপোজ কইরা আসি" :p
-"যাইতেসি তো।দাড়া বুকে ফুঁ দিয়া নিই।"
-"ফুঁ না,বাতাস ঢুকায়া দিমু তোমার ভিতরে।যা তাড়াতাড়ি।আদমশুমারি করার সময় এইসব মনে থাকেনা?" :D
...
তাওসীফ সাহস নিয়ে হেঁটে যায়।আর কয়েক গজ সামনেই মেয়েটা,একটা বান্ধুবীর সাথে হাঁটছে।কথা কিভাবে শুরু করবে তাওসীফ বুঝতে পারছে না,অপরিচিত মেয়ে,তাওসীফ ঘেমে যাচ্ছে,নার্ভাসনেস তাকে কাবু করে ফেলেছে,যেটা লাইফে আগে কখনো হয় নি।
কি বলবে কিছুই বুঝতে না পেরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেই দিলো,
-"এক্সকিউজ মি,তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আমাকে?"
..........
(চলবে)
__________________
লেখা:রাহবার-ই-দ্বীন
গল্প:অস্ফুট নীল নিভাবরী(২য় অংশ)
পরবর্তী অংশঃ পাঠক চাইলে প্রকাশ করা হবে।