সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে আপনি যদি নেটফ্লিক্স বা বিভিন্ন স্ট্রিমিং অ্যাপের মত পেইড সিস্টেমে নিয়ে আসেন, এখানের প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাওয়া নেতিবাচকতা হয়তো কিছুটা হলেও কমে যাবে। এটা সত্যি যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ফেসবুক এই বিশ্বের জন্য অনেক বড় একটা প্ল্যাটফর্ম। আপনার ইমারজেন্সি রক্ত লাগবে, ফেসবুক সমাধান দিচ্ছে। আপনার একটা অনলাইন সেশনে কিছু জানতে হচ্ছে, ফেসবুক সমাধান দিচ্ছে। আপনার একটা প্রোডাক্ট বাইরে থেকে অর্ডার করতে হচ্ছে, ফেসবুকই আপনাকে সমাধান দিচ্ছে। এগুলো যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি উপমহাদেশের এই অঞ্চলগুলোতে এই ফেসবুকেই দানা বাঁধছে সাম্প্রদায়িকতা, ফেসবুকেই তৈরি হচ্ছে অন্যের মতামতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, ফেসবুকেই তৈরি হচ্ছে সাইবার বুলিং, অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা, এবং অনেকক্ষেত্রে হয়তোবা তৈরি হচ্ছে হাজারো মিথ্যে কিংবা গুজব।
মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হল সে নেতিবাচকতার প্রতি আকর্ষিত হয়। আপনি যখন একটা ভালো জায়গায় কয়েক ফোঁটা খারাপকে দানা বাঁধতে দিবেন, ধীরে ধীরে সেগুলোই মানুষের উপর প্রভাব ফেলবে সবচেয়ে বেশি। প্রথমদিকে ইন্টারনেট ছিল দেশের শুধুমাত্র স্বচ্ছল ও আধুনিক শ্রেণির ব্যবহারের মাধ্যম। ধীরে ধীরে ব্যাপক প্রয়োজনীয়তার কারণে এটি সবার কাছে খুব সহজেই হাতের নাগালে চলে এসেছে। এটি অবশ্যই ভালো দিক। এখন খুব কম খরচে একটি অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন পেলে আর কিছুটা ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে দেশের যেকোনো জায়গা থেকেই আপনি উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা পেতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো আপনি ব্যাপারটাকে কিভাবে ব্যবহার করছেন??
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে, বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে একটি বড় অংশ ইন্টারনেট বলতে এখনো শুধু ফেসবুক ব্যবহার করাই বুঝে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের দিকে হিসেব করলে ফেসবুক ব্যবহারের ধারে-কাছেও নেই ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা অন্যান্য অ্যাপ গুলো। এটির বিভিন্ন কারণের মধ্যে একটি যেমন বলা যেতে পারে একই জায়গায় অনেক মানুষের সম্পৃক্ততা, তেমনি আরো বলা যেতে পারে অন্যতম বড় কারণ হল এর সহজপ্রাপ্যতা। আপনি চাইলেই ফ্রি ডট ফেসবুক ব্যবহার করতে পারবেন, লাইক কমেন্ট কিংবা কোনো আপত্তিকর পোস্ট শেয়ার করা, সবকিছুই ফ্রি করতে পারবেন, যেটি অন্যান্য অ্যাপ গুলোতে সুযোগ নেই। এই সহজপ্রাপ্যতা হয়তো একটি বড় কারণ এক্ষেত্রে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, একই নিউজফিড ব্যবহার করছেন বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতার মানুষ। একজন বিখ্যাত ব্যক্তি কিছু একটা লিখলেন, কিংবা কোনো চ্যারিটি করলেন, কিংবা নিছকই নিজের পরিবারেরই একটি ছবি দিলেন, সেই একই ছবিকে তার কমেন্ট বক্সে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে দেখবেন। এটা ঠিক যেকোনো যৌক্তিক সমালোচনা এবং সে সম্পর্কে মত প্রকাশের জন্য এটি খুবই ভালো মাধ্যম। তবে সাইবার ক্রাইম, সাইবার বুলিং আর যৌক্তিক সমালোচনা তো এক নয়। এটাও আপনাকে মানতেই হবে। আপনার নিউজফিডে আপনি নিজ ক্ষেত্রে খুবই রুচিশীল কোনো ঘরানার মানুষ হয়েও হয়তো একই সঙ্গে খুবই অপ্রাসঙ্গিক এবং ভাষায় লেখার অযোগ্য কোনো কমেন্টও আপনার চোখে পড়বে। এটি আপনি কখনোই থামিয়ে দিতে পারবেন না। কারণ আপনি এমন একটি প্ল্যাটফর্মের কথা বলছেন, যেটিতে সকল শ্রেণির সকল পর্যায়ের মানুষ একইরকম ভাবেই ব্যবহার করছে। হয়তো বলবেন, এটাই ফেসবুকের সৌন্দর্য।
কিন্তু না। দেশে ক্রমবর্ধমান সাইবার অপরাধের হাজারো কেইস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ৯০ ভাগই ফেসবুক রিলেটেড। আপনি তো এই সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে বন্ধ করে দিতে পারেন না। অনেক অসাধারণ কাজের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এটিকে আপনি বরং পরিচ্ছন্ন করতে পারেন বা সে ব্যাপারে চিন্তা করতে পারেন। কিভাবে?
প্রথম কথায় ফিরে আসি, বিভিন্ন স্ট্রিমিং অ্যাপের মতো ফেসবুককে পেইড সিস্টেমে করে দিন, প্রতিটা পোস্ট কিংবা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক কমেন্টের জন্য ক্যাটাগরী করে পেইড সিস্টেম রাখতে পারেন। মাসে ১০০ টাকা ফি রাখলেও দেখবেন অনেকটাই নেতিবাচকতা কমে যেতে পারে। মানুষ কি এমবি কিনে, টাকা দিয়ে ইন্সটাগ্রাম ইউজ করে না? অবশ্যই করে। মানুষ কি টাকা দিয়ে স্ট্রিমিং সাইট গুলোতে মুভি কিংবা অন্যান্য বিভিন্ন এডুকেশনাল সাইট গুলোর ভিডিও দেখে না? অবশ্যই দেখে। তাহলে ফেসবুকে কেন নয়? অন্তত ব্যাপক হারে না হলেও, কিছুটা অংশে কেন নয়??
প্রশ্নটা কারো কাছে করছি না। নিজের ভেতরের কিছু বোধের বহিঃপ্রকাশ করছি শুধু।
ফেসবুক এবং আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এই প্ল্যাটফর্মগুলো নিরাপদ হোক, সুস্থ হোক। আমাদের পৃথিবীটা সুন্দর হোক আরো।
(সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও এর ক্রমবর্ধমান নেতিবাচকতা নিয়ে পাঁচ পর্বে কিছু লিখব বলে ভেবে রেখেছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় এই লেখা)
রাহবার-ই-দ্বীন,
১৬-০৫-২০২০