অপারেশন কিং প্যালেস (৪র্থ অংশ)
(গল্পটা কল্পনাপ্রসূত। বিনোদনের স্বার্থে পড়ার অনুরোধ রইলো)
তখন মধ্যরাত। খাগড়াছড়ি শহর থেকে বহুদূরে একটা নীরব আদিবাসী পাড়ায় সশব্দে এসে থেমে গেলো একটা চাঁদের গাড়ি৷ অফিসার রাহাত সবার আগে নামলেন, অন্যদেরকে বললেন, " আপনারা এখানে অপেক্ষা করেন, আমি ভেতরে যাই। এখানে স্থানীয় আদিবাসীদেরকে পরিচয় দিলে হয়তো থাকতে দেবে আজ রাতটা।"
সিভিল ক্রাইম স্পেশালিস্ট আকিব বললেন, "না, অফিসার আমরা এখানে একটা সিক্রেট মিশনে এসেছি, পরিচয় কোনোভাবেই বলা যাবেনা। আপনি দাঁড়ান এখানেই, আমি অনুরোধ করবো ডিটেকটিভ রিমাকে ভেতরে যেতে।.."
- "স্পেশালিস্ট, আপনি কি মনে করছেন না আপনার ডিটেকটিভ টিমকে আপনি পুলিশের উপরে ভাবতে শুরু করেছেন? ভুলে যাবেন না আমি এখানের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার।"
- "সিভিল ক্রাইম ডিপার্টমেন্ট এখানে সাহায্য করতে এসেছে আপনারা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন না বলেই। ল ইনফর্সমেন্ট অথোরিটি আসে ঘটনা ঘটে যাবার পরে, ডিটেকটিভ ক্রাইম টিম যায় ঘটনাটা ঘটিয়ে অপরাধীকে বের করতে। আমরা এখানে কোনো ছোটখাটো অপরাধীকে ধরতে আসিনি এটা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন। মাঝেমধ্যে পরিচয় প্রকাশ না করেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। কি ডিটেকটিভ রিমা, আপনি যাচ্ছেন তো?"
ডিটেকটিভ রিমার দিকে অফিসার রাহাত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এমন সময় ডিটেকটিভ লাবণ্য বলে উঠলেন, "ঠিক আছে আপনারা এখানেই থাকুন, আমি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ভালোই জানি, মনে হয় কিছুটা কথাবার্তা বলতে পারবো।"
ডিটেকটিভ লাবণ্য গেলেন। একটা পাহাড়ি জনপদে শহর থেকে বহু দূরে দুর্গম রাস্তার পাশে নেমে যাওয়া একটা ছোট আদিবাসী পাড়া, যেখানে হয়তো জনবসতিও খুব বেশি নেই। লাবণ্য গেল, একটা বাড়ির কাছে এসে বেশ কিছুক্ষণ কড়া নাড়লো, এরপরই দরজাটা খুলে গেলো। এত রাতে বহিরাগত কাউকে দেখতে হয়তো তারা অভ্যস্ত না, তাই নিজেদের মধ্যেই স্থানীয় ভাষায় কি যেন বলে একজন শক্ত-সমর্থ পুরুষ সদস্য বাইরে এলো। বেশ কিছুক্ষণ তাদেরকে পরখ করে নেয়া, এরপর আঞ্চলিক ভাষায় কিছু কথা বলা।
- "আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?"
- "আমরা..আমরা আসলে ট্যুরিস্ট, ছয়জন। এইদিকেই যাচ্ছিলাম, আগামীকাল সকালেই দূরের পাহাড়ে যাবো তো, তাই ভাবলাম একটা রাত অন্তত আশেপাশেই কোথাও কাটিয়ে দিই, আর আমাদেরও অনেক ইচ্ছে ছিল একটু এরকম দূরে নির্জন কোথাও থাকবো একটা দিন..."
লোকটা কিছুক্ষণ ভাবলো, পুনরায় প্রশ্ন, "আপনারা তো ছয়জন, কোনো অসুবিধা হবে না তো?"
- " না অসুবিধা নেই, আমরা বাইরে গল্প করতে করতেই না হয় কাটিয়ে দিলাম আজ রাতটুকু।"
- "আচ্ছা আসুন.."
অবশেষে গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে গাড়িটা কিছুদূরে রেখে তারা সবাই ভেতরে এল। একটা নির্জন পাহাড়ের কোল ঘেঁষে যাওয়া ছোট একটা আদিবাসী পাড়া, খোলা আকাশের নিচে বসে উপরে ওঠা চাঁদের আলো অনুভব করা। আদিবাসী মানুষটিও বাইরে তাদের সাথেই বসে গল্প জুড়ে দিলেন। নানান বিষয়ের গল্প৷ এখানকার মানুষের জীবন, জীবিকা..।
- "আপনারা আগামীকাল দুপুর পর্যন্ত কি থাকবেন?"
- "না, আসলে আমাদের সকাল সকালই বের হওয়ার ইচ্ছা"
- " ও আচ্ছা, আপনারা থাকলে একটা ছোট জিনিস দেখাতে পারতাম"
- "কি সেটা?"
- "সেটা না হয় সারপ্রাইজ হিসেবেই থাকুক, চেষ্টা করবো সকালেই দেখানোর ব্যবস্থা করতে। আপনারা কিন্তু সকালে না খেয়ে যাবেন না..."
...
বাইরে অল্প অল্প ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। ডিটেকটিভ লাবণ্য গান ধরলো। চাঁদের আলোয় খোলা আকাশের নিচে বসে রাত্রিবেলা তিনটার সময়ে মিষ্টি কন্ঠে কারো গানে মোহনীয় এক পরিবেশে তারা হয়তো ভাবছিল, জীবনটা এত জটিল সমীকরণের মাঝে আটকে না থেকে এরকম হলেই বোধ-হয় ভালো হতো৷
.......................................................
দূরের আকাশে সূর্যের উদয়, আলো ঝলমলে একটা দিনের আভাস। খাগড়াছড়ি সদরে একটা পর্যটন মোটেলের কক্ষে চ্যানেল ফোরটি এইটের কান্ট্রি নিউজ সেকশনের ব্যুরো চিফ লাবিবা এবং নিউজ রিপোর্টার আসিফা তৈরি হয়ে নিচ্ছেন, যেহেতু অফিসে ছুটি দেখিয়েই এসেছেন, তাই এখানে স্থানীয় কোনো সাংবাদিকের সাথে যোগাযোগ করেন নি। আজকের পর থেকে আগামী কয়েকদিন তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে তারা নিজেরাই জানেন না। একজনের Labiba's Live Cast এর অসমাপ্ত এপিসোডের রহস্য সমাধানের চেষ্টা, অন্যজনের সেই রহস্যের খোঁজে ছুটে আসা। নাস্তা সেরে পর্যটক সেজেই তারা বেরিয়ে গেছেন কাজে। সাংবাদিকেরা ডিটেকটিভদের মতো নন, তারা কাজের ধরণটা হয়তো একটু অন্যরকম। শুরুতেই গেলেন স্থানীয় বাজারে। শাক-সবজি ও কাঁচাবাজার ঠেলে চলে গেলেন কিছুটা ভেতরে স্থানীয় শিল্পদ্রব্য ও শৌখিন জিনিসের দোকানগুলোতে। নানান রকম নকশা ও শো-পিস দেখতে দেখতেই লাবিবার চোখ আটকে গেল শেলফে রাখা একটা ছোট সাপের প্রতিকৃতির দিকে। কালো দাগযুক্ত সেই শোপিসটা একটু দেখানোর জন্য বলতেই, দোকানদার কেমন যেন ইতস্তত বোধ করতে লাগলেন। বললেন, "আপা, এটা নিয়েন না.."
- " কেন?"
- " না মানে, এটা দোকানের জন্য সৌভাগ্য হিসেবে রাখি আমি। তাই দিতে চাচ্ছিনা"
- " আচ্ছা, আমরা কি একটা ছবি তুলতে পারি এটার সাথে?"
- "হ্যা অবশ্যই।"
- " আমাদেরকে একটু বলেন তো, এটা আপনি কোথা থেকে আনিয়েছেন? অন্য কোনো দোকানে তো এরকম কিছু চোখে পড়েনি।"
- "না মানে আপা, এটা রাজার লোকদের উপহার..."
- "কোন রাজা?"
- "সে অনেক কথা। সাপের দেশের রাজা..তার বিশাল বড় সাম্রাজ্য। গভীর জঙ্গলে থাকে সে..."
- "সাপের জঙ্গল আছে? কখনো দেখেছেন?"
- " না, তবে শুনেছি অনেক। আপনারা এত প্রশ্ন করতেছেন কেন? ছবি তুলবেন বলছেন না? নেন.."
লাবিবা ছোট সেই কালো সাপের প্রতিকৃতি হাতে নিল। আসিফার ক্যামেরায় ছবি তুললো। এরপর হঠাৎ ইচ্ছে করেই যেন এটা মাটিতে ফেলে দিলো, সাথে সাথেই ভেঙ্গে গেলো সেটা...
- " আরে আরে, করছেন টা কি আপনি? আমার দোকানের ভাগ্য তো নষ্ট কইরা দিলেন..এখন আমার কি হবে..."
লাবিবার সেদিকে খেয়াল নেই। তার চোখে আটকে গেছে ভেঙ্গে যাওয়া সাপের প্রতিকৃতিটার ভেতরে থাকা ছোট একটা চকচকে জিনিস....একটা হীরার টুকরো!!!
...................................................
সকাল হতেই বিজনেস ম্যাগনেট সাদাবী আর হিকোচগামা কিং Minhazul এর পক্ষ থেকে আসা Muntaha বের হলো। দুইজনের চোখেই কালো চশমা, সাদাবীর জন্য আসা পুরনো একটা সবুজ ছাদখোলা জিপ। ড্রাইভার কিং প্যালেসেরই লোক নিশ্চয়ই। চাবিটা দিয়েই সে চলে গেলো। গাড়িতে উঠতেই মুনতাহা স্টার্ট দিল। স্থানীয় বাজারের কাছে আসতেই কিছুটা জ্যাম, আজকে বাজার বসেছে, তাই মানুষের কিছুটা ব্যস্ততা আছে। জ্যাম শেষে গাড়ি ছুটলো শহর ছেড়ে দূরে, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা শুরুর আগে রাস্তার পাশে কোনো এক নদীর দিকে...
..................................................
লাবিবা শোপিসের দোকানদারের সাথে তর্ক করে মাত্রই ফিরে এসেছে, এর মধ্যে আসিফা ট্যুরিস্টের ছদ্মবেশে ভিডিও করতে সামনে গিয়েছিল আশেপাশে এবং রাস্তার দিকে। লাবিবা কাছে আসতেই জিজ্ঞাসা, "কিছু পাওয়া গেছে?"
ভিডিও টা একবার সাউন্ড মিউট করে দেখতে দেখতেই হঠাৎ, "একটু ১০ সেকেন্ড আগে ফিক্স করে দেখবো, কুইক"। ১০ সেকেন্ড আগে ফিক্স করতেই ক্যামেরায় চোখে পড়লো দূরে থাকা একটা গাড়ির ভেতরে চশমা পড়া একজন। ফোকাস করতেই লাবিবা অবাক, এ তো বিজনেস ম্যাগনেট সাদাবী!!! তিনি এখানে কি করছেন! ড্রাইভিং সিটে কে আছে বোঝা যাচ্ছেনা অবশ্য। কিন্তু ততক্ষণে লাবিবা যা বোঝার বুঝে ফেলেছেন। তার মাথায় দ্রতই অনেকগুলো ব্যাপার স্ক্যান হয়ে গেলো। একটা পাহাড়ি রাস্তায় পুলিশের ওপর হামলা, রিপোর্টে অফিসারের থমথমে মুখ, লাইভ সেশনের মাঝপথেই একজন অতিথির হঠাৎ চলে যাওয়া, সেদিন রাতেই ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম আসা, আজ সকালেই দোকানে শো-পিসের ভেতরে থাকা ডায়মন্ড, এবং সর্বশেষ খাগড়াছড়িতে সেই বিজনেস ম্যাগনেটকেই দেখা। না, সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে একটা রহস্যের দরজাটা খোলার খুব কাছে গিয়েও হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে বারবার। না, এখনই তাদেরকে যেতে হবে, তার লাইভ কাস্টের স্পেশাল এপিসোডের খোঁজে আসা এই খাগড়াছড়ি হয়তো দিতে পারে আরো কোনো বড় রহস্যের সন্ধান...
...........................................
সাররাত সেই আদিবাসী পাড়ায় উঠোনে বসে কাটিয়ে দেয়ার পর ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটলো। আদিবাসী মানুষটি কেমন যেন দেরি করছেন, তাদেরকে বারবার বলছেন সকালে নাস্তা খেয়ে যেতে। অগত্যা অনুরোধে ঢেঁকি গিলতেই হলো। উঠোনের এক কোণায় ছোট মাটির ঘর, সেটি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে, নিশ্চয়ই রান্নার আয়োজন। ডিটেকটিভ লাবণ্য, অফিসার রাহাত একটু সেই আদিবাসী মানুষটির ছোট বাচ্চাটার সাথে বাইরে হাঁটতে যাবেন। ডিটেকটিভ রিমা উঠোনেই বসেছেন, সিক্রেট সার্ভিসের দুইজন জুনিয়র মেম্বারও আছেন সেখানে। সিভিল ক্রাইম স্পেশালিস্ট আকিব উঠোন থেকে কিছুটা দূরে একা দাঁড়িয়ে আছেন, গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন। আগে বহুবার বিভিন্ন অপারেশনের অভিজ্ঞতা থেকেই জানেন, পরিস্থিতি একটু শান্ত থাকার মানেই হলো শত্রু সুযোগ খুঁজছে। অপারেশনে কোনো বিরতি থাকে না, যদি বিরতি থেকেও থাকে, সেটা শুধুই কোনো এক পক্ষের কৌশল মাত্র। তাহলে কি কিছু একটা আবারো আসছে??
.............................................
ডিটেকটিভ লাবণ্য ও অফিসার রাহাত আদিবাসী শিশুটির সাথে বাইরে গেলেন। আশেপাশে পাড়ার সরু রাস্তায় কিছুদূর হেঁটে শিশুটি আবার ঘরে ফিরে গেলো। এরপর তারা একটু গাড়ির দিকে যাবেন ভাবছেন, সেদিকে কিছুটা যেতেই দূর থেকে চোখে পড়লো, তাদের গাড়িটা সেখানে নেই!!! এদিক ওদিক তাকিয়েও যেন চোখে পড়ছে না। নিজেদের মধ্যে একটু অবাক হয়ে কথা বলছেন, এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে তাদের উপর দুইটা কালো ঝোলা দিলে কেউ যেন ঢেকে দিলো, এরপর সবকিছুই অন্ধকার। কয়েকজন জোরে ধরে রেখেছে তাদেরকে, হাত বেঁধে ফেলেছে পেছন থেকে। চেষ্টা করেও সরানো যাচ্ছে না। তারা শুধু বুঝতে পারছিলো, একটা গাড়িতে তোলা হয়েছে তাদেরকে, দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে... কে জানে, এটাই কি তাদের জীবনের শেষ গন্তব্য?
অপারেশন কিং প্যালেস, জার্নি টু দ্যা কিংস টেরিটরি!!!
___________________
লেখাঃ রাহবার-ই-দ্বীন
পরবর্তী অংশঃ আগামীকাল
আগের অংশের লিংকঃ অপারেশন কিং প্যালেস (৩য় অংশ)
গল্পগুলো পর্যায়ক্রমে আমার ওয়েবসাইটেও যুক্ত করা হচ্ছে। ধন্যবাদ।