(গল্পের ৪র্থ অংশ)
..........................
মেয়েটা চলে যাওয়ার পরেও সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তাওসীফ।কি আশ্চর্য!মেয়েটা দূর থেকে কয়েকবার ফিরে তাকালো তার দিকে,একটাসময় গাড়িতে উঠে গেলো।আচ্ছা,মেয়েটা কোনো কথাই বললো না কেন?সব কথা তো ওর পাশের রাগী বান্ধুবীটাই বলে দিল।কি মেজাজী মেয়ে রে!কয়েক মিনিট ধমকেই তো অবস্থা খারাপ করে ফেলতে পারে!
সৃষ্টিকর্তার কাছে পুরো পৃথিবীটাই একটা ক্যানভাস,উনি আপন মহিমায় এঁকেছেন সবকিছু।কিন্তু মেয়েটার চোখের চেয়ে সুন্দর কিছু নিশ্চয়ই নেই এই পৃথিবীতে,যেন সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে ফ্রেমে বাঁধাই করে দিয়েছেন মেয়েটার চোখগুলো।একটা মেয়ের চোখ এত সুন্দর হয় কিভাবে! তাওসীফ তো চোখ ফেরাতেই পারছিল না!!!!
"কিরে,ইলেকট্রিক খাম্বার মত একলা একলা খাড়ায় আছোস ক্যান? পাখি কই?" পাশে এসে হঠাৎ বললো মাহির।
-"কই পাখি?কোন পাখি?কিসের পাখি?এইখানে পাখি কই দেখলি তুই?"
-"আরে পাখি রে ভাই,উইড়া আইসা তোমারে ডানা ঝাপটাইয়া চইলা গেলো,ঐটা কই?"
-"ফান করিস না তো,মন মেজাজ বেশি ভালো নাই।"
-"হ,দূর থেইকা দেখলাম তো,তুমি কি যেন কইলা আর কিছুক্ষণ পরেই পাশের বজ্জাত মাইয়াটা পাখিরে টাইনা নিয়া গেল!পুরা বাংলা সিনেমা মাম্মা! ঝাড়ি খাইসোস?নাকি তোরে পছন্দ হয়নাই?"
-"আরে না,কথা বলারই তো চান্স পাই নাই,পাশের মেয়েটা নিয়ে গেলো।নাম জানসি,শায়মা,মনে হয় স্কাল্পচার ফ্যাকাল্টিতেই পড়ে,এইদিকেই তো ছিল।"
-"তা কেমন দেখলা মামা?ভাবতেসিলাম তোমার হার্ট কি ঠিক আছে নাকি আলগা হইয়া গেছে? পেসমেকার লাগান লাগবো?"
-"ভাই তোর পায়ে পড়ি,মেজাজ ভালো নাই,ফান করিস না।"
-"হ,সিরিয়াস অহন।বল তোর নেক্সট ডিসিশন কি?"
-"মেয়েটার সাথে কথা বলবো,সময় নিয়ে।আগামী কয়েকদিন এই ফ্যাকাল্টির দিকে আসবো নিয়মিত।দেখা যাক।"
-"অকা মাম্মা,যা অহন বাসায় গিয়া ঘুম দে,কাল রাইতে তো নিজেও ঘুমাস নাই আমারেও ঘুমাইতে দেস নাই।আর এইসব ঝাড়ি,ছ্যাকা,পল্টিবাজি,এইসব না থাকলে লাইফের এক্সাইটমেন্টই তো খুইজা পাইবি না! ভ্যাদার মত গালে হাত দিয়ে বইসা না থাইকা মাইন্ড ফ্রেশ রাখ ম্যান।দেখবি পজিটিভ হইবো সব,আমি একটু কাকরাইল যাইতেসি,আব্বায় বাড়ি থেইকা টাকা পাঠাইছে,রাইতে কল দিব।লালবাগ চলে আসিস,রাতুল ভাইরে বলিস আজকে ডিনার বাইরে করবি আমার সাথে।"
মাহির চলে যাওয়ার পর তাওসীফ মেসে চলে গেলো।এই মেসে সে আজ প্রায় তিন বছর,চারটা রুমে সাতজন থাকে,মেসে রাতুল ভাইয়ের পরে তাওসীফই বলতে গেলে সিনিয়র।সাধারণত দুপুরের এই সময়টাতে মেসে তেমন কেউ থাকেনা,সবাই যার যার কাজে বাইরে থাকে।সবার কাছেই একসেট চাবি আছে দরজার,তাই কাউকে আলাদা করে দরজা খুলে দিতে হয় না ভেতর থেকে।
দরজা খুলে তাওসীফ দেখলো রওনক ছাড়া তখন আর কেউ নাই,ছেলেটা সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে,ভীষণ পরিশ্রমী,পড়ালেখার পাশাপাশি স্কুলের দুইটা বাচ্চাকে পড়ায়,বাড়িতে টাকা পাঠায়,এই বয়সেই জীবনে অনেকটা কঠিন পথ পাড়ি দিতে শিখে গেছে সে।তাওসীফ বয়সে সিনিয়র হলেও জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই যে শেখার মত অনেক কিছুই আছে,রওনক ছেলেটাকে দেখে সে বুঝতে পারে।জীবনে কঠিন পথ সবাই পাড়ি দিতে পারেনা,কিন্তু যারা পারে,তারা "সাফল্য" শব্দটাকে আলাদা একটা স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে যায়...
নিজের রুমে এসে শার্টটা খুলে বিছানায় শুয়ে পড়লো তাওসীফ।মেয়েটার কথা কোনোভাবেই সে মাথা থেকে দূর করতে পারছে না।একটা মেয়ের জাস্ট চোখের দিকে তাকানোতেই এত সুখ,এত ভালোলাগা থাকতে পারে এটা এর আগে সে কখনো ভাবতেও পারেনাই।ক্যাফেটেরিয়ায় চা খাওয়ার সময় হঠাৎ দেখা,ক্যাম্পাসে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা,পাঁচ-সাত মিনিট মেয়েটার সামনে দাঁড়ানো,এই তো!অথচ ব্যাপারটাকে যেন মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে ঘটে চলেছে!এ যেন অসম্ভব সুন্দর একটা অনুভূতি,বেলীফুলের ঘ্রানে,রজনীগন্ধার নির্যাসে কিংবা রক্তজবা ফুলের সৌন্দর্য যেন একসাথে হয়ে মিশেছে মেয়েটার চোখে।আহা!সৃষ্টিকর্তা আসলেই নিপুণ মহিমায় সৌন্দর্যের সবটুকু দিয়ে তৈরি করেছেন মেয়েটাকে।ইশ!যদি একটাবার তার হাতটা ধরা যেত!সারাজীবনেও কখনো ছাড়তো না তাহলে...
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো তাওসীফ।
-"তাওসীফ,অ্যাই তাওসীফ,উঠ,তোর ফোন বাজতেসে..." রাতুল ভাইয়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙলো তার।ফোনটা হাতে নিয়েই দেখলো ১৯ টা মিসড্-কল! সাথে মাহিরের একটা মেসেজ,"সালা তোরে কল দিতাছি আধা ঘন্টা ধইরা,ফোন রিসিভই হয়না!গাঞ্জা খাইয়া ঘুমাও তুমি?তাড়াতাড়ি লালবাগ চইলা আয়,তোরে আজকে রাইতেই বুড়িগঙ্গায় নিয়া চুবামু"
কোনোরকমে একটা শার্ট পড়েই বের হয়ে গেলো তাওসীফ।রাতে ঢাকায় রাস্তা কিছুটা ফাঁকা হতে শুরু করেছে,তাও পৌঁছাতে তার প্রায় ২৫ মিনিট লাগল।একটা চেয়ারে মাহির বসে আছে,ফোনে কি যেন গেম খেলছে,রাধিকাও এসেছে,মাহিরের পাশেই বসা,একটু পর পর ঘুম ঘুম চোখে বাইরে তাকাচ্ছে।বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা গত কয়েক রাত ঘুমোয়নি, পড়ালেখা, এসাইনমেন্ট, ক্যাম্পাসে প্রোগ্রাম তো আছেই,তার উপর মাহির।বেয়াদবটা মনে হয়ে মেয়েটাকে রাতে ঘুমাতেই দেয়না,সারারাত ইমো আর ভাইবারে জ্বালায় শয়তানটা।এসব ভাবতে ভাবতেই টেবিলটার সামনে আসলো তাওসীফ।
-"হাই ভাইয়া,কি অবস্থা!অনেক দিন পর দেখা হল,বসেন বসেন।"রাধিকা বললো।
-"এই তো আছি আপু,তোমার কি অবস্থা?কখন আসছো?"
-"আর বইলেন না ভাই,হলে বান্ধুবীকে ম্যানেজ করে বের হইসি,বলসি ১১টার মধ্যেই হলে ফিরবো,নাহলে তো গেট অফ হয়ে যাবে।"
মাহির একমনে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।এই অভ্যাস অবশ্য তাওসীফের ভালোই জানা আছে।ফাজিলটা গার্লফ্রেন্ডের সামনে আসলেই একদম সুশীল নাগরিক হয়ে যায়!ভালো বাচ্চা হয়ে যায়!!!
জীবনে যে গেমস জীবনেও খেলেনাই সেটাও খেলা শুরু করে!মুখ দিয়েও তখন সুন্দর সুন্দর শব্দ বের হয় ওর!
-"আরে দোস্ত,এতক্ষণে আসলি!আসতে কোনো প্রবলেম হয়নাই তো?কি খাবি বল?ওয়েটার,এইদিকে আসেন।নে,আজকে তুই অর্ডার দে।"
আর মনে মনে বলতেসে,"শালা বদনা-পাবলিক,রাধিকা সামনে আছে বইলা কিছু কইতাছিনা,নাহলে এতক্ষণ দেরি করলে তোমারে মুড়াইয়া পায়খানার টাংকিতে ফালায় দিতাম"
তাওসীফ অর্ডার করে,খেতে খেতে গল্প করে তারা তিনজন।মাহিরের পড়ালেখার গল্প,রাধিকার প্রোগ্রামের গল্প,সেমিস্টার ফাইনাল,এসব বলতে বলতে হঠাৎ তাওসীফের ব্যাপারে কথা উঠলো।
রাধিকাই বললো,"ভাইয়া,আপনাকে নাকি কে যেন এসে ডানা ঝাপটা দিয়ে চলে গেসে?"
-"কই!মানে!? বুঝলাম না।"
পাশ থেকে মাহির মুচকি হাসে,তাওসীফ বুঝে যায় সব।শালা তাহলে এইসব তার গার্লফ্রেন্ডরে বলে মজা নেয়!উফফ মেয়েটা সামনে না থাকলে এতক্ষণে ব্যাটাকে ফ্রাই করে সস দিয়ে খেয়ে ফেলতো!!!
-"আমি সব শুনসি,মেয়েটা স্কাল্পচারে পড়ে?আচ্ছা আমি খবর নিয়ে জানাবো।টেনশন নিয়েন না ভাই"
তাওসীফ চুপচাপ খেতে থাকে।মনে মনে ভাবে,"হ টেনশন তো নিমুই না!সামনে দাঁড়াইয়া পাঁচ মিনিট কথা বলতে গিয়েই পুরা বডি নার্ভাস হয়ে গেসিলো!
খাওয়া শেষ করে বের হতে প্রায় ১০.৩০ টা বেজে যায়।রাস্তায় এসে কিছুক্ষণ হেঁটে দুইটা রিকশা নেয় তারা।মাহির বলে,"মামা তুই বাসায় যা,আমি রাধিকারে ওর হলে নামায় দিয়ে যাবো।"
ওরা চলে যায়,তাওসীফ রিকশায় উঠে না।আকাশে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে,আজ তার হাঁটতে ইচ্ছে করছে।রাস্তাঘাটে মানুষও তেমন নেই,দুই-একটা গাড়ি ফাঁকা রাস্তায় জোরে চলছে,ব্যস্ত এই শহরের ব্যস্ত মানুষেরা প্রায় সবাই এখন নিজেদের ঘরে ফিরে গেছে।আচ্ছা,এই শহরেরই কোথাও নিশ্চয়ই মেয়েটা থাকে।আচ্ছা,মেয়েটা কি রাগী স্বভাবের?না,হতেই পারেনা।রাগ করলে তো সে নিজেই ধমক দিতে পারতো।আচ্ছা,মেয়েটা কথা বলেনা কেন!ওর চোখজোড়া,বেগুনী রংয়ের ক্লিপে আটকানো চুল,সবকিছু এত বেশি সুন্দর কেন!আচ্ছা,মেয়েটা কি তার কথা ভাবছে এখন?নাকি ভুলে গেছে?মেয়েটার সাথে কি আর কখনো দেখা হবে তার?নাকি সবকিছু এই দেখাতেই শেষ হয়ে যাবে?
ভাবতে ভাবতে তাওসীফ বাসায় যেতে থাকে,ফুটপাতে একটা ছন্নছাড়া বুড়ি বসে তার বিছানা তৈরি করছিল,দেখলো একটা ছেলে,আনমনে কিছু ভাবতে ভাবতে যেন হাঁটছে।ব্যস্ত এই জীবনে ভাবুক মানুষের বড়ই অভাব,সবকিছুই কেমন যেন মেশিনের মত চলছে,এমনকি প্রকৃতিও!বসন্তকালে এখন বৃষ্টি হয়!একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুড়ি...
...........
(চলবে)
__________________
লেখা:রাহবার-এ-দ্বীন
গল্প:অস্ফুট নীল বিভাবরী(৪র্থ অংশ)
পরবর্তী অংশঃ মঙ্গলবার
১ম অংশের লিংকঃ গল্পঃ অস্ফুট নীল বিভাবরী (১ম অংশ)
২য় অংশের লিংকঃ গল্পঃ অস্ফুট নীল বিভাবরী (২য় অংশ)
৩য় অংশের লিংকঃ গল্প:অস্ফুট নীল বিভাবরী(৩য় অংশ)