"....এরপরের কয়েকটা মুহুর্ত আমার কাছে ছিল দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো, আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, একটা তীব্র অনুভূতি আমাকে তার দিকে তাকাতে বাধা দিচ্ছিলো, এটাকে কি বলবো আমি? ভালোলাগা? অপরাধবোধ? ভুল? নাকি বিভ্রান্তি? না, খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হয়নি। রূপকথা চিরকুটের উত্তরে একটা চিরকুট দিয়ে চলে গেছে। আর সাথে শুন্য দৃষ্টিতে বলা একটা লাইন, " হ্যালো, আমি রূপকথা, ফার্স্ট ইয়ার। উত্তরটা বাসায় গিয়ে পড়বেন"।
সৃ্ষ্টিকর্তা মেয়েদেরকে কিছু আশ্চর্য গুণ দিয়েছেন, একটা মেয়ে তার অনুভূতিগুলো ঠিকভাবে না জানিয়েও সুন্দর কিছু পয়েন্ট এর মাধ্যমে প্রকাশ করে ফেলতে পারে, হয়তো ছেলেরা এটা কখনো বুঝতে পারে, কখনো হয়তো বুঝতে পারেনা। রূপকথার ক্ষেত্রেও হয়তো সেটিই হয়েছিল, চিরকুটের উত্তরে লেখা ছিল, "সবকিছু বলে দিলেই কি হবে? বুঝে নিতে হবেনা কিছু ব্যাপার?" শেষে ছোট করে লেখা আরেকটা লাইন, "বোকার মতো তাকিয়ে থাকবেন না ওভাবে আর, ঠিক আছে?"
তারপরের গল্পটা আমাদের "তুমি" বলার গল্প, আমাদের প্রেম শুরু হওয়ার গল্প। একটা ছন্নছাড়া নিয়ম না মানা ছেলের সাথে একটা অসম্ভব গোছানো মেয়ের গল্প। আজ যখন অতীতে ফিরে যাই, স্মৃতির ঝাপসা ফ্রেমের মাঝেও উজ্জ্বল হয়ে ফিরে আসে আমাদের প্রথমবার একসাথে ঘুরতে যাওয়ার বিকেলটা। সারাদিন বন্ধু-বান্ধবের সাথে হই-হুল্লোড়ে, ব্যস্ততায় দিন কাটানো একটা ছেলের জন্য ফরমাল গেট-আপ নিয়ে প্রথমবার অসম্ভব কোনো গোছানো মেয়ের সামনে গিয়ে অফিশিয়ালি প্রেম শুরু করাটা অনেক কঠিন ছিল৷ কি কথা বলবো, সেটাই তো বুঝতে পারছিলাম না ঠিকমতো। মনে মনে শুধু ভাবছিলাম, ভালো লেগেছে প্রথম আমারই, প্রেমপত্রটাও পাঠিয়েছিলাম আমিই, কিন্তু এভাবে যে ফরমাল লুক নিয়ে ভদ্র বাবু সেজে এপিটাইজার খেতে খেতে কথা বলতে হবে, কে ভেবেছিল?
মেয়েরা হয়তো খুব সুন্দরভাবে বুঝতে পারে এই ব্যাপারগুলো। রূপকথা খুব দ্রুতই আমার জন্য ব্যাপার গুলো সহজ করে দিয়েছিল, আধা ঘন্টা রেস্টুরেন্টে থেকেই বের হয়ে হয়েই আমাদের নদী তীরে যাওয়া। বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নামে, নদীর তীরে তখন বাতাসের ঝাপটা, আর সূর্যাস্তের আবছা আলোয় রূপকথার মুখে যেন সেই রঙের প্রতিচ্ছবি। আমি শুধু মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকেছি, মেয়েটার মুখের আবছা আলোয় সূর্যের অস্ত যাওয়া দেখেছি...
তারপর থেকে অনেক বিকেল এভাবে কেটেছে, একটা ছন্নছাড়া অগোছালো ছেলের জীবনে এসে একটা খুব গোছালো মেয়ে অতিদ্রুতই মানিয়ে নিয়েছে। আমি ঘুম থেকে উঠতে দেরি করতাম, ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডায় গিয়ে তাকে অপেক্ষায় রেখে দিতাম, কোথাও যাবো ঠিক করলেও সময়মতো পৌঁছাতে পারতাম না। সারারাত গেমস খেলে ঘুমানো ছেলেটা, একটুও সময় দিতে না পারা ছেলেটাকে নিয়ে কোথাও তার কোনো অভিযোগ ছিল না। আমি মেয়েটার মধ্যে থাকা এই আশ্চর্য ধৈর্যটা দেখে মুগ্ধ হতাম।
ও আচ্ছা, এটা তো বলাই হয়নি, একবার পরীক্ষার সময় এলো, আমি তখন সারাদিন বন্ধুদের সাথে লাইব্রেরীতে, আর সে ফোনের পর ফোন করে যায়, আমার ফোন সাইলেন্ট থাকে, আমি ধরি না। তাতেও যেন তার এতটুকু রাগ নেই, এতটুকু অভিমান নেই! মাঝে একবার ঈদের ছুটি এলো, আঠারো দিন দেখা হলো না। এর মাঝে নিয়মিতই ফোনে কথা হতো, কিন্তু ঠিক ক্লাস শুরুর পর যখন সন্ধ্যায় প্রথম দেখা, অঝোর ধারায় তার সে কি কান্না! আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশি অনুভব করেছিলাম ব্যাপারটা চিন্তা করে। সেদিন প্রথমবারের মতো নিজেকে খুব ছোট লাগছিল, মনে হচ্ছিলো আমি খুব ক্ষুদ্র একজন, যাকে একটা মেয়ে হয়তো একটু বেশিই ভালোবেসে ফেলেছে...
তারপর থেকে আমরা অনেকবার একসাথে বের হয়েছি, প্রতিটা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দেখা আমাদের সব সূর্যাস্তগুলো, ব্যস্ততায় দুপুর পর্যন্ত ক্লাসের পরে আধ ঘন্টার জন্য বসে অলস আলাপ, প্রিয় সব টপিক নিয়ে মিষ্টি ঝগড়া, তাকে প্রত্যেকবার জিতিয়ে দিতে গিয়ে আমার ইচ্ছে করেই হেরে যাওয়া, আমাদের প্রথমবার সমুদ্র দেখতে যাওয়া, আমাদের প্রথম দূরে কোথাও ট্যুর, আমাদের প্রথমবার কাছে আসা, প্রথম কোনো স্পর্শ, প্রথমবার সবকিছু গোছালো থেকে একটু একটু করে অগোছালো হওয়া...
দুইজন খুব প্রিয় মানুষ যখন একে অপরের কাছাকাছি আসে, প্রকৃ্তিও হয়তো সেই ব্যাপারটা উদযাপন করতে চায়। সেজন্যই কিনা, সেদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছিল, আমার নীল রঙা শার্টের বুকপকেটে রূপকথার ভেজা চুলের স্পর্শ, সাথে বৃষ্টির ঝিরিঝিরি শব্দ, যেন সময় থেমে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য...
সেদিনের পর থেকে আমি রূপকথার জন্য একটা চিঠি লিখবো ভেবেছিলাম। প্রতিদিন দেখা হলেও আমরা তখন থেকে ঠিক করেছিলাম চিঠি লেখা শুরু করবো, অনুভূতিগুলো মোবাইলের আয়তাকার স্ক্রিনে না বলে, কিছুটা কাগজ-কলমের ছোঁয়া থাকবে, গন্ধ থাকবে। আমি এতটা বছর পর এসে সেটাকে নাম দিয়েছি "অনুভূতির গন্ধ"।
কাগজটা ভাঁজ করলে ভেতরে লেগে থাকা কলমের কালির সাথে অক্ষরগুলো যখন ভাঁজ হয়ে যায়, অক্ষরে থাকা অনুভূতি গুলোও কি সেভাবেই একে অপরের সাথে মিশে যায়? পৃথিবীর কোনো স্মার্টফোনের কিবোর্ড কখনো কি পারবে ভাঁজ হয়ে যাওয়া কাগজের অক্ষরের মাঝে মিশে থাকা অনুভূতির কাছাকাছি কিছু প্রকাশ করতে?
________________________________
গল্পঃ "রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ" (৩য় অংশ)
(আমার ওয়েবসাইটে পর্যায়ক্রমে লেখাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে)
পরবর্তী অংশের লিংকঃ রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ (৪র্থ অংশ)
১ম অংশের লিংকঃ
২য় অংশের লিংকঃ