(রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদঃ শেষ অংশ)
....................................................
আমি একটা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি, একটা গাড়ি আমার শরীরটাকে রাস্তার পাশে ছিটকে ফেলে দিয়েছে, তারপর আমি আর কিছু জানিনা।
আমি ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। ঝাপসা চোখে শুধু মনে হচ্ছে দূরে একটা বাতি জ্বলছে, আশেপাশে অনেক গুলো যন্ত্র। পুরো শরীরে অসহ্য ব্যথা, ব্যান্ডেজ বাঁধা, তার ভেতর থেকে বের হয়ে আসা লাল রক্তের ছাপ। আমার একটা পায়ের উপর দিয়ে গাড়িটা হিংস্রভাবে চলে গেছে, সে জায়গাটায় অনেকগুলো সেলাই। আমি এখনো বুঝতে পারছিনা কি হয়েছে সেখানে। আমার শুধু মনে হচ্ছিল আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি, হয়তো ঘুম ভেঙ্গে গেলে সব আগের মতোই হয়ে যাবে। আচ্ছা, আমি কত ঘন্টা পর চোখ খুলেছি? বাইরে কি এখন দিন, নাকি রাত? আমার আশেপাশে কেউ নেই কেন? আচ্ছা, রূপকথা কোথায়? আমি তাকে শেষ বার কোথায় যেন দেখেছিলাম?
আমার মাথা নাড়াতে পারছি না, যেন দুইপাশে অনেক গুলো কাঁটা বিঁধেছে, আর আমি স্থির দৃষ্টিতে শুধু সামনে তাকিয়ে আছি। একটু পর ডাক্তার এলেন, পেছনে রূপকথা। আমি তাকাতে পারছিলাম না ওর দিকে, শুধু শুনছিলাম ওর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। কিছুক্ষণ পর সে এলো, আমার পাশে বসলো, এই প্রথম তাকে দেখতে পেলাম, সাদা শার্টে বুকপকেটে রাখা চিঠি হাতে যাকে দেখেছিলাম, যেন মনে হয় এর মাঝে কত যুগ কেটে গেছে, ওকে এত বেশি কাঁদতে আমি কখনোই দেখিনি, আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওর চোখের পানি মুছে দিই, কিন্তু পারছিলাম না, আমি যে বেড থেকে উঠতেই পারছিলাম না....
আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি, আমার একটা পায়ের ভয়াবহ ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে। আমি হয়তো আগের মতো ঠিকভাবে হাঁটতে পারবো না। এই প্রথম নিজের জন্য একটু কষ্ট লাগতে শুরু হলো। আমি জানিনা, কেন। হয়তো মানুষ যখন বুঝতে পারে সে কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছে, তার ভেতরে হঠাৎ করে একটা শূন্যতা অনুভব হয়, সে হারিয়ে ফেলে নিজেকে, কিছুক্ষণের জন্য চিন্তা করতে পারেনা কোনো কিছু। আমার ক্ষেত্রেও কি তাই হয়েছিল?
আমি প্রায় কয়েকমাস ওখানেই ছিলাম, এই পুরোটা সময়ে রূপকথা এসেছে, দিনে দুইবার করে। প্রতিদিন নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছে, আর প্রতিটা দিন আমি তার চোখের পানি দেখেছি।
- "রূপকথা"
- "হুম, বলো।"
- "তুমি প্লিজ আমায় ভুলে যাও"
- "কেন, সাদমান? ভুলে যেতে বলার জন্যই কি ভালোবেসে ছিলে?"
- "আমি একটা পঙ্গু মানুষ, রূপকথা"
- "আমি এই মানুষটাকেই ভালোবাসি"
- "কিন্তু তোমার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে, তুমি প্লিজ বাসায় ফিরে যাও"
- "না, আমি যাবো না"
- "আমার সাথেই থাকবে? এখানে? একটা পঙ্গু হয়ে যাওয়া ছেলের পাশে?"
- "হ্যা, থাকবো। একশবার, হাজারবার। তোমার কোনো সমস্যা?"
আমি চুপ হয়ে যাই। কোনো উত্তর দিতে পারিনা। একটা মেয়ে সব ছেড়ে আমার কাছে চলে আসতে চায়। তার যুক্তির কাছে আমি হেরে যাই।
হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়ে বাসায় নিয়ে আসা হল আমাকে। সাব-লেট বাসা, বিছানা আর হুইলচেয়ারের জীবন। এর মধ্যে রূপকথা প্রতিদিনই আমাকে দেখতে এসেছে, যত্ন করে আমার বন্ধুদের কাছ থেকে ক্লাসনোট গুলো নিয়ে এসেছে, কখনো কফি বানিয়ে বারান্দায় এনে বসিয়েছে, বৃষ্টি দেখিয়েছে। কখনো মন ভালো রাখার জন্য গান শুনিয়েছে। আমার খুব কবিতা শুনতে পছন্দ, রূপকথা মাঝেমাঝেই কবিতা শোনাতো। দুপুরে ক্লাস শেষে পুরো বিকেল আমার বারান্দায় তার ছোট্ট সংসার। জানি, পরেরদিন আবার দেখা হবে, তবুও বিকেলে বাসায় ফেরার আগে আবার চোখ ছলছল।
- "কি, আজকেও কাঁদবা?"
- "কেন? আমি কাঁদলে তোমার সমস্যা? আমার ইচ্ছে হয়েছে, কাঁদবো। তুমি এগুলা বুঝবানা কখনো।"
সেদিন হঠাৎ বিকেলে প্রচন্ড ঝড়। থামার কোনো লক্ষণ নেই। রূপকথা এই বৃষ্টির মধ্যে যেতে পারছে না। আমি বললাম,
- "আজকে থেকে যাও।"
- "কোথায়?"
- "এই তো, এখানে। তোমার ছোট্ট সংসারে"
- "কেন? এখন রাখতে চাও কেন? সেদিন না হসপিটালে বসে বলতেসিলা চলে যেতে?"
আমি চুপ হয়ে যাই। কিছু বলতে পারিনা। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, আমি কিছু না বলে বৃষ্টি দেখি। হঠাৎ আমার কাঁধে ওর মাথা রাখা, ওর চুলের স্পর্শ। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, আমি ওর দিকে তাকাই। আমরা কয়েক মুহুর্তের জন্য চুপ হয়ে যাই। বৃষ্টি ফোঁটা জানালার কার্নিশ বেয়ে কিছুটা এসে পড়ছে আমাদের দুজনের মুখেই, আমি রূপকথার মুখে বৃষ্টির ফোঁটার গড়িয়ে পড়া দেখি। আচ্ছা, বৃষ্টির কি মানুষের হয়ে কথা বলে কখনো??
আমি ভেতরে ভেতরে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম, কিছু একটা হয়েছে। রূপকথা আগের মতো উচ্ছল নেই, আগের মতো সাবলীল নেই। কেন যেন কোথাও সুর কেটে গেছে, কোথাও ছন্দ হারিয়ে গেছে। একদিন দেখলাম আমার বিছানার পাশে রেখে যাওয়া ছোট্ট একটা চিঠিঃ
"সাদমান, আমি কখনো তোমাকে কথাগুলো বলতে পারতাম না। আমার বিয়ের জন্য বাসা থেকে বলা হচ্ছে। আমি তোমার কথা বাসায় খুলে বলেছি, কিন্তু..."
না, আমি আর পড়তে পারবো না। আমার চোখ হঠাৎ আবার ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি কিছু ভাবতে পারছিনা। আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। আমি ফোন করছি তাকে, ফোনে পাচ্ছি না। "আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটি এই মুহুর্তে বন্ধ আছে" স্বয়ংক্রিয় এই লাইনটিকে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে কর্কশ কোনো শব্দ।
এরপরের সময়টা কিভাবে চলে গেছে, আমি জানিনা। আমার এই ডায়েরির খাতায় অতীতে ফিরে গিয়ে এটি লেখার সামর্থ্য আমার নেই।
আমি একমাস ধরে একটা ফিজিক্যালি ডিজ-অ্যাবেল্ড মানুষদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকি৷ দুইবেলা খাবার দেয়া হয়, এখানের চিফ সুপারিন্টেন্ডেন্ট খুব ভালো মানুষ, পরিবারের মতো করে দেখাশোনা করেন আমাদের। ১৫ দিন পর পর ডাক্তার সাহেব আসেন, কারো কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা দেখে যান। গত এক মাসে অনেক বদলে গেছি আমি, স্মৃতির ঝাপসা ফ্রেমে ধুলো পড়ে গেছে, তাই ভেবেছি কিছু লিখবো। সেই লিখতে লিখতেই আজ আপনাদের জন্য এই গল্পটা।
আজকের বিকেলটা যেন একটু অন্যরকম লাগছে। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশে দেখলাম অনেক মেঘ। আকাশ কালো হয়ে এসেছে, আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে একটু বৃষ্টি দেখতে, বৃষ্টিতে ভিজতে। এখানের পিয়নটা এখনো আছে, বলতেই হুইলচেয়ার ঠেলে আমাকে বাইরে নিয়ে এলো। বৃষ্টি শুরু হয়েছে অনেক জোরে। আমি ভিজে যাচ্ছি, সেই তো আমার বাসার বারান্দায় বৃষ্টির দিনের পর, আজ এই প্রথম বৃষ্টি। সেদিন রুপকথা ছিল, আজ নেই। থাকলে ভালো হতো৷ দুইজনে মিলে সুখ-দুঃখের গল্প করতাম। মানুষের জীবন এভাবে বদলে যায় কেন? ভিজতে ভিজতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, আজ তবুও ভেতরে যেতে মন চাইছে না। আমি কাঁদছি, চোখের জল আর বৃষ্টি যেন মিশে যাচ্ছে একসাথে। বড় হয়ে গেলে ছেলেদের কাঁদতে নেই। তবুও আমি কাঁদছি। আচ্ছা, আমার চোখের জল কি বৃষ্টির সাথে মিশে, অন্য কোথাও রূপকথার জানালায় এসে পড়ে? সেই বৃষ্টিতে রূপকথা কি আমার অনুভূতিগুলো দেখে?
হঠাৎ ঝাপসা চোখে মনে হল, দূরে কেউ যেন আসছে। আমি চশমাটা রেখে এসেছি ভেতরে। খুব বৃষ্টি পড়ছে, বুঝছিনা এসময় আবার কে আসছে, কিছুটা কাছে আসতেই, যেন খুব পরিচিত কেউ, যেন খুব প্রিয় কেউ, খুব চেনা কেউ। রূপকথা আসছে, আমার রূপকথা আসছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা....
কাছে এসেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সে, তারপর কান্না। অভিমানের কান্না। যেন এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল, "তুমি কই ছিলা এতদিন? তোমাকে চিঠিটা লিখেছি, কি লিখেছি তুমি কি জানো? তুমি কি পড়ে দেখেছো পুরো টা? নিচে কি লেখা ছিল পড়েছো? বাসায় না গিয়ে ফোন বন্ধ করে বান্ধবীর বাসায় থেকে গিয়েছিলাম যেন পরেরদিন তোমার কাছে পুরোপুরি চলে আসতে পারি। আমি পরেরদিন বিকেলেই তোমার খোঁজে গিয়েছি, পাই নি। কোথায় ছিলা তুমি? এভাবে না বলে চলে গেলা কেন? তুমি জানো না তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না? কেন লুকিয়ে ছিলা এতদিন? একটুও কি মায়া হয়নাই তোমার এই মেয়েটার প্রতি? একটুও কি মনে পড়েনাই আমাকে? গত এক মাস কত খুঁজেছি তোমাকে, তুমি জানো? খুব শাস্তি দিতে ইচ্ছে হয়েছে আমাকে, তাই না? এভাবে পারলা ভুলে থাকতে? এভাবে?...."
বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, রূপকথা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, অভিমানের কান্না। তার কান্নার জল যেন গড়িয়ে পড়ছিল আমার বুকপকেটে, যেন লেখা হচ্ছিল আমার লেখা চিরকুট, "রূপকথা, তুমি আমার কাছে ক্যানভাসে আঁকা কোনো শিল্পীর রংতুলির আঁচড়। শেষ আঁচড় টা দেয়ার পর ছবিটা পূর্ণতা পায়, আর শিল্পীর কাছে সেটি যেন একটা যাত্রার সমাপ্তি। আর কখনো যে ছবিটা আঁকা হবে না, অনুভূতিগুলো রংতুলির স্পর্শে প্রাণ পাবে না। কিন্তু না, আমি আবারো হেরে গেছি, আমাদের অনুভূতির কাছে বিচ্ছেদ হেরে গেছে৷ তুমি প্লিজ আমার কখনোই শেষ না হওয়া রংতুলির স্পর্শ হয়েই থেকো"...
আকাশ ভেঙ্গে আরো জোরে যেন বৃষ্টি এল। দুইজন প্রিয় মানুষ যখন এভাবে কাঁদে, তাদের অনুভূতিতে হয়তো প্রকৃতিরও মন খারাপ হয়। বৃষ্টি নামে, অনুভূতির বৃষ্টি। আর সেই বৃষ্টিতে রূপকথা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে...
(সমাপ্ত)
_____________________________________
গল্পঃ "রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ" (শেষ অংশ)
১ম অংশের লিংকঃ রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ (১ম অংশ)
২য় অংশের লিংকঃ রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ (২য় অংশ)
৩য় অংশের লিংকঃ রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ (৩য় অংশ)
৪র্থ অংশের লিংকঃ রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ (৪র্থ অংশ)