"....সেদিন রাতটা আমার কাছে ছিল খুব দীর্ঘ। বারবার মনে হচ্ছিল, "আমি কি কোনো ভুল করে ফেলেছি? ওভাবে হঠাৎ করে সিঁড়িতে গিয়ে চিরকুটটা দেয়া কি ঠিক হয়েছে আমার? মেয়েটা যদি খারাপ কিছু ভেবে নেয়?" এসব ভাবতে ভাবতেই আর ঘুম হয়নি রাতে, ভোরের দিকে ঘুম এলো ক্লান্তির শেষে। চোখ খুলে ঘড়ি দেখতেই দেখলাম দুপুর ১২ টা। কোনোভাবে তৈরি হয়ে ব্যাগটা নিয়েই ছুটলাম। আজ ক্লাস করার ইচ্ছে নেই। মাথাটা তখনো ধরে আছে। একটু চা খাওয়া দরকার।ক্যাফেটেরিয়াতে গেলাম, প্রতিদিন যে পাশটায় বসে বন্ধুদের আড্ডায় সময় কেটে যায়, সেখানে এখন ফাঁকা। সবাই ক্লাসেই আছে হয়তো। চা খেয়ে লাইব্রেরির দিকে গেলাম। আজ পড়তেও ইচ্ছে করছে না। বই খুলে বসে আছি। ফেসবুকের নোটিফিকেশন চেক করছি আর ভাবছি গতকালের কথা। আচ্ছা, আমি কি সত্যিই কোনো ভুল করে ফেলেছি?
সচরাচর আমি লাইব্রেরির দেয়ালের পাশের তৃতীয় সারিতে বসি। বন্ধুরা একসাথে বসা হয় সেদিকেই। আজ ইচ্ছে করেই একটু দূরে আলাদা চেয়ার টেনে বসলাম। সময় গড়িয়ে দুপুর দেড়টা। আমি জানতাম রূপকথা ক্লাস শেষে বাসায় যাওয়ার আগে এক ঘন্টা লাইব্রেরিতে বসে। আজও এলো, সাথে ওর তিন বান্ধুবী। আমি দূর থেকেই আড়চোখে লক্ষ করলাম, অন্য দিনে রূপকথার চেহারায় যে উচ্ছলতা দেখতাম, আজ কেমন যেন সেটি একটু নেই৷ তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে কিছুটা, মনে হচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে ভাবছে। তার সাথের তিন বান্ধুবীও আজ চুপচাপ। তারা বেশিক্ষণ বসলো না, হঠাৎ সবাই চলে গেলো। আমি ভেতরে কেমন যেন একটা ধাক্কা খেলাম।
বিধাতা মানুষকে কিছু অনিন্দ্যসুন্দর বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন। একটা মানুষ তার পুরো জীবনেই নিজের একটি সুন্দর জগৎ তৈরি করে রাখে, তার চিন্তাভাবনা, তার কল্পনা, সেই জগৎকে ঘিরে আবর্তিত হয়। সচরাচর তারা চায় না সেই জায়গাটাকে প্রকাশ করতে। খুব কাছের বন্ধু-বান্ধবরা হয়তো সেই জায়গাটার কিছুটা অংশে আসতে পারে। সেই জায়গা থেকেই হয়তো তাদের কোনো টপ সিক্রেট ব্যাপার কাছের বন্ধুরাই জানতে পারে। আজ লাইব্রেরীতে রূপকথা ও তার তিন বান্ধুবীর মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝেছিলাম, যে ব্যাপারটার আশংকা করছিলাম মনে মনে, সেটাই হয়তো হয়েছে। ঘটনা জটিল হয়ে গেছে। ভুলটা তো আমারই।
না, প্রকৃতি মানুষের অনুভবের জায়গাটায় ভীষণভাবে ভুল প্রমাণ করে দেয় মাঝেমাঝে। কিছু ভুল অনেক বেশি মধুর হয়ে ধরা দেয়। সেটি যে আমার ক্ষেত্রেই ঘটে যাবে, কে জানতো?
ব্যাপারটা ঘটেছিল এভাবেঃ আমি সেদিন দুপুরে রূপকথার মুখের অভিব্যক্তি দেখে এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে, অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সরাসরি তার কাছে গিয়ে সরি বলবো। আমার সেদিনের কাজটা যে ঠিক হয়নি সেটি সামনাসামনিই বলে আসবো। কিন্তু তাকে একা কোথায় পাই? ক্যাফেটেরিয়া, কিংবা দুই তলার করিডোর, সবসময় পাশে তিন বান্ধুবী থাকবেই। ওদের সামনে গিয়েই বলবো? একবার ভাবলাম, এটা কি ঠিক হবে? একটা ব্যাপারে সরি বলতে গিয়ে কি উল্টো তাকেই আরো বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়া হবে না? নাকি সামনাসামনিই গিয়ে বলবো?
এসব ভাবতে ভাবতেই চলে গেলো দুই দিন। এদিকে রূপকথাকে আমি প্রতিদিনই দেখি, ক্যাফেটেরিয়ায় আড্ডায়, ওয়ান-টাইম কাপে কফি হাতে, করিডোরে হেঁটে যাওয়ার মাঝে দূর থেকে, মেইন রোডে এসে রিকশায় চলে যেতে। আমার অস্থিরতার জায়গাটা ভেতরে ভেতরে আরো গাঢ় হয়, অনুভূতিগুলো যেন আমাকে আরো অনেক বেশি জটিল সমীকরণের দিকে নিয়ে যায়, আমার দুইদিন ধরে ঘুম নেই, লাইব্রেরিতে যাই, বইয়ের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি, সাদা পৃষ্ঠায় কালো অক্ষরগুলোর মাঝে যেন সেই চিরকুটের শব্দগুলো দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে ফিরে। মেয়েটাকে প্রতিদিনই দেখছি চোখের সামনে, কিন্তু কিছু বলতে পারছি না। কোথাও যেন বেঁধে যাচ্ছে, কোথাও যেন আটকে যাচ্ছে। আজ এত বছর পর এসে অতীতে ফিরে গিয়ে আমি যেটাকে নাম দিয়েছি "অনুভূতির বিভ্রান্তি"। আচ্ছা, অনুভূতি তো মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সেই অনুভূতিও কি কখনো নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে যায়? কখনো কি সেই অনুভূতিরা নিজেরাই আটকে যায় কোথাও?
না, সেই অনুভূতির দোলাচলে আর বেশিদিন থাকতে পারি নি। সপ্তাহের শেষ দিনেই ঘটেছিল ব্যাপারটা। আমি বুঝতে পারছিলাম, ব্যাপারটা আমাকেই বলতে হবে। রূপকথা সাধারণত লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে একাই চলে যায়। আমি ঠিক সে সময়ই তার কাছে গেলাম। আমি খুবই নার্ভাস ছিলাম, মনে হচ্ছিল ভেতরে কোনো একটা জিনিস আমাকে টেনে ধরে রেখেছে, আর আমি ছুটে বাইরে চলে যেতে চাচ্ছি, এমন একটা অনুভূতি। নার্ভাসনেস থেকেই কিনা, কিছু বলতে গিয়েও বারবার থেমে যাচ্ছিলাম, শেষমেষ দুইটা শব্দই বলেছিলাম, " আমি দুঃখিত।"
ভয়ে ভয়ে ভাবছিলাম, মেয়েটা কি করবে এরপর? জোরে একটা চড় মেরে বসবেনা তো? কোনো উত্তর দিয়েই চলে যাবেনা তো? হঠাৎ অপমান করবে না তো?
না, রূপকথা কয়েক মিনিট চুপ ছিল, সেই কয়েক মিনিট যেন আমার কাছে কত সহস্র বছর মনে হচ্ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হেসে বললো "এত তাড়াতাড়ি সরি বলে দিলেন যে? উত্তরটা শুনবেন না?"
না, কিছু ভুল আসলেই অনেক বেশি মধুর হয়ে যায়....
(এই যে, যেমনটা ভাবছেন তেমনটাই কিন্তু হবে এমন কোনো কথা নেই, পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকুন)
___________________________________________
গল্পঃ "রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ" (২য় অংশ)
পরবর্তী অংশের লিংকঃ রূপকথা কিংবা বিচ্ছেদ (৩য় অংশ)
(আমার ওয়েবসাইটে পর্যায়ক্রমে লেখাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে)
১ম অংশের লিংকঃ