আজ আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে ডিভোর্স পেপারে সাইন করার দিন। এক মাস ধরে অনেক আলোচনা, অনেকবার মনের ভেতরের অনিশ্চয়তা, সব কিছুর শেষে আমরা বিচ্ছেদের দিকে যাচ্ছি। আমি আজ শেষবারের মতো নীতুকে চিঠি লিখেছি, ছয় বছর আগে প্রেম শুরুর পর প্রথমদিনে লেখা চিঠিটার কথা মনে পড়ছে অনেক। সবকিছুরই একটা শেষ থাকে, আমার চিঠি লেখারও শেষ হচ্ছে হয়তো আজ।
প্রতিটা মানুষের জীবনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিন থাকে। জন্মদিন, প্রথম প্রেমের দিন, বিয়ের দিন। আমার মনে হয় বিচ্ছেদের দিনটাও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ। সকাল হতেই আমার ব্যস্ততা শুরু। আর্টিসান থেকে কেনা খয়েরী রঙয়ের শার্ট, সাথে নীতুর সবচেয়ে প্রিয় ব্লেজার। আমার অ্যালিয়ন সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়িটা নিয়ে বের হলাম, গন্তব্য নীতুর বাসা। নাসিরাবাদ আবাসিক এলাকার ৫ নম্বর রোডের দিকে যাওয়ার পথে আমার চোখে ফ্ল্যাশব্যাকে বারবার চলে আসছিল ছয় বছর আগের সময়গুলোর কথা। সেদিন বিকেলে অঝোর ধারায় বৃষ্টি, আমার কাছে কোনো ছাতা ছিল না। প্রথমবার নীতুকে চিঠি লিখেছিলাম, কাঁপা কাঁপা হাতে প্রথমবার সেই চিঠি তার কাছে দেয়া, লজ্জিত মুখে শুধু বলা, "ভালোবাসি...", আকাশে মেঘের গর্জন, বৃষ্টির ফোঁটায় যেন চিঠির অক্ষরগুলো মুছে যাচ্ছিল। কিভাবে যেন সময় কেটে গেছে। আজ সেই আমি আবারো যাচ্ছি নীতুর বাসায়, শেষবারের মতো...
অফিশিয়ালি বিচ্ছেদের আরো কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই অবশ্য আমরা আলাদা থাকা শুরু করেছি, গত তিন দিন কোনো কথাও হয়নি। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, শেষ দিনেই একসাথে দেখা হবে। আমি পৌঁছানোর আগেই দেখলাম নীতু বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম প্রেমের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মেয়েটা একটা দিনের জন্যও দেরি করেনি। আজ শেষদিনেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
নীতু গাড়িতে এসে বসলো। আজ সে আমার সবচেয়ে পছন্দের শাড়িটা পড়েছে। চোখে গাঢ় করে টানা আই-লাইনার, কানে গত বৈশাখেই আমার গিফট করা কানের দুল। হালকা পারফিউমের ঘ্রাণে নীতুকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। জানিনা, মানুষের মন বিচ্ছেদের আগে এভাবেই শেষবারের মতো সবকিছু অনুভব করে কিনা...
আমি চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছি, গন্তব্য কর্ণফুলি নদীর পাড়ে। গন্তব্যটা দুজনেরই জানা বলেই কিনা, কারো মুখে কোনো কথা নেই বেশ কিছুক্ষণ। গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এলে কি মানুষ এভাবেই চুপচাপ হয়ে যায়?
- " নীতু, কেমন আছো?"
- " এই তো, চলছে। তুমি?"
- "আমিও, ভালো আছি। অনেক ভালো।"
- " মিথ্যে বোলো না। আজ শেষদিনে মিথ্যে বলতে নেই"
- "ও হ্যা, তাই তো। আচ্ছা, আগে কখনো কি আমরা মিথ্যে বলেছিলাম?"
নীতু দূরে তাকায়। কিছুক্ষণ পর বলে, "হয়তো, হয়তোবা না..."
আজও বৃষ্টি পড়ছে অল্প অল্প। নদীর কাছে এসে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করলাম। রাস্তা থেকে কিছুদূর নিচে নেমে গেলেই নদী। আঁকাবাঁকা রাস্তায় কিছুটা কাদা জমে গিয়েছে। সেজন্যই কিনা, হাঁটতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। আমি হাত বাড়িয়ে নীতুর হাতটা ধরলাম। হয়তো শেষবারের মতো, হয়তোবা শেষের শুরু...
এই নদীর তীরে আমরা বহুবার এসেছি। প্রতিটা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে, যখন আমাদের গাড়ি ছিল না, এখানে চলে এসেছি। মাঝেমাঝে নদীর হাওয়ায় উদাস হয়ে গিয়েছি, মাঝেমাঝে খেয়ানৌকার উঠে পড়ন্ত বিকেলে নদীর জলে সূর্যাস্তকে খুঁজেছি। কখনোবা, কালো হয়ে আসা মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে নীতুর স্পর্শ অনুভব করেছি...
আজ শেষদিন, শেষবার এখানে একসাথে আসা। আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি জানি, নীতুরও একই অবস্থা। কিন্তু না, আজ বিদায়টা এভাবে বলা যাবে না। আমরা তো ঠিকই করেছি খুশি মনে, কোনো অভিযোগ-অভিমানের হিসেব-নিকেশ না খুঁজে বিদায় নেবো, বিদায় দেবো...
- নীতু
- হুম, বলো
- কি ভাবছো?
- না, কিছু না। আমি ঠিক আছি। তুমি?
- হ্যা, আমিও ঠিক আছে। দেখো কি সুন্দর কাশফুল দেখা যাচ্ছে। যাবে ওদিকে?
- না, আজ ইচ্ছে নেই। এখানেই ভালো লাগছে।
- আচ্ছা। তোমার মনে পড়ে, প্রথমবার যখন এখানটায় এসেছিলাম?
নীতু কিছু বলে না। ওর মুখে অদ্ভুত সুন্দর একটা হাসি খেলা করে। এই হাসিতে প্রেমে পড়েছিলাম আমি ছয়টা বছর আগে। অনেক দিনের ব্যবধানে অনেক বদলে গেছি আমরা, তবুও এই হাসিটা বদলায়নি। আমি জানি, আজ সে হাসির আড়ালে বিষাদ আছে, তবুও সেই হাসিটা সুন্দর। প্রথম প্রেমের হাসি কিংবা বিচ্ছেদের দিনের হাসি, এভাবে মিলে যায় কেন সবকিছু?
বৃষ্টি এলো, অল্প অল্প করে ফোঁটায় ফোঁটায় জল এসে পড়ছে নীতুর মুখে। আমি জানি নীতু বৃষ্টিতেই বসে থাকবে। বহুদিনের অভ্যাস।ছাতাটা গাড়িতেই আছে। আমি সেদিকে যাওয়ার জন্য উঠতে যাবো, সে বারণ করল। বৃষ্টিটা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছে, কপাল গড়িয়ে জল এসে পড়ছে সেই ভেজা শার্টে। নীতুর খোলা চুল, গাঢ় করে টানা আইলাইনার এর উপর গড়িয়ে পড়ছে সেই জলের ফোঁটা। নীতুকে আমার এক কথায় শুধু বলতে ইচ্ছে করছে, "মায়াবী"... নীরবতা ভেঙ্গে নীতু বললো,
- একটা অনুরোধ রাখবে?
- বলো?
- আমি তোমার কাঁধে একটু মাথা রাখি, প্লিজ?
আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে যাই। ছয় বছরে একবারও এই প্রশ্নটা আমাকে শুনতে হয়নি। আজ এই প্রথমবার নীতু আমার কাছে অনুমতি নিয়েছে। আচ্ছা, মানুষ দূরে সরে যাওয়ার আগে, মানুষের মনগুলো কি দূরে সরে যায়?
নীতু আমার কাঁধে মাথা রাখলো। বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে আমাদের ওপরে। আমি জানি, নীতু কাঁদছে। আমিও কাঁদছি, তবে পুরুষ মানুষের এভাবে কাঁদতে নেই। তাই হয়তো বাকরুদ্ধ হয়ে আছি, আমার কিছু বলার নেই। আমাদের কিছুই বলার নেই।
নদীর জল গড়িয়ে যাচ্ছে, আমার মনে হচ্ছে এই তো আমি এখনো ফ্ল্যাশব্যাকে নৌকোর ওপরে আমাদেরকে দেখতে পাই, আমাদের সূর্যাস্ত দেখার দিনগুলো দেখতে পাই, আমাদের অল্প বৃষ্টিতেই বাইরে ভিজতে যাওয়ার দিনগুলো দেখতে পাই। আমি সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমি জানি, নীতুও দেখতে পাচ্ছে, পৃথিবীটা হয়তো কোনো কিছুর শেষ সময়ে এসে মানুষকে তার সব প্রিয় মুহুর্তগুলো মনে করিয়ে দেয়...
.......................................
বিকেল ৫ টা বেজে ৩০ মিনিট। আমরা ডিভোর্স পেপারে সাইন করে ফেলেছি। শেষবারের মতো পাশাপাশি কোনো কাগজে নিজেদের নাম সাক্ষর করা। শেষবারের মতো আমাদের দুইজনের নাম পাশাপাশি কোথাও থাকা। শেষবারের মতো একই কলম ব্যবহার করা। শেষবারের মতো হাসি হাসি মুখে কোনো কাজ করা...
আমরা শেষবারের মতো একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। আমি জানিনা পৃথিবীতে আর কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে এতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে কিনা। আমি জানিনা পৃথিবীতে কেউ বিচ্ছেদের আগে এতটা শক্তভাবে থেকেও ভেতরে ভেতরে কেঁদেছে কিনা। না, আমি কাঁদতে পারিনি...শেষবারের দেখায় আমি কখনো চাইনি আমাদের বিদায়টা কষ্টের হোক। আমার শেষ চিঠিটা নীতুর হাতে দিয়েছি, ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। তবুও জোর করে তাকিয়েছি, নিজেদের সব ফেলে আসা সুন্দর দিনগুলো মনে করে, শেষবারের মতো লেখা চিঠিটা দিয়েছি। যেখানে লেখা ছিলঃ
"নীতু, আমাদের যখন বিচ্ছেদ হবে, আমরা সেদিন একটুও মন খারাপ করবো না। তুমি আমার সবচেয়ে পছন্দের শাড়িটা পড়বে, আর আমি তোমার প্রিয় ব্লেজার। তোমার খোঁপায় স্নিগ্ধ রজনীগন্ধা, আর আমার হাতে তোমার দেয়া সবচেয়ে প্রিয় ঘড়িটা। দুজনে মিলে শেষবারের মতো একসাথে আমাদের গাড়িটা নিয়ে বের হব, পাশাপাশি বসে শেষবারের মতো উপভোগ করবো ফেলে আসা সুন্দর সময়গুলোকে। এরপর...ডিভোর্স পেপারে সাইন করার মুহুর্তে কিন্তু আমরা কেউ একটুও দুঃখ করবো না, ঠিক আছে?
নীতু, আমরা হয়তো আবারো কথা রাখতে পারবো না। হয়তো দুঃখ করবোনা বলেও, হয়তো কাঁদবো। সুন্দরের সাথে শুরুটা যার, সুন্দর সবকিছু দিয়েই হোক না শেষ? আমাদের সব সুন্দর স্মৃতি, ভালো সময়গুলোর জন্য তোমার কাছে আমি সারাজীবন কৃ্তজ্ঞ। আমাদের সব সুন্দর সময়গুলোর জন্য, আমাদের সব স্মৃতির জন্য, প্লিজ শেষ একটাবার আমায় হাসিমুখে বিদায় দেবে? দেবে তো?.."
..........................................
নীতু কয়েকটা মুহুর্ত চুপ করে আছে। সময় থেমে গেছে। আমরা একে অপরকে হাসিমুখেই বিদায় বলেছি, নীতু চলে যাচ্ছে। শেষবার আমায় ফেলে যাত্রা। আকাশ ভেঙ্গে আবারো নেমেছে বৃষ্টি। তারই মাঝে একটা নীল শাড়ি পড়া মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে আছি, বৃষ্টি দেখছি। চশমার ফ্রেমে পানির ফোঁটা এসে ঝাপসা করে দিয়েছে ফ্রেমটা। সেটা মুছে দূরে তাকালাম, রাস্তার অপর দিক থেকে একটা ছেলে, বছর বিশেক হবে বয়স। তার পাশের প্রেমিকাকে বৃষ্টি মধ্যে লজ্জামাখা মুখে বলছে, "ভালোবাসি..."
...........................................
পৃথিবীতে মানুষের বিচ্ছেদ হয়ে যায়, মানুষের যাত্রা শেষ হয়ে যায়। তবে স্মৃতিগুলো হয়তো থেকে যায়। সেই একই স্মৃতি, একই কথা, একই গল্প, হয়তো অন্য কারো জীবনে, অন্য কারো কল্পনায় ফিরে আসে, রাঙিয়ে দেয় তাদেরকে। আচ্ছা, তাদের শেষ যাত্রায়ও কি তারা আমাদের মতোই হাসিমুখে বিদায় দেবে?
.......
পৃথিবীর সব প্রিয় মানুষেরা ভালো থাকুক।
____________________
"একটা বিচ্ছেদের গল্প"
লেখাঃ রাহবার-ই-দ্বীন