স্বপ্ন কী কখনো বাস্তবের থেকেও বেশী বাস্তব ?
আজ দুটো স্বপ্নের গল্প করব, যাদের বাস্তবতার উপলব্ধির নৈকট্য হয়ত চর্ম চক্ষে দেখা রিয়ালিটির থেকেও বেশী । প্রথমটা আমার বাবার জীবন থেকে, তাঁর কাছেই শোনা। বাবা ছিলেন ভারতের পোষ্ট এন্ড টেলিগ্রাফ ডিপার্টমেন্টের একজন সরকারী ইঞ্জিনীয়র। তাঁর বেশীর ভাগ কর্মজীবনই কেটেছে পি এন টি পরে ডট এর প্রজেক্ট ডিপার্টমেন্টে। টেলি কমুনিকেশনের জগতে স্যাটেলাইট, মাটির তলার ফাইবার অপটিক্স কেবল এবং সমুদ্রতলের কেবলের বহুল প্রচলন আসার আগে , মাইক্রোওয়েভ টাওয়ার এর রিলে ষ্টেশন গুলোই দেশ দেশান্তরকে যুক্ত করেছিল। আর আমাদের নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের ভারত বর্ষের এক প্রান্তকে অন্য প্রান্তের সাথে যুক্ত করে মিলন মহানকে ভাবের থেকে ভাষার জগতে নিয়ে আসছিল সময়ের প্রবাহের সাথে । সত্তর দশকে বাবার ডিপার্টমেন্টের প্রধান কর্মকাণ্ড ছিল নতুন নতুন মাইক্রোওয়েভ টাওয়ার সহ এই রীলে সেন্টার তৈরী করা। সাধারণতঃ এই ষ্টেশন গুলো কোন পাহাড়ের মাথায় করা হত যেতে সহজেই প্রয়োজনীয় উচ্চতায় পৌঁছে সিগন্যাল ক্যাচ করে, এম্লিফাই করে তাকে আবার পরবর্তী টাওয়ারের দিকে ছুঁড়ে দিতে পারে। সবচেয়ে সুলভ (অপ্টিমাইজড ) পথের সন্ধানে বেশীরভাগ সময়েই লোকালয়ের থেকে অনেক অনেক দূরে তৈরী হত এই রিলে সেন্টার গুলো । বাবার পোস্টিং ছিল ভারতের ইস্ট আর নর্থইস্ট - আসাম , মনিপুর , মিজোরাম , নাগাল্যান্ড, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা এই সব রাজ্যে। কিছুদিন একরাজ্যের , এক সাইটে থেকে কাজ মিটিয়ে তারপরে কয়েকশো মাইল দূরে আরেক পাহাড়ে জঙ্গলে আরেক সাইটে গিয়ে কাজে লেগে যাওয়া, এই ছিল বাবার তখনকার জীবন।
এই জীবনের অনেক ইন্টারেষ্টিং গল্প শুনেছি বাবার কাছথেকে। এই গল্প তার একটা থেকেই। এইরকম ভাবে নাগাল্যান্ডেরই ঘন জঙ্গলে এক নিৰ্মায়মান রীলে সেন্টার সাইটে গভীর রাত্রে জীপে করে ঘুমোতে ঘুমোতে বাবা পৌঁছে গেল, পরবর্তী কয়েক মাসের কর্মস্থান হিসাবে । আশে পাশে কুড়ি পঁচিশ মাইলের মধ্যে কোনো জনবসতি নেই, উঁচু বাউন্ডারি ওয়ালের ভিতরে, জেনারেটর আর হ্যাজাকের অল্প আলোয় এক ভুতুড়ে পরিবেশ । তারমধ্যেই জনাকুড়ি স্টাফ আর সাইট ইঞ্জিনিয়ার কয়েকটা টেন্টে আর কয়েকটা সদ্য তৈরী ঘরে থেকে কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তারই একটাতে বাবার থাকার জায়গা তৈরী হয়। ক্লান্ত শরীরে আর দেরী না করে বাবা পৌঁছেই শুয়ে পরে।
রাত্রে ঘুমের মধ্যে মনে হল কেউ যেন জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। দরজা খুলে দেখাগেলো একজন স্থানীয় মহিলা উদভ্রান্ত হয়ে কাঁদছেন আর বলার চেষ্টা করছে কিছু। কিছুক্ষন প্রচেষ্টার পরে কথায়, ইশারায় বোঝাগেল ওনার বাড়ীতে কেউ রাত্রে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, সাহায্যের জন্য সঙ্গে যেতে বলছেন। এর পরে তাকে ফলো করে বাবা সাইটের বাউন্ডারী ওয়াল ছাড়িয়ে জঙ্গলে রাস্তা দিয়ে চলতে থাকে। পায়েচালা রাস্তা , স্থানীয় সাঁকো , নদী এই সবের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় বুঝতে পারে স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু সত্যি কারের ধাক্কাটা আসে পরের দিন সকালে। দিনের আলোয় বাউন্ডারী ওয়ালের বাইরে এসে জঙ্গলে রাস্তায় একটু এগোতেই আশ্চর্য হয়ে দেখে হুবহু আগের রাতে স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে যাওয়া রাস্তাই এটা !
আর পরের স্বপ্নের গল্পটা দক্ষিনেশ্বেরে বামুনটা শুনেছিলেন তাঁর তক্তাপোষে বসে, জেনেছি শ্রী ম র লেখনী থেকে। একবার এক ব্যক্তি ঠাকুরের কাছে আসেন বেশ কিছুদিন ধরে একটা স্বপ্ন তাঁর বার বার ফিরে আসছে সেই ব্যপারে ঠাকুরের মত নিতে। স্বপ্নটা অনেকটা এই রকম , স্বপ্নের মধ্যে তিনি নিজেকে আবিস্কার করেন একটা ছোট টিলার উপরে। চারি দিকে শুধু জল আর জল। দৃষ্টি যতদূর যায় এই টিলা ছাড়া কোনকিছু আর জলের উপরে মাথা তুলে নেই । এমন সময় হঠাৎ চোখে পরে সেই জলের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আদুল গায়ে এক ব্রাহ্মণ এগিয়ে আসছে। কাছে চলে আসার পরে তিনি বামুন ঠাকুরকে সুধান, কোথায় চললেন ঠাকুর মশাই আর আপনি জলের উপরে হাঁটছেন বা কি করে। ঠাকুর মশাই যেতে যেতে উত্তর দিলেন এই অকূল পাথারে সব কিছু জলে তলিয়ে গেলেও এই জলের ঠিক নিচে দিয়েই একটা আলের রাস্তা আছে আমি সেই রাস্তাটা জানি, সেটার উপর দিয়েই হাঁটছি। আমার তাড়া আছে, অপেক্ষা করতে পারব, না তুমি আমার চলার পথটা দেখে রাখ, এটা ধরেই সময় মত এই অকূল পাথারের বাইরে চলে এসো । গল্পটা শুনে দক্ষিনেশ্বেরের বামুন আনন্দে বলে উঠেছিল আমারতো শুনেই রোমাঞ্চ হচ্ছেরে তারপরে কিছু উপদেশও দিয়েছিলেন।