জীবনের শিক্ষা

জীবনের জন্য শিক্ষা না   শিক্ষার জন্য জীবন ?


এই জগতে কোন স্থানই  শূন্য থাকে না , আমাদের মনের  অন্তর্জগৎ ও তাই।  অন্তর জগত কে  সত্যম শিবম সুন্দরম দিয়ে পূর্ণ করার  প্রচেষ্টা না থাকলে, আমরা  বুঝে ওঠার আগেই তা অপ্রয়োজনীয়  আর  অবাঞ্ছিত ভাবধারায়  পূর্ণ হতে থাকে।  অচিরেই তার প্রতিফলন ব্যক্তির  ব্যাবহারে, বিচারে আর কর্মজগতে  প্রকাশিত হতে শুরু হয়। এটা ব্যক্তি জীবনের  ক্ষেত্রে  যেমন সত্যি, সমান ভাবে  সমাজ জীবনের জন্যও প্রযোজ্য । আজকের এই অস্থির সমাজের অন্যতম প্রধান কারণ এটাই। 

আজকের তথাকথিত শিক্ষাব্যবস্থা, মানুষকে এই ভাবে  পথভ্রষ্ট করার এক অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত। যেই শিক্ষাব্যবস্থায় জীবন সত্যম শিবম সুন্দরম করার চেষ্টার কোন  অধ্যায় নেই, তা কেবলই একটা  জাঠরী বিদ্যা। আজকের দিনে আমরা, এই জাঠরী বিদ্যাকেই ব্রহ্ম বিদ্যার স্থানে বসিয়ে দিয়েছি। এটাই আজকের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রহসন।   অনেক ছাত্রই সরল বিশ্বাসে এই জাঠরী  শিক্ষাব্যবস্থা কে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে জীবন এর সর্বস্য দিয়ে বসে থেকে , শেষে   জীবন  বিষময় এবং  অসুখী করে তোলে।  আর তারা, না তো নিজ জীবনে সুখী হয়,  না তো সমাজের কোনো  উপকারে লাগে । এই ভাবে  অজস্র সম্ভাবনা,  পথভ্রষ্ট ব্যর্থ জীবনে  পরিণত হয় আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় মূর্খতায়  বা শিক্ষাকে চেনার শিক্ষা না থাকায়  । 


আজকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মানুষকে দাস বানানোর মেশিন। দাসত্বর প্রাকৃত বীজ হচ্ছে নিজের মানসিকতায় , বাইরের  কোন বলবান আমাদের দাস বানায় না , বানায় আমাদের নিজের মন।  আমরা যদি আমাদের প্রতি পদক্ষেপে বাইরের জগতের সমর্থন খুঁজতে থাকি আমরা স্বাভাবিক ভাবেই তো দাস।  আমাদের ভাল মন্দের বিচার আমাদের নিজের আত্মা যদি করতে অসমর্থ হয় কোন পুঁথিগত জ্ঞ্যন ই  আমাদের স্বনির্ভর করে না। 


আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতি পদক্ষেপে আমাদের অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে শেখায়।  তাই শিক্ষার গন্ডীর বাইরেও এটাই আমাদের চারিত্রিক গঠন হয়ে যায়। আর এই চরিত্রের মানুষকে দাস বানানো সহজ। আর আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থা ঔপনিবেশিকতার কাল থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাই করে চলেছে। 

যেই শিক্ষা নিজেকে , আমি কে সেই প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করে না , তা মানুষকে এক বিভ্রান্ত পথিক ছাড়া অন্য কিছু তৈরী করতে পারেনা। এক  সত্য সন্ধানীর ভাষায়  বলি " জ্ঞানই সবচেয়ে বড় বন্ধন। এটাই ত্যাগ করার চেষ্টা করছি আমি। ছাত্রজীবনে অনেক কিছু পড়েছি। জেনেছি নানা তত্ত্ব। তারপর এই তত্ত্বগুলিকে করে তুলেছি এক-একটি রঙীন চশমা। আর এই চশমার মধ্য দিয়ে জগতটাকে দেখি, বোঝার চেষ্টা করি। এটাই সবচেয়ে বড় ভুল। সব জ্ঞানকে সরিয়ে রেখে এই জগতকে দেখা যায় কি? এক শিশু যেভাবে দেখে। অসীম কৌতূহল, হাজার প্রশ্ন নিয়ে সে সবকিছু দেখে। রঙীন চশমার মধ্য দিয়ে আমরা বয়স্করা, উচ্চশিক্ষিতেরা, বুদ্ধিমানেরা জগৎকে দেখি, ব্যাখ্যা করি। এভাবেই গড়ে তুলি মতামত। আর শেষপর্যন্ত এই মতামতই আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে, বাকী সব গৌণ। স্কুল-কলেজের প্রভাব তো আছেই, এছাড়া পারিবারিক প্রভাব, সামাজিক প্রভাব। রাজনৈতিক-ধর্মীয়-দার্শনিক-  অর্থনৈতিক   অসংখ্য জ্ঞানের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ি আমরা। এ থেকে মুক্তি চাই। অন্তরের মুক্তি। 

এক বিরাট সত্যকে অনুভব করেছি। আর সেই সত্য হলো – আমি কিছুই জানি না। এই উপলব্ধিই এনে দিয়েছে অপার আনন্দ। উচ্চশিক্ষিতেরা যে আত্ম-সম্মোহনে ভোগেন, সেই বন্ধন থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছি। এ যে কতবড় আনন্দ তা কিভাবে বোঝাবো আপনাকে? ছোটবেলায় হারিয়ে-যাওয়া সেই শিশুমনকে খুঁজে পেয়েছি। মানুষ যখন তার মনের সীমাবদ্ধতা ও জ্ঞানের একদেশদর্শিতাকে বুঝতে পারে, তখন ঘটে তার পুনর্জন্ম। এক নতুন জীবনে সে প্রবেশ করে। তার জীবনে নতুন প্রভাত শুরু হয়।

জীবনের মধ্যে এক পুনর্জন্ম ঘটানোই সাধনা। এটাই হলো প্রকৃত দ্বিজত্ব। চাল-ডাল-নুনের জগতের গভীরে রয়েছে অন্য এক জগৎ। সেটাই স্বর্গ, এক নন্দন কানন। কতো কাছের এই জগৎ, অথচ কত দূরে। একটি ছোট স্ফুলিঙ্গ। ব্যাস! হাজার বছরের অন্ধকার কেটে যায়।"

মানুষ একটা স্থির লক্ষ্য ছাড়া জীবন সুন্দর রাখতে  পারে না। কিন্তু যে কোনো পার্থিব  লক্ষ্য অচিরেই  আমাদের  বন্ধনে জড়িয়ে ফেলে, আর আমাদের দুঃখ্য আর অশান্তির কারণ হয়।  আমরা  আমাদের লক্ষ্যের   দাসে পরিণত হই ,  লক্ষ্যই আমাদের চালনা করতে শুরু করে । বহির্জগৎ আমাদের লক্ষ্যকেই  ব্যবহার করে, আমাদেরকে  তাদের মত চালিয়ে নেবার জন্য । আমরা অন্যের হাতের  পুতুল   হয়ে যাই।  কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে আমরা এর থেকে মুক্ত থাকতে পারি আবার জীবনকেও উদ্দেশ্যবিহীন না করে ফেলি। এটা একমাত্র সম্ভব যখন আমরা ঈশ্বরকে জানা অন্যথা নিজেকে জানাকেই জীবনের উদ্যেশ্য রাখতে পারি। যখন মনেপ্রাণে অনুভব করতে পারি , মানব জীবনের লক্ষ্য ঈশ্বর দর্শন বাকী সমস্ত উপলক্ষ।  উপলক্ষ লক্ষে পরিণত হলে জ্যাঠারি বিদ্যা ব্রহ্ম বিদ্যা বলে ভ্রম হতে শুরু হয়। তার পরিনাম  আজকের ঘরে বাইরে সর্বত্র দৃশ্যমান ।