পশ্চিমবঙ্গের প্রগতি

সাধারণ বাঙ্গালী মানসিকতার একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা নিজের ব্যক্তিগত গন্ডির লাভের চেয়ে যেটা ঠিক মনে করি  তার জয় দেখতে চাই, নিজের শত কষ্ট হলেও।  আমার চেনা অনেক কমুনিস্ট নেতাকে আমি মন থেকে সন্মান করি এই কারণে ।  এই  আদর্শ সত্যি মহান। কিন্তু ঠিক সিদ্ধান্ত যা সত্যি বহুজন হিতায় তাকে চেনার শক্তিই যদি না থাকে এই মহান আদর্শের প্রয়োগ হয় ইম্পালসিভ আবেগে। তা করতে গিয়ে যদি বার বার ঠকি  তার দোষ যে ঠকাচ্ছে তার উপরই চাপিয়ে দিয়ে কী  কোন অগ্রগতি হবে  ? আর এই বিচারশক্তি কোনো  শিক্ষা ব্যবস্থা ঠিক করেই  আসবে না...... সময়ের প্রয়োজনে জীবনে চলার পথের থেকেই আসবে .....সেটা না হয়ে কমুনিজম নামক এক আদর্শ যেটা নিজের দেশে এবং সবদেশে পরীক্ষিত ভাবে শুধু ব্যর্থ নয় একটা চূড়ান্ত অব্যবস্থা ( মাৎস্যন্যায় সমাজ ) তৈরী করে দেখেও আমাদের শেষ ভরসা মনে হয় ......কিছু তো একটা ভূল হচ্ছে আমাদের ভাবনায়।

সেদিক থেকে দেখতে গেলে যেই উদ্দেশ্য নিয়ে কমুনিজমকে ইমপ্লান্ট করা হয়েছে ভারতের  মাটিতে  তা অনেক অংশেই সফল।  ব্রিটিশ কারাগারে অল্পবয়সি বন্দীদের এই সব পুস্তিকা এগিয়ে দেওয়া হত তারা যেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবন পন করতে বসেছিল তাকে কাউন্টার করতে । সেদিনের আঠার বছর বয়েসের ভাবাবেগের উর্বর মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে যেই বীজ বসানো হয়েছে একশ  বছর আগে তার প্রভাব আমাদের জীবনের প্রান্তভাগেও , এত জীবন দেখার পরেও রয়ে গেছে। 

ভারতের পোষ্ট কলোনাইজেশন রাজনীতির অভিমুখ অনেকটাই ছিলো , ব্রিটিশ লেবার পার্টি ভাবধারার থেকে পাওয়া সোসালিস্ট মডেল । সেই মননে কমিউনিজিম খুবই আকর্ষণীয় বিষয় , ব্যক্তিগত রাজনৈতিক  আদর্শ  হিসাবে আবার ভোটের বাজারেও  খুবই সফল হাতিয়ার। কিন্তু  কমিউনিজিম এর সব থেকে দুর্বল জায়গা হচ্ছে এই ভাবধারা মানুষের এন্টারপ্রাইসিং স্পিরিটকে উৎসাহিত করতে পারে  না, সৃষ্টি সুখের উল্লাসকে  সম্মানের আসনে বাসাতে পারে না । আমার খুব কাছের আত্মীয় এবং  আমরণ বাঙালী কাম্যুনিস্ট মানুষের , তার মুখ থেকে শোনা , জীবনের অন্তিম লগ্নের এই বিষয়ের উপলব্ধি খুবই অর্থপূর্ণ  মনে হয়। কম্যুনিজম তখনই প্রাসঙ্গিক যখন কাপিটালিজম মানবতাকে নিয়ে চলতে ভুলে যায়, তখনই  আবার সমাজে বিপ্লব লড়াই কথা গুলোর মানে থাকে। কিন্তু কমুনিজিম এর  একটা সমাজ ব্যবস্থার অন্তিম লক্ষ্য হতে পারার শক্তি  নেই , বিপরীত ভাবধারার প্রাসঙ্গিকতার অনুপস্থিতিতে এটা ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ আর তার অপব্যবহারে  অচিরেই একটা বিশৃখল সমাজ তৈরী করে ফেলে। লেলিন সাহেবের সার্থক ভাবে কমুনিজিম আপ্লাই করা সমাজে হাতে পাওয়া অতিরিক্ত  সময়ে শিকার আর ফিলোসফি চর্চা করে কাটানোর বিলাসিতার স্বপ্ন  জীবনের তারে হিল্লোল তুলতে পারে না।

শৃঙ্খল আর শৃঙ্খলা , দুটো শব্দ খুব কাছাকাছি কিন্তু একদম বিপরীত ভাব সম্পন্য। একটা বন্ধন প্রকাশ করে আর অন্যটা আত্মসংযম। আজকের বাঙালীর কাছে এই সুক্ষ প্রভেদ অদৃশ্যমান।  তাই বাঙালী মানেই বাইরের জগতের মনে ধারণা আসে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ,আত্মশক্তি শূন্য , দলপাকিয়ে যে কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধাচারণকারী এক জাতিগোষ্ঠী। 

শৃঙ্খল যেটা বাইরের থেকে কেউ জোর করে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে , সেই শৃঙ্খল ভাঙার জন্যও শৃঙ্খলা থাকার প্রয়োজন। নয়তো উন্মাদের বিপ্লব করে ধ্বংসাত্বক কিছু হয় হয়তো গঠনমূলক কিছু প্রসব করে না। আমরা অন্য কারও কথা কিছুতেই  শুনবো না।  তার কথার  উদ্দেশ্য এবং প্রচেষ্টা গঠনমূলক কিনা তার বিচারের ক্ষমতাও আমাদের নেই না তো আছে নিজেদের কোনো বিকল্প পরিকল্পনা ।  কিন্তু কেন শুনবো তোমার কথা এই তাড়না টাই প্রধান।  তাই দলবেঁধে আন্দোলন তো শুরু হয়েযায় তাড়াতাড়ি , কোনো  গঠনমূলক প্রচেষ্টাকে সফলভাবে পারাস্তও হয়ে যায় কিন্তু আখের কোন অগ্রগতি হয় না । তাই একদল বাঙালী একসাথে কিছু কাজ হাতে নেয়, অচিরেই সেই দলের আরেকটা বিক্ষুব্ধ দল তৈরী হয়ে যায়। 

তাই আজকের বাঙালীর নিজের উন্নতির জন্য , শৃঙ্খল ভাঙ্গার আড়ম্বর এর থেকে শৃঙ্খলাপরায়ন হওয়া শেখা প্রয়োজন।

আমাকে সব সময় এটা ভাবায় , আমাদের সব থাকা সত্ত্বেও কেন এগোতে পারছিনা।  আমাদের যে কী নেই তাই খুঁজে পাওয়া যায় না। বুদ্ধি নেই , জনবল নেই , বাজার নেই কিছুই বলা যায় না , এমন কী পুঁজি নেই তাও  তো বলা যাবে না , সেই সারদার আমল থেকে তো দেখিয়ে দিল বাঙালীর থেকে  টাকা নিয়েও তো হাজার হাজার কোটি কামাই করা যায়।  আগে লোকে টাকা জমিয়ে ফ্ল্যাট কিনত এখন টাকা জমানোর জন্য ফ্ল্যাট কেনে। মনে হয় আমাদের ব্যবসাবিমুখতাই মূল কারণ , এন্টারপ্রাইসিং হবার চেয়ে নির্ঝঞ্ঝাট নিচিন্ত জীবনই বেশী কাম্য ছিল কিছুদিন আগে পর্যন্ত। কিছুই করব না , শুধু ঝামেলার থেকে  দূরে থেকে  ভাল মানুষ হয়ে বসে থাকব আর অন্যের বিচার করব , এটাই ছিল এভারেজ বাঙালীর অবস্থান ।  আশার আলো এটাই , সেটার পরিবর্তন হচ্ছে।

আজকাল পপুলার কালচারে বুদ্ধিজীবী আর সুবিধাবাদী সমার্থক বলা হয় কিন্তু আমাদের সাধারণ  বাঙ্গালী বিচারে এটা ঠিক সেরকম ছিল না পরন্তু বাংলায় তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বলতে তাদেরই বোঝাত যাঁদের একটা মডারেট অবস্থান থাকত কিন্তু তাতেও অসুবিধা ছিল, সেই অবস্থানে যাঁরা সাপের মুখেও চুমু খায় আবার ব্যাঙের মুখেও আরও যথাযত বললে যাঁরা দিনে গৃহস্থকে বলে সাবধানে থেকো  আবার রাতে চোরকে বলে ওই বাড়িতেই চুরি কর গিয়ে তাদেরই বুদ্ধিজীবী  হিসাবে সর্বত্র গ্রহণযোগ্যতা ছিল।  যেখানে  বুদ্ধিজীবীর  সংজ্ঞা হওয়া উচিৎ "যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি, পৌরুষেরে করে নি শতধা"

ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই বিচার শুদ্ধ রাখা আর রাখার প্রচেষ্টাকে অসম্ভব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে , কারণ এটা বিনা চেষ্টা আর  সাধনায় পাওয়া বা রক্ষা সম্ভব নয়। কারণ এই জগতে কোন স্থানই  শূন্য থাকে না , আমাদের মনের  অন্তর্জগৎ ও তাই।  অন্তর জগত কে  সত্যম শিবম সুন্দরম দিয়ে পূর্ণ করার  প্রচেষ্টা না থাকলে, আমরা  বুঝে ওঠার আগেই তা অপ্রয়োজনীয়  আর  অবাঞ্ছিত ভাবধারায়  পূর্ণ হতে থাকে।  অচিরেই তার প্রতিফলন ব্যক্তির  বিচারে প্রকাশিত হতে শুরু হয়। মোহের মেঘ যখন সত্যকে দেখতে দেয় না সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াও অসম্ভব হয়ে ওঠে। 

কিন্তু নিজে কী করে বুঝব আমার বিচার ধোঁয়ায় ঢাকা নয়।  যখন নিজের কর্তব্য সিদ্ধান্ত  তৎপরতার সঙ্গে নিতে পারব , সারা পৃথিবীর সমস্ত বিষয়ে  বিদগ্ধ  মত দেবার চেয়ে নিজের কর্তব্য  স্থির করতে যদি দেরী না হয়, তখনই বুঝতে পারব আমাদের বুদ্ধি-বিচক্ষণতা আছে , বিচার শুদ্ধ আছে আর প্রত্যেকের  জীবনে সেটাই কাম্য আর অভিপ্রেত। 

এই আলোচনায়  দেবদত্ত পট্টনায়েক এর একটা গল্প মনে পড়লো। গল্পটা আমরা সবাই জানি......সেই  গনেশ আর কার্তিকএর  কম্পিটিশান , কে আগে  সাত বার পৃথিবী ঘুরে আস্তে পারে। কার্তিক এর ময়ূর এর পিঠে চোঁচা দৌড়কে হারিয়ে গনেশের মা-বাবা কে সাতবার ঘুরে নিয়ে জিতে যাবার গল্প।  গনেশের কাছে তার মাবাবাই জগৎ , অন্যের কাছে জগৎ যাই হোকনা কেন। সেইরকম  আমাদের রাজনৈতিক চর্চা  জগত উদ্ধারের জন্য দিনপাত না করে এইভাবে যারা আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে, আমাদের পরিবার , প্রতিবেশী  তাদের সঙ্গে যদি এদের নিয়েই যতটা সম্ভব স্বয়ংসম্পূর্ন  ছোট ছোট সামাজিক ইকোসিস্টেম আর তার সমস্যা আর সমাধানে ব্যয় করি স্বাভাবিক নিয়মেই পরিবর্তন আসবে।

মনে হয় এটা যদি ঠিক পথে চলে, খুব তাড়াতাড়ি  "বন্যেরা বনে সুন্দর বাঙালী সুন্দর প্রবাসে" র বাইরে আসতে পারব।

আর হ্যাঁ , আজ বাংলাদেশের সমাজজীবন যে ভয়ংকর দিকে চলে যাচ্ছে তাকে এড়িয়ে, রেমিটেন্স মানির ভরসায়  বাংলাদেশ কী উন্নতি করে ফেলেছে বলার থেকে যদি বাংলাদেশেরও সত্যি প্রগতির কথা বলতে হয় এটা বাংলাদেশের জন্য ও প্রযোজ্য।