সরকারি ব্রাহ্মণ এর পরিচয়পত্র

সময়টা সত্তরের দশকের শেষের দিকের বা আশির প্রথম  , বাড়িতে কেউ এসে খবর দিল যে  এখনকার চন্দনগর মহকুমার প্রধান খুব তৎপর , SC সার্টিফিকেট খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে।  আমি ভদ্রেশ্বরের যেই পাড়ায় বড় হয়েছি তারা প্রায় সবাই বাংলা দেশের ঢাকা জেলার দিঘলী গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসা জালিয়া কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মানুষ। দেশবিভাগের কারণে শিকড় ছেঁড়া তাপশীলি সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রায় সবার সঙ্গেই শুধু দেশের গ্রামের যোগ নয় আত্মীয়তার বন্ধন ও আছে।  এই সব ছেড়ে আসা মানুষ গুলোর সরকারী চাকুরীতে SC সুবিধা এক পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা।  একটু পড়াশুনা করতে পারলেই SC কোঠায় চাকুরী জোগাড় করে অনেক ছিন্নমূল পরিবারই নতুন করে শিকড় ছাড়াতে পেরেছে।  তাই ছেলে মেয়ে বড় হবার সাথে সাথে SC সার্টিফিকেট করিয়ে নেওয়া বড় হবার একটা অঙ্গ।  সাধারণতঃ বছরের পর বছর লেগে যেত।  তাই যখন খবর পাওয়া গেল তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাচ্ছে SC সার্টিফিকেট, করিয়ে নেওয়াটাই সমীচিন মনে করলো বড়রা। পাড়ায়  সার্টিফিকেট করানোর অভিজ্ঞতার থেকে জানতে পারা যায় , তখনকার জেলাশাসক তার পূর্বতন শাসকের তুলনায় অনেক কম চক্রবৎ ভ্রমণ করিয়ে সরকারি ব্রাহ্মণ এর পরিচয়পত্র দিয়ে দিচ্ছেন। তাই আমার আর ভাইয়ের পরিচয়পত্র সংগ্রহের প্রচেষ্টা শুরু হল। তখন আমি St Thomas এ পড়ি। Application এর একটা requirement ছিল স্কুল অধিকর্তার থেকে সার্টিফিকেট। স্কুলে ভাল ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছেলের এইরকম একটা সামাজিক অসম্মানজনক পরিচিতি নিয়ে এগিয়ে আসা খুব একটা সহজ ছিলনা।  আবার তার থেকে যে সব সুবিধা গুলো আসে তাকে অবহেলা করার অবস্থা ছিল না।  তাই অনেক লজ্জা সঙ্কোচ নিয়েই মাকে নিয়ে বড় দিদিমনির কাছে হাজির হলাম।  বড়দি নিজেও confused , এইরকম আব্দার নিয়ে আগে কেউ আসেননি। কদিন সময় নিয়ে , খোঁজখবর করে উনি দিয়েছিলেন। বারকয়েক চক্কর এর পড়ে পরিচয়পত্র ও হাতে এসে পরে। মনে আছে পাসপোর্ট সাইজ ফটো বার দুই তিন করাতে হয়েছিল এটাই ছিল একমাত্র বাধা । 

এর পরের একটা বড় অধ্যায় নিজেকে শূদ্র জ্ঞাত হবার হীনমন্যতা বোধ ছাড়া আর বন্ধু মহলে একটু আধটু সরকারী সুবিধা প্রাপ্তি নিয়ে তির্যক মন্ত্যব ছাড়া তথাকথিত Caste সিস্টেমের কোন নেগেটিভ প্রভাব আমার জীবনে নেই। আমাদের পাড়ার ক্লাবে যেখানে বেশীর ভাগই দিঘলী গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসা জালিয়া কৈবর্ত সম্প্রদায়ের পরিবারের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহন করা প্রজন্মের থেকে , তাদের কাছে এটা রেশন ইত্যাদির মত একটা সরকারী সুবিধাই মনে হত , এটা ঠিক প্রথা কী ভূল তা নিয়ে চিন্তা  ভাবনা বা  বিতর্ক খুব একটা ছিল না।  আমাদের মধ্যে SC সার্টিফিকেটকে বলতাম সরকারী ব্ৰহ্মানের পরিচয় পত্র। 

মাধ্যমিকের ফর্ম ফিলাপের সময় একটা সেক্শনে বলতে হত তাপশীলি জাতি নাকি।স্কুল জীবনে নীলমানিবাবুর আরেকটা মহৎ রূপ দর্শনের সৌভাগ্য হয় তখন। ছাত্ররা লজ্জায় যদি লিখতে না চায় , প্রথমেই বললেন , আমি নিজে  চাষার ছেলে  তা বলতে আমার কোন সংকোচ নেই। বছর পনেরোর বালকের হীনমন্যতা বোধ  কাটাতে যথেষ্ট  সাহায্য করে ছিল।  

SC সংক্রান্ত বিতর্ক  প্রকট ভাবে সামনে এল স্কুল জীবনের শেষ অধ্যায়। সেই সময় স্কুলের পড়াশুনাকে অবলম্বন করে জীবন গড়তে চেষ্টা করা যে কোনো ছাত্রের কাছে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারী কলেজে সুযোগ পাওয়া যে কতটা কাম্য ছিল সেটা আজকের দিনে বোঝানো খুব কঠিন। তাই যারা সুযোগ পায় আর যারা পায় না তাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরী  টা অবশ্যম্ভাবী।  ছাত্র জীবনে পড়াশুনায় খুব খারাপ ছিলাম না।  আমি সেখানে সরকারী নিয়মের সুবিধা নিয়ে ব্যাকডোর এন্ট্রি মন থেকে মানতে পারছিলাম না। আবার হাতে পাওয়া এই সুযোগকে আদর্শগত কারণে ছেড়ে দেবার মত অবস্থা আর আত্মবিশ্বাস ও ছিল না।  তাই একটা অন্তর্দন্দ ছিলই। তবে মনে এই আশা করতাম কোন রকম কোটার সুবিধা না নিয়েই যদি জয়েন্ট পেয়ে যাই। 

কিন্তু জীবনের অনেক আশাভঙ্গের মত জয়েন্টের রেজাল্টেও ব্যাতিক্রম হল না। মেডিকেল এ কোন জেনারেল রাঙ্ক নেই , ইঞ্জিনারিং এ হাজারের কাছাকাছি  একটা রঙ্ক এল তাতে যেখানে সুযোগ হবে , তারচেয়ে আমার SC লিস্ট অনেক অনেক  হাইলি সেলিব্রেটেড  সাবজেক্ট দেবে। আমাদের পরিবারের দিকথেকে একটা ইচ্ছে ছিল ডাক্তারীতে যাই , আত্মীয়দের মধ্যে ডাক্তার থাকার সুবিধার কথা মাথায় রেখেই , কিন্তু মন থেকে শুধু কোটার একটা সুযোগ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ভাল লাগছিল না আবার নিজেকে ঠিক প্লেস করতে পারছিলাম  না মেডিকেল ফিল্ডে আরেকদিকে বাবাকে দেখেছি টেকনিক্যাল ফিল্ড এ হ্যান্ডস অন কাজ করতে , বড় হয়েছি সেইসব দেখে। বাবা চাকরী জীবনের বেশিরভাগটাই DOT এর প্রজেক্ট ডিপার্টমেন্টে কাটিয়েছে।  বাবার অনেক কর্ম কাণ্ডের মধ্যে মাকে না জানিয়ে ৭১ এর warfront এ যাওয়া থেকে , নর্থইস্ট মাইক্রোওয়েভ টাওয়ার বানিয়ে ক্রমাগত যোগাযোগ উন্নত করা , ভুটানের সাথে টেলিকম্যুনিকেশন , দুর্গাপুর , বহরমপুর , পাশকুড়া TV  রীলে স্টেশন বানানো, ভুবনেশ্বর , সম্বলপুর কমিউনিকেশন হাব আর ফাইনালি কমিউনিকেশন এনালগ টু ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন এই সবগল্প শুনেছি    তাই মনে হল ইঞ্জিনিয়ারিং ফিল্ড এর কর্ম জগৎ টা  আমার পরিচিত। তাই ভাবলাম ইলেক্ট্রনিক্স নিয়েই পড়ব , কিন্তু কোটার সুযোগ নিয়েও ইলেক্ট্রনিক্স পেলাম দুর্গাপুর অথবা জলপাইগুড়ি। এদিকে যাদবপুরে শিবপুরে  মেকানিকাল পেলাম, আমাদের সময় যাদবপুর মেকানিকাল খুবই আকাঙ্খিত স্ট্রীম  কারণ চাকরির সুযোগ। কিন্তু যাদবপুর ভাল লাগলো না প্রত্যহ ট্রাভেল করে যাওয়া আসার কথা ভেবে। আর ইলেক্ট্রনিক্সের ছোটো ভাই হবে সেই ভেবে নিলাম ইলেক্ট্রিক্যাল , সেটা  শিবপুরে। কিন্তু কোথায় যেন মনের মধ্যে একটা প্রমান করার ইচ্ছে হত আমিও  খারাপ ছাত্র নই , মনে হত যদি উচ্চমাধ্যমিকে ষ্টার চলে আসে তাহলে আর কেউ ভাববে না যোগ্য ছাত্র না হয়েও কোটার সুযোগে চলে এসেছি। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে সত্তরেই আটকে গেলাম পচাত্তর আর হল না। 

আমার ইঞ্জিনীরিং কলেজ জীবন শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে মণ্ডল কমিশনের আন্দোলন , সেটা একটা কঠিন সময় , সময়টা রাগিং পিরিয়ড এর , যাদবপুরের ঘটনা সামনে আসার পরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কী ধরনের ঘটনা ঘটে তা সবার ড্রয়িং রুমে চলে এসেছে।  এই রকম অবস্থায় জানলাম কাল কলেজ মায়া করে ধর্মতলায় বিক্ষোভ জানানো হবে মণ্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে। এইখানে প্রথম আমি পরিচিত হলাম এই ধরনের গন আন্দোলনে কিভাবে ভেস্টেড ইন্টারেস্ট থেকে পয়সা পাম্প হয়। যেখানে বন্ধুরা মিলে একটা বাস ভাড়া করে পিকনিক করার আয়োজন করতে পয়সা আর পরিশ্রম এর সংস্থান হয় না সেখানে সকাল হতেই একের পর এক বাস দাঁড়িয়ে গেল কলেজের গেটে। আর আমি পড়লাম ধর্মসঙ্কটে , যেই কোটার সুযোগ নিয়ে এই কলেজে এসেছি কোন মুখে তার বিরুদ্ধে স্লোগান দেব। অনেকে গিয়ে জুতো পালিশ করেছে , এবার আমরা করব কী , জুতো পালিশ আবার কী।  কিন্তু আমি সেই বাসে উঠতে পারিনি।  কাউকে বিশ্বাস করে যে এই ব্যাপারে কিছু প্ল্যান করব সেইরকম ভরসা করার মতো কাউকে জানি না , এদিকে যাইনি  ধরা পারলে বাটাম , তাই পালিয়ে সারা দিন একা একা বি গার্ডেন ঘুরে বেড়ালাম আর চোখ রাখলাম সবাই কখন ফেরে , তাদের সঙ্গে হস্টেলে ব্যাক। 

এবার আসি সরকারী বদান্যতায় SC ছাপ নিয়ে কোন প্রতিষ্ঠানের অংশ হওয়া সম্মানজনক তো নয়ই  পদে পদে  অপমানজনক। তিনটে  অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। 

কলেজের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত যে কোন লিস্টে আমার নাম এই রকম দেখেছি   Parthasarathi Mridha ( SC ) । 

কলেজ হস্টেলগুলাতে রুম এলোকেশনে কোন এক অজানা কারণে প্রায় সমস্ত কোটার ছাত্রদের স্থান হয় গ্রাউন্ড ফ্লোর , যেখানে সুযোগ পেলে কেউ থাকতে চায় না। 

কলেজ সোশ্যালএ অন্ধকারের সুযোগে কোটার ছেলেদের বেছে বেছে পেছনে লাথি মারা। 

বাবার ইচ্ছে ছিল যদি আমি IES ক্যাডার হবার চেষ্টা করি , নিজের কর্মক্ষেত্রে IES দের কাজের সুযোগ দেখেই ভাল লেগেছিল। কিন্তু আমি বাবাকে বলেছিলাম, বাবা  আমি সরকারী চাকরীতে যাব না , কারণ গেলে যেই সুযোগ কোটা থেকে পাব তা মন থেকে না চাইলেও  অস্বীকার করতে পারব না। আমার মনে হয় নিজের চেষ্টায় খারাপ কিছু করব না।  সমাজকে সমান করার খাতিরে পাইয়ে দেওয়া সুযোগ সামাজিক  ডিফারেন্সই বেশী তৈরী করে। 

জীবনে সরকারী প্রদত্ত SC সুযোগ খুবই কম নিয়েছি। এই সুযোগ নিয়ে অনেক বক্রোক্তি শুনতে অভ্যস্ত , কিন্তু  সেটা আমার খুবই স্বাভাবিক মনে হয়।  ওই জায়গায় আমি থাকলে আমি হয়তো বা  আরও নেগেটিভলি রিয়েক্ট করতাম।  কিন্তু তার মধ্যেও আমার অনেক বন্ধু বান্ধব , পরিচিত অনেক মানুষ  আর অবশ্যই মাস্টারমশাই দিদিমনি আছেন যারা আমি SC এবং অনেক সরকারী সুবিধার এনটাই টেলেড জেনেও, যেখানে নিজে বা খুব কাছের কেউ ওই সুবিধা না থাকায় স্ট্রাগেল করছে  সেই অবস্থার মধ্যেও  , নিজেদের উদারতায় বুকে টেনে নিয়েছে।  কলেজের সমস্ত অফিসিয়াল লিস্টে নামের পাশে SC  লেখা, অন্ধকারের সুযোগে পেছনে লাথি মেরে চলে যাওয়া, এই রকম কিছু অভিজ্ঞতা র  ঘটনাগুলো ইন্সিগ্নিফিকেন্ট ভাবতে বেশী   প্রচেষ্টা করতে হয় না। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে ,  শূদ্র  হবার জন্য যতনা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সামনে করতে হয়েছে তার থেকে অনেক বেশী বৈষম্য  সহ্য করতে হয়েছে SC র  সুযোগ নেবার জন্য।  কিন্তু আমি SC সুযোগ নিয়েছি জেনেও , এই সিস্টেমের থেকে অনেক  এত ভালবাসা পেয়েছি , আমার কোন অভিযোগ নেই , তাদের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসা আমার কাছে মানুষের নিজের স্বার্থের বাইরে গিয়ে অন্যকে  ভালোবাসার প্রত্যক্ষ উদাহরণ।   সেইগুলো  আমাকে নিজের ভাবনা সমস্ত বিতর্কীত সুবিধার উভয় অবস্থানের  প্রেক্ষাপটে  নিজেকে  এই রকম তৈরী করতে   উৎসাহিত করে।

আজ যদি বলি জীবনের প্রারম্ভের ওই সুযোগ না ব্যবহার করেও নিজের ক্ষমতায়  জীবন চালাতে পারতাম তা হলে সেটা  দ্বিচারিতা হবে। আবার জীবনে যতটুকু কাজের সন্মান পেয়েছি তাতে আমার স্বচেষ্টার কোন অবদান নেই তাও মনেহয়  ঠিক নয়। তবে এটা অনস্বীকার্য আজ যা কিছু করতে পেরেছি তার সূচনাতে ঐ পাইয়ে দেওয়া সুযোগ টা রয়ে গেছে, ব্যক্তিগত ভাবে  সেটা  না থাকলেই বেশী ভাল লাগত.......