ভারতীয় সংস্কৃতিতে জাতিভেদ

হিন্দু সমাজে বা সনাতন ধর্মে জাতিভেদ হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা একটা  অন্ধকার  প্রথা যা দিয়ে বংশানুক্রমে সমাজের একটা বড় অংশকে শোষণ করা হয়েছে  ভারতবর্ষে , এবং আধুনিক সভ্যতার  প্রসারে সদ্য সদ্য তা  বিচারের আলোতে এসেছে  আর এই চেষ্টাতেই তথা কথিত দলিতদের অগ্রগতি শুরু হয়েছে , এই ধারণা কতটা যে ভ্রান্ত তা একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায়।

এটার অর্থ এই নয় ভারতীয় সমাজে কোন যুগে কোন সামাজিক শোষণ ছিল না , সমস্ত সমাজে সর্বকালে দুর্বল মানুষকে চাপিয়ে রাখার প্রবণতা সর্বত্র দর্শিত আর  সর্বজন বিদিত। কিন্তু  তাকে  চতুর্বর্ণের  দোহাই দিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতিকে কলুষিত করার প্রচেষ্টা উদ্দেশ্য প্রণীত বলেই মনে হয়। উদাহরণ হিসাবে আমাদের নিজের পরিবারের ইতিহাস নেওয়া যেতে পারে

আমরা জালিয়া কৈবর্ত সম্প্রদায়ের, আমাদের দেশের দিঘলী গ্রামে, সবাই প্রায় এই সম্প্রদায়ের মানুষ , একসময় পেশাগত ভাবে তারা ছিল জেলে।- যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত।   যাদের সরকারী জাতি বিভাজনে তপশিলি বা scheduled cast হিসাবে গণ্য করা হয় এবং আমরা সমস্ত রকম SC সুবিধার সুযোগ পেতে পারি। তাই নির্দ্বিধায় আমাকে শূদ্র বলা যায়।

এবার আমাদের বংশের পদবী হচ্ছে মৃধা , মৃধা শব্দের উৎস হচ্ছে সংকৃত মৃধ থেকে যার অর্থ যুদ্ধ।  বড়দের কাছে ছোটবেলাতে শুনেছি আমাদের পরিবার অনেক সেনাদলের সাথে লড়াই করেছে।  রাঢ় বাংলায় বর্গী প্রতিরোধেও অংশ নিয়েছে।  এবং পূর্ববঙ্গেও মৃধা বংশ শৌর্যের বংশ হিসাবে পরিচিতি ছিল।  আমাদের লোকে বলতো পাঠা ছিড়া মৃধা। তাদের এমন শক্তি ছিল যে আস্ত পাঠা টেনে ছিড়ে ফেলতে পারার ক্ষমতা ছিল।   তাই আবার বংশ পরিচিতি তে ক্ষত্রিয় বটে।

বাংলা দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আসার সময় আমাদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল কংস  বণিকের।  শুনেছি আমাদের কাঁসা পিতলের বড় কারখানা ছিল তাতে শুধু আমাদের পরিবার নয় গ্রামের অনেক ঘরের জীবিকা নির্বাহ হত। সেই হিসাবে আমাদের  বৈশ্য বলা যায়।

আবার আমাদের পরিবারের মধ্যে সংস্কৃত এবং অধ্যাত্বিকতার যথেষ্ট চর্চা ছিল। বাবা ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় সংস্কৃতে সত্তর  শতাংশ পায়। ছোটবেলা থেকে শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা ইত্যাদির নানা শ্লোকের আর কাহানির  ব্যাখ্যা শুনে শুনে বড় হয়েছি। আমাদের পারিবারিক  আধ্যাত্বিকতার পথ হচ্ছে জ্ঞান মিশ্রিত ভক্তির পথ ,  তাই  বাবা কে গৌড়ীয় ভক্তি যোগেও যেমন দেখেছি কীর্তন করতে করতে অঝরে কাঁদতে , আবার মাকে দেখেছি সাধুকে প্রণাম করে চাইতে , আশীর্বাদ করুন আমি ভগবানকে যেন জানতে পারি। আর এমন অসাধারণ প্রার্থনা শুনে সাধূর চোখে জল। এই ভগবান অনুসন্ধান বা আত্ম অনুসন্ধানের চর্চা যদি ব্রাহ্মণ এর পথ হয় সেই পথও পারিবারিক সূত্রে একদম অচেনা নয়। শুধু  ঐশ্বরিক (ব্রহ্মহ)  চর্চা নয় তার প্রচার এবং বৈচারিক বিতর্কেও অংশ নিতে পিছপা হন নি তাঁরা। তবে পৌরহিত্য কখনো পারিবারিক পেশা ছিল বলে  শুনিনি ।

তাই সময় আর পরিস্থিতির প্রয়োজনে চতুর্বর্ণের যেই বর্ণের কর্মভার এসেছে তাই আমার পরিবার সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছে।   মনে হয় এই রকম কাহিনী শুধু আমার নিজের বংশে সীমাবদ্ধ  নয় , আমরা ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত সমস্ত পরিবারের  ইতিহাস   এইরকমই।  তাই পারিবারিক ইতিহাস দেখে আমার দৃঢ় বিশ্বাস , সনাতন   চতুর্বর্ণের   বংশ পরম্পরায় চলা একটা প্রথা , এই যে ধারণা জনমানসে প্রচলিত তার মধ্যে অসঙ্গতি আছে।

In the contrary , দূর্বলকে সামাজিক অত্যাচারের বাইরে আসার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে তার বিশ্বাস জাগ্রত করা সে দূর্বল নয়।  তাহলে তার জন্য বাইরে থেকে কাউকে ন্যয় করে দিতে হবে না , সে নিজেই  তার জীবন তৈরী  করে নিতে পারবে , ভারতীয় আধ্যাত্বিকতা সেই শিক্ষাই দেয় , তুমি পাপী তাপী দুর্বল নয়........তুমি অমৃতের পুত্র , তোমার মধ্যেই অসীম শক্তি সুপ্ত তাকে জাগ্রত করার বিভিন্ন পথ, প্রকৃতি অনুযায়ী চিনে নেবার দিক দেখানোই  সনাতন ধৰ্ম। সে তো শূদ্র আর ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে  এই কথা বলে যে :

जन्मना जायते शूद्रः संस्कारात् द्विज उच्यते।

शापानुग्रहसामर्थ्यं तथा क्रोधः प्रसन्नता ।|


তাহলে কী করে সে বংশানুক্রমে শোষণ করার একটা সামাজিক ব্যবস্থা হতে পারে ?