আজকাল ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে দেখতে পাই গরু খাওয়াকে উদার মানসিকতার প্রমান হিসাবে দেখানোর একটা প্রবণতা আছে। আমি নব্বইয়ের দশকের থেকে দেশের বাইরে ঘুরছি ,কিন্তু বিফ কখনো খাওয়া একান্ত প্রয়োজন মনে হয় নি। তবে বিফের ব্যাপারে সেইরকম কোন ছুৎমার্গ নেই , অনেক সময়ই এক্সিডেন্টালি পাতে বিফ পরলে ওটা সাইডে রেখে, বাকি খাবার খেয়ে নিয়েছি বেশ তৃপ্তির সঙ্গেই। কিন্তু যেই হেতু আমি ননভেজ খাই কিন্তু বিফ খাই না, তাই অনেক সময় এই ব্যপারে অনেক অভারতীয় র ইনোসেন্ট প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত একটা কারণ শেষে দিচ্ছি, প্রথমে কেন ভারতে হিন্দুরা গরু খায় না তার জাস্টিফিকেশন এইরকম দেই তাদের ।
প্রাচীন ভারতে গরু শুধু গৃহপালিত পশু ছিল না , একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ অংশ ছিল ইকোনমির। সমাজে পরিবারে অংশ ছিল গরুরা, শুধু তাই নয় তারা ছিল পরিবারের ভবিষ্যতের সংস্থানের ( রিসোর্সে প্রোভাইডার ) করার একটা সম্ভাবনা ( অ্যাসেট )। তাই তাকে আজকেই হত্যা করে উদরপূর্তি করা, একরকম অপরিণাম দর্শী ভোগবাদী মানসিকতার পরিচয়। সেই কারণে গরু ভক্ষণ সামাজিক ভাবে সম্মানিত নয়, ভারতীয় সমাজে। গোধন কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার প্রমান যুদ্ধ কথাটার ব্যুৎপত্তির মধ্যে দেখতে পাই...আরও বেশি সংখ্যক গরু থাকার আকাঙ্ক্ষাকেই বলে যুদ্ধ, যেটা বৈদিক লিটারেচারের থেকে পাওয়া ।
আমি একটা কথা সবসময় বলি , যদি কাল থেকে নিজের খাবার প্রাণীকে নিজে মারতে হয় তবে আজকের ৯০% মানুষ এরই নিয়মিত খাদ্যভ্যাস থেকে আমিষ চলে যাবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই । খাদ্যাভ্যাস , ধর্মবিশ্বাস সব বাদ দিয়ে, প্রকৃতি গত ভাবেই মানুষ অন্য প্রাণীকে হত্যা বা কষ্টদেওয়া থেকে বিরত থাকতে চায় । একটা ছোট প্রাণী মারার থেকে , গরুর মত একটা বড় প্রাণীকে হত্যা করে আহার বানানো বা তা করতে দেখা অনেক বেশী বেদনাদায়ক ।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে স্তন্যদায়ীকে মাতার প্রতিরূপ কল্পনা করা হয় , তাই গরুকে মাতা সম্মোধন করা হয় , তাই তাকে মেরে খাওয়াটা অভিপ্রেত নয়।
ভারতে যখন মুসলিম আক্রমণ শুরু হয়, আক্রমণকারীরা প্রকাশ্যে গরু হত্যা খাওয়া যতটা না খাদ্যের প্রযোজনে তার থেকে বেশী ভারতীয় ভাবাবেগে আঘাৎ করার উদ্দেশ্য করত । ভারতের মন্দির ধ্বংসের সঙ্গে গরুর নাড়িভুঁড়ির মালা পড়ানো ছিল (এবং এখনো আছে ) , মূর্তি ভাঙ্গার মতই part of ritual . ওই পন্থাবলাম্বীরা মন্দির আর মূর্তি ভাঙার রিচুয়াল সমস্ত জগৎ জুড়ে চালালেও , গরুর ব্যবহার ভারতের জন্য exclusive . আজও ভারতবর্ষে যখন কোন বিধর্মীকে মুসলমান বানানো হয় , তাকে গরুর মাংস খাওয়ান তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারতে গোমাংস ভক্ষনের বিরূপ মনোভাবের এই সমস্তও কারণ।
এবার ব্যক্তিগত আরেকটা কারণ বলি। আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলে।আমি যদি কিছু প্রমান দেখানোর জন্য গরুর মাংস খাই , কিছু নাবললেও বাবা-মা মনে মনে কষ্ট পেতেন। তাদের অকারণে কষ্ট দিয়ে গরুর মাংস স্বউৎসাহে খেয়ে আমার কোনো কিছু প্রমান করার মত পাইনি ।
লেখাটা শেষ করব একটা সতর্কীকরন দিয়ে , আমিষ গ্রহণ করা বা না করার থেকেও বেশী ভূল এবং বড় অন্যায় , খাদ্যভাসের কারনে মানুষকে বিশেষত নিজের কাছের মানুষদের দূরে সরিয়ে দেবার মানসিকতা , সেটা শুধু অমানবিক নয় ভীষণ ভাবে ধ্বংসাত্বক। জীবিকা আর খাদ্যাভাস এর কারণে দূরে সরিয়ে দেওয়া এক পরিবারের থেকেই জিন্না নামে কেউ বেরিয়ে আসে, সে তার পরিবারের জীবনে প্রবাহে সঙ্গে করে নেয় এমন একটা আদর্শ , তা শুধু তার নিজের পরিবারকেই ধ্বংস করে না ভারতবর্ষের ইতিহাসের স্থান কাল পাত্রে ছেড়ে যায় এক অন্ধকার অধ্যায় ।