.
প্রেমাশ্রয় ও প্র্রশ্রয়ের দৈবী কৌশল
বরিশালের বিশিষ্ট রামায়ণ কীৰ্ত্তনীয়া কবি মুকুন্দ চন্দ্র দাশ। শ্রীশ্রীঠাকুরের মন্ত্রশিষ্য ছিলেন তিনি। পাবনার হিমাইতপুরে ঠাকুরের আশ্রমে প্রায়ই যাতায়াত করতেন। তাঁর বন্ধু বিশিষ্ট কবি হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। পরে সৎসঙ্গে হেমদা নামে সমধিক পরিচিত। হেমদা প্রচুর মদ খেতেন, অনাচারেও নাকি লিপ্ত থাকতেন। মুকুন্দ চন্দ্র দাশ শত চেষ্টা করেও বন্ধুকে ফিরাতে ব্যৰ্থ হয়েছিলেন। মুকুন্দদা হয়তো ভেবেছিলেন, বিশ্ব দুনিয়ায় ভাবান্তর যিনি আনতে সক্ষম, তাঁর সংস্পৰ্শে এলে বন্ধু হেম চন্দ্রের ভাবও পরিবৰ্তন হতে বাধ্য। তা ছাড়া কৃতাৰ্থ হওয়ার উন্মাদনাকে যিনি এক অতিজাগতিক শক্তি দিয়ে আগ্নেয়গিড়ির অগ্নুৎপাতের মত শক্তি সম্পন্ন করে দিতে পারেন, তাঁর কাছে কবি হেমচন্দ্রের আচরণ পরিবৰ্তন করা কোন জটিল বিষয় নয়।
হেমদার বাড়িও বরিশালে। হেমচন্দ্র এলেন পাবনা সৎসঙ্গ আশ্রমে। যেখানে শ্রমের সাথে জ্ঞান আহরণ হয়। শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় তাই-ই আশ্রম। কবি একদিন থাকলেন বন্ধুর সাথে। পরের দিন পাবক পুরুষের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হবে এমনিই বাসনা।
শ্রীশ্রীঠাকুর তীব্র কৰ্মী ছিলেন। তিনি তখন অনন্ত ব্যস্ততার মাঝে একটি রুমে আশ্রমের কৰ্মীদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত। তখন সন্ধ্যার পর মুহূৰ্ত। কবি এলেন,দরজার সামনে উঠানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন, অপেক্ষা করছিলেন কেউ ডাকার। কিন্ত কেউ তাঁকে ডাকছেন না।
কবি মানুষ, বিদ্যার লহরীতো আছে অনেক। বিনীত, কিন্তু দূৰ্বিনীত নন। মানী মানুষ, তাই হাল্কা অভিমান কিছু থাকতেই পারে। কবি তাঁর আগমনী সংবাদ অভিমানের ভাষায় কবিতার ছন্দে বলতে লাগলেন-
"চলিতে চলিতে পথেরি মাঝে
না-হয় প্রদীপ গিয়াছে নিভিয়া-
তাই বলে কেহ কি
লইবে না ডাকি,
সকলে যাইবে চরণে দলিয়া !"
এ যেন মৰ্মস্পৰ্শী আক্ষেপ। জীবন চলার দীৰ্ঘ পথ পরিক্রমায় কোন এক ঘন তমিস্রার মাঝে পথিকের বাতির আলো নিভে যেতেই পারে। তাই বলে পথিককে পথের উপর ফেলে রেখে অন্যরা তার দেহের উপর পা মাড়িয়ে চলে যাবে? কবির আক্ষেপ কি নিতান্তই সমৰ্থনযোগ্য নয়? হ্যাঁ, এই আক্ষেপ শাস্ত্রীয়ভাবেও সমৰ্থনযোগ্য। বৰ্জন নয়, বরণই শাস্ত্রের অনুশাসন। নিগ্রহ নয়, অনুগ্রহ করাই ধৰ্ম।
জাগতিক জীবনে রোগের যেমন চিকিৎসা আছে, আধ্যাত্মিক জীবনের পথেও পাপের চিকিৎসা 'প্রায়শ্চিত্ত' আছে।
কিছুক্ষণ পরেই কে যেন কবিকে ডেকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে আলিঙ্গন করে বুকে টেনে নিতেই তিনি ভ্যাবাচাকা খেয়ে বিস্মিত হয়ে বললেন, ছি ছি-ছি আপনি আমাকে ছুঁয়ে দিলেন ! কত লোক আমাকে ঘৃণা করে তাড়িয়ে দেয়।
অপার প্রেমের আধার শ্রীশ্রীঠাকুর কবিকে দু'বাহু জড়িয়ে বললেন, ''হেমদা ! ডান হাতে ঘা হলে বাম হাত কি ঘৃণা করতে পারে?"
হেমদা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।
বিনীত কণ্ঠে ঠাকুরের কাছে আশ্রমে থাকার অনুমতি চাইলেন, তবে কিছু শৰ্তও জুড়ে দিলেন। শৰ্তগুলো ছিল- কবি আশ্রমে থাকবেন তবে মদ ছাড়তে পারবেন না। আর তাঁকে স্বাধীনতা দিতে হবে।
কাৰ্য-কারণ উৎসের অস্হিত্ব জুড়ে যাঁর দূৰ্বার বিচরণ, তিনি তো কারণানুগ ও সমাধান নিৰ্ণায়ক উত্তর দেবেনই। তাঁর ঐশী কণ্ঠ থেকে ঝড়তে শুরু করল কয়েকটি বেদবাণী সম বাক্য -"এই আশ্রমতো আপনাদের, আর আপনাদের আশ্রমে আপনি থাকবেন,- তাতে অনুমতির কি আছে ?"
তারপর বাকি রইল মদ খাওয়ার অনুমতি, এই অনুমতিতে মাপা ছিল পরমপুরুষের অনুমিত শক্তি। কারণ, ধারণা শক্তি তাঁর চাইতে বেশী কি কারো থাকতে পারে? যিনি সবকিছু ধারণ করে আছেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, "হেমদা! আপনি মদ খাবেন, তা খেতেই পারেন, কিন্তু একটি জিনিষ মনে রাখবেন, মদ যেন আপনাকে না খায়।" আশ্রয় দিলেন আশ্রমের মধ্যমনি যিনি, মদ খাওয়ার প্রশ্রয়ও দিলেন তিনি।
জীবন মানুষের কাছে বড়ই প্রিয়। জীবনকে উপভোগ্য করতে হলে বস্তুর উপর জীবনের আধিপত্য থাকা চাই। বস্তু জীবনের উপর আধিপত্য করলে সে জীবন বস্তুর দাস হয়ে যায়। যেমন ড্রাগসেবী কিছু মানুষ। ড্রাগের কবলে গিয়ে হারিয়ে গেছে কত জীবন, রচিত হয়েছে সন্তানের জন্য মায়ের বিলাপের ইতিহাস, কিন্তু সমাধান আসেনি। অনেক জীবন ফিরে পায়নি তার হারিয়ে যাওয়া সময়। যে জীবনের করণীয় ছিল-কৰ্ম, ভক্তি, স্রষ্টার সাধনা, নাম-ধ্যান, সঙ্গ, স্বাধ্যায় ইত্যাদির অনুশীলন করা, কিন্তু তা না করে সে জীবন ব্যৰ্থ প্রহেলিকায় হারিয়ে যাবে উদ্দেশ্যহীনভাবে; সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ এমনটি হওয়া কামনা করে না।
জীবন রক্ষাৰ্থে মানুষ মানুষকে বাঁচাতে ছুটে যায়। মুকুন্দ চন্দ্র দাসের আকুতিও তাই। পরিবৰ্তনের তরে বন্ধুকে বন্ধুর পথের দিশারীর কাছে নিয়ে এসেছেন। আশ্রমে জন কোলাহলের শেষ নেই। প্রথম পরিচিত হয়ে উঠেছিল পাবনা সৎসঙ্গ নামে। এই সৎসঙ্গের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ও অপপ্রচার করার জন্য একটি চক্র গড়ে উঠেছিল। সহস্র প্রতিকূলতার পাহাড় সৃষ্টি হয়েছিল এই আশ্রমকে ঘিরে, কিন্তু আশ্রমের দরজা ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। শ্রীশ্রীঠাকুর ছিলেন যুগপুরুষোত্তম। বিপাক পথে হাত ধরে মানুষকে সঠিক পথ দেখাতে তিনি এসেছেন মানুষী তনু নিয়ে। তাই তাঁর শ্রীমুখ নিঃসৃত অমৃত বাণী লিখে রাখার জন্য অনেক জ্ঞানী-গুণী তথা লীলাসহচরগণ যেন পূৰ্ব নিৰ্ধারিত হয়ে তাঁর কাছে এসে ভীড় করেছিলেন। তাঁর শ্রীমুখ নিঃসৃত বাণী নিয়ে প্রণীত হলো অনুকূল-সাহিত্য। শুধু তাঁর শ্রীমুখের বাণী নিয়ে শতের কাছাকাছি গ্রন্হ রচিত হল। 'ধৰ্ম'-তাঁর ভাষায় একটি। "ঈশ্বর এক, ধৰ্ম এক, প্রেরিত পুরুষগণ এক বাৰ্তাবাহী।" স্রষ্টা যেহেতু একজন তাই, শ্রীশ্রীঠাকুরের এই মত বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডে এক অনন্য চিরসত্য ও অকাট্য যুক্তির আসন লাভ করল। বহুত্ববাদ ঠুনকো হয়ে গেল। মানবদরদ ছিল তাঁর অপরিসীম। অরুণ দেবের মত। অরুণ দেব চোর, সাধু সবাইকে সমানভাবে আলো দেয়। তাঁর ভালোবাসাও ছিল তেমনই। তাই সবার জন্য আশ্রমের দরজা ছিল উন্মুক্ত। আর তাঁর জীবন ছিল সব সময় বিপরীত মেরুতে। তিনি বলতেন, আমার নাম অনুকূল বটে, কিন্তু আমাকে প্রতিকূলতার পাহাড় কেটে এগুতে হয়েছে।
একদিকে আশ্রম ও শ্রীশ্রীঠাকুরের বিরুদ্ধে কূৎসা রটনা। এই ভার তাঁকে বহন করতে হচ্ছে। অন্যদিকে বিকৃত, বিপৰ্যস্থ মানুষের আশ্রয় প্রাৰ্থনা এবং সেই মানুষগুলোর দুঃখ লাঘবের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও জীবন- ব্যবস্থার সংগ্রাম ইত্যাদিতে পরমপুরুষ বলেই তিনি টিকতে পেরেছিলেন তাঁর সহজাত অপ্রতিরোধ্য শক্তি বলে। বিকৃত, বিপৰ্যস্থ জীবনগুলোর রুচিহীন আচার-আচরণ সৎসঙ্গের বিরুদ্ধে কালিমা লেপনকারীদের জন্য যেন বাড়তি উপাদান ছিল।
এদিকে হেম চন্দ্র মদ খেয়েই চলেছেন, তাঁর আরও কিছু অশোভন আচরণ আশ্রমের বিরুদ্ধে কূৎসা রটনায় সহায়ক হচ্ছিল। অনেক অভিযোগ ঠাকুরের কাছে এল। একদিন ঠাকুর হেমদাকে ডাকলেন, বললেন, "হেমদা ! আপনি দেখতে পাচ্ছেন, আশ্রমে কত গুণী লোক নিত্য আসা যাওয়া করে, কিন্তু এমন কোন কাজ করা ঠিক নয়, যাতে আশ্রমের বদনাম হয়, এই আশ্রমের সুনাম রক্ষা করা আপনারও দায়িত্ব।" শ্রীশ্রীঠাকুর হেমদার জন্য মদ তাঁর ঘরেই এনে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। আনত শিরে হেমদা শুনলেন ঠাকুরে কথা, কিন্তু হেমদার দোষ তো তাঁর প্রবৃত্তির অধীন। ভাবান্তর আসার ক্ষণ এখনও ঘনিয়ে আসেনি। তবে মাইল দুয়েক দূরে শহরে গিয়ে মদ খাওয়ার প্রবণতা কমে আসল। ঠাকুরের নিৰ্দেশে আশ্রমের কম্পাউণ্ডার ভগীরথদা measuring glass এ করে যা তৈরী করে দেন এখন তাতেই তৃপ্তি। একদিন ঠাকুরের গায়ের উপর বমি করে দিলেন মদ। শ্রীশ্রীঠাকুর শিশুর মত হেমদার শরীর মুছে দিলেন। কিছুদিন এভাবে চলল। একদিন ঠাকুর তাঁর কাছেই মদ এনে রেখেছেন। হেমদা ঠাকুরের কাছে চলে এলেন। বিড়াল যেমন শুটকীর পানে ছুটে যায়। শ্রীশ্রীঠাকুর একটু অদূরে গিয়ে মদের বোতলটিকে অতি আপনজনের মত চুমু খাচ্ছিলেন। হেমদা তাকিয়ে দেখছিলেন। হেমদার মনে দ্বন্ধ উপস্থিত হল। মদ ছাড়তে হবে, মতও পরিবৰ্তন করতে হবে। একদিকে মদের প্রতি তীব্র আসক্তি, অন্যদিকে শত সহস্র মানুষের প্রণম্য দেবতা ঠাকুর। তাঁকে উপেক্ষা করে মদ খাওয়া। আরও ভাবলেন, কত লোক আমাকে মনে মনে ঘৃণা করে অথচ ঠাকুর আমাকে এত ভালোবাসেন, আমার ঘৃণ্য আচরণে, সবার বদনামে যাঁর কোন দুঃখ নেই, যিনি অবারিত ঝৰ্ণা ধারার মত ভালোবাসা বিলিয়েই যাচ্ছেন, এই দুইয়ের সমীকরণ করতে হবে। আন্দোলিত হয়ে উঠা ঢেউ কি আর থামে? পরমপুরুষ পারেন না এমন কিছু কি আছে? এই চুমু অনেক আগে দিয়েইতো মদ খাওয়া বারণ করাতে পারতেন, কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুরের আপ্ত দৃষ্টিতে ত্যাগবাদের সংজ্ঞা যে ভিন্নতর। তিনি শরীর সাজানোর চাইতে মন সাজানোর রুঢ় বাস্তব সত্যপথের শিক্ষা দিতেই যে এবার এসেছেন নকলনবিসিপনা ও মিথ্যাবাদীতার যুগে৷ তিনি বাস্তব ত্যাগ সম্পৰ্কে বলতেন, "ভোগের দ্রব্য সন্মুখে রাখিয়া ত্যাগের নামই ত্যাগ।" জোর পূৰ্বক ত্যাগ হলে তা আবার ফিরে আসতে পারে। কমন্ডুল নিলাম, বাসনা মনে রেখে দিলাম- এই তাঁর দৰ্শন নয়।
কবি মহোদয়ের ভাবান্তরের দিন ঘনিয়ে আসল। মনে মনে ভাবলেন, না, আমি তাঁকে উপেক্ষা করতে পারি না, যাঁকে কেন্দ্র করে এত মানুষের সমাগম আর আমি সেই পথে না গিয়ে মাতলামি, অস্থিরতা, সেন্ট্রাল নাৰ্ভাস সিষ্টেম ইত্যাদিতে ডুবে থাকব, না, তা হতে পারে না।
দুই এক দিন পরে হেমদা আশ্রমের ডিস্পেনসরিতে গিয়ে ভগীরথদাকে বললেন, ভগীরথ! মদের বোতলটা দেও। ভগীরথদা এগিয়ে দিলেন। হেমদা বোতলটি হাতে নিয়ে বোতলটিকে ভালো করে দেখে নিলেন।
চেতনা এবার দিয়েছে দোলা হৃদয়ের কোলে। মাথায় ঠেকালেন মদের বোতল, বললেন-'জয়গুরু', আজ তোমাকে চিরদিনের মত বিদায় দিলাম।'- এই বলে বোতলটি সজোরে নিক্ষেপ করলেন ডিস্পেনসরির ফ্লোরে। মদ ছেড়ে দিলেন জীবনের তরে, মতও পরিবৰ্তন করলেন।
এদিকে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। হেমদা যখন ডিস্পেনসরিতে গিয়ে মদের বোতলটি কপালে ঠেকিয়ে 'জয়গরু' বললেন, তখন শ্রীশ্রীঠাকুর কতিপয় ভক্তের সঙ্গে পাশে একটি ভবনে আলোচনায় নিমগ্ন। ভক্তেরা দেখতে পেলেন, হঠাৎ ঠাকুরের শরীর থেকে মদের গন্ধ বেরুচ্ছে এবং তাঁর শরীর থেকে ঘাম বেরুচ্ছে মদের মত। ভক্তেরা হতবাক। ভক্তেরা ঠাকুরকে বললেন, ঠাকুর! আপনিত আমাদের সামনে উপবিষ্ট, কিন্ত আপনার শরীর যে ঘেমে যাচ্ছে এবং গন্ধ বেরুচ্ছে।
বিনীত স্বরে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, 'তা-তো কবের পারি না। তব মদের গন্ধতো বেরুচ্ছে। নিজেকে অসহায় বোধ করে বললেন, 'আজ আশ্রমে ভদ্র লোকেরা আসবেন, তোরা কি তাদের কবি না, তোদের ঠাকুর মদ খায়? আমি কি করি বল, আমাকে যদি কেউ নিবেদন করে, আমি কি তা গ্রহণ না করে পারি?'
আলোচনা থেকে উঠে ডিস্পেনসরিতে গিয়ে একজন দেখতে পেলেন হেমদার ঘটনা। তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরকে নিবেদন করে বহুদিনের প্রিয় পানীয় জীবনের তরে পরিত্যাগ করার ইস্পাত কঠিণ শপথ নিয়ে আত্মসন্মান বোধের তুষাণলে জ্বলে চেতনার মৰ্মমূল থেকে ধ্বনিত হওয়া 'জয়গুরু' বলে বোতল ছুঁড়ে দিয়েছেন খানিক আগেই।
পরমপুরুষের ঐশী কৌশল ভাবান্তর এনে দিল কবি হেম চন্দ্রের জীবনে। আশ্রমে থাকার অনুমতি, মদ খাওয়ার নিয়ম-নীতি মস্তিষ্কের কোষে কোষে বারবার অনুরণিত হচ্ছিল-'মদ যেন আপনাকে না খায়।' প্রবৃত্তি বা মোহ (খাওয়ার আসক্তি) বা কামনাকে জয় করার শিক্ষা পেলেন কবি। অপরদিকে বস্তুর অধীন না হওয়ার শিক্ষাও পেল বস্তুময় দুনিয়ার অগনিত মানুষ। আশ্রমে মেলার আওয়াজ ধ্বনিত হলো হেমদা মদ ছেড়ে দিয়েছেন বলে। মানুষ বড়, প্রবৃত্তি বা কামনা ছোট। আমি মানুষ, আমি বস্তুর অধীন নই, বস্তু আমার অধীন হোক। জ্ঞানী হেমদা সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠলেন আবার, যে শ্রদ্ধা তিনি হারিয়েছিলেন।
**নোটঃ- (প্রয়োজনের তাগীদে যা জরুরী তা কামনামুখীনতা নয়। ক্ষেত্র বিশেষে কোথাও বিশেষ খাদ্য বা পানীয় প্রয়োজন হলে তাতে শ্রীশ্রীঠাকুর সন্মতি দিয়েছেন। তবে বস্তু যেন ভোক্তাকে গ্রাস না করে। আমরা দেখতে পাই পরিবারের বৃদ্ধ লোকেরা আফিম খেতেন। আফিম তো একটি ড্রাগ, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত আফিম ড্রাগের প্রতি আসক্তির পৰ্যায়ে পড়ে।)
শেষে আশ্রমে একদিন কবির কণ্ঠে স্বীয় কাব্যের সুরে গুরুর জয় জয়কার ধ্বনিত হলো - " হে মোর জীবন সাথী চির প্রেমময়,
বিশ্বে শুধু তুমি মোরে দিয়েছ প্রশ্রয়,
তাই তুমি সকলের বড়। সুকৌশলে
অনুগ্রহ-দীন, তুচ্ছ আশ্রয়ের ছলে
করণি লাঞ্ছিত এই উৎকেন্দ্র হৃদয়,
উচ্ছৃঙ্খল চিত্তে তাই ভরি উঠে জয়।
আমার সকল ভাবে সদা অনুকূল
এতকাল খুঁজে খুঁজে ভাঙ্গিয়াছে ভুল।"
নোট-শ্রীশ্রীঠাকুরের মাঝে যা কিছু ঘটেছে তা সাধারণের কাছে অলৌকিক মনে হলেও শ্রীশ্রীঠাকুর এর চাইতে আরও আশ্চৰ্যজনক ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মানুষকে বার বার, লক্ষ বার বলেছেন, ' তুমি কর, হও, পাও।' তাঁর কথায়, কেউ ভগবান হলে তাতে তোমার কি? তিনি বলেছেন, সবাইকে ভগবান হয়ে উঠতে, সবার ভিতর ঠাকুরত্ব (ঈশ্বরত্ব অৰ্থে) জাগ্রত করতে। তখনই সবার জীবনে ঈশ্বরত্ব জাগ্রত হয়ে উঠবে। মোক্ষানুভূতি, নিৰ্বানানুভূতি, ফানাফিল্লাহ্ অনুভূতি তখনই বোধে ধরা দেবে। মানুষই সাধনা করে ঈশ্বরত্ব অৰ্জন করে ঈশ্বর বা স্রষ্টাতে বিলীন হয়। স্রষ্টা মানুষে বিলীন হয় না। ঠাকুরত্ব তথা ঈশ্বরত্ব জাগ্রত না হলে কেউ আমার বা আমাদের কেন্দ্র নয়। যা শ্রীশ্রীঠাকুরই করুণা করে বলে দিয়েছেন।