মানুষের সঠিক বাঁচা বাড়ার জন্যে অস্থিত্বের চারি স্তম্ভ অপরিহাৰ্য বিধান। পরমপুরুষ কৰ্তৃক প্রদত্ত বিধানগুলো হল কৃষি, শিল্প, শিক্ষা ও সুবিবাহ। প্রতিটি বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে।
Please also see the details at * The meaning of being and becoming.
&
Divine Gallery & theological advice
এবং * Actualization of Four Pillars
তবে তার সাথে জীবন বাঁচাতে আরও জরুরী পাঁচটি বিধান দিয়েছেন, সেগুলো হল -
১)যজন
২)যাজন
৩)ইষ্টভৃতি
৪)স্বস্ত্যয়নী ও
৫)সদাচার
*যজন -শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় যজন মানে-
" ইষ্টপ্রাণতার সহিত কায়মনোবাক্যে
বাঁচাবাড়ার রীতিনীতিগুলোকে
যথোচিত পরিপালন করতঃ
নিজেকে উন্নত চলনায় নিয়ন্ত্রিত করা।"
(পথের কড়ি)
অনেকের কাছে 'যজন' নতুন উচ্চারিত শব্দ মনে হয়। না, তা সঠিক নয়। ভগবান শ্রীকৃঞ্চ বলেছেন, " আমার যাজন কর, আমার ভক্ত হও। " দ্রঃ-মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদযাজী মাং . . . . . . " যজন ব্যাপারটিতে বাঁচা বাড়ার রীতিনীতিগুলি পরিপালনের বিষয় জড়িত। সুতরাং অন্যকে বাঁচা বাড়ায় সহযোগীতা না করে শুধু জ্ঞান আহরণ ও বই মুখস্ত করাকেই যজন বলে যে ধারনা প্রচলিত আছে তা সঠিক নয়।
শুরুতেই শ্রীশ্রীঠাকুর আরও বললেন 'ইষ্ট প্রাণতার সহিত' করতে হবে। ইষ্টপ্রাণতা মানে ইষ্টের নিৰ্দেশ মত চলে তাঁর মন মত হয়ে উঠা। যেমন তিনি বলেছেন সমবেত ও নিত্য সন্ধ্যা প্রাৰ্থনা থেকে বিরত না হতে, ব্যষ্টি সহ পরিবেশের পালন পোষণ করতে, এমনিভাবে আরও অনেক কিছু করতে বলেছেন। তাই যজনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বিষয় জড়িত রয়েছে। তবে প্রধান বিষয় হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করলে বলা যায়- নাম, ধ্যান, সঙ্গ ও স্বাধ্যায়। জ্ঞান, কৰ্ম, গবেষণা, ভক্তি ইত্যাদি এই চারটি বিষয়ের মধ্যে নিহিত রয়েছে। আমরা জানি, ধ্যানের মধ্যে কৰ্ম রয়েছে। প্রবীন প্রবুদ্ধ ঋত্বিক শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রবোধ চন্দ্র মিত্র তাঁর একটি বইতে লিখেছেন-উল্লেখিত চারটি বিষয় যজনের অঙ্গ। যজন সম্পৰ্কে কমপক্ষে দশজনের লেখা পড়েছি, জেনেছি। মূল কথা একই।
তবে যজনের মধ্যে কৰ্ম থাকতেই হবে। ধ্যানের মধ্যে যে কৰ্ম আছে তা শ্রীশ্রীঠাকুরের ভক্তেরা তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থ থেকেই হয়তো জেনে থাকবেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় - "ধ্যান মানে হলো অনুরাগমুখর ইষ্টচিন্তন; ইষ্টস্বাৰ্থ ও ইষ্টপ্রতিষ্ঠার পরিপোষক করে ভিতরে বাইরের যা কিছুর নিয়ন্ত্রণ, সামঞ্জস্য ও সমাধানের বুদ্ধি স্থিরীকরণ। ওভাবে চিন্তা করে বুদ্ধি স্থির করে কাজেও তা করা চাই। তাতেই হয় ধ্যান সাৰ্থক, চরিত্রের ইষ্টানুগ বিন্যাসও হয় ওতে করেই। ......"
তাই যাঁর ধ্যান করবেন, তিনি আচাৰ্য্য(আচরণশীল) হতে হবে, কারণ তাঁর আচরণকৃত ও পরীক্ষিত বিষয়গুলো নিৰ্ভুল, এইজন্যে পরম পুরুষদের আপ্তপুরুষ বলা হয়। নিৰ্ভুল পুরুষের জীবনের কৰ্মগুলোকে বাস্তবে রুপ দিতে হবে, তখন ভক্ত নিজেও আচরণশীল হয়ে উঠবেন। এই কৰ্মসমম্বিত ধ্যানই প্রকৃত ধ্যান। এইভাবে প্রচেষ্টা ক্রমাগতভাবে তীব্রগতিতে এগিয়ে নেওয়ার ফলে ভক্তের হৃদয়ে ধীরে ধীরে ঠাকুরত্ব জাগ্রত হয়ে উঠবে, বৃত্তিভেদী বা কামনাভেদী টান সৃষ্টি হতে থাকবে। কামনাভেদী টান পাকা হলেই ভক্ত যোগক্ষেমরহিত হওয়ার পথে যাত্রা করার প্রাথমিক পদে উন্নীত হতে পারবে। বৃত্তি বা আসক্তি বা কামনা অভিভূতি থেকে মন আস্তে আস্তে উঠে আসবে। কামনা অভিভূতি থেকে মনের সম্পূৰ্ণ ত্রাণ বা মুক্তি হলেই মোক্ষের পথে শিশুর জীবন শুরু মাত্র। এসব শুধু আমার কথা নয়। শাস্ত্রের বচনও তাই। শ্রীশ্রীঠাকুর 'কথা প্রসঙ্গে' গ্রন্থে 'বৃত্তি' কে রিপুও বলেছেন। বৃত্তির আভিধানিক অৰ্থ- পেশা, Stipend, প্রশিক্ষণ, কামনা বা ইচ্ছা ইত্যাদি। পূ্জ্য সিদ্ধ পুরুষ শ্রী বামাক্ষেপা রিপুর সঙ্গে সন্নিবেশিত কিছু অবগুণকে মোট ১২টি নামে অভিহিত করে দ্বাদশ বৃত্তি নাম দিয়েছেন। তাই বৃত্তি মানে মোহ বা কামনা বা ষড় রিপু বা আসক্তি ইত্যাদি বলেও বুঝে নিতে পারি। শ্রীশ্রীঠাকুরের কথায় মুক্তি -" . . . . . . . মুক্তি মানেই হচ্ছে এই-ঐ বৃত্তিদের ধাঁধাঁ থেকে একদম রেহাই করে তাদিগকে যখন ইষ্টস্বাৰ্থে স্বাৰ্থবান করে ভোগ করা যায়-তাই। আর মানুষের যখন এই মুক্তি সত্যিকার হয়ে চরিত্রে আবিৰ্ভূত হয়, তখনই শুরু হয় তার অনন্তের পথে অসীম ভগবানে সাৰ্থক চলনা।
"আৰ্য্য ঋষিরা চিরদিনই এই মুক্তিকে মুক্ত বলে আখ্যা দিয়েছেন। মানুষ মুক্ত হলে কাঠ-পাথর হয়ে যায় না-বরং সম্পূৰ্ণরুপে পটু, দক্ষ, কৰ্মক্ষম হয়ে ওঠে।" {কথা প্রসঙ্গে, ১ম খণ্ড, ২য় অধ্যায়, পৃ-৪৮ }
ধ্যান-
সঙ্গ-
স্বাধ্যায়-
উক্ত বিষয়গুলোর মধ্যেই যজনের সবটুকু রয়েছে। এসব পরিপালিত হলেই নিজের যজনটা হবে। যজন না হলে অন্যকে যাজন করা যায় না। এই বিষয়গুলো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের মত।
অধ্যাত্মবিজ্ঞানও একটি বিশাল Subject. এর রয়েছে অনন্ত শাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর পড়লে সাৰ্টিফিকেট পাওয়া যায়। অথচ যুগ-পুরুষোত্তমের দৰ্শন নিয়ে সারাজীবন গবেষণা করলেও সাৰ্টিফিকেট দেবার বা পাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তাই বলে গবেষণা বন্ধ রাখা যাবে না। এগুলো ছাড়া ক্লাব করা যায়, কিন্তু ঠাকুরের মন্দির বা আশ্রম পরিচালনা করা সমীচিন নয়। কেননা ঐ নেতা নিজের মন মত হিসাবে ও চালাকী মিশ্রিত করে চালাতে গিয়ে সেখানে জগাখিছুরী করে দিচ্ছেন, ফলে মন্দাকীনির পুণ্য ধারা শুকিয়ে সাহারা মরুর পাথরে পরিণত হচ্ছে। পরিশেষে সেটা ক্লাবও হচ্ছে না, মন্দির বা আশ্রমও হচ্ছে না। ফলে সত্তার সম্বৰ্ধনার জন্যে পরম পুরুষের ঐশী আৰ্তনাদ আমাদের দ্বারে উপেক্ষিত হচ্ছে।(দেব ভিক্ষা বাণী দ্রষ্টব্য।)
স্বামীজী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "..... ধৰ্ম কি আর ভারতে আছে দাদা ? কে ধৰ্মের আদর করে ? স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুস্থানে কি আছে?" ধৰ্ম বিষয়ক কাৰ্যক্রম পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট জ্ঞান থাকা আবশ্যক। প্রতিটি প্রফেশনাল কৰ্মের মত। অন্যথায় ধৰ্মের সঠিক বিষয়গুলো বাদ পরে যাওয়ার ফলে সমাজ বঞ্চিত হবে। কোন কোন জায়গায় দেখা যায় প্রাসঙ্গিক বিষয়ে জ্ঞান নেই, অথচ পদ ধরে রেখেছে। কাউকে কিছু করতে দেয় না। অনেকে জ্ঞান থাকার পরও কৰ্মে রুপ দিতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে, আর যারা জানেই না তারা কি করতে পারবে তা বলাই বাহুল্য।
*যাজন- যাজন মানে হচ্ছে -
বাক্যে, সেবা, সহানুভূতি ইত্যাদির সহিত
মানুষের অন্তঃকরণে ইষ্টপ্রাণতাকে সঞ্চারিত করিয়া
তাদের দৈনন্দিন জীবনে যাহাতে
বাঁচাবাড়ার রীতিনীতিগুলি পরিপালন করতঃ
তাহারা উন্নতিমুখর হয়
তা-ই করা। পথের কড়ি বাণী নং-২৪২
প্রিয় পাঠক ! দেখুন, যাজনের মধ্যেও বাঁচাবাড়ার রীতিনীতিগুলি পরিপালনের নিৰ্দেশ রয়েছে। অথচ অনেক গুরুভাই বলেন- যাজন মানে অন্যকে জানানো বা প্রচার করা। যাজন কথাটি শুধু শ্রীশ্রীঠাকুরের নয়। গীতায়ও যুগাবতার শ্রীকৃষ্ণ যাজন করতে বলেছেন।
যাজন করতে গিয়ে যারা শুধু জ্ঞানের কথা বলেন, অথচ বাঁচা বাড়া ও সেবায় পাথরের মত শক্ত, কৰ্মে বাস্তবায়ন নেই, শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁদের তরে বললেন-
যাজন সেবায় দান প্রবৃত্তি প্রেষ্ঠ-প্রেমের মুখোশ পরে
উথলে যদি উঠলো না হামবড়ায়ের প্রতিষ্ঠায়
নিরৰ্থক সে যাজন সেবা যাজন তখন করতে থাকিস
অভাব কারো ঘুচলো না। প্রিয়ের যাজন নাই সেথায়।
যথাৰ্থ বাঁচা-বাড়াই শ্রেষ্ঠ ধৰ্ম। কেন ? কেন যুগাবতার,পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বললেন, যারা যজ্ঞ করে মানুষকে খাওয়াই না - তারা চোর, যারা যজ্ঞ রহিত তারা পাপান্ন ভক্ষণ করে। নানারকম দান-যজ্ঞ সহ আঠার রকম যজ্ঞের কথা গীতায় উল্লেখ রয়েছে। পবিত্র বেদেও যজ্ঞের কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ রয়েছে, কিন্ত হিন্দুদের বিশাল অংশ (সবাই নয়) ও সমাজের অন্যান্য অংশ আত্মস্বাৰ্থপরায়ন বিধায় কৃষ্টি, ধৰ্ম, সম্প্রদায় আজ অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্তে। তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে বিকৃতি, অনুষ্ঠানসৰ্বস্যতা, সংগঠন মুখীনতা ও বিভিন্নমুখী স্বেচ্ছাচার। ছোট ছোট লোকজনেরা বলে দুলহাজারা ও চন্দ্রঘোনা মিশনারী হসপিটাল ও মাদ্রাজ মিসনারী হসপিটাল ভালো। আর সামৰ্থ্যবান লোকেরা বাইরে চলে যায়। তাহলে নিজেদের কি আছে? নিজেদের আছে শুধু - "সংগ্রাম চলবে"। রাষ্ট্রকে বা একে অন্যকে দায়ী করলে করতে পারেন, কিন্তু নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে সবার আগে। সরকার বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাচ্ছেন এবং বাধার ভিতর দিয়েও সরকার গণহিতকর প্রকল্প হাতে নিচ্ছে, যা অনস্বীকাৰ্য। তবে দরিদ্র জনগোষ্টীর জন্য সমাজের দায় ধৰ্মে নিৰ্দিষ্ট করে দিয়েছে যা পালন করা হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম শহরের বাসিন্দা। ১৫/১৬ বছর আগের ঘটনা। আমার নিজ চোখে দেখেছি অভাবের তাড়নায় মানুষের করুণ চিত্র। এক বছরের ছোট্টশিশু (ছেলে) কোলে। মা গৃহিনী। বাবা ব্যাংকের পিয়ন। এক সপ্তাহে বেতনের টাকা শেষ। তিনটি শিশু সন্তান তাদের। মা টি দু'দিন পর অপরাহ্নে দুটো ভাত খাচ্ছেন তা ও পান্তা ভাত। লবণ দিয়ে খাচ্ছেন। পাশের ঘরের একজন দিয়েছেন, তার পরিবারের ডেক-কড়াই ধুয়ে দেয়ার বিনিময়ে। ছোট্ট শিশুটি মায়ের দুধ এবং পাওডার দুধ দুটো থেকেই বঞ্চিত। আমি তাদেরকে বলতে পারিনি সেদিন, যাও, তোমরা অমুক প্রতিষ্ঠানে যাও। বিধাতার কি বিচার! দুই বোনের মধ্যে ৩য় শ্রেণীতে পড়া মেঝ মেয়েটি গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারালো। আমাদের সাহায্য ছিল মরুভূমিতে এক পেয়ালা জল ঢালার মত।
উক্ত ঘটনাগুলো মানুষ যে জানে না তা নয়, কিন্তু মানুষের মধ্যে হাত বাড়িয়ে দেয়ার চৰ্চা নেই। দান যজ্ঞ উঠে গেছে। এগুলো একদিন, একমাস, একবছর এবং সমাজের একজন দু'জনে করলে হবে না। শাস্ত্রের বিধান বলছে,- সবাইকে নিত্য করে যেতে হবে।
বৰ্ষীয়ান কবি শ্রদ্ধেয় নিৰ্মলেন্দু গুণ একদিন ATN বাংলায় বলেছেন, "....... হিন্দুদের মধ্যে স্ব-সম্প্রদায়কে সাহায্য করার ধারা চালু নেই, অন্যদের থেকে তারা তা শিখতে পারে।" নোট:বক্তব্যটি প্রায়ই উক্তরুপ ছিল।
সেদিন চিড়ির বন্দর, দিনাজপুরে দুইদিন না খেয়ে থাকল কিছু লোক। নিজ সম্প্রদায়ের কেউ এগিয়ে আসতে পারেনি। বড় বড় ধৰ্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ফাণ্ড থাকা দরকার নয় কি?
সেদিন যশোর থেকে প্রশান্ত মন্ডল নামে একজন ATN বাংলার live অনুষ্ঠানে বলল এবং বিশ্বব্যাপী প্রায় দেশেই লোকজন শুনল, "আমাদের ধনী লোকেরা কোথায় ............. আমাদের তো কিছুই নেই।" এসব অনাকাঙ্খিত ঘটনায় সাহায্যের জন্য প্রস্তুতি দরকার। উন্নত দেশগুলোর অভ্যন্তরে এই ধরনের সমস্যা নেই বললেই চলে, অথচ তাঁরা বাইরের সমস্যার জন্য সাহায্য নিয়ে প্রস্তুত। ধৰ্মগুরুরা এসব ব্যাপারে নিৰ্দেশনা দিয়েছেন এবং আমাদের কৰ্তব্য বলে ধৰ্মানুশাসনে বলেছেন। এইগুলো কাউকে দায়ী করে পিছু আসার বিষয় নয়।
চলবে-