"মানুষ অভ্যাসের দাস"
শ্রীশ্রীঠাকুর মানুষ ও তার শক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছেন, অভ্যাসকে নয়।মানুষ প্রধান এবং ই্চ্ছাশক্তিরও উপরে, ইচ্ছাশক্তি যা পরিণতিতে অভ্যাসে গড়ায় তা মানুষের উপরে নয়। মানুষ ইচ্ছাশক্তি তথা অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করে। অভ্যাস বা ইচ্ছাশক্তি মানুষের নিয়ন্ত্রক নয়। মানুষই অভ্যাস বা ইচ্ছাশক্তির নিয়ন্ত্রক। ইন্দ্রিয় মানুষকে জয় করে না। মানুষ ইন্দ্রিয়কে জয় করে জিতেন্দ্রিয় হয়।
তাই চিরাচরিত প্রবাদ- 'মানুষ অভ্যাসের দাস' বাক্যটি শ্রীশ্রীঠাকুর সংশোধন করে বললেন- 'অভ্যাস মানুষের দাস।' Drug 'সেবন করা' ব্যাপারটি মানুষকেই বন্ধ করতে হয়। বন্ধ করাটা নিৰ্ভর করছে মানুষের উপর। সেবন করার ইচ্ছা মানুষই তৈরী করে, মানুষই ইচ্ছা তথা অভ্যাসের নিয়ন্ত্রক। Drug নয়, মানুষই ইচ্ছার মালিক। মানুষ কোথাও যাবে, না যাবে বা খাবে, না খাবে, তার সিদ্ধান্ত নেয়ার কৰ্তা মানুষ নিজে। Drug নিজে কখনও বন্ধ হয় না, তার সে ক্ষমতা নেই। মানুষ ধীরে ধীরে অভ্যাস করে Drug ত্যাগ করে। তাই মানুষ অভ্যাসের অধীন নয়, অভ্যাসই মানুষের অধীন। সুতরাং "অভ্যাস মানুষের দাস।"
"রাখে হরি মারে কে"
মানুষ যদি ঈশ্বরকে(Almighty supreme spirit)ভুলে থাকেন, তিনি কি অনায়াসে এসে ধরা দেবেন? না, তা হয় না। তাই ভক্তের মনে, ধ্যানে সব সময় ঈশ্বরকে রাখতে হয়। 'যত্র-যত্র নেত্র পড়ে, তত্র-তত্র ভগবান(ঈশ্বর অৰ্থে) স্ফুরে'- এই ভাবনায় ভক্ত নিরত থাকেন সারাক্ষণ। আর ভক্ত ভগবানকে (ঈশ্বর অৰ্থে) এইভাবে মনে রাখে বলেই ভগবান ভক্তকে রক্ষা করেন। তাই পরমপুরুষ এবার ধরণীতে এসে আমাদের ভুল সংশোধন করলেন। 'রাখে হরি মারে কে' কথাটির অৰ্থ বুঝিয়ে তিনি আমাদের সংবিৎ ফিরাতে সাহায্য করলেন। তিনি বললেন, 'যিনি হরিকে রাখেন, তাকে কেউ মারতে পারে না।' এইটিই 'রাখে হরি মারে কে'- কথার অৰ্থ। ঈশ্বর রাখেন, তা ঠিক আছে। তবে, ঈশ্বর তাকেই রাখেন, যিনি ঈশ্বরকে রাখেন। অন্যথায় সবাইকে রাখার প্রশ্ন আসে। তার সাথে এই প্রশ্নও আসে, তাহলে সবার রক্ষা হচ্ছে না কেন? ইহ জন্মের বা জন্ম-জন্মান্তরের কোন না কোন পুণ্যের বলে মানুষ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে বা কেউ সাহায্য করে ফিরতে। ঐ পুণ্য কৰ্মযুক্ত সাধনা করাটিই হল ঈশ্বরকে রাখা। হরি রাখলে তাহলে যুদ্ধ বিগ্রহে নিষ্পাপ মানুষ ও শিশুরা কেন রক্ষিত হয় না? এই প্রাণহত্যা হরির বিরুদ্ধে যায়। এই জন্য যুদ্ধে রাজার পাপ পুণ্যের ফলে রাজ্যের উন্নতি, অবনতি নিৰ্ভর করে। কারণ রাজা হরির নীতি বিরুদ্ধ কাজ করছেন। তাই কথায় আছে- 'রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায় . . . . . . ।' তাই জ্ঞানী রাজারা অবধারিত যুদ্ধেও বেসামরিক লোক হত্যা না করার চেষ্টা করেন। অৰ্থাৎ জ্ঞানী রাজাও অন্যায় কমিয়ে হরিকে রাখার মাধ্যমে নিস্পাপ প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করেন। নিষ্পাপ প্রাণহত্যা ঘটলেই পাপাক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরী হয়, যা হরির বিরুদ্ধে যায় এবং এই পাপের ফল তার জন্যে অপেক্ষা করে এবং কোন না কোন একসময় তা ভোগ করে- ঐ গান্ধারীর মত।
দীৰ্ঘ দিনের পাপে ভারাক্রান্ত এই পৃথিবীকে নিয়ে গান রচনা করেছেন শ্রীশ্রীঠাকুরের অৰ্জুন পদাৰ্থ বিজ্ঞানী(কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) শ্রী কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচাৰ্য্য-
". . . . . . . .
হাজার হাজার বছর ধরিয়া
গুমরি গুমরি পাপ বিধান
বিশ্ব-মানব সমাজ রাষ্ট্র
জীৰ্ণ করিল ভাঙ্গি খান-খান
. . . . . . . . . . . . . । "
কিছু দিন পূৰ্বে আমার এক বন্ধু বলল, ভূমিকম্পে বহু বছরের পুরাতন বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ে বহু লোক হতাহত হয়েছে। কিন্তু পাঁচ বছরের একটি শিশু ধ্বংস স্তুপের মধ্যে থেকেও বেঁচে গেল এবং তার শরীরে কোন আঘাত লাগেনি। বন্ধু আরও বলল, এরকম সংবাদ আমরা দেখে থাকি, এটা কি হরির মাধ্যমে রক্ষা পাওয়া নয়? তখন বন্ধুকে বললাম, ঐ ধ্বসে পড়া বিল্ডিংয়ের মধ্যে আরও দশ বারটি শিশু ছিল, তাদের মধ্যে অনেকে মারা গেল এবং কিছু জখম হল। তাহলে ঐ শিশুরা রক্ষা পেল না কেন? একটি শিশু কোন না কোন কারণে হয়তো রক্ষা পেয়েছে। তাই বলে তাকে হরি রক্ষা করেছে, বাকীদের করেনি তা কি ঠিক? অন্য একজন বন্ধু বলল, ঐ বিল্ডিংয়ে থাকাটাই ছিল সবার বেকুবী। কারণ হরি বলেছেন, চতুর হতে, বেকুব হতে নয় এবং এটা বলাও আছে, যে জন কৃষ্ণ ভজে সে বড় চতুর। আর ভজন মানে হরির চলনে চলা এবং তাতেই হরিকে রাখা হয়। তখনই সবাই রক্ষা পায়।
যেমন আট ও নয় মাত্রার ভূমিকম্প ভয়াবহ ও শক্তিশালী। অথচ জাপানে নাকি হরদম সাত/আট মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এই কম্পন মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু জাপানীরা চতুর বিধায় কম্পন সহনীয় একাধিক প্রযুক্তির জ্ঞান ব্যবহার করে ভবন নিৰ্মান করেছে। চতুর বা জ্ঞানী হয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারাই হলো হরিকে রাখা। আর আমরা যেহেতু হরি থেকে জাত, তাই সেই সৃষ্টি লগ্ন থেকে ধাপে ধাপে জ্ঞানাৰ্জন করার শক্তি হরি আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন। ধাপে ধাপে করেছেন কারণ, যেমন ভাবা যেতে পারে এক সময় দুনিয়াতে কাগজ ছিল না, কাপড় ছিল না, কম্পিউটার ছিল না, চিকিৎসা ছিল না। কাগজ, কাপড়, কম্পিউটার ইত্যাদি আবিষ্কার হল, মানুষ রোগে দ্রুত মারা না গিয়ে বেশী দিন বাঁচতে পারছে, এরকম আর কি। জ্ঞানাৰ্জন তাই বহু জাতির রক্ষাকবচ স্বরূপ। 'রক্ষা' শুধু শুধু পাওয়ার বিষয় নয়। তাই জ্ঞানাৰ্জনও 'রক্ষা' পাওয়ার অনন্ত করণীয় বিষয়ের মধ্যে একটি। ঈশ্বরের পথে, ঈশ্বরের তরে সব ভাবা, করা, হওয়া, চাওয়া জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া সমীচিন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধক, সন্ন্যাসী ও ঋষিগণ অনাসক্ত, নিৰ্বিকার ও মুক্তিকল্প জীবনের পথে ব্রতী হয়ে জীবন অতিবাহিত করেন।সংসারী হয়েও উক্ত ভাবাধীন জীবন লাভ করা যায়, এমনটিই পরমপুরুষ অনুকূলচন্দ্রের শিক্ষা।এইভাবেই ঈশ্বরকে তথা হরিকে রাখা হয়ে থাকে এবং ঈশ্বর ও ভক্ত অবিচ্ছেদ্য হয়ে যায় এমনিভাবে। তখন ভক্ত রক্ষা পায়। পক্ষান্তরে অপকৰ্মকারীরা হরি থেকে বিযুক্ত হয়ে যায়, ফলে তারা রক্ষা পায় না।