মহাজগতে অনেক বিষয় আছে যেগুলো অভিজ্ঞ শিক্ষক, বিজ্ঞানী অথবা সদ্ গুরুর বচনের উপর নিৰ্ভর করে বিশ্বাস করতে হয়। প্রতিটি বিষয় বিশ্বাস করার জন্য প্রতিদিন গুরুকে বা জ্ঞানীকে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। যেমন সমাজে সুনামখ্যাত প্রবীন ডাক্তারের রোগনিরুপনী দক্ষতা নিয়ে মানুষ যেমন ডাক্তারের উপর সন্দেহ রাখেনা, তাঁর দেয়া ব্যবস্থাপত্রানুযায়ী মানুষ কঠিন ঔষধ নিঃসন্দেহে গলাধকরণ করে। অভিজ্ঞদের উপদেশ শুনে যেমন মানুষ বিদ্যুতের তারে হাত দেয় না। সে কোন দিন তার ধরে দেখে নাই, কিন্তু শুনেছে বিদ্যুতের তার স্পৰ্শ করলে ক্ষতি হবে, এমনকি মারাও যেতে পারে। ঠিক তেমনি গুরুর (পুরুষোত্তম স্থাস্নীয় বা সিদ্ধ)কিছু বাণী আছে যা নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে লোকে। কারণ তাঁর অপরাপর বাণীগুলো জীবনে রসায়নের সূত্রের মত সত্য।
আস্তিক হওয়ার ব্যাপারেও আমরা সদ্ গুরুরুপী পরমপুরুষের কথার উপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখব। পরমপুরুষ বলেছেন, নাস্তিক না হতে। সমাজে যদি কেউ নাস্তিক থাকে, আমি তাকে ঘৃণা করব না। বন্ধু ডেকে, ভাই ডেকে বলব, অনুরোধ করব আস্তিক হতে। এটি বলার কারনে যদি মৃদু গাল-মন্দও শুনতে হয়, তাতেও রাজী আছি। তার কারণ, সৰ্বজ্ঞ পূরণপুরুষ শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন, নাস্তিক বা বিশ্বাসহারা হলে তার ইহকাল, পরকাল দুই-ই খতম। এই প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুরের সামনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উদাহরণ উল্লেখ করব। মানুষ তো এক জীবনে দুইবার মরে না, তাই যাচাই করে দেখার সুযোগ নেই।
পূরণপুরুষের বাণী ও পথ সত্য। তিনি বলেছেন,"আমার জীবন হল আমার বাণীরই বস্তবায়িত রুপ।" যুগাবতার সৰ্বজ্ঞ, তিনি experientially wise. আমরা বিদেহী আত্মা, পরমাত্মা, পরকাল, মোক্ষ, নিৰ্বাণ, যজ্ঞ ইত্যাদি ই্ত্যাদি বিশ্বাস করি এবং এগুলো কাজ করে বিধায় পুরুষোত্তম, অবতার, সদ্ গুরু, দেব-দেবীকেও মান্য করব। দেবতা মানে যিনি দীপ্তীময়, আলোকময়। আর তিনি যে কারো ঘরে জন্ম নিতে পারেন এবং আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা করব। শ্রীশ্রীঠাকুরের মতে এবং কান্ডজ্ঞানেও দেখতে পাচ্ছি ঈশ্বর বা God বা Creator বা শক্তি বা power, যে নামেই অভিহিত করি না কেন, তিনি এক।
বায়ু, বিদ্যুৎ এসব চোখে দেখা যায় না, অথচ আছে। ঠিক তেমনি আত্মা আছে এবং এই আত্মা যার সঙ্গে ছিল বা থাকে বা যার অংশ এই আত্মা, তিনি পরমাত্মা বা যে নামেই অবিহিত হোন না কেন, তিনিও আছেন এবং তাঁর অবস্থান তাঁর মত করে অনন্তরুপে, অনন্ত শক্তি নিয়ে আছে। যুগাবতার শ্রীশ্রীঠাকুরের সামনে ভক্তপাৰ্ষদের উপস্থিতিতে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ খেয়ে আসার সময় রাত্রিবেলায় জঙ্গলাকীৰ্ণ পথে ঘটেছিল এক ঘটনা। জন্মস্থান হিমাইতপুরের ঘটনা। ঝোপঝাড়ে ঘেরা গ্রামীন পথ ধরে সবাই যখন হাঁটছেন, তখন বায়ুভূত কিছু আত্মা মাথার প্রায়ই কাছাকাছি এসে 'ঝেও- ঝেও' করে এক ধরণের ভীতিকর শব্দ করছিল। (হিমাইতপুর আশ্রমের লাইব্রেরী থেকে এই তথ্য মিলিয়ে নেয়া যাবে।) ভক্তেরা এই ঘটনা দেখে ভয়ে ভীত হয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের ধূতির ভিতর মাথা গুঁজে থাকল। শ্রীশ্রীঠাকুর আত্মাগুলোর আৰ্তি শুনে উপরের দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, 'যাও তোমরা মুক্ত।' মুহূৰ্তেই আত্মাগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। পরবৰ্তীতে আশ্রমে ফিরে এসে ভক্তদের জিজ্ঞাসার অনুরোধে ঠাকুর বললেন, আত্মাগুলো মুক্তি না পেয়ে বায়ুভূত নিরাশ্রয় হয়ে মুক্তির জন্য কাঁদছিল। তারা আজ মুক্তি পেল।
ভাবসমাধিতে শ্রীশ্রীঠাকুরের উপমানুযায়ী আমরা তাঁরি{(পরমাত্মা) পুণপুঁথি} বুদ্বুদ্। তিনি আরও বললেন, "তোরা আমাতে লয় হতে পারিস কিনা দেখ্।" উদাহরণের ভাষায় তিনি জল স্বরুপ, আর আমরা তাঁর থেকে উদ্ভূত অংশ।
হিন্দু মতে মানুষ বিদেহী হওয়ার পর ক্রিয়া না হওয়া পৰ্যন্ত ঘরের সামনে বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্য পানি দেয়।
নিষ্ঠা না হারানো বা আস্তিক হওয়ার ব্যাপারে পাবনা আশ্রমে সংঘটিত ঘটনার বৰ্ণনা নিয়ে শীঘ্রই আসছি-
বেশ কিছুদিন দেরী হলো বলে দুঃখিত। 7/15/15
নিষ্ঠা বা বিশ্বাস রাখতে না পারাও মনকে এক ধরণের দোলাচালে ছেড়ে দেয়ার সামিল। আর বিশ্বাস হারা জীবনের পরিণতি যদি চরম অশুভই হতে পারে, তাহলে নাস্তিকের পরিণতি আর ও খারাপ হতে বাধ্য।
শ্রীশ্রীঠাকুরে জীবনে ঘটেছে অসংখ্য ঘটনা। এই ঘটনাটি এরকম। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার যতীন্দ্রনাথ আচাৰ্য্য রায় চৌধুরী। শ্রীশ্রীঠাকুরের মহামন্ত্রে দীক্ষিত। তাই গুরুদেবের আশ্রমে ঘন ঘন আসা যাওয়া। যতীনদা কলিকাতা থেকে শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্য গড়গড়ার নল কিনে এনেছিলেন। তামাক সেবনের নলটি ঠাকুর খুব পছন্দ করতেন। আশ্রমে এলে যতীনদা নিজেই রান্না করতেন। যাবতীয় সরঞ্জামাধী নিজেই গাড়িতে করে নিয়ে আসতেন। একবার তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরকে তাঁর রান্না করা অন্ন গ্রহণের অভিলাষ জানালে ঠাকুর তাতে রাজী হন। শ্রীশ্রীঠাকুর যতীনদার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। কিন্তু যতীনদা কি গুরুদেবের ইচ্ছা পূরণে সমৰ্থ?
গ্রহদোষ মানুষকে বিপদে ফেলে। এই বিপদ থেকে নাকি বাঁচা যায়। শ্রীশ্রীঠাকুর কোন এক প্রসঙ্গে একবার বলেছেন, "কিং কুৰ্বন্তি গ্রহা সৰ্ব্বে, যস্য সৰ্ব কেন্দ্রে বৃহস্পতি।"
বৃহস্পতি যখন কেন্দ্রে থাকে তখন গ্রহদোষ কিছুই করতে পারে না। বৃহস্পতি 'মঙ্গল' অৰ্থ দ্যোতক। আর গুরুই মঙ্গলের প্রতীক। তবে আচরণশীল আচাৰ্য্য গুরু থাকা চাই। তিনিই সৰ্বজ্ঞ, পূৰ্ববৰ্তীদের পরিপূরণকারী এবং বৰ্তমান অনুশাসন দাতা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, গুরুকে আমরা জীবনের কেন্দ্রে কতটুকুইবা রেখেছি?
আমরা সাধারনেরা চাই, গুরু আমার চাওয়া-পাওয়া মাফিক আশীৰ্ব্বাদ করুক। আমাদের চাওয়া-পাওয়া সঠিক না বেঠিক তা ভাবার সময়ও আমাদের নেই। তাই গুরুর আশীস্ও পাওয়া যায় না। অবশেষে গুরুকেই অনেকে দায়ী করি। আমার জনম জনমের কৰ্মের জঞ্জাল যেন গুরুকেই পরিস্কার করতে হবে।
একলব্য হয়ে উঠা আমাদের অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। যুগাবতার শ্রীকৃষ্ণ তা আমাদেরকে আগেই জ্ঞাত করেছেন। তিনি বলেছেন, সহস্র সহস্র মানুষের মধ্যে দুই একজন তাঁর ভক্ত হয়ে উঠতে পারে। অৰ্থাৎ তাঁকে পেতে পারে। কত লোক যে বেঘোরে ঘুরে তা সহজেই অনুমেয়।
নিরাকার ঈশ্বরের সাকার রুপ হলেন মন্ত্রের প্রতীক তথা নামের নামী সদ্ গুরুরুপী আচাৰ্য্যপুরুষ। যিনি চির চেতন, চির জাগ্রত। তাঁর সঙ্গে শিষ্যের সম্পৰ্ক সম্পূৰ্ণ নিষ্ঠা, কৰ্ম, জ্ঞান ও ভক্তির উপর নিৰ্ভরশীল। নিষ্ঠাহারা বা নাস্তিক হলে সৰ্বনাশ। কি সেই সৰ্বনাশ, তা শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় ব্যক্ত করব। তবে এখন নয়, এই কাহিনীর শেষে।
মানুষ যে কষ্ট পায়, তার জন্যে শ্রীশ্রীঠাকুর খুব ব্যথা পেতেন। কারণ, কথা না শুনা মানুষের কতগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি। শ্রীশ্রীঠাকুর নিজেই বলতেন, তোরা আমার কথা শুনিস না বলে আমার কোন দুঃখ নেই, কিন্তু আমার কথা না শুনে তোরা যে কষ্ট পাস্, তখন আমি স্হীর থাকতে পারি না।
শিষ্যের কষ্টে গুরুর বুকখানা ভেঙ্গে যায়। কারণ, তিনি যে পরম দরদী ও পাবক পুরুষ। যতীনদা জমিদার। বিশাল ভূসম্পত্তি আছে তাঁর। কিন্তু নিষ্ঠায় ছিল ঘাটতি। যে কথা ঘটনা ঘটার পরে ভক্তেরা শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছ থেকে কষ্ট করে আদায় করে নিয়েছেন।
যতীনদা শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে এসে বললেন, পরদিন সকালে তিনি চলে যাবেন। শ্রীশ্রীঠাকুর খুব আদরের সাথে যতীনদাকে বললেন, না গেলে কি হয় না? পরদিন গেলেই তো ভালো হয়।
যতীনদা বললেন, না গেলে আমার বৈষয়িক ক্ষতি হবে। টেক্সীওয়ালাকে ধরে রাখা যাবে না।
শ্রীশ্রীঠাকুর টেক্সীওয়ালাকে বিদায় করে দিতে বললেন এবং পরে তিনি আশ্রমের গাড়িতে করে যেতে পারবেন, তাও বললেন। যতীনদা বললেন, যেভাবেই হোক, তাঁকে যেতেই হবে এবং না গেলে তাঁর বৈষয়িক ক্ষতি হবে।
যথারীতি যাওয়ার পূৰ্ব মুহূৰ্তে যতীনদা বিদায় নিতে আসলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে বললেন, কলিকাতার যে জায়গায় গড়গড়ার নল পাওয়া যায় সেই ঠিকানাটি লিখে দিতে।
যতীনদার সামনে ডাঃ হরিপদ দা (সাহা) উপস্থিত ছিলেন, তাই তাঁকেই বললেন ঠিকানা লিখে নিতে। শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, ঐভাবে ঠিকানা দিলে চলবে না, ভবানীর নিকট পাকা খাতা আছে, তথায় লিখে রাখতে হবে। ভবানীদা (সাহা) অফিসের ক্লান্তি শেষে বাসায় ফিরে আহারান্তে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বিছানা থেকে উঠে ঠিকানা লিখতে লিখতে আরও কিছু সময় লেগে গেল।
ভক্তেরা বলে থাকেন,পাবকপুরুষের সান্নিধ্যে সময় লাগলেও ভালো, এমনকি জীবনের পুরো সময় লাগলেও ভালো। সদ্ গুরুর কাছে দু'টি উপায়ে আত্মসমৰ্পন করা যায়। উপায় দু'টির কথা শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীকণ্ঠে ব্যক্ত হয়েছে। একটি উপায় 'বকলমা দেয়া,' অন্যটি 'তপশ্চরণ করা।' সিদ্ধপুরুষেরা তপশ্চরণ করেছেন। সেটি খুবই কঠিন। তাই হয়তো সমাজে সাধনায় সিদ্ধি লাভকারী লোকের সংখ্যা এত কম। 'বকলমা দেয়া' মানে জটিল অংকের সমাধান করতে খাতা ও কলম গুরুরুপী শিক্ষক মহোদয়কে দিয়ে দেয়া। জীবন-অংকের উত্তর যখন আমরা নিজেরা মিলাতে পারি না, তখন গুরুকৃপাহি কেবলম্ বলতে প্রস্তুতি নিতে হয়। আমাদের জীবনের সামনে অনাগত প্রতিটি মুহূৰ্ত অজানা। তাই দেখা যায়, পলকে প্রলয় ঘটে যায়। তখন হাত ও কপাল একত্র হয়। জটিল ও জীবনঘাতি দূৰ্দৈব থেকে রক্ষা পেতে হলে ত্রিকালজ্ঞ সদ্ গুরর চরণে নিজেকে সঁপে দিতে হয়। তিনি যা বলেন তাই করতে হয়।
পরমপুরুষের লীলাসহচরগণের অনেকে লিখেছেন, শ্রীশ্রীঠাকুরের ঈঙ্গিত, নিৰ্দেশ, ঈশারা না বুঝে যাঁরা নিজের খেয়ালের বিশ্বাসে চলেছেন, তাঁদের অনেকেরই অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
সম্ভবত শ্রীশ্রীঠাকুর যতীনদার যাত্রা বিলম্বিত করার জন্য গড়গড়ার নলের উছিলায় সময় ক্ষেপন করে যতীনদার মনে চিন্তার ধারাকে গুরুর প্রতি অনুরাগাবিষ্ঠ করতে চেষ্টা করেছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় - 'মানুষের নিজ প্রবৃত্তিগুলির আকাঙ্ক্ষা পূরণের টানের চাইতে ইষ্টে বা ঈপ্সিতে বেশী টান না হলে অদৃষ্ট বা সঞ্চিত কৰ্মফলের বিরুদ্ধে কিছুতেই কৃতকাৰ্য না হতে পারার'-যে নিশ্চিত সম্ভাবনা রয়েছে তাই ঘটতে চলেছিল সেদিন। যতীনদার দূৰ্বল নিষ্ঠার কারণে সেদিন গুরুর কাছে নিজেকে বকলমা দিতে পারেননি। মুক্তাগাছার জমিদার চলে গেলেন বিশ্ব জামিনদারের ঈঙ্গিত ঠেলে। 'সদ্ গুরুর শরণাপন্ন হও,সদ্ নাম মনন কর, আর সৎসঙ্গের আশ্রয় নিয়ে তেমনি করে চলতে থাক, আমি নিশ্চিত করে বলছি, তোমাকে তোমার উন্নয়নের জন্য ভাবতে হবে না' - শ্রীশ্রীঠাকুরের এই অভয় বাণীটি যতীনদাকে নিৰ্ভয় ও শঙ্কামুক্ত করতে পারেনি।
যতীনদা চলে যাওয়ার পরদিন ভোর বেলা আশ্রমে খবর এল যতীনদা শেষবারের মত চলে গেলেন। ঈশ্বরদি যাওয়ার পথে গাড়িটি দূৰ্ঘটনা কবলিত হয়ে যতীনদা প্রাণ হারান। ১৩৪১ সনের জৈষ্ঠ মাস (দিনটি পাওয়া যায়নি) যতীনদা সমস্ত বিষয় সম্পত্তি ফেলে একাই ইহ জগৎ ত্যাগ করেন।
আশ্রমের সকলে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কেউ মনকে প্রবোধ দিতে পারছিলেন না। সবার মনে জিজ্ঞাসা উঁকি মারছিল কেন এমন হল, কেন অকাল মৃত্যু হল?
মানুষকে ভক্ত হয়ে উঠতে হয়। বিশ্বাস ভক্তি এনে দেয়। শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায়-'বিশ্বাস যেমনতর, ভক্তি তেমনতরভাবে আসবে এবং জ্ঞানও তদনুযায়ী,...'(সত্যানুসরণ)। মানুষই দীক্ষা নেই, মন্ত্র শুনে, ঈশ্বরানুরাগী হয়, সাধনা করে। কৰ্ম, ভক্তি ও জ্ঞানের সাগরে অবগাহন করে নিজেকে পবিত্র করে তুলে। ভক্ত এই ত্রিবেণী তীৰ্থরুপী তটিনী পাড়ি দিয়ে দৈবী পথে এগিয়ে চলে অমৃতের সন্ধানে। এসব ভক্তকেই করে চলতে হয়। অক্ষর শক্তিকে এসব কঠিন কাৰ্য সাধন করতে হয় না।
যতীনদার বিশ্বাসের রশি দূৰ্বল ছিল। নররুপী পরমপুরুষের উপর আস্হা ছিল না তাঁর। তবুও পরমপুরুষ চেয়েছিলেন যতীনদার জীবনের জন্ম-জন্মান্তরের কৰ্মচক্রের রূপরেখা নতুন করে রচনা করতে, চেয়েছিলেন শোধন করতে। সৎপথে চলার উপদেশ দেয়ার ধারা তাই তো গুরুত্বপূৰ্ণ৷ কিন্তু অবিশ্বাস, জেদ, অহংকার, আত্মম্ভিরতা, বিষয়ানুরাগ ইত্যাদি জঞ্জাল নিয়ে আমাদের মত অসংখ্য মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না বকলমা দিয়ে একলব্য হয়ে উঠা। তাই, আমাদের আমও যায়, থলেও যায়। অবতার পুরুষগণ লক্ষ-কোটি মানুষকে ঝাপটে ধরে তাদের সৃষ্ট নিজ নিজ কৰ্মের জঞ্ঝাল কখনও পরিষ্কার করে দেন নাই। যদি তাই হতো, তাহলে তাঁর সান্নিধ্যে আসা প্রত্যেকের জীবন বিজলী বাতির ঝলকের মত পরিবৰ্তন হয়ে আলোকিত হয়ে যেত। আর তিনি বলেছেনও তা। পরমপুরুষ প্রায় এভাবেই বলেছেন- 'তাঁর বাণী জীবনে বাস্তবায়িত না করে সারা জীবন তাঁর গাঢ়ুগামছা বইলেও কোন ফল হবে না।' মানুষ নিজেই নিজের সৃষ্ট কৰ্মের বাধা পরিষ্কার করবে। পরমপুরুষের কাজ রাস্তা দেখিয়ে দেয়া, চলার নিয়ম শিখিয়ে দেয়া।
সীমায়িত দৰ্শনশক্তির অধিকারী অনেকের মত সেদিন আশ্রমবাসী সকলের মনে প্রশ্ন উদিত হয়েছিল- কেন যতীনদার অকালমৃ্ত্যু হল? শ্রীশ্রীঠাকুরতো অন্তৰ্যামী। তিনি যতীনদাকে জোরপূৰ্বক ধরে রাখলেন না কেন? আত্মা কখনও মরে না, এটি বুঝতে পেরেও যতীনদার দেহাবসান অকালে কেন হল, তা জানতে সবাই শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে গেলেন।
এই ঘটনার পূৰ্বাপর আরও বহু মৰ্মন্তুদ ঘটনা ঘটেছে। যাঁরা তাঁর কথা শুনেছেন, তাঁরা রক্ষা পেয়েছেন। বিখ্যাত যাজক, প্রচারক ও 'যাজন পথে' গ্রন্হের লেখক প্রতিঋত্বিক শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবৰ্ত্তী বেঁচে গিয়েছিলেন ভয়াবহ ট্রেন দূৰ্ঘটনা থেকে। একবার যাজন পরিক্রমায় যাওয়ার পথে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে যাত্রা থামিয়ে বলেছিলেন, সকালের নিৰ্ধারিত ট্রেনে না যেতে, পরের দিন যেতে বলেছিলেন। ত্রৈলোক্যদা গুরুর আদেশের লক্ষ্যে স্হির থেকে জগতের জন্য আদৰ্শ স্হাপন করেছেন। ঈশ্বরদীর কাছেই সকালের ট্রেনটি সেদিন দূৰ্ঘটনায় পড়ে;বহু লোক তাতে হতাহত হয়। আশ্রমের কৰ্মী গোপাল ভাই এবং সম্পাদক শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়কে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছিলেন, আসার পথে সরাসরি আশ্রমে চলে আসতে, কিন্তু গুরুর আকুতি না শুনে প্রারদ্ধ দোষের অশুভ বিধির কবল থেকে রক্ষা পেলেন না। শহরের বাইরে কাজ শেষে আশ্রমে ফেরার পথে নেমে গিয়ে আবার অন্যত্র কাজ সারতে গিয়েছিলেন সেদিন। ১৩৪৭ সালের ২০ শে শ্রাবণ সেই দিনটিতে ঘোর অমানিশা নেমে এল। মাজদিয়া রেল দূৰ্ঘটনায় দু'জনেই প্রাণ হারালেন। আশ্রমে হাহাকার শুরু হল।
তাই যতীনদার কথার উত্তর দিতে শ্রীশ্রীঠাকুর রাজি ছিলেন না। প্রতিটি অশুভ সংঘটনের পরে মানুষের আৰ্তনাদ দেখে পাবক পুরুষের দরদী হৃদয় ব্যথিত হতো। যাঁরা চোখের সামনে নিরন্তর থাকত, তাদের অকাল বিদায় সত্যিই মৰ্মান্তিক। তাঁর ঐশী সত্তা সবকিছুর উৰ্দ্ধে, তবুও জাগতিক জীবনের অনুভূতি তাঁকেও কাঁদাতো। দীৰ্ঘ শ্বাস ফেলে অনেকটা এমনভাবেই বলতেন, "অত সব প্রশ্ন না করে, অত তত্ব কথার মধ্যে না গিয়ে তোরা যদি সোজা আমার কথা শুনতি তাহলে অনেক বালাই-বিপদ এড়াতে পারতি।"
সবার জীবনের কৰ্মের ছবি শ্রীশ্রীঠাকুরের ভগবত সত্তার দৰ্পনে প্রতিভাত হতো। সকল মানুষের জীবনের ছবি তাঁর দৈবী দৰ্শনে আঁকা। তাই মানুষকে দেখেই তিনি বুঝতেন, মানুষের এষণা শক্তি কি, আর সেই শক্তি টুকুন নিয়ে কিই বা সে করতে পারে। মানুষ মানুষের নিজ নিজ কৰ্ম দিয়ে নিজের জীবনের ছবি এঁকেছে। শুধু নিজের প্রবৃত্তি পূরণের কৰ্মের উপরে উঠে মঙ্গল সাধনে তীব্র সাধনার টান সৃষ্টি করতে পারলেই প্রারদ্ধ অথবা ইহজীবনের অশুভ কৰ্ম ফল কাটানো যায়। যা শ্রীশ্রীঠাকুরই বলেছেন। তাই এই কৰ্মের উপর অন্য কারো হাত নেই। যতীনদার কৰ্ম বিধানে ছিল অশুভ পরিণতি। কিন্তু যতীনদা পরমপুরুষের মন্ত্র শুনেছেন এবং আংশিক ইষ্টকৰ্ম পরায়ণতা ছিল বলেই হয়তো অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা পেয়ে অন্তত পরজন্মে মানবজীবন প্রাপ্তির পথ খোলা পেলেন। অন্যথায় সেটুকুনও হয়ত হারাতে হতো। কেন? যতীনদার ত্রুটি বা ঘাটতি কোথায় ছিল? কিভাবে পরজন্মে মানবজীবন প্রাপ্তির পথ খোলা পেলেন, কেনই বা মহা প্রতাপশালী প্রজাপতি দক্ষের মত অকালে চলে গেলেন এবং পরমপুরুষের ঐশী পরশে যতীনদার কৰ্মচক্রের বিধান কিভাবে রচিত হলো, তা শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীমুখের বৰ্ণনা থেকে বুঝে নিতে পারি। যতীনদার অকালমৃত্যুর ব্যাপারে ভক্তদের জানার তীব্র আকুতি বুঝতে পেরে শ্রীশ্রীঠাকুর উত্তর দিতে শুরু করলেন, বললেন, যতীনদা যখন সেদিন আশ্রমে এসেছিল আমি যতিনদাকে দেখিনি, যতীনদার প্রেতাত্মাকে দেখেছিলাম। অৰ্থাৎ যতীনদার মৃত্যু হবেই তা শ্রীশ্রীঠাকুর সহজাত শক্তিতেই জানতেন। যতীনদা প্রচুর ভূ-সম্পত্তির মালিক। নামের নামী পুরুষের গুরুত্বের চাইতে বিষয় সম্পত্তির গুরুত্ব তাঁর কাছে স্বাভাবিক অন্য দশজনের মত বেশী ছিল। নিষ্ঠা বা আস্হার রশি ছিল আমার মত দূৰ্বল। বহু মানুষ মাঝে মাঝে নিজেই হারিয়ে যায়, তবুও বিষয় হারাতে রাজী নয়। পরমপুরুষ তাঁর শ্রীমুখ থেকে পরমতত্ব বলতে শুরু করলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, "যতীনদাকে যদি জোর করে ধরে রেখে দিতাম, তাহলে যতীনদার বৈষয়িক ক্ষতি যা হবার - তা হতোই। তখন প্রবল বিষয়ানুরাগী যতীনদা দীক্ষা, গুরু ইত্যাদির উপর আরও বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠতেন। হয়তো বলতেন- গুরুর আদেশ রক্ষা করতে গিয়ে আমার এত বড় বৈষয়িক ক্ষতি হলো।" সদ্ গুরু ও নামী পুরুষের উপর অবিশ্বাস মহা অমঙ্গলকর। শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, "অবিশ্বাস মনে পুশে নিয়ে যতীনদার মৃত্যু হলে পরবৰ্তী জন্মে যতীনদা মনুষ্য জন্ম পাওয়ার পথ রুদ্ধ। কারণ নিষ্ঠাহারা জীবনের ইহকাল,পরকাল দুইই খতম।" কিন্তু এখন যতীনদা বুঝতে পারলেন পরমপুরুষের উপর আস্হা হারালে কি হয়। হয়ত মৃত্যুর পূৰ্বে হাসপাতালে বারবার বলছিলেন, 'হায় ঠাকুর! হায় ঠাকুর! ঠাকুরের কথা শুনলে আজ আমার এই পরিণতি হতো না।' শ্রীশ্রীঠাকুর আবার বলতে লাগলেন- "এখন যতীনদা বুঝতে পেরেছেন এবং বিশ্বাস নিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন এবং এখন তাঁর মানব জন্ম পাওয়ার পথ খোলা।" সেদিন পরমপুরুষের উপর বিশ্বাস নিয়েই শেষবারের মত আঁখির পাতা বন্ধ করেছিলেন যতীনদা। ভক্তেরা বুঝতে পারলেন, নিষ্ঠা ও কৰ্ম চক্রে জীবনচক্র কিভাবে বাঁধা বা মানুষের তৈরী করা নিয়তিতে মানুষকে কিভাবে নিয়ত চলতে হয়। মানুষের অনন্তমাত্রিক জীবনতো একটাই। এই জীবন দূৰ্লভ এবং ঐশী মাত্রার নিয়মে বাঁধা। তাই বলতে চাই, অনন্ত অসীমের দুনিয়ায় সসীম মানুষ যেন নিজেকে হামবড় না ভাবে। এরকম বহু ব্রক্ষ্মজ্ঞ যোগী পুরুষের ঘটনা আছে যাঁদের আঁখি যুগলের অগ্নি তেজে বহু অসুর ধ্বংস হয়েছে এবং এখনও হয়। স্রষ্টা বা spirit বা অক্ষর শক্তির প্রভাব আরও অনেক অনেক উপরে।
পরমপুরুষ এবার গুরু, ভক্তি, নিষ্ঠা, ইহকাল, পরকাল, জ্ঞাতব্য, ভবিতব্য, ভয়, নিৰ্ভয় ইত্যাদি সবকিছু সবার সামনে উন্মুক্ত করে দেখালেন। মনে হয় পরমপুরুষ বুঝাতে চেয়েছেন বিজ্ঞানের চরম উৎকৰ্ষতার ফলে মানুষ নিষ্ঠা, ভক্তি, গুরু, ইহকাল ও পরকাল ইত্যাদি ভুলে যেতে পারে, তাই মানুষের বুঝা উচিত, পরম আচাৰ্য্য পুরুষের মনোবীক্ষণ যন্ত্র কত শক্তিশালী। তিনি সৰ্বজ্ঞ যদিও, তবুও তিনি আচাৰ্য্য। আচরণ করে সব কিছু সবার সামনে তুলে ধরেন যুক্তি নিৰ্ভরতার পথে আস্হা না হারানোর জন্যে। তিনি অবুঝ মানুষের কাছে পরীক্ষা দেন। কারণ মানুষ তাঁকে পরীক্ষা করেন। তিনি অনেক দুৰ্জ্ঞেয় (দুজ্ঞেয়) বিষয় এবার সবারে শিখালেন।
চলবে