আত্মিক শক্তি বা আত্মিক সম্বেগই পরমপিতা
আর বৈশিষ্ট্যপালী পুরুষোত্তমই
সাকার ঈশ্বর
যে আত্মিক সম্বেগ
বা যে আত্মিক শক্তির বপনায়
সবাই স্ফুরিত হ'য়ে উঠেছে-
স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে,
প্রকৃতির অংকে,-
তিনিই পরমপিতা;
আর পুরুষোত্তম তিনিই-
যিনি অমন করে উদ্ভিন্ন হয়ে উঠেও
বৈশিষ্ট্যপালী, আপূরয়মান,পরমবেত্তা
তাই, ঐ পুরুষোত্তমই যুগে-যুগে
লোক-উদ্ধাতা-পরমগুরু-
আচাৰ্য্যদেবতা,
মূৰ্ত্ত ব্রাক্ষ্মীপুরুষ-
এক-অদ্বিতীয়।
সংজ্ঞা-সমীক্ষা, বাণী-১০৯
যিনি ঈশ্বরবেত্তা ঈশ্বর তাঁতেই জাগ্রত।
শাশ্বতী, বাণী-২৮৬
গুরুই ভগবানের সাকার মূৰ্ত্তি, আর তিনিই অখন্ড।
সত্যানুসরণ।
ভগবান বাস্তবতায়
না-জানার কল্পনায় তুমি তোমার ভগবানকে
মূৰ্ত্ত করিতে চেষ্টা করিও না,-
ব্যৰ্থতায় চিরাবসন্ন হইবার পথ সৃষ্টি করিও না!-
যেখানে তোমার সৰ্ব্ব
বা অধিকাংশ বৃত্তি সাৰ্থক হয়
সেখানে তোমার প্রয়োজন ভালবাসা,
ভক্তি ও প্রেমকে নিয়োজিত কর
তোমার ভগবান সেখানেই তোমার বোধে
প্রকৃত হইয়া
প্রকট হইবেন,-
যেমন শ্রীকৃঞ্চে অৰ্জ্জুনের ভগবান!-
ভয় নাই,-
ভ্রান্তি তোমাকে
বিপথগামী করিতে পারিবে না।
(চলার সাথী, পৃষ্ঠা-৪৬)
অসীম যখন সসীম হয়ে
ধরাতে লয় স্হান
বৃত্তিভেদী টান হলে তাই
দেখবি ভগবান।
অনুশ্রুতি।
আমরা কোটি কোটি মানুষ স্বীকার করি- ঈশ্বর এক, তিনি নিরাকার এবং অদ্বিতীয় বা স্রষ্টা বা সৃষ্টির পেছনে যে শক্তি সেই শক্তিধর সত্তা নিরাকার। এক কথায় ঈশ্বর নিরাকার। আসলেই তিনি নিরাকার। সৰ্ব ধৰ্মমতের সমম্বয়ের কথা চিন্তা করলে এবং ঈশ্বর বা Spirit বা স্রষ্টার একত্বের কথা ভাবলে কিংবা একত্ববাদ নিয়ে ভাবলে এই অনুভাবনার স্বপক্ষে তথ্য পাওয়া যায়। এই তথ্য বহু মানুষ জানেন সেই বহু পূৰ্ব থেকেই। তবে পৃথিবীতে নবাগতদের জন্য জানা চিরকাল নতুন বিষয় হয়ে থাকবে।
Spirit রুপী নিরাকার ঈশ্বর যুগাবতার হয়ে মানুষ রুপে আসেন। তাই তাঁকেই মানুষ ঈশ্বর মানেন। তাঁর মধ্যেই পূৰ্ণ Spirit বিরাজিত। এই
ঈশ্বরের একত্বের পক্ষে সত্যতা বাইবেলেও খুঁজে পায়। যেমন -"God is spirit, and those who worship him must worship in spirit and truth.”John 4:24 অৰ্থ- ঈশ্বর পরমাত্মা, যাঁরা তাঁর উপাসনা করেন,তাঁদেরকে পরমাত্মায় ও সত্যে উপাসনা করতে হবে।
আর এই Holy Spiritই আত্মিক সম্বেগরূপী শক্তি। যে শক্তি থেকে মহাজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। এই শক্তিই আত্মিক শক্তি বা আত্মিক সম্বেগ বা পরমাত্মা। এই পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে হলে বা তাঁর স্বারূপ্যলাভ করতে হলে যুগে যুগে যিনি নর দেহে আমাদের মধ্যে এসে যে অমৃতবাণী শুনিয়েছেন, সেই তাঁকেই বা তাঁর মধ্যেই Spirit কে উপলদ্ধি করা যাবে। এই জন্যে ঈশ্বরকে যেমন Spirit বা আত্মিক সম্বেগ বা পরমাত্মা বা Supreme Soul বলা হয়েছে তেমনি Son কেও Spirit বলা হয়েছে। যেমন- "God is the Father, God is the Son and God is the Holy Spirit"Matthew 28:19 অৰ্থ- ঈশ্বর পিতা, পু্ত্র এবং ঈশ্বর পবিত্র আত্মা।
এই জন্যে Spirit বা পরমাত্মার স্বারূপ্যলাভ living spiritual son কে ছাড়া সম্ভব নয়। "I am the way and the truth and the life. No one comes to the Father except through me." John 14:6 অৰ্থ-আমি পথ, সত্য আর জীবন. আমার মধ্য দিয়ে না গেলে কেউই পিতার কাছে আসতে পারে না।
এই জন্যে যীশু অনুগামীগণ পবিত্র সত্তা যীশুকেই সৰ্বোচ্চ spirit বা ঈশ্বর বা ত্রাণকৰ্তা বলে ভজনা করেন। কারণ তিনিই Spirit'র মূৰ্ত্ত রূপ। Spiritতো সৰ্বব্যাপী, নিরাকার শক্তিরূপে প্রকাশিত।
প্রেরিত পুরুষ যে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার মূৰ্ত্তি (রূপ) সেই কথা বাইবেলে আরও পরিস্কার করে বলা আছে। যেমন- "I and the Father are one." John 10:30 অৰ্থ- আমি এবং পিতা অভিন্ন।
অপরাপর সম্প্রদায়ের মধ্যে মান্য প্রেরিত পুরুষগণ সম্পৰ্কেও বলা আছে - "তিনি (prophet) আসমানের দীপ্তি, স্রষ্টার প্রেরিত পুরুষ, তাঁহার সত্তা বা তিনিই স্রষ্টা দৰ্শনের দৰ্পন স্বরূপ।" তিনিও Spirit রূপী আলোর মূৰ্ত রূপ, পৃথিবীতে এসেছেন শান্তির বাণী নিয়ে।
আরও বলা আছে -"আমার Prophet কে যে দেখিল, সে যেন আমাকেই দেখিল,..............।" আরও বিশেষ বিশেষত্ব এই যে পরমাত্মা বা আত্মিক সম্বেগরুপী শক্তির নৈৰ্ব্যক্তিক বাণীগুলো পরমাত্মার মূৰ্ত্তরূপ prophet'র জীবনে পরিপূৰ্ণরুপে বাস্তবায়িত। তাই বলা আছে-'আমার জীবনই হল এই গ্রন্হ'(নৈৰ্ব্যক্তিক গ্রন্হ)।
এর পূৰ্বে শ্রীশ্রীগীতায় ও একই সত্য অনুরণিত হয়েছে living Spirit শ্রীকৃঞ্চের শ্রীমুখে। যেমন-
"সৰ্বধৰ্মান্ পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ/
অহং ত্বাং সৰ্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।"অষ্টাদশ অধ্যায়, শ্লোক-৬৬
অৰ্থ- সকল ধৰ্ম পরিত্যাগ করে তুমি একমাত্র আমাকেই স্মরণ কর, আমি তোমাকে সকল পাপ থেকে মুক্ত করব, শোক করো না।
নোট- সকল ধৰ্ম বলতে সম্ভবত সকল সংস্কার ও বিশ্বাসকেই বুঝানো হয়েছিল। অন্য ধৰ্ম মতকে নয়।কারণ তখন অন্যান্য ধৰ্মমত গুলো ছিল না। তাছাড়া তিনি বারে বারে আসেন বলেও বলেছেন।
দিব্য Spirit, পরব্রক্ষ্মের মানুষী রূপ পূৰ্ণ যুগাবতার শ্রীকৃঞ্চ আরও বলেছেন-
"মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্ যাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি যুক্তৈবমাত্মানং মৎপরায়ণঃ।।" ৯ম অধ্যায়, শ্লোক-৩৪।
অৰ্থ- তুমি সৰ্বদা মনকে আমার চিন্তায় যুক্ত কর, আমার যাজন (মদ্ যাজী মাং) কর, আমাতে ভক্তিমান হও, আমাকেই নমস্কার কর।এইরূপে মৎপরায়ণ হইয়া আমাতে মন সমাহিত করিতে পারিলে আমাকেই প্রাপ্ত হইবে।
Spiritরূপী এই জ্যোতিৰ্ময় সত্বা মানুষী দেহে ধরায় অবতীৰ্ণ হন যুগে যুগে। আর তিনিই উপরওয়ালা, কিন্তু মানুষ মনুষ্যদেহে দেখে তাঁকে অবজ্ঞা করে। যেমন- "অবজানন্তি মাং মূঢ়া .......................।"
নৈৰ্ব্যক্তিক বেদের বাণীতেও উল্লেখ আছে ঈশ্বর নিরাকার এবং তিনি জ্যোতিৰ্ময় সত্তা।
শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃস্য পুত্রাঃ, আ যে ধামানি দিব্যানি তস্তুঃ,
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্, আদিত্যবৰ্ণং তমসো পরস্তাৎ।
ঋকবেদ।
অৰ্থ- শুন হে অমৃতের পুত্র যত বিশ্বজন! তমসার পারে আদিত্যবৰ্ণ, শাশ্বত জ্যোতিৰ্ময় মহান পুরুষকে জানিয়াছি।
এই নিরাকার জ্যোতিরূপী তিনিই আদি, তিনিই অনাদি, তিনিই অনন্ত, তিনিই শাশ্বত সনাতন। তিনিই পরব্রহ্ম, কূল-মালিক। বেদ বাণীর চিরন্তন বাক্য থেকেই তা আমরা জেনেছি-
তমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি, নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়।
ঋকবেদ।
অৰ্থ- কেবল তাঁহাকে জানিয়াই, গ্রহণ করিয়াই জীব মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পায়। ইহা ব্যতীত অন্য আর কোন উপায় নাই।
নোট: "মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ" অৰ্থ, মানুষ মোক্ষ লাভ করে চিরমুক্তি পেয়ে পরব্রক্ষ্মের সাথে লীন হয়ে যাবে। তার বার বার জন্ম হবে না এবং বার বার মৃত্যও হবে না।
ঈশ্বর নিরাকার এবং তিনি জ্যোতিৰ্ময় সত্তা৷ তিনি শক্তিরূপে সৃষ্টিতে স্বেদজ, অন্ডজ, জরায়ুজ ও উদ্ভিজ্জকূলে এবং স্হাবর(অচল,স্হীর বৃক্ষ, পৰ্বতাদি), জঙ্গম(নিয়ত গমনশীল,সকল প্রাণীকূল) ও বিশ্বচরাচরে তিনি চেতনা (শব্দ বা আদি নাদ্-ধ্বনি চেতনায় প্রকাশিত) রূপে প্রকাশমান৷চৈতন্য, চেতনাই- যা প্রতি সত্বার প্রাণন সম্বেগ। আদি নাদ-ধ্বনি নিরাকার ঈশ্বরের প্রতীক। নৈৰ্ব্যক্তিক গ্রন্থ পুণ্যপুঁথিতে উল্লেখ রয়েছে- "নাম নিয়ে যায় প্রণবে, আর প্রণব নিয়ে যায় আমাতে"।বৈদিক সময়ে বা তারও পূৰ্বে কখন, কিভাবে, কোথায় এই আদি নাদ্ রূপী নাম ঋষিগণ সাধনায় লাভ করেছিলেন বা বেদ মন্ত্রের মত প্রত্যক্ষ করেছিলেন তার নিৰ্দিষ্ট সময় ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণা হয়নি। তবে সন্ত-সদ্ গুরুগণ এই নাম সাধনা করতেন। নিশ্চয় তাঁরা পূৰ্বের কোন দ্রষ্টা ঋষির কাছে দীক্ষার মাধ্যমে এই নাম-মন্ত্র লাভ করেছিলেন।তাঁরা ধ্যানদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এই নামের নামী ধরাধামে আবিৰ্ভূত হয়েছেন জগজ্জননী মাতা মনোমোহিনীর কোলে৷দেখা যায় নাদধ্বনি আবার একাধিক রয়েছে৷শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় যুগের উপযোগী এবং মানুষের বোধি-চেতনা ও সাৰ্বিক বিবৰ্তন বা পরিবৰ্তন অনুযায়ী বিভিন্ন অবতার পুরুষের সময় এই নাম বা নাদ্ ধ্বনি বিভিন্ন রকম হয়েছে বা পরিবৰ্তন হয়েছে৷ উন্মুক্ত তারকব্রক্ষ্ম নামও যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে সত্য যুগে-" নারায়ন পর বেদা......," ত্রেতাযুগে-" রামায় রামচন্দ্রায় রাম ভদ্রায়........" এবং কলিযুগে- " হরে কৃঞ্চ হরে কৃঞ্চ কৃঞ্চ কৃঞ্চ........"৷
উপরে উল্লেখিত শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীগুলো এইভাবে বুঝে নিতে পারি যে, আদি নাদ্ স্পন্দিত জ্যোতিৰ্ময় নিরাকার আপাত অদৃশ্য ও মানস-অগোচর শক্তিই আত্মিক শক্তি বা আত্মিক সম্বেগ। তিনিই পরমাত্মা। আর আমরা তাঁরই উৎক্ষেপ, তাঁর থেকেই সৃষ্ট জীবাত্মা। তাই জীবাত্মাও spirit এর অংশ,নশ্বর দেহ নয়। হয়তো আমরা অনেকেই (জীব) চেতনাহীনতার জন্যে এই spiritকে অনুভব করতে সক্ষম নই। এই সক্ষমতা অৰ্জন করাই তো শ্রীশ্রীঠাকুরের কথায়- ঠাকুরত্ব জাগ্রত করা। তাই ঈশ্বরানুভূতি অনুভবের বিষয়। সত্যানুসরণের মহা বাণী -'ধৰ্ম অনুভূতির উপর।' অনুভূতি শক্তি অৰ্জনের জন্য প্রয়োজন চেতনা।
শব্দ সৃষ্টির প্রাণস্বরূপ। বেদের সেই মহাবাণী-শব্দ ঈশ্চূতে ব্রহ্ম। প্রাণন-ধ্বনি শব্দব্রহ্মের প্রতিধ্বনি। প্রাণন ধ্বনি সত্তার অবস্থিতিকে অটুট রাখে, চেতন রাখে। আর এই চেতনাও সত্তা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ দান।
"In the beginning was the Word and the Word was with God and the Word was God." John 1:1
নবজীবনের পথ প্রদৰ্শক, পরমাত্মার মানুষী রূপ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র 'স্বতঃ অনুজ্ঞায়'- .......... চির চেতন, অজর, অমর........' বলে বলে চেতনার বৃত্তের মধ্যে থাকার জন্যে আবৃত্তির বিধান দিয়েছেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় -'বৃত্তের বেষ্টনীতে থাকাই আবৃত্তি।'
শাশ্বত বাক্য ধ্বনিত হয়েছে পরমপুরুষ শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীকণ্ঠে-
"সত্তা সৎ, চিৎ ও আনন্দময়।" চিৎ- মানে চেতনাময়। এই চেতনা আরাধনায় প্রাপ্তি সাপেক্ষ বিষয়। তাই মনে হয় মহাগুরুত্বপূৰ্ণ এই 'চেতনা' শব্দ মহামন্ত্র গায়ত্রীর অংশ হয়েছে। আদি নাদ্-ধ্বনি বারবার অনাহত উচ্চারণের মাধ্যমে চেতনার (তীক্ষ্ণ বা সাড়াপ্রবন) জাগরণ আনয়নের বিধান তাই দীক্ষায় অন্তৰ্ভূক্ত হয়েছে। মনে হয় জিকিরের কাৰ্যকারিতাও তাই।
সত্তা - অস্থিত্ব, অবস্থিতি, বিদ্যমানতা, entity, থাকা ইত্যাদি।
নোট: এখানে অত্যন্ত সহজ সরল সাদৃশ্য তুলে ধরার জন্য এই প্রচেষ্টা। এখানে আলোর মহিমা, স্রষ্টার কৃতিত্ব, স্রষ্টার পারদৰ্শীতা ইত্যাদি বৰ্ণনা করার যোগ্যতা আমার নেই বলে মনে করি। একমাত্র আলোকদৰ্শী সাধকতুল্য মানুষই সেই বাস্তব বৰ্ণনা দিতে পারেন। অন্যথায় কলমের মাধ্যমে বাচনিক বৰ্ণনার কোন মূল্য নেই। এই যে আলো বা জ্যোতিৰ্ময় স্রষ্টা, সেই আলো তো দেখা যায় জ্ঞান চক্ষুতে, চৰ্ম চক্ষুতে নয়। নামরূপী শব্দ জপের ক্ষেত্রে যে সব শব্দ বা বাঁশি শুনা যায় তাও সাধকদের পক্ষে বলাটাই যথাৰ্থ। আমরা সাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় ক্ষুদ্র কোন অভিজ্ঞতা হতে পারে।
মহান, নিরাকার ও আলোকময় Spirit বা পরমাত্মা বা স্রষ্টা থেকে সৃষ্ট এই দুনিয়ায় জীবাত্মার আকুতি সৎ, চিৎ ও আনন্দময়তায় থাকা। জীবাত্মার পরমাত্মার সাথে মিলনের আকুতি চিরন্তন। এই মিলনের প্রচেষ্টাকে সাৰ্থক রুপ দিতে হলে জীবাত্মা যে দেহে সৃষ্টির আদি প্রাণন ধ্বনি নিয়ে আছে, সেই দেহকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দেহের যে যে বৈশিষ্ট্য ও ধৰ্ম রয়েছে সেগুলো যাতে তুষ্টি পায়, পুষ্টি পায় তদনুগভাবে তাকে তা দিতে হবে। দেহের ধৰ্ম তার ক্ষুধা আছে, balanced food, বিশুদ্ধ বায়ু, নিরাপদ পরিবেশ, মৌলিক প্রয়োজন ইত্যাদি সে চায়। দেহ আবার একা নয়। তার সাথে আরও রয়েছে মন, বুদ্ধি, অহংকার, হিংসা, লোভ, ক্রোধ, ইন্দ্রিয়, বৃত্তি, কামনা-বন্ধন, গুণ, পুরুষকার, প্রারদ্ধ, অবগুণ, সৎগুণ ইত্যাদি অনেক কিছু। প্রতিটি বিষয়ের আবার বিভিন্ন দিক রয়েছে।
দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও উল্লেখিত, অনুল্লেখিত যা কিছু আছে সব নিয়ন্ত্রণে রেখে, শান্তিতে থেকে, দুনিয়ার বুকে প্রাণ ধারণ করে অন্যায়, অপরাধ না করে Supreme Soul এর সাথে মিলনের কথা মনে রাখার তাগিদ দিয়ে পরব্রহ্মের সাকার রুপ, যুগাবতার পৃথিবীতে আবার মানুষী দেহে এসে বললেন- "আমাদের গন্তব্য ঈশ্বরপ্রাপ্তি................।" অমৃতের পুত্র অমৃতের কাছে পৌঁছে যেতে চাই, তার অদম্য ব্যাকুলতা, সুরত বা আত্মা সাকী বা পরমাত্মার পদে মিশে বিলিন হয়ে যেতে চাই৷"মন নিজ নিকেতনে যেতে চাই..." অমৃৃত পরমাত্মার কাছে পৌঁছালে বারবার মরতে হয় না৷ তাই বেদের সেই মহাবাণী- 'মৃতুৰ্মা অমৃতং গময়...' মৃত্যু থেকে অমৃতে নিয়ে যাওয়ার তীব্র আকুতি জ্ঞানী ভক্তের হৃদয়ে জেগে উঠে৷
তিনি এবার সব কিছু খুলে দেখিয়েছেন। অলৌকিকত্বও বুঝিয়ে দিয়েছেন। উচ্চ শিক্ষার ধারে-কাছে না গিয়ে ইংরেজীতে দাৰ্শনিকত্বব্যঞ্জক বাণী দিলেন হাজার হাজার। শান্তির কথা বললেন বেশী বেশী করে। মৈত্রীর কথা, মিলনের কথা বললেন অপার দরদ দিয়ে। মহামিলনের বাণী অনবদ্য ছড়ার সুরে বললেন-
একই বাপের পাঁছটি ছেলে
দেখলি না তুই চোখটি মেলে-
কাউকে বাপের করলি স্বীকার
কাউকে করলি নয়,
কারে রে তুই দিলি ধিক্কার
গাইলি কাহার জয় ?
হৃদয় উৎসারিত আবেগ নিয়ে প্রত্যেককে স্ব-স্ব ধৰ্ম(শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় ধৰ্ম এক, মত বহু হতে পারে) মতে খাঁটি হয়ে সম্প্রীতির ক্ষেত্র রচনা করে উৎসমুখী হয়ে শান্তিতে বেঁচে থাকা ও বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান জানালেন তিনি।
বললেন- ভ্রান্তি এলো সেই/উৎসবিমুখ চলন, বলন বসল পেয়ে যেই।
দীক্ষাবন্ধনে আবদ্ধ হতে বললেন। দীক্ষা সকলেই নিতে পারেন। সেই প্রসঙ্গও অন্য কোন স্থানে লেখা হবে। এখানে ধৰ্ম বদলের কোন সুযোগ নেই।
দীক্ষায় কৰ্মের কথাও মহাগুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে। চেতনার সাথে কৰ্ম, বুদ্ধি, জ্ঞানও জরুরী। শুধু জরুরী নয়, অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িতও বটে।
বেঁচে থাকা ও বাঁচিয়ে রাখা আজ মৃত্যুর সাথে সন্মুখ সমরে সমুপস্থিত। মানুষের অবস্থিতি বিলোপের জন্য আমরা অধীর, অথচ বাঁচানো ও বেঁচে থাকার জন্য অধীর নই। বাঁচা ও বাঁচানোর যোগ্যতা অৰ্জন করতে পারা প্রকৃতির মহান আশীৰ্বাদ স্বরূপ। এই যোগ্যতা দুনিয়ায় অনেকের নেই। আবার সেই দূৰ্লভ যোগ্যতা লাভ করে অনেকে অনায়াসে হারিয়ে ফেলছে। এই যোগ্যতা হারালে ক্রীতদাস হয়ে বেঁচে থাকাও কঠিন হয়ে পড়ে।
শ্রীশ্রীঠাকুরের শিক্ষা, সবাইকে সাথে নিয়ে আমাদের বাঁচতে হবে। তাই সকলের অস্থিত্বকে সম্মান করতে হবে। শ্রীশ্রীঠাকুর প্রবৰ্তিত প্রাৰ্থনাতে সকল সম্প্রদায়ের অবতার প্রফেটকে মান্য করার বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে। শ্রীশ্রীঠাকুরের মেঝ ও কনিষ্ঠ সন্তানদ্বয়ের সৎসঙ্গে সেই প্রাৰ্থনা হুবহু আবৃত্তি হয়।
রাজার ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন মহাবোধি গৌতম বুদ্ধ। তিনিও যুগাবতার। অৰ্থাৎ তিনি সেই অনন্ত অসীমের সসীম অবতরণ।অবতার শব্দের অৰ্থও অবতরণই বুঝায়।নিরাকার আত্মিক শক্তি তথা পরমাত্মার অবতরণ হয় যুগে যুগে। যে কথা "যদা যদাহি........ " শ্লোকের মাধ্যমে গীতায় ধ্বনিত হয়েছে। বুদ্ধের অনুসারীরাও বুদ্ধকেই আরাধনার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে আসন দান করেছেন। নিরাকার অদৃশ্য শক্তি বা পরমাত্মা বা Holy spirit, অবতার এবং মানুষ এই ত্রিস্তরে আমরা স্রষ্টা, অবতার ও মানুষের অবস্থানকে ভাবি। বৌদ্ধ ধৰ্ম মতে তাঁরা বুদ্ধকেই ভজনা করেন বলে ত্রিশরণ মন্ত্রের মাধ্যমে। "বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি" - আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম-মন্ত্রটি দৃপ্ত প্রত্যয় নিয়ে উচ্চারণ করেন। পরবৰ্তী দু'টি মন্ত্র - "ধৰ্ম্মং শরণং গচ্ছামি" - আমি ধর্মের শরণ নিলাম এবং "সংঘং শরণং গচ্ছামি" - আমি সঙ্ঘের শরণ নিলাম।
চতুরার্য সত্য এবংঅষ্টাঙ্গিক মার্গ হলো আরও গভীরের আলোচনা। অনেক কিছু আমি পড়িনি।
যুগাবতার শ্রী বুদ্ধের দৰ্শনেও পরকাল এবং পুনৰ্জন্ম সম্পৰ্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। তাঁর মতে মৃত্যুর পর - অপায় ভূমি - ক) তীৰ্যক খ) প্রেত ভূমি গ) অসুর ও ঘ) নরকে গমন করে।
৭ ভাগে বিভক্ত ভূমি- ক) মনুষ্য লোক খ) তাবতিংশ স্বর্গ গ) চতুর্মহারাজিক স্বর্গ ঘ) যাম স্বর্গ ঙ) পরনির্মিত বসবতি স্বর্গ চ) নির্মানরতি ছ) তুষিত স্বর্গ ।
১৬ প্রকার রুপব্রহ্মভূমি। ৪ প্রকার অরুপব্রহ্মভূমি। সৰ্বমোট ৩১ প্রকার।
ইহকালে যদি কেউ পিতৃহত্যা, মাতৃহত্যা, গুরুজন হত্যা ইত্যাদি ধরণের হত্যা করে তাহলে মৃত্যুর পর সেই মানুষ চার অপায়ে ( তীর্যক, প্রেতলোক, নরক, অসুর ) জন্মগ্রহণ করে, আর যদি ভালো কাজ করে তাহলে মৃত্যুর পর সেই মানুষ বাকি লোকভূমি প্রাপ্ত হয়। (সূত্র- বুদ্ধদেবের জীবন দৰ্শন) ঈশ্বর এক, সকল মানুষের স্থিতি ও বিলয়ও একই, ভিন্ন নয়।
প্রথম ও প্রধান বিষয় হলো - "বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।" অৰ্থ- আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম।
আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম এবং সাথে সাথে এটিও স্বীকার করা হচ্ছে যে বোধি লাভ জীবনের মূখ্য উদ্দেশ্য। সৰ্বোপরি স্বীকার করা হচ্ছে যে "বুদ্ধত্ব" মানে - পূর্ণ সত্য, শুদ্ধ পবিত্রতা এবং চরম আধ্যাত্মিক জ্ঞান। তাহলে এখানে সৰ্বব্যাপী ঈশ্বর কোথায় ? ব্যক্তিরূপী ঈশ্বর কোথায়? হ্যাঁ, অখন্ড ও অনন্ত অসীম যিনি বা যে আত্মিক শক্তি বা Holy spirit তিনি বা তাঁহা পরম পবিত্র সত্তা বুদ্ধের মধ্যে বিরাজমান। এই সসীম সত্তা অনন্ত ও অসীম সত্তার সাকার রুপ। অহিংসা নীতি পালন ও কামনা বৰ্জন বুদ্ধদেবের মূল শিক্ষা। অসূয়া ত্যাগের কথা বেদ, উপনিষদ এবং ঋষিদের সংহিতাতে সহস্র বার বলা হয়েছে এবং গীতায় কামনাকে নরকের দ্বার বলা হয়েছে। অসূয়া মানে -Envy, calumny, jealousy ইত্যাদি। আর এই অবগুণগুলো হিংসাজাত। পরমসত্তার উপদেশ বচন সৰ্বকালে, সৰ্বস্থানে একই রুপ। যুগাবতার শ্রীশ্রী অনুকূলচন্দ্রের দিব্য বাণী-".....প্রেরিত পুরুষগণ একই বাৰ্তা বাহী...... all prophets are same servers of one." তাঁদের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই। ঠিক একইভাবে যীশুকে ঈশ্বররুপে ভজনা করা হয়। তাঁরা আলোকময় সত্তা বলেই তাঁদেরকে আলোর তৈরী বলা হয়। সসীম অবতারের মধ্যে অনন্ত সৃষ্টিকে অনুভব করতে হলে তাঁর ঐশী লীলা ও জীবনকে জানতে ও বুঝতে হবে। এরপরও যদি মহান সৃষ্টিকৰ্তাকে ভাবতে ইচ্ছে করে তাঁকে দৃষ্টির গোচরীভূত সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে অনুভব করতে হবে, কিন্তু বাধা হচ্ছে সৃষ্টির সবকিছুকে আমরা পূৰ্ণাঙ্গরুপে দেখি না। মহাশূণ্য, পাতাল এবং সাগরের তলদেশের অনেক কিছু এবং আরও অসংখ্য বিষয় ও ব্যাপার মানুষের অজানা। নিরাকার ঈশ্বরের বিভূতি ঈশ্বর নিজেই আমাদের কাছে অজ্ঞাত করে রেখেছেন। জগৎ ব্রহ্মান্ড তো ঈশ্বরের শক্তির বহিঃপ্রকাশ। তাছাড়া ঈশ্বরের আকৃতির কোন রুপ তো নেই। তিনি তো নিরাকার। শুধু আচরণশীল ও ঐশী পথে জীবন চলনায় দিব্যজ্ঞানের অনুভূতিতে তাঁকে অনুভব করা যায়। একটু ভেবে দেখলে আমরা আমাদের সীমায়িত শক্তিকে বুঝতে পারি। আমরা বুঝতে পারি যে সাধক শ্রেণীর পুরুষগণের শক্তির কাছে আমাদের শক্তি কতই না হীন। সুতরাং অবতারপুরুষগণ যেহেতু অনন্ত অসীমের সসীম রুপ সুতরাং তাঁদের রঙে নিজেকে রাঙানো, তাঁদের চলনে নিজেকে চালানো এবং তাঁদের দৰ্শনে নিজে দেখা অনেক সহজ, যদি তাঁদের দেখানো পথে চলি।
মানুষ অনন্ত জ্ঞানের অধিকারী ও সৰ্বজ্ঞ পন্ডিত নয়, কোন দিন বা কোন কালে ছিলও না। জাগতিক জ্ঞানও মানুষ ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে অৰ্জন করে নিজেকে আপেক্ষিক জ্ঞানের আসরে বোদ্ধা বলে উপস্থাপিত করছে। দুনিয়াতে একদিন লেখার জন্য কাগজ, পড়ার জন্য কাপড়, রোগমুক্তির জন্য চিকিৎসা ছিল না। মানুষ গাছের লতা-পাতা ছেঁচে, পিষে খেয়ে সাধারণ রোগগুলো কোনরকমে সারাতো। মানুষ ধাপে ধাপে এগোচ্ছে। তাই নিজেকে মহাজ্ঞানী ভেবে পরমপুরুষকে উপেক্ষা করার কোন ইচ্ছা কাজে আসবে না।
দুনিয়ার বুকে চলতে, শিখতে, বাঁচতে ও বাঁচাতে হলে শিখতে হবে, চালক মনোনীত করতে হবে। আপ্ত পুরুষের শরণাপন্ন হতে হবে। যেমন শিখার জন্য স্কুলে যায়, ফসলের জন্য ভূমিতে যায়, জলের জন্য তার উৎসের কাছে যায়। এই যাওয়াটাকে অহংকার দিয়ে 'আসা' তে রুপান্তর করতে চাইলে হবে না। আমরা যতই বড় হই না কেন জমিতে আমাদেরকেই যেতে হয়। হিন্দুরা জমিকে তথা ধরিত্রীকে পূজাও করে।জমি আমাদের কাছে আসে না।তাই মহান ব্যক্তিদের সফলতার পেছনে ছিল গুরু বা চালক।গুরু বা চালকদের সাথে আবার আচার আচরণের নিয়ম রয়েছে। Spirit, সাধনা, শক্তি ইত্যাদিকে বিশ্বাস না করার উপায় নেই৷ যেমন সাধনা করতে করতে চোখে এমন শক্তি সঞ্চয় হয়, সেই চোখ দিয়ে অভিশাপগ্রস্থ হয়ে দুৰ্বৃত্ত ভস্ম হয়েছে এমন বহু কাহিনী রয়েছে৷ তেমনতর সাধনা করলে এখনও তা হয়৷ এই যে তেজ, এটি সাধনায় প্রাপ্তি সাপেক্ষ বিষয়৷ এটিকে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা দিয়ে যুক্তগ্রাহ্য করতে পারলে ভালো, আর না পারলে বিজ্ঞানের সাথে ফারাক থেকে যাবে৷ মৃত্যুতো ঈশ্বরের হাতে মানা হয়৷ ধ্যানী ঋষির অভিশাপে দুৰ্বৃত্ত যে মারা যায় সেটাতো ঋষির হাতে হয়ে গেল৷ তাই না? তাহলে ঈশ্বরকে বুঝব কিভাবে? এই যে শক্তি ঋষি লাভ করেছেন সেই শক্তিই হলো ঈশ্বর৷ তাহলে ঈশ্বর শক্তিময়, তিনি অনন্তমাত্রিক শক্তিরুপে বিরাজিত৷এই শক্তিকেই Spirit বলা হয়েছে৷তিনি দেহ আশ্রয় করে এসেছেন, হয়ত আবার আসবেনও৷দুনিয়ার বুকে এই শক্তিকে অস্বীকার করতে পারবে এমন কেউ নেই৷
চলবে
গুরুর সংজ্ঞা- নীচের লিংকে ক্লিক করুন