পূৰ্ণাঙ্গ ইষ্টভৃতি ও পুণ্য :প্রাসঙ্গিক কথা
অভাগী কৰ্মদোষে যেমন পরশপাথর অম্বেষণকারী প্রাপ্ত পাথর হারিয়ে প্রলাপ বকতে বকতে কাঁদছিল, ঠিক তেমনি "প্রেরিত পুরুষ স্বদেশে কুৎসামন্ডিত হয়ে...." আমাদেরকেও ভাগ্য বিড়ম্বনার কারণে কাঁদতে হচ্ছে এবং আরও হবে।
"অভ্যস্ত ধারণাভিভূত দৃষ্টি ও
শ্রদ্ধোষিত অনুবেদনী অনুচৰ্য্যাহীনতার দরুণই-
মহতের পরিবার, পরিজন ও পরিবেশ
সাধারনতঃ তাঁকে বুঝতে পারে না,
তাই, কথায় বলে-
প্রদীপের কোলেই আঁধার।"
আদৰ্শ বিনায়ক,পৃষ্ঠা # ২১।
"ঈশ্বর-প্রীতির ছদ্মবেশে যারা বিভেদকে জীইয়ে
রাখে, তারা পাপের পরমাশ্রয়।" (অনন্যধাম থেকে প্রকাশিত 'ইষ্টতপা' পত্রিকা হতে সংগৃহিত।)
- শ্রীশ্রীঠাকুর
"প্রকৃত গুরু যিনি, বেত্তাপুরুষ যিনি, তাঁর মধ্যে দোষ ও ভুল বলে কিছু থাকে না।"
আঃ প্রঃ ১১শ খন্ড, পৃষ্ঠা # ৫১
To be continued
********************
পূৰ্ণাঙ্গ ইষ্টভৃতি যেন পরশপাথর ৷ অপূৰ্ণাঙ্গ ইষ্টভৃতি কোন ফল দেবে না। কেউ ইচ্ছা করলে ফল না চাইতে পারেন। তবে পরমপুরুষের বাণী অনুসারে করার ফল আপনাকে অভিনন্দিত করবেই করবে। ধরুন কোন ধনাঢ্য ব্যক্তি পরমপিতাকে বলছেন, প্রভু! তুমি আমাকে অঢেল সম্পদ দিয়েছ, দুস্থ মানুষের জন্য আমি যেন কিছু করতে পারি সেই ভাবে আমাকে যোগ্য করে তোল, আমাকে মন দাও, পাত্র বিবেচনা করার শক্তি দাও । এটাতো কিছু চাওয়া হয়ে গেল। এই চাওয়া কি সকাম? না, এই চাওয়া সকাম নয়। এই জন্যে শ্রীশীঠাকুর নিষ্কাম কৰ্ম সম্পৰ্কে বললেন, "নিজের জন্য যা করা যায় তাই সকাম, আর অন্যের জন্য যা করা যায় তা-ই নিষ্কাম।" ধৰ্মাত্মা যুধিষ্ঠীরের শিক্ষা বচনও তাই -"পরের হিতকামনা করে যে বা পরের হিত সাধন করে যে সেই ব্যক্তিই সাধু।" দ্বাবিংশ বৰ্ষে পাবকপুরুষ শ্রীশ্রীঠাকুর আরও লিখলেন- "কারো জন্য কিছু না চাওয়াকেই নিষ্কাম বলে- শুধু তা- নয়কো।" তাছাড়া নিজের ন্যায্য চাহিদার ব্যাপারে চাওয়াও সকাম নয়। পরমপুরুষের বাণী সাধারণ কারো কথার সাথে তুলনা করা অশ্রেয়। তাছাড়া নিজের চাহিদা নাই ভেবে অন্যের অভাব ঘুচাবো না- এমন ভাবনা 'নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা' র সামিল৷ আজ নতুন কথা লিখছি৷ অনেক সময় পার হয়েছে৷
আজ4/15/2016 বহুদিন (প্রায় দু'বছর)অপেক্ষা করার পর মনে প্রেরণা আসাতে লেখা শুরু করলাম। আমার পরিবারের লোকেরা একটু একটু করে টাইপ করতে সহায়তা করে। আমরা কেউ টাইপিষ্ট নই, বাংলা টাইপিং softwareও সংগ্রহ করিনি, শধুমাত্র কয়েকটি portable keyboard এর মাধ্যমে সম্পূৰ্ণ ইংরেজী মাধ্যমের পড়ুয়ার মাধ্যমে বাংলা টাইপ করে লেখাগুলো এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। পড়ুয়ারা আমার আদরের মেয়ে। এর ফলে এরাও একটু একটু বাংলা শিখছে।
পরমপুরুষের বাণীর যদি গুরুত্ব থাকে, তাহলে বিশ লাইনের বাণীমন্ত্রের কিছু লাইন গুরুত্বপূৰ্ণ,আর কিছু লাইন গুরুত্বহীন, এমন হবে কেন?
আজ ১৯শে আগষ্ট, ২০১৮৷
প্রথমে উক্ত পূৰ্ণাঙ্গ ইষ্টভৃতি মন্ত্র সম্পৰ্কে লিখতে চাই। আমরা জানি শালগ্রাম ও শিলার মধ্যে যারা পাৰ্থক্য বুঝতে সক্ষম, তাঁরাই শালগ্রামে নারায়ণ জ্ঞানে পূজা করেন। সাধারণ মানুষের মত মনে হলেও পরমপুরুষ সাধারণ মানুষ নন। তাঁর ঐশী শক্তির পরশ অনুভব করে বহু সাধকতুল্য পুরুষ তা গোপন রাখতে চেয়েও পরবৰ্তীতে অকপটে লক্ষ মানুষের সামনে ব্যক্ত করে ফেলেছেন। পরমপুরুষের শক্তির অংশীদার কোন কালে কেউ হয়নি। তিনি ছাড়া আর কেউ উপাসনার আসনে থাকা সম্পূৰ্ণরুপে যুক্তিহীন এবং শ্রীশ্রীঠাকুর তা কোথাও বলে যাননি। পুরুষোত্তম আত্মজদ্বয়ের কেন্দ্রে পুরুষোত্তম ছাড়া আসনে আর কারো ছবি নেই। পরমতীৰ্থ হিমাইতপুরধামেও একই মূলনীতি চলমান রয়েছে। এইসব কেন্দ্রে প্রাৰ্থনাও একই রীতি মেনে করা হয়। রাম, কৃঞ্চ, বুদ্ধ, যীশু, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ প্রমুখ যুগাবতারগণের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। তাঁরই পবিত্র জন্মভূমি পরমতীৰ্থ হিমাইতপুরধাম, বিবেকবিতান, দেওঘর, বিহারে (পুরুষোত্তম আত্মজের সৎসঙ্গ কেন্দ্র)একই নীতি ও আদৰ্শ অনুসৃত হয়। পরমপুরুষের ঐশী বাণীই চূড়ান্ত। তবে তাঁর বাণীগুলো যাজন করতে হবে। যাজনের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে প্রচার একটি অঙ্গ। আর প্রচার করার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রয়োজন। শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় আমরা সবাই পরমপুরুষের কাজের জন্য সমৰ্থ নই। তাঁরই একটি বাণীতে আছে- "পরমপুরুষের কাজ করতে পূৰ্ব জন্মের সুকৃতি লাগে।" তাই তাঁর বাণী অনুসারে বলতে পারি, যে কারো পক্ষে তাঁর বাণী বুঝা এবং সেগুলোকে ফলিত রুপ দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি যত কিছুই হোন না কেন। ভগবান ভক্তকে গ্রহণ করেন। যেমন বিদুরকে গ্রহণ করেছিলেন শ্রীকৃঞ্চ।
ইষ্টভৃতি সম্পৰ্কে আমার মতামত, ব্যাখ্যা ও যাজন শুনে অনেকে বলেছেন আমি যেন বিষয়গুলো লিখি। তাই লিখতে চেষ্টা করছি। আমি দক্ষ লেখক নই, তবুও তাঁরা বলেছেন কথার ভাষায় লিখতে৷ তাই এই অৰ্বাচীন ব্যবহারিক দিককে তুলে ধরার জন্য লিখছি, সাহিত্য সৃষ্টি করতে নয়৷ তাছাড়া মানুষের অনৰ্থক বিরোধীতার বিষয় না বুঝাতে অত্যন্ত সরল, সাবলীল বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি৷ অনেকে একথাও বলেছেন, আমরা নাকি ভুল মন্ত্র জপে ইষ্টভৃতি করি, প্রাৰ্থনাও নাকি ভুলটি করি ইত্যাদি। ইষ্টভৃতি শুরুর ইতিহাস বেশ হৃদয়গ্রাহী এবং সেই ইতিহাস সংক্ষেপে পরে উল্লেখ করব। ৷৷.............. (চলবে)
এক কথায় জানতে চেষ্টা করব ইষ্টভৃতি কি?
উত্তর- ইষ্ট বা মঙ্গলের পথ প্রদৰ্শক যিনি, সেই ইষ্টগুরু তথা নামের নামীর ভরণ-পোষণের উদ্দেশ্যে পরম পবিত্র যজ্ঞ এবং তার সাথে পরমপুরুষের নিৰ্দেশিত ইষ্টভ্রাতা, ভূত ও পাড়া-পড়শীর সেবাযজ্ঞই হল ইষ্টভৃতি।
শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় -"যিনি আমাদের পরম কল্যাননিধান তিনিই ইষ্ট। আৰ্য্যগণ চিরদিন ইষ্টের পূজারী। ইষ্টপূজা তাঁদের নিত্য করণীয়.................।"
আমরা আৰ্য্যদের জীবন ধারাকে আৰ্দশ মান দণ্ড হিসাবে দেখি। আৰ্য্য শব্দের অৰ্থ - উন্নত বা শ্রেষ্ঠবংশজাত বা বনেদী ইত্যাদি। তাঁদের জীবন চলনা এতই কঠিন ও বিধি মাফিক ছিল যে, পঞ্চমহাযজ্ঞ তাঁদের নিত্য পালনীয় ছিল। আচার-আচরণ ছিল পবিত্র ও কঠোর। মুখ থেকে কথিত বচন ফিরিয়ে নেয়া যেতো না। মিথ্যাচার তাঁদের ছিল না। হানিকর কৰ্মে কঠিন প্রায়শ্চিত্তের বিধান ছিল। তাই তাঁরা উন্নত ছিলেন। দূৰ্বল চরিত্রের লোক তঁদের সামনে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। অৰ্থাৎ হীনকৰ্ম তাঁদের কাছে জায়েজ করা সম্ভব ছিল না। অন্যান্য অনেক জাতির মধ্যে আৰ্য্যদের সংযুক্তি ও উন্নত চলনার বৈশিষ্ট্য রয়েছে, শ্রীশ্রীঠাকুর তাও বলেছেন। কিন্তু আমরা যে মিথ্যাচারের মাধ্যমে মন্ত্রটি পরিবৰ্তন করে দিয়ে ইষ্টভৃতির ভাগবত স্পিরিট নষ্ট করে দিয়েছি৷ তাহলে আমরা কি আৰ্যাচারে রইলাম? মন্ত্রটি কি উদ্দেশ্য পরিবৰ্তন করা হয়েছে তা কি দুৰ্বোধ্য বিষয়? মন্ত্র পরিবৰ্তন, প্রাৰ্থনা ও বাণী পরিবৰ্তন ইত্যাদি করে সংহতিতে ভাঙ্গন আনা মহাপাপ কৰ্ম নয় কি? মহাপাপের ফল মহাধ্বংস নয় কি? অযথা বিভক্তি সৃষ্টি করে সঙ্গ, উৎসব, মন্দির ইত্যাদিতে দলাদলি, হানাহানি, প্রতিযোগীতা ইত্যাদির কবলে ফেলে ভক্ত-সজ্জন মানুষের মনে বিষম আঘাত দেয়ার পথ সৃষ্টি করা কি হয়নি?
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন- 'ইষ্টভৃতি পূৰ্বে ছিল, তবে স্বস্ত্যয়নী তাঁর নতুন সংযোজন।' স্বস্ত্যয়নী নিয়ে আলোচনা অন্যত্র করা যেতে পারে। স্বস্ত্যয়নী গ্রহণকারী লোকের সংখ্যাও খুব কম। এই বৰ্ণনা ইষ্টভৃতি নিয়ে। ইষ্টভৃতির পরিপূৰ্ণ পালনে পঞ্চমহাযজ্ঞ পরিপালিত হয়।ইষ্টভৃতি পূৰ্ণাঙ্গরূপে পরিপালনের ফলে ব্যষ্টি ও সামষ্টিক কল্যাণ সাধিত হতো৷ "দানে দুৰ্গতি খণ্ডন হয়" এটি তো সুপ্রাচীন বেদবাক্য। মানুষের দুৰ্গতি অপনোদনের পথ আমরাই তো বন্ধ করে দিলাম৷ আমাদের গন্ডীস্বাৰ্থী ও স্বাৰ্থবাজী মনোভাবের কারণে মহাপরিপূরণকারীর রাষ্ট্রোদ্ধার উপযোগী বেদ-বিধিকে পঙ্গু করে দিয়েছি৷ এই জন্যে বোধ হয় প্রাৰ্থনার "পুরুষোত্তম বন্দনা" টিও বাদ দেয়া হয়েছে, যাতে ব্যক্তি, দম্পতি, রাষ্ট্র উদ্ধার ইত্যাদি দায়িত্ব পালনমুখী বিষয় মানুষের মনের আড়াল হয়ে যায়৷ বিশ্বপিতার বিশ্বকল্যাণ প্রসবী দেব প্রকল্প যাতে খোঁড়া হয়ে যায়৷ পৃথিবীতে এমন লোকের আবিৰ্ভাব হবে, যারা পরমপুরুষের বাণীগুলো মন্থন করে অমৃত বের করে আনবে৷
বুঝার সুবিধার জন্য নিম্নে প্রশ্নোত্তর আকারে ইষ্টভৃতির নিয়মাবলী সম্পৰ্কে শ্রীশ্রীঠাকুরের দেয়া বিধান আমার ভাষায় উল্লেখ করলাম।
*ইষ্টভৃতি কখন নিবেদন করতে হয়?
উত্তর- সূৰ্যোদয়ের পূৰ্ব মুহূৰ্তে ইষ্টভৃতি নিবেদন করতে হয়। তা সম্ভব না হলে প্রাতঃকালীন প্রাৰ্থনার শেষেও ইষ্টভৃতি নিবেদন করলে হয়।
* যাঁরা রাত্রিকালীন চাকুরী করেন বা সন্ধ্যাকালীন কাজ করেন এবং ঘুমাতে যান রাত তিনটায় বা যাঁরা অসুস্থ এবং দেরীতে জাগেন, তাঁরা কখন ইষ্টভৃতি করবেন?
উত্তর- তাঁরা ঘুম থেকে উঠে স্নান করার পর প্রাৰ্থনা-আহ্নিক শেষে কিছু গ্রহণের পূৰ্বে ইষ্টভৃতি করবেন। এটি আমার নিজ মত।
*ইষ্টভৃতির পরিমান কত হওয়া বাঞ্চনীয়?
উত্তর-একবেলার আহাৰ্য্যানুপাতিক।
*কিভাবে ইষ্টভৃতি পূৰ্ণাঙ্গ হয়?
উত্তর- উপরে যে বিশ লাইনের ছড়াবাণী আছে, ঠিক সেভাবে নিবেদন করলে ইষ্টভৃতি পূৰ্ণাঙ্গ হবে।
*স্বামী-স্ত্রী দু'জন চাকুরী করলে কত পরিমান ইষ্টভৃতি নিবেদন করতে হয়?
উত্তর- একজনের একবেলার দ্বীগুণ।
*উপাৰ্জনহীন দীক্ষিত সন্তানগণের অৰ্থের উৎস কি হবে এবং কত পরিমান নিবেদন করবে?
উত্তর- যেহেতু ইষ্টভৃতি শুধুমাত্র আয় থেকে করার নিয়ম, সেহেতু সন্তানগণ উপাৰ্জন না করা পৰ্যন্ত মা-বাবার অংশ থেকেই কিছু নিয়ে ইষ্টভৃতি নিবেদন করবে।
*ইষ্টভৃতি কোথায় এবং কখন পাঠাতে হয়?
উত্তর- শ্রীশ্রীঠাকুরের স্থুল দেহে উপস্থিতির সময়ে তাঁর কাছেই ইষ্টভৃতি পাঠানো হতো। এখন শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণী ও নিৰ্দেশনা মাফিক পাঠাতে হবে। সেই নিৰ্দেশনা মিলানোর দায়িত্ব ভক্তকেই নিতে হবে। পরমপুরুষ সবকিছুই তাঁর বাণীতে বলে গিয়েছেন।
*পূৰ্ণাঙ্গ ইষ্টভৃতি করলে কি হয়?
উত্তর- শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় পূৰ্ণাঙ্গ ইষ্টভৃতি করলে যা হয়, তা পড়ে দেখুন-
ভিক্ষা করেও ইষ্টভৃতি জীবন যদি যায় রে তোর
করলে আৰ্য ছেলে ইষ্টভৃতি ছাড়িস না,
অযুত তীৰ্থ পৰ্যটনের ধৰ্ম, অৰ্থ, কাম, মোক্ষের
ফল তাহাতে মিলে। ঐ নিশানা ভুলিস না।
বিপদ আপদ বেড়া জালে যতই আসুক বিপদ আপদ
শক্তিই যদি পেতে চাস, যেমনই হোক প্রাণ-
শ্রদ্ধা ভরে ইষ্টভৃতি ইষ্টভৃতি আনেই আনে
নিত্য পালিস কাটবে পাশ। সবার পরিত্রাণ।
উক্ত শুভ ফল তখনই জীবনে ফলিত রুপ পরিগ্রহ করবে যখন পূৰ্ণাঙ্গ ইষ্টভৃতি নিবেদন করে কৰ্মে তথা বাস্তবে রুপদান করা হবে৷ অন্যথায় উক্ত আশীস প্রাপ্তিতে ঘাটতি থাকবেই৷ বিষয়টি কোৰ্স শেষ না করে ঔষধ সেবনের মত অবস্থার সাথে তুলনা করা যেতে পারে৷
*কিভাবে যথাৰ্থরুপে আমরা পূৰ্ণাঙ্গ ইষ্টভৃতি পরিপালন করতে পারি? পূৰ্ণাঙ্গ ইষ্টভৃতি কিভাবে নিবেদন করতে হয়?
উত্তর- উপরিলিখিত মন্ত্রটি পড়ে ইষ্টভৃতি নিবেদন করতে হয়। মন্ত্রটি পাঠের সময় নিজেকে আত্মবিশ্বাসী ভাবুন, মন্ত্রের শব্দগুলো এবং তার অৰ্থ আত্মপ্রত্যয়ের সাথে, আবেগমথিত হৃদয়ে এবং দীপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করুন। মন্ত্রের অৰ্থ হৃদয়ঙ্গম করুন৷ নিবেদন করার পর সেই মন্ত্রের কথাগুলোকে বাস্তব কৰ্মে রুপ দান করুন।
নিম্নে প্রদৰ্শিত শেষ লাইনের অৰ্থ পড়ে দেখলে দেখা যায় -"ইষ্ট-ভ্রাতাসহ, জীব-জগতের এ সেবা যজ্ঞে পারিপাৰ্শ্বিক যেন তৃপ্তি পায়।" বুকে হাত রেখে যদি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি, আমরা .00001% জনও কি পারিপাৰ্শ্বিক কল্যাণে কিছু নিবেদন করি? কখনও কি চিন্তা করে দেখি, প্রতিবেশীর দারিদ্র কিভাবে নিরসন করা যায়? শ্রীশ্রীঠাকুরের কনিষ্ঠ আত্মজদ্বয়ের প্রদানযোগ্য পবিত্র পাঞ্জা বইতে এবং পরমতীৰ্থ হিমাইতপুর কেন্দ্রিক দৈবী কৰ্মযজ্ঞের পুরোধা ঋত্বিকবৃন্দের পবিত্র পাঞ্জা বইতে শ্রীশ্রীঠাকুরের লৌকিক জীবদ্দশায় প্রচারিত, মুদ্রিত ও অনুমোদিত এই মন্ত্রটি আজও সত্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। তা হলেও আমরা কি তা পালন করি? ইষ্ট-ভ্রাতা ও জীব-জগতের কথা বাদ রাখলাম, পারিপাৰ্শ্বিককে কি তৃপ্তি দিলাম? ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে মন্ত্রে বললাম একটি, কাজ করলাম ভিন্নটি, এতে সাৰ্থকতা যা হওয়ার তা হবে কি? অন্যদের স্তম্ভগুলোর নাম শুনেননি। ওগুলো কি খেলার খেলা? আমাদের স্তম্ভ টম্ভ নেই কেন? কথা বলার সময় বোদ্ধা ভাব তো খুব দেখাতে জানি। জীবনে আত্মকেন্দ্রি কৰ্ম ও উপাৰ্জন দিয়ে নিজে ফিটফাট থাকলেই কি হলো? আত্মকেন্দ্রিক কৰ্ম ও ডালরুটির লেখাপড়া করলেন, কিন্তু বেদোক্ত দায়িত্ব পালনের লেখাপড়া শেখা কি প্রয়োজন ছিল না? প্রয়োজন যদি থাকতো সমাজে ছড়ালেন না কেন? অন্যান্যদের স্তম্ভগুলো দেখেও তো গুরুত্ব অনুভব করা প্রয়োজন ছিল।
পাবকপুরুষ অনুকূলচন্দ্র দায়িত্বপালনমুখী কঠিন আৰ্যাচারগুলো পালনের আহ্বান জানালেন-
ঋষি-যজ্ঞ, দেব-যজ্ঞ, নৃ-যজ্ঞ, পিতৃ-যজ্ঞ ও ভূত-যজ্ঞ। যজ্ঞ বলতে বুঝায় এদের সেবা করা। আগেকার দিনে কাক বলি, শিবাবলি, এসব হত। রান্নার জন্য চা’ল নেওয়ার সময় ওদেরও চা’ল নিত।
যজ্ঞ মানে বুঝলি কি তুই
আদর সেবায় যত্নে পালা,
আর্য্য ছেলের নিত্য নীতি
পঞ্চ যজ্ঞে জীবন ঢালা। শ্রীশ্রীঠাকুর।
পরমপুরুষ আমাদের এমন প্রস্তুতির কথা বলেছিলেন, যাতে আমাদের অপ্রস্তুতির জন্য কেউ যেন বঞ্চিত না হয়। কোন একটি বিপদ হলে দশটি মন্দির মিলে ৫ হাজার মানুষকে এক সপ্তাহ বাঁচানোর প্রস্তুতি আছে কি? তাহলে লক্ষ-কোটি মানুষের গতি কি হবে? হতে পারে অনেক মানুষের নিজে বাঁচার যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে। কিন্তু অন্যকে নিয়ে বাঁচতে পারার যোগ্যতা না থাকলে বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার কারণ সবাইকে নিয়েই সবার অস্তিত্ব অটুট রয়েছে।
এই জন্যে পরমপুরুষ বললেন- বিধির নীতি পালবি যেমন *খাম খেয়ালে ভজলে গুরু * সবচেয়ে তোর বড় ধান্ধা
যতটা বা যতটুকু, হতে মানুষ হলি গরু। ইষ্টভৃতি হলে-
কেটে ছেটে সব মিলিয়ে তখন থেকে দেখতে পাবি
পাবিও ফল ততটুকু। জীবন কেমন ফলে।
অনেকে ইষ্টভৃতি নিয়ে লিখেছেন। বিশ লাইনের ছড়া বাণীটি শুধু উল্লেখ করেছেন, বিস্তৃত ব্যাখ্যা চোখে পড়েনি। পরমপুরুষের বাণীর যদি গুরুত্ব থাকে, তাহলে বিশ লাইনের ঐশী বাণীর কিছু লাইন গুরুত্বপূৰ্ণ, আর কিছু লাইন গুরুত্বহীন, এমন হবে কেন?
শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় একসময় আৰ্য্য সমাজ তথা পুরো আৰ্য্যাবৰ্ত যজ্ঞময় ছিল। তিনি আমাদেরকে সমাধান দিয়ে গেছেন, অথচ আমরা তাঁকে উপেক্ষা করে চলেছি। যে গাছ থেকে ফল আসে সে গাছের যেমন পরিচৰ্যা করতে হয়, তেমনি পরিচৰ্যাহীনতার কারণে সমাজ যদি শক্তিশালী ও মজবুত না হয় তখন আপনার, সবার অবস্থান দূৰ্বল হয়ে যাবে। এই দূৰ্বলতা শুধু এক সম্প্রদায়মুখী নয়, এটা রাষ্ট্রকে পৰ্যন্ত ছুঁতে পারে।
তিনি তো বিশ্বকে জাগাতে বলেছেন। পরমপুরুষের প্রকল্প হবে বিশ্বকল্যানমুখী। বিশ্বজনীন বিষয়কে আমরা পারিবারিকীকরণ করব কেন?
আমরা গণ্ডীস্বাৰ্থী হব কেন? যে বাণী বিকৃত এবং বৃহত্তর কল্যাণ বিরোধী তা মানুষ মানবে কেন? পরমপুরুষ শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর বাণী পরিবৰ্তনের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করেছিলেন। তখন তিনি বাৰ্ধক্যের ভারে অবসন্ন দেহে শুধুই আপসোস প্রকাশ করছিলেন। বাৰ্ধক্যকালীন সময়ে তিনি যে অন্নগ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন, হতে পারে তা এসবের প্রতিবাদস্বরূপ করেছিলেন। প্রচন্ড মানসিক অস্থিরতা এবং আত্মধিক্কার প্রকাশের মত আচরণ করছিলেন (প্রেমের যমুনা কাঁদিয়া আকুল গ্রন্থ দ্রঃ, প্রত্যক্ষ দৰ্শীর বিবরণ ও তাঁরই কনিষ্ঠ আত্মজের বিবরণ)। ঐসময়ে তাঁর মানসিক চিকিৎসার জন্য যে চিকিৎসক আনা হয়েছিল, সেই চিকিৎসকগণ তাঁর মনবৈকল্যের কিছুই খুঁজে পাননি।
ভিক্ষুক ভিক্ষা চায় নিজের জন্য। পরমপুরুষ মানুষ ভিক্ষা, অৰ্থ ভিক্ষা চেয়েছিলেন। আর তিনি বলেছেন, তিনি ভিক্ষা চান আমাদের মঙ্গলের জন্য ও অস্থিত্ব রক্ষা করার জন্য।(দেবভিক্ষা বাণী দ্রঃ)
*পূৰ্ণাঙ্গ ইষ্টভৃতি করতে হলে আর কি কি করতে হবে?
উত্তর- যেহেতু মন্ত্রের ভাষার মধ্যে " ইষ্টভ্রাতৃভূতযজ্ঞৈস্থৃপ্যন্তু পারিপাৰ্শ্বিকাঃ" ঐশী শব্দগুলো আছে এবং নিবেদনের সময় সেই শব্দগুলো আমি উচ্চারণ করছি, সৰ্বোপরি ২০ লাইনের ছড়ামন্ত্রে উল্লেখ রয়েছে এসবকিছু নিয়েই ইষ্টভৃতি পূৰ্ণ হয়, সেহেতু ইষ্টভৃতি নিবেদনের সময় ভ্রাতা ও পারিপাৰ্শ্বিক অংশও প্রতিদিন একসাথে নিবেদন করতে হবে। মঙ্গল অৰ্থব্যঞ্জক যে শব্দরাশি দিবসের শুরুতে উচ্চারণ করছি এবং তাকে সাৰ্থক করে তুলতে না পারলে সেই উচ্চারণের কি সাৰ্থকতা রইল? একশ্রেণীর মানুষ অত্যন্ত সুকৌশলে এই মন্ত্র ও দৰ্শনের ভিতর বিকৃতি মিশিয়ে, মন্ত্রটি পরিবৰ্তন করে দিয়ে পরম মঙ্গলের স্পিরিটটি নষ্ট করে দিয়েছেন। এসব লোকের জীবনের সাথে পরমপুরুষের পরমতত্ত্বের কোন সম্পৰ্ক নেই। আমি শ্রদ্ধাপূৰ্ণ চিত্তে আবেদন রেখে যেতে চাই, সঠিক মন্ত্রটি চালু করলে এবং দীক্ষিত ব্যক্তিদের জানিয়ে দিলে কোন সমস্যা হবে না। পরমভক্ত শ্রী সতীশচন্দ্র গোস্বামী তো তাঁর শিষ্যদের পুনরায় শ্রীশ্রীঠাকুরের চরণে সমৰ্পন করেছিলেন। এতে তাঁর মৰ্যাদা অক্ষুন্ন ছিল। মনে রাখা বাঞ্চনীয়, এই নিবেদন বা সেবা আপন কল্যাণের তরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অৰ্জন। বিকৃতি দিয়ে এর শ্রেষ্ঠত্ব অটুট থাকবে না। বিভক্তির নিরসন না হলে মনে একটি ক্লেশ বা অসূয়া যেন লেগেই থাকে। আর অসূয়া ভাব নিয়ে চললে ধৰ্ম পালনে অশুভ সৃষ্টি হয়। আমরা সকলে সংক্ষিপ্ত সময় শেষে ইহ জগৎ ত্যাগ করব, কিন্তু পরমপুরুষের দৰ্শন হাজার হাজার বছর ধরে বহমান থাকবে।
*ভ্রাতা ও পারিপাৰ্শ্বিক অংশ কি পরিমানে রাখতে হবে?
উত্তর- নিজের সামৰ্থ্য মত রাখাই যুক্তিসংগত। সামৰ্থ্যের অপলাপ করা পাপবিদ্ধ আচরণ।
*তারপর কি করতে হবে?
উত্তর-একমাস পূৰ্ণ হলে ইষ্টের অংশ তাঁরই নিৰ্দেশনা মাফিক পাঠিয়ে দিতে হবে। ভ্রাতা ও পারিপাৰ্শ্বিক অংশ হতে ভ্রাতার জন্য (গুরুভ্রাতা বা গুরুজন) দু'টি ভুজ্যি দান করতে হয়। তারপর পারিপাৰ্শ্বিক অংশ দিয়ে স্থানীয় পারিপাৰ্শ্বিকদের বিপদ আপদে সাহায্য স্বরূপ দিতে হয়। একটি গ্রামে যদি তিনশত দীক্ষিত পরিবার থাকে এবং তারা সকলে মিলে পারিপাৰ্শ্বিক তহবিল গঠন করে তাঁদের সমাজের অনেক কল্যাণ করতে পারেন। এই পরিধি আরও বিস্তৃত করা যায়। এইভাবে সেবা, যজ্ঞ, দান ও ইষ্টপ্রাণতার মাধ্যমে মানব সমাজ দেব সমাজে রুপান্তরিত হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে।
*এই ঐশী দান ও সেবা শ্রেষ্ঠ অৰ্জন কিভাবে হলো?
উত্তর- প্রথমত স্বামী-স্ত্রী এবং নিজের সন্তান-সন্ততি ও মা বাবা নিয়ে নিজ পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। তারপর পরিবেশ পারিপাৰ্শ্বিকের সেবাকে শ্রেষ্ঠ সেবা বলা হয়েছে। প্রাৰ্থনা বইতে দীৰ্ঘ প্রাৰ্থনার মাঝখানে একটি অংশে আছে -
"নিজের নিজ পরিবারের
ব্যষ্টিসহ পরিবেশের
পালন পোষণ হয় যেন
শ্রেষ্ঠ নীতি এই জীবনের।"
অনুশ্রুতি।
পৃথিবীর সমৃদ্ধশালী দেশগুলোতে এই সব নিয়ম ব্যাপকভাবে পালন করা হয়। এই কাজগুলোর পরিধি এতই ব্যাপক যে, তা দুই শত শব্দেও বলা সম্ভব নয় ।
এখানে একটি প্রাকৃতিক শক্তি কাজ করে। এই ব্যাপারটি পৃথিবীর অনেক জাতি-গোষ্ঠী বিশ্বাস করে। বিষয়টি হলো - যে ভালো কাজটি করা হবে, সেটি তার জন্যে ভালো হয়ে ফিরে আসবে।
শ্রীশ্রীঠাকুরের লীলাসঙ্গী শরৎদা'কে (শরৎচন্দ্র হালদার) কে যেন অনেকটা এভাবেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "শরৎদা, আপনি শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে দীৰ্ঘ দিন আশ্রমে অতিবাহিত করেছেন, আপনি শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে কি পেলেন?
শরৎদা বললেন, " শ্রীশ্রীঠাকুরের একটি বাণীর অৰ্থ বুঝতেই আমার বারো বছর লেগে গেল।"
অন্যান্য অনেক কথার শেষে শরৎদা বললেন, "আমি সংক্ষেপে বলতে পারি শ্রীশ্রীঠাকুরের এতটুকু অঙ্গুলী বাঁকানোয় মঙ্গল নিহিত থাকত।"
আমাদের চলন-বলন, হাব-ভাব, যোগ্যতা দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছিলেন,
".......তোরা একটি সেবাশ্রম মত করে
থাকতে পারবি, তাতে পেটের পূজো হবে,
তবে জানের পূজো হবে না।"
ঠিকই বলেছিলেন তিনি, আর আমরা সেবাশ্রমও গড়ে তুলতে পারলাম না। ক্লাব সৰ্বস্ব কিছু ইট পাথরের ঘর হলেও সেখানে সেবা চালু করার যোগ্যতাও আমাদের নেই।
তিনি যে বিধান দিলেন তাতে উল্লেখ রয়েছে -
"ব্যক্তি, দম্পতি, গৃহ, সমাজ, রাষ্ট্রোদ্ধারণে
যজন, যাজনেষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়নী প্রবৰ্ত্তকম্।" অনুবাদ -ব্যক্তি, দম্পতি, গৃহ, সমাজ ও রাষ্ট্র উদ্ধার করতে যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়নী প্রবৰ্ত্তনকারী।
আশ্রমগুলো অনুকূল প্রকল্প হাতে নিয়ে দুৰ্বার গতিতে এগিয়ে না চললে রাষ্ট্র নয়, গ্রাম পরিবৰ্তন করাও সম্ভব হবে না।
প্রবুদ্ধ ভক্তদের শানিত চেতনায় শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীগুলো মন্ত্ররুপে ধরা পড়েছে। 'স্বাতী নক্ষত্রের জল পাত্র বিশেষে ফল' দেয়ার মত। ভালই হয়েছে, আমরা প্রেরণা পেলাম, কিন্তু প্রেরণা আর এগিয়ে গেল না।
ইষ্টভৃতির ছড়া মন্ত্রটি ২০ লাইনের। উল্লেখিত ছড়ামন্ত্রের ভাষা না বুঝার কথা নয়। আমরা কথা বলার সময় রকেট সায়েন্সের ব্যাখ্যা বুঝায় এবং বুঝি অথচ যুগাবতারগণের হিতোপদেশ বুঝি না। উক্ত ইষ্টভৃতি পূৰ্ণাঙ্গভাবে পালন করা কষ্টসাধ্য বিষয় নয়। ব্যক্তিজীবনে এবং সমষ্টিজীবনে উন্নতি লাভ করা কষ্টসাধ্য, তা অনায়াসে আসে না। সুতারাং উন্নতির নিয়ামক বা চাবি যে ইষ্টভৃতি, তা পরিপালনে ত্রূটি থাকলে উন্নতিও অট্টহাসি হাসবে, আর সমাজ যাবে রসাতলে। আর সমাজ রসাতলে যাওয়ার স্রোতে সবাই সেই স্রোতের টানে ভেসে যাবে। একবার একজন লোক এক ধনাঢ্য ব্যক্তিকে বলেছিল, আপনি চাইলে কয়েক লক্ষ টাকা দিয়ে একটি বিবাহ কল্যাণ তহবিল গঠন করে দিতে পারেন। ৮০ বছরের পুরোনো ভবন দেখিয়ে দিয়ে বলেছিল, আপনার এই ভবনের ইটগুলো একদিন ওরকম লাল ও ক্ষয় হয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়বে। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'ছেলেদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।' কিছুদিন পর তাঁর পরিবারে একটি মৰ্মন্তুদ ঘটণা ঘটলো। শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে বহু মানুষ এসেছিলেন মৃত্যুকে হাতের তালুতে নিয়ে। শ্রীশ্রীঠাকুর তখন সুবিচার করেছেন। তাঁর কাছে এসেছেন যখন এবং রক্ষার আৰ্তি যখন জানালেন, তখন তিনি তাদের রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়েছেন। যারা তাঁর কথা শুনেছেন, তারা রক্ষা পেয়েছেন। শ্রীশ্রীঠাকুর কাউকে বলতেন ৫০ মণ লোহা দান করতে, আবার কাউকে বলতেন ৪০ মণ চাউল দান করতে। কাউকে বলতেন কোন লাভজনক পেশা পরিবৰ্তন করতে। কখনও মৃতপ্রায় সন্তানের কাছে পিতাকে যেতে বাধা দিয়ে রেখেছেন। শেষ দেখা গেল ঐ মৃতপ্রায় সন্তান যমের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
* প্রশ্ন- ধৰ্ম করতে হলে দান করতে হবে কেন? তাহলে ধৰ্ম করতে হলে ইষ্টকেও দিতে হবে কেন? আবার দানের কথা বলে স্বাৰ্থভাব উসকে দিয়ে ধৰ্ম পথে আনার প্রচেষ্টা বলে দাবী করা হবে কেন?
উত্তর- যাঁরা বুঝেন, তাঁরা এমনিতেই বুঝেন, তারপরও বলছি- মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পৰ্যন্ত তার কাছে অন্যের সাহায্য লাগে৷ সাহায্যের এই ধারাকে কেউ ধৰ্ম বলে, কেউ সমাজ সেবা বলে, আর কেউ পরোপকার বলে৷ এইগুলো চালু না থাকলে বিপদে কাউকে পাওয়া যাবে না৷ সেবাগ্রহণকারী না হয়ে, সেবাদানকারী হওয়ার চেষ্টা করবে সবাই৷ সেবাদানকারী সেবাগ্রহণের চাইতে অধিক দান করবেন৷ এটি হতে হলে দানকারী হওয়ার যোগ্যতা অৰ্জনের রূপরেখা জানতে হবে৷ এই রুপরেখার অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে নিজে অন্যকে দান করা একটি বিষয়৷ নিজের কাছে না থাকলে ভিক্ষা করে অন্যের উপকার বা মঙ্গল করা যায়৷ শ্রীশ্রীঠাকুর চেয়েছেন মানুষের যোগ্যতার উদ্বৰ্দ্ধন ঘটাতে। অভাবীজন নিজেই দান করবেন অভাব থেকে দাতা হয়ে উঠতে।
* কিভাবে পাড়াপড়শীর সেবার বৃহত্তর উপায় বের করা যায়?
উত্তর- পরমপুরুষের ঐশী বাণীমন্ত্রটি নীচে আবার উল্লেখ করছি। গুরুত্ব সহকারে পড়ে দেখুন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের এই ব্রত বা বিধি বা ঐশী নিয়ম বা বাঁচার পদ্ধতি যদি রাষ্ট্রোদ্ধার উপযোগী করে পরিপালন করতে চাই, তাহলে তার গুরুত্ব হতে হবে ব্যাপক এবং পরিপালনী কৌশল হতে হবে গভীর।
"ব্যক্তি, দম্পতি, গৃহ, সমাজ রাষ্ট্রোদ্ধারণে
যজন, যাজনেষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়নী প্রবৰ্ত্তকম্।"
ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে কি আকাশে উড়া যায়? আকাশে উড়তে হলে ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন লাগে। তেমনি পরমপুরুষের বাণী নিয়ে ভাবতে, করতে ও চলতে হলে সেই উচ্চতার কৰ্মপরিকল্পনা ও রুপরেখা চাই। আমরা কয়েকটি শুরু করেছি, কিছু আলোকিত লোক সৌভাগ্যক্রমে তাতে সন্মিলিত হয়েছেন। কিন্তু সেটিকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার গতি বেগবান হচ্ছে না। সমাজের লোকদের জাগাতে হবে। সমাজবিজ্ঞান বুঝাতে হবে, পড়াতে হবে। সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব কমে গেলে সমাজ রসাতলে যায়। তখন নিন্দিত বিষয়কে স্বাগতম জানাতে বাধ্য হতে হয়। আপদ-ধৰ্ম তখন নিত্যপালনীয় হয়ে উঠে।
একটি সম্প্রদায় ক্ষয়িষ্ণু হবার পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে সামাজিক সংহতিহীনতা, অসিষ্ণুতা, পালন-পোষণহীনতা, বিভক্তি, নিন্দাবাদ, ঘৃণা, শোষণ ইত্যাদি বিষয় থাকে। এই বিষয়গুলোর ক্ষত অনেকাংশে লাঘব করা যায়, যদি প্রতি প্রত্যেকে পরমপুরুষের দেয়া বিধি বিধান মেনে চলেন। কতিপয় দানবীর স্কুল, কলেজ কত কিছুই না করছেন, কিন্তু সবার অংশগ্রহণ না হওয়ার কারণে দান, সেবা ও যজ্ঞ (দান যজ্ঞ) ইত্যাদির সুফল মানুষের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছায় না। সমাজে অভাব নেই এটা সত্য নয়। বহু ধরনের অভাব নিয়ে মানুষ এখনও দিশেহারা অবস্থায় আছে। এখনও আমার কাছে মেয়ের বিবাহে সাহায্যের জন্য কয়েকজন অনুরোধ জানিয়ে রেখেছেন, আমার মাকেও বলেছেন।
আমাদের সমাজের রোগ কোথায় তা অনেক প্রবীন বোদ্ধা লোকের কাছে শুনেছি। তাঁরা অনেক সময় বলেছেন, একটি বিষয় খুব কঠিন। সেটি হল, মন আর মুখ এক করা। তারপর বলতেন, মানুষ (সবাই নয়) যা ভাবে- তা বলে না, আর যা বলে - তা করে না। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মহামারীর মত ধ্বংসাত্মক। এই বৈশিষ্ট্য যেখানে যত প্রবল, উন্নতি সেখানে তত দূৰ্বল। দেখুন না বেদের শিক্ষা কি, আর আমরা কি করছি, বলছি! ঘরে-ঘরে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, পিতা-পুত্রে চলছে বিশ্বাস ঘাতকতা। চলছে মন্থরার মত কুচক্রী মহলের কু-চাল। ভালো থাকার, ভালো করার সুযোগ ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। দেব -দূৰ্লভ কৰ্মকান্ড থামিয়ে দেয়া হচ্ছে অথবা কলঙ্ক লিপ্ত করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পবিত্র বেদের একটি মন্ত্র পুনরায় উল্লেখ করছি-
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্।
সমানং মন্ত্রমতিমন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বো হবিষা জুহোমি ।। ঋগ্ বেদ।
অৰ্থঃ- তোমাদের মন্ত্র সমান হোক, সমাজব্যবস্হা সমান হোক, মন এবং চেতনা সমান হোক, তোমাদিগকে সমান মন্ত্রই বলছি, সমান হবিঃ দ্বারা আহুতি প্রদান করছি ।
পরমপুরুষের কন্ঠে ধ্বনিত হল অস্তি ও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মানুষ ও কৃষ্টিকে বাঁচানোর উদাত্ত আহ্বান। আমরা তাঁর আহ্বানে বিমুখ হয়ে রইলাম। এখানে সম্প্রদায়গত বিভাজনের চিন্তায় ভাবার কোন সুযোগ নেই। যে মেয়েটি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে সীমাহীন দুঃখের পথে কষ্ট পাচ্ছে বা যে মা টি কিছু দিন অভূক্ত থাকার পর রক্ত বিক্রি করে সন্তানের জন্য খাবার কিনে আনছে সেই মানুষগুলোর পরিচয় যদি জাতিগত হিসাবে করা হয় এবং পক্ষপাতের শিকারে ফেলে সাহায্য করা হয়,সেটি হবে একটি শ্রেষ্ঠ পাপাচার।
ধৰ্ম পালনের ফলে জাগতিক উন্নয়ন হওয়া গন্ধযুক্ত কে বলেছে? বরং নুন আনতে যার পান্থা ফুরোয় তার ধৰ্ম সাধনা দূৰ্বল। শ্রীশ্রীঠাকুরও চেয়েছেন সবাই যেন সচ্চল হয়ে উঠে। তিনি সাহায্যকারী বানাতে চেয়েছেন, সাহায্যপ্রাৰ্থী নয়। প্রতি প্রত্যেককে যোগ্য করে তুলতে চেয়েছেন। সেবা, দান, উপকার ইত্যাদি করার ফলে গরীব লোক ধনী হয়ে উঠে। প্রত্যেকে যেন জমি-জমা, কৃষি ভরা হয়ে উঠতে পারেন তার জন্যে শ্রীশ্রীঠাকুর একটি ছড়া বাণীতে বলেছেন-
জমিজমা কৃষিভরা
ধান্য গোধূম শালী
প্রলয়েও সে নষ্ট না পায়
যাপে স্বজন পালী।
সত্তার বিদ্যমানতাকে সাৰ্বিকভাবে পোষণ দিতে হলে পরোপকারের ব্যাপক আয়োজন প্রয়োজন। এই ভাবে করা ছাড়া ব্যষ্টি ও সমষ্টিগত তথা জাতীয় উন্নতি লাভের খাঁটি পথ আর নেই। উন্নত দেশ সমূহ সেই কাজগুলোকে অবহেলা করে না। তাঁরা যা কিছু করেন, সবকিছু ব্যাকরণ মেনেই করেন, তাই পরম শক্তির আশীৰ্ব্বাদ তাঁদের উপর বৰ্ষিত হতেই থাকে। এই সব কিছু ঠিকভাবে চালু করতে হলে গবেষণা প্রয়োজন। দুুৰ্বল গুণ সম্পন্ন জনগোষ্ঠীর পক্ষে এসবের মধ্যে পরিপূৰ্ণতা আনা সম্ভব নয়। অহংকারী ধনীর ধন বেশী কাল স্থায়ী হয় না। তার অজান্তেই তার আম ও থলে দু'টোই যায়।
...................... চলবে
পঞ্চবর্হি ও সপ্তার্চ্চি সম্পৰ্কে শ্রীশ্রীঠাকুরের দীপ্ত ভাষায় স্পষ্ট বলা আছে অথচ সেগুলো বাদ দেয়া কি শ্রেয় হল?
শ্রীশ্রীঠাকুর- পঞ্চবর্হিঃ বা পঞ্চাগ্নির উপর দাঁড়িয়ে কিছু লোক যদি জোরদার ভাবে দানা বেঁধে ওঠে, তবে সেই জীয়ন্ত দানাই ক্রমশঃ আরো বিস্তৃত ও শক্তিমান হয়ে ওঠে বহু সমস্যার সমাধান দিতে পারে। তোমাদের সৎসঙ্গের প্রাণশক্তি অতুলনীয়। যা আছে সেই সংগে আরো কতকগুলি দেবদক্ষ কর্মী যদি সব ছেড়ে-ছুড়ে দি’য়ে পাগলের মতো নাছোরবান্দা হ’য়ে লাগত-অন্য কোন পিছুটান না রেখে, ইষ্টচিন্তা,ইষ্টকর্ম ও লোকহিতই যদি হ’তো তাদের একমাত্র ধ্যান, জ্ঞান, ধান্দা ও তপস্যা, তবে ঢের হতে পারতো, সবাই পেতে তার সুফল। তারাও পরম প্রাপ্তির অধিকারী হতো।
পঞ্চবর্হিঃ, সপ্তাৰ্চ্চি, হলো আৰ্য্যকৃষ্টির মেরুদণ্ড... এগুলির রোজ স্মরণ করতে হয়। স্মরণ করা মানে শুধু চিন্তা করা নয়।
“হিন্দুমাত্রেরই পঞ্চবর্হি বা পঞ্চাগ্নি স্বীকার্য্য-তবেই সে সনাতন হিন্দু, হিন্দুর হিন্দুত্বের সর্ব্বজনগ্রহনীয় মূল শরণ-মন্ত্র ইহাই! পঞ্চবর্হি যেমন প্রত্যেক হিন্দুর স্বীকার্য ও গ্রহনীয়,সপ্তার্চ্চিও তেমন প্রতি মানবের অনুসরণীয় ও পালনীয়”!-পুন্য-পুঁথি (১ম সংস্করণ)
পঞ্চবর্হি
১।একমেবাদ্বিতীয়ং শরণম্।
২।পূর্ব্বেষামাপূরয়িতারঃ প্রবুদ্ধা ঋষয়ঃ শরণম্।
৩।তদ্বাৰ্ত্মানুবৰ্ত্তিনঃ পিতরঃ শরণম্।
৪।সত্তানুগুনা বর্নাশ্রমাঃ শরণম্
৫।পূৰ্ব্বাপুরকো বর্ত্তমানঃ পুরুষোত্তমঃ শরণম্,
এতদেবার্য্যায়ণম্, এষ এব সদ্বৰ্ম্মঃ,
এতদেব শাশ্বতং শরণ্যম্।
* অনুবাদ *
১। এক অদ্বিতীয়ের শরণ লইতেছি।
২। পূৰ্ব্বপূরণকারী প্রবুদ্ধ ঋষিগণের শরণ লইতেছি।
৩। তাঁহাদের পথ অনুসরণকারী পিতৃপুরুষগণের শরণ লইতেছি।
৪। সত্তা বা অস্থিত্বের গুণপরিপোষক বৰ্ণাশ্রমের শরণ লইতেছি।
৫।পূৰ্ব্ব-পূরণকারী বৰ্তমান পুরুষোত্তমের শরণ লইতেছি। ইহাই আৰ্য্য পথ,
ইহাই জীবনীয় ধৰ্ম, ইহাই চিরন্তন শরণযোগ্য।
সপ্তার্চ্চি
১।নোপাস্যমন্যদ্ ব্রহ্মনো ব্রহ্মৈকমেবাদ্বিতীয়ম্।
২।তথাগতাস্তদ্বাৰ্ত্তিকা অভেদা।
৩।তথাগতাগ্র্যোহি বর্তমানঃ পুরুষোত্তমঃ।
পূর্বেষামাপুরয়িতার বিশিষ্ট বিশেষ বিগ্রহঃ।
৪।তদনুকূলশাসনং হ্যনুসৰ্ত্তব্যন্নেতরৎ।
৫।শিষ্টাপ্তবেদপিতৃপরলোকদেবাঃ শ্রদ্ধেয়া নাপোহ্যাঃ।
৬।সদাচারা বর্ণাশ্রমানুগজীবনবৰ্দ্ধনা নিত্যং পালনীয়াঃ।
৭।বিহিতসবৰ্ণানুলোমাচারাঃ পরমোৎকৰ্ষ হেতবঃ স্বভাবপরিদ্ধংসিনস্তু প্রতিলোমাচারাঃ।
বন্দে পুরুষোত্তমম্, বন্দে পুরুষোত্তমম্,
বন্দে পুরুষোত্তমম্।
*অনুবাদ*
১। ব্রহ্ম ভিন্ন আর কেহ উপাস্য নহে - ব্রহ্ম এক অদ্বিতীয়।
২। তাঁহার বাৰ্তাবহনকারী তথাগতগণ অভিন্ন।
৩। বৰ্ত্তমান পুরুষোত্তম তথাগতগণের অগ্রণী এবং তিনি পূৰ্ব পূৰ্ব তথাগতগণের আপূরণকারী বিশেষ বিশিষ্ট নরবিগ্রহ।
৪। তাঁহার অনুকূল শাসনই অনুসরণীয়।
৫। ঋষি-অনুশাসিত প্রামাণ্য জ্ঞান, পিতৃপুরুষ, পরলোক, দেবতাগণ শ্রদ্ধেয়-অবহেলার যোগ্য নহে।
৬। বৰ্ণাশ্রমের অনুকূল বাঁচাবাড়ার পরিপোষক সদাচার সমূহ নিত্যপালনীয়।
৭। বিহিত সবৰ্ণ এবং অনুলোমক্রমিক আচার (বিবাহাদি) সমূহ পরম উৎকৰ্ষের কারণ-প্রতিলোম আচার স্বভাব ধ্বংসকারী।