সংক্ষিপ্ত প্রাক্ কথন
১৯৭৩ - ৭৪ সালে পরমারাধ্য পিতৃদেবের হাত ধরে বিভিন্ন গ্রামে সৎসঙ্গ অধিবেশনে যোগদান এবং তথায় শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীহস্ত লিখিত সত্যানুসরণ, পুণ্য-পুঁথি পাঠ ইত্যাদি শুরু হয়। তখনও দীক্ষাগ্রহণ হয়নি। মাতৃদেবীর অনুশাসনে তদীয় গুরুদেব শ্রীমৎ স্বামী অদ্ধৈতানন্দ পুরীমহারাজের প্রাৰ্থনা মন্ত্রাদি অনুশীলন করা হতো। ১৯৭৬ সালে পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বাৰ্তাবাহী শ্রদ্ধেয় ঋত্বিক শ্রী মনমোহন চক্রবৰ্ত্তীর নিকট দীক্ষা নেয়ার জন্য বাবা নিজগৃহে ছোট উৎসবের আয়োজন করেন। আমার দীক্ষানুষ্ঠানে বাবার যাজনে উৎসাহী হয়ে আরও ২৩ জন নর-নারী দীক্ষা নিয়েছিলেন। আমরা কূলমালিককে চিনি বা চিনতে চেষ্টা করি। আমরা তো তাঁরই উৎক্ষেপ। সুতরাং এই বক্তব্যের কৰ্তা, অকৰ্তা সবই আপেক্ষিক।
অনেক প্রবীন-প্রবুদ্ধ ঋত্বিকদেবতার আগমন ঘটেছে আমাদের কুটিরে। বাবার সেবা ও ভক্তিতে তাঁরা যার-পর-নাই তৃপ্ত হতেন। তাঁদের আশীৰ্ব্বাদ লাভ করেছি অনেকভাবে।
একবার শ্রদ্ধেয় ঋত্বিক মোহনদা .......................
সঙ্গ, উৎসব ইত্যাদি উপলক্ষে আমাদের গৃহে এসেছেন সৰ্বশ্রদ্ধেয়/শ্রী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জে এম সেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ চন্দ্রনাথ চক্রবৰ্ওী, শ্রদ্ধেয় বিনায়ক চক্রবৰ্ত্তী, মহেন্দ্রলাল ভট্টাচাৰ্য্য, মনমোহন চক্রবৰ্ত্তী, সুখেন্দু বিকাশ চক্রবৰ্ত্তী, অধ্যাপক সুধীর রঞ্জন চৌধুরী, মোহনদা, মনোরঞ্জনদা, চিন্তাহরণ মালো, প্রিয়তোষ দত্ত মহোদয় সহ স্হানীয় অনেক ঋত্বিকবৃন্দ।
ছাত্র জীবন থেকেই দেশের অনেক জেলা-উপজেলায়, শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্ন উৎসব অধিবেশন ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে যুগাবতার শ্রীশ্রীঠাকুরের দীপ্ত জীবন ও ধৰ্ম দৰ্শনের উপর বিভিন্নমুখী ও আবেদনমূলক বক্তৃতা, যাজন, লেখনী, শ্লোগান, যাজন পরিক্রমা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজকে সমৃদ্ধ করার তীব্র প্রয়াস নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি।
এসবের পেছনে শ্রম, সময়, অৰ্থ ছাড়াও কায়ক্লেশ দিতে হলেও এক অনাবিল আনন্দ যেন মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। পাড়ার এক কাকার পড়নের কাপড় রক্তাক্ত দেখে তাঁকে খালি হাতে চট্টগ্রাম শহরে এনে টাকা তুলে চাঁদশীর ক্ষত চিকিৎসালয়ে অৰ্শ অপারেশন করে চিকিৎসা করাতে পেরে আমার বুকখানা আনন্দে ভরে উঠেছিল। আমি তখন সবে মাত্র ম্যাট্রিক পাশ করেছি। আমারও অঢেল টাকা ছিল না। অনেক সময় রাতের তিনটা বাজে শীতল ভাত খেতে হতো। অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এই ঘটনা বহুবার ঘটেছে। মা হয়তো ঘুমে বিভোর। চুলা জ্বেলে গরম করবে কে, ওভেন তো তখন ছিল না।
বিভিন্ন মঠ, মন্দিরে দান যজ্ঞে সাধ্যমত অংশ গ্রহণ করার চেষ্টা করেছি। এখানে যুক্তরাষ্ট্রেও মঠ-মন্দির, হাসপাতাল ইত্যাদিতে অৰ্থ সাহায্য করতে সাধ্যমত চেষ্টা করি ভূত কল্যাণ যজ্ঞ সহ।
দেশে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও দুস্হ রোগীর বিবাহ ও চিকিৎসা সাহায্যের আবেদনে সাধ্যমত সাড়া দেয়ার চেষ্টা করেছি। বেশ কিছু জায়গা থেকে রিটাৰ্ণ জবাবটিও পাওয়া যায়নি। টিভিতে সন্তানের চিকিৎসা সহায়তায় পিতার আবেদন দেখে এক (x) বাবুর একাউন্টে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫,১৩০ টাকা পাঠিয়েছিলাম। (A/C # 134195 Agrani Bank, Tezgah Branch, Dhaka ) মাসখানেক পরে তাঁর ফোন নাম্বারে কল করি। তিনি শুধু বললেন, কয়েকজন লোক তাকে সাহায্য করেছেন। তার ছেলের খবর জানতে চাইলে বলল, ছেলে সুস্হ হয়ে উঠেছে, এই টুকুই। পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকে তার ছেলের জন্যে যে প্রয়াসটুকু নেয়া হল, তার জন্য একটি 'ধন্যবাদ' শব্দ ......... । এরকম আরও কয়েকজন করেছেন। আমি এসব জানি। বেশ কিছু লোক যে চৈতন্যহীন তা জানি, তবে সবাই নয়। এই আচরণ একটু ব্যথিত করলেও তা মনে রাখি না, কিন্তু অন্যদেরকে তা ব্যথা দিতে পারে এবং ভালো কাজে নিরুৎসাহ যোগাতে পারে। কতগুলো বিষয় খুব ছোট, কিন্তু বড়ই বেমানান৷ যেমন এখানে একজন হাঁছি দিল এবং পাশে কেউ আছে৷ এখানে পাৰ্শ্ববৰ্তী লোকটি বলে "God bless you" হাঁছি দানকারী বলেন "Thank you." এমন অবস্হায় পাশে কেউ থাকলে যদি চুপ করে থাকেন তাহলে তা খুব অশোভন দেখায়৷
আমরা শ্র্রীশ্রীঠাকুরের দৰ্শনানুসারে Universal faith এ বিশ্বাস করি এবং তাঁর মতে ধৰ্মান্তরিতকরণ একটি ভুল ব্যাপার। ধৰ্মে ধৰ্মে পাৰ্থক্য করি না, কিন্তু তাই বলে যেন তেন প্রকারে বিয়ের অনুমতি দেন নি তিনি। তবে বিয়ে যে হতে পারে না তা নয়। শ্রীশ্রীঠাকুর বিবাহ ছেলে খেলা নয় বলে উল্লেখ করেছেন। এমনকি নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেও অনেক কিছু যাচাই করতে বলেছেন। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, সকল ধৰ্মমতের মানুষ তাঁর কাছে এসেছিলেন এবং কাউকে তিনি ধৰ্মান্তরিত করেন নি। তিনি ভিন্ন সম্প্রদায়কে সাহায্য দিয়েছিলেন অকাতরে, ধৰ্মান্তরিত করেননি কাউকে।
আমেরিকায় স্হানীয় একটি চাৰ্চে ছোট একটি উপহার দিয়েছিলাম। তাঁরা চিঠি দিয়ে এবং ফোন করে ধন্যবাদ জানালেন এবং তাঁদের কাছে যেতে অনুরোধ জানালেন। আমাদের মধ্যে এই নূন্যতম চেতনাবোধ কাজ করে না, এমনকি আধ্যাত্মিক platform'র কৰ্তা ব্যক্তির কাছে লক্ষ টাকা দেয়ার পরও তাদের অনুষ্ঠানাদিতে যাওয়ার আমন্ত্রণ সম্বলিত কোন ছাপানো লিফলেট পৰ্যন্ত কোনদিন পাঠায়নি। অথচ নিজের সন্মানটি চেয়ে আদায় করে নেন। আমি এখন ঘরে দুষ্টামি করে সন্তানদের বলি- এই আমাকে প্রণাম কর৷ এই চেতনাহীনতা সনাতনী কৃষ্টিকে ভয়াবহ ক্ষতির পথে নিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। এটি নিছক অহংকার ও চেতনাহীনতা ছাড়া আর কি ? অথচ আৰ্য্য ঋষিরা ছিলেন শ্রদ্ধা, সন্মান, শিক্ষা, বিনয়, কৃতজ্ঞতা ইত্যাদির জ্বলন্ত উদাহরণ। এখানে স্কুল জীবন শুরুর সময় manner শিক্ষা দেয়া হয়। কোন একটি ষ্টোরে প্রবেশের সময় একজন অপরজনের জন্য দরজা ধরে রাখেন। যার জন্য দরজা ধরে রাখা হয় তিনি 'ধন্যবাদ' বলেন, আর দরজা ধরে রেখেছেন যিনি তিনি 'স্বাগতম' বলেন। সবাই যে এসব জানেন না তা নয়। সুপার ডিজিটাল হওয়ার পরও এদেশে চিঠিতে মেইল বক্স ভরে যায়। অৰ্থাৎ মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের আধিক্য হেতু তা ঘটে। মানুষ মানুষের সাথে রিএ্যাকশন করতে না চাইলে আমরা তো বোবার দুনিয়ায় চলে যাব। ঐ যে বলছে- 'কেউ কিছু বলছে না কেন?' খুব খারাপ লক্ষণ। একটি প্রতিষ্ঠান বা সক্ষম ব্যক্তি বোবা হয়ে থাকবেন এটা মানাচ্ছেনা তো। একজন মানুষ দেখলে কিভাবে কেটে পড়বে তার সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাখে৷ কি করে সেই ব্যক্তির থেকে লক্ষ টাকা আশা করেন৷ আসলে এরা নষ্ট হয়ে গেছে৷ এদের কারণেই সমাজে আজ সংহতির অভাব৷ একজন মানুষের জীবন ঘটনা প্রবাহের সূত্রে নিরাপত্তা, অৰ্থনৈতিক, পারিপাৰ্শ্বিক অবস্হা ইত্যাদি নিয়ে একটি ভিন্নতর অবস্হানে উন্নীত হতে পারে৷ তাই বলে অহংকারী, অদূরদৰ্শী দান গ্রহীতা উক্ত ব্যক্তিকে উপেক্ষা করবে? এটাই কি হৃদয়বান হওয়ার যোগ্যতা ? কেন এত অহংকার?
কেন করি, বা অন্যরাও কেন করেন? এর উত্তর হলো - করলে একটি পরিবৰ্তন হয়। যে কোন কিছু করলে একটি পরিবৰ্তন হয়। পুকুরের শান্ত পানিতে ছোট একটি ঢিল ছুঁড়ে মারুন, দেখবেন সেখানে ছন্দায়িতভাবে বৃত্তাকারে একগুচ্ছ ঢেউয়ের উৎপত্তি হয়েছে। জীবনেতো বহু কিছু টেষ্ট করা হয়, এটিও করে দেখুন। এটি মানুষের নৈতিক ও নাগরিক দায়িত্বও বটে। কি ? ভাবছেন টাকা চলে যাবে ? আরে মুসকিল, আপনিওতো চলে যাবেন। এখানে যা কিছু আপনার সেগুলোতো এখান থেকেই নিয়েছেন। যাবার সময় আবার রেখে যাবেন।
আরে না, সন্তানেরা আছে না? ওদের জন্য সহায় সম্পদ রেখে যেতে হবে না?
দেখুন, রাজা রায় বাহাদুরের বাড়ির দিকে তাকান। এই বেশী দূরে নয়, কয়েক শত বছর আগের কথা। আরও অনেক রাজা ছিল। উনাদেরও নাতি পতি ছিল। বড়, বড় হাতি ছিল। রাজা হাতিতে চড়ে বেড়াতে যেতেন। অবশ্য তাতে এখনকার মত পরিবেশ দূষণ হতো না। বিরাট বিরাট দিঘী ছিল। জবর দখল না হলে এখনও আছে, কিন্ত কালের বিবৰ্তনে তাঁদের বিশাল রাজবাড়িগুলোতে এখন অশ্বত্থ গাছ উঠেছে, সেখানে নাতিদের বদলে সাপ বাস করে। সব কিছু আপনি ভাবলে, তিনি ভাববেন কি? মানুষের হিসাব নিকাশে মাঝে-মাঝে বিরাট ভুল হয়ে যায়। মানুষ ভাবে একটি, হয়ে যায় অন্যটি। যেমন পলকে প্রলয় হয়ে যায়। রোগ, মহামারী, ভূমিকম্প, যুদ্ধ ইত্যাদিতে খণ্ড প্রলয় হয়েছে দুনিয়ায়, এখনও হচ্ছে। বিশাল মানবিক সাহায্য বিরাট দুৰ্গতিতে দুৰ্গ হয়ে বাঁচাতে পারে।
তাই বলছি, করলে আপনি লাভবান হবেন, কিন্তু আপনাকে স্হান, কাল ও পাত্র বিবেচনা করে করতে হবে। তা ছাড়া মানবপ্রেমিক শ্রীশ্রীঠাকুরের শিক্ষা আমাদেরকে আলোর পথে চলার প্রেরণা যোগায়। শ্রীশ্রীঠাকুর হিত সাধনের শিক্ষার তরে তাঁর আলোকিত সাহিত্যে ছড়ার সুরে উচ্চারণ করলেন -
ভালো করলে ভালোই পাবে
তেমনতরই আশা রেখো,
আশায় যদি বিফলও হও
ভালো করার পথেই থেকো।
পরমপুরুষকে গ্রহণ করলে অবচেতন মনে এক বিরাট প্রেরণার সৃষ্টি হয়। মানুষ বাঁচে প্রেরণায়, এগিয়ে যায় আশায়। আর পরমপুরুষের প্রেরণা ১০০% খাঁটি।
অচেতন জাতীয় জীবনে চেতনা সঞ্চারের জন্য শক্তি সম্পন্ন কথা শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীমুখে ধ্বনিত হয়েছে। তিনি এসেছেনও চেতনার জাগরণ ঘটাতে। তাঁর ঐশী বাণীর অংশবিশেষ উল্লেখ করছি, ".........ভারতবৰ্ষ তার আপন ঐতিহ্য ফিরে পেতে হলে পুরুষোত্তমের অনুবৰ্ত্তন, বৰ্ণাশ্রম, দশবিধ সংস্কার, নিত্য পঞ্চমহাযজ্ঞ, আৰ্দশ বিবাহ, আদৰ্শ শিক্ষা, অনুলোম-অসবৰ্ণ বিবাহ, দৈনন্দিন জীবনে যজন, যাজন, অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, দান-প্রতিগ্রহ, পারিপাৰ্শ্বিকের সেবা, সদাচার পালন ও ব্রত হলো আৰ্যাচারের অঙ্গীভূত। এইগুলি অনুসেবনে মানুষ ধীরে ধীরে বংশপরম্পরায় দেবতুল্য হয়ে উঠে। (আলোচনা প্রসঙ্গে, ২য় খন্ড, পৃ-৩)
আমাদের মনে রাখা দরকার, শ্রীশ্রীঠাকুর জগতের কল্যানের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তবে, শুরুতো করতে হবে কোন একটি জায়গা থেকে।
আমি একটি ছোট সাফল্যের কাহিনী বলতে পারি। সেই ধরণের সাফল্য পেতে হলে ইষ্টানুরঞ্জিত ও সমচেতনাদীপ্ত জনসমষ্টি দরকার। যেখানে আমার শৈশব বেড়ে উঠেছে। ছোট বেলায় বাবার সাথে উৎসবে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে শহরে আসতাম। একটি আশ্রমে প্রায়ই আসা হতো। আশ্রমটির নাম চট্টগ্রাম সৎসঙ্গ আশ্রম। প্রতি সস্তাহে একদিন সবাই সেখানে মিলিত হতাম। প্রাৰ্থনা, ভক্তিমূলক গান, ধৰ্মীয় আলোচনা ইত্যাদি হতো, এখনও হয়। অভাব- অনটন, বিবাহ, রোগ-শোকের সাহায্য চেয়ে মানুষ আসে সেখানে। ভক্তেরা সবাই মিলে কিছু টাকা সংগ্রহ করে অভাবীর হাতে তুলে দিতেন। অভাবীর প্রয়োজন পূরণ হতো কিনা সেটি ভাববার সক্ষমতা অনেকের ছিল না। ৫০০/৭০০ টাকা তুলে দেয়া হতো, কখনও আরও কম। ছোট বেলা থেকেই ভাবতাম গরীব দুঃখীকে যে এত কম সাহায্য দেয়া হয় এই বিন্দু দিয়ে তার কিই বা হবে? ধনী হলেই যে বেশী দান ও সাহায্য করা যায় তা সঠিক নয়। বাধ্যগত সামাজিক ও ধৰ্মীয় দায়িত্ববোধ এবং মনের উদারতা নিয়ে চললেই মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটে এবং বৃহত্তর সমাজের কল্যান করা যায়। একযোগে সবাইকে নামতে হবে। ধৰ্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব সামৰ্থ মত সবার জন্য প্রযোজ্য। এই সূত্র মেনে চললে মানুষের মৌলিক চাহিদার অভাব অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব। এই সূত্রের পরিধি অনন্ত বিস্তৃত। এই সূত্র ধরে অনেক দূর এগিয়ে গেলে আলোর দেখা মিলবে। এই সূত্রের সঙ্গে বহুমাত্রিকতা যুক্ত করতে হবে। পুরনো গল্প বলে গেলে চলে না। নেগেটিভ কথা চির জীবনের তরে বাদ দিতে হবে। কোন কোন সংগঠন ত্রিশ বছর পূৰ্বে বা ১৯৮৫ সালে বন্যা দূৰ্গতদের জন্য চল্লিশ হাজার টাকা সাহায্য দিয়েছিল এবং প্রতিবছর ম্যাগাজিনে সন উল্লেখ না করে গৰ্বের সাথে ত্রিশ বছর যাবৎ ছাপিয়ে যাচ্ছে 'বন্যা দূৰ্গতদের জন্য সাহায্য বাবৎ-৪০,০০০/০০ টাকা।' এটাতো দায়িত্বপালনের পথে বিরাট অন্তরায়। এইভাবে চললে মানুষ পেটের জ্বালায় হাহাকার করবে। শাস্ত্রে সামাজিক দায়িত্ব পালনের বাধ্যতামূলক নিৰ্দেশনা রয়েছে। চেতনার জাগরণ ঘটাতে শ্রীশ্রীঠাকুর বিনীদ্র রজনী যাপন করেছেন। তিনি জঙ্গলাকীৰ্ণ নিভৃত পল্লীতে গড়ে তুলেছিলেন জীবনের সঙ্গে জড়িত যাবতীয় রসদের উৎস কেন্দ্র। আমরা এখানে থাকলেও মা, আত্মীয়-স্বজন ওখানে বাস করেন।
সাফল্যের কথায় ফিরে যাই। বাবার সন্তান আমি, বাবার দেয়া টাকা পয়সা দিয়েইতো বড় হয়েছি। লেখাপড়ায় বাবার প্রেরণা ছিল বেশী। বাবা বড় ডিগ্রীধারী ছিলেন না, তবে শিক্ষানুরাগী ছিলেন। পরীক্ষায় সরল অংক শেষে করার এবং ব্যাখ্যা পুরোটা লিখার সময় না পেলে অন্তত কবির নাম ও পৎক্তির অৰ্থ দুই লাইনে লিখে পরীক্ষার খাতায় full answer করার উপদেশ দিতেন। সমাজ, আত্মীয়-স্বজন, একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, সামাজিক কুসংস্কার, বৈদ্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কিভাবে বাবার প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম এবং ১৫ বছর বেশী বেঁচেছিলেন তার একটি হৃদয়গ্রাহী বৰ্ণনা আছে। সেই কাহিনী জানলে মানুষের উপকার হতে পারে। সেটি অন্যত্র লেখার চেষ্টা করব। বাবার স্মৃতি ভুলবার নয়। ছোট বেলায় শেখানো বাবার সেই ছড়াগুলো আজও মনে পড়ে- ক্রিয়ার শেষে থাকলে 'ব'/ shall কিংবা will দিব,আরও যেমন Do, did, does এর ব্যবহার/ প্রশ্ন করতে, not বসাতে হয় দরকার। অনেক শিক্ষকের ত্তত্বাবধানে পড়ানোর ব্যবস্হা করেছিলেন বাবা। এসব মনে পড়ে। পরম প্রভু শ্রীশ্রীঠাকুরের কৃপায় শোক অনেকটা কাটাতে পেরেছি। বাবার ঋণতো পরিশোধ করতে পারবো না। শ্রীশ্রীঠাকুরের কৃপায় বাবার স্মৃতির ঊদ্দেশ্যে এবং মায়ের নামে ২০০৭ সাল থেকে একটি ক্ষুদ্র শিক্ষাবৃত্তি চালু করেছি। শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীর আলোয় আলোকিত অনেক সতীৰ্থ দাদা ও মায়েরা এই ধরনের প্রকল্পে উক্ত আশ্রমে প্রথমবারের মত যার যার পিতা-মাতা বা কাঙ্খিত জনের নামে বৃত্তি প্রদানে অংশ গ্রহণ করেছেন এবং তাঁরা আলোকিত মানুষের তালিকায় স্হান পেয়েছেন। এই প্রকল্প উন্নত দেশের তুলনায় কিছুই নয়। বৃত্তির টাকার অংক এতই ক্ষুদ্র যে বলতে আমার লজ্জা হয়, কিন্তু সেটিও তো একদিন ছিল না বা অন্যত্রও ছিল না। একটি করেই ক্ষান্ত হলে চলবে না, আরও অসংখ্য করতে হবে। অসংখ্য কাজ পড়ে আছে। ২০টি মন্দির মিলে লাঙ্গলবন্ধে ২০টি পাকা ঘাট নিৰ্মানের দায়িত্ব নিতে পারে। আশা করি মানুষ জাগবে।
আমার আহ্বান সকলের প্রতি, আপনারাও আপনাদের গুরুদেবের মন্দির বা আশ্রমে বা সৎসঙ্গ আশ্রমে এবং সকল সম্প্রদায় তাঁদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিবাহ ইত্যাদি নামে প্রকল্প চালু করতে এগিয়ে আসুন এবং অসাম্প্রদায়িক নীতির ভিত্তিতে সাহায্য করুন। এটি আমার, আপনার সকলের সামাজিক ও নাগরিক দায়িত্ব। এসব যদি পালন করা শুরু না করেন, নিকট ভবিষ্যতে হঠাৎ মানুষের অৰ্তনাদ শুর হলে তাতে জোগান দিয়ে সহায়তা করা দুরুহ হয়ে উঠতে পারে।
অগ্রসরমান, উদার, উচ্চশিক্ষাহার সমৃদ্ধ আমেরিকান জনগোষ্ঠীর প্রতিও আমার আবেদন, এই সমাজেও সহায়তামূলক প্রকল্প বস্তবায়ন করতে পারেন, যদি আপনাদের ধৰ্মীয় ও সামাজিক নিয়ম তা অনুমোদন করে। এদেশের সমাজেও এগুলো দরকার। আমার মেয়ে এদেশের স্কুলে লেখাপড়া করে। আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করি, এই যুক্তরাষ্ট্রেও এই জাতীয় প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তার কথা আমি মানুষের কাছে তুলে ধরব। আমি প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলতে উদ্যোগ নিচ্ছি। এত উন্নত এদেশের মিডিয়া, এটি দ্রুত ছড়ায়ে দিতে হবে সমগ্র দেশব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রকল্প চালু রাখতে হলে কিছু বিষয় যুক্ত হতে হবে এবং এর জন্য ছোটখাট গবেষণা দরকার। অনেক কিছু করার আছে, যদি কমিউনিটির চাহিদা ও সন্মতি থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর কয়েক বছর ধরে দৈনিক দু'টি চাকুরী করতাম। দু'টি চাকুরী করলে তাতে ১৮ ঘন্টা চলে যায়। ৮ ঘন্টা করে ১৬ ঘন্টা এবং একটি শেষ করে অপরটিতে যাওয়ার প্রস্তুতি বাবদ ২ ঘন্টা। এইভাবে কাজ করা ঠিক বলে মনে করি না, কারণ এটা শরীরের নিয়ম বিরুদ্ধ। এই জন্যেই তো মে দিবস পালিত হয়। যাই হোক, তবু অনেকে হয়ত হত বুদ্ধি থেকে বলে উঠেন- "আমি দৈনিক ২০ ঘন্টা চাকুরী করি।" যাঁরা এই ধরণের বলেন তাঁরা হয়ত কাজ জানেন না, দুই ঘন্টার কাজ হয়ত দশ ঘন্টায় সম্পন্ন করেন আর কি?
(চলবে)