সত্যিকারের বন্ধু কে ?
চেহারা যদি অচেনা হয়, তাহলে সেটা কোনো বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না কিন্তু বন্ধু যখন অচেনা হয়ে যায় তখন সেটা সত্যিই মনকে কষ্ট দেয়।
একটি ভালো বই ১০জন বন্ধুর সমান, কিন্তু একজন ভালো বন্ধু একটা সম্পূর্ণ লাইব্রেরীর সমান।
জীবনের চলার পথে আমরা অনেক বন্ধুকে হারাই, আবার অনেক নতুন বন্ধু আহরণ করি । কিন্তু বাল্যের মধুর স্মৃতি কেবলমাত্র শৈশবের বন্ধুদের মাধ্যমেই উদ্ভাসিত হয়, তাই এই বন্ধুদের আমরা কখনো ভুলতে পারি না । এখানে আমি আমার কয়েকজন বাল্যের বন্ধু, তাদের সঙ্গে সংযোগ ও যেখানে সম্ভব তাদের পরিবার সম্পর্কে বলব । পরে আমি পরবর্তী জীবনে আহৃত বন্ধুদের সম্পর্কে বলব ।
বাল্যবন্ধু
আমাদের বিদ্যালয় জীবন আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অবস্থিত যোরহাট শহরে কেটেছে ।
বিদ্যালয়ে আমি, দীপু, মৃণাল, উৎপল (বর্তমানে প্রয়াত), আশু ও হীরেশ (বর্তমানে প্রয়াত) একদলে ছিলাম । আমাদের মধ্যে হীরেশ অনেকটা দূরে থাকত, আশুও কিছুটা দূরে থাকত বাকীরা আমরা খুবই কাছাকাছি থাকতাম । আশু কখনো কখনো আমাদের সঙ্গে যোগ দিত । তবে স্কুলের বাইরে বেশীর ভাগ সময়ই ও বাড়ীতে আবদ্ধ থাকত । দীপু বর্তমানে আমেরিকায় ও আশু গ্রেট ব্রিটেনের সাউথ ওয়েলসে প্রতিষ্ঠিত, দুজনেই বিদেশী নাগরিক । মৃণাল কোলকাতায় স্থিত । হীরেশ ও অবসরের পর উৎপল দুজনেই যোরহাটের বাসিন্দা ছিল । হীরেশ ২০১৫ সালের নবেম্বর মাসে যোরহাটে দেহরক্ষা করে । উৎপলও (ডাকনাম মালু) ২০১৬ সালের নবেম্বর মাসে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। বাকীরা আমরা সবাই এখন অবসরপ্রাপ্ত । আমাদের অন্যান্য সহপাঠি-সহপাঠিনীদের মধ্যে কল্পনা ওরফে গোপা এখন পূণাতে, বেলা চক্রবর্তী (পাল) অবসরের পর স্বামীপুত্র সহ গৌহাটিতে বাস করত (বর্তমানে প্রয়াত), অরুণা সর পুত্রকন্যা সহ নবী মোম্বাইতে বাস করত (বর্তমান স্টেটাস অজানা) । রাণাপ্রতাপ দাস নিউইয়র্কে রয়েছে, আমেরিকার নাগরিক ।
আমার হৃদয়ে আবেগ সৃষ্টিকারী স্কুল ও কলেজ জীবনের দুএকজন বন্ধু বা ব্যক্তির সঙ্গে আমি যোগাযোগ হারিয়েছি, এটা আমাকে খুবই পীড়া দেয় । এদের মধ্যে আছে তরুণ পাল, রাজর্ষি ভট্যাচার্য (ডাক নাম কিসু) (পরে জেনেছি ও চিরদিনের জন্য সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে), দেবশীষ নন্দী ও অন্যান্য । বিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে প্রিয় কোনো একজনের সাথে অনেক চেষ্টা করেও সম্মুখ সাক্ষাৎ সম্ভব হয় নি । আরেকজন সম্পর্কে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে শিলং ভ্রমণের সময় জেনেছিলাম সে দীর্ঘদিন গত হয়েছে । সেই সময় আমি এই বেদনাদায়ক সংবাদ পেয়েছিলাম যে কিসু গত হয়েছে ।
১ । আমার বন্ধু দীপু: আমার কলেজ জীবনের ইতিহাসে প্রদীপ কিশোর রায় বা দীপু এই নামটি বার বার এসেছে । ও আমার বেস্ট ফ্রেণ্ড যদিও ওর কিছু কিছু বিষয় আমি সমর্থন করি না । বিদ্যালয়কাল থেকে শুরু করে শিলং এর সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজ থেকে আই. এসসি পাশ করা পর্যন্ত বরাবর আমরা একসাথে পড়াশোনা করেছি । দীপু আমার জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । ওর জন্যই আমার সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়েছিল যার ফলে আমি ওখানে পড়ার সুযোগ পাই ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারি । আমি ও দীপু ঐ কলেজের হোস্টেলে পাশাপাশি ঘরে থেকে কলেজ জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলো কাটিয়েছি । আইএসসির পর দীপু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক করে বিএস ডিগ্রী লাভ করে ও পরে ১৯৬৯ সালে বায়োক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এ এমএস করে । এই সময়ের মধ্যে আমি একাধিক ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রদক্ষিণ করে শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে স্নাতোকত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এমএসসি ডিগ্রী লাভ করি । ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক হওয়ার পর দীপু কিছুদিন পশ্চিমবঙ্গে চাকুরী করে । পরে ১৯৭২ সালে আমেরিকা চলে যায় এবং তদবধি ওখানেই আছে ও আমেরিকার নাগরিকত্ব অর্জন করেছে । ওখানে ও কর্ণফ্লেক্সখ্যাত কেলগ্স কোম্পানীতে চাকুরী করত । বর্তমানে মিচিগান রাজ্যের গ্রাণ্ড রেপিডস শহরে নিজের বাড়ীতে বসবাস করে । ছোটবেলায় ভাল ক্রিকেট খেলত, আমেরিকায় গিয়ে গল্ফ খেলায় মেতেছে । ভারতে থাকার সময় ও দুবার আমার তদানীন্তনকর্মস্থল কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জে আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল - একবার আমি অবিবাহিত থাকাকালীন ও পরের বার ১৯৭২ সালে আমার বিয়ের পর এবং ওর আমেরিকা রওয়ানা হওয়ার পূর্বে । তারপর আমাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । অবশেষে আমাদের যোগাযোগ পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয় আমার কর্ম্মজীবনের শেষ পর্যায়ে আমি যখন রাইটার্স বিল্ডিংস এ কর্ম্মরত । দীপু কোথাও থেকে (হয়ত ফেসবুক) আমার ফোন নম্বর জোগাড় করে দ্বিধান্বিত ভাবে আমায় ফোন করে জানতে চায় আমি মেখলিগঞ্জের অজয় কি না (সম্ভবতঃ সেই মুহূর্তে স্কুল থেকে কলেজ অবধি আমাদের গভীর সম্পর্কের বিষয় থেকে কোন একটি পরিচিতি যাচাইকরণে ব্যবহার করার কথা ওর মনে হয়নি) । এরপর টেলিফোনে যোগাযোগ বহাল রইল । ১৯৭২ সালের প্রায় সাড়ে তিন দশক পর ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে আমাদের আবার চাক্ষুষ দেখা হল যখন দীপু স্ত্রী রিভাকে নিয়ে ওর কোলকাতার নতুন ফ্ল্যাটে গৃহপ্রবেশ করতে এল । এই প্রথম আমি দীপুর স্ত্রী রিভাকে দেখলাম । দীপুর সাথে আবার দেখা হল ২০১১ সালে ও যখন পুনর্বার কোলকাতা এল । ঐ সময় আমাদের স্কুলের আরেক বন্ধু বর্তমানে সাউথ ওয়েলস নিবাসী আশুও কোলকাতায় ছিল । এরপরও দীপু দুবার কোলকাতা এসেছে । প্রথমবার ২০১৪ সালের জানুয়ারী মাসের শেষে । তখন ওর ছোটবোন খুকুও কোলকাতা এসেছিল এবং আমাদের বাড়ীতে আমরা নৈশভোজে একত্র হয়েছিলাম । সবশেষে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে নববিবাহিতা কন্যা ও জামাতাকে নিয়ে দীপু কোলকাতা এসেছিল । তখন গ্র্যাণ্ড হোটেলে স্থানীয় আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের জন্য কন্যার বিবাহপরবর্তী রিসেপশন পার্টি দিয়েছিল ।
আমি ও আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু দীপু ।
এটি উত্তরবঙ্গের কোন একটি স্থানের ১৯৭০ সালের প্রথম দিকের যখন দীপু প্রথমবার আমার কর্ম্মস্থলে গিয়েছিল ।
২ । আশুতোষ পাল ডাকনাম আশু আমার বিদ্যালয় জীবনের আরেকজন বন্ধু । আমরা মেট্রিক পরীক্ষা পর্যন্ত লক্ষ্মী ইউনিয়ন হাইস্কুলে একসাথে পড়েছি । ও আমাদের ক্লাশে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী ছিল । মেট্রিকের পর ও কোলকাতা আসে ও কলিকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে । তৎপর ও বিদেশ চলে যায়, প্রথমে আমেরিকা ও পরে ইউনাইটেড কিংডাম । ওখানে হাসপাতালে কর্ম্মরত থাকাকালীন একজন ওয়েলশ ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করে ইউকের (UK) সাউথ ওয়েলশে স্থিত হয় । ১৯৬৪-৬৫ সালে ও যখন কোলকাতায় এমবিবিএস করছিল সেই সময় বার কয়েক ওর সাথে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয় । তারপর আমাদের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় ও দীর্ঘকাল পরে দীপুর মাধ্যমে (দীপুর সাথে বরাবরই ওর যোগাযোগ ছিল) যোগাযোগ পুনর্স্থাপিত হয় । বেশ কয়েক দশক পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ওর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়; ও তখন কোলকাতা এসেছিল । এরপর ২০১১ সালের জানুয়ারী, ২০১২ সালের ডিসেম্বর ও ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে ও কোলকাতা আসে । প্রতিবারই আমার সাথে ওর দেখা হয়েছে ও আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করে পরষ্পরের সঙ্গ উপভোগ করেছি । ২০১৩ সালের অক্টোবরে ও স্ত্রী মেরীকে নিয়ে এসেছিল । আমি যথারীতি ওদের সঙ্গে সল্টলেকে আশুর ছোটবোন বেবীর বাড়ীতে দেখা করি । মেরী একজন সুরুচিসম্পন্না মিশুকে ভদ্রমহিলা । তিনি সমাজসেবামূলক কাজ ভালবাসেন ও জনস্বার্থমূলক বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামত রয়েছে । ওর সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায় । বাম পাশের প্যানেলে আশুর ছোটবেলার ও আমাদের যোগাযোগ ঘটার পরবর্তী পর্যায়ের কিছু ছবি সংযোজিত হল ।
স্ত্রী মেরীকে নিয়ে আশুর পরবর্তী কোলকাতা ভ্রমণ: আশুর স্ত্রী মেরীর সাথে আমার প্রথম আলাপ ২০১৩ সালের আশুর সস্ত্রীক কোলকাতা ভ্রমণের সময় । আশু সেই সময় ওর বোনের বিধাননগরের বাড়ীতে ২৪শে অক্টোবর মেরীর জন্মদিন পালন করে । আশু ওদের সাউথ ওয়েলশের বাড়ী থেকে কোলকাতার উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার পূর্বেই আমাকে ও মৃণালকে এই জন্মদিনের আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিল । কিন্তু ঐ একই দিনে আমার ছোট শ্যালিকার বড় ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান থাকায় আমার পক্ষে মেরীর জন্মদিনে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয় নি । আমি পরে মেরী ও আশুর সাথে দেখা করে কিছু সময় কাটাই । আমার বিচারে মেরী একজন সুপরিজ্ঞাত ভদ্রমহিলা বলেই বিবেচিত । তিনি যে শুধু ভারতের বিভিন্ন সমসাময়িক সমস্যা সম্পর্কেই অবগত তা নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সুস্পষ্ট অভিমত রয়েছে । ওর সঙ্গে কথা বলা আনন্দদায়ক । তিনি আমুদেও বটে ।
আশুর পরবর্তী ভারত ভ্রমণ: আশু ২০১৪-২০১৫ সালে আবার কোলকাতা আসে । সঙ্গে ছিল ছোটমেয়ে সুপ্রীতি ও তার বর জনাথন ওরফে জন কিডওয়াল । ওরা ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে এসেছিল । আশুর ছোটবোন বেবীর বাড়িতে ওদের দুজনের সাথে আমার আলাপ-পরিচয় হয় । ওদের দুজনের সাথে আমার ছবি পাশের প্যানেলে দেখা যাবে ।
ওরা দুজন ফিরে যাওয়ার পর আমি ও আশু ২০১৫সালের জানুয়ারী মাসে অজন্তা, ইলোরা এবং মহারাষ্ট্রের ঔরাঙ্গাবাদ জেলার অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সফর করি । এই ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ আমার ইংরাজী ওয়েবসাইটের ট্রাভেলগ 'বী' অংশে লিপিবদ্ধ আছে । এই ট্রিপ আমরা খুব উপভোগ করেছি । দীর্ঘদিন এটি আমাদের মানসক্ষেত্রে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ।
ট্রেভেলগ বী অংশে যেতে হলে এখানে ক্লিক বা টেপ করুন ।
A Tale of a Sylheti Refugee - Travelogue Part B (google.com)
আমরা ঔরাঙ্গাবাদ ট্রিপ থেকে ফিরে আসার অব্যবহিত পর আশুর স্ত্রী মেরী ২০১৫ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী কোলকাতায় আশুর সাথে যোগ দেয় । ঐ সময় আসামে আমার আরেকটি ট্রিপ থাকায় আমি তখন মেরীর সাথে দেখা করতে পারিনি । আসাম থেকে ফিরে আমি স্ত্রী স্বপ্নাকে নিয়ে আশুর বোনের বাড়ীতে ওদের সাথে দেখা করি । আমরা ওদেরকে ২৫শে ফেব্রুয়ারী আমাদের ফ্ল্যাটে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানাই যা ওরা গ্রহণ করে । সেই নৈশভোজের সন্ধ্যা আমরা খুব আনন্দে কাটিয়েছিলাম । মেরী সহজেই সকলের সঙ্গে মিশে গেল । আমার ৪+ বছরের স্বভাবলাজুক নাতি (দৌহিত্র) যে সহজে কারো সাথে মেশে না সে এত মুগ্ধ হল যে মেরীর কাছ থেকে ঈঙ্গিত পেয়ে একটার পর একটা ছবি এঁকে ওকে দেখাতে লাগলো আর মেরীও ওকে উৎসাহ দিতে লাগল । শ্লোক এত মুগ্ধ হয়েছিল যে ওরা চলে যাওয়ার পর মাঝে মাঝেই ওদের কথা জিজ্ঞেস করত । ওরা ১লা মার্চ ভারত ছেড়ে যায় । মেরীও শ্লোকের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিল যে আশুর সাথে আমার ফোনে কথা হওয়ার সময় মেরী কখনো কখনো মাঝে ঢুকে শ্লোকের কথা জিজ্ঞেস করে ।
এই আনন্দময় সন্ধ্যার কয়েকটি স্মরণীয় মুহূর্তের স্মৃতি পাশের প্যানেলের কয়েকটি ছবিতে ধরা আছে ।
আশু আবার কোলকাতা এল ৫ই জানুয়ারী ২০১৬ ও রইল ৯ই মার্চ পর্যন্ত । ও এখানে থাকাকালীন আমার সাথে ৫ই ফেব্রুয়ারী থেকে ১৭ই ফেব্রুয়ারী ২০১৬ পর্যন্ত আসাম ও মেঘালয় সফর করে । আমরা আনন্দে সময় কাটালাম এবং পাহাড়, অরণ্য ও নদীদ্বীপের অন্তর্বর্তী অঞ্চল সমূহ ঘুরে বেড়ালাম । আমরা আমাদের পুরনো জায়গা ও প্রতিষ্ঠান দর্শন করলাম এবং লোকজনদের সাথে কথাবার্তা বললাম । এখন আশুর সাথে যুগ্ম সফর প্রায় বাৎসরিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে । বিদ্যালয় বন্ধুর সাথে নিরবচ্ছিন্নভাবে কয়েকদিন কাটানোর এক আলাদা মাহাত্ম্য রয়েছে ।
এরপর আশু আরো দুবার কোলকাতা এসেছে, ২০১৭ ও ২০১৯ সালে । ২০১৭ সালে আমরা রাঁচিতে যুগ্মসফর করি । প্রচণ্ড গরমে রাঁচির জলপ্রপাতগুলো তখন প্রায় শুষ্ক । একমাত্র হুড্রু ছাড়া অন্য কোন জলপ্রপাতে জলের কোন অস্তিত্ব ছিল না । তবে অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখেছি । ২০১৯ সালের যুগ্মসফরে আমরা আসামের কাজিরাঙ্গা, তেজপুর, নেমারী জাতীয় উদ্যান, অরুনাচল প্রদেশের কিয়দংশ, ওরাং জাতীয় উদ্যান, ডিব্রুগড় ও গুয়াহাটি প্রদক্ষিণ করি । রাজনৈতিক অস্থিরতার দরুণ আমাদের ভ্রমণসূচী কাটছাট করে সময়ের আগে ফিরে আসতে হয় । এটী ছিল এই পর্যন্ত আমাদের শেষ যুগ্ম সফর । ২০১৯ সালে মারাত্মক কোভিড অতিমারীর প্রকোপে স্তব্ধ বিশ্বে কবে আবার যুগ্ম সফর সম্ভব হবে, জীবৎকালে আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা আজ অনিশ্চিত । তবে এই পর্যন্ত সফরে আমরা পরষ্পরের সান্নিধ্য মনে প্রাণে উপভোগ করেছি, আনন্দময় মুহূর্ত কাটিয়েছি, আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ় হয়েছে ।
৩ । আমার বন্ধু মৃণাল: মৃণাল কান্তি হাজরা ডাকনাম খোকন বিদ্যালয় কাল থেকে আমার আরেকজন ঘনিষ্ট বন্ধু । স্কুলজীবনের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র মৃণালেরই আমার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল । এমন কি আমি যখন পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিসে নির্বাচিত হই তখনও আমার এই সার্ভিসে যোগ দেয়ার দ্বিধাগ্রস্ততা নিয়ে একমাত্র ওর সাথেই ইণ্টারেক্ট করেছিলাম । স্নাতক হওয়ার পর মৃণাল আসাম রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদে চাকুরী নেয় । সেই চাকুরীতে ও কিছুদিন কোলকাতায় পোস্টেড ছিল; লিটল রাসেল স্ট্রিটে আসাম হাউসে ওর অফিস ছিল । পরে আসামে ফিরে যায় । পরবর্তী পর্যায়ে ওর সঙ্গে আমার দেখা হয় ও যখন অবসর নিয়ে কোলকাতায় বসবাস করছে । ও কোলকাতায় বিয়ে করেছে এবং এক পুত্রের জনক । বিশেষ একজন সহ বিদ্যালয় কালের বন্ধুদের কয়েকজনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ স্থাপনে মৃণালের অবদান অনস্বীকার্য । সম্প্রতি মৃণাল ঘরকুনো হয়ে গেছে ও খুব একটা যোগাযোগ রাখে না । ওর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে তোলা কয়েকটি ছবি এখানে প্রদর্শিত হল, এর দুএকটি ইতিমধ্যে অন্যত্র প্রদর্শিত হয়ে থাকতে পারে ।
৪ । আমার বন্ধু উৎপল: উৎপল পাল ডাক নাম মালু আমার স্কুলের আরেক বন্ধু । স্কুলে ভাল ক্রিকেট খেলত । ও আমার কোর গ্রুপের বন্ধু ছিল । ও শান্ত ও মধুর স্বভাবের ছিল । যেখানেই বা যখনই দেখা হোক আমি ওর সাহচর্য উপভোগ করতাম । শিক্ষা সমাপ্ত করে ও নাগাল্যাণ্ডে শিক্ষকতা করত । অবসরের পর ও যোরহাটের বাঁশবাড়ীতে নিজবাসে বসবাস করত । ২০০৭ সালে আমি যখন সস্ত্রীক ওর বাড়ীতে দেখা করতে যাই তখন ওর মেয়ে চাকুরী করছে আর ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে । আমার কলেজ জীবনের পর ওর সাথে আমার সেই প্রথম দেখা । এরপর ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রত্যেক আসাম সফরে ওর সাথে আমার দেখা হয়েছে । ২০১৪ সালে আমি ওর সাথে ওর নতুন বাড়ীতে যা সে পুরনো বাড়ীর পরিবর্তে বানিয়েছিল দেখা করি । বাড়িটি ছিল ছিমছাম ও সুসংরক্ষিত । ওর সাথে আমার শেষ দেখা ২০১৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী । আশুও তখন সঙ্গে ছিল ।
দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের প্রিয় বন্ধুকে আমরা হারাই ২০১৬ সালের ৫ই নবেম্বর । উৎপল মৃত্যুকালে স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধু, এক কন্যা, এবং এক পৌত্র রেখে গেছে । অতঃপর আমি যতবারই যোরহাট যাব ওকে মিস করব । ওঁর আত্মার শান্তি হোক ।
কন্যা এনাক্ষী ও স্ত্রী সহ বন্ধু উৎপল ওর বাঁশবাড়ীর বাড়িতে । যোরহাট, ডিসেম্বর ২০০৭ ।
৫ । আমার বন্ধু রাণা: রাণাপ্রতাপ দাস ডাকনাম রাণা স্কুলে আমাদের সহপাঠি ছিল । মেট্রিক পরীক্ষার পর কোলকাতায় পড়াশুনা করে স্নাতক পাশ করে আমেরিকা চলে যায়। সে একজন জার্মান মহিলাকে বিয়ে করে নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত হয় । ওর একটিই ছেলে, নাম ডগলাস, আমেরিকায় কর্ম্মরত । ১৩ই জানুয়ারী ২০০৯ পার্ক স্ট্রিটে অল্পক্ষণের জন্য ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল, স্কুল ছাড়ার কয়েক দশক পর । ও ছেলেকে নিয়ে কোলকাতা বেড়াতে এসেছিল । ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমার ও মৃণালের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সমস্ত কার্যক্রম ওকে বাতিল করতে হয়েছিল । কোলকাতা আসার কিছুদিন পূর্বে ওর স্ত্রী মারা যায় যার ফলে ও খানিকটা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল এবং তা কাটাতে ভারতে বেড়াতে এসেছিল । এরপর রাণা ২০১৮-১৯ সালে আবার ভারতে এসেছিল । এবার ও গড়িয়াহাটে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারের হোস্টেলে উঠেছিল । ঐ সময় আশুও কোলকাতা এসেছিল । আমরা স্কুলের চার সহপাঠি মৃণাল, রাণা, আশু ও আমি একসাথে হয়ে খুব আনন্দ করেছিলাম । রাণা ও মৃণাল হোটেলে আলাদা আলাদা লাঞ্চ পার্টি দিয়েছিল, আমি বাড়ীতে নৈশভোজের ব্যবস্থা করেছিলাম । ইতিমধ্যে আমার কলেজের এক বন্ধু চিত্তেন্দ্র সোম লণ্ডন থেকে এসে পড়ে । নৈশভোজে ওকেও আমন্ত্রণ করেছিলাম । ও সস্ত্রীক আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ।
৬ । আমার বন্ধু হীরেশ: স্কুলে আমাদের আরেক সহপাঠি ছিল হীরেশ রায় । মালু, মৃণাল, আশু, দীপু ও গোকুলের সাথে হীরেশও আমার কোর গ্রুপে ছিল । স্নাতকের পর ও ৭ বৎসর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ছিল । তারপর স্বেচ্ছাবসর নেয় । সেই থেকে ছেলে রাজেশের সঙ্গে যোরহাটের চকবাজারের পেছনে একটি চাপাতা ও অন্যান্য সামগ্রীর দোকান চালাত । ডান দিকের ছবিটি আমার ২০১৪ সালের ২০শে মার্চ যোরহাট সফরকালে ওর দোকানে তোলা । এর আগে ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল ২০০৭ সালে । সেটা ছিল কয়েক দশক পর ওর সাথে আমার প্রথম দেখা । সেই সময় ওর দোকানে দেখা করতে গেলে ও আমায় চিনতে পারেনি, ভেবেছিল আমি ওর একজন ক্রেতা । স্কুলজীবনে ও একবার আমাদের এক সহপাঠিনীর কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের বেত্রাঘাতের সম্মুখীন হয়েছিল । দুর্ভাগ্য, ২০শে নবেম্বর ২০১৫ সালে ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । এরপর যোরহাট সফরে গেলে ওকে আর পাব না !
৭ । আমার বন্ধু গোকুল: স্কুলে গোকুল সাহা আমার বিশেষ বন্ধু ছিল । ও আমাদের কোর গ্রুপেও ছিল । ও খুব ভাল গান করত । ওর একটা গান এখনো আমার কাণে বাজে, "শাহাজাহান নেই আজ, মমতাজ নেই আজ........"। গান শোনার জন্য আমরা ওর চারদিকে ভীড় করতাম । ও সাধারণতঃ হাসি খুশি থাকত । আমাদের বাড়ীর কাছাকাছিই ওরা থাকত । যোরহাটের চকবাজারে ওদের একটি বাসনকোসনের দোকান ছিল । যতদূর মনে পড়ে আসামের ১৯৬০ সালের বঙালখেদা নামক ভাষাদাঙ্গার সময় ওরা ব্যবসাপত্র গুটিয়ে সবাইকে নিয়ে কোলকাতা চলে আসে । স্কুল ছাড়ার পর একবারই ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল, সম্ভবতঃ কোলকাতায়; আমি বোধহয় তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্লাশ করি । বাগমারী মাঠে তখন একটিমাত্র বাড়ী ছিল; লালরঙের জরাজীর্ণ (চারতলা) । গোকুল সেখানে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল, ওরা তখন ঐ বাড়ীতে বা ওর কাছাকাছি কোনো বাড়ীতে বাস করত (আমার সঠিক মনে নেই} । এরপর আর ওর সাথে যোগাযোগ হয়নি । অনেক বছর পর যোরহাট গিয়ে শুনেছিলাম গোকুল আর নেই; ওর মেয়ের ব্যপারে কোন সমস্যার দরুণ মানসিক আঘাতে মারা যায় । সঠিক কারণ জানি না । দুর্ভাগ্যবশতঃ, ওর স্কুল পরবর্তী জীবনের কোন তথ্য বা ছবি আমার সংগ্রহে নেই । ওর জন্য আমার একটাই প্রার্থনা, "যেখানেই থাক, ভাল থেকো ।"
আমার মেয়েবন্ধু
১ । ক্লাশমেট কল্পনা: কল্পনা রায় ডাক নাম গোপা, লক্ষী ইউনিয়ন হাইস্কুলে আমাদের সহপাঠিনী ছিল । ও আমার বেস্ট ফ্রেণ্ড দীপুর জ্যেঠতুতো বোন । মেট্রিকের পর ও দীপুর সাথে শিলং যায় এবং লেডিকিনি কলেজে আইএসসিতে ভর্তি হয় । সেই সময় ও কেণ্টনমেণ্ট রোডে কলেজ হোস্টেলে থাকত । ইণ্টারমিডিয়েটের পর ও ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে । অতঃপর ও পশ্চিমবঙ্গে এসে নগর উন্নয়ন দপ্তরের অধীন পৌর সংস্থায় মেডিকেল অফিসার হিসাবে কাজ করে । অনেক বছর পর কোলকাতায় ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় বন্ধুবর মৃণালের আনুকূল্যে । সেই সময় ও বিধান নগরে আমার বাড়ীর কাছাকাছি বাস করত, কিন্তু আমি জানতাম না । কয়েক বছর পর ও বিধান নগর ছেড়ে অজয় নগরে ইস্টার্ণ বাইপাস সংলগ্ন "ক্যালকাটা গ্রীণ ফেইজ ১" নামক আবাসনে ফ্ল্যাট কিনে উঠে যায় । নতুন ফ্ল্যাটে যাওয়ার কিছুদিন পর ও স্বামী রবীন রায়কে হারায় । ওর স্বামী আর. কে. রায় জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার বরিষ্ঠ পদ থেকে অবসর নিয়েছিলেন । কর্ম্মদ্দেশ্যে তিনি অধিকাংশ সময় সফরে থাকতেন ।
গোপার পুত্র কন্যা বলতে একটি মেয়ে ও ঐ মেয়ের দিকের একটি দৌহিত্রী । স্বামীর মৃত্যুর পর গোপা মূলতঃ মেয়ে-জামাইর সাথে ওদের যোধপুর পার্কের বাড়ীতে থাকত । গোপাসহ ওরা সকলেই এখন পুণায় বসবাস করে । ডানদিকের প্যানেলে গোপার একক ও আমাদের সাথে গ্রুপে ছবি দেয়া আছে । গোপার স্বামীর কোন ছবি আমার কাছে নেই । ওঁর সাথে আমার অল্পদিনের পরিচয়, গোপার সাথে দেখা করতে গিয়ে বার কয়েক দেখা হয়েছে । নিপাট ভদ্রলোক, আলাপী ও আমুদে ।
আমার অন্যান্য সহপাঠিনীরা: লক্ষী ইউনিয়ন হাইস্কুলে আমাদের সহপাঠিনীদের মধ্যে বেলা রাণী পাল ও মায়া ঘোষ ছিল আরো দুজন সহপাঠিনী। ষষ্ট শ্রেণীর পর আমাদের শ্রেণীর অন্যান্য ছাত্রীদের মত ওরাও সপ্তম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট প্রাতঃকালীন বিভাগে স্থানান্তরিত হল । একবার আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আমাদের স্কুলের একই ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ কদাচিৎ হত যদিও আমরা পরষ্পরের ক্রিয়াকলাপের খবর রাখতাম। স্কুল ছাড়ার পর অধিকাংশ সহপাঠির সঙ্গে সংযোগ বিছিন্ন হয়ে যায় । সহপাঠিনীদের সম্পর্কে বলতে হয় স্কুলে পড়ার সময়েই ওদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না বললেই হয়, যেমন আমি বিস্তারিত ভাবে এই ওয়েবসাইটের "আমার শৈশব ও যৌবন......" পাতায় বলেছি । আমার ২০১৪ সালের আসাম ভ্রমণের প্রাক্কালে প্রথম মনে হয় যে ওরা কে, কেমন আকার নিয়েছে জানতে ওদের মধ্যে উপলভ্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে । সেই অনুযায়ী বেলা ও মায়ার (এদের ফোন নম্বর আমি যোগাড় করতে পেরেছিলাম) সঙ্গে দেখা করি । কি ভাবে ও কখন পরবর্তী অনুচ্ছেদে দেখা যাবে ।
২ । বেলা চক্রবর্তী (nee পাল): বেলা আমাদের সঙ্গে যে লক্ষী ইউনিয়ন হাইস্কুলে পড়েছিল তারই প্রধান শিক্ষিকারূপে অবসর গ্রহণ করে । অবসরপরবর্তী সময়ে বেলা স্বামী বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, একমাত্র পুত্র ও পুত্রবধু এবং তাদের যমজ সন্তান সবাইকে নিয়ে গৌহাটিতে বসবাস করত । ওর স্বামীও ওর সঙ্গে একই স্কুলে শিক্ষক ছিলেন ।
দেখা হওয়ার আগে আমি যখন ওকে ফোনে বল্লাম যে আমি গৌহাটি এসেছি ও ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই ও খুব ব্যকুল হয়ে পড়ল । আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে আমি যেখানে উঠেছি (হোটেল ইন্দো মহালক্ষ্মী ময়ামনার) তার ঠিকানা নিল এবং ওর বাড়ীর ঠিকানা ও বাড়ী পৌঁছুবার পথনির্দেশিকা আমাকে ফোনে দিল । পরদিন সকালবেলা ও নিজেই দেখা করতে আমার হোটেলে চলে এল । ও যখন আমার হোটেলে পৌঁচেছিল আমি তখন প্রাতঃরাশ করতে পাশের রেস্ট্যুরেণ্টে গিয়েছিলাম । ফিরে এসে আমি হোটেলের লাউন্জে একজন ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেলাম । আমি রিসেপ্শন কাউন্টারে ঘরের চাবি চাইতে কাউণ্টার ক্লার্ক লাউন্জে বসা ভদ্রমহিলাকে উদ্দেশ করে বলল তিনি যার খোঁজ করছিলেন আমি ই সেই ব্যক্তি । তখনই আমি বুঝলাম ঐ ভদ্রমিহলা বেলা । আমরা কেউ কাউকে চিনতে পারিনি । পেরিয়ে যাওয়া দশকগুলোতে আমাদের এতটাই পরিবর্তন হয়েছিল! আমাদের শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৬০ সালের মার্চ আর এটা ছিল ২০১৪ সালের মার্চ, পাঁচ দশকের অধিক সময়ের পার্থক্য । যাক, বেলা যে অটোরিক্সাতে বাড়ী থেকে এসেছিল সেই অটোরিক্সাতেই ও আমাকে ওর বাড়ীতে নিয়ে গেল; অটোরিক্সাটিকে ও এতক্ষণ আটকে রেখেছিল । ওর বাড়ীতে ওর পরিবারের সঙ্গে কতগুলো আনন্দময় মুহূর্ত কাটালাম এবং গুরুভার প্রাতঃরাশ সেরে ফিরে এলাম । বেলা ওর স্বামীকে সঙ্গে দিয়ে আমায় ফেরৎ পাঠিয়েছিল । ওর আন্তরিকতায় আমি অভিভূত হয়েছিলাম ।
ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা ২০১৮ সালের ২৪শে জানুয়ারী যখন ও আমার ও আশুর সঙ্গে দেখা করতে গুয়াহাটির প্রশান্তি ট্যুরিষ্ট লজে এসেছিল । আমরা তখন গৌহাটিতে ঐ লজে অবস্থান করছিলাম । সেবার নিকটবর্তী ফুডহাবে বেলা আমাদের প্রাতঃরাশে আপ্যায়িত করেছিল । কিছু সময় গল্পগুজবে আমরা ভাল কাটিয়েছিলাম । তখনও বুঝতে পারি নি ও একটা কঠিন রোগে ভুগছে ।
বড়ই দুঃখের, ২০২০ সালের ২৮ শে মার্চ বেলা চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । ও এডিনো কারসিনোভাতে ভুগছিল ও হায়দ্রাবাদে কিছুদিন চিকিৎসা করিয়েছিল, কিন্তু শেষ রক্ষা হল না । আমার বাড়ীতে আসার কথা দিয়েছিল, সেও আর হল না । বেলা কোমল হৃদয়া, নম্রভাষী ও সরল প্রকৃতির ছিল । কেন জানিনা আমার মনে হয় ও বোধহয় জীবনে সুখ পায় নি ।
আমরা একজন বন্ধুবৎসল কোমলাত্মা সহপাঠিনীকে হারালাম । এরপর গৌহাটি গেলে সেখানে আর এমন কেউ থাকবে না যে খবর পেলে দেখা করতে ব্যকুল হয়ে ছুটে আসবে । যেখানেই থাক, ভাল থেকো ।
৩ । মায়া ঘোষ: ২০১৪ সালের ২২শে মার্চ আমি যোরহাট প্রশান্তি লজ থেকে মায়াকে ফোন করি; জীবনে এই প্রথম ওর সাথে আমার কথা, স্কুলে ওর সাথে আমার কখনও কথা হয়নি । ও দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে ও আমাকে ওর বাড়ী যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায় । ওর ঠিকানা জেনে নিয়ে পরে আমি ওর সাথে দেখা করি । ও অবিবাহিতা ছিল এবং জেপি আর রোডে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে একাকিনী বাস করত । কথাপ্রসঙ্গে জানলাম ও ডাক বিভাগ থেকে অবসর নিয়েছে; বিব্রত হতে পারে ভেবে কি পদ জানতে চাইনি । ও বলল কিছুদিন ধরে তীব্র আর্থরাইটিসে ভুগছে । এরপর যতবার যোরহাট গেছি প্রায় প্রত্যেকবারই কিছুটা সময় মায়ার ওখানে গল্পগুজব করে কাটিয়েছি । ওর আর্থরাইটিসের ব্যাথাটা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে ।
দুঃসংবাদ পেলাম, মায়া সম্প্রতি (২০২২ সাল) পরলোকগত হয়েছে । শুধু খবরটাই পেয়েছি, কবে কিভাবে কিছুই জানি না ।
আমি আমাদের আরো কয়েকজন সহপাঠিনী পুতুল, অঞ্জলি ইত্যািদির খোঁজ করছিলাম । বেলা বা মায়া কেউই এদের খোঁজ দিতে পারে নি ।
পরে ২০১৯ সালের আসাম সফরে যোরহাটে থাকাকালীন আমি ও আশু অঞ্জলির দাদামশায়ের ডিপার্টমেণ্টাল স্টোর দাস এণ্ড কোং তে খোঁজ করে অঞ্জলির এক মামাতো ভায়ের কাছ থেকে জানতে পারি মোম্বাইতে অঞ্জলির বিয়ে হয়েছে । আমরা অঞ্জলির এক কালের স্কুলের সহপাঠি জেনেও ওই মামাতো ভাই অঞ্জলির সম্পর্কে কোন তথ্য বা যোগাযোগের বিবরণ দিতে অস্বীকার করলেন ।
৪ । অরুণা: ২০১৬-১৭ সালে আমি আমাদের আরেক সহপাঠিনীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলাম । সে যোরহাটের নির্মল সাইকেল মার্টের মালিকের কন্যা অরুণা সর । অরুণা সম্ভবতঃ আমাদের ক্লাশের মেয়েদের মধ্যে দীর্ঘতমা ছিল । আমি যখন যোগাযোগ করি, ও তখন নবী বোম্বাই এর বাসিন্দা । বেশ কিছুদিন পূর্বে ও স্বামীকে হারিয়েছে বলে জানাল । ওর স্বামী ভাবা এ্যাটোমিক রিসার্চ সেণ্টারের বিজ্ঞানী ছিলেন ও ক্যান্সারের উপর কাজ করছিলেন । ওর এক ছেলে ও দুই মেয়ে । ও ছেলে এবং বড় মেয়ের সাথে থাকে । ও জানাল, গ্রন্থি ব্যথা ও পিঠ ব্যথার দরুণ বেশী সময় বাড়ীতেই আবদ্ধ থাকে । বেশ কয়েকবার ওর সঙ্গে আমি ফোনে কথা বলেছি কিন্তু স্কুল ছাড়ার পর ওর সাথে আর দেখা হয়নি । ওর সম্পর্কে ফোনেই সব জেনেছি । গত কিছুদিন ধরে ফোনও তুলছে না । গোপাও বলেছে ফোন করে পাচ্ছে না । বুঝতে পারছি না কি অবস্থা । পাশে ওর অল্প বয়সের একটি ছবি দিলাম ।
শৈশবের আরো কয়েকজন বন্ধু সম্পর্কিত
তরুণ পাল: তরুণ স্কুলে আমাদের আরেক জন সহপাঠি ছিল । পরে শিলং এ সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজেও আমরা একসঙ্গে পড়েছি । শিলং-এ ও ওর কাকা এস এন পালের কাছে থাকত । এস এন পাল ছিলেন সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজের কেমিস্ট্রি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও একজন প্রথিতযশা অধ্যাপক । আই. এসসি পাশ করে তরুণ গোপার সাথে ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে । কলেজের পর ওর সাথে আমার আর দেখা হয়নি যদিও ও আমার কাছের একজন ছিল । পরে গোপার কাছ থেকে জেনেছি ও দিল্লীতে চলে গিয়েছিল. গোপার সঙ্গে ওর একবার দেখাও হয়েছিল কিন্তু পরে গোপা ওকে আর খুঁজে পায় নি । অনেক চেষ্টা করেও আমি ওর বর্তমান অবস্থান জানতে পারিনি । ওর কোন ছবিও আমার কাছে নেই ।
আমার স্কুলের অনেক সহপাঠির নাম এমনকি ওদের চেহারাও কখনো কখনো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে যদিও ওরা আমার ঘনিষ্ট ছিল না । এদের মধ্যে ছিল ভগবৎ পাল, যোগেশ ঘোষ, দ্বিগেন ভট্টাচার্য, বীরেন ঘোষ ইত্যাদি । এদের সকলেই বোধহয় এখন মৃত । ২০১৪ সালের প্রথম দিকে মালুর সঙ্গে ফোনে কথা প্রসঙ্গে জেনেছিলাম দ্বিগেন অনেকদিন আগেই মারা গেছে । বীরেনও এর মধ্যে কোন এক সময় মারা যায় বলে মায়া জানিয়েছিল । ২০১৪ সালের যোরহাট ভ্রমণের সময় মালু আমাকে জানিয়েছিল ভগবৎ খুব অসুস্থ । ওকে দেখতে যওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সময় করে উঠতে পারি নি । দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই ভগবৎ মারা যায় । ভগবতের মৃত্যু সংবাদ মালুই আমাকে জানিয়েছিল । ২০১৪ সালের ৫ই আগষ্ট সকালে ভাগবৎ পরলোক গমন করে ।
বিদ্যালয় পরবর্তী জীবনের বন্ধুবান্ধব
কলেজের বন্ধু
বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে আমরা যখন কলেজে প্রবেশ করি আমরা এক নতুন পরিবেশে নতুন আশা আকাঙ্খা নিয়ে, নতুন উদ্দীপনায় উজ্জীবিত হয়ে আসি । বিভিন্ন বিদ্যালয়, হয়তো বা বিভিন্ন স্থান থেকেও পাশ করা ছাত্ররা কলেজে এসে একসাথে মিলে । আমার আর দীপুর মত কিছু ছাত্রছাত্রী থাকতে পারে যারা একই বিদ্যালয়ে সহপাঠি ছিল, কিন্তু অধিকাংশই বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে আসে । বিভিন্ন স্থান থেকে একই বিদ্যালয়ের সহপাঠি স্থানান্তরে একই কলেজে একই শাখায় পড়তে আসছে এমন ছাত্রছাত্রী কদাচিৎ পাওয়া যায় । সে যাই হোক নতুন পরিবেশে নতুন সহপাঠিদের মধ্য থেকে সবাইকে নিজের পছন্দের বন্ধু খোঁজে নিতে হয় । যদিও আমি সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজে পাঠকালীন হোস্টেলে থেকেছি শব্দটির যথার্থ অর্থে নতুন বন্ধু বলতে হোস্টেলে আমার জনাদুয়েক বন্ধুই ছিল । আমার নতুন বন্ধুরা যদিও সংখ্য়ায় অল্প,তাদের অধিকাংশই ছিল হোস্টেলের বাইরের এমনকি কলেজেরও বাইরের । এখানে আমি তাদেরই কয়েকজনের কথা বলব ।
(ক) চিত্তেন্দ্র সোম (ডাক নাম চেতু): আইএসসিতে চেতু আমার নতুন ঘনিষ্ট বন্ধু হল । ও আমাদের হোস্টেলে দীপুর পাশের ঘরে থাকত । কলেজে ও আমাদের কোর গ্রুপে ছিল । ও একটু ভারী ধাঁচের ছিল, বাইরে বেরোলে সব সময় হাতে চাবির রিং ঘুরাতো । ইণ্টারমিডিয়েটের পর ও গৌহাটি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করে । আইএসসির পর ওর সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । কয়েক যুগ পর, সঠিক ভাবে বলতে হলে ২০১৭ সালে আশুর মারফৎ ওর সাথে আমার যোগাযোগ পুনর্স্থাপিত হয় । আশু ও চেতু (পরষ্পর অপরিচিত) বৃটেনের কোন এক স্থানে কোন এক উপলক্ষ্যে পরষ্পরের সান্নিধ্যে আসে । পরষ্পরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর ওদের মধ্যে কথাপ্রসঙ্গে আমার ও দীপুর নাম ওঠে । চেতু তখন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে ও আশুর কাছ থেকে আমাদের ফোন নম্বর যোগাড় করে । ঘটনাটি অব্যবহিত পর আশুই আমাকে ফোনে জানিয়েছিল ও চেতুর মোবাইল নম্বর পাঠিয়েছিল । এটা এক আনন্দময় বিস্ময় নিয়ে এল ! আমরা অনতিবিলম্বে পরষ্পরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলাম । চিত্ত ইউনাইটেড কিংডামে মাইগ্রেট করে বৃটিশ নাগরিক হিসাবে ওয়ারিংটনে চিকৎসা প্রদানে নিযুক্ত ছিল, বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত । কোলকাতার লেক গার্ডেনসে ওর একটি ফ্ল্যাটবাড়ী আছে যেখানে ও বছরে একবার এসে থাকে । আমি ও আমাদের আরেক কোলকাতায় থাকা বন্ধু সুব্রত পুরকায়স্থ ৯ই ফেব্রুয়ারী ২০১৮ তারিখে, যখন চিত্ত সস্ত্রীক কোলকাতায় ছিল, ওর লেকগার্ডেন্সের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম । সেই সন্ধ্যাটা পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে ও হাসি ঠাট্টায় আমাদের বেশ ভাল কেটেছিল । সেই সন্ধ্যার দুটি ছবি পাশের প্যানেলে দিলাম ।
চেতু বর্তমানে (সেপ্টেম্বর ২০২২) গুরুতর অসুস্থ হয়ে লণ্ডনের হাসপাতালে ভর্তি, বা-পাশ অবস ।
(খ) সুব্রত পুরকায়স্থ: সুব্রত সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজে আই এসসি কোর্সে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় । সুব্রত হোস্টেলে থাকত না, হোস্টেলের বাইরে ওর শিলং এ পোস্টেড পুলিশ অফিসার দাদার কাছে থাকত । সুব্রত ভাল বন্ধু ছিল । ইণ্টারমিডিয়েটের পর ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক হয় । ভেল সহ বিভিন্ন সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে অবশেষে কোলকাতায় স্থিত (settled) হয় । ১৯৬৬ সালে প্রথমবারের এম. এসসি পরীক্ষা বর্জন করে আমি যখন দিল্লী যাই সেই সময় সুব্রতর রেফারেন্সে ওর এক আত্মীয়ের কাছে ছিলাম । সুব্রতর সেই আত্মীয় কেন্দ্রীয় সরকারের একজন অফিসার-অন-স্পেশাল ডিউটি ছিলেন ও মেসে থাকতেন ।
ও যাদবপুর থেকে পাশ করে বেরোবার পর দীর্ঘদিন ওর সাথে যোগাযোগ ছিল না । ২০১১ সালে ওর সাথে আবার দেখা হয়, তাও ওরই প্রচেষ্টায় । ওর সঙ্গে বৃত্তিগতভাবে পরিচিত আমার এক সহকর্মীর কাছ থেকে আমার ফোন নং যোগাড় করে ও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল । বর্তমানে ও দক্ষিণ কোলকাতার কসবায় এক বহুতলের নিজস্ব ফ্ল্যাটে সস্ত্রীক বাস করে । ওর এক ছেলে ও এক মেয়ে । ও একবার আমার ফ্ল্যটে এসেছে, বিপরীতক্রমে আমিও একবার সস্ত্রীক ওর ফ্ল্যাট ঘুরে এসেছি । সময় সময় আমরা ফোনে খবরাখবর নি । ও এখনো অবসরপ্রাপ্ত হিসাবে বিভিন্ন সংস্থায় চাকুরী করে এবং বেশীর ভাগ সময় ঐ নিয়েই ব্যস্ত থাকে । চাকুরী ওর নেশা, চাকুরী না থাকলে ও ক্লেশ বোধ করে ।
(গ) রাজর্ষি ভট্টাচার্য: রাজর্ষি (ডাক নাম কিসু) আমার শিলংএ কলেজ জীবনের (I. Sc.) বন্ধু । ও সেণ্ট এড্মন্ডস কলেজের ছাত্র ছিল, খুব মিষ্টি কথা বলত; আমি ওকে খুব পছন্দ করতাম । ও শিলং এর স্থানীয় ছেলে ছিল, পলো গ্রাউণ্ডের পথে লোয়ার জেল রোডে ওদের বাড়ী ছিল । আমরা আই. এসসি পড়ার সময় প্রায়ই ওদের বাড়ী যেতাম । কলেজ ছাড়ার পর ওর সাথে আর দেখা হয়নি । আই এস সির পর আরো দুবছর আমি শিলং এ পড়েছি । মনে হয় সেই সময় একবার ওর খোঁজ করেছিলাম । খুব ক্ষীণভাবে মনে পড়ে তখন জেনেছিলাম ও গৌহাটির কটন কলেজে ফিজিক্স নিয়ে পড়ছে । আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ডামাডোলে ও পরবর্তী মানসিক অবস্থায় ও কখন মন থেকে বেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি । এরপর ২০০৭ সালে সস্ত্রীক শিলং ভ্রমণের সময় থেকে কিসু আমার মনে জাগ্রত ছিল । ২০০৭, ২০১৪ দুবারই শিলং গিয়েই ওঁর খোঁজ করেছি । কিন্তু কোন খবর পাই নি । ২০১৪ সালে ওদের বাড়ী খুঁজতে জেলরোড ধরে খানিকটা এগিয়েও বাড়ী খুঁজে পাইনি ।
অবশেষে ২০১৬ সালে বন্ধুবর আশুর সাথে যুগ্ম আসাম ভ্রমণে শিলং এ অবস্থানকালে চায়ের দোকানে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে আকস্মিক ভাবে কিসুর বাড়ীর সঠিক অবস্থান জানতে পারি । পরদিন সকালে বাড়ীটি খুঁজে বার করি । কিন্তু বাড়ীতে ওদের কেউ ছিল না । শেষে এক প্রতিবেশীর সাহায্যে ওদের এক আত্মীয়ের সাথে ফোনে যোগাযোগ করলে "কিসু দীর্ঘদিন গত হয়েছে" এই দুঃসংবাদটি পাই । ওর বোনেরা নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, ফোনের ভদ্রলোক এর বেশী কিছু বলতে পারলেন না । মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল । যে ভদ্রলোকের কাছ থেকে ওদের বাড়ীর সঠিক অবস্থান জেনেছিলাম তিনি অবশ্য তখনই কিসুর সংবাদটি দিয়েছিলেন, কিন্তু মন মানছিল না; সংবাদটির নিশ্চিতকরণের প্রয়োজন ছিল । ঐ ভদ্রলোক কিসুকে চিনতেন না বা ওর নাম জানতেন না, ওর শারীরিক গঠন ও বাসস্থানের অবস্থান থেকে ওর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে ও বোধহয় আর নেই ।
পাশের চিত্রটি সেই বাড়ীটির যেখানে আইএসসি পড়ার সময় বহু সন্ধ্যা পারিবারিক পরিবেশে কাটিয়েছি । এই বাড়ীর বাম অংশ কিসুদের দখলে ছিল । যতদূর মনে পড়ে কিসু, ওর মা ও দুইবোন যাদের মধ্যে একটির নাম ছিল লোপা এই বাড়ীতে বাস করতেন । কিসুর বাবার সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি ।
(ঘ) দেবাশীষ নন্দী: দেবাশীষ আমার কলেজ জীবনের আরেক বন্ধু । ওর বাবা আসাম সরকারের শিক্ষাদপ্তরের একজন অফিসার ছিলেন, ওরা আমাদের কলেজের কাছে নঙ্থুমাই নামে একটা পাড়ায় থাকত । ও সেণ্ট এডমণ্ডস কলেজে পড়ত, বস্তুতঃ ওর মাধ্যমেই কিসুর সাথে আমাদের পরিচয় । ওর দিদি কুমকুম আমাদের কলেজে আমাদের চেয়ে উপরের ক্লাশে পড়ত । আইএসসির পর আমার যাদবপুরে ম্যাকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে স্বল্পকালীন পাঠের সময় আমি ও দেবাশীষ একত্রে ক্লাশ করেছি । ঐ সময়ের পর আমি যখন মেখলিগঞ্জে কর্ম্মরত তখন দেবাশীষের সাথে একবার দেখা হয়েছিল । ও তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহকারী ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে উত্তরবঙ্গের নাগরাকাটা নামক স্থানে পোস্টেড ছিল । আমি নাগরাকাটায় ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম ও পুরনো দিনের গল্প করে সারাদিন কাটিয়ে এসেছিলাম । অনেক দিন পর দীপুর কাছ থেকে জেনেছিলাম ও আমেরিকা চলে গেছে, সপরিবারে নিউ জার্সিতে থাকে । দীপুর সাথে ওর দেখা হয়েছিল । দীপু ওর কণ্টাক্ট পার্টিকুলার্স আমাকে দিতে পারে নি । ওর সাথে যোগাযোগ করার আমার অদম্য ইচ্ছা রয়েছে, কিন্তু উপায় নেই। ফেসবুক, ট্যুইটার খোঁজে দেখেছি । কিন্তু ওর নামে কোন অ্যাকাউণ্ট খুঁজে পাই নি ।
(ঙ) সুরজিৎ চৌধুরী: সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজে স্নাতক স্তরে পড়ার সময় সুরজিতের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয় । ও হোস্টেলে থাকত না, যতদূর মনে পড়ে লাবানে ওর কোন আত্মীয়ের কাছে থাকত । ও খুব আন্তরিক ছিল এবং ওর সাহচর্য আনন্দদায়ক ছিল । কলেজে আমরা পরষ্পরের অনেকটা কাছাকাছি এসেছিলাম । ওর উপাধি উল্লেখে আমার ভুলও হয়ে থাকতে পারে । এটা অর্দ্ধশতাব্দী পূর্বের বিষয় এবং কলেজ ছাড়ার পর আমাদের আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি । ও কোথায় আছে তাও জানি না । তবে কখনো কখনো ওর কথা মনে পড়ে, ওর চেহারাও সুস্পষ্ট ভাবে চোখে ভাসে । ওর মাথায় চুল কম ছিল, ও সব সময়ই টুপি পরে থাকত । একটু ঝুঁকে হাটত ।
(চ) অঞ্জন ভট্টাচার্য: সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজে স্নাতকস্তরে পঠনকালে অঞ্জন আমার সহআবাসিক ছিল । সম্ভবতঃ ও উত্তর আসামের (খুব সম্ভব তিনসুকিয়া) দিক থেকে এসেছিল । সময়ের সাথে আমরা কাছাকাছি এসেছিলাম । ঐ একই সময়ে ওর এক বোন কৃষ্ণা শিলং এর অন্য কোন এক কলেজে পড়ত । শিলং ছাড়ার পর অঞ্জনের সাথে আমার আর যোগাযোগ হয়নি । মেখলিগঞ্জে কর্ম্মরত থাকার সময় খবর পেয়েছিলাম কৃষ্ণা জলপাইগুড়ির পিডি কলেজে শিক্ষকতা করছে । অঞ্জনের অবস্থান জানতে কৃষ্ণার সাথে দেখা করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সময় ও সুযোগের অভাবে আর হয়ে উঠেনি । ডান দিকে অঞ্জনের কলেজকালের ছবি ।
সার্ভিসের বন্ধুবান্ধব
জীবনের পথে আরো এগিয়ে মানুষ যখন কর্ম্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে তখন এক সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশ যেখানে মানুষ বস্তুতঃ আত্মকেন্দ্রিক ও নিজেকে প্রমোট করতে সমধিক ব্যস্ত । এই ক্ষেত্রে সহকর্ম্মীদের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন কদাচিৎ গড়ে উঠে । তবে আমি যেহেতু সংগঠিত সার্ভিসের অঙ্গীভূত ছিলাম এবং স্থান থেকে স্থানান্তরে বদলী হওয়াটা আমার কর্ম্মের অঙ্গ ছিল এইরূপ সংকীর্ণতা থেকে আমি মুক্ত ছিলাম এবং আমার পছন্দের ব্যক্তিকে বন্ধু বলে বরণ করে নিতে আমার কোন বাধা ছিল না । অতএব এই পর্যায়েও একই বয়সকোঠার সহকর্মীদের কারো কারো সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল । তাদের কথাই এখানে বলব ।
(ক) বলাই চন্দ্র চক্রবর্তী: বলাইর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় মেখলিগঞ্জে, ১ঌ৬৮ সালের মধ্য সেপ্টেম্বরে । আমি চাকুরীসূত্রে বদলী হয়ে মেখলিগঞ্জে এসেছি । বলাই তখন ওখানে কর্ম্মরত এবং আমার সঙ্গে একই সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত যদিও আমার আগের ব্যাচের । ও সদ্য বিয়ে করেছিল এবং স্ত্রীকে নিয়েই ওখানে ছিল । শীঘ্রই আমরা পরষ্পরের কাছাকাছি হয়ে গেলাম । বলাই ও ওর স্ত্রী ছবি আমার ভাল বন্ধু হয়ে গেল ।
বলাইর সঙ্গের সেই বন্ধুত্ব আজও অটুট আছে । আমরা এখন নিজ নিজ ফ্ল্যাটে একই কোঅপারেটিভ বাড়ীতে বাস করি । বস্তুতঃ আমার এই কোঅপারেটিভ বাড়ীতে ফ্ল্যাট প্রাপ্তির ব্যাপারে বলাই-ই প্রধান সহায়ক ছিল । দুর্ভাগ্য, ও বেশ কিছুদিন পূর্বে ওর স্ত্রীকে হারিয়েছে । বর্তমানে ওর একমাত্র অবিবাহিত ছেলেকে নিয়ে এখানে বাস করে । ও আমাকে অতীতে নানা ভাবে সাহয্য করেছে । আমার প্রথম সন্তানের জন্মের পূর্বে স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে যখন কোলকাতা আসতাম, তখন ওর সরকারী ফ্ল্যাটেই থাকতাম (আমি তখন কালনায় পোস্টেড, কোলকাতায় আমার কোন আত্মীয়স্বজন ছিল না) । ১৯৮০-৮১ সালে সেন্সাসে কর্মমরত থাকাকালীন যখন কোলকাতা বদলী হয়ে আসি তখন ও ই আমার জন্য ভাড়া বাড়ী ঠিক করে দিয়েছিল ।
(খ) অশোক চ্যাটার্জি: অশোকের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৬ সালে যখন আমি মাসকয়েকের জন্য মেদিনীপুরে পোস্টেড ছিলাম । অশোক তখন ভারত সরকারের সংস্থা নেহরু যুব কেন্দ্রের ইয়ুথ ওয়েলফেয়ার অফিসার হিসাবে মেদিনীপুরে কর্ম্মরত ছিল । অশোক একজন উদারহৃদয় ব্যক্তি, প্রয়োজনে নিজের সীমার বাইরে গিয়েও অপরকে সাহায্য করতে দ্বিধা করে না । মেদিনীপুরে পোস্টড হয়ে আমি যখন থাকার জায়গা পাচ্ছিলাম না, ও তখন নিজের সরকারী ফ্ল্যাট সপরিবারে থাকার জন্য আমাকে ছেড়ে দেয় । অথচ ওর সঙ্গে আমি তখন সদ্য পরিচিত হয়েছি । পরে এই ফ্ল্যাটের ভাড়াও আমাকে দিতে দেয় নি যদিও ওর মাইনে থেকে ভাড়া যথারীতি সরকার কেটে নিয়েছে । আমার মত অনেক সহকর্ম্মীকেই ওর ফ্ল্যাটে ও থাকতে দিয়েছে । ফ্ল্যাটটি নামেই ওর ছিল, বদলী হয়ে আসা সহকর্মীরাই এটা ব্যবহার করত, ও অন্যত্র থাকত । পরবর্তীকালে আমি যখন কোলকাতায় তখন আমার থাকার জন্য রতনবাবু রোডে ওর পৈতৃক বাড়ীর একাংশ আলাদা করে আমাদের থাকতে দিয়েছিল । বাড়ীটি ছিল ওর মা জ্যোতির্ময়ী দেবীর নামে, ভাড়াটা আমরা ওর মাকেই দিতাম । আমরা আলমবাজারের যে বাড়ীতে ভাড়া ছিলাম সেখান থেকে আমার মেয়ের স্কুল যাতায়াতের অসুবিধা হচ্ছে জেনে অশোক আমাদের জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা করেছিল । অশোকের এই পারিবারিক বাড়ীতে আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বাস করেছিলাম ।
চাকুরীতে থাকাকালীন ও বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল, অবসরের পরও অনেকেই ওর সঙ্গ ছাড়েনি বরঞ্চ অবসরপ্রাপ্তদের অ্যাসোসিয়েশনের মত নতুন দুএকটা যুক্ত হয়েছে । অশোক স্বভাবতঃই সকলের খুব প্রিয়, ওর চেনাজানার ব্যপ্তি বহুদূর । ওর এক পুত্র ও এক কন্যা । ওর পুত্র উকিল, সুপ্রিম কোর্টে ওকালতি করছে । কন্যা চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ, কোলকাতার এক নামকরা চক্ষু হাসপাতালে কর্ম্মরতা । আমরা এখন একই কোঅপারেটিভ বিল্ডিং এ বসবাস করি । অশোক, অশোকের স্ত্রী কুমকুম ও পুত্র কুনালের একটি পুরনো ফটো পাশের প্যানেলে প্রদর্শিত হল ।
(গ) বিজয়েন্দ্র চক্রবর্তী: বিজয় (ডাকনাম) ১৯৬৭ সালের পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিসে আমার ব্যাচমেট । কিন্তু ওর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৭৯ সালে আমি যখন সেন্সাস ডাইরেক্টরেটে ডেপুটি ডাইরেক্টর পদে যোগ দিতে যাই । বিজয়ও তখন অন্য অঞ্চলের ডেপুটি ডাইরেক্টর পদে যোগ দিয়েছিল । পরে সেন্সাসের ডাটা ট্যাবুলেশন অফিস সল্টলেক ১ এ আমি এবং সল্টলেক ২ এর দায়িত্বে বিজয় থাকার সময় আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয় । ও বর্ধমান থেকে ট্রেণে অফিসে আসত, আমি বরানগর স্টেশন থেকে ওর সহযাত্রী হতাম । ধীরে ধীরে আমাদের বন্ধুত্ব পারিবারিক স্তরে প্রসারিত হয় । আমরা সপরিবারে একে অপরের বাড়িতে যাতায়াত করতাম । আমাদের দুই পরিবার একত্রে পুরীও সফর করে আসে । দুর্ভাগ্যবশতঃ একটি ক্ষুদ্র ঘটনাকে (সার্ভিস সংক্রান্ত নয়) কেন্দ্র করে এই সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় । বিজয় এর পর আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় অনাগ্রহী হয়ে পড়ে । এরপরও আমি সপরিবারে একবার ওর বাড়ী গিয়েছিলাম কিন্তু মনে হয়েছিল ও তা পছন্দ করে নি । এরপর ওর সঙ্গে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম ও স্ত্রীকে হারিয়েছে, দুর্ভাগ্যজনক অকালমৃত্যু । শুনে আমি ও আমার স্ত্রী দুজনেই খুব কষ্ট পেয়েছিলাম । ওর স্ত্রী খুব হাসিখুশী ও আমোদে প্রকৃতির ছিলেন । বিজয় এখন কোথায় আছে জানি না । ওর একমাত্র পুত্র আমার কনিষ্ঠা কন্যার চেয়ে সামান্য বড় ছিল । আশা করি ও জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে । আশা করি বিজয়ও অবসরের পর ভাল বাসস্থান সংগ্রহ করতে পেরেছে ও ভাল আছে । আমার জীবনে এটী একমাত্র ঘটনা যেখানে একটি সামান্য বিষয় নিয়ে আমার বন্ধু বিচ্ছেদ ঘটেছে । জানিনা দোষটা আমার কি না । বিজয় অনুভূতিপ্রবণ ছিল, হয়ত আমার আচরণে আঘাত পেয়েছিল । তবে বিজয়কে আমি কখনও ভুলব না । পাশে ১৯৮৪ সালে আমাদের সঙ্গে একত্রে পুরীভ্রমণের সময়ের বিজয় ও ওর স্ত্রীর একটি ছবি ।
(ঘ) বিজন সাহা: যদিও সিভিল সার্ভিসে তিন বছরের কনিষ্ঠ, বয়সে বিজন প্রায় আমার সমসাময়িক (জন্ম: অক্টোবর ১৪, ১৯৪৪)। ওর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন ও আমার স্থলাভিষিক্ত হতে বদলী হয়ে মেখলিগঞ্জে আসে । আমার মেখলীগঞ্জ থেকে বদলীর নির্দেশানুযায়ী আমাকে পদ থেকে অব্যাহতি দিতে পর পর তিনজনের নিয়োগ হয়েছিল যার মধ্যে বিজন ছিল ৩য় । বাকী দুজন নিয়োগের আদেশ প্রত্যাহার করিয়ে নিতে পেরেছিল । পরে মেদিনীপুর ও কোলকাতায় বিজনের সাথে আমাদের সম্পর্ক দৃঢ় হয় ও পারিবারিক স্তর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে । আমার মত ওর ও দুই মেয়ে এবং দুই পরিবারের মেয়েরা নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বে আবদ্ধ ছিল । বিজন পরোপকারী ও মিশুকে ছিল । লোকের ভাল করার চেষ্টা করত । একবার আমি এক প্রশিক্ষণে রাজ্যের বাইরে ছিলাম । আমার স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে একাই ঝাড়গ্রামে ছিল । সেই অবস্থায় ও হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে । বিজন সেই সময় সেট্লমেণ্টের চার্জ অফিসার হিসাবে ঝাড়গ্রামে পরিদর্শনে এসেছিল । আমার স্ত্রীকে অসুস্থ দেখে ও ঝাড়গ্রামে থেকে যায় এবং আমার স্ত্রী সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওর দেখাশোনা করে । পরে আমি ফিরে এলে ওদের একা রেখে যাওয়ার জন্য আমায় বকাঝকা করে । দুর্ভাগ্য, ও ব্লাডক্যান্সারে আক্রান্ত হয় ও দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর ২০১৭ সালের ২৪শে আগস্ট গল্ফগ্রীণে বিজন ওর নিজস্ব ফ্ল্যাটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে । আমার কাছে ওর মৃত্যু এক গুরুতর আঘাত, আমি আরেকজন ভাল বন্ধু হারালাম । ও ছেড়ে গেছে ওর স্ত্রী সুপ্রিয়া, দুই মেয়ে টুম্পা ও সম্পা, দুই জামাই, দুই নাতি ও অনেক বন্ধুবান্ধব । যেখানেই থাক বিজন, ভাল থেকো ।
দেশ ও দেশের বাইরে অধিষ্ঠিত কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব: একটি গেট টুগেদার ।
এক দুর্লভ উপলক্ষে আমার তিন বিদেশে আভিবাসিত বন্ধু আশু, রাণা ও চেতু একসঙ্গে কোলকাতায় একত্রিত হয়েছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসে । এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০১৯ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী আমি ঐ বন্ধুদের সস্ত্রীক নৈশভোজ সহ একটি ক্ষুদ্রাকার গেট-টুগেদারের আয়োজন করেছিলাম আমার সল্টলেকের ফ্ল্যাটে । সেখানে আমি আমার কোলকাতায় অবস্থানকারী বন্ধু মৃণাল ও সুব্রতকে সস্ত্রীক আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম । সুব্রত অন্যত্র ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেনি, স্ত্রী অসুস্থ থাকায় মৃণাল একা এসেছিল । আশুর স্ত্রী ভারতে আসে নি, রাণা কিছুদিন আগে ওর স্ত্রীকে হারিয়েছে, চেতু সস্ত্রীক এসেছিল । অড্ডা পুরো জমে উঠেছিল । পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে আর গল্পগুজবের মধ্য দিয়ে সময় কি করে কেটে গেল আমরা বুঝতেই পারলাম না । খাওয়া দাওয়া শেষ করে সকলকে বিদায় জানাতে রাত এগারটা ।
সেই মজলিশী সন্ধ্যার দুটি ছবি এখানে দিলাম ।