নিজস্ব সমবায়ভিত্তিক ফ্ল্যাট, সল্টলেক ।
ভূমিকা
আমি আগেই বলেছি ছিন্নমূল হয়ে শ্রীহট্টে আমাদের পৈতৃক বাসস্থান ছেড়ে আসার পর বাবা এদেশে কোন বাড়ী বা বাসস্থান সংগ্রহ করতে পারেন নি । পার্টিশন পরবর্তী ভারতে কোথাও আমাদের ঘরবাড়ী ছিল না । পশ্চিমবঙ্গের জেলায় কর্ম্মরত থাকার সময় আমিও পরিবারের জন্য কোন বসতজমি বা বাসস্থান জোগাড় করতে পারিনি । বস্তুতঃ চাকুরীসূত্রে কোলকাতা আসার পূর্বে বাড়ী করার ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ ছিল না যদিও আমার স্ত্রী অনবরত এই নিয়ে আমায় খোঁচাত । আমার চাকুরীজীবনের প্রথমার্ধ জেলায় কাটিয়েছি । এই সকল জেলার কোথাও নিজেদের বাড়ী করা যথার্থ বলে আমার মনে হয়নি ।
সল্টলেক প্লট: আবেদন ১৯৮৪, অনেক বছর পর প্রত্যাখ্যাত
আশির দশকের প্রথমে আমি যখন কোলকাতায় পোস্টেড তখন জানতে পারি রাজ্য সরকার একটি স্কীমে সল্টলেকে বাস্তুজমির প্লট বিলি করছেন । ১৯৮৪ সালের ২রা জানুয়ারী আমি এই প্লট বিলির নিয়ন্ত্রক নগর উন্নয়ন দপ্তরের নিকট একটি প্লটের দরখাস্ত করি । এক দশকেরও পর আমি ঐ দপ্তর থেকে ছাপানো পোস্টকার্ডে উত্তর পাই যে সল্টলেকে কোন প্লট উপলভ্য নয় । আমি জানতাম আমাকে যখন ঐ চিঠি পাঠানো হয় তখনও ঐ স্থানে অনেক প্লট রাজনীতিক ও নির্বাচিত আমলা সহ বিভিন্ন শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে বিলি করা হচ্ছিল । অবশ্য সেই জন্য প্রভাবশালীদের পুল ও পুশের প্রয়োজন হত যা আমার একেবারেই ছিল না । যে সহকারী সচিব আমার প্লট প্রত্যাখানের চিঠিতে সই করেছিলেন এবং যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ব্যাচমেট ছিলেন ঐ সময়ে প্লট পেতে তারও কোন অসুবিধা হয়নি । আমার অনেক সহকর্ম্মী যাদের যথাযথ স্থানে সংযোগ ছিল বা যারা প্রভাবশালী লোকেদের দিয়ে স্বপক্ষে তদ্বির করাতে পেরেছিলেন তাদের আমার দরখাস্তের সময় বা পরবর্তী বছরগুলিতে সল্টলেকে প্লট পেতে কোন অসুবিধাই হয়নি ।
সল্টলেকে প্লট বণ্টনের ক্ষমতা হস্তান্তর: নগর উন্নয়ন দপ্তর থেকে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে
১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে ক্ষমতাসীন দল তাদের অনুচরদের এবং আমলা ও অন্যান্য যারা ওদের ধামাধরা ছিল অথবা কোন না কোন ভাবে ওদের সঙ্গে বিশেষ ভাবে জড়িত ছিল তাদেরকে সল্টলেকের বাস্তুজমির প্লট আনুগত্যের পুরষ্কার হিসাবে বরাদ্দ করত । এই সকল প্লট বিলির পদ্ধতিতে কোন স্বচ্ছতা ছিল না । পুরো বণ্টন ব্যবস্থাই রাজনৈতিক অথবা ক্ষমতাশীলদের সঙ্গে সংযোগভিত্তিক বিবেচনায় চালিত হত । আমার রাজনৈতিক বা অন্য কোনরূপ সংযোগ ছিল না; নিজের স্বতন্ত্রতা বিসর্জ্জন দিয়ে এমন কোন সংযোগ গড়ে তুলতে আমি আগ্রহীও ছিলাম না । কেননা , আজকের দিনে এটা সর্বজনবিদিত যে কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়, এক্ষেত্রে সম্ভবতঃ দেয় ছিল আনুগত্য যা স্বতন্ত্রতা হারাবার সামিল । সরকারের নিজস্ব বিবেচনায় বণ্টনীয় সল্টলেকের নির্ধারিত অংশের প্লট বিলির ক্ষেত্রে অস্বচ্ছ্বতার অভিযোগে কোলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয় । জনস্বার্থ মামলার বিচারে প্লটের সর্বশেষ বণ্টনতালিকা বাতিল হয়ে যায় । কোর্ট প্লট বণ্টনের ক্ষমতা নগর উন্নয়ন দপ্তরের হাত থেকে নিয়ে নেন ও নির্দেশ দেন যে অতঃপর কেবল মুখ্যমন্ত্রী সল্টলেকের প্লট বণ্টন করতে পারবেন । এতে কিন্তু সমস্যার সমাধান কিছু হল না, কেবল ক্ষমতার কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক অফিসে স্থানান্তরিত হল ।
এর অনেক বছর পর আমি তখন রাজভবনে কর্ম্মরত । আমার অনুরোধে রাজ্যপাল প্রোঃ নুরুল হাসান সল্ট লেকে আমার অনুকূলে একটি প্লট বরাদ্দের বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন । পরে রাজ্যপাল আমাকে জানান যে মুখ্যমন্ত্রী ওঁকে বলেছেন সমবায় ভিত্তিতে ফ্ল্যাট করার প্লট পাওয়া যেতে পারে । রাজ্যপাল আমাকে মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে দরখাস্ত করতে বলেন এবং নিজের হাতে একটি নোট লিখে দরখাস্তের সাথে জমা দিতে বলেন । সেই অনুযায়ী আমি একটি সম্ভাব্য সমবায় সমিতির প্রমোটার হিসাবে একটি নিয়মমাফিক দরখাস্ত প্রস্তুত করে রাজ্যপালের নোটসহ মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক অফিসের সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের (মুখ্যমন্ত্রীর আপ্ত সহায়ক) কাছে ব্যক্তিগতভাবে জমা দি ই । পরবর্তীকালে একাধিকবার মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক অফিসের সেই সংশ্লিষ্ট আধিকারিককে এ বিষয়ে তাগাদা দি ই । কিন্তু তাতে কোন লাভ হয় নি । শেষ পর্যন্ত আমাকে হাল ছেড়ে দিতে হয় । ঐ সময় আমি জেনেছিলাম সমবায় প্লটের ক্ষেত্রেও দরখাস্তে উল্লিখিত সম্ভাব্য সদস্যদের তালিকায় রদবদল ঘটিয়ে রাজনৈতিক ভাবে পছন্দসই কারো কারো নাম ঢুকিয়ে দেয়া হয় । মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক অফিসে যিনি প্লট বণ্টন ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিলেন তিনি হয়ত যথার্থই সন্দেহ করেছিলেন আমার দরখাস্তে উল্লিখিত সম্ভাব্য সদস্য তালিকায় রদবদল ঘটিয়ে রাজনৈতিক পছন্দের কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে আমি হয়ত রাজী হব না । এই জন্যই সম্ভবতঃ আমার দরখাস্ত (রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রীর পারষ্পরিক কথাবার্তার পর) রাজ্যপালের মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা নোট থাকা সত্বেও মঞ্জুর হয় নি ।
রাজনৈতিক বিবেচনায় বৈষম্যের একটি নিদর্শন
প্রসঙ্গক্রমে, একটি পূর্ববর্তী ঘটনায় রাজভবনে আমার পূর্বসূরী একই রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী চ্যানেল দিয়ে সল্টলেকে ব্যক্তিগত মালিকানার একটি প্লট সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন । কোলকাতার অন্য একটি এলাকায় নিজস্ব একটি ফ্ল্যাট থাকা সত্বেও সল্টলেকে এই প্লট পেতে তার কোন অসুবিধা হয়নি যদিও সল্টলেকে জমি পাওয়ার যোগ্যতা নির্ধারক শর্তে বলা আছে প্রার্থীর কোলকাতা মহানগরী এলাকায় কোন ফ্ল্যাট বা জমি থাকা চলবে না । অথচ কোলকাতা বা ভারতের অন্য কোথাও আমার নিজের বা পৈতৃক কোন জমি বা ফ্ল্যাট না থাকা সত্বেও আমার দরখাস্ত মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক অফিসে নীরব মৃত্যু বরণ করল! আমার ঘটনার বিপরীতমুখী আমার সহকর্মীর এই ঘটনা যে কাউকে বোঝাবার পক্ষে যথেষ্ট কোন বিবেচনায় সেই সময় এই বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হত ।
লটারীদ্বারা বেহালার পারুইতে বাস্তুজমি বরাদ্দ
যাহোক, এর অপর দিকে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবাসন দপ্তরের বিজ্ঞাপনের জবাবে আমি কোলকাতার বেহালা থানার পারুই মৌজাতে বাস্তুজমির জন্য দরখাস্ত করি । ১৯৮৫ সালের ২৬শে এপ্রিল আমি দরখাস্ত করি । দরখাস্তকারীদের মধ্যে লটারীর মাধ্যমে ঐ বছরেরই ৩০শে অক্টোবর ঐ মৌজায় আমাকে একটা প্লট বরাদ্দ করা হয় । সরকারী ঋণের সাহায্যে আমি ঐ প্লটের মূল্য বাবদ ২৪৩৬৭ টাকা জমা দি । ১৯৯৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী আমি ঐ জমির দখল নি ই । এরপর আমি কলিকাতা কর্পোরেশনে জমির মিউটেশনের জন্য দরখাস্ত করি ।
সল্টলেকে বন্ধুদের তৈরী সমবায় আবাসন সমিতিতে যোগদান
ইতিমধ্যে বন্ধু বলাই, অশোক ও অন্যান্যরা প্রাঙ্গন কোঅপারেটিব হাউসিং সোসাইটি নামে একটি সমবায় সমিতি গঠন করে বসতবাড়ী তৈরী করতে সল্টলেকে একখণ্ড জমি সংগ্রহ করতে পেরেছিল । এই জমি পেতে বলাইকে অবশ্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল যদিও ও তখন সল্টলেকে জমি বণ্টনকারী দপ্তরের উপসচিব পদে অধিষ্ঠিত ছিল । এই সমিতির একজন সদস্য, আমাদের এক সহকর্ম্মী, পরে সদস্য থাকতে অনীহা প্রকাশ করে । অশোক ও বলাই তখন আমাকে ঐ সদস্যপদ অফার করে । আমি প্রথমে অনিচছুক ছিলাম । প্রথমতঃ, আমি পারুই জমির জন্য ইতিমধ্যেই সরকারী ঋণ নিয়েছিলাম, দ্বিতীয়বার সল্টলেকের জন্য ঋণ পাওয়ার কোন উপায় ছিল না আর ঋণ ছাড়া বাড়ী তৈরী আমার দ্বারা সম্ভব ছিল না । তাছাড়া, ফ্ল্যাট অপেক্ষা বাড়ী আমার বেশী পছন্দ ছিল । কিন্তু বলাই ও আমাদের এক বরিষ্ঠ সহকর্ম্মী (যার ছেলে প্রাঙ্গন কোঅপারেটিবের সদস্য ছিল) আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে সল্টলেকের জমির ক্ষেত্রে আমার ঋণ পাওয়ার সমস্যা যাতে না হয় তা তারা দেখবেন । বলাই ও আমার স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে আমি শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম । ১৯৯২ সালের ১৭ই জানুয়ারী আমি প্রাঙ্গন কোঅপারেটিব হাউসিং সোসাইটির সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হলাম । আমাদের বরিষ্ঠ সহকর্মী অশোকদা (অশোক ভট্টাচার্য, বর্তমানে প্রয়াত, ওঁর আত্মার সদ্গতি হোক) ও বন্ধু বলাই অর্থ দপ্তরকে সর্তসাপেক্ষে সল্টলেকের ফ্ল্যাটের জন্য আমাকে দ্বিতীয় ঋণ মঞ্জুর করতে রাজী করান ও আমার সমস্যার সমাধান করেন ।
সমবায় আবাসন সমিতিতে ফ্ল্যাট নির্মাণের জন্য সরকারী ঋণ মঞ্জুর
যেমন আগে বলেছি, আমার সহকর্ম্মীদের উদ্যোগে ও অনুরোধে অর্থদপ্তর সল্টলেকে ফ্ল্যাট তৈরীর জন্য শর্তসাপেক্ষে আমাকে দ্বিতীয় ঋণ দিতে রাজী হয় । অর্থ দপ্তরের শর্ত অনুযায়ী আমি প্রথমে পারুইর জমি আবাসন দপ্তরে ফেরৎ দি । এটি ঘটে ৩০শে আগষ্ট ১৯৯৩ । অর্থ দপ্তরের এই শর্ত সরকারের সল্টলেকে জমি বণ্টনের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যে নীতি ছিল কোলকাতা মহানগরী এলাকায় বাস্তুজমি বা ফ্ল্যাট থাকলে সল্টলেকে জমি পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না । কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেক ক্ষেত্রেই এই নীতি মানা হয়নি । যাক সে কথা, পারুই এর জমি ফেরৎ দেয়ার পর আবাসন দপ্তরের প্রদত্ত জমি ফেরতের শংসাপত্রসহ সল্টলেকে ফ্ল্যাট তৈরীর ঋণের জন্য আমি নতুন করে দরখাস্ত করি । এরপর আমার পারুই জমির জন্য আগে নেয়া ঋণের পরিমাণ বাদ দিয়ে বাকী পরিমাণ প্রাপ্য ঋণ অনুমোদন করা হয় । পারুই জমির মূল্যবাবদ দেয়া ২৪৩৬৭ টাকা পরে আমি আবাসন দপ্তর থেকে ফেরৎ পাই ।
ব্যক্তিগত ঋণ ও ব্যয় সঙ্কোচন
সরকারী ঋণ একক ভাবে আমার ফ্ল্যাট নির্মাণ সম্পূর্ণ করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না । আমার এক সহকর্মী তথা বন্ধু অলোক বসু আমার সাহায্যে এগিয়ে এল । অলোক যখন আমার এই অসুবিধার কথা জানতে পারল ও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমার হাতে দশ হাজার টাকার একটি চেক ধরিয়ে দিল যা আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করলাম । ১৯৯০ দশকের দশ হাজার টাকার মূল্য বর্তমানের ঐ পরিমাণ টাকার বেশ কয়েকগুণ বেশী ছিল । আমি আরেকটি দুই হাজার টাকার ঋণ আমার দাদার কাছ থেকে পেয়েছিলাম । এরপরও টাকা কম পড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের সব জানালা কাঠের তৈরী করা সম্ভব হয়নি । আমি এই খাতে ব্য়য় সঙ্কোচ করলাম সামনের দিকের দুটো ঘরের বাইরের দিকের জানালাগুলো বাদ দিয়ে বাকী সব জানালা স্টীলের তৈরী করিয়ে । নান্দনিক কারণে সামনের ঘর দুটোর জানালা অন্য ফ্ল্যাটের সমদর্শ কাঠের করার বাধ্যবাধকতা ছিল ।
সরকারী ঋণ ও দুটো ব্যক্তিগত ঋণই আমি যথাসময়ে পরিশোধ করে দিয়েছি ।
গৃহনির্মান সমাপ্ত: ফ্ল্যাটের দখল ।
১৯৯৫ সালে সল্টলেকের বীবী ২৯ নং প্লটে প্রাঙ্গন কোঅপারেটিভ হাউসিং সোসাইটির আবাসিক অট্টালিকা নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় ও লটারির মাধ্যমে ফ্ল্যাটের মালিকানা বণ্টন করা হয় । বর্তমানে এই অট্টালিকার একটি ফ্ল্যাটের আমি অধিকারী । ১৯৯৭ সালের ১লা জুন থেকে আমরা এখানে বাস করছি । আমি এখন মনে করি পারুই জমির তুলনায় এটি অনেক ভাল পছন্দ ছিল । এই সোসাইটির সদস্যপদ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করার জন্য বলাই ও আমার স্ত্রী আমার ধন্যবাদার্হ । বন্ধু অলোক যার সময়োপযোগী সাহায্য ছাড়া এই ফ্ল্যাট যথাসময়ে সম্পূর্ণ করা সম্ভব হত না তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ ।
এই ভাবে এক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে আমি কোলকাতায় মাথাগুঁজার ঠাঁই জোগাড় করেছি ।